মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-১৬+১৭

0
94

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ১৬

সকাল সকাল বেশ অনেকগুলো ছবি বিছানায় মেলে রেখেছে শাহানা। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সেগুলো। কোনোটাই মনমতো হচ্ছে না, কোনো না কোনো খুঁত থেকেই যাচ্ছে।
নওশাদ গোসল সেরে বেরিয়ে এমন কাণ্ড দেখে বেশ অবাক হয়। উঁকি দিয়ে দেখে বেশ অনেকগুলো কম বয়সী ছেলেদের ছবি শাহানার সামনে।

চুল মুছতে মুছতে কৌতুকপূর্ণ হাসি দিয়ে নওশাদ বললো,”আমার দোয়েল পাখির কি এই পুরোনো নীড় আর মনে ধরছে না? সে কি এই বাঁধভাঙা স্বাধীনতা ছেড়ে নতুন খাঁচায় বন্দী হতে চায়?”
নওশাদের কথা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। বোঝার সাথে সাথেই রাগে লাল হয়ে উঠলো সে।
নওশাদ শব্দ করে হেসে দেয়।
“দেখো, এমনভাবে হাসছেন খুব যেনো মজার কথা বলে ফেলেছেন। অসভ্য লোক একটা। বয়সের নেই গাছপাথর। দিন দিন যেনো কচি খোকা হচ্ছেন।”
নওশাদ এক গাল হেসে মাথাটা এগিয়ে দেয় শাহানার দিকে। শাহানা গম্ভীর মুখে তোয়ালেটা নিয়ে নওশাদের মাথার চুল মুছে দেয়। এই কাজটা রোজ সকালে তাকে করতেই হবে।

শাহানার পাশে নওশাদ এসে বসে কিছুক্ষণ পর। নিজেও দুই/একটা ছবি দেখে।
“এগুলো কারা শাহানা?”
শাহানা ছবিগুলো দেখিয়ে বললো,”ও হলো খায়রুল, সেনাবাহিনীতে আছে। আর ও মিরাজ, অনেক বড় প্রকৌশলী, আর ও…..”
শাহানাকে থামিয়ে দেয় নওশাদ।
“ওরা যে-ই হোক, ওদের ছবি তুমি কোথায় পেয়েছো?”
“আরে আর বলোনা, গতকাল ঘটক চাচী এসেছিলো বাড়িতে। উনি দিয়ে গেলেন।”
নওশাদ মুচকি হেসে বললো,”আমার বউকে আমি আবার বিয়ে দিবো না কিন্তু। আমার একটা মাত্র বউ।”
“উফফ থামবে তুমি?”
“আচ্ছা আচ্ছা, এবার বলো। উনি কেনো এসেছিলেন? আর এতো ছবি-ই বা কেনো দিয়ে গেলেন?”
“বাড়িতে তিন তিনটা সমর্থ মেয়ে থাকলে, সে বাড়িতে ঘটকের আনাগোনা হওয়া কি অসম্ভব কিছু?”
“সমর্থ মেয়ে? কারা?”
শাহানা হালকা চিৎকার করে বললো,”তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি কি দিনদিন লোপ পাচ্ছে? তিন তিনটা মেয়ে জন্ম দিয়েছো, চোখে পড়েনা তাদের?”
নওশাদ অবাক হয়ে বললো,”আমার এতো ছোট মেয়েদের জন্য ঘটক এসেছে বাড়িতে?”
“কোন মেয়ে ছোট তোমার? আভার থেকেও কম বয়সে বিয়ে করে তোমার ঘরে এসেছিলাম। ও, পরের মেয়ে ছিলাম এজন্য আমার বয়স চোখে পড়েনি। নিজের মেয়েদের বয়স চোখে দেখছো না। তোমার বড় মেয়ের বয়স কতো হলো খেয়াল আছে? একটা একটা করে তো পার করতে হবে।”
“আমার মেয়েরা কি গরুছাগল নাকি যে পার করতে হবে। আর তোমাকে তোমার বাবা মা বিয়ে দিয়েছিলো, পড়াশোনা না করে বাঁদরামি করে বেড়াতে তাই। নেহাৎ একটা ভালো মানুষ পেয়ে অমনি তার গলায় ঝুলিয়ে দিলো তোমার বাবা মা। ঠিক যেনো বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা।”
শাহানা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”তোমার গলায় আমি ঝুলেছি আবার বলছো বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা? তাহলে নিজেই বুঝে নাও বাঁদরটা কে।”
নওশাদ প্রমাদ গোণে। নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেলো বুঝি।

“সে যাই হোক, গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগে আমি বহ্নির বিয়ে দিবো না। সে তুমি যতো যোগ্য পাত্রই দেখোনা কেনো। মেয়ে পড়াশোনায় ভালো, তাছাড়া ও পড়তে চায়। ও যতোদূর পড়তে চায়, আমি ওর বাবা ওকে পড়াবো।”
“হ্যা আর বয়সটা যেনো বসে থাকবে। এমনিতেই ছোট দুই মেয়ের তুলনায় এমন কোনো রূপসী না তোমার বড় মেয়ে, গায়ের রঙ ময়লা। এখন থেকে না দেখলে পরে ভালো ছেলে পাওয়া যাবে?”
নওশাদ থমথমে মুখে তাকায় শাহানার দিকে, শাহানা দমে যায় কিছুটা।

“শাহানা তোমাকে আগেও বলেছি, আমার স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল মেয়েকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলবে না। আর গায়ের রঙ ময়লা আবার কি? শ্যামলা বরণ বলতে শেখো। ময়লা তাদের অন্তর যারা এই ফর্সা কালোর বৈষম্য তৈরি করে।”
নওশাদ রাগী মুখে উঠে যেয়ে শার্ট গায়ে চাপাতে থাকে। শাহানা চুপ করে যায়। মেয়েদের নিয়ে কোনো খারাপ কথা শুনতে পারেনা লোকটা। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাহানা। মেয়ে কি তার নয়? তার কি খারাপ লাগেনা এটা বলতে? এলাকা থেকে শুরু করে ঘটক বা যে-ই দেখে সে-ই বলে, বড় মেয়ের আগে ছোট দু’টোর বিয়ে দিন, ভালো ছেলে আছে। এগুলো যে একটা মায়ের মনে কতোটা দাগ কাটে তা কি কেউ বুঝবে?

বউয়ের মুখ ভার দেখে নওশাদ ম্লান হেসে এগিয়ে আসে তার দিকে। তার দুই হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নেয়।
“শাহানা এতো ভাবছো কেনো? তাছাড়া যুগ পাল্টেছে। মেয়ে যখন হয়েছে, বাবা হিসেবে তাদের বিয়ের চিন্তা আমার আছে।”
শাহানা আলতো করে মাথা নাড়ে।
“আচ্ছা আমি বহ্নির সাথে কথা বলবো এ বিষয়ে, কেমন? ও যদি রাজি থাকে তবে আমরা এ ব্যাপার নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করবো। আমার মেয়ে বুদ্ধিমতী। ও জানে কখন কোনটা ওর বা ওর পরিবারের জন্য ভালো।”
শাহানা ধীর কণ্ঠে বললো,”আর ওর যদি কোনো পছন্দ থাকে?”
“ওইযে বললাম আমার মেয়ে বুদ্ধিমতী। ও জানে ওর জন্য কোনটা ভালো। আমার মেয়ে যদি কাউকে পছন্দ করে থাকেও, নিশ্চয়ই এমন কাউকে করবে না যে ওর অযোগ্য।”
“আমার ভয় করে বহ্নির বাবা।”
“কিসের ভয় তোমার? আমি আছি না? তোমার সব ভয় দূর করে দিবো। একবার শুধু বলো, এতো ভয় কেনো তোমার?”
“দিনকাল ভালো না। যদি কোনো সর্বনাশ হয়ে যায়? আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ, সম্বল বলতে আমাদের ওই সম্মানটুকু ছাড়া আর কিছু নেই।”
নওশাদ অবাক হয়ে বললো,”এসব কি বলছো শাহানা? এসব চিন্তা কেনো আসে তোমার মাথায়?”
শাহানা মাথা নিচু করে বললো,”সেদিন রাতে আমি উঠোনে রণের সাথে বহ্নিকে কথা বলতে দেখেছি। ওরা অনেকক্ষণ ধরে ফিসফিস করে কথা বলছিলো। আমি জানিনা ওরা কি বলছিলো তবে যা-ই বলুক অন্ধকারে কেনো? আর বহ্নির সাথেই বা ওর কি কথা? আমি সেদিনই ওদের সামনে ধরা দিতে পারতাম, ওদের যে একসাথে দেখেছি আমি এটা বুঝিয়ে দিতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। যদি তেমন কিছু হয়েই থাকে আমার উপস্থিতি হিতে বিপরীত কিছু ঘটাতে পারতো। তবে আমার তারপর থেকে খুব ভয় হচ্ছে। আগুণ আর বারুদ যে পাশাপাশি রাখতে নেই, বিস্ফোরণ অনিবার্য।”
নওশাদ ভ্রু কুঁচকে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ, কিছু বলেনা।

“আমি সবকিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করি এটা তোমার অভিযোগ আমি জানি। কিন্তু আমার কোনো চিন্তাই যে অবাস্তব নয়, এটা স্বীকার করতেই হবে তোমাকে। আমার মেয়ে বুদ্ধিমতী কিন্তু সেই সাথে ভীষণ আবেগী। ও যতোই শক্ত থাকার চেষ্টা করুক না কেনো উপরে, ওর ভিতরটা অসম্ভব নরম। বছর খানিক আগে ও অনেক বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। তোমরা কেউ না জানলেও আমি জানি।”
নওশাদ হতভম্ব হয়ে বললো,”তার মানে? কি এমন ধাক্কা আমার মেয়েটা খেয়েছে যে ওর বাবাকে না বলে তোমাকে বলেছে?”
“হ্যা আমি জানি মেয়েদের মায়ের থেকে বাবার উপর টান বেশি। তাছাড়া ও আমাকে বলেও নি নিজে থেকে। খালা বলো বা ফুপু বলো, মায়ের উপর কেউ না। তোমরা কেউ ওর হাসির নিচে চাপা কষ্ট দেখতে পাওনি, হুল্লোড়ের পিছনে জমাট কান্না শুনতে পাওনি। আমি মা, আমি পেয়েছি। আমি ওকে জোর করেছি অনেকবার, ও স্বীকার করেনি। পরে আমি ওকে না জানিয়েই ওর ভার্সিটিতে যেয়ে ওর খুব কাছের একটা বান্ধবীর কাছ থেকে সব শুনেছি। আমি কাউকে কিছু জানাইনি, ওকেও বুঝতে দিইনি যে আমি জেনেছি। আমার মেয়েটার হাসির আড়ালে অনেক কষ্ট বহ্নির বাবা। আমি ওকে আর কষ্ট পেতে দিতে চাইনা। যে কেউ ওকে বারবার ভেঙে দিয়ে যাক, মা হয়ে আমি সহ্য করতে পারবো না।”
নওশাদ স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। বাবা হিসেবে নিজেকে চরম ব্যর্থ মনে হচ্ছে। নিজেকে নিয়ে কতোও অহংকার ছিলো, যা কিছু হয়ে যাক মেয়েরা আগে তাকে বলবে। বলতোও তো তাই। কবে মেয়েগুলো এতো বড় হয়ে গেলো সে জানেনা। আজ তার সব অহংকার ভেঙে গেছে। সে শুধু বাবা-ই থেকে গেছে, মেয়েদের বন্ধু হতে পারেনি।

“শাহানা কে কি করেছে আমার মেয়ের সাথে?”
শাহানা চুপ করে থাকে। নওশাদের রাগের পারদ তরতর করে উপরে ওঠা শুরু করেছে বুঝতে পারে সে।
“শাহানা চুপ করে না থেকে বলো, কি জানতে পেরেছিলে তুমি ওর বান্ধবীর থেকে?”
ছবিগুলো গুছিয়ে উঠিয়ে রাখতে রাখতে শাহানা বললো,”তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, তুমি এখন যাও। শুধু রণের ব্যাপারটা মাথায় রেখো। যদি পারো ওকে একটা ভালো ছেলেদের হোস্টেলে উঠিয়ে দিও। টাকাপয়সা কিছু লাগলে দিও। তবে আমার মেয়েদের নিয়ে কোনো আপোষ নয়।”
“রণের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমি বুঝবো। বাবা হয়ে এমন কিছু আমি করবো না যাতে আমার মেয়েদের ক্ষতি হয়। শুধু তুমি আমাকে বলো বহ্নির সাথে কি হয়েছিলো? কার এতো সাহস আমার মেয়েকে কষ্ট দেয়?”
শাহানা শান্ত চোখে নওশাদের চোখে চোখ রাখে।
“আমি এখন এসব কিছুই বলবো না তোমাকে। শুধু একটা কথা শুনে রাখো, তোমার মেয়ের উচ্ছলতা কেড়ে তাকে একরাশ কষ্ট উপহার দিয়ে এক পুরুষ তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। অপমানিত করেছে, ছোট করেছে। বহ্নি চাইলেই প্রতিশোধ নিতে পারতো, সবাইকে জানিয়ে দিতে পারতো লোকটার আসল রূপ। কিন্তু ও তা করেনি। নীরবে সরে এসেছে। কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দেয়নি।”
নওশাদের হাত-পা অবশ হয়ে আসে। যে মেয়েকে ফুলের টোকা কোনোদিন দেয়নি, গলিত শুভ্র মোমের মতো সেই মেয়েটাকে কে এতো কষ্ট দিলো? এমন শুদ্ধতম ভালোবাসা পেয়েও কোন হতভাগা তাকে হারালো? সে কি কোনোদিন বুঝতে পারবে কি রত্ন সে হারিয়েছে?

ক্যান্টিনে বসে গানবাজনা করছিলো উৎস আর তার দলবল। উৎস ঠিক করছে না, বাকিরা করছে আর ও সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাল মেলাচ্ছে।
আচমকাই উৎসের কাছ ঘেঁষে কেউ দাঁড়ায়। কড়া পারফিউমের গন্ধে নি:শ্বাসটা যেনো আটকে আসে তার। বাকিরা গান বন্ধ করে দেয়।
উৎস মাথা তুলে তাকাতেই দেখে প্রত্যাশা দাঁড়িয়ে আছে, কিঞ্চিৎ রেগে।
উৎস পাত্তা দেয়না। বাকিদের দিয়ে তাকিয়ে বললো,”থামলি কেনো?”
“উৎস আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”
উৎস মাটির দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে সে।
আবির প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বললো,”প্রত্যাশা তুমি কিন্তু বেয়াদবি করছো। উৎস তোমার বন্ধু নয়, তোমরা একই সাথে পড়াশোনাও করোনা যে ওকে নাম ধরে ডাকবে। এসব কি অসভ্যতা?”
“আপনি চুপ থাকুন আবির ভাই। যাকে বলছি তার কি মুখ নেই? তার যদি আপত্তি থাকে সে বলুক। নাকি তার সাহস নেই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার?”
আবির হতবাক হয়ে যায়। মেয়েটার অসভ্যতা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। ক্ষমতাধর লোকের মেয়ে বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করবে না?
আবির দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”বাড়াবাড়ি করোনা প্রত্যাশা, তোমাকে কিন্তু…..”
উৎস থামিয়ে দেয় তাকে। সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশার মুখোমুখি হয় সে। তার দৃষ্টি প্রত্যাশার দৃষ্টি ভেদ করে যায়। প্রত্যাশার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

“কি সমস্যা?”
“উৎস….”
“উহু উৎস ভাই। এরপর বাকিটা বলো।”
প্রত্যাশার মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়।
“উৎস ভাই আমার তোমার সাথে…”
“আপনার।”
“আচ্ছা আচ্ছা, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“কিন্তু তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই।”
“কিন্তু আমার আছে, বলতেই হবে।”
“বেশ বলো, শুনছি।”
প্রত্যাশা এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললো,”সবার সামনে বলবো না। আপনি ওদিকটায় চলুন।”
“দেখো তোমার কথা শোনার মতো বিন্দুমাত্র কোনো আগ্রহ আমার নেই যে এখান থেকে অন্য কোথাও যেতে হবে। এখানে বললে বলো, নাহলে চলে যাও। আর কীভাবে বুঝালে বুঝবে তোমার এসব আচরণে আমি বিরক্ত হচ্ছি। আমার শিক্ষা আমাকে মেয়েদের গায়ে হাত ওঠাতে বাঁধা দেয়। নাহলে তোমার জায়গাটা ঠিক কোথায় এটা তোমাকে আরো আগে বুঝিয়ে দিতাম। তোমাকে এতোটা বাড়তে দিতাম না।”
“আমি কি বাড়াবাড়ি করেছি?”
“তুমি আমাকে কিছু না জানিয়েই আমার বাড়িতে যাওনি? আমার বোনদের অপমান করোনি? শীতলকে ছোট করে কথা বলোনি?”
প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। শীতলের নাম আলাদা কেনো বললো?
“আমার বোনেরা এগুলো আমার সামনে বলেনি, কারণ ওরা তোমার মতো অভদ্র নয়। আমার মা সবটা শুনে আমাকে বলেছে। আমার বাড়ির কেউ চায়না তুমি ওখানে যাও, তাও কেনো গিয়েছো? কে তোমাকে অধিকার দিয়েছে ওদের অপমান করতে?”
“আমার আপনাকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো। ক্যাম্পাসে তো দেখাই পাইনা, কোথায় কোথায় থাকেন।”
আবির বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।
“প্রত্যাশা নিজের ক্লাসে যাও।”
“কেনো আবির ভাই? একজনকে দেখার জন্য ভিতরটা পুড়ে যাওয়া কি অপরাধ? মানুষের অনুভূতি কি তার নিয়ন্ত্রণে থাকে?”
আবির ভেবে পায়না এই নির্লজ্জ মেয়েটাকে সে কি বলবে।

উৎস দুই হাত বুকে বেঁধে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বললো,”বেশি পুড়ছে?”
প্রত্যাশা মাথা নাড়ায়।
“বেশি পুড়লে এক গ্লাস পানিতে বার্নল গুলে খেয়ে ফেলো। কোথাও পুড়ে গেলে বার্নল খুব ভালো কাজ করে। যেহেতু ভিতর পুড়ছে, পানির সাথে গুলে খাওয়াই ভালো হবে।”
আবির সহ বাকিরা মুখ টিপে হাসে। অপমানে মুখ কালো হয়ে যায় প্রত্যাশার।

উৎস বসে পড়ে। পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ধরায় সে।
“কি রে গান শুরু কর আবার।”
প্রত্যাশা রাগে ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ে ওর দিকে তাকিয়ে। হঠাৎই চিৎকার করে বলে ওঠে,”অনুপমা কে উৎস? তার পরিচয় কি?”
উৎস থমকে যায়। কম্পিত চোখে তাকায় প্রত্যাশার দিকে, এই নাম ও কীভাবে জানলো? কে বলেছে এসব তাকে?

“বাবা তুমি হঠাৎ আমার ভার্সিটিতে?”
“কেনো রে আসতে পারিনা?”
“একশ বার পারো বাবা। কিন্তু আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্যি এসেছো তুমি?”
নওশাদ হাসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটাকে কি ভালো করে লক্ষ্য করা হয়নি অনেকদিন ধরে? আচ্ছা ওর চোখের নিচটা কি ভীষণ কালো? কাজলের রেখা ঢাকতে পারেনি কালোটুকু? বুকটা হু হু করে ওঠে নওশাদের। এইতো সেদিনই মেয়েটা হলো। হাসপাতাল থেকে যেদিন বাড়ি নিয়ে আসা হলো ওকে, তার মনে হয়েছিলো বাড়িটা বুঝি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। হাজারটা আলো জ্বেলে মেয়েটা প্রথম ঢুকেছিলো বাড়িতে। একদম ভরা পূর্ণিমার রূপ, মুগ্ধ হয়ে যেতো নওশাদ দেখে। অফিসে যেতে ইচ্ছা করতো না মেয়েকে রেখে। অস্বস্তি হতো অফিসে বসে। ঠিক আজ যেমনটা হলো। শাহানার কাছ থেকে সকালে কথাগুলো শোনার পর অফিসে মন বসছিলো না। কেমন বুকটা ভার হয়ে আসছিলো বারবার। মেয়েটাকে এক নজর দেখার জন্য বুকটা খা খা করছিলো, যেনো কতো যুগ দেখেনা। আর অপেক্ষা করতে পারেনি সেই রাত পর্যন্ত, ছুটি নিয়ে সোজা চলে এসেছে মেয়ের ভার্সিটিতে।

“বাবা শুনছো কি বলছি?”
“হ্যা হ্যা শুনছি রে।”
“তুমি হঠাৎ এখানে কেনো?”
“ওই তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিলো।”
বহ্নি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়। বাবার কথাবার্তা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে।

“ওসব বাদ দে, চল আমার সাথে।”
“কোথায় যাবো?”
“তোর সাথে অনেকদিন ঘুরতে যাওয়া হয়না। আজ দুই বাপ বেটি প্রচুর ঘুরবো, চাইনীজ খাবো, কেনাকাটা করবো। যা যা কিনতে চাইবি সব কিনবো।”
বহ্নি বাবার কপালে হাত রাখে।
“তুমি সুস্থ আছো তো বাবা?”
“আরে আমি ঠিক আছি, চল তো।”
“বাবা আমার ক্লাস আছে। এখন কীভাবে?”
“আমি ছুটি নিয়েছি আর তুই নিতে পারবি না? অনেক দিন চাইনীজ খাওয়া হয়না, চল যাই।”
“বাবা তোমার মাথা ঠিক আছে? উৎস, শীতল, আভাকে রেখে আমি চাইনীজ খাবো? এটাও বুঝি সম্ভব?”
বহ্নি কুটকুট করে হাসে। নওশাদের চোখে পানি চলে আসে। মেয়েটা এতো ভালো কেনো? কেনো হতে হবে তাকে এতো ভালো?
বহ্নির মাথায় হাত রেখে নওশাদ বললো,”এমনই থাকিস মা, ওদেরকে চাদরের মতো জড়িয়ে ধরে রাখিস এভাবেই। আমি না থাকলেও তোরা যেনো পালটে যাস না।”
বহ্নি বুঝতে পারেনা বাবা এমন কেনো করছে হঠাৎ, কি হয়েছে মানুষটার হঠাৎ করে?

“কার নাম বললে তুমি?”
প্রত্যাশা দ্বিগুণ দৃঢ়তার সাথে বললো,”অনুপমা, কেনো নাম শোনেননি আগে?”
“এই নাম তোমাকে কে বলেছে?”
“যে-ই বলুক, সে কে?”
উৎস রাগে উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,”তোমাকে বলতে হবে সে কে?”
“হ্যা বলতে হবে।”
উৎস বাকিদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। এরপর প্রত্যাশার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আশা করি এটা বলার পর আর কোনোদিন আমার সামনে তুমি আসবে না।”
প্রত্যাশা উত্তর দেয়না।

“অনুপমা আমার জীবনে শূন্যের মতো এক নারী। শূন্য থেকে শুরু হয় সংখ্যা আর ওই নারী থেকে সূচনা হয়েছে আমার অনুভূতির। ওই শুন্যেই শুরু আমার, ওই শুন্যেই ফেলি শ্বাস, ওই শুন্য জুড়েই লেখা আছে আমার সর্বনাশ। এই পৃথিবীতে দুইজন নারীর চোখের নালিশে আমি উৎস পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারি। তারমধ্যে একজন আমার মা, অন্যজন আমার অনুপমা। অনুপমা আমার জীবনে যুদ্ধক্ষেত্র আচমকা ছুটে আসা এক বুলেটের নাম, যে আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে আজীবনের জন্য, আমি চাইলেও যাকে সরাতে পারবো না। আমার কাজল চোখের প্রেয়সী, আমার বসন্তের প্রথম গোলাপ, আমার শান্তি আমার অনুপমা। যার শীতলতায় আমার মতো উৎস ঠান্ডা হতে বাধ্য। যার জন্য আমি মৃত্যুর দরজায় আঘাত হানতেও দুই মিনিট সময় নিবোনা।”
উৎস থামে, থমথম করতে থাকে পরিবেশ। প্রত্যাশা রাগে ছুটে চলে যায় সেখান থেকে। আবির উৎসের হাত ধরে বসায়। অস্থিরতার সাথে পা নাড়াতে থাকে উৎস। ভালো লাগছে না হঠাৎ করে কিছু। একটু শান্তির প্রয়োজন, চলে যাবে নাকি শীতলের কলেজে? তার যে খুব তৃষ্ণা পাচ্ছে।

বহ্নিকে নিয়ে ভার্সিটি থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা ব্রীজের উপর এসেছে নওশাদ। মেয়েটা ঝালমুড়ি খেয়েছে, বাদাম খেয়েছে। একদম সেই ছোটবেলার মতো। তার উচ্ছ্বাস দেখতে ভালো লাগছে নওশাদের। মেয়েটা ছোট থেকেই এমন উচ্ছল। যা যা খেয়েছে আবার কিছুটা করে ব্যাগের মধ্যে রেখেও দিয়েছে। বাড়ি যেয়ে বোনদের দিবে। সে ভাবতেই পারেনা সে বাবার কাছ থেকে একা কিছু খাবে।
“মা বেলুন কিনবি? দেখ কেমন লাইট দেওয়া বেলুন।”
“বাবা তোমার মাথা ঠিক আছে? আমার কি এখন লাইট ওয়ালা বেলুন দিয়ে খেলার বয়স আছে?”
নওশাদ বহ্নির বারণ শোনেনা। তিনটা বেলুন কিনে মেয়ের হাতে দেয়। বহ্নি হেসেই শেষ। আজ যে বাবার কি হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

“বহ্নি।”
“বলো বাবা।”
“তোকে আমার কিছু কথা বলার আছে।”
“হ্যা বলো না।”
নওশাদ দুই হাত বুকে বেঁধে কিছুটা দূরে যেয়ে দাঁড়ায়। নিচে অস্বচ্ছ পানির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে কিছুক্ষণ। বহ্নি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে।

“তুই যে আমার কি শখের আমি হয়তো কোনোদিন তোকে বোঝাতে পারবো না। শীতল, আভা, উৎস ওদের সবাইকে আমি আমার জীবন দিয়ে ভালোবাসলেও বাবা ডাক আমি প্রথম তোর কাছ থেকে শুনেছি। বাবা হওয়ার যে অনুভূতি, তা তোর জন্মের পর আমি বুঝেছি। তুই যখন প্রথম হাঁটতে শিখলি, ছোট্ট ছোট্ট পায়ে সারাবাড়ি বিচরণ ছিলো তোর। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, সবকিছু এতো ভালো লাগতো। সবাই প্রথমে মা কে ডাকে, তুই ডাকলি বাবা। তোর মায়ের কি রাগ তাতে। সে যতোই রাগে, আমি ততই হাসি। বাবা বাবা বলে বাড়ি মাথায় করতিস তুই। আমি একবারও বিরক্ত হতাম না। তুই অসুস্থ হলে তোর মা কিছু কর‍তে না দিয়ে আমি সব করতাম। সারারাত তোকে কোলে বসিয়ে রাখতাম তোর জ্বর হলে। বলতে পারিস তুই আমার কাছে একটা জীবন্ত পুতুল ছিলি।”
বহ্নি বাবার বাহু আঁকড়ে তার কাঁধে মাথা রাখে।
“বাবা আমি তো জানি তুমি আমাকে কতোটা ভালোবাসো। আমার জীবনে সুপারহিরো তুমি। আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা।”
নওশাদ ম্লান হাসে।
“তোর কোনো কষ্ট হলে আমার দুনিয়া উলোটপালোট করে ফেলতে ইচ্ছা করে। আমি যে মেয়েকে একটা কষ্টের আঁচ পেতে দিইনি, আমি চাইনা আর কেউ তা করার সাহস পাক।”
বহ্নি ঈষৎ কেঁপে ওঠে। হাত ছেড়ে দেয় বাবার।

“এসব কেনো বলছো বাবা? কেউ তো আমাকে কষ্ট দেয়নি।”
নওশাদ স্মিত হাসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে। বহ্নি চোখ নামিয়ে নেয়।
“সত্যিই কি তাই?”
“হ্যা বাবা সত্যি। তাছাড়া আমি তো তোমার লৌহমানবী কন্যা। এতো সহজে কি আমি কষ্ট পাই?”
নওশাদ মেয়ের মাথায় হাত রাখে। বহ্নি ঢোক চেপে অন্যদিকে তাকায়। এখন সে কাঁদতে চাচ্ছে না, কোনোভাবেই না।
“মা রে তোর চোখে আমি কোনোদিন কান্না দেখতে চাইনি। তবে আজ আমার মনে হচ্ছে তোর একটু কাঁদার খুব দরকার। তুই কাঁদ মা, চিৎকার করে কাঁদ। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাইলে কাঁদতে পারিস। ভিতরের জমাট বাঁধা কষ্টটা চোখের পানি দিয়ে বাষ্প করে উড়িয়ে দে। যতোক্ষণ ইচ্ছা কাঁদতে পারিস। আমি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করবো শেষ না হওয়া পর্যন্ত। কোনো ব্যস্ততা নেই আমার।”
বহ্নি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”বাবা এসব কি বলছো? আমার তো কান্না পাচ্ছে না।”
নওশাদ ম্লান হাসে।
“ভয় নেই, কেউ দেখবে না। না শীতল, না আভা, না তোর মা বা ফুপু। ওদের কাছে সেই আগের বহ্নিই থাকবি তুই। শক্ত, কঠিন, লৌহমানবী।”

বহ্নি নিজেকে প্রস্তুত করে। হ্যা আজ সে কাঁদবে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদবে সে। এতোদিন যা পারেনি, আজ সে তাই করবে। সত্যিই হালকা হওয়ার দরকার তার। অপবিত্র হয়ে আছে শরীর, সেই শরীর আর কোনোদিন হয়তো পবিত্র হবে না। কিন্তু মনটাকে তো পবিত্র করা যায়। এই চোখের পানিতে ধুয়েমুছে যাবে সব। পবিত্র কি হবে না এতে?

সন্ধ্যা থেকে মাথা খারাপ শীতলের। তার মনেই ছিলোনা তার কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সামনেই। আজকেই নাম লেখাতে হলো যে যে অংশগ্রহণ করবে। শীতল খুব ভালো গান করে, ডিগ্রীতে পড়া মেয়েগুলো নিজেরাই ওর নাম দিয়ে দিয়েছে। একক আর দ্বৈত দুইটা গানেই ওকে দেওয়া হয়েছে। একক তো ঠিক আছে কিন্তু দ্বৈত কীভাবে? কার সাথে?
আভা শীতলের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বললো,”মেজো আপা তো তূর্য স্যারকে বল না, গান করতে তোর সাথে।”
শীতল রেগে আভার দিকে তাকাতেই সে পড়িমরি করে দৌড় দেয়। এখন মেজো আপার যে মেজাজ, কয়েকটা চড় থাপ্পড় দেওয়াটাও অসম্ভব না।

বহ্নির মাথাটা ভীষণ ধরেছে। সে চা নিয়ে বসেছে বারান্দায়। দুইটার ক্যাচক্যাচ শুনতে ইচ্ছা করছে না এ মুহুর্তে।

“বাবা বাবা।”
শীতলের ডাক শুনে নওশাদ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। তার নিজের মাথাটাও কিছুটা ধরেছে।
“বাবা তুমি আভাকে সাবধান করে দাও, সকাল সন্ধ্যা আমার পেছনে পড়ে আছে।”
নওশাদ হালকা হেসে শীতলের মাথায় হাত রাখে। মেয়েটা হুটহাট করে কেমন রেগে যায় আবার একটু পরেই নামের মতো শীতল হয়ে যায়।

“আমার মা জননীর কি মেজাজ একটু খারাপ?”
“একটু না বাবা, অনেক খারাপ অনেক।”
“হাত দিয়ে মেপে দেখা তো কতোটা? এই এতোটা নাকি আরো বেশি?”
নওশাদ দুই হাত প্রসারিত করে।
“বাবা সবসময় কিন্তু ইয়ার্কি ভালো লাগেনা।”
শীতলের চোখ ভর্তি পানি। বিচলিত হয়ে যায় নওশাদ। মেয়েটা ছোট থেকেই এমন ছিঁচকাঁদুনে, কিছু হলেই কান্না।
“আচ্ছা আচ্ছা মজা করছি না। বলবি তো আমাকে কাহিনী কি? না বললে বুঝবো কীভাবে?”

“উফফ তোদের চিৎকার চেচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে একটু বারান্দায় বসেছি চা নিয়ে। তাও দু’দণ্ড বসতে দিলি না। এখন এখানে এসেও চিৎকার করতে হবে?”
শীতল গলা নামিয়ে বললো,”তোর আর কি, পড়িস তো সেই ভার্সিটিতে। আমার মতো মহিলা কলেজে পড়লে বুঝতে পারতিস, একটা পার্টনারের কি অভাব।”
বহ্নি আর নওশাদ দুইজনই অবাক হয়ে তাকায় শীতলের দিকে।

“পার্টনার?”
“আরে না না ওই পার্টনার না, গানের পার্টনার।”
নওশাদ শীতলের দিকে তাকিয়ে বললো,”গানের পার্টনার মানে?”
শীতল খুলে বলে সবটা। নওশাদ সবটা বুঝে শব্দ করে হাসে।
বহ্নি বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, “হাসছো কেনো বাবা? গানটা মনে হচ্ছে শীতলের সাথে তুমি-ই গাইবে।”
“গাইতেও পারি, আমার গলা তো নেহাৎ খারাপ না।”
শীতল চমকে উঠে বললো,”মাফ চাই বাবা, তোমার ওই হেঁড়ে গলায় দয়া করে গান ধরোনা। আমার দর্শক উঠে পালাবে।”
নওশাদ হাসে, তার মেয়েগুলো এতো মজার কেনো? ওরা যা বলে তাতেই কেমন মজা লাগে তার।

বহ্নিও হাসে।
“কথাটা শীতল মন্দ বলেনি। ফুপু আর তুমি দুই ভাইবোন। অথচ ফুপুর গলা কতো মিষ্টি, আর তোমার? আমাদের উৎসটাও তার মায়ের মতো সুন্দর গান করে।”
“না রে মা, উৎস গান করে ওর বাবার মতো। ওর বাবার কণ্ঠ বেশ গমগমে আর পুরুষালী ছিলো, ঠিক উৎসের মতো।”
হঠাৎ কি মনে করে নওশাদ চোখ বড় বড় করে বললো,”ভালো কথা বলেছিস তো, শীতলের পার্টনার পেয়ে গেছি।”
“কে বাবা?”
“উৎস, উৎস। উৎসই হবে আমাদের শীতলের পার্টনার।”
কান লাল হয়ে ওঠে শীতলের, বহ্নির চোখ এড়ায় না।
নওশাদ সাথে সাথেই বলে,”গানের পার্টনার হিসেবে তোদের বেশ জমবে। দুইজনের গলা পাশাপাশি বেশ যাবে, কি বলিস বহ্নি?”
বহ্নি মুচকি হেসে বললো,”দেখো তোমার আদরের ভাগ্নে রাজি হয় কিনা। তাকে কিছু বলতেই তো ভয় করে।”
শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আঙ্গুলে ওড়না পেঁচাতে থাকে। হাত-পা কাঁপছে তার। সত্যিই এমন সৌভাগ্য হবে তার? তার পাশে দাঁড়িয়ে এক অতি সুদর্শন পুরুষ ভারী পুরুষালি গলায় গান করছে, যে কিনা তার খুব শখের এটা কি স্বপ্ন ব্যতীত বাস্তব হতে পারে?

“সে চিন্তা আমার। তুই যা তো বহ্নি, চট করে উৎসকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আয়, বল আমি ডাকছি।”
বহ্নি কাপ রেখে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে গেলেই নওশাদ কি মনে করে পিছন থেকে ডাকে তাকে।
“আচ্ছা আমি যাচ্ছি। তোকে যেতে হবে না।”
বহ্নি সরু চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করে।

উঠোনের মাঝখানে মাদুর পেতে গোল হয়ে বসেছে সবাই। মাঝে নওশাদ, তার গা ঘেঁষে আভা। শীতল আর বহ্নি পাশাপাশি। সায়েরাও মোড়া পেতে বসেছে। শাহানা আসেনি, তার নাকি এসব আদিখ্যেতা মনে হয়।
উৎস বসেনি, বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শীতলের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় সে। আচ্ছা, এই মেয়েটা কি দিন দিন আরো রূপবতী হচ্ছে নাকি তার প্রেম দিন দিন আরো বাড়ছে? অতি সাধারণ ঘরের পোষাকেও কেনো কোনো তরুনীকে এতো রূপবতী মনে হবে?
এই বেলা করে গোসল দিয়েছে কেনো গাধীটা? সে কি জানেনা দেরিতে গোসল করলে তার ঠান্ডা বসে যায়? লম্বা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে এখনো। উৎসের কাছে অগ্রহায়ণের ভোরের শিশিরের মতো লাগে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়া পানিগুলো। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করে।

“উৎস গান শুরু কর।”
“মানে কি মামা? আমি গান পারিনা।”
“খুব মারবো কিন্তু এবার উৎস।”
শীতল খুশিতে বহ্নিকে জাপটে ধরে, বহ্নি বিরক্ত হয়ে ছাড়িয়ে নেয়। এ কি তাল শুরু করেছে মেয়েটা?

“কি রে শুরু কর।”
“মামা আপনি আমার গান শুনতে আমাকে ডেকে আনবেন জানলে আমি কোনোদিন আসতাম না।”
নওশাদ কিছু বলার আগে সায়েরা ছেলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো,”একটা গান কর না রে বাবা। মামা এতো করে বলছে।”
উৎস আড়চোখে শীতলের দিকে তাকায়। শীতল পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা সবটা জানার পর যা শুরু করেছে, উৎস মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। নাহ, খুবই আহ্লাদী শুরু করেছে, খুবই। একটা শাস্তি দিতেই হবে ওকে।

“কি রে শুরু কর।”
“মামা অনেকদিন ওসব করিনা। কোন গানটা করবো বলে দিন।”
“ওই যে একটা গান আছে না? আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, ওটা কর। ওটা দারুণ করতো তোর বাবা। কতোবার যে শুনেছি ওর কণ্ঠে। সায়েরাও তো ভালোবাসতো গানটা, তাইনা রে?”
সায়েরা ছোট্ট করে হাসে।

উৎস একবার শীতলের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি
তোমায় দেখতে আমি পাইনি
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে।

আমার সকল ভালোবাসায়
সকল আঘাত, সকল আশায়
আমার সকল ভালোবাসায়
সকল আঘাত, সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে
তুমি ছিলে।

আমি তোমার কাছে যাইনি।

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি
তোমায় দেখতে আমি পাইনি
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে।’

উৎসের কণ্ঠে গমগম করতে থাকে খাঁ বাড়ির আঙিনা। নওশাদ শীতলের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে শুরু করতে। শীতলের কোনোদিকে ধ্যান নেই, তার অস্তিত্ব জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। ছটফট করছে আবেগ গুলো, অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসার জন্য।

‘তুমি মোর আনন্দ হয়ে
ছিলে আমার খেলায়
তুমি মোর আনন্দ হয়ে
ছিলে আমার খেলায়
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম
কেটেছে দিন হেলায়।

গোপন রহি গভীর প্রাণে
আমার দুঃখ সুখের গানে
গোপন রহি গভীর প্রাণে
আমার দুঃখ সুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি।

আমি তোমার গান তো গাই নি।

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি
তোমায় দেখতে আমি পাইনি
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে।’

উৎস হতভম্ব হয়ে তাকায় শীতলের দিকে। নি:শ্বাস নিতেও যেনো ভুলে গেছে। দমবন্ধ লাগছে তার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। অদ্ভুত একটা তেষ্টা পায় তার। পানির নয়, নয় সিগারেটেরও। তবে কিসের তেষ্টা? নেশার মতো জেঁকে ধরে তেষ্টাটা তাকে। না মেটালে যেনো মৃত্যুই হয়ে যাবে। এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি কেনো তার?

ছাদ থেকে উঠোনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রণ। এখান থেকে বহ্নিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার মুখ বিষাদে ছেয়ে আছে। তার ইচ্ছা করছে ছুটে যেতে। তবে সে পারবে না। অদৃশ্য জালে আটকা সে।
ঠোঁটের কোণায় বিড়বিড় করে কবিতার সুর ভেসে ওঠে তার।
‘হঠাৎ হৃদয়ে আচমকা দমকা হাওয়া।
ভেবেছি ফাগুনের, অত:পর তা ছিলো কালবৈশাখীর পূর্বাভাস।
বুঝতে না পারায় এই অধমের হলো সর্বনাশ।’

শীতল আর উৎস দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এটা পৃথিবী নয়, পৃথিবীর বাইরের কোনো জায়গা। চারপাশে কেউ নেই তারা দু’টি ছাড়া। উথাল-পাতাল প্রেম দুইজনের দৃষ্টিতে। প্রেম নিবেদন বাদেই চলছে আদানপ্রদান। দূর থেকেই চলছে অলিখিত প্রেমপত্রের চালাচালি।

ঠিক এই মুহুর্তে একটা পুরুষের চেহারা ভেসে ওঠে আভার সামনে। মাথায় একরাশ ঘন কালো কোঁকড়াচুল, জঙ্গলের মতো দাড়ি সারা মুখজুড়ে। সুন্দর হাসি, তীক্ষ্ণ চোখ, সাবলীল চাহনি। যে শ্বেতশুভ্র পাঞ্জাবি পরে আছে, তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আর বলছে মিস ‘নিলামে ওঠা হাবা’ আপনার চোখ দু’টো মাতলা নদীর মতো উত্তাল। বাম হাতে মাদুর চেপে ধরে আভা।

মেয়ের এতো সুন্দর গান শুনে ছুটে এসেছে শাহানা। বুকটা ধুকপুক করছে তার। গানটা অসম্ভব প্রিয় শাহানার। বিয়ের পর অনেকবার গানটা করে শুনিয়েছে মেয়েদের বাবাকে। মানুষটা মুগ্ধ হয়ে শুনতো। সেই মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে আবারও নতুন করে প্রেমে পড়তো সুদর্শন শ্যামবর্ণ পুরুষটির। আজ কীভাবে নিজেকে সামলে রাখে সে? এসেই সোজাসুজি তাকায় সে স্বামীর দিকে। ঘিয়ে রঙা পাঞ্জাবিটায় যেনো সেই সময়ের মতোই সুদর্শন লাগছে তাকে। আচ্ছা আজ কি একটু বেশি সুন্দর লাগছে তাকে? নাকি তার ভ্রম?
নওশাদেরও চোখ যায় অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা তার দোয়েল পাখির দিকে। চুলে এলোমেলো খোঁপা, আঁচল গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে, উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি শুধু তার দিকেই নিবদ্ধ। নওশাদ মুচকি হাসে সেদিকে তাকিয়ে। বহ্নি সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। বাবা মায়ের প্রেমের মতো তার জীবনে কখনো আসবে উথাল-পাতাল প্রেম? জোয়ারের মতো ভালোবাসা ভাসিয়ে দিবে কি তাকে কোনোদিন? অপরপক্ষের পুরুষটি পাগলের মতো ভালোবাসবে কি তাকে? দুই হাতে তাকে বুকে টেনে নিয়ে তার ভিতরের সমস্ত কষ্ট শুষে নিবে? ভালোবাসা দিয়ে পবিত্র করে দিবে আবার তাকে? বহ্নি চোখ বন্ধ করে। সাথে সাথে আবার চোখ মেলে। কি আশ্চর্য, ওই মানুষটার মুখ কেনো ভাসছে? এসব কি হচ্ছে? বহ্নি উপরের দিকে তাকায় কি মনে করে। পরক্ষণেই চমকে ওঠে। এটা কি সত্যি নাকি স্বপ্ন? সে যে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়েই। আচ্ছা সে কি তবে পুনরায় প্রেমে পড়লো? তা না হলে এই আকর্ষণের মানে কি? কারণ কি?

সায়েরা একবার ছেলের দিকে আরেকবার শীতলের দিকে তাকায়। দুইজনের চোখে অপর প্রান্তের জন্য যে সীমাহীন মুগ্ধতা তা রোমাঞ্চিত করে তাকে। হ্যা, ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়, হতেই হয়। বিয়ের আগে তাকে এ বাড়িতেই টিউশন পড়াতে আসতো মানুষটা। সেখান থেকেই প্রনয়, তারপর পরিণয়। এমনই এক অর্ধ জ্যোৎস্নার রাতে, নওশাদ তাকে বলেছিলো গান করতে। ঠিক এই গানটাই করেছিলো সে, সেদিন বোধহয় সে নিজেও গলা মিলিয়েছিলো তার সাথে। এভাবেই দুইজন অপার মুগ্ধতায় দুইজনের দিকে তাকিয়ে ছিলো গান শেষ হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত। সেই দৃষ্টি চোখ এড়ায়নি নওশাদের। বিয়ের জন্য ভেবেছিলো সে তারপরেই। আজ যেনো সেই একই আঙিনায় নতুন করে সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। উৎস কোথায়? এ যে স্বয়ং তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে, আর শীতলের জায়গায় যেনো নিজেকেই দেখতে পায় সায়েরা। দুই চোখ বেয়ে অবলীলায় পানি গড়িয়ে পড়ে। আঁচল দিয়ে মোছার তাগিদ অনুভব করেনা সে। পড়ুক অশ্রু, আজ শত বছরের পুরোনো রাত ধরা দিয়েছে নতুন করে। একই উঠোনে রচিত হচ্ছে আরো এক প্রেমের উপন্যাস। কিছুটা বর্ধিত, বাকিটা অপরিবর্তিত।

(চলবে……)

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ১৭

বহ্নির শরীরটা রাত থেকে ভালোনা। শেষরাতের পর জ্বর এসেছে। সকালের পর জ্বর নামলেও শরীর বেশ দূর্বল। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস থাকা সত্ত্বেও আজ সে ভার্সিটি যাবেনা। বাবার পাশে চাদর গায়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে সে। নওশাদ চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে তাকে খেতে দিচ্ছে।
শীতল বারবার সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে। যদি কলেজে যাওয়ার আগে তাকে একনজর দেখা যায়। কিন্তু কোথায় কি, নবারের এখনো ঘুমই ভাঙেনি হয়তো।

হঠাৎ সিঁড়িতে কারো পায়ের আওয়াজ শুনে নড়েচড়ে বসে শীতল। অতি সাবধানে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে। স্টীলের প্লেটের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেয়, কাজলটা আবার লেপ্টে গেলো কিনা।
কিন্তু সবাইকে বেশ অবাক করে দিয়ে উৎস না, বরং রণ নেমে আসে। সবাই অবাক হওয়ার বিশেষ কারণ সে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এসেছে। সাথে আবার কালো সেই ব্যাগটা, যার মধ্যে সে জামাকাপড় আর বইগুলো এনেছিলো।
বহ্নি জ্বরে ক্লান্ত চোখজোড়া মেলে তাকায় তার দিকে। রণ একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। শেষ বেলায় মিথ্যে মায়ায় আর জড়াতে চায়না সে।

নওশাদই প্রথম কথা বলে।
“রণ আজ কি তোমার কোনো চাকরির পরীক্ষা আছে?”
রণ মাথা নিচু করেই বললো,”জ্বি চাচা, আমার খুব ভালো একটা জায়গা থেকে ডাক এসেছে। অনেকদিন আগেই লিখিত পরীক্ষা দিয়েছিলাম। গ্রাম থেকে এসে পরীক্ষাটা দিয়েই আবার ফিরে গিয়েছিলাম। এরপর অনেকদিন কেটে যাওয়ার পর আমি ভেবেছিলাম আমি বোধহয় পাশ করিনি। কিন্তু গতকাল আমাকে খবর দেওয়া হয়েছে যে আমি লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছি চাচা। আজ মৌখিক পরীক্ষা, আজ পাশ করতে পারলে চাকরিটা আমার হয়ে যাবে। আমার স্বপ্ন পূরণ হবে চাচা, আমি একজন ব্যাংকার হয়ে যাবো।”
নওশাদ সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। বহ্নির শরীরজুড়ে অদ্ভুত একটা মিষ্টি বাতাস বয়ে যায়। তার মুখের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি চোখ এড়ায় না শীতলের। সে বেশ অবাক হয় আপাকে দেখে। তাকে কি কিছুটা অস্বাভাবিক লাগছে না?

নওশাদ দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে রণকে জড়িয়ে ধরে, রণও তার পিঠে হাত ছোঁয়ায়।
“খুব ভালো খবর বাবা। আমি যে কি খুশি হয়েছি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আমি খুব আশাবাদী ছিলাম তোমাকে নিয়ে। তোমার মতো মেধাবী ছাত্র একদিন ঠিক তোমার যোগ্য স্থানে পৌঁছাবে আমার বিশ্বাস ছিলো।”
রণ ম্লান হেসে বললো,”চাচা এখনো মৌখিক পরীক্ষা বাকি, এখনই এতো আশা করবেন না।”
“আমার মন বলছে চাকরিটা তোমার হয়ে যাবে।”
হঠাৎ নওশাদের চোখ যায় পাশে রাখা ব্যাগটার দিকে।
“রণ এতো বড় ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
রণ অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে করতে বললো,”চাচা আমি পরীক্ষা দিয়ে ওদিক থেকেই বাড়িতে চলে যাবো।”
বহ্নি উঠে দাঁড়ায় সাথে সাথে। শারিরীক দুর্বলতার জন্য দাঁড়ানোর পরপরই মাথাটা ঘুরে ওঠে তার। আভা পাশে থাকায় সে তাড়াতাড়ি ধরে বসে তাকে। রণ সেদিকে তাকায়না, নিজের মনের উপর জোর করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

“কি বললে বাবা? আজকেই চলে যাবে তুমি?”
“জ্বি চাচা, অনেকদিন তো হলো। আপনাদের আর কতো বিরক্ত করবো? তাছাড়া বাবার জন্যও মনটা কাঁদছে খুব। আমি ছাড়া তো তার আর কেউ নেই।”
নওশাদ আড়চোখে শাহানার দিকে তাকায়। শাহানা নির্লিপ্ত মুখে তাকিয়ে আছে।

“তাই বলে আজই চলে যাবে তুমি?”
রণ ছোট্ট করে হাসে, কিছু বলেনা। সেই হাসিটা কেনো যেনো ভীষণ বিষাদে মাখা। বহ্নির খুব কষ্ট হতে থাকে হঠাৎ। শাহানা তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে দেখতে থাকে। মেয়ের মুখের প্রতিটা রেখা পরিবর্তন যেনো বুঝতে চেষ্টা করে সে।

“আবার কবে আসবে বাবা?”
“যদি চাকরিটা হয় তবে অবশ্যই আপনাকে, চাচীকে, ফুপুকে আর হ্যা অবশ্যই উৎস ভাইকে জানাতে আসবো। আর যদি চাকরিটা না হয়, তবে এই ব্যর্থ চেহারা আর দেখাতে আসবো না আপনাদের।”
“এভাবে কেনো বলছো রণ? মানুষ কি একবারে সব সফলতা পায়? একবার না পারিলে দেখো শতবার।”
রণ মুচকি হেসে বললো,”তবে শতবার চেষ্টার পর যেদিন সফল হবো সেদিনই আসবো।”
নওশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রণের কাঁধে হাত রাখে।
“আর ক’টা দিন থেকে গেলে হয়না বাবা? তুমি যে কয়টা দিন এসেছো বাড়িটা কেমন ভরা ভরা লাগতো। হ্যা তোমার অস্তিত্ব হয়তো খুব বেশি বোঝা যেতোনা, তুমি নিজেই পড়ে থাকতে উপরের ঘরে একাই। তারপরেও আমার মনে হচ্ছে বাড়িটা কেমন খালি খালি হয়ে যাবে।”
রণ ধরা গলায় বললো,”আপনি অনেক আবেগী মানুষ চাচা, আমার দেখা ভীষণ ভালো একজন মানুষ। আপনি আমার জন্য যা করেছেন, সেই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবোনা।”
“কি এমন করেছি বাবা?”
নওশাদ কথা শেষ করে পকেটে হাত দেয়। পকেট হাতড়ে যে কয়টা টাকা পায় মুঠো ভরে এনে রণের পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। রণ সরে যায় কিছুটা।

“না না চাচা এসব কি করছেন? কোনো টাকার প্রয়োজন নেই।”
“বাবাদের উপরে কথা বলতে নেই রণ, কতো বড় হয়েছো তুমি?”
রণ চুপ করে যায়। অবাধ্য চোখ বার বার ওদিকে তাকাতে মন চাচ্ছে, যেদিকে একটা দেবীর মতো শ্যামসুষমা সজল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রণ দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

“অনেক শুভ কামনা রইলো বাবা, যতোটা ভালো থাকা সম্ভব। আমার ভাঙা ঘরটা অন্ধকার করে চলে যাচ্ছো তুমি। আমি চাইলেও তোমাকে আটকে রাখতে পারছিনা। আমার যে কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে।”
নওশাদ শার্টের হাতায় চোখ মোছে। রণ অভিভূত হয়ে যায়। এই মানুষটা কি দিয়ে তৈরি? এতো ভালো মানুষ কি হয়? মাত্র কয়দিন হলো এ বাড়িতে এসেছে সে। আর তাতেই নাকি তার কাছে ঘর অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে রণ চলে যাওয়ায়। পুরুষ মানুষের চোখে সহজে পানি আসেনা। যখন আসে তখন সত্যিই ধরে নিতে হবে তার কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে।
রণ হঠাৎ জড়িয়ে ধরে নওশাদকে। সে স্পষ্ট টের পায় মানুষটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। এতো ভালোবাসা পেয়েছে তার মতো একটা ছেলে এমন একজন মানুষের?

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রণ গেটের কাছে আসতেই কারো উপস্থিতি টের পায় তার পিছনে। রণ থমকে যায়। নি:শব্দ উপস্থিতিও সে দিব্বি বুঝতে পারছে।

রণ তাকায় না পিছনে। একজোড়া সজল রাঙা চোখের স্মৃতি নিয়ে সে ফিরতে চায়। এর বাইরে আর কিছু না।

“রণ সাহেব।”
মিষ্টি গলার স্বর, কিছুটা ভারী হয়ে আছে।
“বলুন মিস বহ্নি।”
বহ্নি অপ্রস্তুত বোধ করে। সে কি বলবে সে জানেনা। এখানে কেনো এসেছে তাও সে জানেনা। রণ চলে গেলে যাবে, এতে তার কি? মাত্র কিছুদিনের পরিচয়ে তার মতো শক্ত মনের মেয়ের প্রেম হতে পারেনা বলে তার ধারণা। কিন্তু মনের কোথায় একটা অদ্ভুত তোলপাড় হচ্ছে, একরাশ শূন্যতা গ্রাস করেছে হৃৎপিণ্ডের প্রতিটা প্রকোষ্ঠ।

“আপনি উৎসকে বলেছেন যে আপনি চলে যাচ্ছেন?”
রণ স্মিত হাসে ছোট্ট করে।
“উনাকে বলতে পারিনি মিস বহ্নি। আমার কোনো ভাই নেই, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কেমন হয় আমার জানা নেই। উৎস ভাই আমাকে শিখিয়েছে ভ্রাতৃত্ব কাকে বলে। মাত্র এই কয়দিনের মধ্যে কেউ কাউকে এতোটা আপন করে নিতে পারে উনাকে না দেখলে আমি বুঝতাম না। আমার ঘুমাতে অসুবিধা হবে বলে উনি মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমাতেন। আমার কোনো নিষেধ শুনতেন না। আমি একা একা খাবো বলে নিজের খাবারটাও ঘরে এনে খেতেন। আমি সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারিনা। এটা আমি উনাকে কখনো না বললেও উনি কীভাবে যেনো বুঝে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে সিগারেট ধরালে উনি ছাদে চলে যেতেন। আমি আক্ষেপ করলেই বলতেন আমি যেদিন চাকরি পাবো, আমার সেই হাসিমুখ দেখলেই নাকি উনার সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে। কিন্তু আজ আমি সফলতা বা ব্যর্থতার মধ্যে এক দোদুল্যমান অবস্থাতেই এ বাড়ি থেকে বিদায় নিচ্ছি। উনাকে বলার মতো সাহস আমার নেই, সেই মুখ নেই। আজ উনি দেরি করে উঠবেন রাতেই বলেছেন, সকালে ক্লাস নেই। তাই আমি এই সুযোগে বেরিয়ে পড়েছি। যদি ভাগ্যে থাকে আবার দেখা হবে।”
বহ্নি চুপচাপ শোনে রণের কথা।
“শুধু উৎসই বুঝি আপনার জন্য অনেক ভেবেছে? আপনাকে আপন করে নিয়েছে? এ বাড়ির আর কেউ না?”
“এসব কি বলছেন মিস বহ্নি? এ বাড়ির প্রতিটা মানুষ আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছে এ কয়দিনে আমি সারাজীবনও তা ভুলবো না। চাচার মতো মানুষ আমি দুনিয়ায় আর একটাও দেখিনি। এছাড়া চাচী, ফুপু, আপনি, শীতল, আভা সবাই খুব ভালো। গ্রামে এক অন্ধ বাবা ছাড়া আমার আর কেউ তেমন নেই। পরিবার বলতে ওই একজনই। এখানে এসে আমি জেনেছি পরিবার কি, হাসি আনন্দ কি, একসাথে থাকাটা কতোটা সুখের। এই পরিবারের কাছে আমি সারাজীবন ঋণী থেকে যাবো মিস বহ্নি।”
বহ্নি আশাহত হয়, সে অন্যকিছু শুনতে চেয়েছিলো।

“তবে মিস বহ্নি….”
বহ্নি আগ্রহের সাথে বললো,”বলুন।”
“আপনি আমার কাছে আবদার করেছিলেন প্রতিদিন আপনাকে একটা কবিতা শোনাতে। আমি সে কথা রাখতে পারলাম না। তবে আমার কবিতার ডায়েরিটা আপনার কাছে থাকলো। অনুর্বর মস্তিষ্ক থেকে আসা কিছু উলোটপালোট শব্দের বিন্যাসে আমি সাজিয়েছি আমার মনমতো কিছু কথা, তাকে কবিতা বলা যায় কিনা আমি জানিনা। যদি খুব মন খারাপ হয় কোনো কারণে পড়বেন। আমার কোনো লেখা যদি বিন্দুমাত্র আপনার খুশির কারণ হয়, আপনার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটাতে পারে, তবে আমার এ জীবন স্বার্থক।”
কথাটা শেষ করে রণ কিঞ্চিৎ হাসে। হাসিটা বহ্নির মস্তিষ্কে যেয়ে সূক্ষ্ম আ’ঘাত করে। সাধারণ চেহারার মধ্যে অসাধারণ হাসিটুকু পুরো মানুষটিকে অসাধারণ করে রেখেছে।

বহ্নি হঠাৎ কি মনে করে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”আপনি বাড়ি যাবেন ঠিক কয়টায়?”
“সন্ধ্যা সাতটার বাস আমার।”
“আর মৌখিক পরীক্ষা শেষ হবে কয়টায়?”
“সঠিক বলতে পারছি না তবে দুপুর তিনটা নাগাদ শেষ হবে। ওখান থেকে আর এখানে আসবো না তাই ব্যাগ সাথে নিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু কেনো?”
বহ্নি এদিক ওদিক দেখে। গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে তার। জোর করেও নিজের কাঠিন্য ধরে রাখতে পারছে না। শীতলের মতো আবেগী হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।

“বিকাল চারটার দিকে বড় ব্রীজের সামনের মোড়টায় অপেক্ষা করবেন।”
রণ যেনো নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না।
“কি বললেন?”
বহ্নি কঠিন গলায় বললো,”বুঝতে পারেননি কি বলছি? ঠিক বিকাল চারটা, এক মিনিটও যেনো দেরী না হয়। আমি যাবো, অপেক্ষা করবেন আমার জন্য।”
রণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে বহ্নির দিকে। এই মেয়েটা এতো রূপবতী কেনো? এক নারীর জন্য ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিলো, আচ্ছা শখের নারী কি সেই নারীর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রূপবতী নয়? পরক্ষণেই চমকে ওঠে সে, এসব কি ভাবছে? বহ্নি কেনো তার শখের নারী হতে যাবে?

“মিস বহ্নি…..”
“পারবেন কিনা বলুন, চিনবেন তো?”
রণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো,”কতো সহস্র চোরাগলি তো চিনে গেলাম, শুধু এক মায়াবতীর রহস্যের ঠিকানা এখনো খুঁজে পেলাম না। অচেনা রাস্তায় পেলাম না ঠাঁই।”
“কিছু বলছেন?”
“জ্বি না।”
“তবে অপেক্ষা করবেন তো?”
রণ ছোট্ট করে উত্তর দেয়,”মায়াবতীর আদেশ উপেক্ষা করার দু:সাহস প্রকৃতি কোনো পুরুষকে দেয়নি হয়তো, আমি কোন ছাড়?”
বহ্নি ঈষৎ কেঁপে ওঠে রণের কথায়। রণ মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়। বহ্নি দাঁড়িয়ে থাকে গ্রিলে হাত দিয়ে। একহারা লম্বা ছায়াটা ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে আঙিনা, আঙিনা থেকে বাইরের রাস্তায় আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। বহ্নির চোখ জ্বালা করত্র থাকে, মনে হয় জ্বরটা আবার জেঁকে ধরবে তাকে।

দুপুরের পর ভার্সিটিতে এসেছে উৎস। ভার্সিটিতে এসেই তার প্রথম কাজ ক্যান্টিনে বসে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাবে, দলবল নিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিবে এরপর ক্লাসে যাবে। তবে আজ কিছু ভালো লাগছে না তার। সকাল থেকেই মেজাজটা কেমন চড়ে ছিলো, এরপর শুনলো রণ চলে গেছে। তারপর থেকে মনটাও কিছুটা খারাপ। তার মন কখনো তেমন খারাপ হয়না। তবে আজ সত্যিই খারাপ লাগছে কেমন। ছেলেটা সাধারণের মধ্যেও যেনো অসাধারণ ছিলো, উৎস অনেক কিছু শিখেছে তার কাছ থেকে। তার একটা গোপন ব্যাপারও উৎস জানতে পেরেছে। তবে জেনেও নিজের মধ্যেই রেখেছে, কাউকে জানায়নি কিছু।

হঠাৎ দূর থেকে উৎসেরই এক ঘনিষ্ঠ কাছের ভাই আজিমকে ছুটে আসতে দেখে বেশ অবাক হয় সে। কোনো বিপদ নয় তো আবার?
উৎসের কাছাকাছি এসে ছেলেটা থামে, হাঁপাতে থাকে খুব।
“আজিম কোনো সমস্যা?”
আজিম উত্তর দেয়না, জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।
উৎস এবার একটু ধমকে ওঠে।
“আজিম কিছু জিজ্ঞেস করছি না?”
আজিম উৎসের দিকে তাকিয়ে বললো,”ভাই একটা খবর পেলাম। সকাল থেকে আপনাকে খুঁজেছি, পাইনি। খবরটা পেয়ে সোজা দৌড়ে চলে এলাম।

উৎস আজিমের কাঁধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,”আজিম, কি ব্যাপার রে? আশা করি সবকিছু ঠিক আছে? রুস্তম? রুস্তম কি আবার কোনো মেয়েকে?”
“জ্বি ভাই, রুস্তম আবার এক মেয়ের পিছে লেগেছে। তবে…”
উৎস রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”ওরে তো আমি এবার জানে মেরে ফেলবো।”
“ভাই আমার কথাটা তো শুনুন।”
“আবার কি কথা?”
“মেয়েটা আমাদের ভার্সিটির নয় ভাই।”
উৎস কিছুটা দমে যায়।
“ভার্সিটির নয়?”
“না ভাই।”
আবির উৎসের পাশে বসেই চা খাচ্ছিলো। আজিমের কথায় উঠে দাঁড়ায় সে।

“দেখ আজিম আমাদের ক্ষমতা কতোটুকু? আমরা সাধারণ ছাত্র নেতা। ওর মতো মাফিয়ার কতো খারাপ কাজ। এটা তো সিনেমা নয় যে আমরা উড়ে যেয়ে সব গুণ্ডাদের মেরে আসবো। বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা কর।”
আজিম মাথা নিচু করে ফেলে।
উৎস আবিরকে হাত উঁচু করে থামতে ইশারা করে।
“আজিম মেয়েটা কে? তুই জেনেছিস কীভাবে?”
আজিম মাথা তুলে বললো,”মেয়েটা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী ভাই।”
উৎসের হঠাৎ একটা ছোট্ট ধাক্কা লাগে, শীতলও তো সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী।

“মেয়েটার সাথে আমার ছোট বোন পড়ে। ও আমাকে বেশ কিছুদিন আগে বলেছিলো, ওদের সাথে একটা মেয়ে পড়ে। সে কলেজ থেকে বের হওয়ার পর নাকি প্রায়ই মোটরসাইকেলে করে কয়েকটা ছেলে তাকে অনুসরণ করে মেয়েটার বাড়ি পর্যন্ত যায়। ছেলেগুলো রোজই কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। প্রথম পাত্তা না দিলেও আমার বোনের রোজকার কথায় আমি নিজে যাই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে। ভাই ঘটনা সত্যি। তবে ছেলেগুলো যে রুস্তমের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি ওই ঘটনার পর ভালো করেই চিনি ওদের। ওরাই ওভাবে লাল বা সাদা কাপড়ে মুখ বেঁধে এলাকা ঘুরে বেড়ায়। তবে যদি তাই হয় ঘটনা সুবিধার না ভাই। রুস্তম কোনো মেয়ের দিকে চোখ দিলে তার সর্বনাশ করেই ছাড়ে। নোংরা ব্যবসাও আছে ওর। আমার বোনটা খুব মন খারাপ করে ভাই। একই সাথে পড়ে, ওর খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে ভাই।”
উৎসের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। তার দিকে তাকিয়ে আবির বুঝতে পারে উৎস কি ভাবছে।

আবির আজিমের দিকে তাকিয়ে বললো,”আজিম মেয়েটার নাম কি? তোর বোন বলেছে?”
আজিম মাথা চুলকে বললো,”এই রে নামটাই তো ভুলে গেলাম। তবে কেমন একটা নাম যেনো, সচারাচর শোনা যায়না।”
উৎস সাথে সাথে ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়িতে সময় তিনটা বেজে সাঁইত্রিশ মিনিট। শীতলের কলেজ ছুটি হয় চারটায়।
উৎস তৎক্ষনাৎ আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো,”আজ আর ক্লাস করবো না, আমি একটূ আসছি।”
আবির তাকে থামিয়ে বললো,”এখন আবার তুই কোথায় যাচ্ছিস? উৎস তোকে সাবধান করলাম কোনো ঝামেলায় যাস না।”
উৎস আবিরের হাত ছুটিয়ে বললো,”কোনো ঝামেলায় যাবো না, সেইটাই করবো যা একটা পুরুষ মানুষের করা উচিত। যদি না পারি মায়ের কাছ থেকে এক জোড়া চুড়ি নিয়ে পরে বসে থাকবো।”
আবির জানে উৎস কেনো এতো তাড়াহুড়ো করছে। সে পিছন থেকে হালকা চিৎকার করে।
“উৎস আমি আসি?”
“দরকার নেই।”
উৎস চলে যায়। আবির মৃদু হাসে সেদিকে তাকিয়ে।প্রেম বড়ই অদ্ভুত একটা ব্যাপার। ভালো নাকি মন্দ এখনো জানেনা আবির। শুধু জানে এ জিনিস কারো কাছে আসুক বা না আসুক, সে পস্তাবেই।

শীতলের কলেজের সামনে উৎস যখন পৌঁছায় তখন ঘড়িতে সময় তিনটা আটান্ন মিনিট। একদম ঝড়ের বেগেই চলে এসেছে সে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে সে।
হঠাৎ তার মনে হলো তার বাঁ পাশ দিয়ে গোটা তিনেক মোটরসাইকেল খুব দ্রুত শাঁই করে বেরিয়ে গেলো। উৎস কিছু বুঝে ওঠার আগেই, একদম কাছ থেকে। উৎস চমকে যায় একরকম। কি মনে করে আবার ভালো করে তাকাতেই দেখে চালকের মুখ সাদা কাপড়ে ঢাকা, আর কাউকে তেমন দেখতে পায়না। ওর মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। ওরা কি তবে রুস্তমের লোক? রুস্তমের লোকেরা উৎসকে ভালো করেই চিনে। তবে কি ওকে দেখেই ওরা চলে গেলো? ওরা কোন মেয়েকে অনুসরণ করছে? এতো মেয়েদের মধ্যে ও কীভাবে বুঝবে? তবে কি ওর আরেকটু সাবধান হয়ে আসা উচিত ছিলো? যাতে করে ওরা পালাতে না পারে? উৎস রাগে ঠোঁট কামড়ে ধরে।

চোখের সামনে হাতের ঘড়িটা উঁচু করতেই রণ শিউরে ওঠে। ঘড়িটা নষ্ট হওয়ার সময় পেলো না? এটা কখন বারোটা দশে এসে থেমে গেছে ও টেরও পায়নি। রণ ম্লান হাসে, ভাগ্যের সাথে ঘড়িটারও বারোটা বেজে গেছে।
বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ হাঁটাহাঁটি করে রণ। তার মনে হচ্ছে সত্যিই বোধহয় ঘড়ির মতো সময় থমকে গেছে। নাহলে চারটা কি বাজেনি এখনো? মিস বহ্নি তো দেরি করার মতো মানুষ না। যদি তাই হয় চারটা বাজছে না কেনো? কখন বাজবে? শেষবারের মতো চন্দ্ররূপটা দেখা হবে তো? নাকি সে আসবে না? শেষ সময়ও মজা করবে তার সাথে?

আরো অনেকটা সময় চলে যায়। রণ মোটামুটি নিশ্চিত বহ্নি তাকে বোকা বানিয়েছে। চারটার বেশি বাজে অবশ্যই। রণ ঠিক করে সে আর দাঁড়াবে না। বাকিটা সময় বাস কাউন্টারে যেয়ে অপেক্ষা করবে বাসের জন্য। এই মায়ার শহরে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে, এখানে কেউ কারোনা। এ শহর নিষ্ঠুর, ঠিক শহরের মানুষগুলোর মতো।
একদলা চাপা কান্না গিলে রণ যখন দুই পা হাঁটতে যাবে ঠিক তখন সত্যিই তার দমটা আটকে যায়। মনে হয় কোনো ভ্রম। ধূ ধূ মরুভূমিতে পথিক যখন হাঁটতে হাঁটতে নিদারুণ ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন তার মনে হয় সামনে বুঝি সরোবর আছে। সেই সরোবরে আছে স্বচ্ছ, শীতল পানি। পথিক যতোই দৌড়ায় সরোবর ততই দূরে যায়। একে বলে মরীচিকা।
তবে সত্যিই তার মনে হচ্ছে সে বোধহয় ধূ ধূ মরুভূমির এক পথিক। সে তেষ্টায় মৃতপ্রায়। তার সামনে স্বচ্ছ সরোবর। তার গলা শুকিয়ে কাঠ, তার প্রয়োজন ঠান্ডা শীতল পানি, নাহলে তেষ্টায় তার মৃত্যু অনিবার্য।

মেরুন রঙা শাড়িতে যেনো সাক্ষাৎ পরী তার সামনে। মাথাভর্তি চুলে আলুথালু খোঁপা, তাতে চারটে ভৃঙ্গরাজ উঁকি দিচ্ছে। দুই হাতে কিছু রেশমি চুড়ি, যার টুংটাং আওয়াজ সুন্দর কোনো সুর নিয়ে আসছে দূর থেকে যেনো। সামান্য কাজলের ছোঁয়া ব্যর্থ হয়নি সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে, তাকে সাহায্য করেছে ভ্রু যুগলের মাঝে ছোট্ট কালো টিপটি।
রণ ঢোক চাপে, এই তৃষ্ণায় মরে যাওয়াও বুঝি শান্তির।

“খুব বেশি দেরি করে ফেললাম? আপনি রাগ হননি নিশ্চয়ই?”
এতোটা কাছে দাঁড়িয়েও ধ্যান ভাঙ্গে না রণের। চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে ওঠে একনাগাড়ে তপ্ত শ্বাসের ভাপে।

কলেজ থেকে বের হয়ে উৎসকে দেখে থমকে যায় শীতল। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। উনি এখানে? তবে কি আজকেও আগের দিনের মতো সুন্দর একটা বিকেল হওয়া সম্ভব? যে বিকেল শুধুমাত্র এক অতি সুদর্শন প্রেমিক আর তার অনুপমার? খুশিতে মনটা নেচে ওঠে। ইশ তার সময়টা এতো ভালো যাচ্ছে কেনো? জীবন যদি এখানেই থেমে যেতো। এভাবেই চলে যেতো সারাটা জীবন।
মেয়েদের কলকলানিতে গেটে দাঁড়ানো দায়। উৎস কিছুটা দূরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। কিছু মেয়ে বেশ অবাক হয়ে দেখছে তাকে যেতে যেতে। উৎসের নজর সেদিকে নেই। শুধু শীতল রাগে ফুটতে থাকে।তোরা যাচ্ছিস যা না, সুপুরুষ আগে দেখিস নি?

ভীর কিছুটা কমার পর শীতল এসে দাঁড়ায় উৎসের সামনে। উৎস নির্বিকার চোখে তাকায়।
শীতল মাথা নিচু করে লাজুক মুখে বললো,”আজ কোথায় যাবো আমরা উৎস ভাই?”
উৎস কথার উত্তর না দিয়ে আচমকা শীতলের কপালে হাত দেয়। বরফের মতো জমে যায় শীতল। প্রিয় মানুষের স্পর্শ এতো সুখকর কেনো? শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে শীতল।
উৎস শীতলের কপালের বাঁকা টিপটা বাঁ হাতে ঠিক করে দেয়, এরপর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।

“যেটা দিতে পারোনা তো দাও কেনো? এই বাঁকা টিপ নিয়ে সারাদিন কলেজ করেছো?”
শীতল কিছুই বুঝতে পারেনা, কই সে তো ঠিকমতো টিপ দিয়েই বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো। আর তেমন হলে তো অগ্নিই বলতো তাকে।
উৎসের ঠোঁটের কোণায় একটা দুষ্টু হাসি ফুটে ওঠে। গাধীটা আসলেই গাধী। তাকে একটু ছোঁয়ার বাহানা, বোঝার মতো জ্ঞান কি আছে?

“শোনো শীতল, আজ থেকে আমি তোমাকে কলেজ থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবো। আর কোনো টিউশনের দরকার নেই। দরকার হয় আমি তোমাকে পড়াবো বাসায়। আমি না আসা পর্যন্ত এক পা-ও একা কোথাও যাবে না।”
শীতল স্তম্ভিত হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়। এটা কি তার সেই চিরপরিচিত উৎস ভাই নাকি তার রূপ নেওয়া অন্য কেউ? এতো মিষ্টি করে কথা? আবার তাকে কিনা বাড়িতে পড়াবে সে?

“ওভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? মানছি আমি সুন্দর, তাই বলে ওভাবে সবসময় তাকিয়ে থাকার কিছু নেই।”
শীতল লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে মিটমিট করে হাসে। আজ অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে তার। সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। মানুষটাকে যতো গভীরভাবে আবিষ্কার করছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। গম্ভীর মানুষটিও বুঝি প্রেমিক রূপে স্নিগ্ধতায় রূপ নেয়?

কন্যা সুন্দর আলো নেমেছে। গোধূলির ঠিক আগ মুহুর্তে পশ্চিম আকাশ টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সূর্য বিদায় নেওয়ার আগে যেনো আকাশ জুড়ে সিঁদুরের রঙ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারই ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্য দিনের শেষবারের মতো হলুদাভ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই আলো কিছুটা এসে পড়ে ধরণীর বুকে উন্মুক্ত আকাশের নিচে থাকা তরুণীগুলোর চুলে, নাকের ডগায়, মুখজুড়ে, বক্ষে, পুরো শরীর জুড়ে। সেই আলোয় তরুণীদের সর্বোচ্চ সুন্দর কর‍তে প্রকৃতি উঠে পড়ে লেগে যায়। যে কোনো তরুণীকেই বোধহয় এই আলোয় রাজরানীর মতো রূপবতী মনে হয়, ভ্রম হয় তাদের দেখলে। হয়তো পুরুষ সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে নারীদের এক হাতিয়ার এ আলো, ঠিক যেমন ভ্রমর আকৃষ্ট হয় রঙিন ফুলের প্রতি।

আচ্ছা, সূর্য কি জানে? তার এই অসামান্য আলোয় হাজারও নারীর মধ্যে দুই রূপবতীকে আজ তাদের প্রেমিক মুগ্ধ হয়ে দেখার চেষ্টায় হিমশিম খাচ্ছে? পুনরায় প্রেমে পড়ছে, বারংবার পড়ছে। বোধহয় সূর্য জানে, নাহলে আজ প্রেমিকদের এতো সুন্দর লাগছে কেনো অষ্টাদশী আর বছর তেইশের দুই অসামান্য রমনী দু’টিকে? একই আকাশের নিচে দুই প্রেমিক অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে আছে সামনের ললনার দিকে, অথচ কেউ জানেনা!

(চলবে……)