মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-২২+২৩

0
96

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ২২

‘খাঁ’ বাড়িতে একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে। মাসের শেষের কোনো এক ছুটির দিনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসা হয় উঠোনে বা ছাদে মাদুর ফেলে। সেদিন পরিবারের সব সদস্য মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে কখন বা কোন কারণে তা বলবে। বাকিরা চেষ্টা করবে তার মন ভালো করে দিতে। এই আয়োজনের নামও আছে, তা হলো ‘আজ আমাদের মন ভালো করার দিন’। নিয়ম এবং নাম দুইয়েরই প্রবর্তক নওশাদ। তার ধারণা এতে করে পরিবারের প্রতিটা সদস্যের প্রতি বাকিদের ভালোবাসা বাড়বে। সে না থাকলেও যেনো ওরা সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে পারে।
নওশাদের পরিকল্পনা সফলই বলা চলে। মেয়েদের সেই ছোটকাল থেকেই এমন চলে আসছে। ওরাও খুব উপভোগ করে এটা। নিজেদের মন খারাপগুলো বলে সবার সামনে, অন্যরা তার মন ভালো করে দেয়।

আজও তার ব্যতিক্রম নয়। বাইরে খুব সুন্দর বাতাস হওয়ায় তারা ছাদেই আজ মাদুর পেতে বসেছে। হিমেল হাওয়া শরীর মন জুড়িয়ে আসে সবার। খুব সাধারণ একটা সন্ধ্যাকে অসাধারণ বোধহয় এ বাড়িতে শুধু নওশাদই করতে পারে।
একে একে মেয়েরা এসে বসেছে। তিন বোন একদম গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে। শাহানা আর সায়েরা পাশাপাশি বসেছে। শাহানার বড্ড ঘুম আসছে। তার স্বামীর এসব কর্মকাণ্ড নেহাৎ পাগলামি বলে মনে হয় তার। তবে সায়েরা খুব আনন্দ পায় এমন সন্ধ্যাগুলোতে। শর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মাখা আর তেলে ভাজা করে নেয় সে ঝটপট। তার এই জীবনে আনন্দের খুব অভাব। তাই জীবনের ছোট ছোট দিনেও সে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। সারাটা মাস অধীর আগ্রহে বসে থাকে এই সন্ধ্যাটার জন্য।
তবে আজকের আয়োজনে পরিবারের সদস্য বাদেও আরেকজন আছে, আবির। ছেলেটা এসেছিলো উৎসের খাতা নিতে। নওশাদ জোর করে তাকে আটকে রেখেছে। ছেলেটা পরিবার থেকে দূরে থাকে। বাড়িতেও বাবা ছাড়া কেউ নেই, এক ফুপু ছিলো যার কাছে সে বড় হয়েছে। সেই ফুপুও কিছু বছর আগে মারা গিয়েছে। এরপর থেকে তার জীবন অনেকটাই একাকী হয়ে গেছে। আবিরও আর গ্রামে যেতে চায়না। উৎস জানতে পেরেছে সেখানে তার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। এ নিয়ে উৎস বেশি ঘাঁটায় না আবিরকে। নিজে থেকে বলতে না চাইলে কি দরকার একজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাকে প্রশ্ন করার?

নওশাদ আবিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”তুমি বলো বাবা, তোমার এই মাসে সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে কোন ঘটনায়? তোমার মন খারাপের কারণ?”
আবির ঢোক চেপে বললো,”কিন্তু মামা আমি তো এ বাড়ির সদস্য নই। আমি বলবো?”
উৎস কৌতুহলী চোখে তাকায় আবিরের দিকে। আবির থতমত খেয়ে যায়।
নওশাদ আবিরের ঘাড়ে হাত রাখে।
“আজ তুমি আমার এই ছোট্ট আয়োজনে শামিল হয়েছো, আজকের জন্য তুমি এই বাড়ির সদস্য। যদি আমাদের সাথে মনের কোনো কষ্ট ভাগাভাগি করতে চাও করতে পারো। আমরা চেষ্টা করবো তোমার মন ভালো করে দিতে।”
আবির বাঁকা চোখে তাকায় আভার দিকে। আভা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে। আবির চোখ নামিয়ে নেয়।
শাহানা মুখ বাঁকিয়ে বললো,”বলতে না চাইলে তুমি-ই বা এতো জোর করছো কেনো? সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি তোমার।”
নওশাদ ম্লান হেসে বললো,”বেশ ও যদি আমাদের আপন মনে না করতে পারে, তবে থাক।”
আবির তাড়াতাড়ি করে বললো,”না না মামা, এ কি বলছেন? আমার বিপদের সময় এগিয়ে এসেছেন আপনারা বার বার। কেনো আপনাদের আপন ভাববো না?”
আভা লাজুক মুখে হাসে, বহ্নি তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় তার দিকে।

উৎস আবিরের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”ভালো সাজার অভিনয়টুকু করিস না অন্তত, যেটা তুই না।”
আবির চোখ কটমট করে তাকায় উৎসের দিকে।

আবির একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো,”মামা সত্যি বলতে আপাত দৃষ্টিতে আমার কোনো কষ্ট নেই। গ্রামে বাবার অনেক সম্পত্তি, প্রতিপত্তি। নিজেরা যে বাড়িতে থাকি তা বাদে আরো তিনটা বাড়ি আছে আমার বাবার বিভিন্ন জায়গায়। জায়গাজমিরও অন্ত নেই। আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। ছোট থেকে যা চেয়েছি, হাতের কাছে পেয়েছি। স্বামী পরিত্যক্ত এক ফুপু ছিলো। মা’কে সেই কবেই হারিয়েছি, কোন ছোটবেলায়। তার পর থেকে ফুপুই আমাকে বড় করেছেন। কয়েক মাস আগে উনি মারা গিয়েছেন। আমি সবকিছু পেয়েছি জানেন মামা? বাবা আমাকে ভালোই বাসতো বলতে গেলে। আমার জন্য তার কোনো সময় ছিলো না ঠিকই, কিন্তু মাস শেষে ফুপুর কাছে আমার খরচের জন্য প্রচুর টাকা দিয়ে রাখতো। আর সে সারাদিন ব্যবসা-কাজ এসব নিয়েই থাকতো। এরপর আমি শহরে চলে এলাম পড়াশোনা করতে। এখনো সে টাকা পাঠায়। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনা সে। কিংবা ছুটিতে বাড়ি গেলে আমার সাথে একসাথে বসে খাওয়ার কথাও চিন্তা করেনা আমার বাবা। একটা বার জিজ্ঞেস টুকু করেনা, বাবা তুই ভালো আছিস তো? আমি যেনো একান্তই ভিন্ন গ্রহের একজন বাসিন্দা। আমার সাথে আমার বাবার সম্পর্ক শুধু টাকার। কিন্তু আমারও যে কখনো কখনো মনটা চায়, বাবার সাথে আড্ডা দিতে, গল্প করতে, একসাথে বসে খেতে। হয়তো আমার মা বেঁচে থাকলে সে আমার জন্য গ্রামে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো, আমি বাড়ি গেলে গরম ভাত বেড়ে দিতো আমার পাতে। আমি যতোক্ষণ খেতাম আমার পাশে বসে থাকতো, আমার খোঁজ নিতো। এই শহরে আমি কীভাবে বেঁচে থাকি শুনতো আমার পাশে বসে।”
আবির থামে। সবাই অপ্রস্তুত হয়ে যায়, উৎসও। আবিরের চোখ ঈষৎ লাল, মনে হয় সে কাঁদছে। উৎস আবিরকে কখনো কাঁদতে দেখেনি। সে আবিরের কাঁধ জড়িয়ে ধরে। আবির নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তিন বোন, আভার চোখেও পানি। তারা কোনোদিন পরিবার ছাড়া কিছু ভাবতেও পারেনা। সেখানে একটা মানুষ পরিবার ছাড়া কীভাবে বাঁচে? মা নেই, বাবা থেকেও নেই। অথচ সবসময় যেনো ছেলেটার মুখে হাসি লেগেই আছে।
নওশাদও চুপচাপ হয়ে যায়, ছেলেটাকে দেখলে বোঝাই যায়না এতোটা কষ্ট বুকে চেপে আছে সে।
সায়েরারও খারাপ লাগে, ছেলেটার কণ্ঠ বিষাদে মাখা যে কারো কথাগুলো শুনে কষ্ট পেতে বাধ্য।
তবে শাহানার কঠিন মনও দমে গেছে। তার চোখ ভেজা, তবে সে কাউকে বুঝতে দিতে চায়না।

“মামা জানেন যখন উৎসের সাথে আপনাকে দেখি, বা ওদের তিন বোনকে আপনার সাথে আনন্দ করতে দেখি আমার এতো ভালো লাগে। শুধু দেখতেই ইচ্ছা করে। উৎস বাবাকে হারিয়েও কতোটা ভাগ্যবান আপনার মতো মামা পেয়েছে। কিন্তু আমাকে দেখুন, আমার বাবা থাকতেও আমরা দুইজন যেনো যোজন যোজন দূরে। আপনি জানতে চেয়েছিলেন না মামা, যে এই মাসে আমার সবচেয়ে কষ্ট কবে হয়েছে? কিছুদিন আগেই ভোরবেলা আমি আমার স্বপ্নে মা’কে দেখেছি। খুব ছোটবেলায় মা’কে হারিয়েছি তো, মায়ের চেহারাটা খুব ভালো মনে নেই। মায়ের খুব পুরোনো কিছু ছবি আছে আমার কাছে, আমার মা বলতে ওই ছবিগুলোই আমার আছে আমার। তবে সেদিন স্বপ্নে মা’কে এতো স্পষ্ট দেখলাম, বিশ্বাস করুন আমি ভেবেছি স্বপ্ন নয়, বাস্তব। মা সত্যি এসেছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো পরম যত্নে। সেই স্পর্শ একদম জীবন্ত ছিলো। মায়ের প্রতিটা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দও যেনো আমি শুনতে পেয়েছি। মা তেমন কিছু বললো না, শুধু বললো তোর কাছে এমন কেউ আসবে যে তোকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে। আগলে রাখবে, যত্নে রাখবে। এরপর মা চলে যায়, আমি পিছন থেকে কতো ডাকি, কতো ছোঁয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু মা আর ঘুরে তাকায় না। এরপরই চারদিক ধোঁয়ায় ভরে যায়। আমি হারিয়ে যাই একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারিনা। অনেক কষ্টে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে বসি। শরীর ঘামে ভিজে চপচপ করছিলো। সেই সারাটা রাত, সারাটা দিন একটা অদ্ভুত মন খারাপ ছেয়ে ছিলো আমাকে। শুধু এ মাসের কেনো, হতে পারে আমার এই জীবনের সবচেয়ে মন খারাপের সময় ছিলো ওটাই। মনে হচ্ছিলো মা’কে খুব কাছে পেয়ে হারিয়ে ফেললাম আমি, আর কখনো পাবো না।”
আবির কথা শেষ করে ম্লান হাসে। বহ্নি, শীতল, আভা, নওশাদ, সায়েরা সবার চোখ পানি। উৎস শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে আবিরকে। আবির কান্নাটুকু মুছে ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তার চোখমুখ টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
আভা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবিরের দিকে, তার এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো বুঝতে পারছে না। খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার।

নওশাদ নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট্ট করে হাসে। সে বুঝতে পারেনি পরিবেশটা এমন ভারী হয়ে যাবে। আজ তো মন ভালো করার পরিবর্তে মন খারাপের দিন হয়ে গেলো।
নওশাদ শাহানার দিকে তাকায়। কঠিন মানুষটার মুখটাও থমথম করছে।
“শাহানা।”
শাহানা অস্ফুটে সাড়া দেয়,”বলো।”
“আজ আবিরের মন ভালো করার দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। তুমি ওর মন ভালো করে দাও।”
শাহানা কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”আমি?”
“হ্যা তুমি। তুমি একজন মা, আমার মনে হয়েছে ওর মন তুমি ভালো করতে পারবে।”
শাহানা কি মনে করে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে হেঁটে এসে আবিরের মাথায় হাত রাখে। আবির কেঁপে ওঠে সহসা। তার ফুপুও তাকে অনেক ভালোবাসতো, তবে মা তো মা-ই হয়। মায়ের স্পর্শ কেমন হয় তার মনেও নেই। কোনো এক অজানা কারণে তার মনে হচ্ছে তার সামনে দাঁড়ানো এই স্বল্প পরিচিত মানুষটাই তার মা। আবির অন্যদিকে ফিরে দুই আঙ্গুলে চোখ মোছে।

“আবির, আমি আসলে গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা। আমার সাধারণ কথাও ঝগড়ার মতো শোনায়। এ বাড়ির চারটা ছেলেমেয়ে আমার চেয়ে বেশি সায়েরার কাছে বেশি আরাম পায়, স্বস্তি পায়। তবুও এ দায়িত্ব তোমার মামা সায়েরাকে না দিয়ে আমাকে কেনো দিলো আমি বুঝতে পারছি না।”
সায়েরা মুখ টিপে হেসে বললো,”এ তোমার ভুল ভাবী। এ বাড়ির চারটা ছেলেমেয়েই তোমাকে ভয় পেলেও তোমাকেই বেশি ভালোবাসে, এমনকি আমার ছেলেটাও। কিরে উৎস ঠিক না?”
উৎস মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে। মায়ের কথা আংশিক সত্য। সে তার মায়ের জায়গায় আর কাউকে বসাতে না পারলেও, মামিকে ভীষণ ভালোবাসে। কাউকে কোনোদিন বুঝতে না দিলেও এটাই সত্য।

শাহানা হাসে।
“সে যাই হোক, মানুষটা যখন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে, সে দায়িত্ব তো আমাকে পালন করতেই হবে।”
শাহানা বসে আবিরের পাশে, তার হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নেয়। আবির অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে।
“আমি অতো সংলাপ পারিনা কিন্তু। আজ থেকে আমাকে মা বলে ভাববে, আজ থেকে আমি তোমার মা এসব আমি কখনোই বলতে পারিনা। জানি এটা কোনোদিন সম্ভব না। মায়ের সমতুল্য কিছুই না। আমি যতোই তোমাকে এগুলো বলি, তুমি তোমার মায়ের জায়গায় আর কাউকে বসাতে পারবে না। তা সম্ভবও না, উচিতও না। তবে তোমার মন ভালো করার ছোট্ট একটা উদ্যোগ নিবো আমি।”
সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকায় শাহানার দিকে, কি উদ্যোগ নিবে সে? আভা কিছুটা ভয় ভয় পায়। মা’কে ভীষণ ভয় লাগে তার।

শাহানা সায়েরার দিকে তাকিয়ে বললো,”আজ কি রান্না হবে রাতের জন্য?”
“ভাবী আজ তো তেমন কোনো বাজার নেই, মাসের শেষ। শুধু ডিম ভর্তা আর ডাল। আর শীতলের জন্য একটা মাছ ভাজা। ও ডিম খায়না তো তাই। কিন্তু কেনো?”
শাহানা আঁচলের কোণা থেকে গিঁট খোলে। কিছু টাকা বের করে উৎসের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
“অল্পই ছিলো আমার কাছে। দেখো সন্ধ্যার বাজারে যেয়ে ভালো মাছ পাও কিনা। আমি আজ নিজে রান্না করবো।”
নওশাদ উঠে আসে তাড়াতাড়ি।
“শাহানা আমার দিন এতোটা খারাপ হয়নি যে তোমার টাকা দিয়ে বাজার করা লাগবে। তুমি মাছ খেতে চাইলে আমি কিনে আনবো, তুমি টাকা বের করছো কেনো?”
“আমি খাওয়ার জন্য বলছি না। আজ আমি নিজে রান্না করবো মাছটা। এরপর….”
“এরপর?”
“এরপর এই ছেলেটার মন ভালো করে দিবো।”
আবির অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়, উৎসও দাঁড়ায় তার পাশে।
“তার মানে?”
শাহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”আমি আজ নিজে হাতে ওকে খাইয়ে দিবো। ওসব ডিম ভর্তা, ডাল এগুলো দিয়ে খাওয়ানো যায় নাকি?”
সবাই একযোগে উঠে এসে দাঁড়ায় শাহানার পাশে। এতোটা অবাক আগে কখনো হয়নি মনে হয় তারা। শাহানা কিনা আবিরকে নিজে হাতে খাইয়ে দিবে? তবে শাহানা নির্বিকার।

আবির হঠাৎ করে শাহানার দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললো,”মামি আপনার হাত দু’টো একটু ধরি?”
শাহানা গম্ভীর গলায় বললো,”ধরো।”
আবির কাঁপা কাঁপা হাতে তার হাত ধরে। এরপর হু হু করে কেঁদে দেয়। আভা শীতলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। শীতল ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।

“মামি আমি কোনো মাছ খাবোনা। আমি আপনার হাতের ওই ডিম ভর্তা আর ডাল দিয়েই খাবো। বিশ্বাস করুন, ওই খাবারটাই আমার মনে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী, সবচেয়ে মুখরোচক খাবার। আমার মন ভালো হয়ে গেছে মামি, মন ভালো হয়ে গেছে।”
নওশাদ দুই হাতে চোখ মোছে, তাকায় তার দোয়েল পাখির দিকে। এই মানুষটাকে এইজন্যই এতো ভালোবাসে সে। সে সবার চেয়ে আলাদা, সবার চেয়ে ভিন্ন।

‘খাঁ’ বাড়ির ‘আজ আমাদের মন ভালো করার দিন’ আয়োজনটা আজকের মতো শেষ হয়। প্রতিদিন সবার মুখে হাসি দিয়ে শেষ হলেও আজ শেষ হয় সবার চোখে কান্না দিয়ে। তবুও আজকের আয়োজনটা যেনো সবদিনের চেয়ে সেরা, আনন্দের, ভালো লাগার। আবিরের চিৎকার করে কান্না যেনক আকাশ-বাতাস ছাপিয়ে যাচ্ছে। তবুও কোথায় যেনো একটা ভালো লাগা কাজ করে সবার মধ্যে। আভা মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে আবিরকে, বিষন্ন অথচ অজানা এক শান্তিতে মনপ্রাণ ছেয়ে যায় তার।

উৎস অনেক রাতে ছাদে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়। তার রাতে ঘুম আসেনা।
আজও এসেছে, কিন্তু আজও বহ্নিকে ছাদে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় সে। বেশ কিছুদিন ধরেই সে লক্ষ্য করছে বহ্নি অনেক রাতে একাই ছাদে এসে দাঁড়ায়, গুণগুণ করে গান করে। সারাদিন হাসিখুশি থাকলেও রাতে তাকে খুব বিষন্ন লাগে। উৎস নাগাল পায়না তার মন খারাপের।

বহ্নি পিছনে না ঘুরেই বললো,”উৎস আয়।”
উৎস থতমত খেয়ে বললো,”না তুই একা থাকার জন্য এখানে এসেছিস, আমি যাই বরং।”

উৎস পা বাড়াতেই বহ্নি স্মিত হেসে ঘুরে তাকায় তার দিকে। উৎসের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার।
“আমাকে একটা দে, দেখি কেমন লাগে।”
“মানে? কি দিবো?”
“যা করতে এসেছিস তুই এখানে।”
উৎস অবাক হয়ে বললো,”তুই সিগারেট খাবি?”
“কেনো? এসব কি শুধু পুরুষদের জন্য? নারীরা অবহেলিত হবে কেনো? দে একটা। জীবনে সবকিছুর অভিজ্ঞতা থাকা ভালো। আমার তো মাঝে মাঝে শ্যাম্পেন খেতেও ইচ্ছা করে।”
বহ্নি কেমন অস্বাভাবিক কথা বলে যায়। উৎস বহ্নিকে থামায় না। ও বলুক যা বলতে চায়।

“কি রে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? ভাবছিস তো আমি পাগল হয়ে গেলাম কিনা?”
উৎস ক্ষীণ গলায় বললো,”না ভাবছি না।”
বহ্নি হাসে, কিছু বলেনা।
উৎস আস্তে আস্তে হেঁটে বহ্নির পাশে এসে দাঁড়ায়।

“বহ্নি।”
“বল।”
“শুনলাম রণ ভাই নাকি চাকরি পেয়েছে?”
“ঠিক শুনেছিস। মিষ্টিও দিয়ে গেছে তো, খাসনি? চমচমটা অসাধারণ, আমি একাই পাঁচটা খেয়েছি। কোন দোকান থেকে এনেছে কি জানি, আনিস তো আবার।”
উৎস ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,”আনবো।”
দুইজনের কেউ কোনো কথা বলেনা। বহ্নি দূরের দিকে তাকিয়ে গুণগুণ করে গান গেয়ে যায়। মেয়েটার গানের গলা অসাধারণ। তবে সে কখনোই কারো সামনে গাইতে চায়না। কদাচিত কেউ সৌভাগ্যক্রমে শুনে ফেললে সে মুগ্ধ হতে বাধ্য।
মেয়েটা যে কোনো একটা ভয়ংকর কষ্ট বুকে চেপে আছে সে উৎস ভালো করেই বুঝতে পারছে। ও বুঝদার মেয়ে, কষ্ট পেয়ে শীতলের মতো কাঁদবে না নিশ্চিত।

উৎসই নীরবতা ভাঙে আবার।
“বহ্নি তোর মনে আছে, স্কুল থেকে আসার সময় একটা ছেলে তোকে খুব বিরক্ত করতো?”
“মনে থাকবে না আবার? তারপর আমার বীরপুরুষ ভাই মেরে তার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলো। বিচারও তো এসেছিলো বাবার কাছে।”
“হ্যা ঠিক তাই। তোদের কেউ কিছু বললে, অপমান করলে আমার মাথা ঠিক থাকেনা। মেরেই ফেলতে ইচ্ছা করে।”
“হয়েছে নেতা মশাই, আপনি এখন ঘুমাতে যান। সকালে ক্লাস আছে তো নাকি?”
“তোরও তো আছে।”
“আমার আছে, তবে আমি ক্লাসে যাবো না কাল।”
“যাবি না কেনো?”
“কাল অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠবো। উঠেই লেবু দিয়ে কড়া করে চা বানিয়ে খাবো মজা করে। এরপর শাড়ি পরে সাজবো, চোখে কাজল দিবো, হাতে রঙবেরঙের কাচের চুড়ি পরে বাইরে বের হবো। রিকশায় উঠে অনেকক্ষণ ঘুরবো, পুরো শহরটা দেখবো। তারপর বাড়িতে ফিরে আবার ঘুমাবো। কাল হবে আমার ঘুরিংফিরিং দিবস।”
বহ্নি যে খুব কঠিন একটা সময় পার করছে তা দিব্বি বুঝতে পারছে উৎস। তবে এই মন খারাপের কারণ কি শুধুই রণ নাকি অন্য কিছু? বহ্নির মতো মেয়ে এতো সহজে প্রেমে পড়তে পারেনা। যদি অন্য কোনো কারণ হয় তবে তা কি?

“আচ্ছা উৎস কোন মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট? শ্বাসরোধ, বিষ প্রয়োগ নাকি কু’পিয়ে জ’খম? কোনটা করলে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিয়ে কাউকে খু’ন করা যাবে?”
উৎস ভয়াবহভাবে চমকে বহ্নির দিকে তাকায়। বহ্নি নির্লিপ্ত মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“এসব কি কথা? কি বলছিস তুই?”
বহ্নি উত্তর না দিয়ে রহস্যময় হাসি দেয়।

“আচ্ছা তোকে বলতে হবে না। হতেও পারে সবগুলোর সংমিশ্রণ ঘটলো। প্রথমে বিষ প্রয়োগ, যখনই বিষের প্রভাবে ছটফট করবে তখনই ধারালো চা’পাতি দিয়ে জ’খম তারপর যখন মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে কাতরাবে, জীবন ভিক্ষা চাইবে তখন শ্বাসরোধ করে চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় জানানো। এটাই মনে হয় সর্বোচ্চ শাস্তি হবে, কি বলিস?”
উৎস হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বহ্নি কাউকে মারতে চায় এতো কষ্ট দিয়ে? কাকে?
বহ্নি হাই তুলে বললো,”খুব ঘুম পাচ্ছে, গেলাম আমি। কাল আবার সারাদিন অনেক ব্যস্ততায় কাটবে আমার, ঘুরিংফিরিং দিবস বলে কথা। চলি রে আমি, তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর কালো ফুসফুসটাকে আরো কালো কর।”
বহ্নি হাসতে হাসতে চলে যায়। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে উৎস।
সে ঠিক করে নেয় এবার একটু অনধিকার চর্চা করবে সে। খোঁজ নিবে বহ্নির ব্যাপারে। সে কি লুকাচ্ছে তার দিকে, কি কষ্ট চেপে আছে এটা জানতে হবে তাকে। সবার আগে একবার রণের সাথে কথা বলতে হবে তাকে। এই ছেলে যদি বহ্নিকে কোনোরকম কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে তাকে একবার কেয়ামত দেখাতে হবে। উৎসের মামার তিন মেয়ের সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করে পার পাওয়া যাবে না, উৎস নিজের জীবন দিয়ে হলেও তাদের বাঁচাবে। এটা উৎসের প্রতিজ্ঞা।

উৎসকের শীতলের বান্ধবীরা জোর করে রিহার্সাল ঘরে নিয়ে গেছে। তারা শুনতে পেয়েছে শীতলের সাথে তার ফুপাতো ভাই উৎস গান গাইবে অনুষ্ঠানে। তাই ছুটির পর উৎসকে দেখতে এসেছিলো সবাই শীতলের সাথে। যদিও শীতলের কোনো ইচ্ছা ছিলো না বদমাশ মেয়েগুলোর সাথে তার অতি প্রিয় উৎস ভাইয়ের দেখা করানো। কখন কি বলে বসবে মেয়েগুলো, পরে উৎস ভাইয়ের মেজাজ খারাপ হলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠানে গাওয়াই বানচাল হয়ে যাবে শেষে।
কিন্তু ওই অগ্নি মেয়েটা বেশি বেশি করে সবসময়। উৎসকে দূর থেকে দেখেই চিৎকার করে উঠেছে। বাকিদের ডেকে দেখিয়েছে আবার। সবাই একরকম জোর করেই উৎসকে টেনে এনেছে। রাগে তো উৎস লাল হয়ে যাচ্ছে। শীতল ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে এদিকে ওদিকে।
রিহার্সাল ঘরে অতিথি পুরুষ হিসেবে শুধু উৎসই নয়, অনেকেই আছে। কারো স্বামী বা কারো ভাই। কিছু শিক্ষকও আছে। তবুও উৎসের ভালো লাগেনা। এতোগুলো মেয়ের মাঝে বসে তার নিজেকে কেমন গার্লস হোস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট মনে হয়। কি আশ্চর্য, মেয়েগুলো এভাবেই বা কেনো তাকিয়ে আছে তার দিকে?

শীতল একটা চেয়ার টেনে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে বসে উৎসের পাশে।
উৎস শীতলের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বললো,”এসব কি সার্কাস হচ্ছে?”
“সার্কাস বলছেন কেনো? রিহার্সাল হচ্ছে।”
“তো সেখানে আমি কেনো? আর মেয়েগুলো আমাকে এভাবে উইপোকার মতো ঘিরে ধরেছে কেনো? এটা মেয়েদের কলেজ নাকি উইপোকার ঢিবি?”
শীতল রাগী গলায় বললো,”বেশি বলছেন কিন্তু এবার।”
“এসব সার্কাস বন্ধ করো, নাহলে তোমাকে রেখেই আমি চলে যাবো।”
শীতল গাল ফুলিয়ে বললো,”আপনি-ই তো গান করবেন আমার সাথে। এখন রিহার্সাল না করলে আর কবে?”
“এমন হলে আমি…..”
উৎস কথা শেষ করতে পারেনা। তার আগেই নেত্রী গোছের একটা মেয়ে এগিয়ে আসে তাদের দিকে। শীতল একগাল হেসে তার দিকে তাকায়।

“লাভলী আপা কিছু বলবেন?”
লাভলী মেয়েটা বেশ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে উৎসকে দেখতে থাকে। উৎস ভেবে পায়না সে কি কলেজ ছাত্রী নাকি ঘটক? এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?

“শীতল, এটা তোর পার্টনার?”
“জ্বি আপা জ্বি।”
লাভলী ঘোঁৎ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,”ও!”
উৎস আগ্রহী হয়ে লাভলীর দিকে তাকিয়ে বললো,”কেনো ফেয়ার এন্ড লাভলী আপা, আপনার আমাকে পছন্দ হয়নি বুঝি?”
লাভলী রাগান্বিত গলায় বললো,”এই তুমি কি নামে ডাকলে আমাকে?”
শীতল তাড়াতাড়ি করে উঠে এসে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে। লাভলী আপা এই কলেজের নেত্রী ধরণের। ডিগ্রীতে পড়ে, শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাকে সমীহ করে চলে।

“কিছু বলেনি লাভলী আপা, কিছুই বলেনি।”
উৎস মুখ হাতে ঢেকে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে। লাভলীকে দেখে হাসি পাচ্ছে ভীষণ তার। চুলগুলো উঁচু করে মাথার উপর খোঁপা করে রেখেছে, কপালের চেয়েও বড় একটা টিপ পরেছে। এতো হাসি কেনো পাচ্ছে যে তার!

“আচ্ছা, তোর পার্টনারের নাম কি?”
“উনার নাম উৎস শাহরিয়ার।”
লাভলী মুখ বাঁকিয়ে হেসে বললো,”কিসের উৎস?”
উৎস লাভলীর কাছাকাছি এসে বললো,”প্রেমের উৎস লাভলী আপা, লাগবে নাকি?”
লাভলী থমথমে মুখে তাকায় শীতলের দিকে।
শীতল প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বললো,”আপা উনি খুব ভালো গান করেন কিন্তু।”
লাভলী কৌতুকপূর্ণ হাসে।
“তাই নাকি দেখে তো মনে হয়না।”
উৎস ঠোঁটে বুড়ো আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললো,”আপনাকে দেখেও তো মনে হয় না আপনার নাম লাভলী হতে পারে।”
“তার মানে?”
“আপনার নাম লাভলী না হয়ে কাবলি হলে ভালো হতো।”
লাভলী দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”তাহলে কি হতো?”
“তাহলে আপনার জন্য আপনার প্রেমিক কবিতা লিখতে পারতো।
ও আমার কাবলি,
আমারে থুয়ে তুই
কার প্রেমে ডুবলি?
আরে ও কাবলি,
আমার খেয়ে আমার পরে
কার কথা ভাবলি?”

শীতল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে, লাভলীর দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা। আজ নিশ্চিত একটা ফাটাফাটি হবে এখানে। কোন কুক্ষণে যে এই লোকটার সাথে গান করতে চাইলো সে। লাভলী আপা তো আজ চিৎকার করে কলেজ মাথায় তুলবে।

কিন্তু শীতলকে অবাক করে দিয়ে লাভলী কিছুই করলো না।
শান্ত গলায় উৎসের দিকে তাকিয়ে বললো,”খুব ভালো। এবার আমিও দেখি কবিতা বানানো ছাড়া আর কি গুণ আছে তোমার। শুনি তোমার গান। তবে মনে রেখো, গান ভালো না হলে একইভাবে অপদস্ত তোমাকেও হতে হবে।”
শীতল প্রমাদ গোণে। উৎস কিছু বলেনা, ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখে শুধু।

“এই কেউ ওকে গীটার দে।”
উৎস হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,”লাগবে না, আমার গলাই যথেষ্ট।”
“এতো অহংকার?”
উৎস ফিসফিস করে বললো,”এটা অহংকার না, আত্মবিশ্বাস।”

শীতল নিঃশ্বাস আটকে বসে থাকে। কি জানি কি হয় আজকে। গান ভালো না হলে লাভলী আপা কি হাসাহাসি করবে? কিন্তু উনি তো ভালোই গান করে। আজ যদি ভালো না হয়?
শতশত চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় শীতলের, ঘাম ছুটে যায় তার।

‘নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে

কত কি রয়েছে লিখা কাজলে কাজলে

নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে

কত কি রয়েছে লিখা কাজলে কাজলে

নয়ন সরসী..’

কিছু গুঞ্জন চলছিলো উৎস গান ধরার আগে। হঠাৎ এমন গমগমে সুরে যেনো রিহার্সাল ঘর একদম ঠান্ডা হয়ে যায়। শীতল কাঁপা কাঁপা পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সত্যিই তার কাজল লেপ্টে যাওয়ার যোগাড় হচ্ছে নয়নের জলে। উফফ, এতো শান্তি লাগছে কেনো?
লাভলী বাকি নেত্রী ধরণের মেয়েগুলোর সাথে দাঁড়িয়ে ছিলো, খুঁত পেলেই একটা হাস্যরস তৈরি করবে। কিন্তু এ কি, সবাই তো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছে তার গান। রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে সে।
অগ্নি পা টিপে টিপে শীতলের পাশে এসে দাঁড়ায়।
“কি রে শীতল রানী, তোমার উনি তো ফাটিয়ে দিচ্ছে। ইশ তোমার উপর থেকে যেনো নজর সরছেই না।”
“চুপ কর না।”
অগ্নি হেসেই শেষ।

উৎসের গান তখনও থামেনি। তার কণ্ঠে যেমন দরদ, দৃষ্টিতে তেমন প্রেম। শীতলের চোখের দিকে সেই প্রেমময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। আজ সত্যি নিজেকে প্রেমিক মনে হচ্ছে। এতোটা সুন্দর মেয়েটাকে আগে লাগেনি কেনো?

‘বেদনার কলি তুমি দাও ভালোবেসে বঁধু

ফুল ফোটানোর ছলে আমি ভরে দেবো মধু

সারা মন কেন তুমি চোখে সাজালে

কত কি রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে

নয়ন সরসী..

জনম সফল হবে বঁধুয়ার ঘরে আজ

শরমের আড়ালেতে দেখা যাবে ফুলসাজ

জনম সফল হবে বঁধুয়ার ঘরে আজ

শরমের আড়ালেতে দেখা যাবে ফুলসাজ

নিশিরাতে বিরহের…

নিশিরাতে বিরহের বাঁশী ওরে কে বাঁজায়

ভালোবেসে কেন বঁধু আজ শুধু কেঁদে যায়

সেধে সেধে কেন তুমি মরণ নিলে

কতকি রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে

নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে

কত কি রয়েছে লিখা কাজলে কাজলে

নয়ন সরসী..’

উৎসের সুর যেনো বিশাল ফাঁকা ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে, আলাদা করে কোনো বাদ্যের প্রয়োজনই নেই। উৎস থামার পরেও রেশটুকু যেনো আরো অনেকক্ষণ থেকে গেছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
অনুষ্ঠানের গানের ভারপ্রাপ্তে থাকা এক শিক্ষিকা উঠে দাঁড়ায়। নীরবতা ভেঙে সে-ই প্রথম বলে ওঠে,”অপূর্ব।”
ধ্যান ভাঙ্গে সবার। হাততালিতে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।
শুধু তালি দেয়না ঘরের তিনটা মানুষ। লাভলী, তার তো দেওয়ার প্রশ্নই নেই।
উৎস আর শীতল। অপার মুগ্ধতায় দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে যেনো কেউ নেই দু’টো মানুষ ছাড়া। বাকিসব ধূসর, ম্লান শুধু তারা রঙিন।

(চলবে……)

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ২৩

একটানা কড়া নাড়ার আওয়াজে ঘুম ভাঙে রণের। বিছানার পাশে রাখা হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে মাত্র সকাল ছয়টা বাজে। এই অসময়ে তার কাছে কে আসবে? এ বাসায় নতুন উঠেছে সে। তেমন পরিচিত কেউ নেই তো।
চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলতেই ভীমড়ি খেয়ে যায় রণ। চোখ দু’টো আবার ডলে নেয় ভালো করে। যা দেখছে তা কি ঠিক?

“আপনি ঠিকই দেখছেন রণ ভাই, আমি-ই এসেছি।”
রণ হতবাক হয়ে বললো,”উৎস ভাই তুমি?”
উৎস এদিকে ওদিকে তাকায়।
“ভিতরে যেতে বলবেন না?”
রণ জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
“কেনো বলবো না উৎস ভাই? তবে আপনাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছি আমি। আমি আশাই করতে পারিনি। আপনি বাসার ঠিকানা কোথায় পেলেন?”
উৎস রণের কথার উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢোকে। চোখ বুলায় একবার পুরো ঘরের উপর। আসবাব বলতে কিছুই তেমন নেই। ঘরের এক কোণে মেঝেতে একটা তোষক পাতা, তার উপর ফুলতোলা একটা চাদর আর বালিশ। আরেক কোণে মাঝারি আকৃতির একটা ট্রাংক। বইসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দেওয়ালের সাথে স্তূপ করে রাখা। এ বাদে আর কিছু নেই চোখে পড়ার মতো। তবে অল্পের মধ্যে ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে গুছানো। কোথাও কোনো ধূলা-ময়লা নেই। পুরুষ মানুষ একা থাকলে সেই ঘর এতোটা পরিপাটি থাকে উৎসের ধারণা ছিলোনা। কারণ তার নিজের ঘর থাকে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত অঞ্চলের মতো।

“বাহ ঘর খুব সুন্দর গুছিয়েছেন।”
রণ হালকা হেসে বললো,”গরিবের আবার ঘর। জিনিসপত্রই নেই কোনো, অগোছালো হবেটা কি? তবে আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে নিবো উৎস ভাই। একেক মাসের বেতন পেয়ে একেকটা জিনিস করে নিবো।”
রণ মাথা নিচু করে হাসে, উৎস তাকায় তার দিকে। ছেলেটার সরলতাই যেনো তার সৌন্দর্য।
“তাড়াহুড়োর কি আছে? আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিবেন সবকিছু, সমস্যা নাই তো। বউ নাই, ঝামেলা নাই।”
রণ হাসতে হাসতে বললো,”বাবাকে খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবো উৎস ভাই। আমার বাবা সারাজীবন অনেক কষ্ট করেছে জানো? তাকে শেষ জীবনে একটু শান্তি দেওয়ার জন্য আমার প্রাণটা ছটফট করছে।”
উৎস পা ছড়িয়ে বসে মেঝেতে। রণ তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে।

“এ কি ভাই মাটিতে বসলে কেনো? এই তোষকের উপর বসো।”
রণ তাড়াতাড়ি করে বিছানাটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে।
“আরে কি করছেন রণ ভাই, থামুন তো। আমার এসবে কোনো অসুবিধা নেই। সে আপনি খুব ভালো করে জানেন।”
“জানি উৎস ভাই। তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছো। মেঝেতে ঘুমিয়েছো। আমি তোমাদের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।”
উৎস হাসে।
“আপনার বাসাটা কি স্মোকিং ফ্রি জোন? সিগারেট ধরানো মানা?”
“কোনো মানা নেই, তুমি আরাম করে সিগারেট ধরাতে পারো।”
উৎস সিগারেট পকেট থেকে বের করেও কি মনে করে আবার রেখে দেয়।
“কিন্তু তুমি কিন্তু ভাই আমাকে অবাক করেছো। আমি ভাবতেই পারিনি তুমি আমার ঠিকানা খুঁজে আমার সাথে দেখা করতে আসবে। অবশ্য আমি নিজেই তোমাদের সবাইকে দাওয়াত দিতাম। একটু গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। দেখতেই পারছো, কিছুই নেই ঘরে। একটা সোফাসেট, একটা খাট বা অন্তত একটা টেবিল। এসব ছাড়া তোমাদের কীভাবে আপ্যায়ন করি?”
“রণ ভাই, আপনি হয়তো জানেন না আপনার ভাবনার আরো অনেক অনেক দূরে উৎসের বিচরণ। ছোট্ট একটা শহর, আপনার ঠিকানা বের করা খুব কঠিন কিছু না আমার জন্য।”
রণ কিছুটা অবাক হয়। উৎসের কণ্ঠ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেছে। কেনোই বা তার ঠিকানা যোগাড় করলো সে?

রণের ভাবনাচিন্তার মধ্যেই দরজার বাইরে পরিচিত কণ্ঠ শুনে উঠে দাঁড়ায় রণ। দরজার খুলে কিছু একটা নিয়ে আবার ফিরে আসে।
উৎস দেখে রণের হাতে একটা কাগজের ঠোঙা।

“বাকি কথা পরে হবে উৎস ভাই, এসো আগে নাশতা করে নেওয়া যাক। আটটায় অফিস যেতে হবে।”
“আজ থেকেই শুরু?”
রণ লাজুক মুখে হাসে।

“সামনের নাশতার দোকানের ছেলেটা রোজ সকালে এসে নাশতা দিয়ে যায়, মাসিক চুক্তি করেছি। খাবার অসাধারণ, অমৃতের কাছাকাছি।”
রণ ঠোঙা থেকে দুইটা পরোটা আর যৎসামান্য তরকারি বের করে।

“নাও শুরু করো।”
উৎস স্মিত হেসে বললো,”আমি খাবো না রণ ভাই, আপনি খান।”
রণ মন খারাপ করে বললো,”পরিমাণ কম দেখে খাবেন না তাইনা? বেশ আমি নাহয় আবার যেয়ে….”
“কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার অফিস আছে আপনি খান, তাছাড়া আমি এতো সকালে খেতে পছন্দ করিনা। আমি সকালের খাবার কখনো দশটা বা কখনো এগারোটায় খাই। আবার কখনো খাইনা। ছন্নছাড়া জীবনে এতো নিয়মকানুন আমার ভালো লাগেনা।”
রণ ইতস্তত করে, উৎস তাকে আবারও আশ্বস্ত করে।
গোগ্রাসে খেতে থাকে রণ। তার মুখ দেখেই বোঝা যায় আসলেই খাবারটা অমৃতের কাছাকাছি। এতো সাধারণ খাবার এতোটা তৃপ্তি নিয়ে এর আগে কাউকে খেতে দেখেনি উৎস। খুব সম্ভবত রাতে তেমন কিছু খায়নি সে। এজন্যই এমন খিদে পেয়েছে। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় উৎসের। তীক্ষ্ণ চোখে অবলোকন করতে থাকে ছেলেটাকে। নেহাৎ গ্রামের খুন সাধারণ একটা যুবক। চালচলন, পোশাক, চেহারা সবই সাদামাটা। তবুও তার মধ্যে সম্মোহনী কোনো শক্তি আছে। হয়তো এই শক্তিটাই বহ্নিকে আকৃষ্ট করেছে। নাহলে ওর মতো মেয়ে কেনো এতো সহজে কারো প্রেমে পড়তে পারে? কিন্তু তার সামনে বসা মানুষটাকে কি কোনোভাবে প্রতারকের দলে ফেলা যায়? মনে তো হয়না কোনোভাবেই। তবে বহ্নির কার উপর এতো রাগ? কাকে সে নৃ’শংস ভাবে মারতে চায়?

রণ খাওয়া শেষ করে। তার মধ্যে অপরাধবোধ প্রবল হতে থাকে। অতিথিকে বসিয়ে রেখে নিজে খেয়ে নিয়েছে এটা সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না। কিন্তু সত্য বলতে তার রাতে খাওয়া হয়নি। একেবারেই হয়নি তা না। কিছু মুড়ি আর দুই গ্লাস পানি খাওয়া হয়েছে। সকাল হতে হতে খিদাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। তবে এখন মনে হচ্ছে খুব ভুল হয়ে গেলো।

“রণ ভাই…”
“হ্যা বলো না।”
উৎস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”আপনি আমাকে অনেকদিন আগে একটা প্রশ্ন করেছিলেন। আমি কারো প্রেমে পড়েছি কিনা। আজ যদি আমি আপনাকে একই প্রশ্নটা করি, আপনি কি আমাকে উত্তর দিবেন?”
রণ থমকে যায়। আলুথালু চোখে তাকায় উৎসের দিকে। উৎস নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

“উৎস ভাই আসলে…”
“ডিপ্লোমেটিক উত্তর চাইনা আমি। খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন করবো। আপনি কি কারো প্রেমে পড়েছেন? হ্যা অথবা না-তে উত্তর দিবেন।”
রণ মাথা নিচু করে রাখে।
“মাথা নিচু করে রাখবেন না রণ ভাই। পুরুষ মানুষকে মাথা নিচু অবস্থায় দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী দৃশ্য। পুরুষ মানুষ মাথা ঝোঁকাবে শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার সামনে। এ বাদে তার মস্তক থাকবে চির সমুন্নত, শিরদাঁড়া থাকবে সোজা।”
রণ মাথা উঁচু করে, তবে উত্তর দেয়না।
উৎস সরু চোখে তাকায় তার দিকে। রাগে হাত-পায়ের তালু জ্বলে ওঠে তার হঠাৎ।
উঠে দাঁড়ায় সে সাথে সাথে, রণও দাঁড়ায়।

“এ কি দাঁড়িয়ে পড়লে যে? কিছুক্ষণ আগেই তো এলে, এখনই চলে যাবে?”
উৎস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”কাপুরুষের সামনে আমি বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারিনা রণ ভাই। আমার দম আটকে আসে এমন পুরুষদের সামনে যার শিরদাঁড়া এখনো শক্ত হয়নি। টাকাপয়সা, সমাজে নাম, প্রতিপত্তি এগুলো আসবে যাবে। তবে পুরুষের জন্য সবচেয়ে আগে যেটা দরকার তা হলো পুরুষত্ব। তা না থাকলে সেই পুরুষকে আমার ঘৃণা হয়, স্রেফ ঘৃণা হয়।”
উৎস রাগে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। রণ তখনও ঠাঁয় দাঁড়ানো।
উৎস রণের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।
“আপনার নামটা আপনার সাথে যায়না রণ ভাই। রণ মানে যুদ্ধ, সংগ্রাম, শৌর্য। কিন্তু আপনি….”
“আমি কি উৎস ভাই?”
“আপনি কি আপনি ভালো করে জানেন। তবে একটা কথা জেনে রাখবেন আর ভালো করে মাথায়ও ঢুকিয়ে রাখবেন। আমার মামা আমার জীবন। তার জন্য আমি মৃত্যুকে বরণ করতে একবারের বেশি দুইবার ভাববো না। আর স্বভাবতই তার তিন মেয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা। ওদের কোনো কষ্ট আমি দেখতে পারবো না। তার জন্য পৃথিবী উল্টোপাল্টা করে ফেলতে হলে তাই ফেলবো। কেউ যদি স্বেচ্ছায় তাদের কষ্ট দিতে চায়, আমি তাকে শেষ করে ফেলবো। আশা করি বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলছি।”
রণ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে।
উৎস রাগে হনহন করতে করতে দরজার কাছে যেতেই থমকে যায় রণের কথায়।

“তবে সজীবকে খুঁজে বের করো, শেষ করে দাও তাকে।”
উৎস অবাক হয়ে রণের দিকে তাকায়।
“সজীব কে?”
রণ ধীর পায়ে এগিয়ে আসে উৎসের দিকে।
“সে কে বা সে কি করেছে এটা আমি তোমাকে বলতে পারবো না। একজন বিশ্বাস করে আমাকে একটা কথা বলেছে। তার কথা আমার কাছে আমানত। সেই আমানত আমি ভাঙতে পারবো না। তবে উৎস তোমার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে তুমি শুধু সজীবকে খুঁজে বের করো। যেহেতু তুমি বললে তোমার বিচরণ আমার ভাবনার আরো অনেক ঊর্ধ্বে তুমি এটা পারবে বলে আমি মনে করি। তবে….”
“তবে কি?”
“তবে তাকে শাস্তি দিবো আমি। সেই শাস্তির মধ্য দিয়ে আমি তোমাকে দেখাবো উৎস আমি কাপুরষ নই। হ্যা আমি তোমার মতো রাগী নই, আমি হয়তো আমার প্রিয় মানুষের জন্য পৃথিবী উল্টেপাল্টে ফেলতে পারিনা, প্রিয় মানুষটার চোখের এক ফোঁটা পানির জন্য রক্তের বন্যা ভাসিয়ে দিতে পারিনা। তবে আমি যা পারি তা-ও খুব সাধারণ কিছু না উৎস ভাই। আমি শুধু সজীবকে চাই। বাকিটা আমি দেখে নিবো।”
উৎস থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কার আমানতের কথা বলছে রণ? বহ্নির? বহ্নি ছাড়া শীতল বা আভা তো খুব বেশি কথা বলতো না রণের সাথে। আবার বলছে প্রিয় মানুষ। যদি তাই হয়, তবে সজীব কে বহ্নির জীবনে? সে কি খারাপ কিছু করেছে বহ্নির সাথে? বহ্নি কি তাকেই ওভাবে মারতে চায়?

“রণ ভাই আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি।”
“তুমি বুদ্ধিমান উৎস ভাই, একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে আমার কথা। তবে আমাকে একটা সুযোগ যদি দাও আমি প্রমাণ করে দিবো আমি কাপুরষ নই, আমার নাম কিছুটা হলেও স্বার্থক। এর বেশি এখন আমি আর কিছুই বলবো না উৎস ভাই।”
উৎস তাকায় রণের দিকে। তার চোখজোড়া জ্বলছে ধিকধিক করে। একটু আগেও যাকে দেখে রাগ হচ্ছিলো, কাপুরষ হিসেবে ঘৃণা হচ্ছিলো তার প্রতি কিছুটা হলেও শ্রদ্ধা জন্মায়।

“উৎস তোমার আরেকটা প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দিবো না। আমি কারো প্রেমে পড়েছি কিনা সে আমার অন্তর জানে, সেটাই যথেষ্ট আমার জন্য। আমার অন্তর যখন চাইবে বাকিরা জানুক তখন রণ নিজে সবাইকে জানাবে। আমি সবার মতো প্রেম প্রকাশ করতে পারিনা। ফুলের তোড়া নিয়ে প্রিয়তমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারিনা, একসাথে বৃষ্টিবিলাশ করতে পারিনা, একসাথে জ্যোৎস্না দেখার অযুহাতে প্রেমিকার হাতে হাত রাখতে পারিনা। তবে আর কিছু না পারলেও আমি একটা জিনিস পারি। আমার প্রিয় মানুষটাকে রানী বানানোর স্বপ্ন দেখতে পারি আর সেই স্বপ্ন অনুযায়ী নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। পৃথিবীর সাথে লড়াই করে কি হবে উৎস ভাই যদি আমি প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলি? তার বিনিময়ে আমি পৃথিবীর সব খারাপ থেকে আমার প্রিয় মানুষটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করতে পারি। এটাই যদি আমাকে কাপুরষ বানায়, তবে তাই হোক। আমি পৃথিবীর সামনে মাথা পেতে মেনে নিবো আমার কাপুরুষতা। কারণ পৃথিবীর সামনে আমার নিজেকে সুপুরুষ প্রমাণ করার কোনো দরকার নেই। আমি একজনের সামনে শুধু সুপুরুষ থাকতে পারলেই খুশি, আমার তাতেই চলে যাবে।”
রণ কথাটা শেষ করে মুচকি হাসে। উৎস অবাক হয়ে দেখে তার হাসিতে এক দাম্ভিকতা ফুটে উঠেছে বীরত্বের। উৎস ভেবে পায়না, এই কথাগুলো কি রণ তাকে উদ্দেশ্য করে বললো?

উৎস নেমে পড়ে রাস্তায়। অন্যদিন হলে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট না ধরালে গলা শুকিয়ে আসতো তার। কিন্তু কি আশ্চর্য! আজ মোটেই ইচ্ছা করছে না একটা সিগারেট ধরাতে। তেতে আছে মুখটা। তবে কি সে ভুল আর রণ সত্যি? পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে যেয়ে সে কি তার প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলবে? যে বীরত্বের বড়াই সে এতোদিন করতো তা সব মিথ্যে? রণ মাত্র দশ মিনিটে বুঝিয়ে দিলো কে আসল বীরপুরুষ?

“এই শীতল দাঁড়া।”
শীতল ঢোক চাপে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো সে। অগ্নিও দাঁড়ায় তার সাথে।

লাভলী সোজাসুজি এসে দাঁড়ায় শীতলের সামনে। শীতল জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
“কি রে অগ্নি, তোকে দাঁড়াতে বলেছি? তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
অগ্নি ভয়ে ভয়ে বললো,”লাভলী আপা আমি….”
“তুই যা, আমি শীতলের সাথে কথা বলবো।”
শীতল অসহায় চোখে তাকায় অগ্নির দিকে। অগ্নি অনিচ্ছাসত্ত্বেও চলে যায়। তবে ঠিক যায়না, পিলারের পিছনে লুকিয়ে পড়ে।

“ওটা কে ছিলো?”
শীতল ক্ষীণ গলায় বললো,”কে লাভলী আপা?”
“নেকামি করিস না, মারবো টেনে এক থাপ্পড়।”
শীতল ঈষৎ কেঁপে বললো,”আমার ফুপুর ছেলে উনি লাভলী আপা। উনি ভার্সিটিতে পড়ে।”
“তোর উনি যেখানেই পড়ুক আমার জানার দরকার নেই। অসভ্যটা আমাকে অপমান করেছে, এর শাস্তি ওকে পেতে হবে।”
শীতল ভয়ে ভয়ে বললো,”শাস্তি মানে?”
“শাস্তি মানে শাস্তি। আমাকে কাবলি বলা? আমার নামে ভুলভাল আবার কবিতা বানানো? এই লাভলী কে এটা ওকে জানতেই হবে।”
শীতল বিরস মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। এই লোকটার সবসময় যে কেনো বাড়াবাড়ি করা লাগে আমি জানিনা। কি দরকার ছিলো এই লাভলী আপাকে খোঁচানোর?

“শোন শীতল, তোর ওই পিয়ারের ভাইকে বলে দিস। এই লাভলী যে সে নয়। এমনিতেই এতো ক্ষমতা নিয়ে কলেজে টিকে নেই সে। ও এখনো আমার পরিচয় জানেনা। পরিচয় জানলে জায়গায় দাঁড়িয়ে কাপড় নষ্ট করে ফেলবে।”
শীতলের এবার রাগ হয়। এই মেয়েটাকে কষে একটা চড় দিতে ইচ্ছা করে। এতো বড় কথা!

“ওকে বলে দিস আমি এই এলাকার বিখ্যাত বা কুখ্যাত ছোট রুস্তমের একমাত্র বোন। ছোট রুস্তম যদি একবার জানতে পারে তার বোনকে ওই অসভ্যটা অপমান করেছে তাহলে ওর কলিজাটা বের করে আনতে মাত্র দেড় মিনিট লাগবে আমার ভাইয়ের।”
শীতল হতভম্ব হয়ে যায়। এইতো সেই ছোট রুস্তম, যে লোক দিয়ে উৎস ভাইকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। তার মানে এমনিতেই শত্রুতা আছে তার সাথে। তার উপর যদি আবার শোনে তার ছোট বোন লাভলীকে উনি এসব হাবিজাবি কবিতা শুনিয়েছে তাহলে কি যে করবে। কে বলেছে উনাকে আগুন নিয়ে খেলতে? এই লোকটা একদিন তাকে মেরেই ফেলবে দুশ্চিন্তা দিতে দিতে, ঠিক মেরে ফেলবে।
লাভলী চলে যায়। শীতল কাতর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। অগ্নি এসে তার হাত ধরে। বুকটা কাঁপতে থাকে শীতলের ভয়ে।

“শাহানা আগামীকাল একবার জমিতে যেতে হবে, খদ্দের পেয়েছি একজন ভালো। আমাকে প্রাপ্য দামটাই দিবে উনি।”
রাতের খাওয়ার পর শাহানা বিছানা গোছাচ্ছিলো। পাশেই চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলো নওশাদ।
স্বামীর কথা শুনে শাহানা কিছু একটা ভাবে। এরপর ধীর পায়ে হেঁটে নওশাদের পাশে এসে বসে। নওশাদের হাতের উপর আলতো করে হাত রাখে।

“বলছি আরেকবার ভাবলে হতো না?”
“কি ভাবতে বলছো?”
“দেখো আমাদের ছেলে সন্তান নেই, তিনটা মেয়ে। ওরা বড় হচ্ছে। একে একে ওদের বিয়ে দিতে হবে। বহ্নির এ বছর শেষ হলে ওর গ্রাজুয়েশন শেষ হবে। আর কতোদিন মেয়েকে কাছে রেখে দিবে? বিয়ে দিতে হবে তো। এখন থেকেই যদি চিন্তাভাবনা না করো সে ব্যাপারে…”
নওশাদ শান্ত চোখে তাকায় স্ত্রীর দিকে।
“কে বলেছে চিন্তাভাবনা করছি না?”
শাহানা অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”তুমি যেভাবে সহজ করে ভাবছো সবকিছু এতো সহজ না বহ্নির বাবা। মেয়েদের বিয়ে দিতে অনেক খরচ হবে। তাছাড়া বাড়ি তো আমাদের একটা আছেই, মাথা গোঁজার জন্য যেটুকু ঠাঁই দরকার আমাদের আছে। এরবেশি কি দরকার বলো তো?”
নওশাদ চায়ের কাপে চুমুক দেয়, উত্তর দেয়না শাহানার কথার।
শাহানা কিছুটা নরম গলায় বললো,”আমি জানি তোমার অনেক শখ মেয়েদের জন্য দোতলা বাড়ি বানানোর। কিন্তু মেয়েরা আর ক’দিন এ বাড়িতে থাকবে বলো? আস্তে আস্তে চলে যাবে তিনজনই। উৎস চাকরি পেয়ে ওর মা’কে নিয়ে চলে যাবে। থাকবো শুধু আমি আর তুমি। আমাদের দুইজনের জন্য এতো বড় বাড়ির কি দরকার? তারচেয়ে টাকাটা মেয়েদের বিয়ের জন্য যদি রাখা যায়, সেইটা কি ভালো হবে না?”
নওশাদ চা শেষ করে কাপটা রেখে দেয়।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে শাহানার চোখের দিকে তাকায় সে।
“শাহানা মেয়েদের বাবা যখন হয়েছি তাদের চিন্তা আমার মাথায় সবসময়ই ছিলো, আছে আর থাকবে। ওদের বিয়ে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি লাইট বন্ধ করে দাও, আমার ঘুম পাচ্ছে।”
শাহানা হালকা চিৎকার করে ওঠে।
“আমি দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারিনা আর তোমার এতো ঘুম পায় কেনো?”
“এতো দুশ্চিন্তা কেনো তোমার শাহানা? আমি তো আছি।”
শাহানা উত্তর দেয়না, ভীষণ কান্না পায় তার। কীভাবে কি হবে সামনের দিনে বুঝতে পারে না সে।

“শাহানা সারাজীবন সৎ থেকেছি। একটা টাকা ঘুষ খাইনি, কারো টাকা মেরে খাইনি। হয়তো আমার অনেক টাকা নেই তবে এককালীন কিছু টাকা তো পাবো চাকরির শেষে। তাতে কি আমার তিন মেয়ের বিয়ে হবে না?”
“আর তারপর? আমাদের চলবে কীভাবে? কি খাবো আমরা?”
নওশাদ বিছানায় যেয়ে বসে। শাহানাও পিছন পিছন ছুটে আসে।
“উত্তর না দিয়ে তুমি ঘুমাতে পারবে না। এই উত্তর তোমাকে দিতেই হবে।”
শাহানা নওশাদের একদম সামনে এসে দাঁড়ায়। নওশাদ চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে বিছানায়। শাহানা নড়ে না।
উপয়ান্তর না পেয়ে নওশাদ আবারও উঠে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে হেঁটে যেয়ে আলমারি খোলে। নিজের ব্যক্তিগত ড্রয়ার থেকে একটা ব্যাংকের বই বের করে শাহানার দিকে বাড়িয়ে দেয়।

“কি এটা?”
“নিজেই দেখো।”
শাহানা কিছুটা ইতস্তত করে বইটা হাতে নেয়। পাতা ওল্টায়। আর সাথে সাথেই স্তম্ভিত হয়ে যায় সে।

“এতো টাকা….?”
নওশাদ কিছু না বলে ছোট্ট করে হাসে।
“এতো টাকা কোথায় পেয়েছো তুমি?”
“আমার টাকা, আমার কষ্টের টাকা। কোথায় আর পাবো?”
শাহানা স্বাভাবিক হতে পারেনা। একের পর এক পাতা ওল্টায় আর অবাক হতে থাকে। দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তার।

“আঠারো বছর যাবৎ বেতনের অল্প অল্প টাকা জমিয়েছি ব্যাংকে, শুধু মেয়েদের জন্য। তোমাকে জানাইনি, কারণ তুমি অধৈর্য্য। সংসারের অনেক টানাপোড়েন গেছে। তুমি হয়তো সেসব দিনে আমাকে বলতে ওই টাকা থেকে খরচ করতে, জোর করতে। আমি তা চাইনি শাহানা। আজও তোমাকে বলতাম না। আমার বিশ্বাস ছিলো তুমি মেয়েদের সব চিন্তা আমার উপর দিয়েই নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। তবে আজ এই প্রথমবারের মতো তোমাকে এতোটা চিন্তিত হতে দেখলাম মেয়েদের বিয়ের জন্য। তুমি আমার উপর এতোটুকুও বিশ্বাস রাখতে পারলে না। তাই দেখিয়ে দিলাম।”
শাহানা উত্তর দেয়না, সে এখনো ধাতস্থ হতে পারেনি। বইটা হাতে নিয়ে অনড় দাঁড়িয়ে আছে সে।

“শাহানা, আমার দোয়েল পাখি। আমি স্বামী হিসেবে হোক, পিতা হিসেবে হোক, ভাই বা মামা হিসেবেই হোক, আমি কাউকে কোনোদিন খারাপ রাখতে চাইনি। আমার ক্ষমতা সীমিত, সামর্থ্য সীমিত তবে আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাই আমার এই সাজানো গোছানো পরিবারটাকে ভালো রাখতে। আমার খুব ইচ্ছা দোয়েল পাখি, দোতলার বারান্দায় তোমার সাথে বসে থাকার, আমার মেয়েগুলোকে আলাদা আলাদা ঘর দেওয়ার। এতে আমি অপার্থিব আনন্দ পাবো গো। আমাকে এই আনন্দটুকু থেকে বঞ্চিত করোনা। একবুক অতৃপ্তি নিয়ে তবে আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো।”
নওশাদ শুয়ে পড়ে। শাহানা ঘুমাতে পারেনা। একরাশ অপরাধবোধ ঘিরে ধরে তাকে। গলা শুকিয়ে আসে। সে কি বেশি বেশি করে ফেললো? মানুষটা সহজে রাগে না, তবে অভিমান করলে সে অভিমান বড় কঠিন হয়। শক্ত প্রাচীরের মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলে। কারো সাধ্যি নেই সেই প্রাচীর ভাঙার। কীভাবে ভাঙবে এখন সে? কি করবে?

রাতে সাধারণত একা ছাদে আসেনা শীতল। ভূতের ভয় পায় সে। তবে আজ তাকে আসতেই হবে। উৎস ফিরেছে রাত করে। কলেজেও নিজে আনতে যায়নি তাকে, অন্য কাউকে পাঠিয়েছে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। এতো কিসের ব্যস্ততা যে লোকটার বোঝেনা সে। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত খুব চিন্তা হয় তার।

একটু একটু ভয় পেলেও ছাদে আসতেই তার মন ভালো হয়ে যায়। দূর থেকে একবিন্দু আগুন দেখে খুশি হয়ে যায় সে। মানে সে ছাদেই আছে। তাহলে আর কিসের ভয়?

ঝুনঝুন নুপুরের আওয়াজে মুচকি হাসে উৎস উল্টোদিক ফিরেই। তার মন বলছিলো সে আসবে। সারাদিনে একটাবারও দেখা হয়নি তার সাথে। এতোটুকু দেখার যে খুব দরকার ছিলো। নাহলে যে তৃষ্ণায় সারারাত ছটফট করতো।

“আসুন রানীসাহেবা, কাছে আসুন।”
শীতল বরফের মতো জমে যায়। ইশ! এই মানুষটা কি দিয়ে তৈরি? একরাশ স্নিগ্ধ ভালো লাগায় তার শরীর জুড়িয়ে আসে। শিরশির করে ওঠে প্রতিটা শিরা-উপশিরা।

উৎস সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়।
শীতল কাচুমাচু করে এসে উৎসের পাশে দাঁড়ায়।
“এতোটা দূরে দাঁড়ালেন যে, কাছে আসতে বললাম না?”
শীতল গাঢ় গলায় বললো,”কি হচ্ছে কি?”
“কেনো ভয় পাচ্ছেন?”
“কিসের ভয় পাবো শুনি?”
উৎস দুই হাত বুকে বেঁধে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় শীতলের দিকে। হালকা নীল জামা পরেছে একটা, সাথে গাঢ় নীল চুড়িদার সাদা ওড়না। লম্বা চুলগুলো দুই বেনী করা। কি ভীষণ অপূর্ব লাগে তাকে। উৎসের ঠোঁটের কোণায় সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে।

“বললেন না কিসের ভয় পাবো?”
উৎস নিজেই অনেকটা কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় শীতলের। শীতল সরে যেতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। অদৃশ্য চুম্বকের টানে আটকে আছে যেনো।
“কিসের ভয়? যদি শুষ্ক হৃদয়টা এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজতে চায়? অবাধ্য শ্বাস-প্রশ্বাস মিশে যেতে চায় অপরের সাথে? বেপরোয়া মনটা জেনেশুনে এই রাতকে সাক্ষী রেখে কোনো ভুল করতে চায়?”
শীতল কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”আপনি কোনো ভুল করতেই পারেননা।”
উৎস আচমকা শব্দ করে হেসে দেয়। শীতল ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। উৎস আবারও কিছুটা দূরে যেয়ে দাঁড়ায়।

“কেনো তোমার বাবার ভাষায় আমি মহাপুরুষ, এজন্যই আমি কোনো ভুল করতে পারিনা?”
শীতল মাথা নিচু করে বললো,”জানিনা আমি।”
উৎস রেলিঙে হাত ঠেকিয়ে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“কিছু বলতে এসেছিলে?”
“কেনো কিছু না বলতে চাইলে আসা যাবে না?”
উৎস ভ্রু উঁচু করে তাকায় সাথে সাথে শীতলের দিকে। শীতল অন্যদিকে ফিরে ঠোঁট কামড়ে হাসে।
“খুব কথা শিখেছেন যে রানীসাহেবা।”
“আপনি প্রশ্রয় দিয়েছেন যে, তাই।”
“আচ্ছা? তাহলে আমাকেও একটু প্রশ্রয় দিন।”
“সাহস থাকলে বাবাকে বলুন, চেয়ে নিন।”
“চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন?”
“নিজের ইচ্ছাটুকু জানালাম।”
“খুব ইচ্ছা না?”
শীতল উৎসের দিকে তাকায়, কীভাবে যে সে তাকিয়ে আছে! লজ্জায় লাল হয়ে যায় শীতল।
“কিসের ইচ্ছা? কোনো ইচ্ছা নেই, যান তো।”
উৎস চোখ ফেরায় না, সেভাবেই তাকিয়ে থাকে।
শীতল দুই হাতে মুখ ঢাকে। তার হাতের নীল চুড়িগুলো ঝুনঝুন করে ওঠে। সেই শব্দে কি এক ভ্রম হয় উৎসের, রোমাঞ্চিত হয় শরীর।

“আপনাকে কিন্তু আমি কিছু জানাতে এসেছিলাম। বলতে পারেন বকা দিতে এসেছি।”
উৎস অবাক হয়ে বললো,”তুমি আমাকে বকা দিবে?”
“হ্যা দিবো।”
“তুমি জানো আমাকে সবাই কি পরিমাণ ভয় পায়? আর তোমার মতো ছোট্ট এক পিঁপড়া নাকি আমাকে বকা দিবে।”
শীতল হেসে বললো,”এ যেনো তেনো পিঁপড়া নয়, বিষ পিঁপড়া। বিষ পিঁপড়ার কামড়ে সিংহও কুপোকাত হতে পারে।”
উৎস কিছু বলেনা, হাসে আপনমনে।
শীতল চাপা গলায় ফিসফিস করে বললো,”আপনি যাকে ইচ্ছা শাসন করুন কিন্তু আপনাকে শাসন করার অধিকার শুধুমাত্র আপনার অনুপমার।”
“নাহ অনেক বেশি কথা শিখেছো। সত্যি এবার তোমার পিতামশাইকে জানাতে হচ্ছে। আর তারপর….”
“তারপর?”
“তারপর বিষটুকি শুষে নেওয়ার পালা।”
“উফফ অসভ্য একটা। আমি গেলাম।”
শীতল চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উৎস পিছন থেকে শক্ত করে তার হাত ধরে। দু’টো চুড়ি আলগোছে ভেঙে নিচে পড়ে যায়। শীতল অতি ঠান্ডা একটা হাতের স্পর্শে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

“কি বলেছে? ওই কাবলি ছোট রুস্তমের বোন?”
“কাবলি কাবলি করবেন না তো, লাভলী ওর নাম।”
“আমি ওসব বলতে পারবো না, কাবলিই ঠিক আছে।”
শীতল হাল ছেড়ে দেয়।
“বেশ তোমার কাবলি আপাকে আগামীকাল যেয়ে একটা কথা বলবে। পারবে না?”
“কি কথা?”
“বলবে উনার ভাইকে যেয়ে যেনো বলে উৎস শাহরিয়ারকে ডেকে যেনো খুব করে বকে দেয় তার বোনকে কবিতা শোনানোর অপরাধে। আর হ্যা, উনার একটা লাল ওড়নাও ভাইকে দিয়ে আসতে বলবে।”
“কি বলছেন এসব? লাল ওড়না দিয়ে রুস্তম কি করবে?”
“সে দেখা যাবে কি করে।”
“তার মানে আপনি আবার ওই রুস্তমের কাছে যাবেন?”
“তাহলে কি কাবলির কাছে ক্ষমা চাইবো?”
শীতল উশখুশ করতে থাকে।

“আচ্ছা বেশ আমি আগামীকাল তোমার অতি প্রিয় কাবলি আপার সাথে দেখা করবো প্রথমে। এরপর বাকিটা দেখা যাবে।”
“আপনি কিন্তু আর কোনো ঝামেলা করবেন না উনার সাথে। উনি ছোট রুস্তমের বোন।”
“ওহ, অনেক ভয় পেয়ে গেলাম। আচ্ছা দুই ভাই বোনকে একসাথে নাচাবো তাহলে। হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মলমল, মেরা লাল দুপাট্টা মলমল।”
শীতল রাগে অন্যদিকে তাকায়। এই মানুষটা আর ভালো হবে না, সে সম্ভাবনাই নেই। তাকে আজীবন এভাবে দুশ্চিন্তায় রেখেই যাবে।

উৎস আর শীতলকে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে যায় বহ্নি। ঘরের মধ্যে ভালো লাগছিলো তাই ছাদে এসেছিলো সে। দূর থেকে দুইজনকে একসাথে দেখে সে ভেবে পায়না কি করবে। বড় বোন হয়ে এখন কি করা উচিত তার? শীতলকে ঘরে পাঠিয়ে দিবে নাকি ওদের কিছু না বলেই নিজে চলে যাবে এখান থেকে?

হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়ে উৎসের প্রথম, এরপর শীতলের। শীতল ভয়ে এতোটুকু হয়ে যায়। ঠোঁট কাঁপতে থাকে ভয়ে। আজ বোধহয় আপা তাকে মেরেই ফেলবে।

“বহ্নি আয়।”
বহ্নি শীতলের দিকে তাকায়। শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
উৎস প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,”আজ ওকে পড়াতে পারিনি তো, তাই এসেছিলো শুনতে আগামীকাল পড়াবো কিনা।”
বহ্নি ছোট্ট করে বললো,”ভালো।”
“তোর সাথে আমার কথা আছে বহ্নি।”
“আমার সাথে?”
উৎস মাথা নাড়ে। শীতলের দিকে তাকায় সে পিছন ঘুরে।

“শীতল ঘরে যাও তুমি, আগামীকাল পড়াবো তোমাকে।”
শীতল ঘাড় কাত করে চলে যায়। আপার কাছাকাছি আসতেই তাই ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায়। বহ্নি নির্বিকার, অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে। শীতল চলে যায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে।

“বহ্নি।”
“বল।”
“আমার দিকে তাকা।”
বহ্নি তাকায় উৎসের দিকে। তার দৃষ্টি এলোমেলো, উৎস কিছুটা ঘাবড়ে যায়।
“তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
“কই না তো।”
“যদি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করি তুই ঠিকঠাক উত্তর দিবি তো?”
বহ্নি ম্লান হেসে বললো,”এমন কখনো হয়েছে যে ঠিকঠাক উত্তর দিইনি তোর প্রশ্নের?”
উৎস ভেবে পায়না কি করবে, অন্ধকারে ঢিলটা কি ছোঁড়া ঠিক হবে?

“কি হলো বল, কি জানতে চাস?”
উৎস একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”সজীব নামে কাউকে চিনিস তুই?”
ভয়াবহভাবে চমকে ওঠে বহ্নি। চাপা আর্তনাদ করে কিছুটা দূরে ছিটকে যেয়ে পড়ে। উৎস হতবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। বহ্নি কাঁপছে থরথর করে।

(চলবে…..)