মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-২৬+২৭

0
88

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ২৬

“এই বহ্নি, পানি মেরে গাধীটার জ্ঞান ফেরা তো। এটা মানুষ নাকি ভাঙা ক্যাসেট বুঝতে পারিনা মাঝে মাঝে। একটু পর পর ঘড়ঘড় করছে আর ফিট খাচ্ছে।”
বহ্নি সহ বাকিরা বেশ অবাক হয়ে উৎসের দিকে তাকায়। এমন পরিস্থিতিতে ও এতো শান্ত কীভাবে? অবলীলায় কিসব বলে যাচ্ছে।

“হ্যা তা ইনস্পেকটর সাহেব, যা বলছিলেন আবার একটু শুরু থেকে বলা যাক। আমি দক্ষিণ নদীর পাড়ে ছোট রুস্তমের সাথে মারামারি করেছি, প্রত্যক্ষদর্শী তা দেখেছে। ভালো কথা, তারা যদি দেখে থাকে তারা আমাকে বা রুস্তমকে চিনেনা। যদি চিনতো হয়তো আমাদের বাঁধা দিতে আসতো। তাই ধরে নিলাম তারা আমাদের চিনেনা। না চিনলে ওরা মাত্র এই কয় ঘন্টায় কীভাবে নিশ্চিত হলো, ওকে গুম বা খু’ন আমি-ই করেছি? আমার নাম উৎস শাহরিয়ার আর আমার বাড়ি এটাই? এতো তাড়াতাড়ি জেনে গেলো তারা? আর ডায়েরীটা যদি রুস্তমের নিজের লোকেরা করে থাকে, তবে তারা দেখেছে আমাকে ওর সাথে মারামারি করতে। দেখার পরেও তারা এগিয়ে আসেনি কেনো তাদের গুরুকে ছাড়াতে? নাকি তারা অপেক্ষা করছিলো, কখন মারামারি শেষ হবে, আমি বাড়ি চলে আসবো এরপর তারা থানায় যাবে? আপনার কি বিবেচনা স্যার?”
ইনস্পেকটর কিছুটা ইতস্তত করে।
“এতো কথা জানিনা, মিসিং ডায়েরী করা হয়েছে তোমার বিরুদ্ধে। তোমাকে থানায় যেতে হবে এখন, তোমার যা বলার থানায় যেয়ে বলবে। আর কেস কোর্টে উঠে গেলে তো বুঝতেই পারছো।”
সায়েরা আবারও আর্তনাদ করে ওঠে। নওশাদ বোনকে বুকে জড়িয়ে রাখে। সে কোনো কথা বলতে পারছে না। এই মুহুর্তে তার কিছু বলার দরকার। কিন্তু কথা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে মুখের মধ্যে, আড়ষ্ট লাগছে শরীর, খুব দূর্বল লাগছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে।

“থানায় তো যেতেই হবে আমাকে, আমার বিরুদ্ধে মামলা থাকলে। তবে আমার একটা শর্ত আছে।”
“শর্ত মানে? তোমার আবার কি শর্ত? দেখো উৎস বাড়াবাড়ি করোনা। তোমার কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার হুকুম আছে। আপোষে না গেলে তা-ই করবো।”
উৎস ঠোঁট কামড়ে হাসে।
“তাই নাকি স্যার? কে দিলো এই হুকুম? ছোট রুস্তম নয় তো?”
ইনস্পেকটর থমথমে মুখে বললো,”এই অসভ্য, কি মনে হয় তোর আমাদের? আমরা বাইরের কারো হুকুমে চলি? বহুদিন ধরে তোর আর তোর দলের উপর নজর আমাদের। একদিন তো থানায় আটকেও ছেড়ে দিতে হলো। তবে এবার আর রক্ষা নেই। পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। তোর অতিরিক্ত পাখা গজিয়ে গিয়েছে।”
উৎস আভার দিকে তাকিয়ে বললো,”হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? চেয়ার এনে বসতে দে স্যারকে, কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? দেখছিস না, চেতে গেছে।”
আভা ভয়ে ভয়ে ভিতরের দিকে চলে যায় চেয়ার আনতে।

“উৎস কোনো রকম চালাকি করার কথা চিন্তাও করোনা। তুমি চালাকি করে পার পাবেনা। আজ তোমাকে নিয়েই আমি ফিরবো।”
“আহা স্যার, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। আমি কোনো চালাকি করবো না। আমি এখানেই থাকবো, আপনার সামনে। রুস্তমকে খুঁজছিলেন না আপনারা? রণে, বনে, জঙ্গলে যেখানেই থাকুক, ও নিজে এসে হাজির হবে, এখানে। আমার কোথাও যেতে হবে না তার জন্য।”
ইনস্পেকটর হতবাক হয়ে বললো,”তার মানে? বাটি চালান দিবে নাকি?”
“কি যে বলেন স্যার। আপনি-ই তো একটু আগে বললেন, আমি ওকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছি। তাহলে আমি জানবো না?”
ইনস্পেকটর সরু চোখে উৎসের দিকে তাকায়, ওর কথা কিছু বুঝতে পারেনা। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না।

আভা একটা চেয়ার এনে দেয়।
উৎস ছোট্ট করে হেসে বললো,”স্যার বসেন।”
“তোমার কি মনে হয় উৎস, আমি এখানে বসতে এসেছি?”
“এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকবেন? পা ব্যথা করবে না? বেশ, তাহলে আমি-ই বসি।”
ইনস্পেকটর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”আমি ডিউটি টাইমে এক ঘন্টা নষ্ট করবো তোমার জন্য? এক্ষুনি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো আমি। এই ওকে হ্যান্ডকাফ পরাও, এখনই।”
“আরে আরে, এতো ব্যস্ত কেনো? এই পোশাকটা যখন গায়ে চড়িয়েছিলেন স্যার, শপথ নিয়েছিলেন কোনো নিরপরাধকে শাস্তি পেতে দিবেন না। এটুকু সময় কি পোশাকের সম্মান বাঁচাতে, নিজের প্রতিজ্ঞা রাখতে দিবেন না আপনি?”
ইনস্পেকটর ঘন ঘন শ্বাস ফেলে উৎসের দিকে তাকিয়ে। ধপ করে বসে চেয়ারের উপর। তবে উৎস আবার নতুন করে কোন চাল দিচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। প্রচন্ড ধুরন্ধর ছেলে। ওকে বিশ্বাস নেই।

উৎস নিজের হাতঘড়িটা মেলে ধরে ইনস্পেকটরের সামনে।
“এখন নয়টা দশ বাজে স্যার। ঠিক দশটা দশ মিনিট পর্যন্ত আপনাকে এখানে অপেক্ষা করতে হবে। এরমধ্যে রুস্তম ফিরে না এলে, আমি নিজে আপনাদের সাথে থানায় যাবো। আমার কোমরে দড়ি বাঁধার প্রয়োজন হবে না।”
উপস্থিত সবাই অবাক। এটা কীভাবে সম্ভব? উৎস এখানে দাঁড়িয়ে থেকেই কীভাবে এতোটা নিশ্চিত হয়ে বলছে রুস্তম এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবে? তবে কি ও জানে রুস্তম কোথায়?
সবচেয়ে অবাক হয় ইনস্পেকটর। এটা সম্ভব না, কোনোভাবেই না। উলটো চাল দিচ্ছে তো ছেলেটা!

নওশাদ কাঁপা কাঁপা হাতে উৎসের হাত ধরে টেনে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসে, উঠোনেই।

“বাপ রে, ও বাপ কি হচ্ছে আমারে বল না। আমি তো আর নিতে পারছি না। আমার শরীরটা কেমন লাগে। ওরা ওসব কি বলছে বাপজান আমার?”
উৎস ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে মামার দিকে তাকায়। মানুষটা দরদর করে ঘামছে।
উৎস নিজের শার্টের হাতা দিয়ে মামার কপালের ঘাম মুছে দেয়। নওশাদ হু হু করে কেঁদে দেয়।

“মামা আমাকে বিশ্বাস করেন তো? আমি যে কাউকে খু’ন করতে পারিনা এই বিশ্বাসটুকু কি আমার উপর নেই আপনার?”
নওশাদ ঘোলাটে চোখে তাকায় উৎসের দিকে।
“আছে বাপজান আছে। আমি নিজের চেয়ে তোমারে বেশি বিশ্বাস করি। এ কথা কি তুমি জানো না?”
উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”তাহলে নিশ্চিত থাকেন, আমার কিচ্ছু হবে না। ওরা আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।”
“কিন্তু ওরা যে বললো তোমারে নিয়ে যাবে।”
“আমি যাবো না মামা, একটু অপেক্ষা করুন। আপনি নিজের ঘরে যেয়ে বিশ্রাম করুন। আপনাকে খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে।”
“অসম্ভব, আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়বোনা। তোমাকে নিয়ে গেলে আমিও যাবো তোমার সাথে। আমি দরকার হয় গারদের মধ্যে তোমার সাথে বসে থাকবো।”
উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”মামা তার কোনো দরকার হবে না। অপরাধী শাস্তি পাবে, আমি না।”
উৎস নওশাদের হাত ধরে বসায় তাকে।

শীতলের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। উৎস রাগী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শীতল ভাবলেশহীন, কাঁদছেও না। উৎস ভীষণ ভাবে চাচ্ছে রাগ করতে তার উপর, ব্যর্থ হচ্ছে।
‘আল্লাহ এতো মায়া দিয়ে ক্যান পাঠালা তারে দুনিয়ায়, শান্তি করে একটু রাগতেও দিবে না?’ আনমনে বিড়বিড় করতে থাকে উৎস।

ইনস্পেকটর একটা দীর্ঘ হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দশটা বেজে পনেরো মিনিট। রুস্তম এখনো আসেনি। সবার মুখ কালো হয়ে আছে। তবে উৎস কি ভাবছে এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

“তাহলে নেতামশাই, পাঁচ মিনিট অতিরিক্ত দেওয়া হলো। এক ঘন্টার হিসেব তো নেওয়া হবেই, তবে এই পাঁচ মিনিটের হিসেব আলাদা নেওয়া হবে।”
উৎস মুচকি হেসে বললো,”বেশ হ্যান্ডকাফ পরানো হোক তবে।”
শাহানা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। নওশাদ উঠে দাঁড়ায়, সে কোনোভাবেই উৎসকে একা যেতে দিবে না। সায়েরা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে।

ঠিক এমন সময় গেটের বাইরে আজাদের গলার আওয়াজ শুনে ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে ওঠে। ইনস্পেকটর ভ্রু কুঁচকে তাকায় সেদিকে।

“ভাই মা’ল পেয়েছি।”
উৎস ফিসফিস করে বললো,”সাবাশ বেটা, সাবাশ।”
শুধু আজাদ না, আবিরও ঢোকে সাথে। আভা তাকে দেখে শিহরিত হয়। বহ্নি শীতলের হাত চেপে ধরে রাখে।

“আপা কি হচ্ছে এখানে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“শীতল ভালো কিছুই হবে দেখিস, আমার ভাই নিরপরাধ। ওর কোনো অসুবিধা হবে না।”
শীতল বহ্নির হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। শরীর ভীষণ দূর্বল লাগছে তার।

“কই সে? স্যারের সামনে নিয়ে আয় তাকে।”
আজাদ গেটের বাইরে থেকে ঠেলতে ঠেলতে কাউকে ঢোকায়। উৎস দুই হাত বুকে বেঁধে দাঁড়ায় শান্ত হয়ে।

“উৎস এসব কি হচ্ছে? কাকে নিয়ে আসছে ওরা?”
“নিজেই দেখুন স্যার, হয়তো দশ মিনিট দেরি হয়েছে। তবে উৎস মিথ্যা বলেনা।”
সবাইকে অবাক করে দিয়ে রুস্তম ঢোকে, তার চোখমুখ উদ্ভ্রান্তের মতো। রাগে ফুঁসছে সে।

নওশাদ চিৎকার করে বললো,”রুস্তম, তুমি মরোনি?”
উৎস শব্দ করে হেসে দেয় মামার কথা শুনে। ইনস্পেকটর তার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। রুস্তম কোনোদিকে তাকায়না।

উৎস ধীর পায়ে হেঁটে রুস্তমের সামনে দাঁড়ায়। ঠান্ডা চোখে তাকায় তার দিকে। রুস্তম তাকায় না।
“রুস্তম, তুমি যে ভালো হওয়ার মানুষ নয় আমি জানি। তুমি যতোই আমার সামনে ভালো সাজতে চাও, তুমি পারবে না। তুমি যখন আমাকে ডাকলে নদীর পাড়ে, আমি তখনই সন্দেহ করেছিলাম। কোনো একটা চাল দিতে চাচ্ছো তুমি। কিন্তু আমি ধরা দিইনি। আমি শুধু আবির আর আজাদকে লুকিয়ে থাকতে বলেছিলাম। তুমি ইচ্ছা করে আমার সাথে ঝগড়া বাঁধালে। আচমকা আমার উপর আক্রমণ করলে। আমি তোমার উপর আক্রমণ করতে চাইনি। যত্রতত্র কাপুরুষের মতো মারামারি করে আমি হাত নষ্ট করিনা। নিজেকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে আটকালাম। এতেই নাকি মারামারি হয়ে গেলো। আমি বাড়ি চলে আসলাম। তুমি নাটক করলে গুম হয়ে যাওয়ার। নিজের শার্ট রক্তাক্ত করে নদীর পাড়েই রেখে দিলে। যাতে সবাই মনে করে আমি তোমাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি। তুমি মনে করছো আমি বুঝিনা, কিন্তু চান্দু আমি ভাত খাই, সুজি না। বাকিটা আবির তুই বল।”
আবির হাসতে হাসতে বললো,”তুই যা ভেবেছিলি ঠিক তাই উৎস। তুই চলে যাওয়ার পর ও শার্ট ফেলে ছুটতে থাকে রাস্তায়। আমরাও সাবধানে পিছু নিই ওর। পরক্ষণেই দেখি একটা সাদা পাজেরো এসে থামে, ও উঠে যায়। আমরা বাইক নিয়ে পিছু পিছু যাই ওর। শহরের উল্টোদিকে যে ডেরাটা আছে ওর৷ তোর মনে আছে যেখানে আমাদের প্রথম বার উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো ও, সেখানেই গা ঢাকা দিতে চেয়েছিলো। কিছু মাসের জন্য বিদেশ যাওয়ার চিন্তা করেছিলো। সব ঠিক থাকলে আগামীকাল সকালেই ওর ফ্লাইট। কিন্তু বিধি বাম, বেচারার কপালটাই খারাপ। এতো চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলোনা।”
আজাদও হাসে আবিরের সাথে।
“উৎস ভাই, ও ওর স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আমরা ওখানে উপস্থিত হবো। ইচ্ছা করছিলো বেটার মাথা ফাটিয়ে দিই। কিন্তু আপনার নির্দেশ ছিলো ওর গায়ে যেনো একটা নখের আঁচড়ও না লাগে। তাই কিছু বললাম না, নাহলে….”
আজাদ হাত উঁচু করে মারতে যায় রুস্তমকে, রুস্তম কিছুটা দূরে সরে যায়।

উৎস ইনস্পেকটরের খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। সে ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
উৎস তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,”আমি জানি এখানে আপনারও হাত আছে। তবে না, আমি এ কথা কাউকে বলবো না। স্যার, আমরা মানুষ ভালো না। আমাদের নিম্নশ্রেণীর লোকদের সাথে যেমন ওঠাবসা, উচ্চ শ্রেণীর অনেকের সাথেও পরিচয় আছে। ডিআইজি স্যার আমাকে পুত্রের মতো স্নেহ করেন, জানেন তো?”
“উৎস লাগাম টানো, তুমি জানোনা তুমি কি বলছো।”
“আমি জানি স্যার, আমি এমন কোনো কথা বলিনা যেটা আমি জানিনা। আমার সাথে যদি লাগতে আসার নিতান্তই ইচ্ছা হয়, গায়ের এই পোশাকটা খুলে তারপর আসবেন। এই পোশাক অনেক সম্মানের, আমি সম্মান করি। আমার বাবার স্বপ্ন ছিলো আমি এক সময় এই পোশাক পরবো। তাই এই পোশাকে আমি একবিন্দু ধূলো লাগতে দিবো না।”
“তোমাকে তো আমি দেখে নিবো। কি ভেবেছো, পার পেয়ে যাবে?”
“আমি কিছু ভাবিনা স্যার। ভাবনাচিন্তা করে দার্শনিকরা, সেই ভাবনা কাজে রূপান্তর করে আমাদের মতো অসভ্য ছেলেরা। আমাদের ভাবার মতো সময় কোথায়?”
“তোমার নেতাগিরি কীভাবে বন্ধ করতে হয় আমার জানা আছে।”
“নেতা হলে নেতাগিরি বন্ধ করতেন। আমি তো নেতা নই স্যার, আমি ওদের প্রতিনিধি, সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধি। আমার আর কি বন্ধ করবেন স্যার?”
রাগে গজগজ করতে করতে ইনস্পেকটর বেরিয়ে যায়। সাথে রুস্তমকেও টানতে টানতে নিয়ে যায়।

আভা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে।
“থ্রি চিয়ার্স ফর উৎস ভাই, হিপ হিপ হুররে।
থ্রি চিয়ার্স ফর আজাদ ভাই হিপ হিপ হুররে।”
আজাদ আবিরের কাছে এসে মুচকি হেসে বললো,”ভাই আপনার নামটা নিলো না যে?”
আবির লাজুক মুখে হাসে, উৎসও হেসে তার পিঠ চাপড়ে দেয়।

সুযোগ লুফে নিলো বহ্নি।
সে-ও চিৎকার করে ওঠে চোখ মুছে।
“থ্রি চিয়ার্স ফর আওয়ার হিরো আবির, হিপ হিপ হুররে।”
সায়েরা আর শাহানা জড়াজড়ি করে কাঁদে। তারা ভুলেই গেছে আজ সকালেও তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে৷ অন্যদিনের ন্যায় আজও শাহানা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে।

নওশাদ দুই হাতে চোখ মুছে শাহানার দিকে তাকিয়ে বললো,”আমার তিন সাহসী বীরপুরুষের জন্য রাতে কি একটু ভালোমন্দ খাওয়া হবে না শাহানা?”
শাহানা কান্নার মধ্যেই হেসে দেয়।
“তুমি তো আছোই ওই বাহানায়।”
বহ্নি মায়ের কাছে এসে তার হাত ধরে বললো,”ওমা আমরা সাহায্য করে দিবো, তুমি আর না করোনা তো।”
“হ্যা কি সাহায্য করবে তোমরা আমার জানা আছে।”
নওশাদ এবার হাততালি দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বললো,”থ্রি চিয়ার্স ফর মাই দোয়েল পাখি।”
বাকিরা সমস্বরে চিৎকার করে বললো,”হিপ হিপ হুররে।”
“আজ কারো ফেরা হবে না, আজ সবাই মামার গরীবখানায় থাকবে।”
শাহানা চলে যায় সায়েরাকে নিয়ে। পাগল লোকটা ক্ষেপেছে আজ।

শুধু উৎস কোনো কথা বলে না, তার দৃষ্টি শুধুমাত্র তার অনুপমার দিকেই নিবদ্ধ। মেয়েটা কাঁদছে না। কেমন ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উৎস দুষ্টু দুষ্টু হাসে, শীতল চোখ নামিয়ে নেয়। ভীষণ দূর্বল লাগছে তার। শরীর ছেড়ে দিয়েছে, খুব ঘুম পাচ্ছে হঠাৎ করেই।

প্রতিদিনের মতো উৎস গভীর রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিজের জীবনের কথা ভাবছে। কি হতে চেয়েছিলো আর কি হয়ে গেলো। তার বাবার স্বপ্ন ছিলো, ছেলে মস্ত বড় সৎ পুলিশ অফিসার হবে। আর আজ? পুলিশের নজরে নাকি সে খারাপ ছেলে, গুন্ডা মাস্তান। আচ্ছা এই জনমে কি বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে সে?

আচমকা পিঠে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে সে। কেউ যেনো লেপ্টে আছে তার শরীরের সাথে। উৎস জানে কে, তার সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে সরতে পারছে না। চুম্বকের মতো যেনো আটকে আছে সে।

ধাতস্থ হতেই লাফ দিয়ে সরে যায় উৎস। শীতল কখনো এতোটা সাহস করেনা। পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরা? অসম্ভব।
কাজল লেপ্টে আছে মেয়েটার। দূর থেকে আসা হলুদ স্ট্রিটের আলো এসে পড়েছে তার চিবুকে।এই মুহুর্তে তার মা’কে ডেকে দেখাতে ইচ্ছা করছে, মা দেখো, সত্যি চন্দ্রকন্যা আছে।

“শীতল এতো রাতে তুমি? ঘুমাও নি?”
শীতল উত্তর দেয়না, ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে উৎসের দিকে।
উৎস কিছুটা ইতস্তত করে শীতলের গালে হাত দেয়। হালকা ভেজা গালটা মুছে দেয় আলতো করে।

“কথায় কথায় এতো কাঁদো কেনো শীতল? এতো নরম হলে তো যে কেউ তোমাকে ভেঙে দিয়ে চলে যাবে। নরম মাটিতে কেঁচো বাসা বাঁধে।”
শীতল উৎসের হাতের উপর মাথা কাত করে। এভাবেই ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা হয় তার। এভাবেই যদি জীবনটা কেটে যেতো।

“যতো দূরে যেতে চাই তত সরে আছি কাছে, আমার গায়ে যে তোমার গন্ধ লেগে আছে।”
শীতল গাঢ় গলায় বললো,”দূরে চলে যেতে চান? তবে যান।”
“ওইযে বললাম আমার শরীরে যে তোমার গন্ধ লেগে আছে। এই গন্ধটা তো আমাকে এক মুহুর্ত স্বস্তি দিবে না দূরে গেলে।”
“দূরে যেতে চান কেনো?”
“চাঁদের বুকে কলঙ্ক লাগাতে চাইনা তাই।”
“কিছু কলঙ্ক থাক না লেগে, যেভাবে চন্দ্রের বুকে কালো দাগ ওঠে জেগে।”
উৎস ভ্রু উঁচু করে তাকাতেই শীতল লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।
“কতো কথা শিখে গেছে।”
“কেনো? না শিখলে ভালো হতো?”
“না ভালো হতো না। আমার ছোট শীতল কীভাবে শিখবে তাহলে?”
কথাটা বুঝতে বেশ অনেকক্ষণ সময় লাগে শীতলের। পরক্ষণেই লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে সে।

“আপনি….. ”
“আমি কি? অসভ্য, গুণ্ডা, বদমাশ, মাস্তান….?
শীতল মাথা নিচু করে হাসে।

“শীতল তুমি কি কিছু বলবে?”
“বলবো।”
“বলো।”
শীতল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”সবকিছু ছেড়ে দিলে হয়না?”
“কি ছাড়ার কথা বলছো?”
“বুঝতে পারছেন না কি বলছি? এসব রাজনীতি, মারামারি সব ছেড়ে দিন, সব। আমার বাবা যেমন সারাজীবন সরল পথে চলেছে, আমাদের ভালো রেখেছে আপনি কি পারবেন না ওরকম? আমরা যদি অনেক দূরে চলে যাই? অনেক অনেক দূরে?”
“ঘরে যাও শীতল, অনেক রাত হয়েছে।”
শীতল ম্লান হেসে বললো,”আমার চেয়েও রাজনীতি বেশি ভালোবাসেন?”
“তোমার জন্য রাজনীতিকে ভালোবাসি।”
“এসব বলবেন না, দয়া করে এসব বলবেন না।”
উৎস থুতনিতে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল ঠেকিয়ে শীতলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শীতল বিরক্ত হয়ে চলে যেতে গেলেই উৎস তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
“যেতে দিন আমাকে।”
“যাবে, তার আগে তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার আছে। নিয়ে তারপর যাও।”
“আমার কোনো উপহার চাইনা।”
“না চাইলেও নিতে হবে।”
শীতল ভ্রু কুঁচকে তাকায়, উৎস পকেট থেকে এক পাতা টিপ বের করে দেয় শীতলের সামনে। শীতলের মনটা ভালো হয়ে গেলেও প্রকাশ করেনা। উৎসকে বুঝতে হবে, সে-ও রাগতে পারে।

উৎস গুণগুণ করে গান করে ওঠে,”আমি এক গরীব প্রেমিক নীলা, আমার আর কিচ্ছু দেওয়ার নেই।”

শীতল মনে মনে হাসলেও উপরে গম্ভীর থাকার চেষ্টা করে।
“আচ্ছা ম্যাডাম রেগে আছেন এখনো। কীভাবে রাগ কমাই?”
“লাগবে না, আমি চলে যাবো এখন।”
“আচ্ছা আমি পরিয়ে দিই?”
শীতল ঝট করে তাকায় উৎসের দিকে। কঠিন মানুষটা এমন মায়া মায়া করে কথা বলছে কেনো আজ? সে রেগে আছে তাই? তাহলে তো সবসময় রেগে থাকবে এখন থেকে।

শীতলের অনুমতির অপেক্ষা করেনা উৎস। টিপের পাতা থেকে একটা টিপ নিয়ে শীতলের কপালে দিতে যাবে ঠিক এমন সময়…..

“ভাই….”
আজাদের ডাকে চমকে ওঠে উৎস, শীতলও। চার হাত পিছিয়ে যায় শীতল। তাড়াতাড়ি করে মাথায় ওড়না চাপিয়ে উৎসের হাত থেকে ছোঁ মেরে টিপের পাতাটা নিয়েই ছুটে পালায় সে। সিঁড়ি থেকে তার ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।

আবিরও এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণ। আজ রাতে তাদের ফেরা নিষিদ্ধ, নওশাদের কথামতো।

“ভাই কি করছিলেন?”
উৎস থতমত খেয়ে বললো,”কি আবার করবো? ও এসেছিলো পড়ার কথা বলতে। ওকে পড়াই আমি। তোরা না ঘুমিয়ে কি করছিস বুঝলাম না।”
আবির আর আজাদ দুইজন উৎসকে দুই পাশ থেকে চেপে ধরে।

“হচ্ছেটা কি? যা বলছি।”
“ভাই এতো রাতে আপনার চন্দ্রাবতী পড়ার কথা বলতে এসেছে? টিপের পাতা সম্পর্কিত পদার্থবিজ্ঞান নাকি রসায়ন?”
আবির মুখ টিপে হেসে বললো,”আজাদ কি বলিস, জীববিজ্ঞান পরানো হচ্ছিলো, বায়োলজি।”
উৎস নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,”দূর হ তোরা, কেনো আছিস এখানে?”
“বিরক্ত করলাম ভাই? আরেকটু হলে তো প্রাকটিকাল ক্লাসও হয়ে যেতো।”
“আজাদ….”
উৎস রাগ করতে চায়, কেনো যেনো পারেনা। তার নিজেরও অদ্ভুত ভাবে ভালো লাগছে।

“তুমি তলে তলে টেম্পু চালাও, আমি করলে হরতাল?”
আজাদ আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো,”ভাই আপনার কেসটা কি? ভাই রে ভাই, এক বাড়িতেই দেখি সব সিনেমা। আমি আর বাকি কেনো? ভাই আপনাদের কোনো শালী নেই? আমার কপালে তো মেয়ে নেই।”
উৎস আর আবির হাসতে হাসতে আজাদের পিঠ চাপড়াতে থাকে। আজাদও হাসে। আজ ওরা খোলা আকাশের নিচে একসাথে মন খুলে হাসে। কোনো খাঁদ নেই সেই অমলিন হাসিতে। একদম যেনো সেই কিশোরবেলায় ফিরে যায় ওরা। উৎসকে এতোটা মন খুলে হাসতে দেখার সৌভাগ্য এর আগে খুব কমই হয়েছে। আজাদের চোখে আচমকাই পানি চলে আসে। ইশ, তার এই দুই ভাইয়ের মুখে যদি আজীবন এমন হাসি থাকতো! তার আর কিচ্ছু চাওয়ার ছিলো না।

ক্লাস শেষে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরার জন্য রিকশা খুঁজছিলো বহ্নি। আজ একটা রিকশাও পাওয়া যাচ্ছে না। আজকাল হুটহাট রাগ ওঠে তার। প্রচন্ড গরমও পড়েছে। দরদর করে ঘাম ঝরছে কপাল থেকে। ওড়না দিয়ে মুখটা মোছে।

হুট করে একটা রিকশা এসে থামে তার সামনে। রিকশাওয়ালা পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হেসে বললো,”আম্মা ওঠেন।”
“আম্মা ওঠেন মানে? কে আপনার আম্মা?”
“আপনে আম্মা, আমি আপনার ছেলে।”
“কি অদ্ভুত কথা, কি বলেন এসব?”
“চলেন তো, বাড়ি পৌঁছায় দিয়ে আসি।”
বহ্নি রাগী গলায় বললো,”আপনার রিকশায় যাবো না, যান আপনি।”
রিকশাওয়ালা হুড খুলে দেয়, বহ্নির কথা যেনো শুনতেই পায়নি সে।

“বললাম তো আপনার রিকশায় যাবো না। বিরক্ত করছেন কেনো বুঝলাম না।”
“কিন্তু উনি যে ভাড়া দিয়েছেন৷ বললেন আপনাকে যেনো সাবধানে বাড়ি পৌঁছে দিই।”
বহ্নি ভ্রু কুঁচকে বললো,”উনিটা কে?”
রিকশাওয়ালা আবার হেসে বললো,”উনার উপর রাগ করছেন আম্মা? রাগ করিয়েন না, সব মিটায় নেন।”
“দেখুন একদম ফাজলামি করবেন না কিন্তু। আমাকে অন্য মেয়েদের মতো ভাববেন না। আপনি মুরুব্বি বলে এখনো কিছু বলছি না। যান বলছি, যান।”
রিকশাওয়ালা মুখ কালো করে বললো,”কিন্তু উনি যে আপনার জন্য একটা উপহার পাঠালো আমার কাছে। ওটা রাখেন।”
বহ্নি অবাক হয়ে দেখে রিকশাওয়ালা একটা প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে দেয়।

“আপনার জিনিস নেন, আমি চলে যাই।”
“আমার জিনিস মানে?”
“নিজেই দেখে নেন।”
বহ্নি বিরক্ত হয়ে কিছুটা সরে যেয়ে দাঁড়ায়, কোন পাগলের পাল্লায় পড়া গেলো আবার।

রিকশাওয়ালা আবার তার কাছে এসে দাঁড়ায়।
“নেন না আম্মা, আপনার আমানত নিয়ে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো আমি?”
বহ্নি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে প্যাকেটটা ছিনিয়ে নেয় হাত থেকে।
সাথে সাথে একটা ছোট্ট কাগজ নিচে পড়ে যায়।
রিকশাওয়ালাই তুলে আবার তার হাতে দেয়।

মিস বহ্নি,
আপনার অসামান্য রূপের কাছে এই উপহার অতি সামান্য। যদি আপনার যোগ্য মনে করেন তবে এটা পরে আজ রাত বারোটায় আপনাদের বাড়ির ছাদে থাকবেন। আমি প্রেমিক নই, তবে হতে ইচ্ছা করছে।

বি.দ্র.: আমি উৎস ভাইয়ের মতো পাগল প্রেমিক হতে চাই, মাঝে মাঝে একটু পাগলামি করা নেহাৎ খারাপ কিছু না। নাহলে নাতি-নাতনীদের কি গল্প দিবো বলুন? রাগ করেছেন? রাগ করলে আসবেন না ছাদে, কিন্তু আমি অপেক্ষা করে যাবো বড় রাস্তার পাশে।

ইতি,
একজন ভীতু মানুষ।

চিঠিটা হাতে নিয়ে বরফের মতো জমে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে বহ্নি। তার মনে হচ্ছে এটা কোনো স্বপ্ন, অবশ্যই স্বপ্ন। শ্বাস নিতেও যেনো ভুলে গেছে সে।

“আম্মা বাড়ি যাইবেন?”
বহ্নি মুখ চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। এতোটা বিশেষ কেউ অনুভব এর আগে কেউ করেনি তাকে। কেনো এমন অনুভূতি হচ্ছে তার? উনি সত্যি তাকে ভালোবেসেছে? সব জেনে? বাবার কথা কি তবে ঠিক? মহাপুরুষ সত্যিই আছে?

রিকশায় উঠে বসে বহ্নি। শক্ত করে হুড চেপে ধরে। নাহলে মনে হচ্ছিলো মাথা ঘুরে পড়েই যাবে। কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বহ্নি প্যাকেটটা ছিঁড়ে ফেলে।
সাথে সাথেই মিষ্টি গোলাপি একটা জামদানী শাড়ি ভেসে ওঠে। এতো সুন্দর! এত্তো সুন্দর!!
শাড়িটা মুখে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় বহ্নি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণহীন লাগে তার। সে ইচ্ছা করে কাঁদছে না, কে যেনো ভিতর থেকে কাঁদতে বাধ্য করছে তাকে।

“কাইন্দেন না আম্মা, শক্ত করে হুড চেপে ধরে রাখেন। আর উনারে কষ্ট দিয়েন না, উনি মানুষ ভালো। বোকাসোকা, নাহলে আমারে বিশ্বাস করে দিলেন কেনো? আমি যদি নিয়ে চলে যেতাম? তয় আম্মা, বোকা মানুষ ভালো। বোকা ছাড়া দুনিয়া চলেনা।”
বহ্নি থামেনা, আরো কেঁপে কেঁপে কাঁদতে থাকে। পৃথিবীটা হঠাৎ করে অদ্ভুত রঙিন লাগছে তার। বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছা করে।

“আপনাকে কারো মতো হতে হবে না রণ সাহেব, আপনি আপনার মতো করে প্রেমিক রূপে ধরা দিন। আমি ওভাবেই মানিয়ে নিবো।”

“আম্মা কিছু বলতেছেন”
বহ্নি গাঢ় গলায় বললো,”না, নাহ।”
শাড়িটা দুই হাতে চেপে বহ্নি বসে থাকে, চোখে পানি আর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে।

দূর থেকে রিকশাটা দেখতে থাকে রণ, যতোক্ষণ পর্যন্ত তা দৃষ্টিসীমার বাইরে না যায়।
আস্তে আস্তে রিকশাটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
রণ একটা লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললো,”এই পৃথিবীর সকল ভগ্ন হৃদয়ের প্রেমিকদের মন শীতল করে দেওয়ার জন্য, তোমার মতো প্রেমিকা বার বার জন্ম নিক, বহ্নি।”

[শেষের দু’টো লাইন আমার লেখা গল্প ‘ভেসে যায় জলপদ্ম’ থেকে নেওয়া। পদ্মকে উদ্দেশ্য করে আরিফ বলেছিলো।]

(চলবে….)

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ২৭

দৌড়ে ঘরে ঢোকার মুখে বারান্দায় কারো সাথে ধাক্কা লেগে ছিটকে যেয়ে পড়ে বহ্নি। হাত থেকে ব্যাগও ছুটে চলে যায় কোথায়। কপালে হাত দিয়ে ভয়ংকর বিরক্ত হয়ে তাকাতেই দেখে উৎস কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

বহ্নি উঠে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত গলায় বললো,”চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি? দেখে হাঁটতে পারিস না?”
উৎস অবাক হয়ে বললো,”একই কথা যদি আমি বলি? আমি তো দিব্বি ভালোমানুষের মতো হাঁটছিলাম। তুই এমন ফ্লাইং সসারের মতো উড়ে এসে আমার গায়ে পড়লি। এখন আবার আমাকেই দোষ দিচ্ছিস?”
বহ্নি কিছুক্ষণ উৎসের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা উৎসের হাত ধরে তাকে ঘোরানোর চেষ্টা করে। যারপরনাই হতবাক হয়ে যায় উৎস। তবে যদিও তাকে এক চুলও নড়াতে পারেনা বহ্নি। পাটকাঠির মতো শরীরে বিশালদেহী উৎসকে ঘোরানো কি আদৌ সম্ভব?

“কাহিনী কি রে ভাই? আভার মতো ছেলেমানুষী করছিস কেনো?”
“উৎস আজ অনেক খুশি আমি, অনেক। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এতো খুশি কেনো লাগছে আমার জানিনা।”
উৎস ভ্রু কুঁচকে তাকায় বহ্নির দিকে। মেয়েটার মুখ উজ্জ্বল, খুশি উপচে পড়ছে যেনো। উৎসের মনটাও ভালো হয়ে যায় হঠাৎই।

“ভাই রে, তোরা মেয়েরাই ভালো আছিস। ব্রেনও নাই, ব্রেন ক্যান্সার হওয়ার ভয়ও নেই।”
বহ্নি কপট রাগ করে বললো,”ব্রেন নাই মানে? আমাদের মেয়েদের ব্রেন না থাকলে কি আছে?”
“ব্রেনের জায়গায় একদলা পচা আলুর ভর্তা আছে। তোরা কখন হাসিস, কখন কাঁদিস তোরা নিজেরাই জানিস না। অন্তত তোকে শীতল আর আভার থেকে আলাদা ভেবেছিলাম। সেই ভাবনা তুই ভুল প্রমাণিত করলি আজকে।”
বহ্নি দুই হাত কোমরে চেপে দাঁড়ায়। তার মন অসম্ভব ভালো, এই বাজে ছেলেটার কথায় মেজাজ খারাপ করার কোনো কারণই নেই এখন।

“আচ্ছা তুই থাক তোর এই পচা আলুর মতো ব্রেন নিয়ে। আমার কাজ আছে, গেলাম।”
বহ্নিকে রাগিয়ে দিতে উৎসের ভালো লাগে। সে মুখ টিপে হেসে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বহ্নি পিছন থেকে ডাকে তাকে।

“এই শোন।”
“কি হয়েছে?”
বহ্নি কিছুটা ইতস্তত করে, কিছু বলেনা।
উৎস কৌতুহলী চোখে তাকায় তার দিকে। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কাউকে প্রেম নিবেদন করতে চাস? সাহায্য লাগবে আমার?”
“উৎস….”
“আচ্ছা আচ্ছা রাগ করতে হবে না। বল কি হয়েছে।”
বহ্নি এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললো,”আজ রাতে তুই ঘর থেকে বের হবি না, ঘরেই থাকবি। সিগারেট খেতে ছাদে আসতে হবে না।”
“কেনো? ছাদ থেকে লাফ দিবি নাকি কারো বিরহে?”
“সবসময় কি বাজে কথা না বললেই নয়?”
উৎসের আচমকাই কেমন মায়া লাগে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। চোখেমুখে একরাশ ক্লান্তি, ঘামে ভেজা গাল, বাম গালের কোণায় ব্রণ। সবকিছু মিলিয়েও যেনো ওকে পরীর মতো রূপবতী লাগছে। ও কি সত্যিই আজ খুব খুশি? কেনো? ওর খুশিটা এই মুহুর্তে নষ্ট করতে ইচ্ছা করলো না।

“আচ্ছা যা থাকবো না। আজ ছাদ তোর।”
বহ্নির মুখটা আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সামনে উৎস না হয়ে শীতল বা আভা হলে নির্ঘাৎ জড়িয়ে ধরতো। উৎস ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে আড়চোখে দেখে বহ্নি মেঝেতে পড়ে যাওয়া একটা প্যাকেট খুব যত্নের সাথে বুকে চেপে ধরেছে। উৎস আর কিছু বলেনা।

সন্ধ্যার পর থেকেই শীতল আর আভা অবাক হয়ে খেয়াল করে তাদের আপা একটু পর পর কেমন ছটফট করছে আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে বারবার। একবার কাজল টেনে দিচ্ছে, আরেকবার মুছে ফেলছে। আয়নার সামনেই বসে আছে তখন থেকে। কোনো সাজই যেনো মনমতো হচ্ছে না তার। সেই রাগও দেখাচ্ছে নিজের উপর মাঝে মাঝে। সবকিছু ছাপিয়ে তার চোখেমুখে খুশি স্পষ্ট।

“মেজো আপা, এই মেজো আপা।”
“কি হয়েছে বল।”
“বড় আপার কি হয়েছে বল তো? আপাকে এভাবে পাগলামি কর‍তে দেখেছিস এর আগে?”
শীতলের নিজেরও কেমন অবাক লাগে কিন্তু দে আভার সামনে প্রকাশ করেনা। কিছু একটা অনুমান করার চেষ্টা করছে সে। যেটা কোনোভাবেই এই হাবার সামনে প্রকাশ করা যাবেনা।

“এই মেজো আপা, কিছু বল।”
“বিরক্ত করিস না তো আভা। আপার আজ ইচ্ছা করছে সাজতে, সাজছে। এরমধ্যে পাগলামির কি দেখলি তুই?”
“না না তুই বুঝতে পারছিস না মেজো আপা। বড় আপাকে এমন পাগলামি করতে দেখতাম সেই বছর দুই আগে। মাঝে আপা কেমন হয়ে গেলো। আজ হঠাৎ সেই আগের বড় আপাকে দেখে এতো ভালো লাগছে।”
শীতল চাপা গলায় ফিসফিস করে বললো,”যা-ই হোক, এখন আপাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবি না। আপা খুশি থাকুক, এরচেয়ে ভালো লাগার আর কি আছে আমাদের?”
“ঠিক বলেছিস মেজো আপা। বড় আপার খুশির জন্য আমরা আমাদের খুশিটুকুও বিসর্জন দিতে পারি, তাইনা বল?”
শীতল আনমনে সাড়া দেয়। হঠাৎ আভার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,”আচ্ছা তোর ব্যাপারটা কি রে?”
আভা থতমত খেয়ে বললো,”আমার আবার কি ব্যাপার?”
“তোর ড্রয়ারে সেদিন সুন্দর কয়টা চুড়ি দেখলাম। কে দিয়েছে তোকে ওগুলো?”
আভার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। তার মেজো আপাকে দেখলে যতোটা সাদাসিধা মনে হয় সে মোটেই তা নয়। সে সবকিছু দেখে, কিছু বলেনা। মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করে শুধু।

আভা ভয় পেলেও শীতল আর ওদিকে কথা বাড়ায়না। শীতল সরু চোখে বহ্নির দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে।

“শাহানা তুমি কি আমার পাশে এসে কিছুক্ষণ বসবে?”
নওশাদ আজ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছে। আসার পর থেকেই শান্ত মুখে বসে আছে নিজের ঘরে। অন্যদিন বাড়ি ফেরার পর এক কাপ চা খায়, আজ তা-ও খেতে চায়নি। শাহানা তাকে বেশি ঘাঁটায় না।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর নিজেই শাহানাকে কাছে ডাকে। তার কণ্ঠ একদম ঠান্ডা। শাহানা নিজের কাজ ফেলে দৌড়ে যায় তার কাছে। স্বামীর হাতে হাত দিয়ে বসে।
“কি হয়েছে তোমার? এমন লাগছে কেনো তোমাকে? লেবুর শরবত করে দিই?”
“কিছু লাগবে না শাহানা। তুমি শুধু আমার পাশে বসে থাকো কিছুক্ষণ, তাতেই হবে।”
শাহানার কেমন যেনো লাগে। মানুষটা তো এমন করেনা সাধারণত। সে কি দুশ্চিন্তায় আছে কিছু নিয়ে? ওই রুস্তম আবার কোনো ঝামেলা করলো না তো?

“আচ্ছা আমাকে দয়া করে বলো কি হয়েছে। না বললে বুঝবো কীভাবে?”
বেশ কিছু সময় নওশাদ চুপ করে থাকে। এরপর নিজেই উঠে যায়। আলমারি খুলে একটা মাঝারি ধরণের কালো ব্যাগ বের করে আনে। শাহানা নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে ব্যাগটার দিকে।

“ব্যাগটা খোলো শাহানা।”
“কি আছে এতে?”
“নিজেই দেখো।”
শাহানা ব্যাগটা হাত নেয়, বেশ ভারী। নওশাদের দিকে একবার তাকিয়ে ব্যাগটার চেইন খোলে আস্তে আস্তে।
সাথে সাথেই শাহানার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। বিস্ফারিত চোখে তাকায় স্বামীর দিকে। মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হয়না তার।

“এগুলো তুমি যত্ন করে রেখে দাও শাহানা। খুব তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজ শুরু হবে। যখন লাগবে তোমার কাছ থেকে চেয়ে নিবো।”
শাহানা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”এতো টাকা? এতো টাকা কোথা থেকে এলো?”
“জমির বায়নার টাকা পেলাম আজ। বাকিটা লেখালেখি হওয়ার পর পাবো।”
শাহানা এতো টাকা একসাথে দেখেনি কখনো, তার চোখ ঘোলাটে হয়ে যায়।

“আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে শাহানা, আমার দোতলা বাড়ি, আমার রাজকন্যাদের ঘর, আমার রানীর ঘর। আমার বোনকেও দিবো নিচতলাটা গুছিয়ে, উৎসেরও আলাদা ঘর থাকবে। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে শাহানা। আমার মনে হচ্ছে খুব জ্বর আসবে, তুমি কি আমার কপালে একটু হাত রাখবে?”
শাহানা নওশাদের কপালে হাত রাখে। কপাল আসলেই বেশ গরম। শিউরে ওঠে শাহানা।
“তোমার তো অনেক জ্বর, চলো কিছু খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিবে।”
“আমার ওষুধ লাগবে না শাহানা। তুমি বসে থাকো আমার পাশে কিছুক্ষণ। তাহলেই হবে।”
শাহানা নওশাদের হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাখে।
“আমি আছি, তুমি যতোবার আমাকে চাইবে ততবার আমাকে পাবে। যা কিছু হয়ে যাক, আমি আছি তোমার কাছে।”
নওশাদ আচমকাই শাহানার কাঁধে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে ওঠে। হতবিহ্বল হয়ে যায় শাহানা।

“আজ এতো খুশির একটা দিন, তোমার স্বপ্ন পূরণের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তুমি। তুমি কাঁদছো কেনো?”
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না শাহানা। আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমি আমার নতুন বাড়ি দেখে যেতে পারবো না। তোমরা তোমাদের আলাদা জগৎ পেয়ে কতোটা খুশি হও, আমি দেখতে পারবো না।”
স্তম্ভিত হয়ে যায় শাহানা। নির্বাক হয়ে তাকায় নওশাদের দিকে। বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে তার।

“এসব কি বলছো? কেনো বলছো?”
নওশাদ দুই হাত দিয়ে চোখ মোছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। শাহানা ধাতস্থ হতে পারেনা।
“কি হলো? বলো? এসব কেনো বলছো?”
“শাহানা আজ খিচুড়ি করবে? সায়েরা না, তুমি করো। তোমার হাতের খিচুড়ি অমৃতের কাছাকাছি। আজ সবাইকে একসাথে নিয়ে খাবো। সবাইকে নিয়ে। উৎস কি বাড়ি ফিরেছে?
শাহানা উত্তর দেয়না নওশাদের কথার। তারও হঠাৎ মন খারাপ লাগে, কিছুই ভালো লাগেনা।

সবাই একসাথে খেতে বসেছে। বহ্নির কেনো যেনো কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। খাবারগুলো নাড়াচাড়া করছে শুধু হাত দিয়ে।
শীতল তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বহ্নি বারবার তাকাচ্ছেও ঘড়ির দিকে। কি হয়েছে কে জানে!
নওশাদও খেয়াল করে তার বড় কন্যাকে।

“কি রে মা খাচ্ছিস না যে? তোর মা আজ অসাধারণ রান্না করেছে। মনে হচ্ছে বেহেশতি কোনো খাবার খাচ্ছি।”
বহ্নি ক্ষীণ গলায় বললো,”খাচ্ছি তো বাবা।”
“কোথায় খাচ্ছিস? আয় তো আমি তোকে খাইয়ে দিই আজকে।”
“না না বাবা, আমার আর খিদা নেই।”
“শরীর খারাপ না তো?”
বহ্নি হাত ধুয়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। সবাই অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। দশটা বেজে পনেরো মিনিট। উফ, আজ সময় যাচ্ছে না কেনো? কখন বাজবে বারোটা?
“আমি আসছি।” বলেই বহ্নি চলে যায়। কেউ কিছু বুঝতেই পারে না কি হচ্ছে।

“উৎস ভাই, এই উৎস ভাই। দরজা খুলুন না।”
উৎস ঘড়ির দিকে তাকায়। পৌনে বারোটা বাজে। এই অসময়ে শীতল কেনো? সে তাড়াতাড়ি করে উঠে দরজা খোলে।
তাড়াহুড়ায় গায়ে শার্ট চাপাতেই ভুলে যায় সে। আচমকা দরজা খুলতেই তার উন্মুক্ত বক্ষ দেখে শিউরে ওঠে শীতল। চোখ নামিয়ে নেয় পরক্ষণেই।

“কি হয়েছে? এতো রাতে তুমি?”
শীতল মাথা নিচু করেই বললো,”আপনি শার্ট পরে একটু বাইরে আসুন, কথা আছে।”
উৎস ভ্রু উঁচু করে তাকায় শীতলের দিকে। ঠোঁট কামড়ে হাসে।

“কেনো? ভয় পাচ্ছো?”
“কিসের ভয় পাবো?”
“যদি ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা হয়? বদনাম হবে যে, নওশাদ খাঁয়ের মেজো রাজকন্যা শীতলের।”
“উফফ, যতো বাজে কথা। যান তো, আমি অপেক্ষা করছি। খুব দ্রুত আসবেন।”
উৎস হেসে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। ফিরে আসে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই।

শীতল উল্টোদিকে ফিরে দুই হাত ঘষছিলো। অজানা উত্তেজনায় কাঁপছে সে। হাত বরফের মতো ঠান্ডা, কপালও ঘামছে দরদর করে।

আচমকা কাঁধের কাছে কারো তপ্ত শ্বাসের উষ্ণতা অনুভব করতেই তার সারা শরীর স্থাণুর মতো জমে যায়। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে সে। ওড়না চেপে ধরে দুই হাতে শক্ত করে।
উৎস শীতলের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”দীর্ঘশ্বাস ঠিকঠাক জায়গায় ফেলতে হয়। সাবধানে, চুল সরিয়ে, ঘাড়ের পাশে। যাতে তুমি বুঝতে পারো আমি কতোটা অসহায়।”
শীতলের ঘাড়ের কাছে ভিড় করা কয়েক গাছা চুল উৎস অতি সাবধানে সরিয়ে দেয়। তবুও তার আঙ্গুলের ঠান্ডা স্পর্শ লাগে শীতলের কাঁধে। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে তিরতির করে। মানুষটা হঠাৎ হঠাৎ কেমন অদ্ভুত আচরণ করে। মনে হয় ভীষণ খরার পর এক পশলা শান্তির ঠান্ডা বৃষ্টি খোঁজে সে শীতলের কাছে। শীতল সেই বৃষ্টিতে ভেজাতে পারেনা, ভয় পায়, সরে আসে।

“শীতল, এই জ্যোৎস্না বিহীন আঁধার রাতে তুমি আমার কাছে এসো না।”
শীতল ঢোক চেপে জিজ্ঞেস করলো,”কেনো?”
“আমার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হয়। সব নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা হয়। শক্ত করে নিজের বাহুডোরে আটকে ফেলতে ইচ্ছা হয় তোমাকে। ভাবতে ইচ্ছা হয় পৃথিবীতে এই দুই নর-নারী ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই। ন্যায়-অন্যায়ের ভাবনা ভুলে যাই।”
“আচ্ছা আর আসবো না।”
উৎস সরে দাঁড়ায়। অন্যদিকে তাকায় শান্ত চোখে। যেনো এতোক্ষণ কিচ্ছু হয়নি। শীতলও তাকাতে পারেনা তার দিকে। ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে শুধু তার।

“কেনো এসেছিলে?”
এতো কিছুর চক্করে শীতল ভুলেই গিয়েছিলো সে কেনো এসেছিলো এখানে। মনে পড়তেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটে সে।
“ইশ! একদম ভুলে গিয়েছিলাম।”
“কি হয়েছে?”
শীতল এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,”আপা কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে উৎস ভাই। সন্ধ্যার পর থেকেই দেখছি। এই হাসছে, এই সাজছে। সাড়ে এগারোটার দিকে আপা ঘর অন্ধকার করেই সাজতে বসেছে। আপা ভেবেছিলো আমরা ঘুমিয়ে গেছি। কিন্তু আমি চোখ অর্ধেক খুলে সব দেখেছি।”
উৎস অবাক হয়ে বললো,”কি দেখেছো?”
“আপা একটা খুব সুন্দর শাড়ি পরলো, শাড়িটা আগে কখনো দেখিনি আমি। উঠোন থেকে সাদা অতসী ফুল ছিঁড়ে এনে খোঁপায় বাঁধলো। দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি পরলো। আপাকে এর আগে কাজল আর টিপ ছাড়া আর কিছু দিয়ে সাজতে দেখিনি বেশি। তবে সে আজ অনেক সাজলো, একদম মোহনীয় সাজ। একটা পরীর মতো লাগছিলো তাকে।”
উৎস হতাশ গলায় বললো,”এই কথা বলতে তুমি এতো রাতে এখানে এসেছো। মেয়ে মানুষের হাজারটা শখের মধ্যে প্রধান শখ সাজগোজ করা। সে সেজেছে, তাতে কি হয়েছে?”
“ধুর, পুরোটা শুনবেন তো আগে। আপা সেজেগুজে ঘরে বসে থাকলেও বুঝতাম। আগে প্রায়ই আপা এই কাজটা করতো। নিজেই সেজে বারান্দায় হাঁটতো আর গুণগুণ করে গান করতো। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে যেতো তখন। তবে আজ অন্য ব্যাপার?”
“কি ব্যাপার?”
“আপা আজ ছাদে এসেছে। আসার আগে আয়নার সামনে বসে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। কি হয়েছে আপার উৎস ভাই? আমার খুব ভয় করছে।”
উৎস কিছুটা ধাক্কা খায়। আসলেই তো, বিকালেই বহ্নি বললো সে যেনো আজ রাতে ছাদে না যায়। কি করতে চাচ্ছে ও? ও কি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে? সজীবের ঘটনা থেকে বের হতে না পেরে? না না, ও তো এমন নরম মনের মেয়ে নয়। কিন্তু অবসাদ৷ দুশ্চিন্তা যদি তাকে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে? উৎস হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

“উৎস ভাই, চলুন না আমার সাথে ছাদে। আমার একা ভয় করছে।”
উৎস কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”কিন্তু আমি যে ওকে কথা দিয়েছি আমি আজ ছাদে যাবো না।”
“তার মানে?”
উৎস কি করবে বুঝতে পারে না। মাথা কেমন এলোমেলো লাগতে থাকে তার।

রাত বারোটা বেজে নয় মিনিট। বড় রাস্তা ফাঁকা, কেউ নেই সেখানে কেউ না। বহ্নি ক্লান্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে তার সামনে পুরো পৃথিবীটা দুলছে। তবে কি মানুষটা তাকে মিথ্যা বললো? কিন্তু কেনো? এতে কি লাভ তার?
লজ্জায়, অপমানে শরীর কাঁপছে বহ্নির। নিঃশ্বাস টুকু নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে তার। নিজের কাছে নিজেই গ্লানিতে মরে যাচ্ছে বারংবার। তাকে বোকা বানালো, তাকে? কিন্তু কেনো? সে কি সবার ব্যবহার করার মানুষে পরিণত হলো? ইচ্ছা করছে এখনই এই ছাদ থেকে বড় রাস্তার উপর ঝাপিয়ে পড়তে। যাতে কালচে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে পিচের রাস্তাটা ভরে। অসহ্য রকম রাগ লাগছে নিজের উপর। কেনো এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো তার জীবনটা?

শ্রান্ত পায়ে বহ্নি ফিরেই আসছিলো। কি মনে করে শেষবারের মতো তাকায় পিছন ঘুরে। সাথে সাথে তার শরীরে ঝাঁকি লাগে, ভুল দেখেছে কিনা বুঝতে চোখ ডলে আবার তাকায় সে। না সে ভুল দেখছে না, কোনোভাবেই না।
বড় রাস্তার পাশে কয়েকটা হলুদ স্ট্রিট লাইট। সেই হলুদাভ আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে একটা একহারা লম্বা গড়নের যুবক, গাঢ় নীল পাঞ্জাবি পরে এদিকেই ছুটে আসছে পাগলের মতো। হলুদ আলোয় তার নীল পাঞ্জাবি কেমন কালচে দেখায়। তার হাতে অনেকগুলো গোলাপ। ছোটার কারণে কিছু গোলাপের পাঁপড়ি ছিটকে পড়ছে রাস্তায়, যুবকের সেদিকে খেয়াল নেই। সে শুধু ছুটছে, শুধুই ছুটছে।

বহ্নি চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ খোলার সাহস পায়না। যদি সে চোখ খুলে দেখে সে যে যুবকের অপেক্ষায় এতোক্ষণ তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো, এ সেই যুবক না? এই যুবক হতে পারে কোনো ভাগ্যবতী নারীর বিশেষ কেউ। তার ভাগ্য তো এতো ভালো না, কোনোদিন না।

“মিস বহ্নি, শুনছেন? শুভ জন্মদিন। শুনতে পাচ্ছেন আপনি?”
রণের চিৎকারে বহ্নি কিছুক্ষণের জন্য যেনো নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে যায়। হৃৎপিণ্ডটাও যেনো গলার কাছে এসে থেমে গেছে। আজ তার জন্মদিন? তাই তো, উনি মনে রেখেছেন?

বহ্নি কাঁপা কাঁপা চোখে তাকায়। রণ হাঁটু চেপে ধরে হাঁপাচ্ছে। গোলাপগুলো শক্ত করে ধরা তার হাতে।
বহ্নি কখনো মহাপুরুষ দেখেনি। তার মনে হচ্ছে সে নিজের চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এক উপন্যাসের পাতার মহাপুরুষকে। যে মহাপুরুষ হতে রূপবান হওয়ার প্রয়োজন নেই, ধনবান হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু এক সমুদ্রের মতো বিশাল একটা হৃদয় থাকতে হবে। আর সে হৃদয় শুধু একজনের মায়ায় থমকে যাবে।

(চলবে……)