#মহুয়ার_রাতদিন.৮ ✍️ #রেহানা_পুতুল
আমান অদ্ভুত চোখে পুলিশকে জিজ্ঞেস করলো,
“কী ব্যাপার? কোন অপরাধে আমাকে এরেস্ট করলেন?”
“প্রথম স্ত্রী জীবিত। কিন্তু তার অনুমতি না নিয়ে কোন কারণ ছাড়াই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এটা ফৌজদারি অপরাধ। তাই থানায় আপনার নামে মামলা হয়েছে। চলুন।”
“কে দিলো আমার নামে মামলা?”
বিচলিত কণ্ঠে জানতে চাইলো আমান।
“যে দেওয়ার সেই দিয়েছে। চলুন।”
আমান বিষিয়ে আসা কণ্ঠে মহুয়ার উদ্দেশ্যে গোপনে বললো,
” ছাড়া পাই আগে। পরে তোর বিষ বাইর করবো।”
আমানের মা তফুরা কান্না জুড়ে দিলো।
পুলিশকে কাকুতি মিনতি করে বললো,
“আপনাগো আল্লার দোহাই লাগে,আমার পোলারে ছাইড়া দ্যান। ওর দোষ নাই। আমিই ওরে ইন্ধন দিছি আবার বিয়া করনের লাইগা। যেহেতু পহেলা ঘরে শুধু মাইয়াই হইতাছে।”
“আপনি মুরুব্বি বলে আপাতত বেঁচে গেলেন। নয়তো ছেলের সাথে আপনার হাতেও হাতকড়া পরাতাম। ঘর সামলান। আপনার ছেলে বছর খানেক ঘুরে আসুক। ধরে নিবেন এতোদিনের মতো এখনো সে দেশের বাইরে আছে।”
আমান বরের বেশ চেঞ্জ করার অনুমতি চাইলো। পুলিশ দিল না। অন্যদের বললো,
“উনার কাপড় চোপড় নিয়ে কেউ থানায় আসুন। সেখানে চেঞ্জ করার অনেক জায়গা আছে।”
তফুরা উঠানের মাটিতে বসে আছাড়িপিছাড়ি করে কাঁদতে লাগলো।অন্যরা হায় হুতাশ শুরু করলো তাকে শান্তনা দিতে দিতে। কেউ কেউ মহুয়ার পক্ষ নিয়ে মনে মনে বললো,
“বেশ হইছে। মা,ছেলের শিক্ষা হওনের দরকার আছিলো। কত ভালো ছিলো আমানের বউ। নাহ, এর নাতি চাই নাতি। এতে বউর কী দোষরে মুরুক্ষ বেটি? তোর ছেলে তার প্যাটে যেইটা দিবো সেইটাই ত বাইর হইবো। কিন্তু আমানের বউর এত বড় দুঃসাহস ক্যামনে হইলো?”
সময়, পরিবেশ,পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। সাহসী করে তোলে। একা বাঁচতে শেখায়। আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী করে তোলে। যেমনটি হয়েছে মহুয়ার ক্ষেত্রে।
মহুয়ার আপন ফুফাতো বোন নববধূ শিউলির বিয়ের আনন্দ ধূলায় মিশে গেলো নিমিষেই। ঘোমটা পরিহিত অবস্থায় সে বিষন্নমনে বসে আছে। তার সাথে আসা চাচাতো ভাই বোনেরা চলে গেলো বাড়িতে। শিউলির বাবা মাকে বিষয়টা জানালো। শুনে আমানের পরিবারের মতো তারাও বিক্ষুব্ধ হলো মহুয়ার উপরে। পারেতো গেঁড়ে ফেলে মহুয়াকে।
শুক্রবার বলে মহুয়া বাড়িতেই ছিলো। ছোট ভাই মিরনও ছিলো বাড়িতে। মহুয়া মা ও ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলো। মিরন তার অস্পষ্ট ভাষায় বোনকে বললো,
“বেশ হইছে ধইরা নিছে। আমি সামনে পাইলে তারে কিল-ঘুষি মারতাম।”
হালিমা ভীরু কণ্ঠে মেয়েকে বললো,
“এবার কী হয় আল্লায় জানে। আমরা ওদের চাইতে নিরীহ মানুষ। তোর বাপ থাকলেও এক কথা আছিলো। আমার মনে কেমন জানি কু ডাকতাছে। তোর যেই জল্লাদ হড়ি। পানিতে ফালাতা বোবা মাছুম নাতনিরে যে মাইরা ফালাইতে পারে,তার পক্ষে সবই সম্ভব। আল্লাহ গো রহম করো। দয়া করো।”
“দূর মা। অযথা টেনশন করো না। কী করবো সে বা তারা আরেক গ্রামে থেকে? এক বাড়িতে বাস হলে তাও কথা ছিলো। আরো নিরীহ কেউ হলেও মামলা করার রাইটস আছে তার। আমি থানায় গিয়ে সব পুলিশদের বলেছি। তারা আমাকে আস্বস্ত করেছে। মিরন ত সবই শুনছে। নারে ভাই?”
মিরন মাথা ঝাঁকিয়ে বোনের কথার সম্মতি জানায়।
শনিবারে মহুয়া দোকানে যায়। আসিফ আসে তার পরে। দোকানে কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় মহুয়া, মালিক আসিফ,ম্যানেজার ফাহিম কেউই কারো সাথে অহেতুক কথা বলে না। সবাই প্রফেশনালিজম বজায় রাখে। তার বাইরেও তারা কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করে না। মহুয়াকে দুইদিন মোবাইলে আসিফ কল দিয়েছে। তাও প্রয়োজনেই। আসিফের নজর এড়ালো না মহুয়ার মলিন মুখের অভিব্যক্তি। মহুয়া দুপুর শেষে মহুয়া চলে যায় বাড়িতে। আসিফ একবার ভাবলো ফোন দিবে মহুয়াকে। পরে আর দিল না। দেওয়া ঠিক হবে না এই ভেবে।
বিকেলে মহুয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে পাশের বাড়িতে গেলো। সেই ভাবি থেকে আমানদের ঘরের খবর নিলো। সেই ভাবি তাকে জানালো,
“আমাইন্না থানায় পইড়া আছে। মধুর বাসর, গাঙে ভাইসা গ্যাছে। হের মা জামিনের জন্য ছুটাছুটি করতাছে। বড় উকিল ধরছে। উকিলরে ঘুষ দেওনের লাইগা গয়না বন্ধক দিছে। তোর ফুফাতো বইন শিউলিমালারে নিয়া গ্যাছে তার চাচাতো ভাই আইসা। আর আসেনাই বেচারি।”
তারপর মহুয়া কিছুক্ষন গল্প করলো সেই ভাবির সাথে। ঘরের পিছনের সরু আড়া অতিক্রম করে চলে এলো নিজেদের বাড়ি। বাড়িতে এসে মা,ভাইকে জানালো সব। তারা শান্তি পেলো শুনে। হালিমা বললো,
“হ পোলায় জেলে থাউক। মা পোলারে ছুটানোর জন্য নাকানিচুবানি খাউক একবার।”
মিরন মিলে যায়। কাজ করে। মাস শেষে নামমাত্র হলেও মাইনে পায়। মহুয়ার চাকরিটাও মন্দ নয়। মাস শেষে নিয়মমাফিক বেতন পায়। ব্যস্ততায়,বেদনায় মোটামুটি ভালই দিন যাচ্ছে তাদের।
#গল্প দ্রুত পেতে #রেহানা_পুতুল পেইজে 👉follow ও like দিয়ে রাখবেন। পেইজ গ্রো না দেখলে হাত চলে না।🙋♀️✍️
তার সাতদিন পরের ঘটনা। হেমন্তের রাত্রির শেষভাগ। প্রকৃতি নিরব, নিস্তব্ধ! হালকা ঠান্ডার আমেজে সেও এলিয়ে পড়েছে রাত্রির গায়ে। ঝিঁঝি পোকার দল ডাকছে না। জোনাকিরা জ্বলছে না। বাতাস বইছে না। সারা আকাশে ছড়িয়ে আছে কালো মেঘের চাদর। নেই তারাদের আনাগোনা। ঘরের কোণের কুনো ব্যাঙটাও আজ ডাকছে না। শোনা যাচ্ছে না কুকুরের ডাক। কিংবা বিড়ালের মিহিস্বরে কান্না।
মহুয়াদের ঘরে সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সবার গায়ে পাতলা কাঁথা জড়ানো। হঠাৎ বুলবুলি নড়ে উঠলো কান্না করে। মেয়ের জন্য উপর দিয়ে ঘুম হলেও ভিতরটা সারাক্ষনই সজাগ থাকে মহুয়ার। সে চোখ মেললো। বুলবুলির দিকে তাকাতেই নিজের গায়ে উষ্ণতা অনুভব করলো। মুহূর্তেই দেখলো আগুন জ্বলছে তার রুমের চারপাশের বেড়ার মধ্যে। মহুয়া আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো,
“মা…আগুন। আমার রুমে আগুন।”
হালিমার ঘুম ছুটে গেলো। চোখ মেলতেই দেখলো সারাঘরেই আগুন জ্বলছে। অসহায়ের মতো পাগল পাগল কণ্ঠে সে চিৎকার করে বললো,
“বাইর হইয়া যা মা,মাইয়া। হারাঘরেই আগুন।”
মিরন কাঁথামুড়ি দিয়ে আছে বিধায় টের পেল না আগুনের তাপ। মহুয়ার কোলে বুলবুলি,তাই সে চাইলেও ভয়ে মিরনের কাছে যেতে পারল না। উচ্চস্বরে ভাইকে ডাকলো,
“মিরনরে..। মিরন..।ভাই উঠানে আয়। আগুন ঘরে।”
মিরনের গায়ে খুব গরম লাগছে। সে ধড়মড়িয়ে উঠে গেলো। তার গায়ে আগুন জ্বলছে। ঘটনার আকস্মিকতায় মিরন হতভম্ব! নির্বাক! কোনদিকে যাবে তাও বুঝে উঠছে না। হালিমা ছুটে গেলো মিরনের চৌকির কাছে। ততক্ষনে হালিমার পরনের শাড়িতে আগুন ধরে গিয়েছে। সে শাড়ি খুলে ফেলে দিলো। মিরনকে ঝাপটে ধরে টেনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি।
মহুয়া বাড়ির অন্যদের ডাকলো ভয়ার্ত চোখে কম্পিত গলায়। তারা এসে ঘরে আগুন নেভাতে পারলো না চেষ্টা করেও। তার পূর্বেই ঘর পূড়ে ছাঁই। দুই কামরার ছোট্ট দোচালা বেড়ার ঘরটি কয়েক মিনিটেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো।
হালিমাকে একটা কাপড় এনে এলো এক জা। মহুয়ার কোল থেকে বুলবুলিকে কোলে নিয়ে নিলো তার এক চাচাতো ভাই। মিরনের অবস্থা শোচনীয়। তাকে বাড়ির লোকজন মিলে ধরাধরি করে নিয়ে গেলো হাসপাতালের দিকে।
হালিমা ও মহুয়া বুক ফাটিয়ে আকূল স্বরে কান্না করছে। মিরনকে নিয়ে যাওয়া লোকদের পিছন পিছন গেলো মা,মেয়ে। নিশুতি রাতের আঁধার ঠেলে বিক্ষিপ্ত পায়ে প্রায় দৌডাচ্ছে তারা। আগুন কিভাবে লাগলো তা নিয়ে আপাতত তাদের ভাবান্তর নেই। মিরনকে বাঁচানোই মূল আরাধ্য। সহজ,সরল মিরন মায়ের প্রাণের ধন। বোনের পরান। মিরনকে হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হলো বাড়ির মানুষের সহযোগিতায়।
মহুয়াদের বাড়ির রাত্রির নিস্তব্ধ শেষ প্রহর মুখরিত হলো বহু মানুষের গুঞ্জনে। সবাই জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ধারণা করলো ঘরের ভিতর মশার কয়েল,বা অন্যকিছু থেকে আগুন লেগেছে।
বিচক্ষণ দুই একজন বললো,
” মহুয়াদের সবাইকে মেরে ফেলার জন্যই সারা ঘরে কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিলো নাতো? কিন্তু কে বা কারা করতে পারে এমন নৃশংস কর্মকাণ্ড!”
পাশ থেকে আরেকজন পুরুষ জ্ঞানগর্ভ সুরে বললো,
“ওদের এখন শত্রু আছে। এক তার ফুফুরা। আরেক তার জামাইরা। হয়তো এর বাইরে আরো কেউ আছে।”
চলবে…৮