#মহুয়ার_রাতদিন. ১২ ✍️ #রেহানা_পুতুল
মহুয়া ও তার মাকে বোঝাতে লাগলো যেন সাবেরকে বিয়ে করে মহুয়া। এতে তাদের উপকার ছাড়া ক্ষতি হবে না। কিন্তু মহুয়া ও তার মা কিছুতেই রাজী হলো না। সাবের লোক মারফতে ভয়ংকর হুমকি দিলো মহুয়াদের।
হালিমা আবারো মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লো। পরেরদিন মহুয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে আসিফকে ফোন দিলো। পথের একপাশে দাঁড়িয়ে সাবেরের কাণ্ডকীর্তি বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মহুয়ার আকুল কান্না আসিফের হৃদয়কে তোলপাড় করে দিলো।
সে মহুয়াকে আন্তরিক গলায় বললো,
“উনাকে প্রতিহত করার এবং তোমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব আজ থেকে আমার। তুমি নিশ্চিন্তে মনে থাকো। আর ঘর যেভাবে হওয়ার প্ল্যান হয়েছে সেভাবেই হবে। সাবেরের পরিবর্তে বাকি হেল্প আমি করবো। আমি আজ তোমার সাথে তোমাদের বাড়ি যাবো। এমনিতেই তোমার ছোট ভাই মিরনকে দেখতে আসতাম।”
” আজ নয়। ভয় লাগে ভাইয়া। সাবের কাকা শুনলে আবার যদি কোন বদনাম রটায়?”
“ওকেহ, আমি তোমার সাথে যাবো না। শুক্রবার বিকেলে আসবো। ঠিক আছে মহুয়া।”
“হ্যাঁ ঠিক আছে। ধন্যবাদ আমার কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য।”
স্মিত হেসে বলল মহুয়া।
“পথ চলায় কে কখন কীভাবে কার কাছে গুরুত্ব পাবে তা আগে থেকে কেউই জানে না। যাইহোক, এত ভারাক্রান্ত হয়ে থাকলে মানায় না। দোকানে যাও। আমি আসতেছি।”
মহুয়া কান হতে মুঠোফোনটাকে আলগা করে নেয়। দোকানে চলে যায়। ম্যানেজার ফাহিম ক্যাশে বসে আছে। সেদিনের পর হতে সে মহুয়ার সাথে অতিরিক্ত একটি কথাও বলে না। আসিফ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে মহুয়াকে নিয়ে। কিন্তু ভাবনার কোন থই খুঁজে পেল না সে। তাই ভাবনার ইতি ঘটিয়ে দিলো আপাতত। উঠে ফ্রেস হয়ে দোকানে চলে গেলো। দোকানে মহুয়ার সাথে সেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। পেশাদারীত্বভাব বজায় রেখে চলে।
শুক্রবারে আসিফ মহুয়াদের বাড়িতে গেলো। মহুয়ার চাচাদের ঘরে গিয়ে বসলো। সামান্য নাস্তা করলো। মিরনকে দেখলো। হালিমার মন খারাপ দেখে আসিফ জিজ্ঞেস করলো,
“কোন সমস্যা,খালাম্মা?”
“বিপদ যহন আসে তহন চারদিক হইতেই আসে বাবা। মিরনরে আর মিলে কামে রাখব না সাবের ভাই। মিরন গতকাইল গেলো আর খেদায়া দিলো সে। মুখের ভাষাও কর্দয করছে সেই।”
“কী বলল?”
জবাব দিলো মহুয়া। বলল,
“আমার মিলে তুই আর আসবি না। তোদের মতো ছোটলোকদের উপকার করতে নেই। তোরা প্রতিদান দিতে জানিস না। কেবল নিতে জানিস।”
আসিফ স্থির রইলো। পরমুহূর্তেই বললো,
“ভালো হয়েছে এক হিসেবে। মিরন স্পেশাল চাইল্ড! ওর কোন কাজ না করাই ভালো। তুমি যেহেতু চাকরি করছো, তাহলে ও বাড়িতে থেকে তোমার মেয়েকে ও সবকিছু দেখাশুনা করতে পারবে খালাম্মার সাথে থেকে। মিল থেকে ও কিই বা আর এমন বেতন পেতো?”
“তাও কথা।”
আক্ষেপের স্বাস ছেড়ে বলল মহুয়া।
আসিফ বেরিয়ে গেলো উঠানে। মহুয়াদের খালি ঘর ভিটা দেখলো ভালো করে। মহুয়ার মা আসিফকে তাদের ঘর,রান্নাঘর,বাগান দেখিয়ে সংসার জীবনের কিছু স্মৃতিচারণ করলো। সাথে মহুয়া ও মিরনও আসছে। আসিফ বললো,
“আমি কাল ঘর করার মিস্ত্রি পাঠিয়ে দিবো। তারা দেখে হিসেব দিবে আমাকে। আপনারা মা,মেয়ে ঘর করা নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না।”
“যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছেন, তাহলে আগের হিসেবে ঘর হলে আমরা যেই টাকাগুলো সাবের কাকাকে দিতাম, সেটা আপনি নেন।”
নমনীয় চোখে বলল মহুয়া।
“পরে দিলেও হবে। এখন দিতে চাইলেও দিতে পারো।”
মহুয়া ব্যস্ত পায়ে তার চাচাদের ঘরে গেলো। চাচীর স্টিলের আলমারিতে গচ্ছিত রাখা টাকাগুলো নিলো। পা ঘুরিয়ে উঠানে আসিফের নিকট এলো। টাকাগুলো আসিফের হাতে দিয়ে বললো,
“এই নিন ভাইয়া। গুনে নিন।”
আসিফ টাকাগুলো গুনে বললো,
“এত টাকা কীভাবে ম্যানেজ করতে পারলে?”
“আমার নানার বাড়ির আত্মীয়দের কিছু হেল্প আছে। আম্মা বড় দুটো আমগাছ বিক্রি করেছে। আমার কানের এক জোড়া দুল ও গলার একটা সোনার চেইন বিক্রি করে দিয়েছি। বেশী টাকা তো এখান থেকেই এলো।”
“তাই বলো। ঠিক আছে। আমি এখন আসি। কাল মিস্ত্রি পাঠিয়ে দিবো।”
আসিফ টাকাগুলো নিয়ে চলে গেলো।
পরেরদিন মিস্ত্রি দুজন এলো। মাফজোক করে দিলো ঘরের। আস্তে আস্তে ঘরের উঠানে স্তুপ হতে লাগলো ঘর তৈরির সরঞ্জামাদি। দশদিনের মধ্যে মহুয়াদের তিন কামরার ফুলটিনের ঘর তৈরি হয়ে গেলো। হালিমা মসজিদের হুজুর ডেকে ঘর বন্ধক করালো। সার্মথ্যের ভিতরে মিলাদ পড়িয়ে কয়জন মিসকিন খাইয়ে দিলো। আসিফকেও বিশেষভাবে দাওয়াত করেছে হালিমা। আসিফ অপারগ প্রকাশ করেছে আসবে না বলে।
এক নিরিবিলি ভোরে তফুরা মহুয়াদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলো। মহুয়া ও তার মা চমকালো। থমকালো না। বরং এইদিনের অপেক্ষায় মা,মেয়ে প্রমোদ গুনেছিলো। যেহেতু তফুরার আপাদমস্তক বোরকা ও নেকাব দিয়ে আবৃত। তাই মহুয়া চিনেও না চেনার ভান করলো। তারা মা,মেয়ে চুপ করে রইলো। তফুরা বুলবুলিকে নিজের কোলে নিয়ে নিলো। বিনয়াবনত হয়ে সংকোচপূর্ণ গলায় মহুয়ার দিকে চেয়ে বললো,
“আমি ওর দাদী। তোমার কাছে আইছি মামলাটা তুইলা নেওনের জন্য। আমার পোলায় তো তোমারে ছাইড়া দেয়নাই। অস্বীকার করেনাই। তুমি হুদা হুদাই ঝামেলা পাকাইছো। এই নাদান মাইয়াটারে বাপের মহব্বত থেইকা সরাইয়া রাখছো। তুমি চইলা আসো বাড়িতে।”
“আপনি চলে যান। মামলা তুলব না। আইনমতে তার প্রাপ্য সাজা পেয়ে গেলে এমনিতেই জামিন হয়ে যাবে।”
টনটনে সুরে প্রতিউত্তরে বলল মহুয়া।
“কিন্তুক বিপদ তো আরেকখানে। আমান তিন মাসের ছুটিতে আসছে। বিদেশের কোম্পানিরে লোক দিয়া বলাইছি,আমান হাসপাতালে। অনেক অসুখ। এক মাস ছুটি দিছে। নইলে আরো একমাস বাড়ান যাইবো। এর বেশী হইলে তার চাকরি থাকব না।”
মুখের নেকাব সরিয়ে নিরীহ স্বরে কথাগুলো বলেই মরা কান্না জুড়ে দিলো তফুরা।
“যার কর্ম যেমন তার ফলও তেমন। তার চাকরি বাঁচানোর দায়িত্ব আমার নয়। আপনি আসতে পারেন। ডিভোর্স লেটার চলে যাবে আপনাদের বাড়ি।”
তফুরা হতাশ হলো। বিদীর্ণ মুখে উঠে চলে গেলো নিজের গন্তব্যের দিকে। জেলখানায় গিয়ে ছেলেকে জানালো বিষয়টা। আমার মুখকে বিকৃত করে ফেলে। তার ঘনিষ্ঠ একটি ছেলের নাম বলে মাকে। এবং বলল, সেই ছেলে যেন তার সাথে দেখা করে শীঘ্রই।
মহুয়াদের ঘর আসিফ দায়িত্ব নিয়ে খরচ দিয়ে তুলে দিয়েছে। এ খবর চাউর হয়ে গেলো আড়ালে আবডালে। সাবের বিষ্ফোরক হয়ে উঠলো। আসিফের বাবাকে নরম গলায় জানালো বিষয়টা। শুনে কাশেম উত্তেজিত হলো। তিনি রাতে আসিফকে জিজ্ঞেস করলেন সত্যতা যাচাইয়ের জন্য।
“কিরে তুই নাকি মহুয়াদের ঘর তুলে দিলি?”
আসিফ বিনাবাক্যে স্বীকার করে নিলো।
“বাবা ঘর মিস্ত্রিরা তুলেছে। আমি নই।”
“বের্ত্তুমিজ পোলা! বাপের ভুল ধরিস? কিছুদিন আগে আমারে প্রশ্ন করলি আমি কবে থেইকা এতো দানশীল হইলাম। একই প্রশ্ন আমিও তোরে করতাছি। উত্তর দে।”
“ঘরের অর্ধেক টাকা তারা দিয়েছে। বাকি অর্ধেক আমি দিয়েছি বাকিতে। কারণ মহুয়া আমার দোকানে চাকরি করে। তার বেতন থেকে কেটে নিবো। এবং ঋণের দায়ে সে চাকরি ছাড়ার নাম নিবে না মুখে। তাকে দিয়ে দোকানে ভালো প্রফিট হয়।”
“নাকি অন্যকিছু?”
“যা ভাবেন আপনারা।”
আসিফের মা আফিফা চনচন করে উঠলো।
“জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পাইছে তোর? কই আগরতলা কই উগিরতলা? সাবের ভাই শুনলেও বা কী কইবো?”
কাশেম শাসনের সুরে ধমকে উঠে বললো,
“যদি এমন কিছু ঘটে। তাইলে আমার ঘরের দুয়ার তোর লাইগা বন্ধ। মান ইজ্জত বলে কিছু থাকবো সমাজে?”
“যেটা আমার মাথায় নেই সেটাই আপনারা ভেবে বসে আছেন। এই মেয়ের সাথে আমার ভালো করে আলাপই হয় না। আবার প্রেম,বিয়ে? সে আমার দোকানের একজন বিশ্বস্ত ভালো কর্মী। এর বাইরে আর কিছুই না। ওরা নিঃশ্ব! অসহায়! তাই ওদের পাশে দাঁড়িয়েছি,সহমর্মিতা দেখিয়েছি মানবিকবোধের জায়গা থেকে। ব্যাস!”
ক্ষ্যাপানো স্বরে কথাগুলো বলেই বের হয়ে যায় আসিফ।
এদিকে তোড়জোড় করে শিউলিকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিলো তার পরিবার। কেননা তারা জানতে পারলো, মহুয়া মামলা তুলে নিবে না। আমানকে পুরো দুই বছর সাজা ভোগ করতে হবে। তার বিদেশ যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেলো। তার স্থানে মালিক নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। সুতরাং তার আশায় মেয়েকে ধরে রাখা বোকামি। এই খবর আমান জেনে গেলো।
মহুয়ার উপর আমান, তফুরা,শিউলি, তার মা,বাবা, মহাজন সাবের,কাশেম,ম্যানেজার ফাহিম সবাই ক্রোধান্বিত! সবার আক্রোশ! সবার দিগুন বিরুক্তি!
তারপর এক ঊষালগ্নে মহুয়া আটকা পড়লো সাবেরের ঘরে। সাবের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। মহুয়াকে টেনে নিজের বিছানার উপরে নিয়ে ফেললো। হিংস্র শার্দূলের মতো আগ্রাসী থাবায় মহুয়ার গায়ের সমস্ত পোশাক খুলে নিলো। পাঞ্জাবী খুলতে খুলতে বিশ্রী গালি দিয়ে বললো,
“মাইয়া তোরে এখন রক্ষা করার কেউই নাই। তোর নাগর আসিফ তার গ্রামে নাক ডাইকা ঘুমাইতাছে।”
মহুয়া খাঁচায় বন্দী পাখির ন্যায় ছটপটাতে লাগলো শত মিনতি করে। লাভ হলো না। সাবের তার কাজ শুরু করে দিচ্ছিলো,ঠিক তক্ষুনি তার দরজায় করাঘাত হলো বিকট শব্দে। সাবের ক্ষেপে গিয়ে দরজা খুললো। নয়তো বাড়ির অন্য ঘরের লোকজন এসে যাবে। মহুয়া কাঁপতে কাঁপতে সেলোয়ার জামা পরে নিলো।
আগুন্তক ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল। সাবেরের গলা টিপে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
“মিরনকে কোথায় গুম করছিস লুইচ্চা?”
পুরুষালী গলা শুনে মহুয়া রুমের আড়াল হতে উঁকি মারলো। দেখলো তার সেই পুরোনো প্রিয়মুখটি। বিস্ময়ে! লজ্জায়!সংকোচে মহুয়ার মরে যাওয়ার উপক্রম!
চলবে…১২