#মাতাল_প্রেমসন্ধি
পর্ব : ১৮
পশ্চিম আকাশ হালকা লাল হওয়া শুরু করেছে, সূর্য ডোবার আগাম বার্তা জানাচ্ছে প্রকৃতিকে। রণ আর বহ্নি একটা চায়ের দোকানের অদূরেই একটা কাঠের বেঞ্চে বসে আছে। রণ যথাসম্ভব চেপে বসেছে, ছোট বেঞ্চ কোনোভাবেই যেনো স্পর্শ না করে বহ্নিকে।
তবে বহ্নি মনে হলো খুব মজা পাচ্ছে। সে চা নিয়েছে দোকান থেকে। ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে কাপে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এমন মজার চা সে কোনোদিন খায়নি আগে।
রণ চা নেয়নি, বহ্নির খাওয়া দেখছে বাঁকা চোখে তাকিয়ে। তবে বহ্নিকে দেখে তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আবেগী মেয়েগুলো কষ্ট পেলে কাঁদে, যারা নিজেদের শক্ত খোলসে আবৃত রাখে তারা কষ্টে কাঁদে না, বরং উপর উপর দেখায় তারা কতোটা সুখে আছে।
রণই নীরবতা ভাঙে প্রথম।
“মিস বহ্নি।”
বহ্নি চা খেতে খেতেই বললো,”বলুন রণ সাহেব।”
রণ কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান? হঠাৎ আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন যে?”
বহ্নি অন্যদিকে ফিরেই বললো,”কেনো কিছু বলার না থাকলে দেখা করতে পারিনা? আপনার বাসের তো এখনো অনেক দেরি আছে। আপনার যদি অন্য কোনো ব্যস্ততা থাকে আপনি চলে যেতে পারেন। আমি আরো দুই কাপ চা খাবো, আমার অসাধারণ লেগেছে এখানের চা। এমন মজার চা কখনো খাইনি আমি।”
রণ তাড়াতাড়ি করে বললো,”না না কোনো ব্যস্ততা নেই। আপনি শেষ করুন, আমি অপেক্ষা করছি।”
বহ্নি রণের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনার মৌখিক পরীক্ষা কেমন হলো? মিষ্টি কি খাচ্ছি আমরা?”
রণ হালকা হেসে বললো,”আপনি মিষ্টি খেতে চাইলে এখনই খাওয়াচ্ছি।”
“পরীক্ষা কি ভালো হয়নি?”
রণ মাটির দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,”দেখা যাক।”
বহ্নি দুই কাপ চা খায়না, হাতের কাপটা শেষ করেই আচমকা উঠে দাঁড়ায়।
“উঠে পড়লেন যে? আরো দুই কাপ খাবেন না?”
বহ্নি চোখমুখ কুঁচকে বললো,”না আর খাবো না, চায়ের মধ্যে হরলিক্স দিয়েছে। বিশ্রী লাগছে খেতে।”
একদলা থুতু ফেলে বহ্নি মাটিতে। রণ বিস্মিত হয়, মেয়েটা কি অদ্ভুত। একটু আগেই বলছিলো এমন অসাধারণ চা নাকি আগে খায়নি কখনো।
পাশাপাশি হাঁটছে বহ্নি আর রণ। রণের নিজের ভাগ্যবান মনে হচ্ছে খুব। এমন একটা বিকেল যে তার জীবনে আসতে পারে সে কোনোদিন ভাবতে পারেনি যে বিকেলে তার পাশাপাশি হাঁটার সৌভাগ্য হবে এক রূপবতী রাজকন্যার সাথে।
“রণ সাহেব।”
“জ্বি বলুন মিস বহ্নি।”
“আপনি বুদ্ধিমান, ঠিকই ধরেছেন। আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায়, যা চোখের নিমিষেই আমার জীবন উলোটপালোট করে দিয়েছে। আমি এখন পর্যন্ত কাউকে এ কথা বলতে পারিনি, কেউ জানেনা।”
রণ অবাক হয়ে বললো,”আপনি যে কথা কাউকে বলতে পারেননি সে কথা আমাকে বলবেন?”
“কেনো আপনি শুনতে চাচ্ছেন না? তাহলে থাক।”
“না না তা বলিনি। আসলে আপনি এতো অল্প সময়ে আমাকে এতোটা বিশ্বাস করছেন আমি ভাবতেও পারছি না।”
বহ্নি দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ। রণের চোখের দিকে তাকায়, একদম দৃষ্টি ভেদ করে। রণ ভেবাচেকা খেয়ে যায় আচমকা।
“বছরের পর বছর একসাথে সংসার করে, একই ছাদের নিচে থেকে, একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে, যুগের পর যুগ হাজারটা মুহুর্ত দুইজন ভাগাভাগি করে নেওয়ার পরও কি সবসময় দুইজন দুইজনের আপন হতে পারে? সবসময় কি ভাগ্য মিলিয়ে দেয় দুইজনের আবেগ? আমার মন চেয়েছে আপনাকে বলতে। মনে হয়েছে আপনি আমার কথা ধৈর্য্য ধরে শুনবেন। একটা বছর নিজের মধ্যে সবকিছু চেপে রাখতে রাখতে আমি ক্লান্ত, আমি কাউকে বলতে চাই আমার কথাগুলো।”
রণ দুই হাত বুকে বেঁধে দাঁড়ায় শান্ত হয়ে।
“আপনি বলুন, আমি ধৈর্য্য ধরে শুনবো।”
“যদি আপনার বাস মিস হয়ে যায়?”
রণ হালকা হেসে বললো,”বাস মিস হলে বাস আবার পাবো কিন্তু মায়াবতী মিস হয়ে গেলে তাকে আর পাবো না।”
বহ্নি আবার হাঁটা শুরু করতে করতে আনমনে হাসে, প্রতিত্তোর করেনা রণের কথার কোনো।
“আমি তখন মাত্রই প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছি। প্রেম ভালোবাসায় কখনো তেমন বিশ্বাসী ছিলাম না। বাবাকে দেখেছি মা’কে কীভাবে ভালোবেসেছে, আগলে রেখেছে। তাই জীবনসঙ্গীর বিষয়টা ভাগ্যের উপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তবে সেই আমি কীভাবে বদলে গেলাম, কি থেকে কি হয়ে গেলো নিজেই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎই জড়িয়ে পড়লাম একজনের মায়ায়, ভালোবাসায়। অবশ্য এক্ষেত্রে অপর পক্ষ থেকেই অগ্রগতি ছিলো বেশি। আমি আরো অনেক পরে একটু একটু করে প্রেমে পড়লাম, রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে কাটতে থাকে আমার জীবন।”
রণের হৃদয়ে ছোট্ট একটা ধাক্কা লাগে। যদিও বহ্নি তার প্রেমিকা নয়, তবুও এমন কষ্ট কেনো লাগছে তার?
বহ্নি রণের ফ্যাকাশে চেহারার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে।
“তার নাম ছিলো সজীব, আমাদেরই সিনিয়র ছিলো ভার্সিটিতে। আমরা যেবার ভার্সিটিতে ঢুকলাম, সে সেবার চতুর্থ বর্ষে। তখন থেকেই আমাকে প্রস্তাব দেওয়া শুরু করে আর আমি রাজি হই আমার দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতে যেয়ে। এতোগুলো দিন সে আমার পিছনে জোঁকের মতো পড়ে ছিলো। আমি প্রথমে পাত্তা দিইনি, ওইযে বললাম প্রেম ভালোবাসায় আমি কোনোদিনই বিশ্বাসী ছিলাম না। তবে হঠাৎ করে আমার মননে পরিবর্তন আসে। আমি একদিন বুঝতে পারি আমি নিজেও তার জন্য অপেক্ষা করছি, তাকে একটু দেখার জন্য আমার প্রাণ ছটফট করছে, তাকে পাশে না দেখলে দম আটকে আসছে। আমি বুঝলাম আমি পুরোপুরি ভাবে সজীব নামক মানুষটার অপার মায়ায় আটকে গিয়েছি।”
রণের দমবন্ধ লাগছে, শুনতে ইচ্ছা করছে না এসব কথা। না শুনেও উপায় নেই, সে যে বিশ্বাস করে তাকে বলতে চেয়েছে। না বলবে কীভাবে?
“খুব সুন্দর চলছিলো আমার দিনগুলো। দারুণ সুন্দর সুপুরুষ ছিলো সে। যে কেউ একবার দেখলেই মুগ্ধ হতে বাধ্য। আমি সেই তুলনায় মোটেই সুন্দরী নই। তবুও সে আমাকে বুঝাতে সফল হয়েছিলো যে সে আমাতেই বিমুগ্ধ, আমাতেই পাগল। বছর দেড়েক ভালোই কাটলো। খুব বেশি ঘনিষ্ঠ প্রেম না হলেও দুইজনের প্রতি দুইজনের টানটা কম ছিলো না, অন্তত আমার তাই মনে হতো। সে তখন ভার্সিটি থেকে বের হয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তবুও রোজ সকালে আমাকে আমাদের বাড়ির পাকা রাস্তা থেকে নিয়ে ভার্সিটি পর্যন্ত দিয়ে আসতো। আমি বারণ করতাম, সে শুনতো না। অবশ্য আমারও ভালো লাগতো। শুধু ভয় হতো বাবা কোনোদিন দেখে ফেললে আমাকে খারাপ ভাববে।
এরকমই এক সকালে সজীব আমাকে জানালো তার ভিসা চলে এসেছে, পরের মাসেই সে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। আমাকে এতোদিন কিছু বলেনি খবরটা দিয়ে আমাকে চমকে দিবে তাই। হ্যা আমি চমকে গিয়েছিলাম বটে, ভীষণ চমকে গিয়েছিলাম।”
বহ্নি থামে, বড় করে শ্বাস নেয়। তার চোখেমুখে একরাশ কষ্ট ফুটে ওঠে।
“আপনার যদি কষ্ট হয় আর বলবেন না।”
বহ্নি ছোট্ট করে হেসে বললো,”আমি ঠিক আছি।”
“তাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। আমি সত্যিই তখন তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমি মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। সজীব এসে আমার হাত ধরে। আমাকে তখন সে বলে আমার জন্য নাকি আরো একটা চমকপ্রদ খবর আছে। আর তা হলো সে যাওয়ার আগেই আমাকে আংটি পরিয়ে যাবে, এক বছর পর দেশে ফিরলে এরপর বিয়ে হবে। তারপর আমাকেও ওর সাথে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাবে। ওদের পরিবার থেকেও রাজি। তারা আসবে আমার বাবার সাথে কথা বলতে। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা রণ সাহেব, সেদিন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী মনে হচ্ছিলো। একবার ইচ্ছা করছে হাওয়ায় ভেসে যেতে আরেকবার ইচ্ছা করছে রঙিন প্রজাপতির মতো ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতে। আমার সামনে তখন আমার প্রেমিক, আমার ভালোবাসা যে আমাকে কথা দিয়েছে যাওয়ার আগেই একটা বন্ধনে আবদ্ধ হবে সে আমার সাথে। আমি ওখানেই খুশিতে কেঁদে ফেলি। আমার খুশি দেখে সে-ও খুশি।”
“বাহ ভালো তো।”
বহ্নি ম্লান হেসে বললো,”হ্যা ভালোই বটে। এরপর সজীব আমাকে বলে সেদিন আমার ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমাকে নিয়ে আংটির মাপ নিতে যাবে, এরপর ওদের বাড়িতে ছোট্ট একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান আছে ওর স্কলারশিপ পাওয়া উপলক্ষে। আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। বাবা মা’কে না জানিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি আমার কখনো তার আগে। আমি না করে দিই সাথে সাথে। সব যখন ঠিক হয়েই আছে, আগে বাবাকে জানানো হোক। এরপর নাহয় তার বাড়িতে যাবো আমি। সজীব আমাকে বলে, আজ তার মামা, খালা, চাচা সবাই আসবে। তার হবু বউকে দেখবে সবাই। আমাকে অনুরোধ করতে থাকে। এটাও বলে যে সন্ধ্যার পর পরই আমাকে বাড়িতে পৌঁছায় দিবে। আমি রাজিও হইনা আবার না-ও বলতে পারিনা। প্রেমটা মোটামুটি বছর দেড়েকের হলেও আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া বেশ হয়েছে খুব ভালোই। তবুও আমার একদমই মন সায় দিচ্ছিলো না। সজীব আমাকে আর জোর করেনা, তবে তার মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়। আমার খুব খারাপ লাগে দেখে। আমি হৃষ্টচিত্তে না বললেও মনের বিরুদ্ধে জোর করে হ্যা বলে দিই।”
বহ্নি হাতঘড়ির দিকে তাকায়, ছয়টা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি এখনো। তার মানে আরো কিছুক্ষণ রণের সাথে কথা বলা যায়।
“তারপর কি হলো? আপনি গেলেন?”
বহ্নি হ্যা সূচক মাথা নাড়ে আস্তে আস্তে।
“আমি গেলাম রণ সাহেব। প্রথমে একটা আংটির দোকান থেকে সজীব আমাকে অনেক দামী একটা আংটি কিনে দেয়। কিনে দেয় বললে ভুল হবে, আংটিটা ও নিজের কাছেই রাখে। বলে যে যেদিন বাবার সাথে কথা বলে তাকে রাজি করিয়ে আংটিবদল অনুষ্ঠান করবে সেদিনই আমাকে এটা পরিয়ে দিবে। আমার ওসবে কোনো চিন্তা ছিলোনা, আমি হাসিমুখে মেনে নিই।
এরপর আমাকে নিয়ে ও ওদের বাড়িতে গেলো।”
বহ্নি থামে আবারও, তার দৃষ্টি দূর আকাশের দিকে।
“অনুষ্ঠানে সবাই আপনাকে দেখে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলো?”
“খুশি হয়েছিলো কিনা ঠিক জানিনা, সবাই কম বেশি হাসিমুখেই আপ্যায়ন করলো আমাকে। সজীবের বাবা, মা, বোন সবাই ছিলো সেখানে। বাইরের আত্মীয়রাও ছিলো। তাদের সাথে খাওয়া দাওয়া করলাম কিছু। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে বাড়িতে। দেরি হলে সবাই খুব দুশ্চিন্তা করবে। আমি বারবার সজীবকে ইশারা করছিলাম। আমার ইশারা বুঝতে পেরে ও সম্মতি জানায়। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বাইরে আসলেই ও বলে যে ওর মোটরসাইকেলের চাবি ভুল করে রেখে এসেছে ও ওর ঘরে। ওই বাড়িতে ওর দুইটা ঘর। একটা দোতলায় আরেকটা বাড়ির সামনে বাগানের মধ্যে, একটু ভিতরের দিকে। এখানে নাকি ওর বৃষ্টিবিলাশ করতে বেশ ভালো লাগে, এজন্য তার বাবাকে বলে ঘরটা বানিয়েছে সে। চাবিটা ওখানেই ছিলো। ও আমাকে বললো ওর এই ঘরটাও দেখে যেতে। আমি যেতে চাচ্ছিলাম না। ওকে বললাম আমি বাইরে অপেক্ষা করছি, সে যেনো নিজে যেয়ে নিয়ে আসে। ও আমাকে হালকা জোর করে, ঘরটা দেখে নাকি আমার খুব ভালো লাগবে, মনমতো সাজিয়েছে ও। ওর খুব শখের ঘর ইত্যাদি। আমি বাধ্য হয়ে ওকে অনুসরণ করি। তখন প্রায় সন্ধ্যে, এই এমন সময়ই।”
রণ গম্ভীর গলায় বললো,”তারপর?”
“তারপর আমি ওর পিছু পিছু ঘরে যাই। ঘরটা ভীষণ অন্ধকার ছিলো। আমি ওকে আলো জ্বালাতে বললাম। ও জানালো এই ঘরে নাকি কোনো আলো নেই, ইচ্ছা করেই রাখেনি। অন্ধকার নাকি ভালো লাগে ওর ভীষণ, এজন্য। আমি বেশ অবাক হলাম। আমি বললাম তাহলে আমাকে এখানে এনে লাভ কি? বাইরের আলোও বেশি ঢোকে না ঘরে, আমি এখানে কি দেখবো? এই বলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাই আমি। আচমকা সজীব আমার হাত টেনে ধরে। আমি হতবাক হয়ে যাই। জোরাজোরি করি যেনো আমার হাত ছেড়ে দেয়। এমন না যে এর আগে ও আমার হাত ধরেনি। তবে সে দু’টিতে অনেক তফাত। এ হাত ধরায় কোনো প্রেম ছিলোনা। আমি চিৎকার করতে গেলে ও আমার মুখ চেপে ধরে। আমি ওকে কামড়ে, খামচে পালাতে যাই সেখান থেকে। কিন্তু ও আমার থেকে আরো অনেকটা লম্বা আর স্বাস্থ্যবান। কোনোভাবেই পারিনা নিজেকে ছাড়াতে। তবুও কয়েকবার চিৎকার করেছি, সেই চিৎকার বিশাল বাগানের বাইরেই যেতে পারেনি, বাড়ির ভিতর ঢোকা দূরে থাক।”
রণ বিস্ফারিত চোখে তাকায় বহ্নির দিকে, বহ্নি নির্বিকার।
“কি বলছেন আপনি? নিজেকে বাঁচালেন কীভাবে এরপর?”
বহ্নি কঠিন গলায় বললো,”বাঁচাতে তো পারিনি।”
“তার মানে?”
“মানে আপনি যা ভাবছেন তাই।”
রণ অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় বহ্নির দিকে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে কিছুতেই। বহ্নি অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে থাকে। রণ টের পায় সে ঈষৎ কাঁপছে।
“জানোয়ারটা কি করলো এরপর?”
“এরপর সে আমাকে সুন্দরমতো বাড়ি পৌঁছে দিলো। সে আমাকে বললো ভয় না পেতে, ভুল যখন করেই ফেলেছে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগেই আমাকে বিয়ে করে রেখে যাবে। কিন্তু আমি স্বাভাবিক হতে পারিনি। সারারাত সেদিন ট্যাপ ছেড়ে বসে ছিলাম বাথরুমে। এতো এতো পানি দিয়ে নিজেকে পবিত্র করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু অপবিত্রতা ছাড়েনি আমার শরীর। আমি মুখ চেপে ধরে সারারাত কেঁদেছি, অজ্ঞান হয়ে পড়েও ছিলাম বাথরুমে। সে আমাকে বিয়ে করতে চাইলেও আমার করা উচিত কিনা আমি বুঝতে পারছিলাম না। একবার ভেবেছিলাম উৎসকে বলবো সব। তখন মাত্রই নিজের ভার্সিটিতে ছাত্রনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে সে। ওকে বললে হয়তো মেরেই ফেলতো সজীবকে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি যে এমন কিছু হলে বাবা তো মরেই যাবে, এতো চাপ নিতে পারবে না। তার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে? আমার ছোট বোন দু’টোর কি হবে? আমি ঠিক করলাম বিয়েটা আমি করবো ওকে। তাছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করলে তো তাকে ঠকানো হবে আমার। দুর্ঘটনাটা হোক আমার ইচ্ছায় বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে।”
রণ কোনো কথা বলতে পারেনা, ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে থাকে সে।
“তবে না সজীবের সাথে আমার আর দেখা হয়না, ওটাই ছিলো আমাদের শেষ দেখা কিংবা শেষ কথা।”
“তার মানে?”
“বেশ কিছুদিন হয়ে যাওয়ার পরেও যখন সজীবের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই যে আমি ওর বাড়িতে যাবো। যদিও নিজের প্রতি অসম্ভব ঘৃণা হচ্ছিলো আমার। আমি আমার বাবার আদর্শে বড় হয়ে এ কি করে বসলাম? তবুও আমি গেলাম। সেখানে যেয়ে জানতে পারি সজীব আরো তিনদিন আগেই অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। আর বাড়িতে বলেছে আমি নাকি বিয়েটা করতে চাইনি, এজন্য ওরা আর আগায়নি এ ব্যাপারে।”
রণ চিৎকার করে বললো,”আপনি জানোয়ারটাকে ছেড়ে দিলেন? কোনো শাস্তি দিলেন না ওকে?”
বহ্নি শান্ত গলায় বললো,”রণ সাহেব, এমন যে ভাবিনি তা নয়। নিজের উপর নিজের বিতৃষ্ণা হতো, মরে যেতে ইচ্ছা করতো। আত্মহ’ত্যা করার চেষ্টাও করেছি, ব্যর্থ হয়েছি। মরতে ভয় পাই খুব, আমার যে বাঁচার অনেক ইচ্ছা।”
“ছি বহ্নি আপনাকে আমি দৃঢ় মেরুদণ্ডের একজন ভেবেছিলাম, সেই আপনিও এমন বোকা আর দূর্বল? একটা অসভ্যের জন্য নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছেন তাকে শাস্তি না দিয়ে?”
“শাস্তি? এই সমাজে কি পুরুষেরা কোনো শাস্তি পায়? শাস্তি শেষমেশ আমারই হতো। আদালতে যেতে হতো, সেখানে রগরগে বর্ণনা থাকতো সবকিছুর। আমার বাবা শেষ বয়সে একটা পাপী কন্যার পিতা হিসেবে হেয় হতো সমাজের কাছে, আমার ছোট বোন দুইটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হতো। আর কি হতো রণ সাহেব? সজীব তো অস্ট্রেলিয়ায়, সে আর কোনোদিন ফিরেই আসতো না হয়তো জেল খাটার ভয়ে। ওখানেই তার জীবন শান্তিতে পরিপূর্ণ।”
রণ উত্তর দেয়না। তার ইচ্ছা করছে এখনই ওই জানোয়ারটার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দিতে।
“এই কথা আমি কাউকে বলিনি। আমার বান্ধবীরা এটুকু জানে যে সজীব আমার সাথে প্রতারণা করেছে, আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠকিয়ে চলে গেছে। এরবেশি আর কিছু তারা জানেনা, আমি জানাইনি। আমি এটা জানি যে আমার মা আমার ভার্সিটিতে যেয়ে ওদের কাছে আমার কথা শুনেছে, তারা যেটুকু জানে তা জানিয়েছে মা কে।”
“তাই বলে সত্যিই আপনি কিছু করবেন না বহ্নি? আপনাকে তো আমি এমনটা ভাবিনি।”
বহ্নি হাসে, কিছু বলেনা।
“হাসবেন না বহ্নি, আমি সহ্য করতে পারছি না আপনার মতো মেয়ের এমন নির্লিপ্ততা।”
বহ্নি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাতটা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি।
“দেখুন রণ সাহেব, হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত চলে এসেছি। আপনার বাস কোনটা?”
রণ এতোক্ষণ খেয়ালই করেনি, আসলেই তো তারা বাসস্ট্যান্ডে। কখন হেঁটে এদিকে চলে এসেছে তার মনেই নেই। সময়জ্ঞানও নেই, এক্ষুনি তো তার বাস ছাড়বে। কিন্তু এই মুহুর্তে আর একদম যেতে ইচ্ছা করছে না, একটুও না।
“যান রণ সাহেব, আপনার আগামীর জন্য শুভ কামনা রইলো। আশা করি আবার দেখা হবে আপনার সাথে, সেদিন আপনার মুখে সফলতার হাসি থাকবে।”
রণের মনে হয় তার কান্না আসবে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার কোথায় যেনো। নিজেকে সামলাতে পারছে না সে।
“আপনি কিছুই করবেন না? ওকে এভাবেই ছেড়ে দিবেন আপনি?”
বাস হর্ণ দেয় তখনই।
“বাসে উঠুন, সাবধানে যাবেন। আর হ্যা ভালো থাকবেন।”
“আপনি আগে আমাকে বলুন, আপনি ওকে এভাবে ছেড়ে দিবেন?”
বহ্নি একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হাসে।
“ছাড়বো কে বলেছে? ছাড়বো না তো। রক্তস্নান না হলে যে আমি পবিত্র হবো না।”
রণ হতভম্ব হয়ে বললো,”মানে?”
“কিছু না, যান আপনি।”
রণ কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বহ্নির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মুহুর্তে দেবীর মতো সুন্দর আর দৃঢ় মনে হচ্ছে তাকে। এরপর যন্ত্রের মতো হেঁটে বাসে যেয়ে ওঠে। বারবার পিছন ঘুরে তাকায় সে। বহ্নি একইভাবে মিষ্টি করে হেসে তার দিকেই চেয়ে আছে। মেরুন রঙা শাড়ির মায়াবতীটাকে মনে হচ্ছে সে এতো সহজে থামবে না। সবার জন্য সে মায়াবতী নয়, কারো জন্য সে ধ্বংসবতীও। বহ্নির টগবগে রক্তের ফুটন্ত শব্দ যেনো দূর থেকে শুনতে পাচ্ছে সে।
বাস ছাড়ে, জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বহ্নির দিকেই তাকানো রণ। বহ্নির মুখে এখনো সেই রহস্যময়ী হাসি। শেষ মুহুর্তে বহ্নি হাত নেড়ে বিদায় জানায়। রণের ইচ্ছা করছে এখনই নেমে যেতে বাস থেকে। কোনোভাবেই এই অসামান্য মেয়েটাকে একা হতে দিতে ইচ্ছা করছে না। হঠাৎ একটা টান অনুভব করে সে স্বল্প পরিচিত নারীটির জন্য, খুব সূক্ষ্ম কিন্তু তীক্ষ্ণ সেই টান।
সন্ধ্যা হওয়ার পরপরই শীতল আজ বই নিয়ে বসেছে। গোসল করে আসার পরেও ঘামছে সে। উৎস ভাই নাকি আজ থেকেই পড়াবে তাকে। এ আবার কি বিপদ! যদি আগে কি কি পড়েছে সব ধরে? আর যদি সব ভুল করে সে? উৎস ভাই কি রেগে যাবে? মারবে না তো?
দুশ্চিন্তায় কান্না পেয়ে যায় শীতলের। তাড়াতাড়ি করে বই বের করে পড়তে থাকে সে। কিন্তু এতোগুলো বিষয়ের মধ্যে কোন বই আগে পড়বে সে? কোনটা থেকে উৎস ভাই শুরু করবে তা-ও তো সে জানেনা। পাগল পাগল লাগে শীতলের।
শীতলকে অসময়ে বই বের করতে দেখে আভা তো যারপরনাই অবাক। এই সময়ে তার মেজো আপা হয় মুড়িমাখা করে সবার জন্য নাহয় বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে চুল শুকায় আর গুণগুণ করে গান করে। গড়িমসি করে পড়তে বসতে বসতে সেই রাত হয়ে যায় তার। আজ হঠাৎ হলো কি তার?
“হ্যা রে বড় আপা? আজ কি সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উঠে পূবে অস্ত গেলো রে?”
বহ্নি কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে, শরীরটা ভালো লাগছে না তার। এসেই শুয়ে পড়েছে বিছানায়।
“তার মানে?”
“দেখছিস না একজন পড়তে বসেছে?”
তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে শীতল।
“আপা এই বেয়াদবটাকে চুপ করতে বলো। ও কিন্তু আমার হাতে খুব মাইর খাবে এবার, তুমি কিচ্ছু বলতে পারবে না আমাকে পরে।”
বহ্নি বিরক্ত হয়ে বললো,”থাম তো তোরা, অসহ্য।”
শীতল কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো,”হ্যা তুমি তো সবসময় আমাকেই থামাও। ওকে কিছু বলতে পারোনা?”
আভা মুখ টিপে হাসে।
বহ্নি মহাবিরক্ত হয়ে বললো,”এখানে কান্নার কি আছে শীতল? তোর এই ছিঁচকাঁদুনে স্বভাবটা কবে যাবে?”
আভা হাসতে হাসতে বললো,”শুধু শুধু কি আর উৎস ভাই গাধী বলে ডাকে?”
“আর তোকে যে হাবা বলে?”
আভার মুখ কালো হয়ে যায়। বহ্নি রাগে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুখেই দরজায় উৎসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায়।
“আরে উৎস বাবু যে? তা হঠাৎ এখানে? আমাদের মনে পড়ে তবে মাঝে মাঝে?”
উৎস কিছু বলেনা, বহ্নির দিকে তাকায় সে। মেয়েটাকে স্বাভাবিক লাগছে না। কি হয়েছে মেয়েটার?
“কি রে কিছু বল।”
“বহ্নি তুই ঠিক আছিস?”
বহ্নি থতমত খেয়ে যায়।
“ঠিক থাকবো না কেনো রে? কি বলছিস?”
উৎস তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় বহ্নির দিকে, মেয়েটা কি কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে? চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে।
উৎসের গলার আওয়াজ শুনে আভাও এগিয়ে আসে।
“উৎস ভাই আপনি এখানে?”
“আমাদের হাবা যে, কেমন আছিস বল?”
আভা মুখ অন্ধকার করে চলে যায় সেখান থেকে। উৎস হাসে, বহ্নিও হাসে। তবে তার হাসিটা কেমন যেনো বিষাদে মাখা।
“বহ্নি কোনো সমস্যা?”
“তুই কি বলছিস বল তো তখন থেকে? আমার কিচ্ছু হয়নি।”
উৎস শান্ত হয়না, অবশ্যই সে কিছু লুকাচ্ছে।
“কিছু বলবি তুই?”
উৎস কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”শীতলকে আজ থেকে পড়াবো আমি, ওর পরীক্ষার আগ পর্যন্ত।”
বহ্নি অবাক হয় উৎসের কথায়।
“তুই পড়াবি শীতলকে?”
“হ্যা পড়াবো।”
বহ্নি একবার উৎসের দিকে আরেকবার শীতলের দিকে তাকায়। খাটের উপর বসে বইয়ের দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে শীতল।
“তুই কষ্ট করে ততক্ষণ মায়ের ঘরে বিশ্রাম কর। আমার ঘরেও যেতে পারিস, এখন তো রণ ভাই নেই।”
শেষের কথাটা বলে উৎস বহ্নির দিকে তাকায়, বহ্নির অনুভূতির পরিবর্তন বোঝার চেষ্টা করে। তবে বহ্নি নির্বিকার।
“সমস্যা নেই, তুই যতোক্ষণ থাকতে চাস এখানে থাক। হয়ে গেলেই আমি আসবো।”
উৎসকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বহ্নি চলে যায়। উৎস চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
খাটের পাশেই চেয়ার টেনে বসে উৎস। শীতল নি:শ্বাস আটকে বসে থাকে। বুকের মধ্যে যেনো হাতুড়িপেটা হচ্ছে তার। একবারও তাকাতে পারেনা উৎসের দিকে। যদি কিছু জিজ্ঞেস করে আর সে না বলতে পারে? মানসম্মান যেটুকু ছিলো তাও থাকবে না।
“শীতল বের করো।”
গম্ভীর আওয়াজে শীতল মৃদু কেঁপে ওঠে।
“কি বের করবো উৎস ভাই?”
“আপাতর বইখাতা ছাড়া আর কি বের করতে চাও? আমি কি আর কিছু দেখতে এখানে এসেছি?”
শীতলের কান গরম হয়ে যায়। এই লোকটা কি কোনোদিন একটু সভ্য হবে না? যা-ই হোক না কেনো, সে তো তার প্রেমিকা। একটু তো ইজ্জত দিয়ে কথা বলবে।
শীতলের অপেক্ষা না করে নিজেই শীতলের পদার্থবিজ্ঞান বইটা নিজের হাতে নেয় উৎস। ফিজিক্সে ভীষণ দুর্বল শীতল। ভয়ে কান্না পেয়ে যায় তার।
“ফিজিক্সের কি অবস্থা? কতোদূর শেষ হয়েছে?”
শীতল উত্তর দেয়না, ঢোক চাপে।
“কি হলো কি? কলেজ ছুটির পর তো বান্ধবীদের সাথে হাঁটার সময় কথার তুবড়ি ছোটে, এখন চুপ কেনো?”
হালকা ধমক শুনে কেঁপে ওঠে শীতল, এরচেয়ে টিউশন ক্লাস ঢের ভালো। উনাকে কে পড়াতে আসতে বলেছে?
“আচ্ছা খাতা বের করো, আজ তোমাকে শ্রোডিঙ্গারের ইকোয়েশন বুঝাবো।”
শীতল মাথা কাৎ করে। কি বুঝাবে কে জানে, তার যে নিরেট মাথা সব ভালো করে বুঝলেই হয়।
নওশাদ অফিস থেকে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। শাহানা তাকে চা দিয়ে গেছে। কেবলই চায়ের কাপটা মুখে দিতে যাবে এমন সময় সদর দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে। এখন আবার কে এসেছে?
দরজা খুলতেই আগন্তুককে দেখে ভীষণভাবে চমকে ওঠে নওশাদ। তার চোখমুখ কঠিন হয়ে যায়।
“এ কি তুমি এখানে?”
“নওশাদ চাচা ভালো আছেন?”
“আমি ভালো আছি কি নেই তা দিয়ে তোমার কি? রুস্তম আবার পাঠিয়েছে তোমাকে? আমি তো ওকে বলেই দিয়েছি আমি ওর কাছে জমি বেচবো না, আবার কি?”
লোকটা বিশ্রীভাবে হাসে, রাগে গা জ্বলে যায় নওশাদের।
শাহানা মাথায় কাপড় দিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়ায়, নওশাদ সাথে সাথে তাকে ইশারা দেয় ভিতরে যাওয়ার জন্য। শাহানা একটু দূরে সরে গেলেও ভিতরে যায়না, দাঁড়িয়ে থাকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে। এই লোক আবার কি চায়? উৎস তো বাড়িতে আছে, ডাকবে নাকি একবার?
“নওশাদ চাচা আপনি হেভি রাগ করেন। আগে কথাটা তো শুনবেন।”
“তোমাদের কোনো কথা শোনার ইচ্ছা নেই আমার। তুমি যাও এখন, আমার ইচ্ছা নেই তোমাদের কোনো কথা শোনার।”
“আহা রে! আপনার সাথে কথা বলতে আসিনি তো আমি।”
“তাহলে?”
লোকটা হেসে বললো,”আপনার ভাগ্নে উৎস বাবাজীকে রুস্তম ভাই ডাকছে। আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে বললো।”
এই বলে লোকটা এমনভাবে হাসা শুরু করলো যেনো ভীষণ মজার কিছু বলে ফেলেছে। আত্মা কেঁপে ওঠে নওশাদের। উৎসকে কেনো রুস্তম ডাকবে? উৎসের সাথে ওর কি দরকার?
“এই ছেলে, উৎস কি রুস্তমের ব্যক্তিগত সম্পদ যে যখন ইচ্ছা ডেকে পাঠাবে আর ওকে যেতে হবে?”
“আপনার ভাগ্নেকে ডাকেন, বাকি কথা তার সাথেই বলবো। এরপর সে সিদ্ধান্ত নেবে সে যাবে কিনা।”
নওশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”ওকে ডাকা যাবেনা। তুমি চলে যাও।”
“আপনি বললেই তো আর হবে না চাচা। আপনার ভাগ্নে পানিতেও নামবে আবার ভিজতেও চাইবে না তাতো হয়না, ডাকেন ওরে।”
শেষ কথাগুলো উচ্চস্বরে বলায় ভিতরের ঘর থেকে কানে যায় উৎসের। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় সে।
শীতল আচমকা তার হাত চেপে ধরে। ঠান্ডা কোমল একটা হাতের ছোঁয়ায় কিছুটা চমকে ওঠে উৎস।
শীতল ভীতু গলায় বললো,”আপনি যাবেন না উৎস ভাই।”
উৎস কঠিন গলায় কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়, মেয়েটা এমন মায়া মায়া করে তাকায় আছে। উৎস চোখ ফিরিয়ে নেয়।
“আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো শীতল।”
“আমি কোনোভাবেই আপনাকে এখন যেতে দিবো না।”
উৎস কোনোরকমে নিজের হাতটা শীতলের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। শীতল সজল চোখে উৎসের দিকে তাকায়।
শীতলের দিকে তাকিয়ে উৎস মুচকি হেসে বললো,”আমি চলে আসবো আমার রাণীসাহেবা, আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।”
শীতল জমে যায় উৎসের কথা শুনে। ঠোঁট কাঁপতে থাকে তিরতির করে।
উৎস বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। শীতল পিছন পিছন আসতে চাইলে উৎস তাকে বাঁধা দেয়। শীতল দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার।
নওশাদের সাথে লোকটার বাকবিতন্ডা শুনে বহ্নি আর আভা মায়ের দুই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে তারা। সায়েরাও ছুটে এসেছে।
“আমার ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাবেন আপনি? আমার ছেলে কি করেছে? ও ভাইজান কি বলে ও?”
“তুই এসেছিস কেনো সায়েরা? আমি কথা বলছি তো ওর সাথে।”
সায়েরা অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”ওকে চলে যেতে বলো ভাইজান, আমার ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাবে? রুস্তম কে ভাইজান? কি বলছে ও?”
বহ্নি এগিয়ে এসে জোর করে ফুপুর হাত ধরে সরিয়ে নেয় তাকে।
নওশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই উৎস এসে দাঁড়ায় সেখানে।
“মামা।”
সবাই চমকে উঠে তাকায়। সায়েরা দৌড়ে এসে ছেলেকে জাপটে ধরে।
নওশাদ রাগী গলায় বললো,”তুমি এসেছো কেনো? আমি কথা বলছি তো।”
লোকটা খেক খেক করে হাসে।
“আপনার ভাগ্নে জানে নওশাদ চাচা এখন তারে যাইতেই হবে। এজন্যই এসেছে, তাই না রে?”
উৎস থমথমে গলায় বললো,”কি ব্যাপার মতিন? তুই এখানে কেনো?”
নওশাদ সহ বাকিরা অবাক হয়। মনে হচ্ছে উৎসের সাথে তার অনেক আগের পরিচয়।
“ভাই, রুস্তম ভাই ডাকছে আপনারে। যাওয়াই লাগবো।”
“না গেলে কি করবে তোর রুস্তম ভাই? কি ক্ষমতা আছে ওর?”
মতিন দাঁতে বের করে হাসে।
“উৎস ভাই আপনার কি ক্ষমতা আছে কন দেহি।”
উৎস দুই হাত বুকে বেঁধে দাঁড়ায়।
“আমার যদি কিছু ক্ষমতা না-ই থাকতো তুই এভাবে তোষামোদ করে আমাকে নিয়ে যেতে আসতিস না। আমাকে জোর করে বেঁধে নিয়ে চলে যেতি। তাহলে এবার বোঝ আমার কি ক্ষমতা আছে।”
মতিনের মুখ অন্ধকার যায়।
“আবির ভাই, আজাদ ভাই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে, আরো অপেক্ষা করাবেন?”
আভা থমকে যায় আবিরের নাম শুনে। তাকেও ধরে নিয়ে গেছে? কেনো? কি করবে তাদের সাথে?
উৎস ভ্রু কুঁচকে বললো,”আবির, আজাদ?”
মতিন কিছু না বলে হাসে। উৎস নওশাদের দিকে তাকায়। নওশাদ শাহানার দিকে তাকিয়ে বললো,”শাহানা ঘর থেকে আমার পাঞ্জাবিটা এনে দাও।”
“মামা আপনি কোথায় যাবেন?”
“কি ভেবেছিস আমি তোকে একা ছাড়বো?”
উৎস ম্লান হেসে মামার কাঁধে হাত রাখে।
“মামা দুশ্চিন্তা করবেন না। ওরা কাপুরষ, ওরা আমার একটা চুলও ছিঁড়তে পারবে না। কখনো দেখেছেন একপাল কুকুর সিংহের সাথে লাগতে আসে?”
“উৎস….”
“মামা আপনি বাড়ি থাকুন ওদের সাথে। আমি রাতের মধ্যে ফিরে আসবো।”
সায়েরা ছেলেকে ছাড়ে না, জীবন চলে গেলেও ছেলের হাত ছাড়বে না সে।
“মা ছাড়ো আমাকে, যেতে দাও। বললাম তো চলে আসবো। গরম ভাত খাবো এসে।”
“না না না।”
উৎস কোনোভাবেই নড়তে পারেনা।
হঠাৎ শীতল মুখে মাথায় ওড়না চাপিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। মতিনের দিকে তাকাতেই বেশ অবাক হয় সে। লোকটাকে কোথায় যেনো সে দেখেছে মনে করতে পারেনা। মতিন একদৃষ্টিতে শীতলের দিকেই তাকিয়ে থাকে।
উৎসের হঠাৎ সেদিকে নজর যেতেই সে ছুটে এসে মতিনের কলার চেপে ধরে।
“এই শু’য়োরের বাচ্চা, চোখ উপড়ে ফেলবো একদম।”
মতিন কলার থেকে উৎসের হাত ছাড়িয়ে বললো,”আরে ভাই চেতেন কেনো? আসমানে চাঁদ উঠলে মানুষ দেখবে না?”
“হারা’মির বাচ্চা তোকে….”
“আচ্ছা আচ্ছা তাকাচ্ছি না। এবার চলেন তো।”
উৎস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।
শীতলের দিকে তাকায় সে। চোখ দু’টো ছাড়া মুখাবয়বের আর কিছু দেখা যাচ্ছেনা। চোখজোড়া পদ্মের মতো লাল হয়ে ফুটে আছে। উৎস চোখ ফিরিয়ে নেয়, এখন ওই চোখের মায়ায় পড়ে গেলে আর দুইপা এগোতে পারবে না সে।
উৎস চলে যাওয়ার সাথে সায়েরা হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। শাহানা যেয়ে শক্ত করে ধরে তাকে। নওশাদ উৎসের পিছন পিছন দৌড়ায়। বহ্নি আর আভা জড়াজড়ি করে কাঁদে।
শুধু শীতল কাঁদে না, ছিঁচকাঁদুনে মেয়েটা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ঠিক করে মানুষটা না ফেরা পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে সে, এক পা-ও নড়বে না।
নওশাদের চোখের সামনে দিয়ে উৎসকে একটা কালো জীপে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। নওশাদ রাস্তার উপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। দুই হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে ওঠে সে।
কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়িতে বসা লোকেরা উৎসকে দুই পাশ থেকে চেপে ধরে, কালো কাপড়ে মুখ বেঁধে ফেলে।
“এই জানো’য়ারের বাচ্চা, কাপড় খোল। মুখ বেঁধেছিস কেনো?”
মতিন উৎসের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”ভয় পাচ্ছেন ভাই?”
“ভয় পাওয়ার জন্য উৎসের জন্ম হয়নি, ভয় দেওয়ার জন্য হয়েছে। আমি মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখতে চাই, কাপড় খোল বাইন****।”
কাপড় খোলা হয়না, তার বদলে মতিনের নির্দেশে উৎসের ঠোঁটে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয় আরেকটা কাপড়, যাতে চিৎকার করতে না পারে।
(চলবে……)
#মাতাল_প্রেমসন্ধি
পর্ব: ১৯
উৎসকে মুখ বাঁধা অবস্থায় চারজন মিলে ওকে টেনেহিঁচড়ে ঘরের ভিতরে আনতে দেখে রুস্তম রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় বসা থেকে। মতিনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে সে।
“এই মতিন হারাম’জাদা, ওকে এভাবে ধরে আনতে বলেছি তোকে? ওর মুখে কালো কাপড় বাঁধা ক্যান? ছাড় ওরে।”
মতিন মাথা চুলকায়, যাহ বাবা! এই লোকের আবার কি হলো? সে-ই তো আদেশ দিয়েছিলো উৎসকে এভাবে ধরে আনতে। এখন কি উৎসের সামনে তার বেলুন চুপসে গেলো?
উৎসের হাত ছাড়তেই উৎস হিংস্রতার সাথে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে নিজের মুখ থেকে নিজেই কাপড় সরিয়ে নেয়।
“রুস্তম কি সমস্যা তোমার? তুমি আমার বাড়ি পর্যন্ত কেনো পৌঁছে গেছো তুমি? তোমার সাথে আমার কথা হয়েছে বাইরে, সব কথা হবে বাইরেই। তুমি বাড়ি থেকে আমাকে কেনো তুলে আনলে? আমার মামা অসুস্থ মানুষ, আমার মা কান্নাকাটি করছে, বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তা করছে। এসব কি অসভ্যতা তোমার?”
রুস্তম দুঃখী দুঃখী মুখ করে উৎসের দিকে এগিয়ে এসে আমার কিছুটা পিছিয়ে যায়। হিংস্র সিংহের মতো তাকিয়ে আছে সে রুস্তমের দিকে।
“চুপ করে থাকবে না রুস্তম। তোমার এখানে অনন্ত কাল বসে থাকার সময় নেই আমার, বাড়ি ফিরতে হবে। আবির আর আজাদকেও শুনলাম তুলে এনেছো, ওরা কোথায়?”
রুস্তম একটা তেলতেলে হাসি দিয়ে বললো,”বেচারাগুলো ভার্সিটির হলে থাকে, এতো রাতে আর বিরক্ত করতে চাইনি ওদের।”
উৎস অবাক হয়ে মতিনের দিকে তাকাতেই, মতিন ভয়ে ভয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।
“কাপুরুষের বাচ্চা, আমাকে এমনিতে ডাকলেই তো আমি চলে আসতাম। মিথ্যা বললি কেনো তুই?”
রুস্তম মতিনকে চোখের ইশারা দেয় চলে যাওয়ার জন্য। মতিন সহ বাকিরা পড়িমরি করে দৌড় দেয়।
“উৎস ভাই, মাথা ঠান্ডা করো। তুমি বড়ই গরম মেজাজের মানুষ। দু’টো সুখদুঃখের কথা বলি।”
“তোমার মতো একটা নর্দমার কীটের সাথে সুখদুঃখের কথা বলার মতো সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই উৎসের নেই।”
“আমি নর্দমার কীট?”
“শুধুমাত্র তাই নয়, তুমি কাপুরষ। যদি তা না হবে রাতের অন্ধকারে এভাবে আমাকে ডেকে আনতে না। আমার দলবল যদি জানতে পারে, তোমার চেহারার ভূগোল পালটে দিতে পারে তারা এটা জানো তো?”
রুস্তম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জোর করে উচ্চশব্দে হেসে দেয়। যেনো কি একটা মজার কথা শুনেছে।
“এখন বলো আমাকে কেনো ডেকে আনলে? আমার সাথে তোমার কি কাজ?”
রুস্তম নরম গলায় বললো,”তুমি তো ঘামছো, একটু ঠান্ডার ব্যবস্থা করি?”
উৎস শান্ত গলায় বললো,”ঠান্ডা তোমার আন্ডার মধ্যে পাচার করে দিবো। অবশ্য তোমার মতো কাপুরুষের আন্ডার বদলে রসুনের কোয়া আছে কিনা কে জানে।”
রুস্তম উৎসের মজা ধরতে পারেনা, মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“দয়া করে মুখ বন্ধ করো রুস্তম, গন্ধে আমার আকীকার খাবার বেরিয়ে আসবে বমি হয়ে। দ্রুত শেষ করো কথা, খুব দ্রুত।”
রুস্তম অপমানিত মুখে মুখ বন্ধ করে দাঁড়ায়।
রুস্তম থমথমে মুখে বললো,”তোমার সাথে একটা চুক্তি করবো আমি। রাজি হলে বলো, এতে তোমারই লাভ।”
উৎস মুচকি হেসে বললো,”আমার লাভের জন্য তুমি আমাকে ডেকে আনোনি সে জানি। বাকিটা বলো, কি চুক্তি আবার তোমার সাথে আমার?”
রুস্তম গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বললো,”আমার কিছু মেয়ে দরকার।”
“মেয়ে দরকার, বিয়ে করে বাচ্চা পয়দা করো। তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে বাচ্চা দিবো?”
“উৎস….”
রুস্তমকে এবার কিছুটা রাগী মনে হলো। উৎস পাত্তা না দিয়ে হাই তোলে। রুস্তম আরো রেগে যায়।
“অনেকক্ষণ ধরে উল্টাপাল্টা কথা বলছো। কিছু বলছি না মানে এটা না যে আমি কিছু বলতে পারিনা। চাইলে এখনই তোমাকে এখানে পুঁতে রাখতে পারি জানো নিশ্চয়ই?”
উৎসের মুখের রেখাগুলো হঠাৎ শক্ত হয়ে যায়। রুস্তমের অনেকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় সে।
“পুঁতে রাখতে হবে না রুস্তম, শুধুমাত্র আমার শরীরে একটা নখ বসিয়ে দেখো তুমি। একটা আঁচড়ের বিপরীতে তোমার মতো রুস্তমকে আমার ছেলেরা উপরে পাঠিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। আর তুমি এটাও জানো যে ওদের সামনে থেকে আমাকে তুলে আনার কোনো ক্ষমতা তোমার নেই। এজন্য রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে তুলে আনলে। আর হ্যা, আমাকে পুঁতে ফেলার ক্ষমতা যদি তোমার থাকতো তাহলে এতোদিন দেরি করতে না। সেইদিনই আমাকে শেষ করে দিতে, যেদিন আমি তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছিলাম।”
রুস্তম কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারেনা, উৎস ভুল কিছু বলেনি।
“বলো রুস্তম যা বলছিলে।”
রুস্তম ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,”শোনো উৎস আমার কাজে তুমি আর বাঁধা দিও না। তাছাড়া ওরা তো তোমার নিজের কেউ না, তুমি সবাইকে বাঁচাতেও পারবা না। অহরহ এসব হচ্ছে, কয়জনকে বাঁচাবা তুমি?”
উৎস উত্তর দেয়না, ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে থাকে সে।
“তোমারে আমি একটা কথা বলি, এসব কিছু ভুলে যাও। তোমার ছেলেদের তুমি বললেই ওরা থেমে যাবে। এর বদলে তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করে দিবো আমি।”
উৎস ঠোঁট কামড়ে বললো,”ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলতে?”
রুস্তমের মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।
“যা চাইবে সব পাবে তুমি। আমার টাকাপয়সার অন্ত নেই। বলো কি চাও তুমি?”
“সত্যিই আমি যা চাই তাই দিবে তুমি?”
“একশবার, একবার শুধু বলো তুমি। তুমি যা চাও তোমাকে দিবো, তার বিনিময়ে তুমি ভালো হয়ে থাকবে শুধু। আমার কোনো কাজে তুমি বাঁধা দিবে না। যদি কিছু জানতেও পারো, না জানার ভান করে থাকবে। তুমি ঝামেলা না করলে কেউ করার সাহস পাবে না ওরা।”
উৎস চুপ করে থাকে। রুস্তম হাসে, মনে হচ্ছে কাজ হবে এবার।
“উৎস কিছু বলো। তুমি চাইলে তোমার মামার জন্যও করবো আমি সব।”
উৎস ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমার মামার জন্য কি করতে চাও তুমি?”
“তোমার মামার অনেক শখ দোতলা বাড়ির। সে জমি বেঁচে বাড়ি বানাতে চায়। আচ্ছা যদি এমন হয়, তার জমিও তার থাকলো আবার দোতলা বাড়িও হয়ে গেলো?”
“দোতলা বাড়ি তুমি বানিয়ে দিবে তাকে?”
রুস্তম রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,”তুমি যদি চাও হতেই পারে। এখন বলো শুধু কি লাগবে তোমার।”
উৎস মুচকি হেসে রুস্তমের দিকে তাকায়। রুস্তমও হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে উৎসের দিকে।
বাড়ির ভিতর থেকে সায়েরার কান্নার আওয়াজ আসছে। সে কখনো চিৎকার করে কথা বলেনা বা কাঁদে না। তবে আজ সে চিৎকার করছে। একেকবার গোঙাচ্ছে সে আর শীতল উঠোনে বসেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। প্রায় ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গেছে, এখনো উৎস আসেনি। শীতল ঠিক করেছে সারা রাত কেটে গেলেও সে এখানেই অপেক্ষা করবে, কোথাও যাবেনা।
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে যায় শীতল। পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখে বহ্নি দাঁড়িয়ে আছে পাংশু মুখে। চুলগুলো উড়ছে বাতাসে, চোখজোড়া লাল। তাকে এতোটা ভেঙে পড়তে শীতল কখনো দেখেনি। তার আপা সবসময় শক্ত থাকে বলে তারাও ভরসা পায়। কিন্তু আজ আপাকেই এমন ভেঙে পড়তে দেখে শীতলের বুক মোচড় দিয়ে ওঠে।
“শীতল এখানে বসে আছিস কেনো?”
শীতল কান্নাটা ঢোক চেপে গিলে ফেলে।
“এমনিতেই আপা।”
বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”তোর পাশে একটু বসি আমি?”
শীতল উত্তর না দিয়ে কিছুটা সরে বসে। ভীষণ গরমেও তাদের জাম গাছের নিচের এই শানবাঁধানো বেদীটা খুব ঠান্ডা। বসলেই প্রাণ জুড়িয়ে আসে।
দুই বোন বেশ কিছু সময় চুপচাপ বসে থাকে। কেউ কিছু বলেনা। বহ্নি ঘাড় ঘুরিয়ে শীতলের দিকে তাকাতেই দেখে শীতল গম্ভীর মুখে বসে আছে। তার দৃষ্টি উদ্ভ্রান্তের মতো।
“এতোটা ভয় পাচ্ছিস কেনো? উৎস তো বলেছে ও ফিরে আসবে।”
“ওরা কারা আপা? উৎস ভাই কেনো এসবের মধ্যে জড়িয়েছে বলতে পারিস? কি দরকার ছিলো তার? জীবনটা কি সরলরেখায় চলতে পারতো না?”
বহ্নি ঈষৎ হেসে শীতলের হাতের উপর হাত রাখে। বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে শীতলের হাত দু’টো।
“সবাইকে সরলরেখায় চলার জন্য সৃষ্টিকর্তা দুনিয়ায় পাঠাননি। কিছু মানুষকে সরলরেখা থেকে বেরিয়ে বক্ররেখায় জীবন চালাতে হয়, যাতে করে তার চারপাশের মানুষগুলো সরলরেখায় চলতে পারে।”
শীতল অবাক হয়ে বহ্নির দিকে তাকায়। তার আপার কথাগুলো ভীষণ সুন্দর, কথা বললে মনে হয় বুঝি বই থেকে দু’টো লাইন অবলীলায় পড়ে যাচ্ছে। কতোটা সুন্দর করে এমন ভারী কথাটা বললো সে।
“যুগে যুগে যদি এই মানুষগুলো দুনিয়ায় না আসতো তবে বাকিরা এতো সুখে থাকতে পারতো না। সেই নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে শুরু করে নেতাজী সুভাশচন্দ্র কিংবা ক্ষুদিরাম বসু কিংবা মতিউর রহমানের মতো দেশপ্রেমিকেরা। তারা যদি বক্ররেখায় না চলে সরলরেখাতেই চলতে চাইতো তবে কি আমরা সরলরেখায় চলতে পারতাম? কিছু মানুষ তার নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়, বাকিদের ভালো রাখতে। আমাদের রাজপুত্তুরটি তো ওরকমই বল? সেই কিশোর বেলা থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো। কতো যে বিচার আসতো বাবার কাছে, বাবা কোনোদিন ওকে বকা দিতে পারতো না। কীভাবে দিবে? সে যে ভুল কিছু করতো না।”
শীতল অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”তাকেই কেনো করতে হবে আপা? আর যদি করতেই হয় দূর থেকে করলেই হয়, সবসময় সামনে থাকার কি দরকার?”
বহ্নি ম্লান হাসে।
“কাউকে না কাউকে তো সামনে দাঁড়াতেই হবে শীতল সোনা। একজন সামনে না দাঁড়ালে বাকিরা সাহস পাবে কীভাবে? কুসুমকুমারী দাশের ওই কবিতাটা পড়িসনি? ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’
উৎস তো আমাদের সেই সোনার টুকরো ছেলে রে। আমাদের এসব স্বাভাবিক জীবনে যে ওকে আমরা চাইলেও বেঁধে ফেলতে পারবো না।”
শীতল চুপ করে যায়। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। নিষ্ঠুর সময় বয়েই যাচ্ছে, একটুও থামছে না। কিন্তু মানুষটার এখনো ফিরলো না। কি করছে তার সাথে খারাপ লোকগুলো? মারছে না তো?
শিউরে ওঠে শীতল, মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় তার।
“বলো উৎস কি চাই তোমার?”
উৎস দুই হাতে বুকে বেঁধে দাঁড়ায়।
“তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছো আমি যা চাই তুমি আমাকে দিবে। তাহলে আমি তোমার কাজে কোনো বাঁধা দিবো না।”
রুস্তম চকচকে মুখে বললো,”রুস্তম যখন কথা যখন দেয়, কথা সে রাখে। একবার শুধু বলো। কতো টাকা চাই তোমার বলো।”
উৎস হাই তুলে বললো,”টাকা বেশি লাগবে না, ওই কাটাছেঁড়ার পর সেলাই করা বাবদ যা লাগে। সামান্য কিছু টাকারই ব্যাপার। দ্য গ্রেট রুস্তম পাটোয়ারীর কাছে কোনো ঘটনাই না ওটুকু টাকা।”
রুস্তম হতবাক হয়ে বললো,”কাঁটাছেড়া, সেলাই এসবের মানে কি?”
উৎস রুস্তমের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”আগামীকাল সকালে তুমি আমার সাথে হাসপাতালে যাবে।”
“হাসপাতালে কেনো?”
“তোমার অ’ন্ড’কোষ কেটে ফেলা হবে। তারপর সুন্দর মতো সেলাই করে দেওয়া হবে। একটু ব্যথা করবে না তা না, তবে অবশ করে নেওয়ার কথা বলবো বারবার। তোমার জন্য এতোটুকু করতেই পারি আমি।”
আঁৎকে ওঠে রুস্তম। ভয়ে দুই হাত দূরে ছিটকে যেয়ে পড়ে। উৎস ক্রুর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে সত্যিই রুস্তমের এই সর্বনাশ ঘটিয়েই ছাড়বে।
“এসব মজার মানে কি উৎস? এগুলো কি বলছো?”
“ও বাবা, ভয় পেয়ে গেলে? তুমি-ই তো বললে আমি যা চাইবো তুমি আমাকে তাই দিবে। এখন ভয় পেলে চলবে? সকালে সকাল তৈরি থেকো, আমি এসে নিয়ে যাবো। আমার পরিচিত ডাক্তার আছে। জানোই তো টুকটাক মারপিটের বদঅভ্যাস আছে আমার। প্রায়ই কাটাছেঁড়া সেলাই করতে হাসপাতালে আসা লাগে আমার।”
“চুপ করো, চুপ করো। আর একটা কথা বললে তোমার খবর আছে।”
উৎস শব্দ করে হাসে, রুস্তম হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“এরপর তুমি যতো ইচ্ছা মেয়ে নিয়ে আসবে, তাদেরকে ‘আম্মাজান’ ডেকে আবার সসম্মানে ফিরিয়ে দিবে তুমি। আমি একদম বাঁধা দিতে আসবো না তোমাকে। কি রাজি তো?”
রুস্তম চিৎকার করে মতিনকে ডাকে। মতিন ছুটে আসে।
“ভাই কি হয়েছে?”
“ওকে চলে যেতে বল, এক্ষনি ওকে দূর হয়ে যেতে বল আমার চোখের সামনে থেকে।”
উৎস মাটির দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে। বেচারার চেহারার দিকে তাকাতে পারছে না। বোধহয় কল্পনা করছে, ‘জিনিস’ ছাড়া কীভাবে থাকবে সে বাকি জীবন। উৎস কোনোভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা।
“ভাই ও কি বেয়াদবি করেছে আপনার সাথে? বলেন তো এক্ষনি ওকে…”
উৎস এগিয়ে আসে মতিনের দিকে।
“কর কি করবি, আমিও দেখি তোর কলিজার ওজন কতোটুকু।”
রুস্তম চিৎকার করে আরো জোরে।
“এই মতিন তোকে এতো কথা কে বলতে বলেছে? বললাম না ওকে বের করে দে এখান থেকে?”
উৎস গম্ভীর গলায় বললো,”তাতো হবে না পাটোয়ারী সাহেব। আমাকে এনেছেন গাড়িতে, বাড়িতে পৌঁছেও দিতে হবে গাড়িতে। তবে এবার তোমার লোকেদের বলে দাও আমার মুখে যেনো কাপড় না বাঁধা হয়। আমি খোলা জীপে বসে, সিগারেট খেতে খেতে বাড়ি ফিরবো। আর আমি গান করবো, মতিনকে নাচতে হবে সেই গানের সাথে। মতিন ওই নাচটা পারিস নাকি? হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মলমল, পারিস?”
মতিন অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় উৎসের দিকে। এই লোকটা অদ্ভুত! গম্ভীর মুখেও মজা করে যায় অবলীলায়। তারচেয়ে বেশি অবাক হয় রুস্তম এগুলো শুনছে চুপ করে, কিচ্ছু বলছে না। বরং ভয়ে ভয়ে উৎসের দিকে তাকাচ্ছে সে। কি এমন কথা হয়েছে তাদের মধ্যে?
“ভাই আপনি ওকে কিছু বলবেন না? ও কি বলছে?”
রুস্তম জোর করে গলার স্বর উঁচু করে বললো,”উফফ যা তো, যা চাচ্ছে কর। আমাকে জ্বালাস না।”
মতিন হতভম্ব হয়ে যায়, সে এখন লাল দুপাট্টা গানে নাচবে?
“দেখ তোর ওস্তাদ বলে দিয়েছে, এখন তোকে নাচতেই হবে। খুব ভালো হতো একটা লাল ওড়না পেলে। তোর কি আছে লাল ওড়না?”
মতিন স্তম্ভিত হয়ে যায় উৎসের কথায়।
“আমি লাল ওড়না কোথায় পাবো? আমি কি মেয়ে মানুষ?”
“শরীরের যে অবস্থা তোর, ওড়না পরা তো ফরজ তোর জন্য। চল বেটা, আজ তোরে উড়াধুরা নাচাবো। জীপ বের কর।”
মতিন কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, রুস্তম ভাই চুপ? সে কি কিছু শুনতে পাচ্ছে না?
যাওয়ার আগে উৎস রুস্তমের অনেকটা কাছে এসে চাপা গলায় বললো,”আর একটা কথা, আমার মামার জমি সুন্দর মতো তাকে ফেরত দিবে তুমি। উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করলে জানো তো কি হবে?”
রুস্তম চিঁচিঁ করে বললো,”কি হবে?”
উৎস কিছু না বলে রুস্তমের প্যান্টের দিকে মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে মতিনকে বলে যায় তার ওস্তাদকে লবণ পানি খাওয়াতে। সে নাকি দারুণ ভয় পেয়েছে কোনো কারণে!
রুস্তম চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে ‘জিনিস’ হারিয়ে লাল ওড়না গায়ে নাচছে, গানও বাজছে কোথা থেকে, ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মলমল, মেরে লাল দুপাট্টা মলমল।’
রুস্তম ভয়ংকর চিৎকার করে চোখ খুলে ফেলে। আজ মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্নেও এই গান শুনবে সে, সাথে ওই ভয়াবহ দৃশ্য।
রাস্তার মানুষ যেতে যেতে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে একটা কালো জীপের দিকে। সেখানে একটা লোক কেমন মুদ্রা করে নাচছে ভয়ে ভয়ে। পাশেই এক যুবক সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গান করছে। লাল ওড়না না পাওয়ায় ওদের মধ্যেরই আরেকজনের লাল গেঞ্জিটা খুলে নিয়েছে উৎস। সেটি-ই ওড়নার মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচতে হচ্ছে মতিনকে। থামলেই উৎস এমন ভয়ংকরভাবে তাকাচ্ছে যে মতিনের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার মানুষ যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না, এমন দৃশ্য যে বিরল। দূর থেকে গমগমে গলার সুর ভেসে আসছে, ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মলমল, মেরা লাল দুপাট্টা মলমল।’
উৎস গেট পেরিয়ে উঠোনে ঢোকার সাথে সাথে শীতল থমকে যেয়ে উঠে দাঁড়ায়। উৎসকে দেখে সে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছোটে তার দিকে।
উৎস কিছু বুঝে ওঠার আগে শীতল তাকে জড়িয়ে ধরে ভেউভেউ করে কেঁদে দেয়। এতোক্ষণ বহু কষ্টে কান্না চেপে রেখেছিলো সে। সব কান্না যেনো একবারেই উগড়ে দিবে সে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় উৎস। কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। শীতলের কান্নায় ভিজে যাচ্ছে তার শার্ট। শীতলের কাঁপুনিও স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে।
“শীতল কি হচ্ছে? কান্না থামাও, আমি চলে এসেছি তো।”
শীতল মাথা তোলে না, কান্নার বেগ আরো বাড়ে। উৎসের অবস্থা বেকায়দা। তার মামা দেখে ফেললে তো সর্বনাশ!
বহ্নি শীতলকে না সরিয়েই চিৎকার করতে থাকে বাচ্চাদের মতো। খুশি যেনো উপচে পড়ছে। উৎসকে নয় যেনো ঈদের চাঁদ দেখেছে।
“ও বাবা, ফুপু তাড়াতাড়ি এসো। উৎস ফিরে এসেছে।”
উৎস বিরক্ত হয়ে বললো,”এভাবে চিৎকার করার কি আছে তাতে? তুই কি এই গাধী আর হাবার মতো ছেলেমানুষ হয়ে গেলি? অদ্ভুত, করছিস কি তোরা?”
“এই তুই চুপ কর তো।”
উৎস ভেবে পায়না সে কি করবে। শীতল তার বুক ছাড়ছে না। তার চোখের পানি, নাকের পানিতে বিশ্রী অবস্থা উৎসের শার্টের। তবুও খারাপ লাগছে না তার। শুধু মামাকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। এই অবস্থায় দেখে নিলে কি যে ভেবে বসবে।
নওশাদ, সায়েরা, শাহানা আর আভা যেনো উড়তে উড়তে ছুটে আসে। শীতলকে ততক্ষণে উৎস সরিয়ে দিতে সফল হয়। কিন্তু শীতল তখনও ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। তার মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে এতোটুকুতেই। উৎসের ভীষণ মায়া লাগে হঠাৎ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। এতো মায়াভরা কেনো মেয়েটা? এই মায়াই তো কাটাতে পারছে না সে।
রাতে নিজের ঘরে শুয়ে বই পড়ছে উৎস। নিচে যেনো পিকনিক চলছে। সে বাড়ি ফেরা উপলক্ষে নাকি এই রাতেই ভালোমন্দ খাওয়া হবে। নওশাদ বাজারে ছুটেছে, এই রাতে বাজার খোলা থাকে কিনা উৎস জানেনা। এই বাড়ির মানুষগুলো এমন অদ্ভুত কেনো সে ভেবে পায়না। সামান্য এতোটুকু কারণে কেউ এতো খুশি হতে পারে? মাত্র দুই ঘন্টা সে বাইরে ছিলো, এতেই নাকি এই রাতে ভুড়িভোজের আয়োজন করতে হবে।
হঠাৎ কি মনে করে উৎস উঠে দাঁড়ায়। আলনায় রাখা শার্টটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। ধীর পায়ে হেঁটে যেয়ে শার্টটা হাতে তুলে নেয়। শীতলের কান্নায় যে জায়গাটা ভিজে গিয়েছিলো সেখানে নাক ডুবিয়ে রাখে সে কিছুক্ষণ। মনের ভুল কিনা তার জানা নেই, কিন্তু অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে সেখান থেকে। কেউ যেনো অনেকগুলো শিউলী ফুল ঢেলে দিয়েছে ওখানে।
পরক্ষণেই নিজের উপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে সে। এতোটা দূর্বল তো কখনোই ছিলো না সে। কি হয়েছে তার? মেয়েটা কি গ্রাস করতে করতে তার অনুভূতির নাগাল পেয়ে গেছে? এখন কি সেখানেও রাজত্ব চালাবে? ভারী অন্যায়, ভারী।
“উৎস ভাই।”
কিছুটা চমকে ওঠে উৎস। তাড়াতাড়ি করে শার্টটা জায়গায় রেখে দেয়। দরজায় জবুথবু হয়ে আভা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব দুশ্চিন্তায় আছে সে।
“হাবা তুই?”
কিন্তু আজ আভা অন্যদিনের মতো রাগ করেনা, মুখ গোঁজ করে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
উৎস এগিয়ে আসে তার দিকে।
“আভা তাকা তো আমার দিকে।”
আভা তাকায় না।
“কি হয়েছে আমাকে বল? কোনো সমস্যা?”
আভা কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে যায়।
“আচ্ছা আমি যাই।”
আভা চলে যেতে গেলে উৎস পিছন থেকে ডাকে তাকে।
“এই দাঁড়া বলছি।”
আভা না ঘুরেই বললো,”বলুন।”
“তুই কি বলতে এসেছিস? না বলেই বা কেনো চলে যাচ্ছিস?”
আভা উত্তর দেয়না। অগত্যা উৎসকে আভার সামনে আসতে হয়। এই মেয়েগুলোর মতিগতি কিছু বুঝতে পারে না সে। মেয়ে জাতি এমন অদ্ভুত কেনো?
“সমস্যা কি?”
“উৎস ভাই, একটা কথা বলবো?”
“বল।”
“রাগ করবেন না তো?”
“আবার ফেইল করেছিস?”
“না না না।”
“তবে?”
আভা কিছুটা ইতস্তত করে ক্ষীণ গলায় বললো,”বলছিলাম আপনাদের সবাইকে ছেড়ে দিয়েছে তো?”
উৎস ভ্রু কুঁচকে বললো,”মানে? কে ধরেছিলো যে ছেড়ে দিবে? আর আমাদের মানে? ভণিতা না করে স্পষ্ট কথা বল।”
আভা ঢোক চাপে, উৎস তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ধুর কেনো যে এলো।
উৎস কয়েক সেকেন্ড আভার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,”আবিরের কথা বলছিস তুই?”
আভা ঝট করে মাথা তুলে উৎসের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। এই বুঝি একটা রামধমক খায়।
সে ভেবেছিলো উৎস রেগে যাবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে উৎস ঠান্ডা গলায় বললো,”ঘরে যা আভা, সবাই ঠিক আছে।”
আভার মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। উৎস মুখ টিপে হাসে। একরত্তি মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই যেনো বলতো এসে,”উত্ত ভাই, উত্ত ভাই, তক্কেত খাবা?”
সেই মেয়েটা কিনা আজ প্রেমে পড়ছে? ডালপালা মেলে শুধু ওই রূপটাই বাড়ছে, বুদ্ধি আর বাড়ছে না। আবেগ লুকাতে শেখেনি এখনো। তার মামার ছোট দুইটা মেয়েই বোকা। বোকাদের আবার বিভিন্ন ভাগ আছে। দুই বোন বোকা হলেও দুই ভাগের বোকা। একজন আসলেই বোকা, তাকে যদি বলা হয় নদীতে মৎসকন্যা ধরা পড়েছে সে অবাক হয়ে বলবে, ‘ওজন কতোটুকু, কি খায় ওরা? মানুষের মতো কথা বলতে পারে?’ খালি খালি কি আর গাধী নাম দেওয়া তাকে?
আর আরেকজন অন্য শ্রেনীর বোকা হওয়ায় সে বলবে,’মেজো আপা, তুই যে কি বলিস মৎসকন্যা বলে কিছু হয় নাকি আমাদের দেশে? ওগুলো বিদেশে হয়, মারমেইড বলে ওদের।’ ‘হাবা’ নামটা আসলেই যায় তার সাথে। তবুও দুইজন অসম্ভব ভালো, অসম্ভব। উৎসের মায়া লাগে ওদের তিনবোনের জন্য। এতো ভালো কেনো ওরা? এতো ভালো কেনো হতে হবে মেয়েগুলোর?
খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে নওশাদ আর শাহানা। নওশাদ ঘুমানোর আগে এক কাপ চা খায়, অদ্ভুত অভ্যাস। সেই চা আবার শাহানাকেই বানাতে হয়।
শাহানা মাত্রই চা বানিয়ে নওশাদের হাতে দিয়ে বিছানা গোছাচ্ছিলো। হঠাৎ দরজায় কারো আওয়াজ পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে। এখন আবার কে?
“কে?”
উৎস গম্ভীর গলায় সাড়া দেয়। শাহানা বেশ অবাক হয়। উৎস তাদের ঘরে আসেনা, কোনোসময়ই তেমন আসে না। হঠাৎ এতো রাতে কি মনে করে?
শাহানা দরজা খুলে দেয়। উৎস মৃদু হাসে তার দিকে তাকিয়ে।
“উৎস তুমি?”
“বিরক্ত করলাম?”
“মায়ের ঘরে যেয়েও বুঝি এই কথাটা বলো?”
উৎস কিছুক্ষণ বুঝতে পারেনা শাহানার কথা, বোঝার পর সুন্দর করে হাসে সে। শাহানা হাসতে যেয়েও হাসেনা। তার ধারণা দূর্বলতা বুঝে ফেললে ছেলেমেয়েগুলো মাথায় উঠে যায়, শুধু উঠে বসে থাকে না নৃত্য করা শুরু করে। এসব একদম পছন্দ না তার।
“আয় বাবা, বাইরে কেনো দাঁড়িয়ে আছিস?”
উৎস ঘরে ঢুকে নওশাদের সামনে তাকায়। শুধু মানুষটার মেয়েগুলোকে দেখে না, এই মানুষটাকে দেখেও মায়া হয় তার। এমন সরল চেহারার একজন মানুষ, কি এমন আছে তার মাঝে এতো ভালো লাগার মতো? মন খারাপের সময় কেনো তার বুকে মাথা রেখে একটু শ্বাস নিতে ইচ্ছা করে প্রাণভরে?
উৎসকে চুপ করে থাকতে দেখে নওশাদ কাপ রেখে উঠে দাঁড়ায়। শাহানাও এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
“উৎস সব ঠিক আছে তো? রুস্তম তোকে কেনো ডেকেছে বা কি বলেছে আমি জানতে চাইনা। তুই নিজে থেকে বলতে চাইলে বলবি।”
“সব ঠিক আছে মামা। আমি আপনাকে অন্য একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”
“হ্যা বল।”
উৎস একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,”আপনার দক্ষিণের জমিটা যে রুস্তম ভোগদখল করে রেখেছিলো এ কথা আপনি আমাকে আগে জানাননি কেনো? ঘরের কথা বাইরের মানুষের থেকে শুনতে হবে আমাকে?”
নওশাদ কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে।
“তোকে ঝামেলার মধ্যে জড়াতে চাইনি বাবা।”
উৎস হালকা হাসে।
“ঝামেলার সাথেই আমার বসবাস, ঝামেলাতেই আমার প্রতিনিয়ত সর্বনাশ। এখন আর ওসবের ভয় পাইনা মামা। যাই হোক, কাল থেকে আপনার জমি মুক্ত। আমি একচ্ছত্র মালিক ওই জমির। আপনি বিক্রি করতে চাইলে করতে পারেন। যে বাঁধা দিবে তার র’ক্ত এনে দিবো আপনার কাছে।”
নওশাদ আঁৎকে ওঠে। এসব কথা শুনলেও তার রক্তচাপ বেড়ে যায়।
“উৎস এসব কি বলছিস? গুন্ডামি করার শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে?”
“দুনিয়াটা যদি শুধুমাত্র আপনার মতো ভালো মানুষদের দখলে থাকতো তবে আমিও ভালো মানুষ হতাম মামা। যেহেতু এখানে মানুষের পাশাপাশি মানুষরূপী জানোয়ারদেরও বসবাস আমি আমার মতো উৎসদেরও মাঝে মাঝে জানোয়ার হতে হয় মামা। নাহলে যে মানুষের বদলে দুনিয়া একদিন শুধু জানোয়ারেই ভরে যাবে।”
নওশাদ শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। এই ছেলেটাকে সে মাঝে মাঝে কি বলবে ভেবে পায়না। দুঃসাহসী? আত্মবিশ্বাসী নাকি ভয়ংকর রাগী?
“আগামীকাল আমি আপনার সাথে যাবো ওখানে। দেখি কে আসে বাঁধা দিতে, কয় গ্রাম ওজন তাদের কলিজায়। তৈরি থাকবেন, আমি নিয়ে যাবো।”
উৎস মুচকি হেসে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে শাহানার মুখোমুখি হয়।
“মামি মায়েদের ঘরে যেতেও অনুমতি লাগে। মায়েদের ঘর যে পুণ্যভূমি, সম্মান করা যে অনিবার্য।”
উৎস চলে যেতেই শাহানা থতমত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। নওশাদ ছোট্ট করে হাসে তার দিকে তাকিয়ে।
“আপা এই আপা।”
বহ্নি বিরক্ত হয়ে বললো,”কি রে শীতল, ঘুমাচ্ছিস না কেনো?”
“ঘুম আসছে না আপা।”
“ঘুম না আসলে মাথা এক বালতি পানিতে চুবিয়ে বসে থাক, আমাকে জ্বালাস না।”
শীতল দমে যায়না, দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে কথা বলতে থাকে। আপাকে জ্বালাতে খুব ভালো লাগে তার।
“আপা এই আপা।”
“উফফ আবার কি?”
“তোর কি মনে হয় রণ ভাই ফিরবে?”
ঈষৎ কেঁপে ওঠে বহ্নি। আসলেই তো, সে কি আর ফিরবে? সে যে বহ্নির জন্য একটা আবেগের রাজ্য গড়ে তুলছিলো তার মনে সে তার চোখ দেখেই বহ্নি বুঝেছে। তবে আজ সে যা শুনলো, এরপর কি সে আর ফিরবে? যদি ফেরে তবে সত্যিই বাবার কথা মেনে নিবে সে, মহাপুরুষ সত্যিই আছে পৃথিবীতে।
“আমি কি জানি? আমাকে বলছিস কেনো?”
শীতল কিছু সময় চুপ থেকে আস্তে আস্তে বললো,”মেরুন শাড়িতে তোকে অপূর্ব লাগছিলো আজ, উনি মুগ্ধ হয়নি?”
বহ্নি উঠে বসে বিছানা থেকে। শীতল অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়ে যায়। এখন আপার আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিবে না সে।
হতভম্ব হয়ে বসে থাকে বহ্নি বেশ কিছু সময়। মেয়েটাকে সে যতোটা বোকা ভাবে আসলেই কি সে তাই? আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লো নাকি সে নিশ্চিত হয়েই বললো? যদি তাই হয় তবে বহ্নির তরফ থেকে আবেগের ঠিকানা কি শীতল ইতোমধ্যে খুঁজে পেয়েছে?
(চলবে…..)