মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-২৪+২৫

0
93

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ২৪

“তুই কার নাম বললি উৎস?”
উৎস শান্ত গলায় বললো,”রিল্যাক্স বহ্নি, এমন করছিস কেনো?”
বহ্নি আরো জোরে চিৎকার করে বললো,”তুই কার নাম বললি আবার বল?”
উৎস ক্ষীণ গলায় বললো,”সজীব কে বহ্নি? চিনিস তাকে?”
“তোকে এই নাম কে বলেছে?”
“যে-ই বলুক, তুই চিনিস কিনা বল।”
বহ্নি উত্তর দেয়না। দুই হাতে মাথা চেপে ছাদের রেলিঙের ঘেঁষে দাঁড়ায়। হৃৎপিণ্ডটা যেনো গলার কাছে এসে ধকধক করছে তার।

উৎস ধীর পায়ে হেঁটে বহ্নির পাশে দাঁড়ায়। বহ্নির মাথায় আলতো করে হাত রাখতেই কেঁপে ওঠে বহ্নি।

“কি হয়েছে বহ্নি? তুই আমাকে বলবি না? তোর উৎস বাবুকে বলবি না?”
বহ্নি উত্তর দেয়না। চোখের সামনে এই ঘটনা ভাসছে। একদম জীবন্ত, যন্ত্রণা ছুঁয়ে যাচ্ছে তার প্রতিটা শিরা-উপশিরা।

“বহ্নি তোর মনে আছে, ছোটবেলায় তুই শীতল আর আভাকে সাজিয়ে দিতিস। আলমারিতে তোলা ফ্রক পরিয়ে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে। আমাকেও মাঝে মাঝে জোর করতিস ওরকম সাজার জন্য। আমি লজ্জায় দৌড় দিতাম। বলতাম ওসব মেয়েদের সাজ, আমি কি মেয়ে? তুই তখন বলতি তুই আমার পুতুল। আমরা তিনজনই নাকি তোর পুতুল। পুতুলকে যেভাবে সাজায়, তুইও আমাদের সেভাবে সাজাতে চাস, মনে পড়ে?”
বহ্নি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। উৎস তাকে থামায় না।

“আসলেই আমরা তোর কাছে পুতুল ছিলাম রে। তুই আমাদের বকা দিয়েছিস, মেরেছিস আবার একটু পর নিজেই কষ্ট পেয়ে কেঁদে ভাসিয়েছিস। আমাদের বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছিস। আমরা হয়তো-বা কখন ভুলে গিয়েছি তোর বকার কথা, কিন্তু তুই ঠিকই মনে রেখে কষ্ট পেয়েছিস। তুই এতো ভালো কেনো রে বহ্নি? এতো ভালো কেনো হতে হবে একটা মানুষকে?”
বহ্নি উৎসের হাত চেপে ধরে দুই হাতে। ফোঁপাতে থাকে একনাগাড়ে। উৎসের কলিজাটা যেনো ছিঁড়ে যায়। বহ্নিকে এভাবে ভেঙে পড়তে কখনো দেখেনি সে।

“বহ্নি তুই আমাকে বলবি না তোর কিসের এতো কষ্ট? কে সজীব?”
“কেউ না কেউ না কেউ না।”
“আচ্ছা বুঝলাম কেউ না। যদি কেউ না হবে, তুই এরকম করছিস কেনো তার নাম শুনে?”
বহ্নি ঝট করে উৎসের হাত ছেড়ে দেয়।

“আমাকে স্পর্শ করিস না উৎস। আমি অপবিত্র, আমার শরীর নোংরা। রক্তস্নান না করলে আমি পবিত্র হবো না।”
আঁৎকে ওঠে উৎস। হতবাক হয়ে তাকায় বহ্নির দিকে।
“বহ্নি…..”
বহ্নি চোখ মুছে বললো,”ঘুমাতে যা, আমিও যাবো।”
বহ্নি চলে যেতে গেলেই উৎস তার পথ আগলে দাঁড়ায়। বহ্নি তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় তার দিকে।

“সামনে থেকে সরে যা উৎস, আমাকে যেতে দে।”
“ওরকম বাজে একটা কথা কেনো বললি তুই? এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তোকে এক পা এগোতে দিবো না আমি।”
“জোর করবি?”
“করবো।”
বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”আমার ভালো লাগছে না উৎস, যেতে দে। নাহলে খুব মার খাবি।”
“আমাকে তুই খু’ন করে ফেললেও আমি তোকে এক পা এগোতে দিবো না। আগে আমাকে সবটা বলবি, তারপর যাবি।”
বহ্নি আহত চোখে তাকায় উৎসের দিকে। উৎস গম্ভীরভাবে চেয়ে আছে।

“কি শুনতে চাস তুই?”
উৎস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”সজীব কে? আর একটু আগে কি বললি তুই, শরীর নোংরা, অপবিত্র। আবার রক্তস্নানে পবিত্র হবি, এগুলোর মানে কি?”
“এমনি বলেছি।”
“বহ্নি।”
উৎসের ধমকে কেঁপে ওঠে বহ্নি।
“ফাজলামি করছি তোর সাথে আমি এতো রাতে?”
“চিৎকার করছিস কেনো? কে অধিকার দিয়েছে তোকে আমার সাথে এভাবে কথা বলতে?”
উৎস সহসাই কিছুটা দমে যায়।
বহ্নি থামে না।
“ভাই আছিস ভাইয়ের মতো থাক, আমার ব্যক্তিগত গণ্ডিতে ঢুকতে যাস না। আমরা সেই ছোট্টটি নেই যে, সব ব্যক্তিগত কথা সবাইকে বলতে হবে। তোর ব্যক্তিগত কিছু আমাকে বলিস? আমি অবশ্য জানতেও চাইনা। তুই কেনো জোর করছিস?”
বহ্নি এবার থামে। উৎস আশা করেনি বহ্নি তার সাথে এভাবে কথা বলতে পারে।

“এবার দয়া করে সামনে থেকে সরে যা, আমাকে যেতে দে।”
উৎস কিছুটা সরে দাঁড়ায়। অপরাধবোধ বহ্নিকে জেঁকে ধরলেও সে পাত্তা দেয়না।

বহ্নি কয়েক কদম এগোনোর পর উৎস হালকা হেসে বললো,”বুঝলাম, আমার থেকে রণ ভাই তোর কাছে বেশি আপন হয়ে গেছে। যে ব্যক্তিগত কথা তুই উৎসকে বলতে পারিস না, সেই একই ব্যক্তিগত কথা তুই রণকে বলতে পারিস। বাহ বহ্নি, খুব ভালো।”
বহ্নি থমকে যায়, পা দু’টো জমে যায় হঠাৎ।

“বেশ, তোর ব্যক্তিগত গণ্ডিতে আমি আর প্রবেশ করবো না। এতেই যদি তুই ভালো থাকিস, তবে তা-ই হোক।”
উৎস আবারও হাসে ছোট্ট করে।

“উৎস….”
“নিচে যা বহ্নি, ঘুমা।”
“রণ তোকে কি বলেছে? কোথায় পেয়েছিস তাকে?”
“কোনটা জানতে চাস, আমাকে কি বলেছে নাকি তাকে কোথায় পেয়েছি?”
“আগে বল উনি তোকে কি বলেছে? সজীব নামটা উনার কাছ থেকে শুনেছিস তুই? উনি সব বলে দিয়েছে তোকে?”
“না উনি কিছু বলেনি আমাকে। শুধু নামটা বলেছে, আমি যেনো তাকে খুঁজে বের করি।”
“তাকে দিয়ে উনি কি করবে? কেনো খুঁজতে বলছে?”
উৎস বহ্নির কথার উত্তর না দিয়ে সিগারেট ধরায়। রেলিঙে হেলান দিয়ে দূরে তাকায়।
বহ্নি অসহিষ্ণু হয়ে এগিয়ে আসে।

“চুপ করে আছিস কেনো? কেনো খুঁজতে বলেছে তাকে? কি করবে উনি?”
“সেইটা তো তুই জানিস।”
বহ্নি উশখুশ করতে থাকে।

“উৎস আমি তোকে কিছু বলতে চাই।”
উৎস শীতল চোখে তাকায় বহ্নির দিকে। বহ্নি হঠাৎ দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে ছাদের উপর। উৎস সিগারেট ফেলে দিয়ে বহ্নির মুখোমুখি বসে।

ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে উৎসের, গলার রগ ফুলে উঠেছে। এই মুহুর্তে তাকে দেখতে আহত সিংহের মতো লাগছে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। বহ্নি ঠাঁয় বসে থাকে।

“এই কথা তুই আমাকে আগে বলিসনি কেনো?”
বহ্নি উত্তর দেয়না, শরীরের সব শক্তি মনে হচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে সে। ক্লান্ত হয়ে বসে আছে শূন্যের দিকে তাকিয়ে।

উৎস চিৎকার করে উঠে বললো,”কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস না? আগে বলিসনি কেনো এই কথা আমাকে?”
“উৎস আস্তে কথা বল, বাবা জেগে যাবে।”
উৎস আস্তে বলেনা, আরো জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকে সে। পৃথিবী জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার আগুন দিয়ে।

“জেগে যাক, পুরো দুনিয়া জেগে যাক। তুই আমাকে আগে কেনো এই কথা বলিস নি জবাব দিতে হবে।”
“আমি তোকে কোনো ঝামেলায় ফেলতে চাইনি।”
“ঝামেলা? ঝামেলা? ঝামেলা এখন হবে।”
বহ্নি উঠে দাঁড়ায়।
“তার মানে? কি করবি তুই?”
“শু’য়োরের বাচ্চার গলার নলি টেনে ছিঁড়ে না ফেললে আমার নাম উৎস না। ওরে খু’ন করে আমি জেলে যাবো দরকার হয়। র’ক্ত দিয়ে স্নান করবি না তুই? র’ক্ত এনে দিবো তোকে কুত্তার বাচ্চার, তাজা র’ক্ত।”
বহ্নি নির্লিপ্ত চোখে দূরে তাকায়। উৎসের রাগ সময়ের সাথে দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকে।
এক পর্যায়ে উৎস গোঙাতে গোঙাতে ছাদের উপর বসে পড়ে। দুই হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে। বহ্নি কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়। এভাবে কখনো কাঁদতে দেখেনি সে উৎসকে, কখনো না।

“উৎস….”
“ইয়া আল্লাহ! হে আমার রব, আমি তোমার পাপী বান্দা মওলা। যদি কোনোদিন একটু হলেও কোনো ভালো কাজ করে থাকি, তুমি তার বিনিময়ে আমাকে শক্তি দাও। আমি ওরে জ্যান্ত কবর দিবো খোদা। এরপর তুমি আমারে যা শাস্তি দিবা, আমি মাথা পেতে নিবো। আমার ফাঁ’সি হোক, ভয়ংকরভাবে আমার মৃত্যু হোক আমি সব সহ্য করতে পারবো। কিন্তু আমি এই যন্ত্রণা সহ্য করবো কীভাবে মওলা? আমার ফুলের মতো বোনটাকে ও কষ্ট দিছে, ওরে যন্ত্রণা দিছে। আমার যে বোনের শরীরে কেউ একটা ফুলের টোকা দেয়নি সেই বোনরে ওই শু’য়োরের বাচ্চা ব্যথা দিছে। ওরে সারাজীবনের জন্য মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে গেছে। ওরে খু’ন না করে আমি শান্তি পাবো কীভাবে? আমারে তুমি ক্ষমা করে দিও মা’বুদ।”
উৎস দুই হাত মাটিতে আছড়াতে থাকে। বহ্নি ছুটে যেয়ে তাকে আটকায়।

“উৎস এসব কি করছিস?”
পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না, যখন সে হৃদয়ের সমস্ত কষ্ট নিংড়ে কাঁদে তখন সেই দৃশ্য অতি ভয়াবহ হয়। বহ্নি মূর্তির মতো বসে থাকে।
“বহ্নি তোরে কষ্ট দিছে, অনেক ব্যথা পেয়েছিস? আর আমি দিব্বি হাসিমুখে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি কেনো বুঝতে পারিনি তোর মুখ দেখে? বহ্নি আমারে মেরে ফেল না তুই, ফেল না। আমি সহ্য করতে পারছি না তো।”
“উৎস কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। তুই শান্ত হ, সোনা ভাই আমার। এমন করিস না। সবাই জেগে যেয়ে যদি এমন কিছু দেখে কি ভাববে বল তো?”
“যা ভাবে ভাবুক। পুরো দুনিয়া দেখুক আমি কতোটা যন্ত্রণা পাচ্ছি।”
বহ্নি উৎসের হাত ধরে চুপচাপ বসে থাকে।

“আমি বাইরের প্রতিটা নিরীহ মেয়েদের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে লড়াই করছি। আর আমার ঘরে, আমার কলিজার টুকরো বোন কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত আর আমি জানিনা? আমি উৎস বেঁচে থাকতে আমার বোনের সুন্দর হৃদয়টা খু’ন করেছে যে, সেই খু’নী এখনো পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এটা আমার জন্য কতোটা যন্ত্রণার তোরে আমি কীভাবে বুঝাই?”
বহ্নি উৎসের হাত নিজের কপালে ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে, উৎস পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে যেনো তার।

হন্তদন্ত হয়ে রুস্তমের ঘরে ঢোকে মতিন। সকাল সকাল তার থলথলে শরীরটা দেখে মেজাজ খারাপ হয় রুস্তমের। মতিনকে বেশ চিন্তিত মনে হয় দেখে।

“ভাই, ভাই।”
রুস্তম সকালে এক গ্লাস করলার রস খায়। এতে নাকি দীর্ঘকাল বয়স ধরে রাখা যায়, যৌবন ধরে রাখা যায়।
এক চুমুক খেয়েই মুখটা তেতে আসে তার।
চোখমুখ কুঁচকে মতিনের দিকে তাকিয়ে বললো,”কি হয়েছে কি?”
“ভাই আপনি এখনো চুপ করে থাকবেন? কিচ্ছু বলবেন না?”
রুস্তম উত্তর দেয়না। মতিন সব ব্যাপারেই এমন উত্তেজিত থাকে। তাকে এতো গুরুত্ব দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
“ভাই শুনছেন কি বলছি?”
“আরে বলবি তো কি হয়েছে? ভাঙা ক্যাসেট চালিয়ে যাচ্ছিস তখন থেকে।”
মতিন মুখ গোঁজ করে বললো,”নওশাদ খাঁ তো জমিতে খদ্দের নিয়ে গেছে। বিক্রি করে ফেলতেছে, আমাদের হাত থেকে সব বেরিয়ে যাচ্ছে। আপনি কিছুই করবেন না?”
রুস্তম আরেক চুমুক দেয় গ্লাসে। আবারও চোখ কুঁচকে ফেলে।
“ভাই, ও ভাই…”
“আহ, থামবি তুই?”
রুস্তমের দিকে মতিন অবাক হয়ে তাকায়।
“ভাই আপনিও কি তাহলে ওই পুচকে ছোকড়াটাকে ভয় পাচ্ছেন? আপনার যে এতো ক্ষমতা….”
মতিন কথা শেষ করার আগেই রুস্তম চোখ গোল গোল করে তাকায় তার দিকে। ভয়ে চুপসে যায় মতিন।

“আমাকে একবার শুধু অনুমতি দেন ভাই, ওরে আমি কি করে দেখেন।”
“তাই নাকি? কেমন নেচেছিস জীপের পিছনে পুরো শহর দেখেছে কাপুরুষের বাচ্চা। কি করবি তুই?”
মতিন অপমানিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।
“এখন যা বিরক্ত করিস না।”
মতিন তা-ও দাঁড়িয়ে থাকে।

“আবার কি?”
“ভাই অভয় দিলে একটা কথা বলতাম।”
রুস্তম কোনো কথা না বলে তাকায় মতিনের দিকে।
“ভাই আপনি সত্যি সামান্য একটা ছোকরাকে ভয় পাচ্ছেন? আপনার এতো ক্ষমতা থাকতে, ওর উপরে কিছুই বলতে পারছেন না?”
রুস্তম আপনমনে হাসতে থাকে।
“ভাই…”
“মতিন, উৎস সামান্য নয়। আমার ক্ষমতা বেশি তবে ওর জনপ্রিয়তা বেশি। ও একবার ডাক দিলে শত শত ছেলে জমা হবে। ওর সম্পর্কে আমি অনেক খোঁজ নিয়েছি। ওকে যতোটা সাধারণ মনে হয়, ও ততটা সাধারণ নয়। ওর মধ্যে এমন কোনো ক্ষমতা আছে, যা দ্বারা খুব সহজে পরিবেশ উত্তপ্ত করে ফেলতে পারে ও।”
“তাই বলে এভাবেই বাড়তে দিবেন ওকে?”
রুস্তম উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে হেঁটে জানালার পাশে যায় সে।

“মতিন ঘুড়ি উড়িয়েছিস তুই কোনোদিন?”
“উড়িয়েছি ভাই, কিন্তু কেনো?”
“নাটাই থেকে আস্তে আস্তে সুতা ছাড়তে হয় প্রথমে। ঘুড়িকে অনেক দূরে উড়তে দিতে হয়। ঘুড়িটা তখন ভাবে, আর কিসের চিন্তা? এবার আমি মুক্ত। সে মনের সুখে উড়তে থাকে আকাশে। নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করতে থাকে, নিজের মালিককেও ভুলে যায়। কিন্তু হঠাৎ যখন ঘুড়ির মালিকের খেলা শেষ হয়ে যায়, সে তখন সুতা টান দিতে থাকে। একটু একটু করে সুতা টেনে ঘুড়িটাকে নিজের বাগে নিয়ে আসে। ঘুড়িকে এটা বুঝিয়ে দেয় যে তোমাকে শুধুমাত্র কিছুক্ষণের জন্য উড়তে দেওয়া হয়েছিলো, সারাজীবনের জন্য নয়। ঘুড়ির মালিকের মর্জিমতো তুমি উড়েছো এখন তার মর্জিমতোই তোমাকে সুতার টানে ফিরিয়ে এনেছে সে।”
রুস্তম থামে, মতিন হা করে তাকিয়ে থাকে রুস্তমের দিকে। তবে কি রুস্তম ভাইয়ের অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে উৎসকে নিয়ে? থাকলে সেইটা কি?

“বুঝেছিস রে মতি পাগলা? অবশ্য তোর শরীরের মতো তোর মাথাটাও মোটা। এতোকিছু বুঝবি না তুই। সময় হলে সব বুঝিয়ে দিবো। এখন যা তো আমার সামনে থেকে। খোদার খাসির মতো শরীরটা নিয়ে যখন তখন চলে আসবি না।”
মতিন দাঁত বের করে হাসে। উৎসকে শাস্তি দেওয়া হবে ভাবতেই ভালো লাগছে। তাকে যেমনভাবে নাচিয়েছে, অপমান করেছে একইভাবে সে নাচাবে ফাজিলটাকে। কত্তবড় সাহস!

মতিন খুশিতে নাচতে নাচতে দরজার কাছ পর্যন্ত যেতেই আচমকা কারো ধাক্কায় ধপ করে মাটিতে পড়ে, আগন্তুক তার গায়ের উপর।
ধাতস্থ হয়ে চোখ মেলে তাকাতেই তার পিলে চমকে ওঠে। রুস্তম ভাইয়ের বোন লাভলী?

লাভলী রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,”ভাইজান এই মোটকাটা এখানে কি করছে? ওর কি চোখ নেই? দেখে হাঁটতে পারে না?”
মতিন অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায়৷
মুখে একটা তেলতেলে হাসি ফুটিয়ে মতিন বললো,”লাভলী আপা ভালো আছেন?”
লাভলী ভয়ংকর একটা দৃষ্টি ফেলে মতিনের দিকে। মনে হলো এটা যেনো কোনো মানুষের দৃষ্টি না, ডায়নোসর হা করেছে, এক্ষুনি আগুন ঝরবে।

রুস্তম বিরক্ত হয়ে বললো,”মতিন চোখে দেখিস না নাকি? সবসময় একটা অশান্তি বাঁধিয়েই চলেছিস।”
মতিন মাথা নিচু করে মিটমিট করে হেসে বললো,”লাভলী আপা আজ কিন্তু আপনারে জব্বর সুন্দর লাগছে, গোসল করছেন নাকি?”
“মতিনের বাচ্চা…..”
মতিন যেনো ছুটে পালায়। লাভলী রাগে কাঁপতে থাকে।

“আচ্ছা রাগ করিস না৷ বল কেনো এসেছিস? টাকা চাই? ড্রয়ারে আছে নিয়ে যা।”
লাভলী গটগট করে হেঁটে ভাইয়ের পাশে বসে। রাগে মুখ থমথম করছে তার।
“কি হয়েছে লাভলী? এমন দেখাচ্ছে তোকে কেনো?”
“ভাইজান এক অসভ্যকে তোমার খতম করতে হবে। নাহলে আমার শান্তি হচ্ছে না।”
রুস্তম অবাক হয়ে বললো,”তোকে বিরক্ত করেছে? প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে? নামটা শুধু বল একবার। জিন্দা কবর দিবো হারামজাদার। কতোবড় সাহস, ছোট রুস্তমের বোনকে কুপ্রস্তাব দেয়।”
“উফফ ভাইজান আগে আমাকে বলতে তো দাও।”
“বল।”
“আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি কেউ।”
“তাই বল! এতোদিন কাউকে দেখলাম না তোকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে, আজ হঠাৎ কে দিবে?”
লাভলী সরু চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”ফাজলামি করছো তুমি আমার সাথে?”
“না না বল।”
লাভলী নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে।
এরপর কাঁদো কাঁদো গলায় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”ভাইজান ওই অসভ্য আমাকে কাবলি বলেছে। আবার সেই কাবলি নাম দিয়ে কবিতাও বানিয়েছে।”
“বলিস কি রে? কবিতা?”
“হ্যা। আমার প্রেমিক নাকি আমাকে এই কবিতা শোনাবে।
ও আমার কাবলি,
আমারে থুয়ে তুই
কার প্রেমে ডুবলি?
আরে ও কাবলি,
আমার খেয়ে আমার পরে
কার কথা ভাবলি?
ভাবতে পারছো ভাইজান?”
রুস্তম ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে। চোখ এড়ায় না লাভলীর। সে রাগে যেনো লাল হয়ে ওঠে।
“ভাইজান তুমি হাসছো? এক ঘর লোকের সামনে বদমাশটা আমাকে এতো বাজে কবিতা শোনালো, আমাকে অপমান করলো। আর তুমি হাসছো এটা শুনে?”
“কোথায় হাসছি? আসলেই তো, বদমাশটার কি সাহস। ওকে দেখছি আমি, নাম পরিচয় বল। বেটার হচ্ছে আজকে।”
লাভলীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
“অসভ্যটার নাম উৎস, উৎস শাহরিয়ার। আমাদের কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী শীতলের ফুপাতো ভাই।”
মুখ ঝুলে যায় রুস্তমের।
“ও ভাইজান শুনেছো কি বলছি?”
রুস্তম হা করে তাকিয়ে থাকে লাভলীর দিকে।
“ভাইজান শীতলকে আমি বলে দিয়েছি যে আমার ভাই এই এলাকার ত্রাস ছোট রুস্তম। আমার কাছে যদি ফাজিলটা ক্ষমা না চায়, তুমি ওকে উচিত শিক্ষা দিবে বলো? ওর দাঁত ভেঙে দিবে তুমি।”
“দাঁত ভেঙে দিবো?”
“হ্যা। সেই সাথে ওকে অপমানও করবে তুমি, আমাকে যেভাবে করেছে ও।”
“কি অপমান করবো?”
লাভলী কিছুক্ষণ ভেবে বললো,”ওকে নাচাবে তুমি একঘর লোকের সামনে। লাল ওড়না পরিয়ে নাচাবে।”
চাপা আর্তনাদ করে ওঠে রুস্তম। ওইদিনের পর থেকে লাল রঙ দেখলে তার বুক কেঁপে ওঠে। সেই ভয়ংকর স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। যে স্বপ্নে সে লাল ওড়না ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচছে আর গান গেয়ে যাচ্ছে, ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মলমল, মেরা লাল দুপাট্টা মলমল।’

“ভাইজান ও ভাইজান। নাচাবে তো তুমি বলো ওকে?”
রুস্তম জোর করে হাসার চেষ্টা করে। লাভলী খুশি হয়ে ভাইকে বিদায় জানিয়ে একরকম লাফাতে লাফাতে চলে যায় ঘর ছেড়ে।

রুস্তম তাকায় করলার রসের গ্লাসের দিকে। গা গুলিয়ে ওঠে তার।
“উৎসরে তুই কি আমারে মরেও শান্তি দিবি না রে? এখানেও তুই? আর কোথায় গেলে তুই মুক্তি দিবি তুই আমারে?”
মাথায় হাত দিয়ে রুস্তম বসে থাকে।

অন্যদিনের মতো প্রফুল্লতা দেখা যাচ্ছে না আজ উৎসের, মেজাজটাও ফুরফুরে নেই। শীতলে পাশাপাশি হাঁটছে আর ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে উৎসের দিকে। একটা কথাও এখনো বলেনি সে।

“উৎস ভাই।”
উৎস জবাব দেয়না।
“কিছু বলছি তো।”
উৎস থমথমে গলায় বললো,”বলো।”
“আপনার কি মন খারাপ?”
“তোমার কেনো মনে হচ্ছে আমার মন খারাপ?”
“এইযে এতোক্ষণ ধরে হাঁটছি আমরা আপনি একটা কথাও বলছেন না আমার সাথে।”
“প্রয়োজন মনে করছি না বলার, তাই বলিনি। প্রয়োজন হলে বলবো।”
শীতল মুখ ভোঁতা করে হাঁটতে থাকে।

“আচ্ছা শীতল একটা কথা বলবে?”
“বলুন।”
“তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করোনা?”
“আমরা মানে?”
“তোমরা মানে তোমরা তিন বোন বা পরিবারের আর কেউ।”
“হঠাৎ এমন কথা বলছেন কেনো?”
“তোমাদের কারো কোনো বিপদ হলে আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না? আমার সেই ক্ষমতা নেই?”
শীতল দাঁড়িয়ে পড়ে।
“এগুলো বলছেন কেনো? কে বিপদে পড়েছে?”
উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”কিছু না, চলো।”
শীতল ইতস্তত করতে থাকে, সে বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে উৎসের৷ সে স্বীকার করছে না। রাতে বড় আপা গিয়েছিলো ছাদে। তার সাথে এমন কোনো কথা হয়েছে? কিছুই মাথায় ঢোকে না তার। বাকি রাস্তা উৎস আর একটা কথাও বলেনা। চুপচাপ হাঁটতে থাকে। নীরবতা অসহ্য লাগে শীতলের।

মাসের শুরুতে কোনো এক রাতে নওশাদ নিজে ভালো ভালো বাজার করে আবার নিজেই রান্না করে। উঠোনের মাঝে চুলা বানানো হয়। মেয়েদের তার চারপাশে গোল হয়ে বসে থাকা বাধ্যতামূলক। সেসব রান্না কোনোদিনই তেমন ভালো হয়না। কোনোদিন লবণে পোড়া হয়, কোনো অর্ধেক সিদ্ধ। তবুও নওশাদের উৎসাহে ভাটা পড়েনা। সে করবেই এটা। শাহানা আর সায়েরাকে কিচ্ছু করতে দেওয়া হয়না। তারা মুখ ভোঁতা করে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
তবে মেয়েরা এসব ক্ষেত্রে বাবাকে উৎসাহ দিয়ে যায়। বাবা যা-ই রান্না করে, তাই সোনামুখ করে খেয়ে নেয়। মুখটা এমন করে রাখে যেনো অমৃত খাচ্ছে। এমন মজার খাবার খায়নি তারা কখনো।
মেয়েগুলো খুশিতে হাসাহাসি করে, নওশাদের বড় আনন্দ হয়। মধ্যবিত্তের সংসার, আহামরি কিছু দিতে পারেনা মেয়েদের। এতোটুকু আনন্দ দিতে ক্ষতি কি?

তবে আজ বহ্নির মুখটা অন্ধকার। নওশাদ খেয়াল করেছে অনেকক্ষণ। কিছু বলছে না। অন্যদিন মেয়েটা কতো হাসাহাসি করে, বাবাকে মজা করে বলে, বাবা আজ খাওয়া যাবে তো? নাকি আমাদের পেটে পাথর বেঁধে ঘুমাতে হবে? নওশাদ হাসে সেসব শুনে।
তবে আজ সে একদম চুপ। একদৃষ্টিতে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। উৎসও আসেনি আজ নিচে। সন্ধ্যায় ফেরার পর থেকে নিজের ঘরে বসে আছে, তার নাকি ভীষণ মাথা যন্ত্রণা করছে।

“শীতল।”
“বলো বাবা।”
“রান্নাটা একটু দেখ তো, আমি আসছি।”
শীতল খুন্তিটা যেয়ে ধরে।
নওশাদ বহ্নির দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করে ঘরে আসার জন্য। বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার পিছু পিছু উঠে যায়।

“বহ্নি, মা আমার।”
“বলো বাবা।”
“তোর কি কিছু হয়েছে?”
বহ্নি কিছুটা চমকে ওঠে। জোর করে হেসে বলে,”বাবা কি বলছো? আমার আবার কি হবে?”
নওশাদ মেয়ের মাথায় হাত রাখে।
“বাবার চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না।”
“আমি কারো চোখ ফাঁকি দিচ্ছি না বাবা। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। খুব ঘুম পায় ইদানীং। শরীর দূর্বল লাগে। এজন্যই মনে হয়….”
আঁৎকে ওঠে নওশাদ।

“তার মানে? কি হয়েছে তোর? ডাক্তার দেখাতে হবে তো।”
“কোনো ডাক্তার লাগবে না বাবা। তুমি-ই আমার ডাক্তার। তুমি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও। তোমার কোলে একটু শুই। তাহলেই আমি সুস্থ হয়ে যাবো।”
নওশাদ ম্লান হাসে। খাটে যেয়ে বসে। বহ্নি মুচকি হেসে বাবার কোলে মাথা রাখে। নওশাদ পরম যত্নে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
সে টের পায় উষ্ণ পানি পড়ছে বহ্নির চোখ দিয়ে। একরাশ বিষন্নতা ছুঁয়ে যায় তাকে। মেয়েটা কবে মানসিকভাবে সুস্থ হবে? মেয়েটাকে এভাবে দেখতে যে মোটেই ভালো লাগছে না তার।

উৎস খেতে বসেছে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে তার, চুলগুলো রুক্ষ হয়ে উড়ছে। শীতলের মনটা খারাপ হয়ে যায় তাকে দেখে। কি হয়েছে মানুষটার? এমন করছে কেনো সে? মাথাব্যথা কি খুব বেশি?
“উৎস তোকে আরেকটু দিই?”
“না মামা আর খাবো না।”
“কিছুই তো নিলি না, শরীর কি খুব বেশি খারাপ?”
“না আমি ঠিক আছি।”
কথাটা বলে প্লেটেই হাত ধুয়ে ফেলে উৎস। চলে যায় নিজের ঘরে। বহ্নি সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। শীতলও আর খেতে পারেনা। কোনোরকমে কয়টা খেয়ে নিজেও উঠে যায়। আজকের রাতটা সেভাবে জমে না অন্যদিনের মতো। মনটা খারাপ হয়ে যায় নওশাদের। ছেলেমেয়েগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। চাইলেও তাদের নাগাল পাওয়া যায়না। একেকজন একেকরকম। আগের মতো আর কিছুই নেই। নওশাদও তেমন কিছু খেতে পারেনা।

“উৎস ভাই।”
ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিলো উৎস। দূর থেকে একটা সুক্ষ্ম আলো ঢুকেছে ঘরে। আলো বলতে অতোটুকুই।
মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে উৎস তাকায়। হালকা আলোয় দেখতে পায় শীতলের সরু কায়াটা।

“এসো।”
শীতল আস্তে আস্তে ঘরে ঢোকে, ঘরের মেঝে অসম্ভব ঠান্ডা। শীতলের কেমন অস্থির লাগে।

“কেনো এসেছো?”
“মাথাব্যথার ওষুধ এনেছি আপনার জন্য, আর এই মলমটা। এটা দিয়ে মাথা টিপে দিলে আরাম পাবেন।”
“কে টিপে দিবে?”
শীতল অপ্রস্তুত বোধ করে।

“রেখে যাও, আমি নিয়ে নিবো।”
শীতল যায়না, দাঁড়িয়ে থাকে ওভাবেই।
“তুমি দিতে চাও?”
শীতল মাথা নাড়ে।
“তাহলে কাছে এসো।”
“লাইট জ্বেলে দিই?”
“কেনো অন্ধকারে ভয় পাও আমার কাছে আসতে?”
শীতল আবার মাথা নাড়ে।
উৎস শব্দ করে হেসে দেয়।
“হাসছেন যে?”
“এমনিতেই হাসছি। খুব যে কাল বলছিলে আমি সবাইকে শাসন করলেও নাকি তুমি আমাকে শাসন করো। এদিকে তুমি তো কাছে আসতেই ভয় পাচ্ছো।”
শীতল কিছুটা ইতস্তত করে পা টিপে টিপে উৎসের খাটের কাছে যেয়ে দাঁড়ায়।
শীতল পাশে বসে। উৎস অবাক হয়ে যায়। শীতলের নামটা কে রেখেছিলো? সে কীভাবে জানতে পেরেছিলো মেয়েটা সত্যিই এমন শীতল হবে। সে পাশে থাকলে সবকিছু যেনো শীতল হয়ে যায়। মন, প্রাণ, দেহ সব। মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে তার শরীর থেকে। কিসের? মেয়েটা চুলে তেল দিয়েছে, হতে পারে তেলের গন্ধ। আবার হতে পারে ওর নিজস্ব গন্ধ। উৎসের মাতাল মাতাল লাগে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে সে।
শীতলের চুড়ির টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যায়। মেলোডির মতো শোনায় উৎসের কাছে। শখের নারীর বোধহয় সম্মোহনী শক্তি থাকে। মাথা যন্ত্রণাটা অনেক কম মনে হয় তার এখনই।

ঠান্ডা কোমল একটা স্পর্শে শরীর শিরশির করে ওঠে উৎসের। আলতো করে শীতল তার কপালে ওষুধ দিয়ে টিপে দিচ্ছে। নেশাক্ত চোখে শীতলের দিকে তাকায় সে। সামনের চুলগুলো অবাধ্য হয়ে ঝুঁকে পড়ছে। ঈষৎ আলোয় কি ভীষণ মায়াবতী লাগছে তাকে।

“শীতল।”
“বলুন।”
“তুমি আফ্রোদিতিকে চিনো? গ্রীক দেবী আফ্রোদিতি। গ্রীক পুরাণে যার রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। যাকে তারা সৌন্দর্যের দেবী নামে জানে।”
“না চিনিনা।”
“আফ্রোস অর্থ সমুদ্রের ফেনা। আফ্রোদিতি মানে সমুদ্রের ফেনার মতো সুন্দরী নারী। তোমাকে মাঝে মাঝে গ্রীক দেবী আফ্রোদিতি বলে মনে হয় আমার। তুমি এতো সুন্দর কেনো শীতল?”
শীতল কেঁপে ওঠে। উঠে দাঁড়ায় সাথে সাথে।
“আমি আসছি উৎস ভাই। আপনি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন, ব্যথা চলে যাবে।”
“তুমি ভয় পাচ্ছো শীতল? তুমি আমাকে কাপুরষ ভাবছো?”
“কি বলছেন, তা কেনো ভাববো?”
উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”যাও, আর কখনো আমার ঘরে এসোনা।”
শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“কি হলো? কিছু বলবে?”
“কখনোই আসবো না?”
উৎস উঠে বসে, দেয়াকে বালিশ চেপে তাতে হেলান দিয়ে বসে সে। ঠোঁট কামড়ে শীতলের দিকে তাকায়।

“আসবে, তবে ঘরটা যেদিন আমার নিজের বানানো হবে আর তুমি সেই ঘরে রানীর মতো চলতে পারবে সেদিন আসবে।”
শীতল গাঢ় গলায় বললো,”তার আগে আসলে কি হবে?”
“আমার যে তোমাকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছা করবে।”
“এইযে বললেন আপনি কাপুরষ না, তাহলে?”
“সুপুরুষের মতো আদর করবো তাহলে।”
শীতল দুই হাতে মুখ ঢেকে ছুটে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। দরজার পাশে রাখা একটা স্টীলের জগ তার পায়ে লেগে মেঝেতে পড়তে ঝনঝন করে শব্দ হয়। উৎস হাসে, শীতল কোনোদিকে আর না তাকিয়ে একদম প্রজাপতির মতো ভাসতে ভাসতে চলে যায়।

হঠাৎ সিঁড়ির মুখে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় শীতল। কেউ একজন জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে ঠাওর করতে পারেনা সে। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। শুকনো গলা কাঠ হয়ে যেনো আটকে আছে ভিতরে।

“উপরে কেনো গিয়েছিলি শীতল?”
“মা……?”

(চলবে……)

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ২৫

শীতলের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় শাহানা। রাতে ঘুমানোর আগে শাহানা দেখে পানি নেই জগে। পানির জন্য উঠে দেখে সিঁড়ির দরজা খোলা। সন্দেহ হয় শাহানার। দৌড়ে যায় মেয়েদের ঘরে প্রথমে। সায়েরার পা ব্যথা, সে নিশ্চয়ই এতো রাতে ছেলের ঘরে যাবে না। মেয়েদের মধ্যে কেউ গেছে উপরে। যেয়ে দেখে বহ্নি আর আভা দুইজনই ঘুম, শুধু শীতল নেই। তখন থেকেই সিঁড়ির গোড়ায় অপেক্ষা করছিলো সে।

“তুই উপরে গিয়েছিলি?”
শীতল শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। মা আজ চিৎকার করছে না, বকা দিয়ে কথা বলছে না। তা-ও তার কণ্ঠ শুনে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তার। মা কি ভুল বুঝবে? বাবা আর ফুপুকে জানাবে? লজ্জায় আর দাঁড়াতে পারবে কোনোদিন তাদের সামনে সে? কিন্তু সে তো কোনো অন্যায় করেনি।

“উৎসের ঘরে গিয়েছিলি তুই?”
শীতল চমকে উঠে মায়ের দিকে তাকায়, তার মুখ রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে যায়।

“কি রে শীতল, চুপ করে আছিস কেনো? মা’কে বল আমি পাঠিয়েছি তোকে উৎসের ঘরে।”
বহ্নির কথায় শাহানা আর শীতল দুইজনই অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। নির্লিপ্ত মুখে বহ্নি দাঁড়িয়ে আছে ঘুমভাঙা চোখে।

“আপা….”
বহ্নি মায়ের কাছে এগিয়ে এসে হাই তোলে।
“রাত-বিরেতে কি শুরু করলে মা? আমি শীতলকে পাঠিয়েছিলাম উৎসের ঘরে। আমি-ই যেতাম, আমার মাথাটা এতো ধরেছে। তাই ওকে বললাম যেতে।”
“তুই বলেছিস? কেনো? ওখানে কি কাজ?”
“আর বলোনা মা, দেখলে না উৎস খেতে পারলো না ঠিকমতো। ওরও তো মাথাটা ধরেছে। দুই ভাইবোনের একসাথেই হলো। তাই মলম আর ওষুধ পাঠালাম শীতলের হাতে। তুমিও না….”
শাহানা থমথমে গলায় বললো,”এতো রাতে ওকে পাঠানোর কি দরকার ছিলো? আমাকে বললেই হতো। ঢং যতোসব।”
শাহানা রাগে গজগজ কর‍তে করতে ঘরে চলে যায়।

শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। বহ্নি তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় তার দিকে।
“শীতল মাথা নিচু করে রাখে যাদের মনে পাপ আছে। আমি তোদের দুইজনকে বিশ্বাস করি, তোরা কেউ অন্যায় করতে পারিস না। তাহলে মাথা নিচু করে আছিস কেনো?”
শীতল আচমকে ছুটে এসে বহ্নির বুকে মাথা রেখে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বহ্নির ভিতরটা যেনো ঠান্ডা হয়ে যায়। সে পরম মমতায় নিজের হাতটা শীতলের মাথায় রাখে।

“আপা বিশ্বাস করো, আমি শুধু উনাকে ওষুধ দিতে গিয়েছিলাম। আর কিচ্ছু না। উনি কষ্ট পাচ্ছিলেন, দেখে আমার একটুও ভালো লাগছিলো না।”
“হয়েছে হয়েছে। এখন দয়া করে কান্নাকাটি শুরু করিস না। বাবা জেগে গেলে সর্বনাশ। একশটা প্রশ্ন করবে তার আদরের কন্যার চোখে পানি দেখে।”
হাসবে না হাসবে না করেও শীতল ফিক করে হেসে দেয়।
বহ্নি অবাক হয়ে শীতলের দিকে তাকায়। কি সুন্দর নিষ্পাপ একটা মুখ মেয়েটার। ভীষণ বোকা, খুব আবেগী আর অদ্ভুত রকম সহজ সরল। খুব ভালো হবে যদি কোনো বাঁধা ছাড়া উৎস ওকে নিজের করে নিতে পারে। উৎস ছাড়া কেউ মেয়েটাকে বুঝবে না। উৎস বুঝেছে, এজন্যই সে জানে শীতল পৃথিবীর শুদ্ধতম নারীর মধ্যে একজন। যার মনে কোনো প্যাঁচ নেই, কুটিলতা নেই। দুনিয়ার এতো জটিলতা সে বোঝে না। বহ্নির বুক কেঁপে ওঠে সহসাই। সে তো বুদ্ধিমতী, যে বুদ্ধির অহংকার করে বাবা-ও। তার বড় মেয়েদের ক্ষুরধার বুদ্ধি। কিন্তু সে কি করলো জীবনে? একটা ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে নিজের সর্বস্ব ধ্বংস করে দিলো। শীতল বা আভার সাথে এমন কিছু হবে না তো?
কান্নাজড়িত চোখে বহ্নি তাকায় শীতলের দিকে। মেয়েটা মাথা নিচু করে কুটকুট করে হেসেই যাচ্ছে। এতোটা নিষ্পাপ লাগছে কেনো তাকে? বহ্নি আবারও বোনের মাথাটা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে। ইশ! যদি এভাবেই রাখতে পারতো সারাজীবন, কোথাও যেতে দিতো না বুকটা ছেড়ে। আহা রে, এতো মায়া লাগে ক্যান? এই দুনিয়া এতো মায়ায় ভরা ক্যান?

“ভাই।”
“উৎস ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, আজাদ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। তার চোখমুখ কিছুটা উজ্জ্বল, মনে হচ্ছে সে কিছুটা উত্তেজিত।
উৎস সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়।

আড্ডার মধ্য থেকে বেরিয়ে পড়ে উৎস আজাদের কাঁধে হাত দিয়ে। আবির কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়। কি এমন গোপন কথা উৎসের আজাদের সাথে? সবার মধ্য থেকে চলে গেলো কেনো?

“আজাদ কি অবস্থা? তোকে এমন লাগছে কেনো?”
“সজীবের খোঁজ পেয়েছি ভাই।”
উৎস চোখ বড় বড় করে বললো,”এতো তাড়াতাড়ি? নিশ্চিত তুই?”
“নিশ্চিত মানে? হান্ড্রেড পার্সেন্ট। শুধু সজীব না, ওর চৌদ্দ গুষ্টির খোঁজ নিয়ে এসেছি। শিল্পপতির ছেলে, ভীষণ বড়লোক। অস্ট্রেলিয়া গেছে বছর খানিক আগে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে।”
উৎস আজাদের বাহু চেপে ধরে বললো,”সাবাশ আজাদ, ঠিক মানুষের সন্ধান পেয়েছিস। কবে ফিরবে জানিস?”
“দারোয়ানটা বলতে চাচ্ছিলোনা।”
“জানা গেলো না তাহলে?”
আজাদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,”কি যে বলেন ভাই, আজাদরে আপনি চিনেন না? আপনি একজনের খোঁজ চেয়েছেন আর আমি অর্ধেক খোঁজ নিয়ে চলে আসবো? দারোয়ানটাকে কিছু ঘুষ দিতেই গড়গড় করে সব বলে দিলো। বেটা আসবে সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে। এসেই বিয়ে করবে। মেয়েও দেখা হয়েছে নাকি। বাপের বিজনের পার্টনারের মেয়ে, বড়লোকের একমাত্র দুলালী বিয়ে করবে শালা।”
উৎস হাসে নিঃশব্দে, আজাদের পিঠ চাপড়ে দেয়।

“ভাই কি করতে হবে শুধু বলেন। শুধু অর্ডার দিবেন, দেখবেন হারামির বাচ্চার কলিজা ছিঁড়ে আপনার হাতে এনে দিবো। বিয়ে করার শখ আজীবনের জন্য মিটিয়ে দিবো। ডাইরেক্ট কবরে, বিয়ে আর ওর কপালে নেই।”
উৎস আজাদকে ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। দুই হাত পিছনে বেঁধে দাঁড়ায়।

“ভাই…”
“না রে, প্রাণে ওরে মারবো না আমি। মরলে তো মরেই গেলো। এই দুনিয়ায় থেকে ও নরকের আগুনে জ্বলবে, তিলে তিলে শেষ হবে। সেই ব্যবস্থা করবো আমি।”
আজাদ মাথা চুলকে বললো,”বিয়ের আগেই তাহলে করতে হবে যা করার।”
“উহু বিয়ে করবে, বিয়ে ওকে করতে দিতে হবে। বিয়ের রাতে বউয়ের কাছে যাওয়ার আগেই যা করার করে ফেলবো। আদর সোহাগ করার সুযোগ ওকে দেওয়া যাবে না।”
আজাদ অবাক হয়ে বললো,”ভাই কি করতে চাচ্ছেন আসলে?”
উৎস পকেট থেকে সিগারেট বের করে৷ আজাদকে একটা দিয়ে নিজেও ধরায়। তার ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। আজাদ বুঝতে পারে উৎস ভয়ানক কোনো পরিকল্পনা করছে। মনে মনে সজীব বেচারার জন্য মায়া লাগে আজাদের। ‘আহা রে! তুই তো বেটা গেলি। কার নজরে পড়ছিস নিজেও জানিস না।’

“ডাক্তার আকবরকে বলে রাখবি আগে থেকে, আমাদের রোগী যাবে একটা। বিদেশী রোগী, অস্ট্রেলিয়ান মাল। একটু যেনো ঠিকমতো কাজবাজ করে দেয়।”
আজাদ লাফ দিয়ে উৎসের সামনে আসে।

“তার মানে ভাই, আমি যা ভাবছি তাই?”
উৎস উত্তর না দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।
আজাদ বেশি উত্তেজিত হলে লাফালাফি করে, দারুণ মজা পাচ্ছে সে।

“কাইটা দিতে হইবো রে বেটা, পরাণ পাখি কাইটা দিলে বাঁইচা থাইকাও মইরা যাইবো। কথা বোঝা গেছে না?”
আজাদ দাঁত বের করে হেসে বললো,”বোঝা গেছে ভাই, বোঝা গেছে।”
উৎস গুণগুণ করে গান গেয়ে ওঠে।

“ছোট পাখি ছোট পাখি, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
আজাদও গলা মেলায়, দুইজন খুব হাসে কিছুক্ষণ।

কিছুক্ষণ পর আজাদ ক্ষীণ গলায় বললো,”ভাই অভয় দিলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
উৎস গম্ভীর গলায় বললো,”আমি জানি তুই কি জিজ্ঞেস করবি। তবে সেই উত্তর আমি দিবো না। সজীবকে কেনো আমি শাস্তি দিতে চাই, এর উত্তর আমি কাউকে দিবো না। আর কেউ যেনো জিজ্ঞেস না করে।”
আজাদ মাথা কাৎ করে বললো,”কেউ জিজ্ঞেস করবে না ভাই। আপনি নিশ্চিত থাকেন।”
উৎস আনমনে ধোঁয়া ছাড়ে আর মনে মনে বলে,’তোর সম্মান নষ্ট হয় এমন কিছুই আমি করবো না বহ্নি। তুই কি জানিস আমি নিজের জীবনের চেয়েও তোদের বেশি ভালোবাসি? আমার জীবন থাকতে তোর অসম্মান হতে দিবো না। তুই তাজা রক্ত চেয়েছিলি না? এনে দিবো। শু’য়োরের বাচ্চার শরীরের যেখানের রক্ত চাস, তাই এনে দিবো। তুই অপবিত্র না বহ্নি, ওই কুত্তার বাচ্চা অপবিত্র। ওরে আমি দুনিয়ায় নরক দেখাবো। এটা তোর উৎস বাবুর প্রতিজ্ঞা তোর কাছে, দেখাবোই।’

“ফুপু আসি?”
সায়েরা নিজের ঘরে কাপড় গোছাচ্ছিলো। শীতলের গলা পেয়ে মুচকি হাসে। এই মেয়েটাকে কাছে পেলে তার মন অকারণে ভালো হয়ে যায়। মেয়েটা এতো মিষ্টি, এতো মায়াবী। শুধু আদর করতে ইচ্ছা করে। গায়ে পায়েই বড় হয়েছে শুধু, বুদ্ধিটা সেই ছোট বাচ্চাদের মতোই থেকে গেছে।

“আয় মা, কাছে আয়। আমার ঘরে ঢুকতে আবার অনুমতি লাগে নাকি?”
শীতল দৌড়ে এসে সায়েরাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। সায়েরা জানে শীতল এটা করবেই, সবসময় এমন করে ও।

“আজ মনে হচ্ছে আমার মা’টার মন ভালো?”
“আমার মন সবসময় ভালো থাকে ফুপু। তোমরা বলো না আমি বোকা? বোকাই ঠিক আছি। বেশি চালাক হলে মন খারাপ হয়। দেখো না৷ আপাকে? আজকাল কেমন মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়ায়।”
সায়েরা কিছুটা দমে যায়। আসলেই বহ্নিকে আজকাল কেমন যেনো দেখায়। বছর খানিক আগে একবার এমন হয়েছিলো। বেশ কিছুদিন যাবৎ কেমন একটা হয়ে গিয়েছিলো। খেতো না, কারো সাথে কথা বলতো না, বাইরে যেতো না। সবাই কতো দুশ্চিন্তা করতো। হঠাৎ করেই সব ঠিক, সেই প্রফুল্লতা, ছোটাছুটি, হাসাহাসি। কিছুটা অস্বাভাবিক লাগলেও কেউ কিছু আর ভাবেনি। মেয়েটা হাসছে এটাই যথেষ্ট। কিন্তু আবার যে কি হলো। মেয়েগুলোকে মনমরা দেখতে মোটেই ভালো লাগেনা। শেষ জীবনে আর তো কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই। চারটা ছেলেমেয়ের মুখে হাসি দেখা ছাড়া আর কি চায় সে?

“আচ্ছা ফুপু তোমার গায়ে এটা কিসের গন্ধ পাই সবসময়?”
“ওই হবে তেলমশলার, আবার কি?”
“না না, তেলমশলার না। কেমন যেনো অন্যরকম। মা মা গন্ধ।”
সায়েরার চোখে হঠাৎ পানি চলে আসে। এই মেয়েটা এতো মায়া করে কথা বলে কেনো? হুটহাট অপ্রস্তুত হয়ে যেতে হয়।

“কেনো রে? তোর মায়ের গায়ে নেই?”
“হ্যা মায়ের গায়েও আছে সুন্দর গন্ধ। তবে তোমারটা আলাদা। দুইজনেরটা দুইরকম মিষ্টি। আচ্ছা ফুপু আমার গায়ে কি গন্ধ আছে কোনো?”
“আছে তো, তুই যেমন আমার আর তোর মায়ের গায়ে গন্ধটা পাস ঠিক তেমনই তুই যখন মা হবি তোর সন্তানেরাও তোর গায়ে এমন গন্ধ পাবে। একদম মিষ্টি মা মা গন্ধ।”
লজ্জায় শীতলের মুখ গাঢ় লাল হয়ে ওঠে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ফুপুটা যে কি! কিসব বলে। সে আবার কবে মা হবে?

সায়েরা মুখ টিপে হেসে শীতলের থুতনি উঁচু করে।

“হ্যা রে, কাউকে পছন্দ করেছিস নাকি? মনে ধরেছে কাউকে?”
শীতল ভেবাচেকা খেয়ে বললো,”কি বলো ফুপু এসব? একদম না, কখনো না।”
সায়েরা শব্দ করে হাসে, শীতল আরো গুটিয়ে যায় নিজের মধ্যে।
“আরে এই তো প্রেম করার বয়স। আমিও তো এই বয়সেই তোর ফুপার প্রেমে পড়েছিলাম। আমাকে টিউশন পড়াতে আসতো। বইখাতা দেওয়া নেওয়া থেকে কখন মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেলো, টেরই পেলাম না আমরা। তবে তুই কিন্তু আমার মতো ভুল করিস না। আমি পড়াশোনাটা শেষ করলাম না, বিয়ে করে নিলাম। তুই কিন্তু ঠিকমতো পড়াশোনা করবি। তোর বাবার অনেক স্বপ্ন রে তোদের নিয়ে।”
শীতল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”আচ্ছা ফুপু, তুমি প্রথম কীভাবে বুঝেছিলে যে তুমি ফুপাজানের প্রেমে পড়েছো? মানে কেমন লাগতো তোমার ওই সময়ে, কেমন অনুভূতি হতো?”
সায়েরা লজ্জায় হাসতে হাসতে কাপড় গোছাতে থাকে।
শীতল অসহিষ্ণু হয়ে আবার বললো,”ও ফুপু বলোনা, কীভাবে বুঝলে তুমি?”
“বোকা মেয়ে, ওভাবে কি বোঝার কোনো যন্ত্র আছে নাকি? দেখতাম ওকে একদিন না দেখলে বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতো, কিছু খেতে ইচ্ছা করতো না, ঘুম আসতো না, ওকে একবার দেখলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতো।”
শীতল সায়েরার কথা শুনতে শুনতে ভাবুক হয়ে যায়। আসলেই তো, তার অনুভূতিও তো একই। সে যে আষ্টেপৃষ্টে উৎস ভাইয়ের প্রেমে জড়িয়ে গেছে এ কথা কি তার মা জানে? সে যেভাবে ভালোবেসেছিলো, সে যেভাবে গভীরভাবে প্রেমে পড়েছিলো মানুষটার, কেউ একজন তার ছেলের প্রেমেও এভাবে পড়েছে। এ কথা কি ফুপু জানে?

“এই তোর আবার কি হলো?”
শীতল ধাতস্থ হয়ে বললো,”কিছু না ফুপু, কিছু না।”
সায়েরা শীতলের মুখে আলতো করে হাত রাখে। শীতল ঈষৎ কেঁপে ওঠে।

“মা রে, কাউকে ভালোবাসলে সবটা উজাড় করে ভালোবাসবি। কিন্তু আগে নিশ্চিত হয়ে নিবি মানুষটা তোর জন্য সঠিক কিনা। তার পক্ষ থেকেও যদি অনুভূতি একই হয় তবে আর কোনো ভয় নেই। নিজেকে আয়নার মতো মেলে ধরবি তার সামনে। তোর ভিতরের সবটা যেনো সে পড়ে নিতে পারে। মনে করবি দুইজনের দুইজন ছাড়া আর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। নিখাঁদ ভালোবাসা সবাই পায়না, যদি কখনো পাস হেলাফেলা করিস না। মেয়েদের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা অদ্ভুত মায়া দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে। সেই মায়া দিয়ে ওরা সব করতে পারে, পাষাণের হৃদয়কেও গলিয়ে ফেলতে পারে। কথা দে আমাকে, যদি কাউকে ভালোবেসে থাকিস তাকে ভালোবাসতে একটুও কার্পণ্য করবি না।”
শীতল কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”করবো না ফুপু, করবো না।”

মা’কে কিছু বলতে উৎস এসেছিলো মায়ের ঘরে। দরজার কাছে আসতেই বুঝতে পারে শীতল আছে ঘরে। লুকিয়ে পড়ে সে পর্দার পিছনে। একদৃষ্টিতে তাকায় সে শীতলের দিকে। মেয়েটা আজ হঠাৎ শাড়ি পরেছে কেনো? এতো সুন্দর লাগছে তাকে, নিজেকে সামলানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে অনেক অনেক দূরে চলে যেতে মেয়েটাকে নিয়ে। যেখানে কেউ বাঁধা দিবে না তাদের ভালোবাসায়। হঠাৎ করেই এই ভুলেভরা ছন্নছাড়া জীবনটার উপর বিতৃষ্ণা জন্মে তার। কেনো এসবে জড়ালো সে? কেনো সে চাইলেও নিজের জীবনটা আগের মতো গুছিয়ে নিতে পারছে না? চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। ঝাপসা চোখের ওপাশে তার খুব শখের দুইজন নারী হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে পড়ছে। ইশ, ওদের আনন্দে যদি সে-ও ভাগ বসাতে পারতো!

একগাদা তেলে ভাজা নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে নওশাদ। উদ্দেশ্য ছেলেমেয়েগুলোকে একসাথে নিয়ে আজ মজা করা। ওদের মুখে হাসি দেখার জন্য মনটা ছটফট করে সবসময়।
শীতল চা করেছে সবার জন্য, সায়েরা মুড়ি মেখেছে। বারান্দায় সবাই গোল হয়ে বসেছে। উৎস আসেনি, ওর এসব নাকি ভালো লাগেনা।

নওশাদ নিজেই যায় উৎসকে ডাকতে। উৎস ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। নওশাদ ঘরের আলো জ্বেলে দিতেই উৎস ধড়ফড় করে উঠে বসে।

“মামা আপনি?”
নওশাদ বসে উৎসের পাশে।
“কি হয়েছে বাবা? তোকে এমন লাগছে কেনো? সব ঠিক আছে?”
উৎস হাসির চেষ্টা করে, ঠিক হাসতে পারেনা। ওকে কেমন অস্থির দেখায়। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। কথাও কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে।
নওশাদ উৎসের কাঁধে হাত রাখতেই কিছুটা চমকে ওঠে সে। নওশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এতোটা অস্বাভাবিক হওয়ার কি আছে নওশার বুঝতে পারেনা।

“উৎস কি হয়েছে তোর? ক্যাম্পাসে কোনো ঝামেলা নয় তো?”
“না না মামা, কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি তো।”
“অবেলায় শুয়ে আছিস কেনো? আর বিকেলে নাকি বাড়িতে ছিলি না তুই, একটু আগে বাড়ি ফিরেছিস। তোর মামি বললো। কোথায় গিয়েছিলি?”
উৎস স্তম্ভিত হয়ে তাকায় নওশাদের দিকে। নওশাদ দেখে উৎসের চোখমুখ কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। ঘোলাটে দৃষ্টি চোখের। নওশাদের ভয় লাগে, ছেলেটা কোনো বিপদে জড়ালো নাকি?

“নিচে চল, সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
“মামা আমি একটু ঘুমাবো। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, আমি একটু ঘুমাতে চাই।”
নওশাদ দিশেহারা হয়ে যায়, ছেলেটাকে এমন ভেঙে পড়তে তো কোনোদিন দেখেনি সে।

আচমকাই নিচে মেয়েদের আর্তনাদে চমকে ওঠে নওশাদ, উৎসের চোখমুখও কেমন হয়ে যায়। সায়েরার চিৎকার, পুলিশের গাড়ির শব্দ। নওশাদের বুকের বাঁ পাশটা কেমন ব্যথা করে ওঠে।

ধুপধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে কেউ উপরে উঠছে। নওশাদ কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ায়, উৎস তার হাত ধরে। সে যথেষ্ট শান্ত হয়ে আছে এখন।

বহ্নি হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢোকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ঝড় বয়ে গেছে তার উপর দিয়ে।

“বাবা একটু নিচে চলো তো, ওরা কিসব বলছে।”
নওশাদ ভাঙা গলায় বললো,”কি হয়েছে মা? কি হয়েছে আমাকে বল।”
“তুমি আগে নিচে চলো।”
উৎসই এগিয়ে আসে আগে।
“আমি যাচ্ছি, চল।”
বহ্নি উৎসের দিকে কঠিন চোখে তাকায়।

“তুই কোথাও যাবি না, এখানেই থাক। আমি বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি। তোকে কোথাও যেতে দিবো না আমি।”
“আমাকে যেতে দে বহ্নি, আমাকে দেখতে হবে।”
“উৎস….”
“না বহ্নি, তুই সামনে থেকে সরে যা।”
নওশাদের শরীর থেকে যেনো সব শক্তি চলে গেছে। ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়ে সে। বহ্নি ছুটে যেয়ে তাকে ধরে। উৎস বহ্নিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নেমে যায়। বহ্নি চিৎকার করে ডাকে পিছন থেকে, উৎস শোনেনা সেই ডাক।

“রুস্তমকে আপনি কি করেছেন উৎস শাহরিয়ার? মেরে ফেলেছেন?”
শীতল একনাগাড়ে ফোঁপাচ্ছে, বহ্নি আর আভা শক্ত করে ধরে রেখেছে তাকে। সায়েরা ছেলেকে জাপটে দাঁড়িয়ে আছে। শাহানা হতবাক হয়ে একবার উৎসের দিকে আরেকবার পুলিশের দিকে তাকাচ্ছে। নওশাদ হাতজোড় করে পুলিশের সামনে দাঁড়ানো।
শুধু উৎস শান্ত, তার চোখমুখ ভাবলেশহীন।

“স্যার এসব কি বলছেন? আমার উৎস আর যা-ই করুক, কাউকে মেরে ফেলতে পারেনা। এগুলো কি বলছেন আপনি?”
ইনস্পেকটর হাসে।
“তাই নাকি? তবে আপনি আপনার এই উৎসকে এখনো চিনতে পারেননি। ও যে একটা মাফিয়া গ্যাং এর হয়ে কাজ করছে, জানেন আপনি?”
উৎস হাসে, বাকিরা চিৎকার করে ওঠে।

সায়েরা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
“এগুলো মিথ্যা, এগুলো সব মিথ্যা। উৎস, বাপ আমার, চুপ করে আছিস কেনো বাপ? এসব কি বলছে?”
উৎস শান্ত গলায় বললো,”বলতে দাও মা। ইন্সপেক্টর আপনি বলতে থাকুন।”
ইন্সপেক্টর উৎসের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।

“লা’শটা কি করেছেন?”
“মিথ্যা মামলা আপনারা সাজিয়েছেন, আপনারাই বলুন কি করেছি আমি।”
ইন্সপেক্টর রাগী মুখে বললো,”মশকরা করছেন? থানায় চলুন, মশকরা বের করে দিবো।”
নওশাদ চিৎকার করে বললো,”ওকে কোথাও যেতে দিবো না আমি। কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে? কিসের ভিত্তিতে এসব বলছেন আপনি?”
“প্রমাণ ছাড়া আমরা কাজ করিনা। আপনার আদরের ভাগ্নে আজ বিকেলে কোথায় ছিলো জিজ্ঞেস করুন।”
উৎস ঠান্ডা গলায় বললো,”কোথায় ছিলাম? আপনি-ই বলুন।”
“এই একে হ্যান্ডকাফ পরাও, নেতাগিরি বন্ধ করি আগে।”
“এক মিনিট, আমার বিরুদ্ধে কি প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে এটা না জানা পর্যন্ত আমি কোথাও যাবো না।”
“প্রমাণ চাই? এই শার্টটা দে তো কেউ।”
একটা কনস্টেবল রুক্তমাখা একটা শার্ট দিয়ে যায়।

“শার্টটা চেনা চেনা লাগে উৎস শাহরিয়ার? দক্ষিণ নদীর পাড়ে আজ রুস্তমের সাথে দেখা করোনি তুমি? কথার এক পর্যায়ে হাতাহাতি হয়নি তোমার সাথে তার? প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য আছে।”
“তারপর? আমাকে মারতে দেখেছে?”
“সেই প্রমাণও হবে, বাকি প্রমাণ আদালতে হবে। তবে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে তোমার নামে। রুস্তমের ডেডবডি পাওয়া যাচ্ছেনা। হতে পারে তুমি তাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছো, রক্তাক্ত এই শার্ট ওখান থেকেই উদ্ধার করেছে আমার টীম।”
উৎসের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা যায়না। সায়েরার গগণবিদারী চিৎকার করছে। নওশাদের বুকে ভীষণ ব্যথা করছে, যে কোনো সময় জ্ঞান হারাবে।
শীতল ছুটে আসতে চায়, বহ্নি আর আভা দুই পাশ থেকে শক্ত করে ধরে রাখে তাকে।

“নেতামশাই, তোমার খেলা যে শেষ। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট ফর দ্য মার্ডার অব ছোট রুস্তম।”
শীতল সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়।

(চলবে…….)