মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-১০

0
55

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ১০

শীতলের চুল তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে বহ্নি। শীতলের হাঁচি শুরু হয়ে গেছে। শীত হোক বা গরম, অসময়ে গোসল করলেই শীতলের হাঁচি কাশি শুরু হয়ে যায়। তাও আবার এতো রাতে। গোসল না করেও উপায় ছিলোনা। কেঁচোটা চুল থেকে সোজা ঘাড়ে, হাতে এসে পড়েছিলো। শীতল কোনোরকমে চিৎকার করে নিস্তার পেয়েছে। চিৎকার শুনে বহ্নি আর আভা ছুটে এসে দেখে শীতল নাগ-নাগিনীর নৃত্য দিচ্ছে। সে এক অবাক করা দৃশ্য।

বহ্নি শীতলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,”কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না উৎস তোর চুলে কেঁচো ছেড়ে দিয়েছে।”
শীতল রাগান্বিত হয়ে বললো,”আমি কি মিথ্যা বলছি আপা?”
বহ্নি আমতা আমতা করে।
“কি হলো বল? আমি মিথ্যা বলছি?”
“না না তা বলিনি। কিন্তু ও তো তেমন ছেলেই না।”
শীতল দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললো,”না সে মহাপুরুষ, বাবার ভাষায় পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধতম মানুষ। সে যে তলে তলে কি টেম্পু চালাতে পারে আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?”

“কিছু বলছিস শীতল?”
শীতল কিছু বলতে যেয়ে থামে, আবারও কয়েকটা হাঁচি দিয়ে বসে।
এতোক্ষণ সব কিছু দরজায় দাঁড়িয়ে হজম করার চেষ্টা করছিলো আভা। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মেজো আপা সকালে কেঁচো খুঁজছিলো কি ব্যবচ্ছেদ না কি করার জন্য। সেই কেঁচো উৎস ভাইয়ের কাছে গেলো কীভাবে? মেজো আপার চুলেই বা গেলো কীভাবে? সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

“এই হাবা।”
উৎসের ডাকে চমকে ওঠে আভা। কখন যে লোকটা পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি সে।
“আপনি আবার আমাকে হাবা বলছেন উৎস ভাই?”
“আমি আভা-ই বলি, তুই শুনিস হাবা। কারণ তুই আসলেই হাবা।”
“উৎস ভাই…..”
“হচ্ছে কি ওদিকে? চিত্রপ্রদর্শনী নাকি?”
আভা কোমরে হাত বেঁধে বললো,”আপনি মেজো আপার চুলে কেঁচো ছেড়ে দিয়েছেন কেনো? আপার যে এখন গোসল দিতে হলো। এমনিতে আপার ঠান্ডার সমস্যা। এতো রাতে গোসল দিয়ে যদি আপার নিউমোনিয়া বেঁধে যায়।”
“আহা রে খুকী, নিউমোনিয়া হবে নাকি।”
“কিছু বললেন?”
“না, তুই যেয়ে বোস ওখানে। আমি ওষুধ এনে দিচ্ছি।”
আভার মুখ হাঁ হয়ে যায়।
“আপনি ওষুধ এনে দিবেন?”
“তোর সমস্যা আছে?”
আভা মুখ বাঁকিয়ে বললো,”আমার আবার কি সমস্যা?”
“তাহলে যা। আর হ্যা যেয়ে তোর গাধী মেজো আপাকে বল, সে যা চাইছে তাই হবে। সে মন থেকে আমাকে কিছু খাওয়াতে চায় আর আমি খাবোনা তাতো হয়না।”
আভা মাথা চুলকাতে থাকে, কিছুই মাথায় ঢোকেনা তার। কি চলছে তার মেজো আপা আর উৎস ভাইয়ের মধ্যে?

রাত প্রায় আড়াইটার দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় শাহানার। পাশে হাত দিয়ে মনে হলো নওশাদ পাশে নেই। তাড়াতাড়ি করে উঠে শাহানা দেখলো বারান্দার টিমটিমে আলোয় নওশাদ মাথা ঝুঁকিয়ে কি যেনো করছে। রাত জাগা নওশাদের পছন্দ না। সে বরাবরই দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে ভোরবেলা উঠে যাওয়া মানুষ। এতো রাতে সে জেগে কি করছে?

নওশাদের পিছনে যেয়ে দাঁড়াতেই শাহানা দেখে সে বারান্দার চেয়ারের উপর বেশ কিছু টাকা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। বাকিটা সে গুণছে এক এক করে। শাহানা অবাক হয়। এতো রাতে টাকা গোণার কি আছে বারান্দায় বসে?

“বহ্নির বাবা।”
নওশাদ চমকে উঠে পিছনে তাকায়। তাড়াহুড়ো করে টাকাগুলো আবার খামের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে সে। শাহানা ভ্রু কুঁচকে স্বামীর কান্ডকারখানা দেখে। স্ত্রীর সাথে এতো লুকোচুরি কিসের?
নওশাদ উঠে এসে শাহানার সামনে দাঁড়ায়। তার মুখটা হাসি হাসি।
“শাহানা ঘুম ভেঙে গেলো কেনো তোমার? ভয় পেয়েছো একা?”
শাহানা কঠিন গলায় বললো,”ঢং রাখো, বয়স হলো এতো। দুইদিন পর শ্বাশুড়ি হবো। এখনো নাকি একা ঘরে ভয় পাবো আমি।”
নওশাদ খোলা গলায় হাসে বেশ কিছুক্ষণ। শাহানা বুঝতে পারে, মানুষটা কিছু গোপন করতে চাচ্ছে তার কাছ থেকে। কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবে এখন সে।
“তা ভালো, মাঝে মাঝে একটু মনে করিয়ে দিও যে তোমার বয়স হচ্ছে। মাঝে মাঝে তো ভুলেই যাই বউটা আমার বুড়ি হয়ে যাচ্ছে, দুইদিন পর শ্বাশুড়ি হবে। সে নিজেই এখনো কিশোরী আমার কাছে। মাঝে মাঝে বহ্নির পাশে দাঁড়ালে তো তোমাদের দুই বোন মনে হয়।”
শাহানা খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে নির্বিকার মুখে চেয়ারে এসে বসে।
“একসময় তোমার এসব সংলাপ ভালো লাগতো। উন্মাদের মতো শুনতাম, খুশি হতাম। এখন বিরক্ত লাগে।”
নওশাদ হাঁটু ভাঁজ করে শাহানার সামনে মেঝেতে বসে। শাহানা দূরে তাকিয়ে আছে। দুই/একটা রাতজাগা পাখি মাঝে মধ্যে উড়ে যাচ্ছে। ভালোই লাগছে তার দেখতে।
“এখন ভালো লাগেনা কেনো? আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তাই?”
“দেখো বহ্নির বাবা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হলো বিশ্বাস, একে অন্যের প্রতি ভরসা রাখা আর একে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা সময় আর কোনো শারিরীক সম্পর্ক হয়না। তবুও তারা শেষ জীবন পর্যন্ত বছরের পর বছর একসাথে থাকে কীভাবে? এই বিশ্বাস, ভরসার জোরেই।”
নওশাদ ভরাট গলায় বললো,”আমাদের মধ্যে কি সেই বিশ্বাস, ভরসা নেই?”
শাহানা আচমকা নওশাদের চোখে চোখ রাখে। নওশাদ কিছুটা ভড়কে যায়। শাহানাকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে।
“না নেই।”
নওশাদ আহত দৃষ্টিতে তাকায়।
“নেই বলছি তারও কারণ আছে। তুমি আমার মতামতের মূল্য দাওনা। আমি যে তোমার স্ত্রী, তোমার তিন সন্তানের মা এটা ভুলে যাও তুমি মাঝে মাঝে। এই বাড়িতে আমি নামেই তোমার স্ত্রী। কিন্তু সবকিছু হয় তোমার কথাতেই।”
নওশাদ মুচকি হেসে পকেট থেকে খামটা বের করে শাহানার কোলের উপর রাখে। শাহানা কিছু না বুঝে তাকায় স্বামীর দিকে।

“এটা নিয়েই তো এতো কথা, দেখো কি আছে এতে।”
“কি আছে?”
“খামের উপরেই দেখো কি লেখা।”
নওশাদ সংসার জীবনের শুরু থেকেই সঞ্চয়ে বিশ্বাসী। অল্প রোজগার হলেও সংসারের যাবতীয় সব খরচ থেকে কিছুটা টাকা বাঁচিয়ে সে খামে রাখে। আর যে কাজের বাবদে রাখা তা খামের উপর লিখে রাখে। এতে করে মনে রাখতে সুবিধা হয়, কোন টাকা কোন খাতে যাবে।

‘মেয়েদের নতুন ঘরের জন্য তোলা রইলো’
খামের উপর লেখাটা দেখে বেশ অবাক হয় শাহানা। এই বাবদে টাকা সে বছর দুই যাবৎ গোছাচ্ছে। মেয়েরা বড় হয়েছে, এক ঘরে তিনজন গাদাগাদি করে থাকে। তা দেখে কষ্ট হয় তাদের বাবার। তাই সে ঠিক করেছে মেয়েদের জন্য বাড়ির সাথেই একটা পাকা ঘর তুলবে। আর সে কারণেই টাকাটা জমাচ্ছিলো সে।

“জানো শাহানা ভাবছি ঘরের কাজটা এবার শুরুই করে দিবো। আগামীকালই মোক্তার মিস্ত্রীর সাথে কথা বলবো। পরশু থেকেই কাজ শুরু করে দিক। আর আমি এ কথা অবশ্যই তোমাকে জানাতাম। মতামতও নিতাম তোমার কীভাবে কি হবে। কিন্তু তার আগেই তুমি……”
“পাকা ঘর তোলার টাকা ইতোমধ্যে গুছিয়ে ফেলেছো তুমি?”
নওশাদ মাথা নিচু করে রাখে।
“কি হলো? চুপ করে আছো যে?”
নওশাদ হালকা হেসে বললো,”পাকা ঘর তোলার টাকা আপাতত হচ্ছে না শাহানা। আপাতত টিনের ঘর তুলবো। পরবর্তীতে আবার টাকা জমিয়ে ছাদটা দিয়ে ফেলবো।”
শাহানা অবাক হয়ে বললো,”তুমি টিনের ঘর তুলবে?”
“কেনো টিনের ঘরে কি মানুষ থাকে না?”
“অবশ্যই থাকে, আমিও একসময় থাকতাম। কিন্তু তোমার এতো তাড়াহুড়োই বা করা লাগবে কেনো? একবারে আরো কিছু টাকা জমিয়ে পাকা ঘর তুলো। মেয়েরা এতোদিন যখন কষ্ট করেছে আর কয়টা দিনও নাহয় করুক।”
নওশাদ রণের কথা উঠাতে যেয়েও থেমে যায়। কোনোরকম অশান্তি এখন ভালো লাগছে না।

শাহানা কিছু বুঝতে পারে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে। আনমনে হাসে কিছুক্ষণ। নিজেকে খুব চালাক ভাবে মানুষটা। আসলে তার সব চালাকি যে তার স্ত্রী বুঝে ফেলে নিমিষেই এটাই সে বোঝে না। সে ঠিক বুঝতে পারে, এই ঘরের প্রয়োজনীয়তা হঠাৎ কেনো এতো বেড়ে গেলো।
নওশাদ শাহানার দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। শাহানা হাত ছাড়িয়ে নেয়না। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে তার। ঝগড়া বিবাদ ভালো লাগেনা। রাতের এই সময়টা বড্ড শান্ত। এই শান্ত পরিবেশে প্রকৃতিই হয়তো কোনো অশান্তি চায়না। তাই মানুষের মনেও শীতলতা বিরাজ করে।

“ঘর হয়ে গেলে তুমি আর আমি একদিন বৃষ্টির রাতে ওখানে থাকবো কেমন শাহানা? বৃষ্টি বিলাশ করবো।”
“বুড়ো বয়সে বৃষ্টি বিলাশ করবেন মশাই? বলি সে বয়স আছে?”
“আনন্দ করতে বয়স লাগেনা শাহানা। জীবন আর কয়দিনের-ই বা বলো? এই ছোট্ট জীবনটা হেসেখেলে পার করে দিলে কি খুব বড় অপরাধ হয়ে যাবে?”
“এতো শক্ত কথা বুঝিনা।”
“আমি বুঝিয়ে দিবো?”
নওশাদ মুখ টিপে হাসে। শাহানাও হাসবে না হাসবে না করে হেসে দেয়।

“শাহানা।”
“বলো।”
“শুনবে না কীভাবে বৃষ্টি বিলাশ করবো?”
“আমার শুনে কাজ নেই।”
শাহানা যদিও মুখে বললো। কিন্তু তার শুনতে ইচ্ছা করছে মনে মনে খুব।

নওশাদ শাহানার পাশে চেয়ার টেনে বসে। দূরে কোথায় যেনো একটা ঝিঁঝি পোকা ডাকছে একনাগাড়ে। তীব্র না হলেও একটানা ডেকে যাচ্ছে, তবে বিরক্ত লাগছে না তাতে।

“তুমি সেদিন ছাই রঙা তাঁতের শাড়িটা পরবে, ওইযে যেটার পাড় কালো রঙের। তোমাকে ভীষণ মানায় ওই শাড়িতে। দুই হাত ভর্তি কাচের চুড়ি পরবে। তোমার লম্বা চুলগুলো বরং ছেড়েই রাখবে। উঠোনে যদি সেদিন ভাগ্যবশত দুই/একটা ভৃঙ্গরাজ ফোটে তবে তুলে এনে তোমার কানে গুঁজে দিবো। টিনের চালায় বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের সাথে তোমার কাচের চুড়ির রুনুঝুনু শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনবো সেই আওয়াজ।”
শাহানা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসে। লোকটা মাঝে মাঝে বড়ই আশ্চর্যজনক কথা বলে। এই বয়সে নাকি সে কাচের চুড়ি পরবে। মেয়েরা হাসবে না দেখে?

“মেয়েদের প্রেম করার বয়সে মেয়েদের বাবা প্রেম করতে চাচ্ছে। পারোও তুমি, যাও তো। ঘুম আসছে চলো ঘুমাতে যাই।”
“আরো কিছুক্ষণ থাকি। আরো কিছু স্বপ্ন ভাগাভাগি করি তোমার সাথে।”
“মাফ চাই বহ্নির বাবা। তোমার এই স্বপ্ন ভাগাভাগির চক্করে আমার ঘুমের দফারফা করে দিও না।”
“স্বপ্ন তা নয় যা আমরা ঘুমিয়ে দেখি, স্বপ্ন তাই যা আমরা জেগে দেখি। হয়তো আজ যদি আমি তোমাকে চারতলা আলিশান অট্টালিকার আশ্বাস দিতে পারতাম তাহলে তোমার ঘুম আসতো না। তুমি অপার মুগ্ধতার সাথে আমার সেই স্বপ্নের গল্প শুনতে। টিনের ঘরের স্বপ্ন ভাগাভাগি করতে অবশ্যই ঘুমের দফারফা করা যায়না, চলো ঘুমাতেই যাই।”
শাহানার বুকে ধাক্কা লাগে। মানুষটা কতো আশা নিয়ে গল্প করতে চাচ্ছিলো। সে কি খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললো? সত্যি বলতে তার অট্টালিকার চেয়ে স্বামীর টিনের ঘরের গল্পই বেশি ভালো লাগছিলো। বোঝাতে ব্যর্থ হলো সে?

নওশাদ উঠে যেতে গেলেই শাহানা তার হাত চেপে ধরে। আবার বসায় চেয়ারে।
“ব্যস গল্প শেষ?”
“তুমি -ই তো বললে ঘুম পাচ্ছে তোমার।”
“ইশ! আমার কথা যেনো কতো শোনা হয়। এখন এমনিও আমার ঘুম আসবে না। তারচেয়ে গল্পই শুনি।”
নওশাদ মুচকি হেসে বললো,”তাহলে চুল খোলো, আমি ভৃঙ্গরাজ এনে দিই কানের গুঁজে দিতে?”
শাহানা চোখ কটমট করে নওশাদের দিকে তাকাতেই নওশাদ শব্দ করে হেসে দেয়। শাহানা স্বামীর কাঁধে মাথা রাখে। নওশাদ স্বপ্নালু আলুথালু চোখে বাইরের দিকে তাকায়। বাকিটা রাত তারা গল্প করেই কাটাবে ঠিক করে,ঠিক বিয়ের পর যেমন কর‍তো প্রথমদিকে।
এরকম এক আধটা রাত জাগলে শরীরের খুব বেশি ক্ষতি হয়না, বরং বিবাহিত জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এমন রাত না আসলেই ভীষণ ক্ষতি হয়ে যায়, ফাটল ধরে সম্পর্কে। ঝিঁঝি পোকাটা আরো জোরে ক্রমাগত ডাকতে থাকে। রাতের এই পরিবেশে দুইজনের পাশাপাশি বসে থাকতে বেশ ভালো লাগে। রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেনো, মরীচিকার মতো সুন্দর লাগে সবকিছু।

সকালে সবার জন্য নাশতা পরিবেশন করছে সায়েরা টেবিলে। শাহানা নামমাত্র সাহায্য করছে। এই সময়টা ভীষণ দৌড়াদৌড়ির উপর থাকতে হয় সায়েরার। মেয়েরা বাইরের খাবার খায়না। দুপুরের খাবারও তাদের তৈরি করে দিতে হয়। তাছাড়া সকালের খাবার তো আছেই সবার জন্য। এক মুহুর্তও ও দাঁড়াতে পারেনা সায়েরা এই সময়ে।

হঠাৎ দরজা দিয়ে পরীর মতো সুন্দর একটা মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে কিছুটা থমকে যায় সায়েরা। থমকে যাওয়ারই কথা। এমন সুন্দর মেয়ে খুব বেশি দেখা যায়না সচারাচর। সায়েরা বাড়ির বাইরে যায় খুবই কম। সৌন্দর্যের মাপকাঠি বলতে সে তার তিন ভাইঝিকেই বোঝে। তবে এই মেয়েটা যেনো আরো সুন্দরী। তবে জামাকাপড়ে মফস্বল শহরের সাথে কেমন বেমানান। এমন পোশাক এই তল্লাটে কেউ পরেনা। বোঝাই যাচ্ছে বেশ বড়লোকের মেয়ে, পোশাকও বেশ দামী-ই মনে হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটাকে তো একেবারেই অচেনা লাগছে।

“মা তোমার পরিচয়?”
মেয়েটা সায়েরার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে। ইতিউতি তাকাতে থাকে সে। পরিবেশটা ঠিক পছন্দ হয়নি তার মনে হচ্ছে।
সায়েরা এগিয়ে আসে তার দিকে।
“তুমি কি কাউকে খুঁজছো?”
মেয়েটা জোর করে হেসে বললো,”এটা কি উৎসের বাড়ি?”
সায়েরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই মেয়েটা উৎসের কাছে এসেছে? উৎসের সাথে কি সম্পর্ক তার?
“এটা উৎসের মামাবাড়ি, ও এই বাড়িতেই থাকে।”
মেয়েটার মনে হলো উত্তরটা ঠিক পছন্দ হলোনা।
“আসলে আপনাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা এতো সরু, আমার গাড়িটা ঢুকলোই না। বড় রাস্তায় রেখে এসেছি। কোনো সমস্যা হবে না তো? অবশ্য আমার ড্রাইভার আছে।”
সায়েরা মৃদু হেসে বললো,”এতোটা কষ্ট করে উৎসের খোঁজ নিতে এসেছো তুমি? তুমি কি ওর বন্ধু?”
“বন্ধু? না না আমি উনার বন্ধু না। আমি উনার জুনিয়র, ভার্সিটিতে। উনি আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র।”
সায়েরার খটকা লাগে মনে। দুই ব্যাচ সিনিয়রের বাড়িতে কি করছে এই মেয়ে? আর নাম ধরেই বা ডাকছে কেনো উৎসের?

“আচ্ছা আপনি উৎসের কি হন?”
সায়েরা যন্ত্রের মতো বললো,”আমি উৎসের মা।”
মেয়েটা জিভ কামড়ে বললো,”আমি একদম বুঝতে পারিনি, ভুল হয়ে গেছে।”
“কোনো ব্যাপার না।”
“আমার নামটাই তো বলা হয়নি এখনো। আমার নাম প্রত্যাশা, তবে উৎস আমাকে আশা বলেই ডাকে।”
সায়েরার মনে কু ডাকে। উৎস কেনো তাকে অন্য নামে ডাকবে? ওদিকে এই মেয়েটা সমানে উৎসের নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে। কি সম্পর্ক এই মেয়েটার সাথে উৎসের?

“আপনি কি দয়া করে উৎসকে ডেকে দিবেন? ওর সাথে খুব দরকারি কথা আছে আমার।”
সায়েরা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে। তার মনটা মোটেও মানছে না। উৎসের সাথে কি এই মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক? না তা কি করে হবে? বুকটা ধকধক করে ওঠে তার কেমন।

“তুমি এখানে এসেছো কেনো?”
“উৎস তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছো কেনো? আমার অপরাধটা কি?”
উৎস দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলছে তার।

খাওয়ার টেবিলে মূর্তির মতো বসে আছে শীতল। তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। তবে কি এই সেই অনুপমা? উৎস তাকে দেখেই উঠোনে নিয়ে গেছে কথা বলতে। কি এমন কথা ওর সাথে যে সবার সামনে বলা যাবে না?
বহ্নি আর নওশাদও খেতে পারছে না। বারবার তাকাচ্ছে বাইরের দিকে। মেয়েটার উপস্থিতি কারো ভালো লাগছে না। উৎস তাকে নিয়ে বাইরে কথা বলতে গেলো এটাও পছন্দ হচ্ছে না কারো। তবুও কেউ কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না।
সায়েরা বাঁকা চোখে তাকায় শীতলের দিকে। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তার ভিতরে কি চলছে। সায়েরার বুক ফেটে কান্না আসে। তার ইচ্ছা করছে এখনই ছেলেটাকে খুব করে শাসন করে দিতে। তার ভাইঝিকে কষ্ট দেওয়ার সাহস কীভাবে করে সে?

“ভাইজান।”
নওশাদ অস্ফুট আওয়াজ করে।
“আমি কি ওকে ডেকে আনবো?”
“ডেকে আনার দরকার কি? ওর প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে নিজেই আসবে ও।”
সায়েরা হালকা চিৎকার করে বললো,”মেয়েদের সাথে কিসের গুরুত্বপূর্ণ কথা ওর? তাও একইসাথে পড়লেও মানতাম। জুনিয়র একটা মেয়ে, ওর সাথে কিসের কথা?”
নওশাদ বিরক্ত হয়ে বললো,”আজকাল ভার্সিটিতে অনেক ব্যাপারস্যাপার আছে। সিনিয়রদের নোট লাগে, সেসব নিয়েই কথা বলতে এসেছে হয়তো। সব বিষয়ে বেশি বোঝার স্বভাব তোর।”
সায়েরা মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে থাকে। নওশাদেরও ভালো লাগছে না বিষয়টা যদিও। তবুও সে কিছু বলেনা।

আভা খেতে খেতে বললো,”কেমন জামা পরেছে মেয়েটা একবার দেখো। ভাবছে নিজেকে বিশ্বসুন্দরী লাগছে। ভাবের চেয়ে ভঙ্গী বেশি।”
বহ্নি চোখ পাকিয়ে তাকায় আভার দিকে।
“এই তুই চুপ কর। সবসময় বেশি কথা।”
আভা ভেংচি কাটে।
শীতলের কোনো কথা কানে যায়না। কান থেকে যেনো তাপ বের হচ্ছে তার। এতোটা অসহায় আগে কখনো লাগেনি তার।

“তোমাকে এড়িয়ে চলার কোনো কারণ দেখছি না প্রত্যাশা।”
“উৎস আমাকে কিন্তু তোমার আশা বলে ডাকার কথা।”
উৎস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”এই মেয়ে তোমাকে না আমি নিষেধ করেছি আমাকে নাম ধরে বা তুমি বলে ডাকবে না? একটা কথা কতোবার বলতে হবে তোমাকে? আমার বাড়ির ঠিকানা কে দিয়েছে তোমাকে?”
“আমি যোগাড় করেছি।”
“কেনো যোগাড় করেছো?”
“ক্যাম্পাসে অনেকদিন দেখতে পাচ্ছিলাম না, তাই….”
“তাই বাড়িতে এসে হাজির হয়েছো?”
প্রত্যাশার চোখের কোণায় পানি জমে। উৎস পাত্তা দেয়না।
“একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো প্রত্যাশা। আমি মানুষটা ভালো নই, একদমই না। আমি গুন্ডা, মাস্তান। আমাকে যতোটা ভালো মনে করেছো আমি তা নই। আমার রাগ হয়ে গেলে আমি ভুলে যাবো তুমি একজন মেয়ে। মেয়েদের গায়ে হাত তোলা আমাদের শিক্ষা না, কিন্তু রেগে গেলে ভাই আমি অন্য মানুষ। ওসব শিক্ষা আমার মনে থাকেনা। এতোদিন অনেক অশান্তি করেছো। তবে আজ চূড়ান্ত করলে তুমি। আর কোনোদিন যদি এ বাড়ির ত্রিসীমানায় তোমাকে দেখি তুমি তোমার সিনিয়র উৎসকে না, ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ানো, পুলিশের কাছে ধরা খাওয়া, শার্টের পিছনে রা’মদা নিয়ে চলা, মাস্তান উৎসকে দেখবে। এখন যাও এখান থেকে। আর যা বললাম মনে রাখবে।”
প্রত্যাশার চোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়তে থাকে। উৎস সেদিকে তাকায় না। জোরে জোরে তপ্ত শ্বাস ফেলতে থাকে সে রাগে।

“কি হলো কি? যেতে বললাম না?”
ধমক শুনে কেঁপে ওঠে প্রত্যাশা। লজ্জায়, অপমানে কুঁকড়ে যাচ্ছে সে নিজের মধ্যে। এতোটা লজ্জা কোনোদিন পেতে হবে বোঝেনি সে। বিশাল শিল্পপতির একমাত্র মেয়ে, যখন যা চেয়েছে পেয়েছে। ‘না’ শুনতে হয়নি কখনোই। কিন্তু আজ কিনা এতোটা অপমান তার কপালে ছিলো?
প্রত্যাশা কাঁপা কাঁপা পায়ে গেটের দিকে এগোতে থাকে। রাগে উৎসের নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করে। অসহ্য লাগে সবকিছু।

“মামা।”
উৎসের ডাক শুনে শীতল বাদে সবাই একযোগে তাকায় তার দিকে। শীতল মাথা নিচু করে শক্ত হয়ে বসে থাকে। আড়চোখে উৎস তাকায় তার দিকে। অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে তাকে। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে, সে কি কেঁদেছে? বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে উৎসের।

“মেয়েটা কোথায় উৎস?”
উৎস ক্লান্ত গলায় বললো,”চলে গেছে।”
“চলে গেছে মানে? খেয়ে যেতে বলিসনি ওকে?”
“না বলিনি।”
“কেনো?”
“প্রয়োজন মনে করিনি।”
বহ্নি একবার উৎসের দিকে আরেকবার শীতলের দিকে তাকায়। শীতল স্বাভাবিক হতে পারছে না।

“এগুলো ঠিক না উৎস। পরের বার থেকে যেনো এমন না হয়। খাওয়ার সময় অভুক্ত কাউকে বিদায় জানাবে না, সে যে-ই হোক।”
উৎস উত্তর দেয়না। তার দৃষ্টি এবং মন দুইটাই শীতলের দিকে। সে কি উল্টোপাল্টা কিছু ভাবলো? সায়েরা তীক্ষ্ণ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“তা বেশ, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? বসে পড়।”
উৎস চেয়ার টেনে বসতে গেলেই শীতল উঠে দাঁড়ায়।
বহ্নি শীতলের দিকে তাকিয়ে বললো,”কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লি যে।”
শীতল যন্ত্রের মতো বললো,”আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
নওশাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,”মাত্র আটটা বাজে, দেরি হচ্ছে কোথায়? খাওয়াটা শেষ কর।”
শীতল ঝড়ের বেগে ছুটে বেরিয়ে যায়, কোনো উত্তর দেয়না। শীতলের ব্যবহারে সবাই অবাক।
উৎস মাথা নিচু করে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। যে কোনো মুল্যে শীতলের রাগ ভাঙাতে হবে তাকে। কাজটা সহজ হবে না। শীতল অভিমান করলে ভেঙে যায়, তবে রাগ হলে তা সহজে ভাঙে না। উৎস ভেবে পায়না শীতলের ভুল ভাঙাবে কীভাবে সে?
নিজেও কিছু খেতে পারেনা সে, গলা দিয়ে নামেনা খাবার।

“চাচী।”
বসার ঘরে বসে সকালের চা খাচ্ছিলো শাহানা। সবাই বেরিয়ে গেলে ফাঁকা সময়ে বসে চা খেতে ভালো লাগে তার।
হঠাৎ কারো ডাকে চমকে ওঠে সে। তাকাতেই দেখে রণ দাঁড়িয়ে আছে। শার্ট, প্যান্ট পরা খুব পরিপাটি করে। চুলগুলোও একদম সমান করে আঁচড়িয়েছে। কেমন যেনো বোকা বোকা চেহারা, তবে কি একটা মায়া আছে মুখে।

শাহানা কঠিন গলায় বললো,”কি হয়েছে?”
“চাচী আজ আমার একটা চাকরির পরীক্ষা আছে।”
“তো আমি কি করবো? তোমার চাকরির পরীক্ষা আমি দিয়ে আসবো?”
রণের মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। এমন উত্তর আশা করেনি সে। এ বাড়ির সবাই কেমন অদ্ভুত। কেউ একই রকমভাবে অদ্ভুত না। যে যার নিজের মতো করে অদ্ভুত।

“না তা বলিনি।”
“তো কি চাও?”
রণ আস্তে আস্তে বললো,”আমার তো মা বেঁচে নেই। অনেক ছোট থাকতে মা মারা গিয়েছে। মায়ের তেমন স্মৃতিও মনে নেই। মা বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক দোয়া করতো পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময়। তাই…..”
রণ কথা শেষ করতে পারেনা, গলা ধরে আসে তার।
শাহানা অপ্রস্তুত বোধ করে।

“এই ছেলে, বেটা মানুষের এমন ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না আমার একদম ভালো লাগেনা। কথায় কথায় কান্না আসবে মেয়েদের। মেয়েরা একটু ঢংঢাং করবে, কেঁদে চোখ ফোলাবে। পুরুষ মানুষ কেনো এসব করবে?”
রণ হঠাৎ হেসে দেয়।
“ভারী অদ্ভুত ছেলে তো তুমি। কাঁদতে কাঁদতে কেউ হাসে?”
“ইয়ে মানে…..”
“যাই হোক, দোয়া করবো যেনো চাকরিটা হয়ে যায়। হয়েছে? এবার বিদায় হও।”
রণ যায়না, দাঁড়িয়ে থাকে। উশখুশ কর‍তে থাকে।
শাহানা বিরক্ত মুখে বললো,”আবার কি? টাকা লাগবে নাকি?”
রণ তাড়াহুড়ো করে বললো,”না না কি বলছেন।”
“তাহলে?”
“একটা আবদার করতাম, রাগ করবেন না তো?”
শাহানা বিরস মুখে তাকায়। ছেলেটা কিশোরী মেয়েদের মতো ঢং করে কেনো?

“কি আবদার?”
রণ কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”মাথায় যদি হাতটা রাখতেন আপনার, খুব ভালো লাগতো। সায়েরা ফুপুও রেখেছে। বলেছে আমার পরীক্ষা খুব ভালো হবে।”
শাহানা কিছুটা কেঁপে ওঠে। হঠাৎ করে ছেলেটাকে এতো সুদর্শন লাগছে কেনো? কেমন যেনো মায়া মায়া লাগছে।

“এইযে শুনছেন?”
যাওয়ার মুখে মিষ্টি একটা গলার আওয়াজ শুনে থেমে যায় রণ। পিছন ঘুরে তাকাতেই হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে ওঠে। এইতো সেই রাগী মেয়েটা, যার নাম বহ্নি। মেয়েটাকে আজ এতো বেশি সুন্দর লাগছে কেনো? প্রখর রোদ এসে পড়েছে তার চোখে, চুলে, গালে। এমন শাশ্বত বাঙালি মেয়ের রূপের কথা ভেবেই হয়তো কবি ‘বনলতা সেন’ লিখেছিলো।

রণ পরক্ষণেই নিজের উপর রেগে যায়। এসব কি ভাবছে সে? সে নিজে আশ্রিত মেয়েটার বাড়িতে। আর সে কিনা মেয়ের রূপের দিকে নজর দিচ্ছে। এতোটা অধ:পতন কবে হলো তার?

“এইযে মিস্টার লজ্জাবান, হাঁ করে কি দেখছেন?”
রণ ভেবাচেকা খেয়ে যায়।
বহ্নি গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,”শুনলাম আজ আপনার চাকরির পরীক্ষা?”
“জ্বি, দোয়া করবেন।”
“মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করতে হবে না?”
রণ হতবাক হয়ে যায়। বহ্নি খিলখিল করে হেসে ওঠে। তার হাসির শব্দ যেনো মেলোডির মতো রণের কানে এসে লাগে।

“শহরে নতুন আপনি, পথঘাট চিনবেন তো?”
“পথ পথিককে সৃষ্টি করেনা, পথিকই পথ সৃষ্টি করে। ঠিক চিনে নিবো।”
“বাহ আপনি তো খুব সুন্দর করে কথা বলেন। দেখে তো মনে হয়েছিলো লজ্জিত আর ক্ষমাপ্রার্থী ছাড়া আপনার অভিধানে আর কোনো শব্দ নেই।”
রণ মুখ টিপে হেসে বললো,”আমার অভিধানে আরো অনেক শব্দ আছে ম্যাডাম। আপনি ধারনাও করতে পারবেন না। গ্রামের সহজ সরল ছেলে দেখে হয়তো মজা করছেন। তবে এ অধমকে যতোটা অপদার্থ ভেবেছেন ততটা বোধহয় নয়। কিছুটা পদার্থ আছে।”
বহ্নি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রণ হালকা হেসে বেরিয়ে যায়। বহ্নি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কথা তো ভালোই জানে লোকটা। মুখ বুঁজে পড়ে থাকে ভালোমানুষ সাজার জন্য তবে?

কলেজ শেষ করে এলোমেলো পায়ে হাঁটছে শীতল। আজ টিউশনে যেতে ইচ্ছা করছে না। সকাল থেকেই বুকটা কেমন ভার হয়ে আছে। কোনো কিছুতেই মন বসেনি। অগ্নিও আসছে তার সাথে। মেয়েটা দাঁড়ি কমা ছাড়া কথা বলে যায় সবসময়, যার অর্ধেকই বোঝা যায়না। শীতল শুধু মাথা নেড়ে যাচ্ছে। এ বাদে কোনো কথাই তার কানে ঢুকছে না।

“কি রে শুনছিস কি বলছি?”
“হু।”
“হু আবার কি রে শীতল? সেই সকাল থেকে দেখছি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছিস তুই। দয়া করে বলবি কি হয়েছে?”
“কি আবার হবে? কিছু হয়নি।”
অগ্নি মাঝরাস্তায় শীতলের দুই বাহু চেপে ধরে তাকে থামায়। সেই স্কুল থেকে বন্ধুত্ব দুইজনের। কারো কোনো কষ্ট হলে অন্যজন ঠিকই বুঝতে পারে।

“আমার দিকে তাকা।”
“কি হয়েছে?”
“একবার বললাম না কিছু হয়নি? কেনো জ্বালাতন করছিস?”
“বাড়িতে কোনো সমস্যা?”
শীতল গম্ভীর মুখে বললো,”না।”
অগ্নি কিছু বলতে যাবে তার আগেই দূর থেকে আসা এক ঝাঁক মোটরসাইকেল দেখে অবাক হয় সে। দুইদিন পর পর এদিকের পাতিনেতাগুলো মোটরসাইকেলের মহড়া দেয় রাস্তায়। তাদের জন্য সাধারণ মানুষদের চলাচলের ভারী অসুবিধা হয়ে যায়। আজও বোধহয় তাই। অগ্নি শীতলের হাত ধরে রাস্তার এক পাশে নিয়ে আসে।

মোটরসাইকেলগুলো শীতল আর অগ্নির অনেকটা কাছে চলে আসে। অগ্নি অবাক হয়ে দেখে সবার নাক থেকে ঠোঁট কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা, শুধু চোখ দু’টো দেখা যাচ্ছে। প্রায় নয়/দশটা মোটরসাইকেল, তাতে দুইজন করে বসা। সবারই একই অবস্থা। ভয়ে অগ্নি বরফের মতো জমে যায়। বিকেল হওয়ার আগ মুহুর্তে এই সময়ে রাস্তাটাও বেশ ফাঁকা থাকে। গত মাসেই এই রাস্তা থেকে একটা মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে।

শীতল অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো তাদের কাছে এসেই মোটরসাইকেলগুলো গতি কমিয়ে দিয়েছে। ভয়ে ভয়ে সে অগ্নির হাত শক্ত করে চেপে ধরে। দ্রুত পা চালানোর ইশারা করে সে অগ্নির দিকে তাকিয়ে।

আচমকাই তাদের দুই পাশ থেকে ঘিরে ফেলে মোটরসাইকেলগুলো। তাদের মাঝে রেখে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে সেগুলো। শীতল ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। অগ্নি শক্ত করে তাকে ধরে রাখে।

“এই কে আপনারা? আমাদের যেতে দিন।”
অগ্নি কিছুটা সাহস সঞ্চার করলেও শীতলে ভয়েই শেষ। আশেপাশে তেমন কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।
“কি বললাম কানে যায়নি? রাস্তা ছাড়ুন।”
হঠাৎ মোটরসাইকেলগুলো থামে। শীতলের হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে ধকধক করতে থাকে।

একটা মোটরসাইকেল থেকে বেশ লম্বা একটা পুরুষ নামে। শীতলের অনেকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় সে। শীতল ভয়ে চোখ তুলে তাকাতে পারেনা।
অগ্নি ভয়ংকর রাগী চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,”আমরা কিন্তু এবার চিৎকার করে লোক জড়ো করবো। দিনেদুপুরে নোংরামি তাইনা?”
লোকটা অগ্নির দিকে একবার তাকায়।

হঠাৎ শার্টের ভিতর থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপ বের করে সে। সাথে সাথে বাকি মোটরসাইকেলগুলো থেকে একে একে সবগুলো ছেলে নামতে থাকে। সবাই যার যার শার্টের ভিতর থেকে একই রকম গোলাপ বের করে। একযোগে সবাই ফুলগুলো শীতলের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

স্তম্ভিত হয়ে শীতল তাকিয়ে থাকে ছেলেগুলোর দিকে। হতবাক হয়ে যায় অগ্নিও। হচ্ছে কি এসব? এরা কারা? এমন অদ্ভুত কান্ড কস্মিনকালেও ওরা দেখেনি।
শীতল অবাক হয়ে খেয়াল করলো ছেলেগুলো তার থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে সবাই কোমল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কালো কাপড়ে বাঁধা হলেও শীতল স্পষ্ট বোঝে তারা হাসছে। এই আঠারো বছর বয়সে এমন অবাক মনে হয় এর আগে কখনো হয়নি সে।

(চলবে…….)