#মহুয়ার_রাতদিন.৭ ✍️ #রেহানা_পুতুল
“কোঁচার ছুরি দিয়ে এইভাবেই প্যাট কাটা যায়। বুঝলি মা।”
“নাহ মা। বুঝতে চাই না। বোঝার কথাও না।”
চোয়াল শক্ত করে বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলো মহুয়া।
হালিমা উঠে গিয়ে নিজের অতি সস্তা বাটন সেটটি হাতে নিলো। ক্ষোভে বেলুনের মতো ফুলেফেঁপে উঠছে। ফোন দিলো তার আপন ননদকে। তার ননদ মোবাইল রিসিভ করে বড় ভাবিকে সালাম দিলো।
হালিমা সালাম নিয়েই উত্তেজনায় গজগজ করে বললো,
“তুই এইটা কী কইরলি? শিউলির বিয়া আমার মাইয়ার জামাইর লগেই তোর দিতে হইবো? তোর ভাইয়ের লগে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়া তোর মনোমালিন্য ছিলো। কিন্তু আমাদের সাথে তো কিছু ছিল না তোগো। আর শিউলি কী হারামি মাইয়া,মহুয়ার লগে তার কত খাতির ছিলো। আমরা সবাই কত কইতাম মহুয়া ফুল আর শিউলি ফুল হইলো দুই সই। তুই এই বিয়া ভাঙানি দে কইলাম। বিদেশি পোলা পাই তোর লোভ হইলো?”
“ভাবি থামো। অনেক কইছো। মহুয়ার হড়ি শিউলিরে ম্যালা পছন্দ করলো। কইলো মহুয়াও থাকবো আমানের পহেলা স্ত্রী হিসাবে। আমরা তো আরো মনে করলাম,তোমরা অতটা মনে কষ্ট পাইবা না। দুই মামাতো ফুফাতো বইন একলগে মিলামিশ্যা থাকবো। সমস্যা ত দেখি না। শিউলি না হইলেও হেরা অন্য মাইয়ারে বিয়া করাইতো। তহন বেশী ভালা লাগতো মহুয়ার? মন মেজাজ ঠান্ডা করো ভাবি। মাইনা নেও। ভালো হবো কইলাম।”
হালিমা আর কিছু বলে না। কান থেকে মোবাইলটা আলগা করে নেয়। মেয়ের দিকে ব্যথিত মুখে চায়। মহুয়া অভিমানী গলায় বলে,
“তুমি ফোন কেন দিলে মা? দরকার নেইতো। বিয়ে ফাইনাল। এখন ভাঙ্গবে?”
“তাইলে কী করবি? সতীনের ঘর করবি?”
“অসম্ভব! একলার জীবন অনেক ভালো। হাত আছে,পা আছে,মাথায় মগজ আছে। এই যথেষ্ট আমার, পেট চালানোর জন্য।”
তার দুদিন বাদে আমান মহুয়াদের বাড়ি যায়। এটা সেটা নিয়ে যায় যেতে। হালিমাকে সালাম দিলো সে। মহুয়া নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বাইরে বাঁশঝাড়ের দিকে চলে গেলো। আমান হালিমাকে সব বুঝিয়ে জোর অনুরোধ করলো মহুয়াকে যেন ডেকে আনে তার সামনে।
“আমি ডাইকা আনতাছি মহুয়ারে। তবে তোমার লগে যাওয়া,তোমার ঘর করা এইটা সম্পূর্ণ তার মর্জি। আমার কিছুই না।”
হালিমা গিয়ে মেয়েকে বললো,
“দুপুর হই যাইতাছে। পরে দুপুরের ভাত খাওয়ানো লাগবো হ্যারে। বুলবুলিরে না দেখলে যাইবো না কইলো। গিয়া কথা বইলা বিদায় কর মা। যতসব আপদ! মরা!”
অসহনীয় গলায় বলল হালিমা।
মহুয়া নিরুপায় হয়ে মায়ের কথায় ঘরের ভিতরে এলো। নয়তো তার ইচ্ছে ছিলো দেখা দিবে না। তার মেয়েকেও ছুঁতে দিবে না আমান নামের অ-মানুষটাকে।
“কেমন আছো মহুয়া?”
মহুয়াকে দেখেই নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো আমান। বুলবুলিকে জোর করে মহুয়ার কোল হতে নিজের কোলে নিয়ে নিলো। অচেনা মানুষের স্পর্শ পেয়ে বুলবুলি কেঁদে উঠলো। মহুয়া ফের বুলবুলিকে নিজের কোলে নিয়ে নিলো। বুলবুলির কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। মায়ের গলা পেঁচিয়ে চুপটি করে রইলো পরম নির্ভরতায়।
মহুয়ার কণ্ঠ চড়ায় গেল না। শান্ত গলায় বললো,
“আমি কেমন আছি তা জেনে আপনার কাজ নেই। আপনার মুখে মহুয়া নাম শুনতে বাজে লাগছে। কেন এসেছেন বলে বিদায় হউন।”
মহুয়ার পরিবর্তিত নির্দয় আচরণে আমান হতাশ হলো। সে নরম গলায় অপরাধীর মতো করে বললো,
“আমি, তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম?”
“আমি দূরের মানুষদের সবসময় আপনি বলি।”
দৃষ্টি মাটিতে রেখে বললো মহুয়া।
আমি তোমাকে ও বুলবুলিকে নিতে এসেছি। মা বললো নিয়ে যেতে।”
“আমি যাব না। আপনি আসতে পারেন।”
“রা গ করো না বলছি। বাবার সংসারে আস্তাকুঁড়ের মতো পড়ে থাকার চেয়ে স্বামীর ঘরে সম্মানের সাথে থাকা ভালো নয়?”
“সতীন নিয়ে ঘর করার মতো সম্মান আমি চাই না। আমি আমার ঠিকানায় ভালো আছি।”
“তুমি কী আর কোনদিন আমাদের বাড়ি যাবে না।”
“ধরে নিতে পারেন,নাহ।”
“এটাই তোমার ফাইনাল কথা?”
“হ্যাঁ।”
“ভুল করছো কিন্তু মহুয়া। বিরাট ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছো। তোমার, বুলবুলির সব কিছুই তো ঠিক থাকবে। সমস্যা কোথায়? আমিতো মায়ের মন রাখার জন্য রাজী হয়েছি। মন থেকে না।”
“যদি তাই হয়,তাহলে আমার চোখে আপনি একজন মেরুদণ্ডহীন পুরুষ। যে কি-না নিজের লাইফের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে না। নিজের স্ত্রীর অধিকার ঠিক রাখতে পারে না। সুতরাং আপনার মতো মেরুদণ্ডহীন মানুষের লাইফে আমি থাকতে রাজী নই। কারণ আমার মেরুদণ্ড আছে।”
এভাবে ঘন্টাব্যাপী পালটা যুক্তিতর্ক চললো আমান ও মহুয়ার মাঝে। আমান পরাজিত সৈনিকের মতো ক্ষিপ্ত মেজাজে মহুয়াদের ঘর ও বাড়ির প্রাঙ্গন ত্যাগ করলো।
মহুয়া ফোঁস করে তপ্ত স্বাস ছাড়লো। মায়ের কাছে গেলো বুলবুলিকে কোলে নিয়ে। বললো,
“আরেহ মা, সে আমাকে যতটুকু মায়া দেখিয়ে নিতে চাইলো,তার চেয়ে বেশী হলো অন্য কারণ। ভাবছে বুঝতে পারবো না তার মায়ের চালাকি। তার মা আমাকে নিয়ে যেতে বলছে,এটা সত্যি। আমাকে কখনো ছাড়বে না সে, তা মায়ের কথায় হোক বা তারও মায়া থেকে হোক,এটাও সত্যি।
আমি যদি বিয়েতে উপস্থিত থাকি, তখন সবাই ধরে নিবে আমার ইচ্ছেতেই পুত্র সন্তানের জন্য সে দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাচ্ছে। এবং তারাও সেটাই সবার কাছে প্রকাশ করবে আমার অগোচরে। কিন্তু আমি তা কিছুতেই হতে দিব না। খেলা দেখাবো এদের। এই রকম খাটাইশ,অবিবেচক,পাষাণ মানুষদের কঠিন সাজা দিতে হয়।”
হালিমা আক্ষেপের সুরে বললো,
“হাঁচাই কইছত মা। এইটাই আসল কাহিনী। বিয়ার দিন তুই হেগো ঘরে থাকলে সবকিছু সহজ হইয়া যাইবো হ্যাগো লাইগা। কারো প্রশ্নের মুখে পড়বো না। এখন ত খাইবো মাইনকার চিপা।”
মহুয়া বাঁকা হাসলো আমানকে নিয়ে।বললো,
“তবে আর বলি কী মা, বিয়ের বিষয় না হলে সে এখন আসতোই না আমাদের বাড়ি। আমিও মাঠে নেমে পড়লাম।”
পরেরদিন মহুয়া দোকানে যায়। ম্যানেজার ফাহিম তার সাথে কোনো কথা বলছে না। মহুয়া বলল কথা। একই স্থানে কাজ করতে গেলে সহপাঠির সাথে কথা না বলে কাজ করা যায় না। কিছুক্ষণ পর দোকানে আসিফ চলে এলো। মহুয়ার ডিউটি শেষ হওয়া অবধিই সে থাকবে। যেন ফাহিমের সাথে মহুয়ার আর কোন আপত্তিকর ঝামেলা না হয়। তাই। মহুয়া চলে গেলো ডিউটি শেষে। আসিফও তখন বেরিয়ে গেলো।
মহুয়াকে ফোন দিলো। জিজ্ঞেস করলো,
“সারাক্ষণ তোমাকে বিমর্ষ লেগেছে। কোন কথাও বলনি। তুমি কী চাকরি ছেড়ে দিতে চাচ্ছো?”
মহুয়া নমনীয় গলায় বললো,
“এমন কিছুই না ভাইয়া। ভিন্ন বিষয়।”
“কী বলো। আমি তোমার এক ধরনের অভিভাবক। বলো?”
আসিফের জোরাজোরিতে মহুয়া বললো,
“প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করা কতটা যৌক্তিক? এটা জানা খুব দরকার আমার।”
“ওকেহ। আমার পরিচিত ল.ইয়ার আছে। জেনেই জানাচ্ছি তোমাকে।”
রাতে আসিফ ফোন দিলো মহুয়াকে। বললো,
“খবর নিয়েছি। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে তা আইনত অবৈধ এবং ফৌজদারি অপরাধ। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ৬ ধারা অনুযায়ী এই রুলস।
প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করা এবং তার ভরণপোষণ না দেওয়া একটি ফৌজদারি অপরাধ। এবং ইসলামিক আইন অনুযায়ী, একজন পুরুষ চারটি বিয়ে করতে পারে। তবে শর্ত হলো তাকে সকল স্ত্রীর প্রতি সমানভাবে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি কোনো পুরুষ এই সমতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে দ্বিতীয় বিয়ে করা তার জন্য জায়েজ নয়।”
মহুয়া আসিফকে কৃতজ্ঞতার সাথে অশেষ ধন্যবাদ জানালো। আসিফ মোবাইল রেখে দিলো। অতিরিক্ত কোন কথা বলল না মহুয়ার সাথে। সে আগেই বুঝতে পেরেছে, বিষয়টা মহুয়ার। অন্য কারো হলে সে ব্যস্ততার মাঝে ফোন করে করে এত তথ্য রেডি করতো না।
তারপরের দিন মহুয়া আমানদের নিকটবর্তী থানায় চলে গেলো দোকানে যাওয়ার আগে। সবকিছু জানালো। এবং বললো পরে আসবে মামলা করতে।
হেমন্তের এক মধ্য দুপুর। আমানদের সারা উঠানজুড়ে ছড়িয়ে আছে মিঠে রোদ্দুরের কোমলতা। আমান মাত্রই বউ নিয়ে বাড়িতে এসেছে। ঘরোয়া আয়োজনে সম্পন্ন হলো তার দ্বিতীয় বিয়ে। বরবেশে সে খোশ মেজাজে আছে। নতুন ফুল। নতুন সুবাস। আহা! মধু! মধু!
এমন সময় দু’জন পুলিশ আমানদের ঘরের উঠানে হাজির হলো। উপস্থিত সবাই ভড়কে গেলো। আমান পালিয়ে যেতে চাইলো। পারলো না। তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিলো একজন পুলিশ।
আমান অদ্ভুত চোখে পুলিশকে জিজ্ঞেস করলো,
“কী ব্যাপার? কোন অপরাধে আমাকে এরেস্ট করলেন?”
চলবে…৭