মহুয়ার রাতদিন পর্ব-১১

0
11

#মহুয়ার_রাতদিন. ১১✍️ #রেহানা_পুতুল
“কী কস তুই? কারা এই পশু,এমন জানোয়ার?”
মেয়ের দিকে কাতর চাহনি নিক্ষেপ করে অসহায় কণ্ঠে জানতে চাইলো মহুয়ার মা।

“মা, আমি বুলবুলিদের বাড়ির এক ভাবিকে ফোন দিয়েছি। উনি বললো,আমান এখনো থানায়। তার মা অনেক চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছে না তাকে। তার মায়ের মানসিক অবস্থা খুব খারাপ। শিউলি যে বিয়ের দিন চলে গিয়েছে আর আসেনাই। তবে আমান ছাড়া পেলেই শিউলিকে নিয়ে আসবে। তাদের বাসর হবে।”

“তারপর?”

“তারপর চুপিচুপি শিউলিদের বাড়িতে গেলাম। ফুফুর বাড়ি যেহেতু। সবই তো চেনা। ক্ষেতের আল ধরে শিউলির চাচাদের ঘরে ঢুকলাম। তারা বললো,শিউলির বিয়ের দিন আমানের মা তাদের বাড়ি গিয়েছে। সবার সামনেই তিনি ফুফুকে শান্তনা দিলো। এবং আমান আসার অপেক্ষায় থাকতে বললো। অনেকক্ষণ নাকি আমাকে গালমন্দ করেছে। তিনি চলে গেলে ফুফু মাঝ উঠানেই দাঁড়িয়ে বলছে, আপন ভাইয়ের মেয়ে আমার মেয়ের কপাল পোড়ার চেষ্টা করলো। জামাইকে পুলিশ দিয়ে ধরালো। আমি এর বদলা নিয়েই ছাড়বো। তো তাদের ধারণা আমাদের ঘরে আগুন ফুফুই লোক দিয়ে লাগিয়েছে। এটা তার বাপের বাড়ি। সব রুমই তার মুখস্থ। তাই আগুন কোন সাইড দিয়ে লাগালে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, সেতো তা জানেই। আমার বিশ্বাস হয়েছে এটা। আমানের মা যখন দেখলো আমি পুলিশ দিয়ে তার ছেলেকে থানায় নিয়েছি। সে কিছুটা হলেও ঘাবড়ে গিয়েছে। তাই সে আর বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করবে না।”

হালিমা অবশ গলায় বললো,

“র*ক্তের মানুষ এত নিচু মনের হয়? আপন,ভাতিজি,ভাতিজারে সে মাইরা ফালাইতে চাইলো? আমি কী না করছি এই নন্দের লাইগা। যাক, শোকর মাওলার দরবারে। আমি অসহায় মানুষ। চাক্ষুষ প্রমাণ নাই। ক্যামনে ধরি তারে।”

বলে হালিমা দুঃখের গভীর স্বাস ছাড়লো।
“মাওলার দরবারে সব ছেড়ে দিলে হয় না মা। নিজেদের হাতেও কিছু বিচার রাখতে হয়।”

মেয়ের কথায় চ্যাত করে উঠলো হালিমা। দুঃখভরা মন নিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলল,

“কয় কেলাস পইড়া বেশী বাইড়া গ্যাছত তুই। তোর জিদ্দের লাইগাই আইজ আমাগো জীবনের এই বিতিকিচ্ছিরি। আমার বেমারে থাকা নাদান পোলাড়া কতই না কষ্ট পাইতাছে শরীরে। তুই যদি বুলবুলির বাপেরে পুলিশ দিয়া না ধরাইতি,তাইলে কী আমার ঘর পোড়ে? আমার এত বছরের সংসারের সব স্মৃতি শ্যাষ হইয়া গ্যালো। কতজনের হাতে পায়ে ধইরা টাকার বন্দোবস্ত করতে হইলো। তুই যেহেতু তার ঘরে যাইবি না আর, তাইলে চুলায় যাক তারা। দরকার কী আছিলো কাহিনী করবার। আমাগো সেই মুরোদ আছে তাগো লগে লড়বার? সব সময়ে,সবার লগে লড়তে নাই। চুপ মাইরা থাকতে হয়।”

মহুয়া নিরবে শুনে যায় মায়ের কথাগুলো। পুকুর ঘাটে গিয়ে মুখে বার কয়েক পানির ঝাপটা মারে। যেন চোখের জল ও পুকুরের জল মিশে একাকার হয়ে যায়।

শুক্রবারে সাবের মহাজন দু’জন কাঠমিস্ত্রী নিয়ে মহুয়াদের বাড়ি এলো। মিরনকে দেখল ঘরে গিয়ে। মিরনের পোড়া টান ধরেছে। সে এখন ভালোর দিকে যাচ্ছে।
এই কাঠমিস্ত্রীরা টিনের ঘরও তৈরি করে থাকে নকশাসহ। মহুয়া মাথায় ওড়না দিয়ে তাদের সামনে গেলো। মিস্ত্রিরা ঘরের পরিমাপ করলো। কতটুক কাঠ, টিন লাগবে। চেয়ারে বসে কাগজে কলমে সব হিসাব করে ফেললো।

মহুয়াকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমরা কত টাকা যোগাড় করতে পারবা আন্দাজমতে?”

“চাচা, বলতে পারছি না। চেষ্টা করছি আমরা। দুই তিনদিন পরেই জানাতে পারবো আপনাকে।”

“তাহলে ঘরের আয়োজন শুরু করুক তারা। টিনের দোকানদার আমার পরিচিত। বাকিতেও নেওয়া যাইবো।”

“ঠিক আছে চাচা। শুরু করুক উনারা।”

সাবেরের ধারণা ছিলো মহুয়া ও তার মা বিয়ের বিষয়টি জানে কিছুটা হলেও। সে মনে মনে বলল,

“চাচা না,আমি তোর স্বামী হমু কয়দিন পর।”

তারা চলে যায়। মহুয়া ও তার মা মিলে টাকার ব্যবস্থায় নেমে পড়লো। মহুয়ারা তাদের দুটো বড় গাছ বিক্রি করে ফেললো। আত্মীয়স্বজন থেকেও সাহায্য নিলো। আসিফের কাছে সাহায্য চাইলো না তারা। কেননা আসিফ মিরনের রিলিজ হওয়ার পুরো টাকা দিয়েছে। তারপর মহুয়া বড় বাজারে স্বর্ণের দোকানে যায়। তার গলার চেইন, ও এক জোড়া কানের দুল বিক্রি করে দিলো। এতে ভালো টাকা চলে এলো হাতে।

মহুয়া যখন গহনার দোকান হতে বেরিয়ে যায়,দূর হতে আসিফ তাকে দেখলো। বুঝলো কিছু। সে গহনার দোকানে এসে বললো,

“বোরকা পরা যেই মেয়েটি বেরিয়ে গেলো, সে কি বিক্রি করেছে দেখি?”

দোকানদার দেখালো।

“কত টাকা দিয়েছেন?”

দোকানদার টাকার অংক বলল।

আসিফ তার মানিব্যাগ হতে সম পরিমাণ টাকা দোকানদারের হাতে গুঁজে দিলো। বললো,

“আমি বসছি। ঘষে মেজে চকচকে করে দিন চেইন ও দুলজোড়া।”

দোকানদার তাই করলো। আসিফ মহুয়ার কানের দুলজোড়া ও গলার চেইনটা যত্ন করে তার কাছে রেখে দিলো।

তার পরেরদিন মহুয়া দোকানে গেলো। দেখলো ম্যানেজার ফাহিম নেই। ক্যাশে আসিফ বসে আছে। মহুয়া তাকে সালাম দিয়ে একপাশের টুলটাতে বসলো। নিত্যদিনের মতো বোরকা খুলে নিলো।
“ম্যানেজার কই ভাইয়া?”

“অসুস্থ। ফোন দিয়ে জানালো। সেজন্যই আমার আসতে হলো।”

আসিফ নিচু মাথায় ট্যালি খাতায় বিক্রির হিসাব দেখছে আর মহুয়ার কথার জবাব দিলো। সে ক্যালকুলেটরেও হিসাব মিলাচ্ছে। কিন্তু গরমিল হচ্ছে। মহুয়াকে ডাকলো । মহুয়া আসিফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। খাতায় হিসাবটা বুঝিয়ে দিলো আসিফকে।

আসিফ মহুয়ার দিকে তাকালো। দেখলো মহুয়ার কান ও গলা খালি। জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার চেইন ও দুল কোথায়?”

মহুয়া সত্যিটা বললো। আসিফ বললো,

” ঘরের জন্য?সেটার কী ব্যবস্থা হলো?”

মহুয়া সাবেরের কথা বলে সব বললো। আসিফ চিন্তা করে দেখলো আজ দোকান খালি। মহুয়াকে বিষয়টা এবার জানাই। হয়তো মহুয়া রাজী হতেও পারে সব বিবেচনা করে।

আসিফ গম্ভীর গলায় মহুয়াকে বললো,

“তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো। ক্লিয়ার আনসার দিবে।”

“অবশ্যই। বলেন?”
হকচকানো গলায় বলল মহুয়া।

“তুমি কী তোমার হাজব্যান্ডকে ডিভোর্স দিবে?”

“এখনো ভাবিনি মেয়ের কথা ভেবে।”

“তুমি তার কাছে যেহেতু যাবেই না,তাহলে ডিভোর্স না দিয়ে উপায় কী? তোমার অল্প বয়স। পুরো লাইফ সামনে। দ্বিতীয় বিয়ে করা জরুরী তোমার।”

মহুয়া বিস্মিত চোখে তাকায় আসিফের দিকে।
“আমি গরীবের মেয়ে। কে আমাকে বিয়ে করবে? আর এখন এসব আমার মাথায় নেই একদম। আমার মাথায় আছে, আমার পরিবার,আমার মেয়ে।”

“তোমার মেয়ের জন্যও দরকার একজন ভরসার মানুষ।”

মহুয়া মৌন থাকে। আসিফ সংকোচপূর্ণ কণ্ঠে খোলাখুলিভাবে মহুয়াকে সাবেরের প্রস্তাব শোনায়। নিমিষেই মহুয়ার সারামুখে অমাবস্যা ভর করলো। উজ্জ্বল মুখখানা অনুজ্জ্বলতায় ভরে গেলো। নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। কষ্টে, বিরক্তিতে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কেঁদেকেটে নাক মুখ ফুলিয়ে ফেলল। মহুয়ার নাজেহাল অবস্থা দেখে আসিফ বাবার উপর বিরক্ত হলো। ক্যাশের থেকে উঠে গেলো। মহুয়ার দিকে একটি টিস্যু বাড়িয়ে দিলো।

সহানুভূতির গলায় বললো,

“মুখ মুছে ফেলো। সরি তোমাকে কাঁদালাম বলে। ঠিক আছে বাবাকে বলে দিবো যেন উনাকে মানা করে দেয়।”

মহুয়া ফোঁফানো ধরা গলায় বললো,

“হ্যাঁ তাই করুন। উনাকে আমি চাচা বলি। আর উনি ছিহ! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। আমি দরকার হলে মরে যাবো। বাকি জনম একলা থাকবো। তবুও এ অসম্ভব! আমাদের ঘর করে দেওয়া লাগবে না উনার। যা পারি আমরাই করবো। আমি গরিব বলে এতটা পঁচে যাইনি,যে চাচা সম্বোধন করে ডাকা পিতার বয়েসী কারো গলায় ঝুলে পড়বো। কিন্তু আমার ব্যক্তিত্ব আছে। আত্মমর্যাদাবোধ আছে।”

“মরে যাওয়া, একলা থাকা কোন সুস্থ সমাধান নয় মহুয়া। বেঁচে থাকতে হবে। বিয়ে করতে হবে। লড়াই করতে হবে জীবন নিয়ে।”

বিজ্ঞের সুরে বলল আসিফ।

দুপুরে আসিফ দোকান থেকে বের হয়ে গেলো। দু’জনের জন্য দুই প্যাকেট মুরগী পোলাও নিলো। দোকানে এসে মহুয়াকে বললো,

” আমার ক্ষুধা লেগেছে। তুমিও একটু লেট করে যেও আজ। যেহেতু ম্যানেজার নেই। বাইরে গিয়ে খেলে দোকান বন্ধ করে যেতে হবে দুজনের। তাই নিয়ে এলাম। ওই যে প্লেট, গ্লাস সবই আছে। বেড়ে নিজেও খাও। আমাকেও দাও।”

মহুয়া আসিফকে দিলো। নিজেও খেলো ইতস্ততবোধ করে হলেও। ক্ষুধায় তার পেটটাও চনমনিয়ে উঠেছে।

খাওয়া শেষে আসিফ বললো,
“ঘরে আগুন কে দিয়েছে জানতে পেরেছো?”

“নাহ। এখনো পারিনি।”

মহুয়া নিজের ফুফুর কথা গোপন করলো। নয়তো নিজেই ছোট হয়ে যাবে। মহুয়া বিকেলে বাড়িতে গিয়ে দেখে তাদের উঠান ভর্তি জিনিসপত্রে। ঘর তৈরির সরঞ্জামাদি চলে আসলো ভ্যানে করে। সবকিছুর তদারকি করছে সাবের মহাজন। তার উপরে হালিমার কৃতজ্ঞতা অসীম। মহুয়া ক্ষোভ নিয়ে মাকে সব জানালো। হালিমার মাথায় যেন বজ্রপাত পড়লো।

বললো,
” এই ছিলো বেটার মনে? তোরে আমি কই ভাই। আর তুই আমারে মাইয়ারে চাস বিয়া করতে? মন চায় কোপায়া ধড় আলগা কইরা ফালাই। চোখের শরম উইঠা গ্যাছে তার বউ মরার লগে লগে। নইলে তার তুলনায় ল্যাদা মাইয়ারে ক্যামনে বিয়া করতে চায়।”

আসিফ বাড়িতে গিয়ে তার বাবাকে মহুয়ার অমতের কথা জানালো। তিনি সাবেরকে জানিয়ে দিলেন। সাবের ক্রোধে ফুঁসে উঠলো। পরেরদিন সে লোক পাঠিয়ে মহুয়াদের উঠান থেকে ঘর তৈরির সবকিছু নিয়ে গেলো। লোক মারফতে ভয়ংকর হুমকি দিলো মহুয়াদের।

বিষয়টা আর গোপন রইলো না। জানাজানি হয়ে গেলো। তেলা মাথায় তেল সবাই ঢালে। তাই সবাই সাবেরের পক্ষ নিলো। মহুয়া ও তার মাকে বোঝাতে লাগলো যেন সাবেরকে বিয়ে করে মহুয়া। এতে তাদের উপকার ছাড়া ক্ষতি হবে না। কিন্তু মহুয়া ও তার মা কিছুতেই রাজী হলো না।

চলবে…১১