#মহুয়ার_রাতদিন. ১৬ ✍️ #রেহানা_পুতুল
মহুয়ার মুখ বেঁধে ফেলে একজন যুবক। বাকিজন বললো,
“এবার যত পারিস চিল্লা সুন্দরী! একটু পরে দেয়ালের ভিতরের কুদাকুদি বাইরে থেকে কোন পক্ষীও টের পাইবো না।”
বলেই দু’জন অচেনা যুবক ডেভিল হাসি দিলো উচ্চস্বরে!
একটি নির্জন স্থানে গিয়ে সিএনজি থামে। যুবকদ্বয়ও নেমে পড়লো। একজন চালককে ভাড়া মিটিয়ে দিলো। বললো,
“নেন। ডাবল আছে কথামতো।”
চালক চলে গেলো দ্রুত।
মহুয়া বের হয়েই মুখ বাঁধা অবস্থায় দৌড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো। পারল না। পিছন থেকে হাতে টান পড়ে। যুবক দু’জন মহুয়াকে একটি নির্জন রুমের ভিতরে নিয়ে গেলো। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। মহুয়ার মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে বললো,
“এবার যা ইচ্ছা জিগাও। উত্তর পাইবা।”
“আমাকে তুলে এনেছেন কেন? আমি কী করেছি? কে আপনারা দু’জন?”
ভয়ার্ত স্বরে জানতে চাইলো মহুয়া।
“তোমারে তুইলা আনছি হাডুডু খেলার জন্য। তুমি আমি আর ও। তিনজন মিলে জম্পেশ খেলাধূলা হবে। মজা তিনজনই পামু। সমানসমান। তুমি কি করছো? তুমি আমান মিয়ার লাইফের শুধু বারোটা নয় চৌদ্দটা বাজায়া দিছো। দ্বিতীয় বউ চইলা গ্যালো। বাসরের সুখটাও পাইল না। তুমিও দিলা তালাক। বেচারার মা মইরা গ্যালো। ভালো কইরা মায়ের মুখটাও দেখতে পারল না। বিদেশ যাওয়া ক্যান্সেল হইলো। ভিসার মেয়াদ ফুরালো। চাকরি চইলা গ্যালো। দুই বছর জেলে পঁইচা মরবো। আর তুমি বাইরে আরামের হাওয়া খাইতাছো। এইটা হয়? তাই আমান মিয়া তোমার তেজ কমাইতে কইলো। এতে তোমার ইজ্জত হইবো লুট। মাথা হইবো হেঁট। আমান পাইবো দিলে কিছু সুখ।”
পাশ থেকে বাকি যুবক বললো,
“আমরা কী পামু?”
অপরজন বললো,
“আমরা ডাবল খাজনা পামু। সুখ ও ট্যাকা।”
মহুয়া ভীতসন্ত্রস্ত! তাদের দিকে করুণ চোখে চেয়ে কাতর গলায় বললো,
“আমার ছোট্র মেয়ে আছে বাড়িতে। আমাকে না দেখে কান্না করছে। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।”
“ওমা! তোমারে ছাইড়া দিলে আমাদের লাভ? কিরে কী কয়?”
” আপনারা টাকা পেয়েছেন আমাকে তুলে আনার জন্য। এটাই তো লাভ।”
ভিখারির মতো নিরীহ গলার বলল মহুয়া।
“তোমারে যে খাইতে কইলো? খামু না?”
মহুয়া উত্তেজিত হলো না। ঘৃণাভরা চোখে তাদের দিকে চাইলো না। ঘৃণা, জেদ দিয়ে সব সময় পার পাওয়া যায় না। কোমল আচরণ করতে হয়।
মহুয়া বললো,
“আমি যদি আপনাদের মায়ের পেটের বোন বা অন্য কোন বোন হতাম,আপনারা এমন কুৎসিত মনোভাব পোষণ করতে পারতেন আমাকে নিয়ে? আমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দিন। সে তার মায়ের জন্য কাঁদছে ভাই।”
মহুয়ার কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না একটি ছেলে। সে মহুয়ার বোরকা খুলে নিলো। বুক থেকে ওড়না নিয়ে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়। কুকুরের মতো জিভ চাটতে লাগলো মহুয়ার বুকের দিকে চেয়ে। মহুয়ার পুরো শরীর হাতড়াতে লাগলো কোনকিছু খোঁজার মতো করে। বাকি ছেলেটা তাকে থামালো।
মহুয়াকে বললো,
“তোমার কথা বিবেচনা করতে পারি এক শর্তে। বিনিময়ে ক্যাশ চাই বড় অংকের। কও কারে ফোন মারলে কাজ হইবে?”
মহুয়া আসিফের কথা বলল পরিচয় গোপন করে। এছাড়া তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার মতো আর কেউই নেই। মিজান থাকলেও চলতো। কিন্তু সেতো দূরে।
“নিউ নাগর নাকি? তোমার মোবাইল দিয়া কথা কও। এই ব্যাংক একাউন্টে মাত্র ৫০ হাজার পাঠাইতে কও। আর কিছু কইবা না। ধরো,লেইখা দিলাম।”
হুমকি দিয়ে বলল তারা।
আসিফের ফোন বেজে উঠলো। মহুয়ার নাম্বার দেখে দ্রুত রিসিভ করলো। মহুয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
“আমি খুব বিপদগ্রস্ত ভাইয়া। এখনো বাড়িতে যেতে পারিনি। সম্ভব হলে ব্যাংকে ৫০ হাজার টাকা পাঠাবেন। আমি পরে শোধ করে দিবো। নাম্বার মেসেজ করে দিচ্ছি।”
“আমি এক্ষুনি দিচ্ছি মহুয়া। তুমি বাড়ি যাও নি কেন?”
মহুয়ার ফোন কেড়ে নেয় ছেলে দুটো। আসিফ ঠিক বুঝতে পারলো না মহুয়ার কী রকম বিপদ! সে ততড়িঘড়ি করে নিকটস্থ থানায় চলে গেলো। মহুয়ার পরিচয় দিয়ে পুলিশদেরকে সব বললো। পুলিশের সাইবার টিম, মোবাইল নাম্বার ধরে লোকেশন ট্র্যাক করে ফেললো। আসিফ পুলিশ নিয়ে গন্তব্যের কাছাকাছি চলে গেলো। ভাগ্যিস নাম্বার অফ করে ফেলেনি। আসিফ ও পুলিশ বুদ্ধি করে মহুয়ার ফোনে কোন কল করেনি। তারা লোকেশন অনুযায়ী দুটো বাসা পেলো। একটাতে খোঁজ করে মহুয়াকে পেল না। বাকি দালানের নিচতলায় প্রবেশ করলো তারা। কেউ নেই। ভিতর হতে বন্ধ একটা রুম পেলো।
আসিফ সেই বাড়ির মানুষকে খুঁজে বের করলো। তাদেরকে বিষয়টা অবহিত করলো। তারা কয়েকজন সেই রুমে গিয়ে নক করলো। পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন পুলিশ ও আসিফ। ভিতর হতে দরজা খোলা হলো। সবাই হুড়মুড় করে ভিতরে প্রবেশ করলো। বাড়ির মানুষ একজনের দিকে বিষ্ফোরক চাহনি নিক্ষেপ করলো। পুলিশ দু’জন যুবককে গ্রেফতার করলো।
এবং বললো,
“চোর চুরি করে যাওয়ার সময় ভুল করে একটা প্রমাণ রেখে যায়। এতে তাকে শনাক্ত করতে সহজ হয়। উনার নাম্বার অফ করতে ভুলে গেলে?”
তারা দু’জন একে অপরের দিকে আহাম্মকের ন্যায় প্রশ্নাতুর চোখে চাইলো।
পুলিশ তাদের জিজ্ঞেস করলো,
“এই রুম কে ঠিক করে দিলো তোদের?”
পাশ হতে বাড়ির এক বাসিন্দা একজনকে দেখিয়ে বললো,
“স্যার ওতো এই বাড়ির চারতলার ছেলে। কিন্তু ও যে এতো জঘন্য কাজের সাথে জড়িত টাকার লোভে তা এখন জানলাম এবং স্বচক্ষে দেখলাম।”
“কিইই!” বলে পুলিশ চমকে উঠলো। ভিমরি খেলো। সাথে মহুয়া ও আসিফও। পুলিশ আসিফের দিকে চেয়ে বললো,
“থ্যাংক ইউ মিস্টার আসিফ,সমাজের এমন কীটদের ধরতে হেল্প করার জন্য। আপনার স্টাফকে নিয়ে যেতে পারেন। এদেরকে থানায় নিয়ে গরম ডলা দিচ্ছি।”
পুলিশ ছেলে দুজনকে ধরে নিয়ে গেলো। মহুয়া এতক্ষণ দেয়ালের সাথে সিঁটিয়ে ছিলো। আবেগে আপ্লুত হয়ে আসিফের দু’হাত ধরে ফেলল। আসিফ মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“আমি আছি। ভয় পেয়ো না। কাহিনীটা কী?”
“ফোনে বলবো ভাইয়া। এমনিতেই আম্মা চিন্তায় মরে যাচ্ছে।”
“ওকেহ। আসো রিকশা নিয়ে দিই। আমি ৫০ হাজার সাথে নিয়েই বের হয়েছি।”
মহুয়াকে আসিফ রিকসায় তুলে দিলো। মহুয়া বাড়িতে গিয়েই মেয়েকে বুকে লেপ্টে নিলো। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মাকে সব বললো। হালিমা নির্বাক! বাক্যহারা! আশ্চর্য হয়ে অসহায় সুরে বললেন,
“আল্লারে! মানুষ এত জানোয়ার ক্যামনে হয়? এই লাইগা ঘর করা বউর ইজ্জত নিতে চাইলো কমজাতের পোলা কমজাত? আরে চামার, কেউ শত্রুরও তো এতবড় ক্ষতি করতে চায় না। আর তোর লগে ত আমার মাইয়া ঘর করছে। এক বিছানার শুইছে।”
“মা, আসিফ ভাই,মিজান ভাই, মানুষ না, ফেরেশতা আমাদের জীবনে।”
“এক্কেরে সত্য কইছস মা। যা ভাত খাইয়া ল।”
আচম্বিতে ঘটে যাওয়া বিশ্রী ঘটনার তিক্তকর অভিজ্ঞতা নিয়ে মহুয়া ভাত খেয়ে উঠলো। রাতে আসিফকে ফোন দিয়ে সবিস্তারে জানালো।
আসিফ উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
“দেখলে, তুমি একাকী বলে বারবার বিপদের সম্মুক্ষীন হচ্ছো। তোমাদের ঘর পুড়িয়ে দিলো। তোমার ভাইকে গুম করলো। তোমার সম্ভ্রম হানির চেষ্টা করলো। তোমাকে বিয়ে করতে চাইলো সাবের মিয়া। আজ তোমাকে তুলে নিলো। ভাড়াটে ছেলে দিয়ে সেই একই কাজ করাতে চাইলো তোমার মেয়ের বাবা। যদি তোমার পাশে একজন সঙ্গী থাকতো, মানে তোমার হাজব্যান্ড,তাহলে কখনোই এক উদ্ভট! ভয়াবহ সমস্যাগুলো সৃষ্টি হতো না।”
“আপনি ঠিক বলেছেন। আচ্ছা তেমন পাত্র পেলে বিয়ে বসবো।”
“আমার কাছে আসতে আপত্তি কেন?”
“এটার আনসার আপনার জানা। তবুও ফাইনালি বলছি। আর্থ সামাজিক বিচারে উঁচু নিচুতে বন্ধুত্ব হতে পারে। প্রেম হতে পারে। কিন্তু চিরদিনের সম্পর্ক বিয়ে হতে পারে না। করজোড়ে মাফ চাই।”
নির্মোহ স্বরে জানালো মহুয়া।
আসিফ থেকে মহুয়া বিদায় নেয়। ডুবে যায় চিন্তা ও কল্পনার মাঝ সমুদ্রে। কোন থই খুঁজে পায় না মহুয়া। তার পরের সপ্তাহে মিজান আসে বাড়িতে। মহুয়াদের বাড়ি আসে হালিমার সাথে দেখা করতে। হালিমা পরেরদিন দুপুরের জন্য মিজানকে দাওয়াত করে। মিজান গ্রহণ করে হাসিমুখে।
সেই দুপুরে মিজান ভাত খেয়ে হালিমাকে সরাসরি বলে,
“চাচী,আপনার আপত্তি না থাকলে মহুয়াকে আমাদের ঘরের বউ করতে চাই।”
শুনে পাশে বসা মিরন উৎফুল্ল হয়ে উঠে। আনন্দভরা চোখে মিজানের দিকে চায়। হালিমাও অত্যন্ত খুশী হয়।
বলে উঠে,
“বাবা,তুই আমার লগের বাড়ির ভাসুরের পোলা। ল্যাদাকাল হইতে তোরে চিনি আমি। আমার কোন আপত্তি নাই। কিন্তু তোর ঘরের মানুষ মাঝেমইধ্যে মহুয়ার আগের সংসারের কথা তুইলা খোঁটা মারবই। আইজ কইব না। কাইল কইবো। নয়তো পরশু বাদে তরশু কইবো। নয়তো ছয়মাস বাদে কইবো। তাই আমার মনে হয় না মহুয়া তোর প্রস্তাবে রাজী হইবো। মহুয়া আমার মাইয়া। সবার চাইতে ভালো কইরা চিনি আমি। সে আইলে আমি তোর হইয়া বুঝায়া কমুনি।”
“আপনি বইলেন। আমি সন্ধ্যার পর এসে বলবো তাকে।”
মিজান চলে যায়। তার বিশ্বাস মহুয়া রাজী হবে। এই মহুয়াই একসময় তাকে দেখলে পা বাড়িয়ে এগিয়ে যেতো। কথা বলার নানা অজুহাত খুঁজতো।
মহুয়া বাড়ি এলে হালিমা মিজানের বিষয়টা বললো। মহুয়া চুপ রইলো। মাকে কিছু বলল না। মিজান রাতে এলো মহুয়াদের বাড়ি। মহুয়া তার রুমে বিছানায় শুয়ে মেয়েকে স্তন পান করাচ্ছে। মিজান দরজার সামনে থেকে দৃশ্যটি দেখেও না দেখার ভান করলো।
বললো,
“আসতে পারি মহুয়া?”
“কে? মিজান ভাই। আসেন।”
মহুয়া শশব্যস্ত হয়ে কামিজের সামনের বোতামগুলো লাগিয়ে নিলো। বুকের উপর ওড়না মেলে দিলো। মিজান রুমে গিয়ে মহুয়ার পাশে চৌকির উপরে বসলো। বললো,
“তাড়াহুড়ো করে বুকের বোতামগুলো উপর নিচ করে ফেলছিস। লাগিয়ে নিস ঠিক করে।”
মহুয়া অপ্রতিভ হয়ে উঠে। মনে মনে বলে,
পুরুষের চোখ মেয়েদের বুকে কী খোঁজে এতো? পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মা বলল আপনি দুপুরে খেয়েছেন আমাদের ঘরে। আমি খুব খুশী হয়েছি।”
“আম্মা আর কিছু বলে নি?”
“বলছে।”
“উত্তর জানতে এলাম।”
“মা, যা বলছে সেটাই আমার উত্তর মিজান ভাই। আপনাকে আমি পছন্দ করি। আমার এই পছন্দ আমৃত্যু বহমান থাকবে। কিন্তু গ্রামের বিষয় তো আপনি জানেন। আপনার পরিবার ও লোকে বলবে, তালাকপ্রাপ্তা মহুয়া মেয়ে নিয়ে অবিবাহিত মিজানের কাঁধে চড়ে বসলো। আরো নানা কুরুচিপূর্ণ কথা রটাবে। লাগোয়া বাড়ি। আমার মায়ের কানে আসবে সব কথা। সহ্য করতে না পেরে মা জবাব দিবে। এতে মন কষাকষি তৈরি হবে দুই পরিবারে। তারচেয়ে বর্তমানের সম্পর্কই ভালো।”
“আমি তোকে ও বুলবুলিকে আগলে রাখবো। আমার কাছে নিয়ে যাবো। কেউ দুকথা বলারও সুযোগ পাবে না।”
“না,মিজান ভাই। এ হয় না। আমি নিজের ভালোর জন্য স্বার্থপরের মতো আমার বিধবা মাকে, একমাত্র অসুস্থ ভাইটাকে ফেলে কোথাও যাব না। যেভাবে আছি চলে যাচ্ছে জীবন।”
মিজান মহুয়ার দুহাত টেনে নিজের বুকে চেপে ধরলো। বললো,
“এটাই তোর শেষ কথা? আমার চাওয়ার মুল্য দিবি না?”
“হ্যাঁ। এটাই আমার শেষ কথা। মূল্য অবশ্যই আছে। সবসময় আপনি বন্ধু হয়ে, ছায়া হয়ে আমাদের পরিবারের পাশে থাকবেন। এটা আমার একান্ত চাওয়া ও অনুরোধ! আর বিয়ে করে ফেলেন। দেখবেন খারাপ লাগাটা কেটে যাবে মিজান ভাই।”
মোলায়েম গলায় অনুগত হয়ে বলল মহুয়া। মিজান বুক হতাশ মনে বাড়ি ফিরে যায়।
একদিন বিকেলে দোকান শেষে আসিফ বাইরে দেখা করে মহুয়ার সাথে। পূর্বের বলা রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেয় দু’জন। আসিফ মহুয়াকে বুঝায় তাকে বিয়ে করার জন্য। মহুয়া একব্যাকে মানা করে। আসিফ মহুয়ার একহাত টেনে নেয়। পকেট থেকে মহুয়ার সেই কানের দুলজোড়া ও গলার চেইনটা বের করে। মহুয়ার হাতে গুঁজে দেয়। ঘটনা খুলে বলে
এবং আরো বলে,
“ইচ্ছে ছিলো বাসর ঘরে এসব ফেরত দিয়ে তোমাকে চমক দিবো। কিন্তু সেই সুযোগ যেহেতু হবেই না। তাই এখন দিয়ে দিলাম।”
এক আসমান বিস্ময় ও মুগ্ধতা মহুয়ার হৃদয়ে আছড়ে পড়ে সমুদ্রের ফেনিল উচ্ছ্বাসের মতো। আসিফের দুহাতের পিঠের উপরে নিজের কপাল ঠেকিয়ে ধরে। হৃদ্যতাপূর্ণ ভেজা গলায় বলে,
“যদি পারতাম আমি আপনার হতাম।”
আসিফ নিরব রয়। গম্ভীর মুখে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মহুয়া জড়ানো পায়ে বাড়ি ফিরে আসে। মাকে সব বলে। শুনে হালিমা বলে,
“মারে, জীবন তোর। ভালোমন্দ তুইই আমার চাইতে ভালো বুঝিস। আমি মুরুক্ষ মানুষ আর কি কমু?”
মহুয়া ঠিক করে চাকরিটা ছেড়ে দিবে। দেওয়া উচিত। কেননা দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা থাকলে আসিফের হৃদয়ে ব্যথা জাগতে পারে। তার নিজের কাছেও বিব্রতকর লাগবে। মহুয়া কয়েক মাস ধরে একটু একটু করে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। চাকরি করে কিছু টাকা জমিয়েছে। সেই গলার হার ও দুলজোড়া আবার বিক্রি করে দিলো। তারপর ছোট্ট একটা কাপড়ের দোকান দিলো বাজারে। আসিফের দোকানের চাকরিটা ছেড়ে দিলো। আসিফ আটকালো না মহুয়াকে। সাপোর্ট দিলো। দোকান নিয়েও রাতদিন ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয় মহুয়াকে। পাশে নেই মিজান। নেই আসিফ। সবাই সবার মতো করে নিজের জীবন সাজাতে ব্যস্ত! এটাই বাস্তব! এমনই হয়।
তার এক বছরের ভিতরে মিজান বিয়ে করে ফেললো। আসিফও বিয়ে করলো পরিবারের চাপের মুখে। আমান জেল থেকে জামিন পেলো। তার নিস্ক্রিয় দেহে রোগ বাসা বাঁধলো। বেকার ও অসুস্থ! তাই আর তৃতীয় বিয়ে করতে পারে নি। রোগে,শোকে,যন্ত্রণায়,বিষিয়ে আসা মন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে সে। ভাইবোন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
তার আরো এক বছর পরের কথা। সময় বৈশাখ মাস। তখন বুলবুলির বয়স তিন। বৈশাখি মেলা হচ্ছে স্থানে স্থানে। মিরন বায়না ধরলো বোনের কাছে,ঘুরতে যাবে বলে। মহুয়া, ভাইকে ও বুলবুলিকে নিয়ে চড়ক মেলায় ঘুরতে গেলো। দেখতে পেলো একই মেলায় আসিফ ও নিজামকে। দু’জনেই বউ নিয়ে ঘুরতে এসেছে।
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। সবাই চলে যাচ্ছে একে একে। মেলার স্থান ফাঁকা হয়ে এলো। আসিফ বউকে দাঁড় করিয়ে মহুয়ার কাছে এলো।
“কেমন আছো মহুয়া? কেমন যাচ্ছে তোমার রাত- দিন?”
“মহুয়াদের রাত-দিন বলে আলাদা কিছুই নেই। তাদের আকাশে কখনো রঙধনু উঠে না। পাখিরা উড়ে না। তাই তাদের রাত-দিন একই। ধূসর! বিবর্ণ! এটাই হয়তো মহুয়াদের নিয়তি।”
প্রসন্ন চোখে তাকিয়ে বলল মহুয়া।
“দোয়া রইলো তোমার জন্য।”
আহত গলায় বলে আসিফ চলে যায় বউর ডাক পেয়ে।
মিজান এগিয়ে আসে মহুয়াকে দেখেই।
“আমার প্রাণের পড়শী। তবুও দেখি না। আমি জানি তুই ভালো নেই। কিন্তু আমি তোকে ভালো রাখতে চেয়েছিলাম।”
দুঃখ করে বলল নিজাম।
“চাইলেই কী সবাইকে ভালো রাখা যায়? ভালো থাকা যায়? নিয়তির ছকে বাঁধা আমাদের জীবন। যার জীবন যেভাবে কাটার কাটবেই।”
নিরস হেসে বলে মহুয়া।
মিজান তপ্ত স্বাস ফেলে মহুয়ার জন্য। চলে যায় পা ঘুরিয়ে।
মহুয়ার আঁখিদুটি জলে ভরে যায়।
আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। থেমে থেমে গর্জন করছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার পূর্বাভাস! মহুয়া ত্রস্তপায়ে রাস্তা পার হয় মেয়ে ও ভাইকে সঙ্গে করে।
এভাবেই মহুয়ার রাত কাটে, দিন কাটে। জগত সংসারে কিছু মহুয়াদের জীবনে উপভোগ নেই। উদযাপন নেই। উল্লাস নেই। আছে শুধু কোনভাবে সময়টাকে পার করে জীবনের বেলাভূমিতে পৌঁছে যাওয়ার নিরন্তর প্রয়াস!
সমাপ্ত।