মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-২০+২১

0
96

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ২০

ভোরবেলা দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে বিছানায় লাফ দিয়ে বসে বহ্নি। জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে আলো-ও ভালো করে ফোটেনি। শীতল আর আভা বো’মা মারলেও উঠবে না, যে যার বিছানায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
‘কারো কোনো বিপদ হয়নি তো’ চিন্তাটা মাথায় আসতেই দিকবিদিকশুন্য হয়ে যায় বহ্নি। কোনোরকমে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে দরজা খুলতেই স্তব্ধ হয়ে যায় সে। বাইরে উৎস দাঁড়ানো। চোখ ফোলা, ঈষৎ লাল। দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমানি।
বহ্নি অবাক হয়ে চাপা গলায় বললো,”উৎস তুই এখানে? তা-ও আবার এই সময়, কি হয়েছে তোর? সবকিছু ঠিক আছে তো?”
উৎস শান্ত গলায় বললো,”বহ্নি তোদের মধ্যে কারো নীল শাড়ি আছে? তোর, আভার কিংবা শীতলের।”
বহ্নি হতভম্ব হয়ে যায় উৎসের কথা শুনে। ছেলেটাকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। কথাগুলোও মনে হচ্ছে স্পষ্ট না।

বহ্নি উৎসের হাত ধরে বললো,”কি হয়েছে বাবু? আমাকে বল, কি সমস্যা?”
“আছে কিনা বল।”
বহ্নি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,”আছে।”
“তাহলে একটা কাজ করতে হবে তোকে।”
“কি কাজ?”
উৎস নেশাক্ত গলায় বললো,”শীতলকে ঘুম থেকে ডেকে তোল, ওকে নীল শাড়িটা পরিয়ে দে। বেশি সাজগোজের দরকার নেই, শুধু টেনে কাজল পরিয়ে দে আর কপালে ছোট্ট একটা নীল টিপ।”
বহ্নি হতবাক হয়ে যায় উৎসের কথা শুনে। মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছে না সে। এসবের মানে কি? সকালের আলো ফোটেনি এখনো। আর এখন কিনা উৎস এসে বলছে শীতলকে ঘুম থেকে তুলে শাড়ি পরিয়ে দিতে?

“এসবের মানে কি উৎস? ঘড়িতে দেখেছিস কয়টা বাজে?”
“উৎস ঘড়ি দেখেনা, সে যখন মনে করে এখন সময় তাহলই এখনই সেই সময়।”
“পাগলামি করছিস কেনো? কি হবে এখন ওর শাড়ি পরে?”
“আমি ওকে নিয়ে একটু বের হবো।”
বহ্নির চোখে যেটুকু ঘুম ছিলো তা-ও উড়ে গেছে উৎসের উন্মাদের মতো কথা শুনে।

“উৎস আমার কথা শোন….”
“তোর সময় পনেরো মিনিট। মামা হাঁটতে যাওয়ার আগে আমি বের হবো ওকে নিয়ে। এই পনেরো মিনিটের মধ্যে ওকে তৈরি করে দিবি।”
বহ্নি ভ্রু কুঁচকে বললো,”হুমকি দিচ্ছিস নাকি? না করলে কি করবি?”
উৎস মুচকি হেসে বহ্নির অনেকটা কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”তোর প্রেমটাও হতে দিবো না।”
বহ্নিকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উৎস উঠোনে চলে যায়। বহ্নি শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কি বলতে চাইলো ও? বুঝে ফেললো নাকি কিছু?

ঘুম ভাঙা চোখে পিটপিট করে তাকাচ্ছে শীতল উৎসের দিকে। অবাক হওয়ার সীমাও যেনো পার করে ফেলেছে সে। এই লোকটার মাথায় যে কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে সে জানে। কিন্তু সেই সমস্যা যে ডালপালা মেলে এতোটা প্রকট হয়েছে কবে এটা বুঝতে পারছে না সে।
মাত্রই আলো ফুটেছে, এখনো রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। দু’একজন মানুষ কদাচিত যাচ্ছে, তারা অবাক হয়ে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে ওদের দিকে। এই ভোরবেলা অতি রূপবতী একটা মেয়ে নীল সুতি শাড়ি পরে অবাক হয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন এক পুরুষের দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যুবকটির কোনো নজর নেই সেদিকে। সে একমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। সামনেই বয়ে যাচ্ছে নদী, স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে যাচ্ছে শরীর জুড়ে। এমন দৃশ্য বিরল, অতি বিরল।

শীতলের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না উৎস। নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছে। যার চোখের দিকে তাকিয়ে শত্রুরাও কথা বলতে পারে না, যার শান্ত দৃষ্টিতেই অসহায় বোধ করে তার শত্রুরা সেই মানুষটা নাকি প্রেমিকার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। এটা কোনো কথা? তাকালেই যে সে দূর্বল হয়ে পড়ছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মুগ্ধতা কাটাতে একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছে। নাহলে যে কারণে শীতলকে এখানে এখন ডেকে এনেছে তা সে করতে পারবে না, ব্যর্থ হয়ে যাবে।

নীরবতা শীতলই ভাঙে প্রথম।
“কি হয়েছে আপনার?”
উৎস উত্তর দেয়না।
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো।”
উৎস তা-ও নিশ্চুপ।
বিরক্ত হয়ে শীতল উৎসের সামনে দাঁড়ায়। করবে না করবে না ভেবেও একটা সাহসী কাজ করে বসে সে। উৎসের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে টেনে ফেলে দেয়। উৎস অবাক হয়ে যায়, কিছু বলেনা।

“এইযে শুনুন, আপনি আমাকে ডেকে এনেছেন, এই ভোরবেলা। আমার এতো সুন্দর ঘুমটা নষ্ট করেছেন। এখন আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার সিগারেট খাওয়া দেখবো?”
উৎস দুই হাত বুক বেঁধে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় শীতলের। শীতল হঠাৎ চুপসে এতোটুকু হয়ে যায়। সাহসটুকু গ্যাস বেলুনের মতো উড়ে যায়।

“কি বলছিলে আবার বলো?”
শীতল অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”কিছু বলিনি।”
উৎস হঠাৎ হেসে দেয়, সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় শীতল।

“শীতল।”
“বলুন।”
“তোমাকে আমি কিছু কথা বলতে চাই। বলবো কি বলবো না এই দুই লড়াই চলেছে আমার মস্তিষ্ক জুড়ে সারারাত। কিছুক্ষণ আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি কথাটা বলবো, নাহলে আমি সারাজীবন নিজেই নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো।”
শীতল ভাসা ভাসা চোখে তাকায় উৎসের দিকে। কি এমন বলতে চায় সে? কি এমন কথা তাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি?

উৎস কিছুটা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। সুবিন্যস্ত নদীর দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নেয়। বুকটা ভার হয়ে আছে তার।
“শীতল তুমি অনেক আগে থেকেই আমার কাছে একটা খোলা বইয়ের মতো। আমি ইচ্ছামতো তোমাকে পড়েছি, যখন যে পৃষ্ঠা থেকে পড়তে ইচ্ছা হয়েছে পড়েছি। আমি যেনো তোমার পুরোটা জানি, তোমার পুরোটা দেখি। তোমার মনের প্রতিটা চোরাগলিতেও আমার বিচরণ হয়েছে।”
শীতল এতো কঠিন কথা বোঝেনা, শুধু এটুকু বোঝে যে উৎসের মনটা বোধহয় খারাপ।

“আমি প্রথম যেদিন বুঝতে পারি আমি তোমার প্রেমে পড়েছি, সেদিন আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি মনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। তুমি যে মামার খুব যত্নের এক রত্ন। রত্নকে রাখার যোগ্যতা তো শুধু রাজার থাকে, আমি তো নিতান্তই এক যোদ্ধা।”
“আপনি এগুলো কেনো বলছেন উৎস ভাই?”
“শীতল আমি নিজেও চাইনি এই ভয়ংকর জীবনে প্রবেশ করতে। বিশ্বাস করো, আমি খুব সাজানো গোছানো একটা জীবনের স্বপ্ন দেখতাম দুইটা বছর আগেও। কীভাবে চোখের পলকে জীবনটা বদলে গেলো আমি বুঝতে পারলাম না, যখন বুঝলাম তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। আমি চাইলেও নিজেকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। আর কোনোদিন পারবো কিনা জানিনা। জানো, এখনই আমার কাছে প্রস্তাব আসে আমি যেনো টাকার বিনিময়ে বড় বড় রাঘববোয়ালদের হয়ে কাজ করি। সবার কাছে উৎস এখন মাস্তান।”
উৎস শব্দ করে হাসে। শীতল টেরও পায়না তার দুই গাল বেয়ে কখন অঝোরে পানি ঝরা শুরু হয়েছে। একটা শক্ত খোলসের মধ্যে আজীবন নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা মানুষটা এতো মায়া মায়া করে কথা বলতে পারে?

“শীতল আমিও যদি তোমার মতো এভাবে কাঁদতে পারতাম হয়তো অনেকটা হালকা হতে পারতাম। কিন্তু আমি কাঁদতে পারিনা। সৃষ্টিকর্তার কি বৈষম্য দেখো, সব কান্না, রাগ দেখানো, অভিমান নারীজাতির জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছেন। আর পুরুষরা করলেই সে দূর্বল। কেনো? আমাদের কষ্ট নেই? আমাদের অনুভূতি নেই? আমাদের চোখ বেয়ে নোনাপানি পড়লে যদি আমরা দূর্বল বলে বিবেচিত হই, তাহলে কেনো দিলেন আমাদের এই অনুভূতি? অনুভূতি শুন্য করে পৃথিবীতে পাঠাতেন।”
শীতলের মনে হচ্ছে তার ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে মানুষটার মাথা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরতে। যতো ইচ্ছা সে সেখানে কান্না করবে, কেউ বলবে না সে দূর্বল।

“জানো শীতল, ওই মেয়েগুলোকে বিপদে পড়তে দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। ওদের দিকে তাকালেই আমার সামনে বহ্নি কিংবা আভা বা তোমার মুখটা মনে পড়তো। আজ যদি তোমরা থাকতে ওই জায়গায়? আমি কি পারতাম সব দেখেও না দেখার ভান করতে? তবে গতকাল থেকে আমার বুকটা ভার হয়ে আসছে জানো, আমি ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছি না।”
শীতল উদ্বিগ্ন গলায় বললো,”কি হয়েছে আপনার উৎস ভাই? আমাকে বলুন না, কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার?”
টকটকে লাল এক জোড়া চোখে উৎস শীতলের দিকে তাকাতেই সে চমকে ওঠে।

“আমি নিজের অনুভূতি কখনো তোমার সামনে প্রকাশ করতে চাইনি। আমার এই পরিণামহীন জীবনে তোমার মতো তাজা ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে যাক এটা আমি ভাবতেও পারিনি।”
“এসব কি বলছেন উৎস ভাই? আপনার জীবন যেনো পরিণামহীন হবে?”
উৎস ম্লান হাসে, কিছু বলেনা।

শীতল অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”কি হলো আপনি চুপ কেনো?”
“শীতল, আমার জন্য তোমার জীবন নষ্ট হলে আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবোনা। তুমি গোলাপের পাপড়ির মতো কোমল। তোমার শরীর একটু আঘাত লাগলে যে আমার দুনিয়া উলোটপালোট করে দিতে ইচ্ছা করবে।”
“এগুলো কেনো বলছেন? কে আমাকে আঘাত করবে? আপনি আছেন না?”
উৎস ক্ষীণ গলায় বললো,”আর যদি আমি না থাকি?”
শীতল ভয়াবহভাবে চমকে উৎসের দিকে তাকায়, উৎস নির্লিপ্ত।
“এগুলো কি কথা? আর কোনোদিন এসব বলবেন না আপনি।”
শীতলের চিৎকারে আশেপাশের কিছু মানুষ তাকাচ্ছে তার দিকে। উৎস তাদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই আবার চলে যাচ্ছে।

“শীতল শান্ত হও।”
“কিসের শান্ত? শান্ত হবো না আমি। আপনি এগুলো কেনো বলছেন?”
শীতল ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে থাকে। কাজল লেপ্টে গেছে চোখের নিচে। এই অবস্থায় তাকে কি পরিমাণ মায়াবতী লাগছে সে হয়তো জানতেও পারবে না। উৎস চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে শীতলকে স্বাভাবিক হতে সময় দেয়।

“শীতল।”
শীতল কিছুক্ষণ হয় কান্না থামিয়েছে। সকালে হয়ে গেছে পুরোপুরি কিন্তু নদীর এ দিকটা এখনো অনেকটাই নির্জন।
“তুমি তো কাঁদলে, নিজেকে হালকা করলে। আমি কীভাবে করবো?”
শীতল ভীতু চোখে তাকায় উৎসের দিকে। বিষাদমাখা একটা মুখ। বাবার মহাপুরুষের এমন বিষাদে ছেয়ে যাওয়া মুখ দেখতে একটুও ভালো লাগছে না শীতলের।

“আমিও একটু কাঁদতে চাই, তোমার মতো চিৎকার করে কাঁদতে চাই। নিশানকে ওরা পঙ্গু করে ফেলেছিলো। ও বিছানায় পড়ে আছে, মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমার চোখের সামনে আমার জ্বলজ্যান্ত বন্ধুর জীবনটা শেষ করে দিয়েছে ওরা। আমি ঠিক করেছিলাম ওর এই অবস্থা যারা করেছে তাদের শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমি কাঁদবো না। কিন্তু আমি আর পারছি না, আমার একটু কাঁদার প্রয়োজন।”
শীতল কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মূর্তির মতো এগিয়ে যায় উৎসের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে উৎসের মাথাটা নিজের বুকে আলতো করে চেপে ধরে। উৎসের অবাক হওয়ার কথা, কিন্তু এই মুহুর্তে তার আর কিছুই মনে নেই। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে, হাউমাউ করে। মাঝে মাঝে কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে সে। সে সময় তার মাথাটা আরো শক্ত করে চেপে ধরছে শীতল। এই প্রথম এতোটা কাছাকাছি দুইজন, কিন্তু কারো মধ্যেই আদিম প্রবৃত্তির কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। একজন যেনো অন্যজনের কষ্ট নিজের মধ্যে শুষে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

প্রায় দশ মিনিটের মতো উৎস কাঁদে। আচমকাই কান্না থামিয়ে মাথা তোলে সে। শীতল তাকায় তার দিকে।
দুই হাতে চোখ মুছে নিজেকে সামলায় সে।
কোনো কথা না বলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সে। শুধু পিছন ঘুরে শীতলের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বললো,”বাড়িতে চলো।”
শীতল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে থাকে। বিষাদে পূর্ণ কিংবা অদ্ভুত ভালো লাগার একটা সকাল পার হয় দুইজনের, আর কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলো না সে কথা।

বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে স্কুল গেট থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো আভা। আড্ডা জমিয়ে রাখতে আভা একাই যথেষ্ট। সে একাই কথা বলে যাচ্ছে আর বাকিরা খিলখিল করে হেসে যাচ্ছে। আভা আড্ডায় এতোটাই মগ্ন যে কেউ একজন অপার মুগ্ধতায় তার দিকে তাকিয়ে আছে সে টেরই পাচ্ছে না।
অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ কারো ডাকে থমকে দাঁড়ায় সে। গলার আওয়াজ শুনে পা দু’টো অনড় হয়ে যায় তার।

“আভা একটু দাঁড়াবেন?”
আভাসহ ওর বাকি বান্ধবীরাও দাঁড়ায়।
আভা পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখে আবির দাঁড়িয়ে আছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কালো শার্ট আর সানগ্লাসে এতো সুন্দর লাগছে যে আভার দম বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু কথা হলো উনি এখানে কেনো?

“তোরা এগিয়ে যা, আমি আসছি।”
বান্ধবীরা কি মনে করে মুখ টিপে হেসে চলে যায়। লজ্জায় লাল হয়ে যায় আভা ওদের দিকে তাকিয়ে।

“আবির ভাই আপনি এখানে?”
আবির ভেবাচেকা খেয়ে যায়, আসলেই তো! সে এখানে কেনো? কি বলবে সে?
“আবির ভাই আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?”
আবির মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে আভার দিকে।
“আভা আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।”
আবিরের কথায় থতমত খেয়ে যায় সে। কোনোরকমে এদিকে-ওদিকে তাকায় ভয়ে ভয়ে। কেউ আবার শুনে ফেললে কি কেলেঙ্কারি যে হবে।

“আভা আপনার কি দশটা মিনিট সময় হবে?”
“কেনো বলুন তো?”
আবির মাথা নিচু করে বললো,”আপনার জন্য ছোট্ট একটা উপহার আছে, ওটা দিতাম।”
আভা অবাক হয়ে বললো,”উপহার আবার কিসের? আজ কি আমার জন্মদিন?”
“না না, আসলে সেদিন স্থানীয় চুড়িমেলায় গিয়েছিলাম। বান্ধবীগুলো জোর করে নিয়ে গেলো। সেখান থেকে তোমার জন্য সামান্য কিছু উপহার এনেছি, তুমি নিলে খুব খুশি হবো।”
আভা ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,”আপনি থেকে সরাসরি তুমি?”
আবির অপ্রস্তুত বোধ করে, আসলেই তো ভুল হয়ে গেলো। তার বেগতিক অবস্থা দেখে আভাও মিটমিট করে হাসতে থাকে।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছে আবির আর আভা। আভা আগে, আবির পিছনে কিছুটা দূরত্ব রেখে।
“উপহার তো নিয়েছি, তা-ও পিছু পিছু আসছেন কেনো?”
“আমি তো ভার্সিটিতে যাচ্ছি, এদিক দিয়েই যাবো তাই ভাবলাম একসাথেই….”
“আপনার ভার্সিটি অন্যদিকে স্যার, এদিকে তো নয়।”
আবির ঢোক চাপে, মেয়েটার বুদ্ধি ভালো। এতোটা ভালো সে ভাবতে পারেনি।
“না মানে, এদিকে একটা কাজ আছে। ওটা শেষ করে তারপর….”
আবির কথা শেষ করতে পারেনা, আভা হঠাৎ দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রাখতেই চুপ করে যায় সে।

“আবির ভাই এদিকে আপনার কোনো কাজ নেই। আপনি চাইলে আমাদের বাড়িতে যেতে পারেন।”
আবির লাফ দিয়ে উঠে বললো,”না না বাড়িতে যাবোনা, তুমি যাও।”
আভা মুচকি হেসে বললো,”কেনো? উৎস ভাইকে ভয় পান বুঝি?”
আবির অসহায় মুখে তাকায় আভার দিকে। আভা শব্দ করে হেসে দেয়। পরক্ষণেই বুকে ছোট্ট একটা ধাক্কা লাগে আবিরের।
‘মুখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা।’
কবিগুরু হয়তো তাদের মতো তরুণ কিংবা যুবকদের জন্যই এ কথা বলেছেন। আভা হাসতে হাসতেই চলে যায় তার সামনে থেকে। আবির আটকাতে পারেনা, নিজেই হাঁটতে পারেনা। দাঁড়িয়ে থাকে মাঝরাস্তায় থতমত খেয়ে।

জ্যোৎস্না রাত, উঠোনে পাশাপাশি বসে আছে নওশাদ আর শাহানা। রাত বেশ হয়েছে, বাকি সবাই ঘুম। শুধু ঘুম নেই নওশাদের চোখে। আজ তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে, সীমাছাড়া আনন্দ যাকে বলে। আর ভীষণ আনন্দের সময় স্ত্রীকে পাশে নিয়ে বসে থাকতে ভীষণ ভালো লাগে নওশাদের।

হঠাৎ শাহানার হাতের উপর হাত রাখে নওশাদ। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ছেয়ে যায় শাহানার শরীর। মনে হচ্ছে বিয়ের এতোগুলা বছর পার-ই হয়নি। নববিবাহিত যুগলের মতো লাগছে দু’জনকে।

“শাহানা আজ আমি অনেক খুশি। এতো বছর পর নিজের জমিটা ফেরত পেলাম। পুরোটা সময় উৎস দাঁড়িয়ে ছিলো আমার পাশে। রুস্তমের লোকদের সাহস হয়নি একটা কথা বলার। আমার নামের সাইনবোর্ডও বসিয়ে দেওয়া হয়েছে জমিতে। খুব তাড়াতাড়ি খদ্দের দেখে বিক্রি করে দিবো।”
“রুস্তম আসেনি?”
নওশাদ বিরস মুখে বললো,”না, সে নাকি গতকাল রাতে কি এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছে। তারপর থেকে সে ঘুমাতেও ভয় পাচ্ছে। সেই সাথে নিজের লুঙ্গি চেপে ধরে রেখেছে। অদ্ভুত লোক একটা।”
শাহানা কিছু বলেনা।
“বাদ দাও তো, তুমি দেখো ওদিকটায় আমি আরেকটা ঘর বানাবো। ওটা উৎসকে দিবো। সারাজীবন ছেলেটা ছোট্ট একটা ঘরেই কাটিয়ে দিলো। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো শাহানা?”
শাহানা গম্ভীর গলায় বললো,”বাড়ির ছেলে আলাদা ঘর পাবে, এতে আবার আপত্তির কি আছে?”
নওশাদ হাসে, তার দোয়েল পাখিটা মুখে যা-ই বলুক, তার মনটা ভীষণ ভালো।

“আর দোতলায় আমার রাজকন্যাদের জন্য আলাদা আলাদা ঘর হবে। দক্ষিণেরটা বহ্নির, ওর খোলা বারান্দা খুব প্রিয়। বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে চুল বাঁধে আর গুণগুণ করে গান করে। এতো ভালো লাগে দেখতে সেই দৃশ্য। ওর ঘরের সাথে আলাদা বারান্দা দিবো। ও বারান্দায় হাঁটবে, গান করবে আমি দু’চোখ ভরে দেখবো।”
“কীভাবে দেখবে? ও কি কারো সামনে গান করে?”
“লুকিয়ে দেখবো।”
নওশাদ আর শাহানা দুইজনই হেসে দেয় একসাথে।
“আর আমার কান্নার রানী শীতলের জন্য মাঝের দিকের একটা ঘর রাখবো। খুব ভীতু মেয়েটা, মাঝামাঝি থাকলে ভয় করবে না। অনেক বড় একটা আয়না থাকবে ওর ঘরে। ও সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাজল টেনে দিবে চোখে, টিপ পরবে কপালে, শাড়ি পরে সাজগোজ করবে। খুব সাজতে ভালোবাসে কিনা মেয়েটা। আর আমার ছোট কন্যার জন্য উত্তরের ঘরটা রাখবো। ওর শীত খুব পছন্দ, উত্তরের হাওয়া আসবে। ও জানালা খুলে দিবে, হিমেল হাওয়ায় ওর মন ভালো হয়ে যাবে।”
শাহানা মাথা নিচু করে ক্ষীণ গলায় বললো,”আর আমার জন্য?”
নওশাদ প্রেমময় চোখে শাহানার দিকে তাকায়। মুচকি হেসে উঠে যায়। অদূরেই ঝোপঝাড়ের মধ্যে যত্ন ছাড়াই অসংখ্য ভৃঙ্গরাজ ফুটে আছে। সেখান থেকে কিছু ফুল তুলে এনে শাহানার খোঁপায় গুঁজে দেয়। শাহানা তো লজ্জায় শেষ। বড় মেয়েটা প্রায় রাতজেগে পড়ে। বোনদের অসুবিধা হবে বলে বারান্দায় এসেই বসে পড়ে মোড়া পেতে। দেখতে পেলে সে ভারী লজ্জার হবে। লোকটা যে কি করে মাঝে মাঝে। তবে এই লজ্জার মধ্যেও যে কি শান্তি আছে তা হয়তো এমন প্রেমিক পুরুষদের স্ত্রীরাই বুঝতে পারে।

শাহানাকে এক হাতে জড়িয়ে নেয় নওশাদ। ভারী কিন্তু মধুর গলায় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,”আমার রাজপ্রাসাদটাই তো আপনার মহারানী। আমার দোয়েল পাখির জন্য সবচেয়ে বড় ঘরটা রাখবো। সে ইচ্ছামতো সাজাবে। টানা বারান্দা থাকবে ঘরের সাথে। সেখানে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না বিলাশ হবে আমাদের। বলি দোয়েলের খাঁচায় কি এই ধনেশ পাখিটার একটু জায়গা হবে? বেশি না, অল্পতেই আমার হয়ে যাবে।”
শাহানা হঠাৎ কিশোরীদের মতো খিলখিল করে হেসে দেয়। দু’টো রাতজাগা পাখি ক্ষণিকের জন্য চমকে উড়ে যায় ডাল ছেড়ে।

একদৃষ্টিতে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে নওশাদ। ঠিক যেনো সেই ষোড়শী বউটা, প্রথম যেদিন পা দিয়েছিলো এ বাড়িয়ে, ঠিক তেমনই আছে। একটুও বদলায়নি।
হাসি থামিয়ে শাহানা নওশাদের গালে আলতো করে ধাক্কা দেয়।
“কি হচ্ছে?”
“যা হওয়ার।”
“মানে?”
“মানে এই বয়সে দৃষ্টি বিনিময়ের প্রেম ছাড়া আর কি হবে? তাই-ই হচ্ছে।”
শাহানা লজ্জায় লাল হয়ে বললো,”দুইদিন পর মেয়েদের বিয়ে হবে, আর উনার কি ঢং দেখো কথার।”
“তাতে কি হয়েছে? মেয়ে জামাইদের দরকার হয় প্রেম শিখাবো। এমন প্রেমিক শ্বশুর ক’জনের কপালে জোটে?”
শাহানা রাগ দেখাতে যেয়েও দেখাতে পারেনা, হেসেই গড়াগড়ি খায় সে।
নওশাদ অনেক রাত পর্যন্ত শাহানাকে বুঝায় কোথায় বা কীভাবে কোন ঘর হবে, কীভাবে সাজাবে। শাহানা শুধু মুগ্ধ হয়ে স্বামীকে দেখে। মানুষটা কেমন স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। সহসাই বুকটা কেঁপে ওঠে শাহানার। সবকিছু ঠিকমতো হবে তো শেষ পর্যন্ত? তার সুখের ভরা সংসারে কোনো শকুনের দৃষ্টি পড়বে না তো? ভাঙা ঘরে কি খুব অসুবিধা ছিলো? একদমই না। সে শুধু তার সংসারটাকে ভালো রাখতে চায়, এই মানুষগুলোকে ভালো রাখতে চায়। তাদের কোনো বিপদ হবে না তো? মেয়েদের বাবা কিংবা উৎস? ভালো থাকবে তো সবাই?
নওশাদ কথা বলেই যায়, শাহানা আর মন দিতে পারেনা। বুকটা কেমন অজানা আশঙ্কায় কাঁপতে থাকে।

বড় আপা বা মেজো আপা ঘুমিয়েছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নেয় আভা। অন্যদিন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলেও আজ অনেক কষ্টে জেগে আছে সে। বাকি দুইজন ঘুমিয়ে গেছে কিনা নিশ্চিত হয়ে বেরিয়ে আসে সে ঘর ছেড়ে। পিছনের বারান্দাটা ছোট আর সরু। এখানে তার ফুপুর সায়েরা ছাড়া তেমন কেউ আসেনা।
হাতে আনা প্যাকেটটা অনেকক্ষণ চেপে রাখে সে। মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে সেখান থেকে। আভার ইচ্ছা হয়না খুলতে। খুললেই তো শেষ।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর, শেষমেশ প্যাকেটটা খোলে সে। সাথে সাথেই চমকে যায় আভা। এক জোড়া এন্টিকের চুড়ি, এত্তো সুন্দর! চোখ জুড়িয়ে যায় আভার। চুড়ির উপর আবার লাল চুনির মতো দেখতে পাথরের কারুকার্য। হালকা চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে যেনো।

আভা সাথে সাথে হাতে পরে নেয়। ফর্সা হাত দু’টোতে যেনো ফুটে উঠেছে চুড়ি দু’টো। নিজেকে রাজরানীদের মতো মনে হয়। বেশ কিছুক্ষণ নিজের হাত দু’টো দেখে সে নয়নভরে।
প্যাকেটটা হঠাৎ হাত থেকে নিচে পড়তেই ঝুনঝুন করে ওঠে। মানে আরো কিছু আছে। আভা তাড়াতাড়ি করে প্যাকেটটা তুলে নেয়।
আবার খুলতেই আরো একপ্রস্ত অবাক হয় সে। একজোড়া নুপুর, রূপোলী রঙের। আভার চোখে পানি এসে যায়। এতো সুন্দর উপহার সে আগে কখনো পায়নি। ইচ্ছা করছে সাজিয়ে রাখতে।
কিন্তু তার আপারা যদি দেখে ফেলে? বড় আপা যে চালাক, নির্ঘাত বুঝে ফেলবে। ভয়ে ঘাম ছুটে যায় আভার। পরক্ষণেই আবার একরাশ ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় তাকে। বারান্দার গ্রিলে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে সে অনেকক্ষণ। মেজো আপাকে খুব ক্ষেপায় সে কথায় কথায় কান্না করার জন্য। আজ তার নিজের কান্না পাচ্ছে ভীষণ। যে কান্নার কোনো কারণ নেই, অভিপ্রায় নেই। আচ্ছা সে কি একটু কাঁদবে? কাঁদলে কি ভালো লাগবে? শরীর মন জুড়িয়ে আসবে, যতোটা জুড়িয়েছিলো স্কুল ছুটির পর আকস্মিক ভাবে তাকে দেখে?

মাঝরাতে হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায় বহ্নির। এই অসময়ে ঘুম ভাঙলে একদম ভালো লাগেনা তার। বাকি রাত তো আর ঘুম আসেই না বরং খুব বিরক্ত লাগে। তা-ও বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে বহ্নি বিছানায়। তারপর যখন বুঝতে পারে আজ আর ঘুম আসবে না, তখন সে উঠে বসে।
হঠাৎ রণের সেই কালো মলাটের ডায়েরিটার কথা মনে পড়ে বহ্নির। নিঃশব্দে উঠে বসে সে। নিজের বিছানার তোষকের নিচে রাখা ডায়েরিটা বের করে। এরপর পা টিপে টিপে বেরিয়ে যায় সে ঘর ছেড়ে, সোজা ছাদে। এই সময় বারান্দায় বসা যাবেনা, তার মা প্রায় রাতেই ঘুম থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করে এখানে। ঘুমের কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে তার। মা খুব সন্দেহপ্রবন এবং চালাক। তাকে এখন মিথ্যা বলতেও ইচ্ছা করছে না।

ছোট্ট টর্চের আলো জ্বেলে একের পর কবিতা পড়ছে বহ্নি। এতোটা দরদ ঢেলে, এতোটা মায়া মিশিয়ে কীভাবে কেউ লিখতে পারে? বহ্নি শিউরে ওঠে। হালকা বাতাসেও যেনো কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। ইদানীং যে কি হয়েছে, অল্পতেই কান্না পায় তার। শীতলের ছোঁয়া লেগেছে যেনো। অল্পতেই দূর্বল হয়ে পড়ে। কারো আশ্রয় পেতে খুব ইচ্ছা করে। একটা বলিষ্ঠ বুক, সেই বুকে মাথা রেখে সে হাসবে, কাঁদবে যা ইচ্ছা তাই করবে। শক্ত থাকার অভিনয় করতে করতে খুব ক্লান্ত লাগে মাঝে মাঝে আজকাল, বুক ভারী হয়ে আসে।

“বহ্নি।”
আচমকা উৎসের ডাকে চমকে ওঠে বহ্নি। উৎস এতো রাতে? ও ঘুমায়নি?
তড়িঘড়ি করে ডায়েরিটা নিজের ওড়নার নিচে আড়াল করে পিছন ঘুরে তাকায় সে। উৎস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে, তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।

বহ্নি জোর করে হাসির চেষ্টা করে বললো,”আরে উৎস বাবু যে, ঘুম আসছে না? কার কথা চিন্তা করা হচ্ছে, হুম?”
উৎস হালকা কথার ধার দিয়েও গেলোনা।
গম্ভীর গলায় বহ্নির দিকে তাকিয়ে বললো,”বহ্নি কাঁদছিস তুই?”
থমকে যায় বহ্নি। সাথে সাথে গালে হাত দিতেই দেখে তার গাল যে ভেজা। সে কখন কাঁদছে? টেরও পায়নি একবারের জন্যও।
চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে বহ্নির গাল। এই অবস্থায় তাকে কতোটা রহস্যময়ী লাগছে সে কল্পনাও করতে পারবে না।
‘চন্দ্রকন্যা’ বলে কি কিছু হয়? উৎস অনেক ছোট থাকতে তার মা চন্দ্রকন্যাদের গল্প শোনাতো তাকে। শুক্লপক্ষের রাত গুলোতে, অনেক রাতে আকাশ থেকে পরী নেমে আসে। তারা শ্বেতশুভ্র পোশাক পরে। অতি রূপবতী সেই পরীগুলো চাঁদে বাস করে। তীব্র জ্যোৎস্না উপেক্ষা করতে পারেনা তারা পৃথিবীর। নেমে আসে উপভোগ করতে পৃথিবীর উথাল-পাতাল জ্যোৎস্না। কখনো কখনো অনেক ভাগ্যবান কেউ তাদের দেখা পেয়ে যায়। চন্দ্রকন্যার রূপে তারা অন্ধ হয়ে যায়। তবুও তারা ভাগ্যবান কারণ ওই রূপ দেখার সৌভাগ্য সবার হয়না। ছোট থেকেই উৎস এসব বিশ্বাস করতো না, আর বড় হলে তো হাসি পেতো মায়ের এসব উদ্ভট গল্প শুনে। তবে আজ তার মনে হচ্ছে সত্যি চন্দ্রকন্যা আছে, তার বড়ই রহস্যময়। ভরা জ্যোৎস্নায় এই সামান্য নারীটিকে চন্দ্রকন্যা বলে ভ্রম হয় উৎসের।

“কাঁদছিস কেনো তুই? সব ঠিক আছে তো?”
বহ্নি হেসে বললো,”সব ঠিক আছে বাবা। ভাবিস না তো।”
উৎস বহ্নির ওড়নার নিচে থাকা বাম হাতে কিছু লুকানো স্পষ্ট দেখতে পায়। কিছু বলেনা, কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে তার ভালো লাগেনা।
“নিচে যা, এতো রাতে ছাদে থাকিস না।”
“তুই আছিস যে?”
উৎস হেসে দেয়, বহ্নিও হাসে।
“চন্দ্রকন্যার অপেক্ষা করছি, যদি দেখা পেয়ে যাই।”
বহ্নিরও মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় তার ফুপুর কাছ থেকে শোনা সেই চন্দ্রকন্যার গল্প।

বহ্নি উৎসের অনেকটা কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”চন্দ্রকন্যার দেখা কি পাসনি তুই?”
উৎস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীর কণ্ঠে বললো,”পেয়েছি।”

(চলবে…..)

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ২১

তূর্য স্যারের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে শীতল। ভীষণ ভয় করছে তার। কিছুদিন আগেই পরীক্ষা হয়েছে, আগামীকাল ফলাফল। আর আজকেই কিনা তূর্য স্যার তাকে ডেকে পাঠালো। সে তো পরীক্ষা ভালোই দিয়েছিলো, ইংরেজি পরীক্ষা তো আরো ভালো হয়েছিলো। তূর্য স্যারের মুখও কেমন থমথম করছে। মনে হচ্ছে রেগে আছে সে ভীষণ শীতলের উপর।
মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তাও ঘামছে শীতল। প্রায় দশ মিনিট যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে সে। তূর্য খাতায় কি যেনো দেখছে, এখনো কোনো কথা বলেনি।

“শীতল।”
শীতল ক্ষীণ গলায় বললো,”জ্বি স্যার।”
তূর্য ঠান্ডা চোখে তাকায় শীতলের দিকে।
“পড়াশোনা কি বাদ দিয়েছো? যদি তা-ই হয় বাবাকে বলো বিয়ে দিয়ে দিতে। শুধু শুধু টাকা অপচয় করে পড়ে কি হবে?”
শীতল হতভম্ব হয়ে যায়। সে কি এমন করেছে যে স্যার এভাবে কথা বলছে? সে কি উৎস ভাইয়ের সাথে বাড়ি ফিরতে দেখেছে শীতলকে? তাতে কি হয়েছে? বাড়ি থেকে কেউ নিতে আসতেই পারে, উনার কি তাতে?

“ধরো এটা।”
তূর্য একটা খাতা এগিয়ে দেয় শীতলের দিকে। শীতল ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
“চেনা যাচ্ছে?”
খাতাটা হাতে নিতেই চমকে ওঠে শীতল। এ যে তার খাতা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় সে ইংরেজিতে মাত্র ছাব্বিশ পেয়েছে, মানে ফেইল? লজ্জায়, অপমানে, ভয়ে কেঁপে ওঠে সে। কীভাবে সে বাড়িতে বলবে যে সে ফেইল করেছে? তারচেয়ে বড় কথা সে তো এতো খারাপ পরীক্ষা দেয়নি ফেইল করার মতো।

“কি দেখছো এভাবে?”
“স্যার আমি তো….”
তূর্য হাত উঁচু করে থামিয়ে দেয় তাকে।
“এটাই বলবে তো যে, তুমি এতো কম পাওয়ার মতো পরীক্ষা দাওনি তাইতো?”
শীতলের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে, ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভেঙে গেলেই দেখবে সব ঠিক, সে ফেইল করেনি।
“কি হলো উত্তর দাও।”
“স্যার আমি তো ভালো পরীক্ষাই দিয়েছি।”
“তাহলে আমি কি তোমাকে ইচ্ছা করে ফেইল করিয়েছি?”
তূর্যের চিৎকারে ভয় পেয়ে যায় শীতল। ভীষণ অসহায় লাগছে তার। অগ্নি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে তার জন্য।

“তুমি কি জানো তুমি বাদে বাকি সবাই কৃতকার্য হয়েছে?”
“স্যার কি বলছেন?”
“নিজেকে কোথায় নামিয়েছো ভাবতে পারছো? অর্ধবার্ষিকীতেও কতো ভালো করলে আর এখন?”
শীতল ঠোঁট উলটে কেঁদে দেয়, তূর্যের ভাবান্তর হয়না দেখে।

“এখন কেঁদে কি হবে? আগেই ভাবা উচিত ছিলো। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ালে কি পাশ করা যায়? এই অবস্থায় তুমি উচ্চমাধ্যমিক দিবে? তারচেয়ে ভালো পরের বছরই দিও।”
শীতল স্তম্ভিত হয়ে যায় তূর্যের কথা শুনে। পরের বছর মানে?

“স্যার পরের বছরে পরীক্ষা দিবো আমি?”
তূর্য হেলান দিয়ে বসে চেয়ারে। খুব স্বাভাবিক হয়ে বসে থাকে সে। শীতল অশান্ত।
“স্যার কিছু বলুন, পরের বছর পরীক্ষা দিবো মানে?”
“মানে আবার কি? এই ফলাফল দেখে হেডস্যার তোমাকে উচ্চমাধ্যমিকে বসতে দিবে ভেবেছো? যতোই হোক এই কলেজের একটা সুনাম তো আছে। তোমার জন্য সেই সুনাম নষ্ট হোক, তাতো স্যার চাইবেন না।

শীতল ওড়না চেপে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। এই মুখ সে কীভাবে দেখাবে? বাবা কতো কষ্ট করে তাদের পড়াশোনা করায়। আর সে কিনা পরীক্ষাতেই বসতে পারবে না? সে এখন কি করবে? আত্মহ’ত্যা করবে? এ ছাড়া উপায় কি? লজ্জায় তো এখনই মরে যেতে ইচ্ছা করছে তার।

“স্যার কিছু কি করা যায়না? আমি কথা দিচ্ছি আমি মন দিয়ে পড়াশোনা করবো, আরো মনোযোগী হবো। খুব ভালো ফলাফল করবো উচ্চ মাধ্যমিকে। আমার জন্য কলেজের সুনাম নষ্ট হবে না স্যার, বিশ্বাস করুন।”
তূর্য অন্য খাতা দেখতে দেখতে বললো,”আমি কি করবো বলো? যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। ফলাফল তৈরি হলেই হেডস্যারের কাছে আগে পৌঁছে যাবে, তিনি-ই বাকি সিদ্ধান্ত নিবেন।”
শীতল দুই হাত জড়ো করে, কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যায় তার।

“স্যার একটু দয়া করুন, আপনি কিছু একটা করুন।”
তূর্য গালে হাত ঠেকিয়ে কি যেনো ভাবে কিছুক্ষণ।
“আমি বরং তোমার হয়ে স্যারের কাছে সুপারিশ করতে পারি খুব বেশি হলে।”
শীতলের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
“এতো খুশি হওয়ার কিছু হয়নি, আগে পুরো কথাটা শোনো।”
শীতলের মুখ আবার চুপসে যায়।
“আমি তোমার হয়ে সুপারিশ করলাম। এরপর যদি তুমি ফেইল করে যাও উচ্চমাধ্যমিকে। হেডস্যারের কাছে আমার মুখ থাকবে?”
শীতল তাড়াতাড়ি করে বললো,”স্যার আমি ফেইল করবো না, আমি খুব ভালো করে পড়াশোনা করবো।”
“আমি কীভাবে বিশ্বাস করবো?”
শীতল ঢোক চাপে, কিছু বলতে পারেনা। তূর্য কি বলার চেষ্টা করছে বুঝতে পারছে না সে।

তূর্য গলা থেকে টাইটা ঢিলা করে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার চোখেই পড়ছে না শীতলকে।

“তুমি যদি একান্তই এবার পরীক্ষায় বসতে চাও তাহলে আমাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে তুমি পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত, যোগ্য।”
“বলুন স্যার আমাকে কি করতে হবে, আমি করবো। তবুও আমাকে পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দিন স্যার।”
তূর্য এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় বললো,”আমি তোমাকে টিউশন পড়াতে চাই। আমি নিজে তোমাকে পড়াবো। নিশ্চয়ই ভালো করবে তাহলে।”
শীতল অবাক হয়ে বললো,”কিন্তু আপনি তো টিউশন করাননা স্যার।”
“করাই না, তবে করাবো এবার। তোমাকে একাই পড়াবো।”
“তার মানে?”
“কলেজ ছুটির পর আমি প্রায়ই অফিসে বসে কাজ করি, খাতা দেখি। পিওন আমার কাছে চাবি দিয়ে চলে যায়। তুমি চাইলে কলেজ ছুটির পর ওই সময় তুমি আমার কাছে পড়তে পারো।”
শীতল ভয়ে ভয়ে বললো,”আমি একা?”
“ফেইল তো তুমি একা করেছো, তাহলে অন্য কাউকে আমি কেনো পড়াবো?”
শীতল উত্তর দেয়না। সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা সে। সে একা কীভাবে পড়বে স্যারের কাছে? কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক না দিতে পারলে কি হবে? পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে।

“ভেবে দেখো শীতল, ভেবে দেখো। আমাকে আজকেই জানাতে হবে না, আগামীকাল জানালেও হবে।”
শীতল আস্তে আস্তে বললো,”স্যার আমার বড় বোন ইংরেজি সাহিত্যে গ্রাজুয়েশন করছে, তার কাছে যদি পড়ি আমি?”
“তাহলে তাকেই বলো হেডস্যারকে এসে সুপারিশ করতে।”
“না না স্যার আমি তা বলিনি। আসলে টিউশন ফিস এরও ব্যাপার আছে। সত্যি বলতে আমার বাবার তেমন অবস্থা নেই সব বিষয়ে আলাদা টিউশন দেওয়ার।”
“আমি কি ফিস চেয়েছি তোমার কাছে? তুমি আমার ছাত্রী, আমার তো একটা দায়িত্ববোধ আছে তাইনা?”
শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে আঙ্গুল পেঁচাতে থাকে। নিজেকে এতোটা অসহায়, এতোটা অপমানিত আগে কখনো মনে হয়নি তার।

“যদি রাজি থাকো আগামীকাল থেকেই শুরু করে দিবো। পরীক্ষার তো বেশিদিন বাকি নেই তাইনা?”
শীতল উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
“এখন যাও।”
শীতল ধীর পায়ে বেরিয়ে যায়। অগ্নি অধীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখেই অগ্নি ছুটে আসে। শীতল এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। আজ আর ক্লাস করবে না সে, বাড়ি চলে যাবে। অগ্নি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু না বুঝে।

“সমস্যা কি তোমার? তোমাকে না বলেছি আমি না যাওয়া পর্যন্ত কলেজ গেটের সামনেও আসবে না? তুমি কিছু না জানিয়ে বাড়ি চলে আসলে?”
উৎসের কথা চুপচাপ শোনে শীতল। বাড়ি ফেরার পর থেকে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না শীতলের। নিজের ঘরেই পুরোটা সময় হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে ছিলো। উৎস বাড়ি ফিরে শীতলকে টেনে বারান্দায় এনেছে। কলেজ গেটে তাকে দেখতে না পেয়ে উৎসের মাথা খারাপ হয়ে যায়। পরে অগ্নি তাকে জানায় সব কথা।

“আমার দিকে তাকাও।”
শীতল তাকায়না।
“কি বলছি, তাকাও।”
“তাকাবো না, ফেইল করা ছাত্রীর সাথে কথা বলতে হবে না আপনার।”
উৎস অবাক হয়ে বললো,”ফেইল করা ছাত্রী মানে? কে ফেইল করেছে?”
শীতল ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। রাগে দাঁতে দাঁত ঘষে উৎস।
“কান্না থামাও বলছি, থামাও।”
শীতল কান্না থামায় না, দ্বিগুণ তালে কাঁদতে থাকে।
উৎস রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,”আর একবার কাঁদলে চ্যাং-দোলা করে বড় ড্রেনের পাশে ফেলে আসবো। কেউ যাবে না ঘরে আনতে। সারারাত থাকবে ওখানে। রাতে তেনারা এসে তুলে নিয়ে গেলে আর বাড়ি ফিরতে হবে না।”
শীতল সাথে সাথে কান্না মুছে ফেলে। উৎস মনে মনে হাসে। এই মেয়েকে ভূতের ভয় দেওয়া ছাড়া গতি নেই।
“তেনারা মানে?”
“তেনারা মানে তোমার বন্ধুবান্ধবী, ভূত-পেত্নী।”
শীতক মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে সে আর কাঁদেনা। উৎস যে মানুষ, তাকে সত্যি সত্যি বড় ড্রেনের পাশে ফেলে এলেও সে এতোটুকুও অবাক হবে না।

“এখন বলো কি হয়েছে? ফেইল করা ছাত্রী মানে কি?”
“আমি ফেইল করেছি উৎস ভাই, আমি ইংরেজিতে মাত্র ছাব্বিশ পেয়েছি।”
শীতল আবারও কান্নার প্রস্তুতি নেয়, কিন্তু উৎসের দিকে তাকিয়ে আর সাহস পায়না।
“ছাব্বিশ? অনেক পেয়েছো। আমি কলেজে থাকতে একবার ইংরেজিতে তেরো পেয়েছিলাম। তুমি তো তা-ও আমার দ্বিগুণ পেয়েছো।”
শীতল রাগান্বিত গলায় বললো,”মজা করছেন আপনি আমার সাথে?”
“যা সত্যি তাই বললাম। এবার বলো ফলাফল তো কাল দিবে, আজ কীভাবে জানলে তুমি ফেইল করেছো?”
শীতল বলবে না বলবে না করেও ইতস্তত করে সবটা বলে দেয় উৎসকে। তূর্য স্যার কি কি বলেছে সব।
উৎস কোনো উচ্চবাচ্য না করে পুরোটা শোনে, শুধু মাঝে মাঝে তার গলার রগগুলো ফুলে ওঠে।
শীতলের কথা শেষ হওয়ার অনেকক্ষণ পরেও উৎস কোনো কথা বলেনা।

“উৎস ভাই।”
উৎসের উত্তর নেই।
“উৎস ভাই আপনি কি শুনছেন?”
“শুনছি।” উৎস ছোট্ট করে উত্তর দেয়।
“আমি কি যাবো উনার কাছে টিউশন পড়তে?”
উৎস শান্ত চোখে তাকায় শীতলের দিকে, শীতল চুপসে যায়।
“না না আমি যাবো না, যাবো না।”
“তুমি যাবে।”
“হ্যা?”
“তুমি টিউশন পড়তে যাবে তোমার তূর্য স্যারের কাছে৷ আগামীকাল থেকেই যাবে।”
“কিন্তু উনি যে বললেন একা…..”
উৎস দুই হাত বুকে বেঁধে বললো,”শীতল জানো তো, আমি নিজেও ইংরেজিতে ভীষণ দূর্বল। কেমন হয় যদি আমিও তোমার সাথে টিউশন পড়তে যাই, তোমার তূর্য স্যারের সাথে?”
শীতল হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
“ঘরে যাও শীতল, কে তোমাকে উচ্চমাধ্যমিকে বসতে না দেয় আমি দেখছি।”
“উৎস ভাই….”
“যাও বলছি।”
শীতল চলে যায়, উৎস মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে।

সন্ধ্যার পর নওশাদ অফিস থেকে ফিরে চা খাচ্ছে বারান্দায় বসে। বহ্নি তার পাশে ছোট্ট টুলে বসে বাবার পায়ের নখ কেটে দিচ্ছে যত্ন করে। নওশাদ নিষেধ করলেও মেয়েগুলো শোনেনা। এমন গরীব বাবা তারপরেও তার সেবা করার জন্য যেনো প্রতিযোগিতা শুরু করে দেয় মেয়েগুলো। কে কি করবে ভেবে পায়না। নওশাদের মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায়, মেয়েগুলোকে পৃথিবীর সব সুখ কিনে দিতে ইচ্ছা করে। মনে হয় সে যা-ই করে তাই কম হয়ে যায়।

হঠাৎ গেট থেকে কাউকে ঢুকতে দুইজনই অবাক হয়ে তাকায়। এই অসময়ে সাধারণত কেউ আসেনা তাদের বাড়ি।
আগন্তুককে দেখে হতবাক হয়ে যায় দুইজনই। বহ্নি উঠে দাঁড়ায় কাঁপা কাঁপা পায়ে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।

নওশাদও উঠে দাঁড়ায়।
“রণ?”
রণ হাসে সুন্দর করে, ক্লান্ত মুখ কিন্তু হাসিটাও যেনো একটুও অমলিন নয়।
“এই শাহানা, সায়েরা এদিকে এসো তোমরা দেখো কে এসেছে।”
নওশাদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ায়। রণ দৌড়ে এসে নওশাদেকে জড়িয়ে ধরে। তার হাতে অনেক প্যাকেট মিষ্টি।

“চাচা চাকরিটা আমার হয়ে গেছে চাচা, আমি চাকরিটা পেয়েছি।”
বহ্নির দুই গাল বেয়ে অবিরত পানি পড়তে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে রণ চোখ নামিয়ে নেয়।
নওশাদ যেনো খুশিতে কথা বলতেই পারছেনা।
“চাচা আপনার জন্য সামান্য কিছু মিষ্টি এনেছি।”
নওশাদ তাকিয়ে দেখে বেশ অনেক প্যাকেট।
“এটাকে সামান্য বলছো রণ? এই বহ্নি দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? ওর হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিয়ে ভিতরে যা। মা আর ফুপুকে বল রাতের খাবারের আয়োজন করতে। রণ খুশির খবর নিয়ে এসেছে। আজ ভুড়িভোজ হবে না?”
বহ্নি কাঁপা কাঁপা হাতে রণের হাত থেকে প্যাকেটগুলো নেয়। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখে রণ একবারও তার দিকে তাকাচ্ছে না, সে যেনো দেখতেই পাচ্ছে না বহ্নিকে। বহ্নির খটকা লাগে।

“চাচা একটা কথা।”
“এখন কোনো কথা নয়। আগে খাওয়া দাওয়া হবে, মজা হবে ফূর্তি হবে এরপর কথা বলার জন্য সারারাত পড়ে আছে।”
“চাচা আমার কথাটা শুনুন। আমি রাতে থাকবো না, চলে যাবো।”
নওশাদ আর বহ্নি দুইজনই অবাক হয়ে যায়।

“কি বলছো বাবা? এখনই চলে যাবে? এতো রাতে বাস ধরলে গ্রামে পৌঁছাতে তো মাঝরাত। আজ রাতটা তোমাকে এখানে থাকতেই হবে, আগামীকাল দেখা যাবে।”
রণ গম্ভীর গলায় বললো,”না চাচা, আমি এখন গ্রামে ফিরবো না।”
“তবে?”
“একটা বাসা দেখেছি নতুন অফিসের পাশে, দুই কামরার। ওটাই ঠিক করেছি। নতুন ঘর গুছিয়ে নিতে হবে, বাবাকে নিয়ে আসবো এবার। অল্প অল্প করে গুছিয়ে নিবো।”
বহ্নি ম্লান হাসে মাথা নিচু করে। সে যা বোঝার বুঝে গেছে। মাঝে আড়চোখে বাবার দিকে তাকায়। মনে মনে বলে,’বাবা মহাপুরুষ বলে কিছু হয়না গো, ওগুলো গল্পেই মানায়। বাস্তবের পুরুষেরা কখনো মহাপুরুষ হতে পারেনা।’

“আপনারা আমার জন্য যা করেছেন আমি কোনোদিন ভুলবো না। তাই সবার আগে আপনাদেরই জানাতে এসেছি। তবে এবার আমি বিদায় নিবো। বাবাকে নিয়ে আবার নাহয় একদিন আসবো।”
নওশাদ কিছু না বলে ছোট্ট করে হেসে রণের ঘাড়ে হাত রাখে।
“বেশ আমি তোমার চাচী আর ফুপুকে ডেকে আনছি। ওদের সাথে কথা বলে যাও।”
রণ মাথা নিচু করে বললো,”বেশ।”
নওশাদ ভিতরে চলে যায়। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে রণ আর বহ্নি।

“আপনি কি শুধু মিষ্টি দিতেই এসেছেন?”
রণ ধীর কণ্ঠে বললো,”না তা কেনো হবে? আপনাদের সবার সাথে দেখা করে গেলাম। সুখবরটা জানিয়ে গেলাম। আপনারা খুশি দেখতেও ভালো লাগে আমার। এমন পরিবার পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার।”
বহ্নি মাথা নিচু করে কুটকুট করে হাসে, কেনো জানি ভীষণ হাসি পাচ্ছে তার। নিজেকে নিয়ন্ত্রণই করতে পারছে না।

“হাসছেন যে? আমি কি হাসির মতো কিছু বললাম?”
বহ্নি হঠাৎ হাসি থামিয়ে রণের চোখে চোখ রেখে তাকায়, রণ শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।

“আপনাকে আমি কিছু দিতে চাই, একটু অপেক্ষা করুন।”
“আমাকে কি দিবেন আপনি?”
বহ্নি উত্তর না দিয়ে চলে যায়, খুব দ্রুতই ফিরে আসে হাতে কিছু নিয়ে।

“নিন।”
রণ দেখে সেই কালো মলাটের ডায়েরিটা বহ্নি তার দিকে এগিয়ে রেখেছে।
“এটা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন যে?”
“এটা আপনার খুব শখের আর শখের জিনিস শখের মানুষের কাছে থাকাই ভালো।”
“মিস বহ্নি…..”
বহ্নি আর একবারও ঘুরে না তাকিয়ে ছাদের সিঁড়ির কাছে চলে যায়। তরতর করে উঠতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। হতভম্ব মুখে সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে রণ।

রাত করেই তূর্য ফিরছিলো বাড়িতে, নিজের বাইকে করে। বাড়ি যাওয়ার পথে একটা অন্ধকার রাস্তা পড়ে, বেশ সুনশান। মানুষজন খুবই কম থাকে এখানে।

হঠাৎ কিছুটা দূরেই বেশ কয়েকটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তূর্য থমকে যায়। পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেগুলো। প্রত্যেকের হাতে হকিস্টিক ধরণের কিছু। তূর্য সাথে সাথে ব্রেক কষে। ভয়ে তার ঘাম ছুটে যায়, কিন্তু মুখে প্রকাশ করেনা।

“এই কে? কারা ওখানে? পথ আটকে রেখেছেন কেনো?”
তূর্য যদিও চিৎকার করে কিন্তু তার মনে ভয়। বুক কাঁপছে ভীষণ। বাইকের আলোয় স্পষ্ট দেখে ছেলেগুলোর মুখে কালো কাপড় বাঁধা। তারা একে একে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ভয়ে বাইক ফেলেই উল্টোদিকে দৌড় দিতে ইচ্ছা করছে তার।

ওদের মধ্যে একটা ছেলে এগিয়ে আসে তার দিকে। বাইকে করে কিছু পাকা কলা কিনে নিয়ে যাচ্ছিলো সে। ছেলেটা এসে কলাগুলো হাতে তুলে নেয়। সবাইকে দেয় একটা একটা করে। তূর্য হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে।

হঠাৎ মাঝখান থেকে নেতাগোছের একটা ছেলে এসে তার খুব কাছাকাছি দাঁড়ায়। ভয়ে দমবন্ধ হয়ে আসে তূর্যের।

“দেখুন আমি সাধারণ কলেজ শিক্ষক। আমার কাছে টাকা নেই বেশি। যা আছে আপনারা নিয়ে নিন, আমাকে যেতে দিন।”
“আপনার বউ আছে?”
“কি বললেন?”
“বউ বউ।”
পিছন থেকে একজন বললো,”আবির ভাই উনি ইংরেজির শিক্ষক, বউ বললে বুঝবে না। ওয়াইফ বলেন।”
“ও হ্যা তাই তো। হ্যা যা বলছিলাম, ওয়াইফ আছে আপনার ওয়াইফ?”
“এগুলো কেমন প্রশ্ন?”
“খারাপ ছেলেদের খারাপ প্রশ্ন। বলবেন নাকি…?”
আবির হাতের হকিস্টিকটা নাড়াচাড়া করে।

তূর্য দ্রুত বললো,”আছে আছে।”
আবির তূর্যের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”ওয়াইফকে একটু জানায় দিবো আপনি মেয়েদের ফাঁকা কলেজে টিউশন পড়াতে চান? তা-ও আবার একা?”
তূর্য স্তব্ধ হয়ে যায়। মানে ওরা শীতলের পরিচিত? ভয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় তার মেরুদণ্ড বেয়ে।

আচমকাই সবচেয়ে লম্বা আর পেটানো শরীরের ছেলেটা এগিয়ে আসে তার দিকে। সে-ই মনে হলো বড় নেতা।
এসেই তূর্যের কাঁধে হাত রাখে।
“শুনেছি তোমার ওয়াইফ পুলিশ কমিশনারের মেয়ে। জানালে কি হবে জানো তো?”
তূর্য চিঁচিঁ করে বললো,”মাফ করে দিন আমাকে, আর কখনো এমন করবো না।”
“ঠিক করে বলো এবার, শীতল কি ফেইল করেছে?”
তূর্যের মুখ থেকে কোনো কথা বের হয়না।
“কি হলো বলো? না বলে এটা দেখছো তো? পশ্চাৎদেশ দিয়ে চালান করে দিবো। দুই মাস উপুড় হয়ে শোয়া লাগবে।”
তূর্য হাউমাউ করে কেঁদে দুই হাত জড়ো করে।
“না না শীতল ফেইল করেনি, ও খুব ভালো করেছে। আমি ওকে ইচ্ছা করে ফেইল করিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি আজকে বাড়িতে যেয়েই ঠিক করে দিবো সব। কালকের ফলাফলের আগেই সব ঠিক করে দিবো। আমাকে ছেড়ে দিন।”
“এতো সহজে তো তোমার ছাড়া যাবে না বী… ওহ দুঃখিত তূর্য স্যার।”
তূর্য ভয়ে মুর্ছা যাওয়ার যোগাড়।

“তার মানে?”
উৎস দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললো,”মানে হলো এইযে এখানে যে কয়টা পোলাপান দেখছো কেউ ইংরেজি পারেনা, সব ইংরেজিতে ম্যাড়মেড়ে। তাই আজ সারারাত তুমি এদের ইংরেজি টিউশন দিবে। তুমি মানবতার ফেরীওয়ালা শিক্ষক, বিনা পয়সায় পড়াতে চাও। আমাদেরও একটু পড়াও আজ রাতে।”
তূর্যের মুখ লম্বা হয়ে যায়।

“মুখ বন্ধ করো তূর্য স্যার, মুখ খোলা অবস্থায় তোমাকে একটা আলুর মতো লাগছে, পঁচা আলু।”
“আমাকে যেতে দিন, যেতে দিন।”
“না যেতে দিলে কি করবে? পুলিশ কমিশনার শ্বশুরকে জানাবে? তা জানাতে পারো, আমাদের জেল খেটে অভ্যাস আছে পঁচা আলু। তবে তুমি ভেবে দেখো সত্যটা জানার পর তোমার শ্বশুর তোমাকে কীভাবে জামাই আদর করবে। আপ্যায়ন করবে থানার কনস্টেবলগুলো।”
তূর্যের চোখের পানি নাকের পানি এক হয়ে যায়।

“নাও নাও শুরু করো। টেনস থেকে শুরু করো। পাস্ট টেনস, প্রেজেন্ট টেনস, ফিউচার টেনস।”
তূর্য এখনো বুঝতে পারছে না সত্যি এমন কিছু হবে। হঠাৎ কালো কাপড়ের নিচ থেকে উৎসের জ্বলজ্বলে চোখ দু’টো দেখে তার পিলে চমকে যায়। সে ভাঙা ভাঙা গলায় টেনস পড়ানো শুরু করে।
উৎস তূর্যের বাইকের উপর আধশোয়া হয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে।

তূর্য মাঝে মাঝে থেমে করুণ চোখে তার দিকে তাকায়, উৎস হকিস্টিকটা তূর্যের পশ্চাৎ বরাবর ইশারা করলেই আবার পড়ানো শুরু করে সে। “প্রেজেন্ট টেনস চার প্রকার, প্রেজেন্ট ইনডিফিনাইট, প্রেজেন্ট কন্টিনিউয়াস……”

উৎস বাঁকা ঠোঁটে হাসে। সাহস কতো বড়, তার অনুপমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। শা’লা ঘুঘুর সাথে এবার ফাঁদটাও দেখবে তুমি।

(চলবে……)