মহুয়ার রাতদিন পর্ব-১০

0
12

#মহুয়ার_রাতদিন. ১০✍️ #রেহানা_পুতুল
অদ্ভুত চোখে চেয়ে ভীষণ অবাক কন্ঠে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো আসিফ।

কাশেম হকচকিয়ে গেলো ছেলের অভিব্যক্তি খেয়াল করে। গলা ছেড়ে কেশে উঠলো। বললো,

“তোর হাবভাব দেখে মনে হইতাছে আমি কোন ভুল কাজ করার সিদ্বান্ত নিছি। একটা অসহায় মেয়ের সহায় হওয়া,তার জীবনের একটা গতি কইরা দেওয়া সওয়াবের কাজ। এই মেয়েটার বয়স কত হইবো? বড়জোর বিশ কি একুশ। আস্ত একটা জিন্দেগী তার সামনে পইড়া আছে। কোলের একটা শিশু বাচ্চা নিয়া এভাবে একলা জীবন ক্যামনে পার করবো? মা আইজ আছে কাইল নাই। ভাই তো না থাকার মতই। তখন মেয়েটা নানাভাবে লাঞ্চিত হইবো। নিরাপত্তা কই? সমাজটা বহুত নষ্ট। তোর মাও জানে বিষয়টা। মেয়েটার একটা আশ্রয় দরকার। একজোড়া ভরসার হাত দরকার।”

কথাগুলো বলে কাশেম আসিফকে মোটামুটি ভাঁজে আনতে সক্ষম হলো।

“বুঝলাম। বিয়ে হওয়া জরুরী মহুয়ার অবস্থান ভেদে। ভালো পরিবার হলে অবশ্যই ভালো। নয়তো ঝামেলা আরো বাড়বে বাবা।”

তখন আসিফের মা আফিফাও তাদের পাশে এসে বসলো। আসিফ মাকে জিজ্ঞেস করলো,

“আম্মা,বাবা নাকি মহুয়া মেয়েটার বিয়ে ঠিক করেছে?”

“তোর বাবা ঠিক করেনাই। একটু ভাব নিতে চাইলো আর কী দায়িত্ব নিয়া। ঠিক করছে মহুয়ার বাবার চাকরি করা মিলের মহাজন।”

“সাবের চাচা?”

“হ্যাঁ। উনিই তোর বাপের সাথে পরামর্শ করলো। তোর বাপ তোর সাথে পরামর্শ করতে বসলো। এই হইলো বিষয়।”

” পাত্র কে?”

“পাত্র উনি নিজেই!”

স্পষ্ট গলায় জানালো আফিফা।

“হোয়াট!” বলে আসিফ তেতে উঠলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঝাঁঝালো স্বরে বললো,

“তোমাদের মাথা ঠিক আছে? না-কি ঘুষ খেয়েছো তার থেকে? এটা অসম্ভব! একটা তরুণী বয়সের মেয়ের বিয়ে কীভাবে এত এডাল্ট লোকের সাথে হয়? উনার চোখ এত খারাপ? মহুয়া না উনাকে চাচা বলে? ছিহ!”

কাশেম স্থির হয়ে বসে আছে চেয়ারে। ভাবখানা এমন যেন ভাজা মাছটিও উলটে খেতে জানে না। আসিফের মুখের কথা ঝামটি মেরে কেড়ে নেয় আফিফা। মেঘমুখে বললেন,

“বয় হারামজাদা। তুই এমন চ্যাতস ক্যান? মহুয়া তোর নিজের কেউ? না আমাদের কেউ? আরেক গ্রামের মাইয়া। চাচা কয় কী হইছে। তার আপন চাচা? সাবের ভাইর লগে মহুয়ার বিয়ে জায়েজ আছে। সাবের ভাইর লগে তোর বাপের সম্পর্ক দোস্তের মতোন। উনার বয়স কী এমন বেশী? পুরুষ মানুষের বয়স বেশী হইলেও কমবয়সী মেয়েরে ঘরে তুলতে পারে। এরমধ্যে বিপত্নীক উনি। দুই মেয়ে থাকে স্বামীর সাংসারে। কোন ছেলে নাই। মহুয়া গরীব। সমাজের নিচুতলার। কে তারে আবার বিয়ে করবো? ক? বাপের ভিটায় পঁইচা মরণের চাইতে অবস্থাসম্পন্ন,মান্যগণ্য একজন পুরুষের বউ হওয়া উত্তম। সাবের ভাই কইছে মহুয়ার নামে বিশ শতক জমি লেইখা দিবো। মহুয়ার মেয়ের সমস্ত খরচ নিজে বহন করবো। মহুয়াদের ঘরের বন্দোবস্ত করবো। মহুয়ার ঘরে যদি উনার কোন পুত্র সন্তান হয়,উনি মহুয়ার নামে একটা মার্কেট দিবো।”

আফিফা থামে। আসিফ এতক্ষণ বিষ্ফোরিত চোখে ও ব্যথাতুর হৃদয়ে মায়ের কথাগুলো হজম করে গেলো। তপ্ত স্বাস ফেলে আসিফ বাবা,মাকে জিজ্ঞেস করলো,

“বাহ! ভালই ত উনি তোমাদেরকে ম্যানেজ করে ফেললো। এই কাহিনী মহুয়ার পরিবার জানে?”

এবার যেন কিছু বলার সুযোগ পেলো কাশেম। বললো,

“নাহ। এজন্যই তো তোকে জানানো। সাবের ভাই কইলো মেয়েটা তোর দোকানে চাকরি করে। তুই ওকে ভালো করে বুঝিয়ে বললে ও রাজী হবে সবদিক বিবেচনা করে।”

আসিফের মাথায় হঠাৎ করে একটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো। সে বললো,
“আচ্ছা আমি ভেবে দেখি।”

আফিফা অনুনয় করে বললো,

“হ্যাঁ বাপ। মেয়েটার উপকার কর। সাবের ভাইয়ের মতো সামর্থবান,মানীলোক মেয়েটারে পছন্দ করছে,এটাই ত মেয়েটার সাত জনমের কপাল। নইলে অমন ঘরভাঙা, হতদরিদ্র, বাপ নাই,ভাই প্রতিবন্ধী, কোলে কন্যাশিশু, অমন পোড়ামুখী,জনমদুঃখী পথের মাইয়ারে কে বিয়া করতে চাইবো?
হয়তো অল্পবয়সের কোন তাগড়া ছেলে করবো। কিন্তু সে হয় সি.এন.জি চালক হইবো,নয়তো কোন কারখানার শ্রমিক হইবো। তিনবেলা ভাতের বদলে কিল-ঘুষি খাইবো। আর সাবের ভাইয়ের ঘরে না ভাতের অভাব হইবো। না পিন্দনের কাপড়ের অভাব হইবো। বাড়তি রাজত্ব তো পাইবোই। লগে ইজ্জতও। গুরুত্বও। তুই ওরে বুঝাইয়া ম্যানেজ কর। এই দায়িত্ব তোর। সাবের ভাই অনেক খুশি হইবো তোর উপরে। ”

আসিফ ক্ষণসময় ব্যয় করলো ভাবনায়। দেখলো মহুয়ার জীবন নিয়ে তার মা,বাবার কথাগুলোয় যথেষ্ট যুক্তি আছে। সে বললো,

“আচ্ছা,কয়দিন যাক। তারপর বলবো সময় নিয়ে বুঝিয়ে। আগে তার ভাই সুস্থ হউক। ওদের মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হোক।”

“তাই ভালো।”

আসিফের কথায় ভরসা পেলো তার বাবা,মা। তারা ভিতরের রুমে চলে গেলো। আসিফও নিজের রুমে চলে গেলো। রাতে ঘুমানোর আগে সে মহুয়াকে ফোন দিলো। মিরনের খোঁজ খবর নিলো।

সেই রাতেই সাবেরকে ফোন দিলো কাশেম। বললো,

“ভাই কাজ হবে মনে হয়। আপনার মনের আশা পূরণ হইবো। আসিফ দায়িত্ব নিছে মেয়েটারে রাজী করানোর। কয়দিন পর বলবে বলছে।”

সাবের হিমালয় জয় করার মতো খুশী হয়।

পাঁচদিন পর মিরনের রিলিজ হলো। এই ভিতরে তিনদিন মহুয়া দোকান করেছে বুলবুলিকে তার মায়ের কাছে রেখে। তবে আগের চেয়ে কম সময় দিয়েছে দোকানে। বাড়িতেও গিয়েছে হাঁসমুরগিগুলো দেখাশোনার জন্য। পাশের বাড়ির ইরা ও মিরাকেও পড়া বন্ধ করে দিলো।

আসিফ উপস্থিত থেকে ডাক্তারদের সাথে কথা বলে মিরনের রিলিজ পর্ব সম্পন্ন করলো। মেডিসিনগুলো বুঝে নিলো মহুয়াকে পাশে রেখে। মহুয়া টাকা যেগুলো ম্যানেজ করলো। আসিফের হাতে দিতে চাইলো ডাক্তারকে দেওয়ার জন্য। আসিফ নিল না।
স্মিত হেসে বললো,

“এখন তোমার কাছে রাখো। আপাতত সব টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। খুব বেশি নাতো সরকারি হাসপাতালের বিল।”

মহুয়া কাঁচুমাচু করতে করতে টাকাগুলো আবার তার ব্যাগে রাখলো। আসিফ লুকানো চোখে মহুয়ার আপাদমস্তক দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এর আগে মহুয়াকে কখনো সে এভাবে দেখেনি। মহুয়ার প্রতি তার একটা মানবিক ও সহানুভূতির দৃষ্টি ছিলো তার দোকানের স্টাফ হিসেবে। কিন্তু সাবের কেন মহুয়াকে বিয়ে করতে চায়,এই প্রশ্ন থেকেই না চাইলেও আসিফের ভাবনায় ঠাঁই পেলো মহুয়া।

আসিফ মহুয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

“মিরনকে নিয়ে তোমরা এখন কোথায় উঠবে। ওর সেবাযত্নের জন্য ভালো পরিবেশ দরকার।”

“আপাতত সেটার কোন সমস্যা নাই ভাইয়া। বাড়িতে এক চাচার ঘরে থাকবো। উনারা আমাদের জন্য একরুম ঠিক করে রেখেছে।
উনারা সচ্ছল এবং ভালো মানুষ। আব্বার আপন চাচাতো ভাই।”

বিনয়ী গলায় বলল মহুয়া।

“আচ্ছা থাকার আপাতত বন্দোবস্ত হলো। কিন্তু তোমাদের খাওয়া, দাওয়া?”

“দু চারদিন ত উনারাই খাওয়াবে বলছে। এরপর আমরা আলাদা রান্না করবো। আমাদের রান্নাঘর ঠিক আছে। আগুনতো দিলো আমাদের থাকার ঘরে।”

“বুঝলাম। তোমাদের ঘর তো তুলতে হবে। ভেবেছো কিছু?”

“মাথা গোঁজার ঠাঁই তো অবশ্যই করতে হবে। বাড়িতে যাই। আত্মীয়স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করবো সাহায্যের জন্য।”

“ঠিক আছে তোমরা চলে যাও। আমি দোকানে যাই। সব বিষয়ে যোগাযোগ রাখবো তোমার সাথে।”

গুরুগম্ভীর গলায় বলল আসিফ।

আসিফ মহুয়াদেরকে একটা গাড়ি ঠিক করে দিলো। আয়াদের সাহায্য নিয়ে মিরনকে ধরে গাড়িতে তুলে নিলো।
বাড়িতে গিয়ে চাচাদের ঘরে উঠলো তারা। আপাতত তারা নিজের বাড়িতেই থাকতে পারছে এটাই বড় শান্তি ও শান্তনা তাদের জন্য।

হালিমা মহুয়াকে বললো,

“আল্লার অশেষ দয়ায় আমার পোলা ভালোর দিকে যাইতাছে। ঘরে আগুন কে দিলো,এবার এইটা বাইর করার চেষ্টা করতে হইবো।”

মহুয়া বললো,
“মা,সেটাতো আছেই। আমাদের ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে সহসাই। কাকাদের ঘরে কতদিন আর থাকবো।”

“তুই এক কাম কর মা,তোর মহাজন চাচার সাথে দেখা কর। উনি যদি কিছু টাকা পয়সার ব্যবস্থা করে দেয় আমাদের। বড় উপকার হয়। বেড়ার ঘর দেওন যাইবো না। আগুন আবার দিবো জালিমেরা। টিনের ঘর দিতে হইবো। ফুল টিনের ঘর।”

মায়ের কথায় মহুয়া সম্মতি জানায়।

পরেরদিন ভোরে বুলবুলি ঘুমে থাকতেই মহুয়া বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে। সাবের মহাজনের বাড়িতে গেলো। একই গ্রাম মহুয়া ও সাবেরের। মহুয়া তার দালানের ঘরে পা রাখতেই তিনি টের পেলেন। অসম্ভব খুশী হলেন মহুয়াকে দেখে। বুঝে উঠতে পারছেন না ঠিক। আসিফ কী তার হয়ে প্রস্তাবটা দিলো? মহুয়াকে কী তার মা জেনেশুনেই তার খালি পাঠালো কাজের ছুতোয়?

“চাচা আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? ”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি হঠাৎ কইরা? বসো বসো।”

“চাচা আমি বেশী সময় নিব না। আমার তো ছোট বাচ্চা আছে জানেন।”

“হ জানি তো। তোমার বুকের দুধ পান করা শিশু, খাইতে না পারলে কাঁদবো।”

বলেই মহুয়ার বুকের উপরে চোরাচোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সাবের। মহুয়ার নজরে পড়েনি সেটা। সে বললো,

“চাচা, আপনার মিল এখন বন্ধ। তাই বাড়িতে আসলাম সরাসরি। মা বললো, বাড়িতে আসতে। নিরিবিলি কথা বলা যাবে। মিলে ব্যস্ত থাকেন।”

“তোমার আম্মা একদম বুদ্ধিমানের কাজ করছে। তোমারে কী যে খাইতে দেই। আমার ত খালি ঘর। কাজ করার জন্য পাশের বাড়ির এক বেডি আসে আরো পরে।”

“চাচা,আমি কিছুই খাব না। আপনি বসেন।”

তবুও সাবের নিজেই মহুয়াকে চা,কলা,কেক এনে দিলো ট্রেতে করে। মহুয়া সংকোচপূর্ণ মুখে সামান্য খেলো ভদ্রতা দেখিয়ে।

তারপর মহুয়া তাদের ঘর নিয়ে সবিস্তারে বললো। শুনে মহাজন বললো,

“আমার কথাও টিনের ঘর হোক। নিরাপদে থাকতে পারবা তোমরা। তোমরা যা পারো কালেকশন করো। এরবাদে বাকি যা থাকে,সব ভর্তুকি দিয়ে আমি নতুন ঘর তুলে দিবো। যেহেতু তোমার বাপ নাই। তাই তোমাদের গার্ডিয়ান হিসেবে কাঠমিস্ত্রীর সাথে আমি আলাপ করবো খরচপাতি নিয়া।”

মহুয়া খুশী হয় সাবেরের মহানুভবতায়। বাড়িতে এসে মাকে ও মিরনকে জানায়। হালিমা সাবেরের উপর চিরকৃতার্থ হয়। মেয়ের সাথে একবেলা পার করে সাবেরের গল্প করে।

তারপর মহুয়া গোপনে অনেকভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেলো তাদের ঘরে কে আগুন দিলো তা উদঘাটনের জন্য। এবং কিছুটা জেনেও গেলো। মহুয়া নির্বাক মনে বাড়ি ফিরে এলো। গায়ের বোরকাটা খুলতে খুলতে মাকে বললো,

“মা,আমরা যাদের ধারণা করেছি,ঘরে আগুন তারা দেয়নি। অন্যকেউ লাগিয়েছে লোক দিয়ে। তাদের উদ্দেশ্যেই ছিলো আমাদের চারজনকে পুড়িয়ে ছাঁই করে দেওয়া।”

“কী কস তুই? কারা এই পশু,এমন জানোয়ার?”

মেয়ের দিকে কাতর চাহনি নিক্ষেপ করে অসহায় কণ্ঠে জানতে চাইলো মহুয়ার মা।

চলবে…১০