#মাতাল_প্রেমসন্ধি
পর্ব: ৩২
সময় যাচ্ছে আর বহ্নির বিয়ের দিনও এগিয়ে আসছে। নওশাদ চেয়েছিলো মেয়েটার গ্রাজুয়েশন শেষ হলেই বিয়েটা হবে। কিন্তু রণের দেরি সইছে না। সে বলেছে বাকি পড়াশোনা বহ্নি বিয়ের পর করবে। বহ্নি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। নওশাদ তাই ধরে নিয়েছে বহ্নির আপত্তি নেই বিয়েতে। মিয়া বিবি রাজি থাকলে সে নিজে আর আপত্তি করে কি করব? মত দিয়েছে বিয়েতে।
তবে পাল্লা দিয়ে নওশাদের বাড়ি তৈরির কাজও চলছে। নতুন জামাই আসার আগে দোতলায় অন্তত একটা ঘরের কাজ শেষ হোক। নতুন জামাই কোথায় থাকবে নাহলে?
শাহানা তো রাগ করেই বাঁচে না। নতুন জামাই আবার কি? এখানেই তো থেকেছে কতোদিন। সবকিছুতেই লোকটার বাড়াবাড়ি।
এমনই এক বিকেলে হঠাৎ রণ হাজির খাঁ বাড়িতে। বাড়িতে তখন শাহানা আর সায়েরা বাদে আর কেউ নেই। বাকিরা যে যার কাজে বাইরে।
রণকে দেখে চমকে ওঠে শাহানা। এই সময়ে তো তার আসার কথা না। সে তো জানে বহ্নি এই সময় ভার্সিটিতে থাকতে। বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায় তার।
শাহানা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,”রণ তুমি?”
রণ কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”চাচী ভালো আছেন?”
“ভালো আছি বাবা, ভিতরে এসো।”
রণ ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে। শাহানা কিছুটা বিরক্ত হয়। বিয়ের আগে ছেলেটার এতো ঘন ঘন এ বাড়িতে আসা তার পছন্দ না। কিন্তু হবু জামাই তাকে তো আর কিছু বলাও যায়না।
“তুমি কি কিছু বলবে বাবা?”
“ফুপু কোথায়?”
“আছে ভিতরেই।”
রণ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকে।
হঠাৎ মাথা তুলে বললো,”চাচী আমি যদি আপনাদের কাছে কিছু চাই, মানে আবদার করি। আপনারা কি রাখবেন?”
সহসাই কম্পিত হয় শাহানা। আবদার মানে? রণ কি যৌতুক চায়? কি চাইতে পারে সে? দামী কিছু? যদি এমন কিছু হয় কি করবে তারা? মেয়েদের বাবা তো শুধুমাত্র বিয়ের খরচটা ব্যাংক থেকে তুলে এনে রেখেছে। আরো দু’টো মেয়ে আছে, বাকিটা তাদের জন্য রাখা। আর জমি বিক্রির টাকা তো বাড়ি করতে যেয়েই শেষ হয়ে যাবে। যৌতুক চাইলে কোথা থেকে দিবে তারা? সে সামর্থ্য কই তাদের? রণ কি সবটা জানেনা? তবে আর যা-ই হোক, রণকে তো এমন লোভী মনে হয়নি কখনো। সবই কি অভিনয় ছিলো?
হাজারটা চিন্তা মুহুর্তের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে শাহানার মাথায়।
“রণ, কি আবদার তোমার? দামী কিছু? এসব আলোচনা তোমার চাচা আসলে করলেই কি ভালো হতো না?”
রণ সুন্দর করে হেসে দেয়, শাহানার হাসি আসেনা। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে রণের দিকে। ওদের কথা শুনে সায়েরাও এসে দাঁড়িয়েছে শাহানার পাশে৷ তার মন বলছে রণ খারাপ কোনো উদ্দেশ্যে এখানে আসেনি।
“কি ব্যাপার হাসছো যে?”
রণ উঠে দাঁড়ায়। শাহানার মুখোমুখি দাঁড়ায় এসে।
“হ্যা চাচী অনেক দামী কিছু, অনেক। কিন্তু এটা চাচা দিতে পারবে না। আপনি আর ফুপু দিতে পারবেন।”
শাহানা হতবাক হয়ে বললো,”এটা আবার কি বলছো তুমি? আমরা এতো দামী উপহার কীভাবে দিবো তোমাকে? তাছাড়া আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। তুমি তো জানোই সবটা। কীভাবে আশা করো আমাদের থেকে এতো দামী উপহার?”
রণ মুখ টিপে হেসে বললো,”পারবেন পারবেন। যান তো দুইজন চট করে তৈরি হয়ে নিন। দুইজনই শাড়ি পরবেন কিন্তু। আচ্ছা আপনাদের কি ধবধবে সাদা রঙের শাড়ি আছে?”
শাহানা আর সায়েরা হতভম্ব হয়ে যায়। ছেলেটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো? তারা তৈরি হবে কেনো? কোথায় নিয়ে যাবে রণ তাদের? কি দামী উপহার চায় সে ওদের কাছে?
সায়েরা জোর করে হেসে বললো,”বাবা তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমরা। তৈরি হয়ে কোথায় যাবো?”
রণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো,”ফুপু আমি রণ, সেই ছোট্টবেলায় মা’কে হারিয়েছে। মায়ের স্মৃতি বলতে একটা ছবি আছে আমার কাছে। যেই ছবিতে মা ধবধবে সাদা শাড়ি পরে মিষ্টি করে হেসে বসে আছে। আমার হয়তো অগাধ টাকাপয়সা নেই। হয়তো একদিন হবে। তবে আমার কাছে টাকাপয়সার চেয়ে অনেক দামী হলো মায়ের ভালোবাসা। কারণ আমি তা কোনোদিন আর পাবো না, পৃথিবীর সমস্ত টাকা দিয়েও কিনতে পারবো না আমি। মা বলতে তো এখন আপনারা দুইজনই আমার, আর কে আছে? তাই আমি আপনাদের থেকে একটু ভালোবাসা চাই। আর কি দামী উপহার ভেবেছিলেন আপনারা?”
শাহানা স্তম্ভিত হয়ে যায়, সায়েরার অবস্থাও তাই। রণ মিটিমিটি হাসছে তাদের দেখে।
“দেখো বাবা আমরা আসলে…..”
“আমি জানি চাচী আপনি কি বলতে চাচ্ছেন। সত্য বলতে আমাকে যে আপনার পছন্দ না এটাও আমি জানি, বুঝি।”
শাহানা কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। কেমন অপরাধবোধ হতে থাকে তার। সায়েরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“থাক এসব বলে আর বিব্রত করতে চাইনা আপনাদের। আপনারা এখন খুব তাড়াতাড়ি সাদা শাড়ি পরে তৈরি হবেন। আমি আপনাদের নিয়ে একটু বেরোবো। শুধু আমরাই, আর কেউ না।”
শাহানা ক্ষীণ গলায় বললো,”কিন্তু যাবো কোথায় আমরা?”
রণ হালকা হেসে শান্ত গলায় বললো,”আজ আমার মা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতো জানেন চাচী? তার সেই ছোট্ট রণ আজ বড় হয়ে গেছে। বিয়ে করে বউ ঘরে তুলছে। তার খুশি দেখে আমি খুশি হতাম। ইচ্ছা করতো তাকে বাজারের সবচেয়ে দামী শাড়িটা কিনে দিতে। যেটা পরে মা তার ছেলের বিয়েতে যেতো। আমার তো নিজের মা নেই, কিন্তু ওইযে বললাম এখন আমার মা বলতে আপনারা দুইজন। তাই সেই খুশিটা আমি আপনাদের দিয়ে পূরণ করতে চাই। আমি আপনাদের দুইজনকে দুইটা শাড়ি কিনে দিতে চাই। এটাই আমার আবদার আপনাদের কাছে, এটাই হবে আমার জন্য দামী উপহার।”
শাহানা বরফের মতো জমে যায়। সায়েরার চোখে পানি এসে যায় হঠাৎ। ইশ! এই ছেলেটা এতো ভালো কেনো? তাদের বহ্নিটা হয়তো ভীষণ ভাগ্যবতী যে এমন একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে যাচ্ছে।
শাহানা চাপা গলায় বললো,”না না বাবা এসব কি বলছো? এগুলোর কোনো দরকার নেই।
“দয়া করে মানা করবেন না চাচী। আমাকে এটুকু করতে দিন। আমার ভালো লাগার জন্য।”
শাহানা কিছু বলতে যেয়ে থেমে যায় রণের চোখের দিকে তাকিয়ে। কি ছিলো সেই দৃষ্টিতে শাহানা জানেনা। মায়া যেনো ঝরে পড়ছে সেই চোখ থেকে। শাহানা কিছুক্ষণ পর ক্ষীণ গলায় বললো,”তুমি বসো আমরা সাদা শাড়ি পরে তৈরি হয়ে আসছি।”
রণ ঠোঁটের কোণে আত্মবিশ্বাসী হাসি ঝুলিয়ে বললো,”ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ।”
সায়েরা অবাক হয়ে শাহানার দিকে তাকায়। তার ভাবী এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে সে ভাবতেও পারেনি। শাহানা সায়েরার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে ঘরে নিয়ে যায়। রণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে।
“আচ্ছা উৎস ভাই, আপনি কি দয়া করে বলবেন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
উৎস উত্তর দেয়না শীতলের কথার। শীতলের সব কথার উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে সে মনে করেনা।
শীতল দমে যায়না। দ্বিগুণ উৎসাহে আবার জিজ্ঞেস করে,”বলুন না কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানেই যাচ্ছো।”
“কেনো আমি জানতে পারিনা?”
“না পারো না।”
পুরোটা রাস্তা উৎস একটা কথাও বলেনা শীতলের সাথে। শীতল অস্থির হয়ে যায়। এ কোন লোকের সাথে যে প্রেম করে, কিছুই বুঝতে পারেনা। একটু বললে কি হয়?
রিকশা থামিয়ে রিকশা থেকে নামে উৎস। শীতল ভেবাচেকা খেয়ে যায়। উৎস একটা বিশাল বড় শপিং মলের সামনে নেমেছে। এতো বড় শপিং মলের মধ্যে জীবনেও ঢোকেনি সে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সে।
উৎস বিরক্ত গলায় বললো,”নামেন ম্যাডাম, নাকি এখন নামার জন্য পালকি নিয়ে আসবো?”
শীতল থমথমে মুখে নামে। সবসময় টিটকারি দিয়ে কথা বলে লোকটা।
“চলো।”
“কোথায় যাবো?”
উৎস শান্ত মুখে শীতলের দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমার একটা কিডনী বিক্রি করে দিবো। তাই নিয়ে এসেছি তোমাকে এখানে।”
শীতল রাগী গলায় বললো,”মজা করেন? শপিং মলে কিডনী কীভাবে বিক্রি করবেন?”
“তো শপিং মলে মানুষ আর কি করে?”
“এ কেমন কথা? এখান থেকে মানুষ কেনাকাটা করে।”
“তাহলে গাধী এখানে তোমাকে কি তোমার চেহারা দেখাতে এনেছি? চলো ভিতরে, চলো।”
শীতল গম্ভীর মুখে উৎসকে অনুসরণ করতে থাকে। সে ঠিক করেছে আগামী এক ঘন্টা এই অসভ্য লোকটার সাথে কথা বলবে না। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সময় চারটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট, তার মানে পাঁচটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট বাজা পর্যন্ত সে মৌনব্রত পালন করবে।
বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো একটা শাড়ির দোকানে উৎস ঢোকে। শীতল বাইর থেকেই দেখতে থাকে। কি সুন্দর দোকান, কি সুন্দর কাঁচের মতো মেঝে। মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। ম্যানিকুইন গুলো গায়ে দামী দামী শাড়ি জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় শীতল। এতো সুন্দর শাড়ি হয়? এত্তো সুন্দর। শীতলের সব কিনে ফেলতে মন চায়। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে যায় সে। ভাগ্যিস মনের কথা আর কেউ শুনতে পায়না। তাহলে সে ভারী লজ্জার কথা হতো। ব্যাগের মধ্যে দুইটা দশ টাকার নোট পড়ে আছে। তা-ও আবার একটা ছেঁড়া। ছেঁড়া বলে কোনো রিকশাওয়ালাও নিতে চায়না। এই বেহাল দশায় নাকি সে এতো দামী শাড়ি কিনবে।
“কি হলো কি? বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
শীতল উত্তর দেয়না। এক ঘন্টা হতে এখনো পঞ্চাশ মিনিট বাকি।
আচমকাই উৎস শীতলের হাত চেপে ধরে। শীতল স্তব্ধ হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য। প্রতি মুহুর্তেই মানুষটা তাকে স্পর্শ করে আর সে মনে করে একদম নতুন। এমন ছোঁয়া এর আগেই কখনোই পায়নি সে। কবে এই ছোঁয়া পুরোনো হবে তার কাছে কে জানে? তবে সে চায় কখনোই যেনো এই স্পর্শ পুরোনো না হয় তার কাছে। লক্ষ হাজার বার স্পর্শ পাওয়ার পরেও না।
দোকানদার সুন্দর করে হেসে বললো,”কেমন শাড়ি চাচ্ছেন আপনি বলুন স্যার?”
শীতল তাড়াতাড়ি করে বললো,”না না আমরা তো শাড়ি কিনতে আসিনি।”
দোকানদার মুখ কালো করে ফেলে। আজকালকার কম বয়সী ছেলেমেয়েগুলো এসবই করে। হাজারটা শাড়ি মেলে, দেখে এরপর না নিয়েই চলে যায়। নির্ঘাৎ এরা তেমন কেউ।
উৎস চোখ কটমট করে তাকায় শীতলের দিকে। শীতল চুপসে যায়।
“তোমাকে কেউ এতো কথা বলতে বলছে কেউ?”
শীতল অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”এখনো এক ঘন্টা হয়নি, তাই কিছু বললাম না।”
“মানে? কিসের একঘন্টা?”
শীতল উত্তর দেয়না। উৎস রাগে গজগজ করতে করতে বেশ কিছু শাড়ি বের করতে বলে দোকানদারকে। উল্টেপাল্টে দেখে সবগুলো। কোনটাই মনের মতো হয়না তার।
শীতল ব্যাগের থেকে ছোট্ট একটা পুতুল বের করে। উৎস কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারেনা। এই মেয়ে কি এখনো বাচ্চা? পুতুল ব্যাগে নিয়ে ঘুরছে কেনো?
“এই পুতুল শোন, উনাকে বলে দে তো। শাড়ি পরলে উনাকে খুব পচা লাগবে।”
উৎস হতভম্ব হয়ে যায় শীতলেত কান্ডকারখানায়।
“এই তুমি কি বললে? আমি পরার জন্য শাড়ি কিনছি?”
শীতল মুখ টিপে হাসতে থাকে অন্যদিকে তাকিয়ে। উৎস ভিতর ভিতর রেগে অস্থির হয়ে যায়, প্রকাশ করেনা উপরে।
বেশ অনেকগুলো শাড়ি দেখার পর হঠাৎ একটা শাড়িতে চোখ আটকে যায় উৎসের। একদম সেই শাড়ি, যা তার পছন্দ। কালো আর রানী গোলাপির মিশেল, সাথে রূপোলী কাজ করা ভিতরে। এতো সুন্দর শাড়ি সে আগে কেনো দেখেনি?
শাড়িটা হাতে তুলে নেয় উৎস। শীতলেরও চোখে গেছে সেদিকে। চোখ দু’টো চকচক করে ওঠে তার। শাড়ি এতো সুন্দর হয়? ইশ কথা না বলার প্রতিজ্ঞা যে সে কেনো নিয়েছিলো। নাহলে তো জিজ্ঞেস করা যেতো, শাড়িটা কার?
দোকানদার গম্ভীর গলায় বললো,”দাম কিন্তু বেশি এটার, বুঝে শুনে হাতে নিয়েন।”
উৎস ঝট করে তাকায় তার দিকে।
“এই শাড়ি যার জন্য নিবো তার দামের কাছের পৃথিবীর আর কোনোকিছুর দাম বেশি নয়। আমি এটাই নিবো, যতো দাম হোক।”
শীতল অবাক হয়ে তাকায় উৎসের দিকে। তবে কি উৎস ভাই শাড়িটা তার জন্য নিলো? ঠোঁট কেঁপে ওঠে তার।
দাম পরিশোধ করে উৎস শাড়ির প্যাকেটটা নিয়ে হাঁটতে থাকে। পিছন পিছন দৌড়ায় শীতল। অদ্ভুত, তাকে নিয়ে এসে শাড়ি কিনে এনে তাকে ফেলেই কিনা চলে যাচ্ছে?
এক ঘন্টা এখনো হয়নি। শীতল মৌনব্রতের গুলি মেরে উৎসের দিকে তাকিয়ে বললো,”শাড়িটা দিন আমাকে।”
“তোমাকে কেনো দিবো?”
শীতল মুখ কালো করে বললো,”আমার জন্য এনেছেন তো আমাকে দিবেন না?”
“কখন বললাম তোমার জন্য এনেছি?”
শীতল কান্নাজড়িত গলায় বললো,”তাহলে কার জন্য এনেছেন? কে আপনার কাছে সবচেয়ে দামী? ফুপু তো এমন শাড়ি পরেনা।”
উৎস নিজের চুল ঠিক করতে করতে বললো,”আগামী পরশু প্রত্যাশার জন্মদিন। দাওয়াত করেছে, যেতেই হবে। খালি হাতে তো যাওয়া যায়না, তাইনা?”
শীতল থমকে দাঁড়ায়। এই মুহুর্তে এখানেই বসে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। তার মানে এই শাড়ি ওই শাঁকচুন্নিটার জন্য কিনেছে?
“কি হলো দাঁড়িয়ে পরলে কেনো?”
“তো কি করবো? আমাকে কলেজ থেকে ক্লান্ত শরীরে এখানে এনে আপনার প্রত্যাশার জন্য শাড়ি কিনতে এসেছেন? তা-ও আবার সে নাকি আপনার কাছে অনেক দামী কেউ?”
উৎস উত্তর দেয়না। মেয়েটা মনে হয় এবার কেঁদেই দিবে সত্যি। ঠোঁট বাঁকানো শুরু করেছে কেবল।
“হ্যা হবে না কেনো? আমি তো আর সুরেলা গলায় দুষ্টু বলে ডাকতে পারিনা।”
উৎস জোর করে হাসি চেপে রেখে বললো, না ডাকতে পারলে শিখে নাও, সমস্যা নাই তো। তুমি বললে প্রত্যাশা তোমাকে শিখিয়ে দিয়ে যাবে।”
শীতল রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,”দরকার নেই আমার শেখা, যত্তসব।”
উৎসকে একা রেখেই শীতল ছুটে চলে যায় সেখান থেকে। তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আস্তে আস্তে হেসে এরপর জোরে শব্দ করে হেসে দেয় সে। মেয়েটা এতো বোকা কেনো? এতো বোকা কেনো হতে হবে কাউকে? এতো মায়া লাগে উৎসের, ওর বুকটা মুহুর্তের মধ্যে কেমন শূন্য শূন্য লাগে।
সন্ধ্যার কিছু সময় পর পরই রণ শাহানা আর সায়েরাকে বাড়ি নামিয়ে দেয়। শাহানা চুপচাপ, কোনো কথা বলতে পারছে না। রণ তাদের এতো দামী শাড়ি কিনে দিবে সে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। তাদের কোনো বারণ রণ শোনেনি। লজ্জায় শাহানা চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। ভিতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে তার।
“যান চাচী বাড়ি যান।”
শাহানা আস্তে করে বললো,”তুমিও চলো। রাতে খেয়ে যাবে।”
রণ প্রশান্তির হাসি হেসে বললো,”আজ আপনারা আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন চাচী, আমার আর খাওয়া লাগবে না। পেট, মন, মস্তিষ্ক সব ভরে গেছে। বিশ্বাস করুন, আজকের মতো খুশি আমি খুব কমই হয়েছি। আমার ইচ্ছা করছিলো যেনো পুরো দোকানটাই আপনাদের কিনে দিই।”
রণ দুই আঙ্গুল চোখে ঠেকায়, হয়তো নিজের আবেগটুকু প্রকাশ করতে চাচ্ছেনা এখন সে এই দুই মানবীর সামনে।
শাহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”জানো আমার একটা ছেলে বাচ্চার শখ ছিলো অনেক। পেলাম না, তিনটা মেয়ে হলো। সায়েরার উৎস হওয়ার পর যখন আমার শীতল হলো, তখন আমার ভারী হিংসা হয়েছিলো, কেনো আমার একটা ছেলে হলো না। পরে অবশ্য সেসব ভুলে গিয়েছি কবেই। আমার তিন মেয়ে আমার কাছে রত্ন। তবে মনের কোথায় যেনো একটা চাপা কষ্ট থেকেই গেছে। তবে আজ মনে হচ্ছে আমার সেই কষ্ট সত্যিই ফুরোনোর দিন এসে গেছে। সত্যিই আমার ছেলে এসে গেছে।”
রণ থতমত খেয়ে বললো,”চাচী….”
শাহানা স্মিত হেসে বললো,”মা কে বুঝি কেউ চাচী বলে ডাকে?”
রণ উত্তর দেয়না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে চোখে উপচে পড়া পানিটুকু মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রাখে সে।
“জোর করবো না, মন থেকে চাইলে মা বলে ডেকো। সায়েরা চলে এসো।”
সায়েরা রণের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে গেটে ঢোকার মুখে হঠাৎ থমকে যায় দুইজনই।
“মা….”
শাহানা অপ্রস্তুত হয়ে পিছনের দিকে তাকায়। রণ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“আরেকবার ডাকবো?” রণের কণ্ঠে আশকারা চাওয়ার আবেগ।
শাহানা যন্ত্রের মতো বললো,”যতোবার ডাকলে তোমার মনে স্বস্তি আসবে ততবার ডাকো।”
রণ ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখে কিছুক্ষণ।
“চোখের পানি আটকে রাখতে নেই, ছেড়ে দাও। ওরা বাইরে বেরোলেই হৃদয় হালকা হয়।”
রণ কান্নাজড়িত গলায় বললো, মা মা মা….”
“মা এতোক্ষণ কোথায় ছিলে তোমরা? আমরা দুশ্চিন্তায় শেষ। আর তোমার চোখ এমন ফোলা আর লাল কেনো? কেঁদেছো তুমি?”
বহ্নির কথা শেষ হওয়ার আগেই নওশাদ ছুটে আসে।
“কি হলো? চুপ করে আছো কেনো? কোথায় গিয়েছিলে দুইজন আমাদের না বলেই? আর হাতে এসব কি?”
শাহানার বুকটা ভার হয়ে আছে, সে কোনো কথা বলতে পারেনা।
অসহিষ্ণু হয়ে নওশাদ সায়েরার কাছে যেয়ে দাঁড়ায়, তার চোখেও পানি।
“কি হয়েছে তোদের বলবি দয়া করে? সমস্যা কি তোদের বুঝিনা।”
শাহানা শক্ত গলায় বললো,”বহ্নির বাবা।”
“বলো।”
“নতুন ঘর উঠতে আর কতোদিন লাগবে?”
নওশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,”এইতো আর অল্প কিছুদিন, কেনো?”
“যতো তাড়াতাড়ি পারো শেষ করো। আমার রণ এসে কি পুরোনো ঘরে উঠবে? আর হ্যা, নতুন আসবাবপত্রও কিনতে হবে। কাল একবার শ্যামল কাকার গোডাউনে যাবো। উনার কাঠের আসবাবগুলো বেশ ভালো। একা যেও না তুমি আমার। রণের জন্য যা কেনার আমি কিনবো। তোমার রুচিতে ভরসা নেই।”
গটগট করে হেঁটে শাহানা চলে যায় কথাটা শেষ করেই। সায়েরা কান্নার মধ্যেই ফিক করে হেসে দেয়।
আর নওশাদ, বহ্নির কথা তো বলাই বাহুল্য। দুইজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে শাহানার দিকে। কি এমন হলো যে এক বেলার মধ্যেই মন পালটে গেলো? শেষে কিনা আমার রণ? বাপ রে, বাপ! কাহিনী কি?
সায়েরা ছুটে পালায়। থাকুক বাপ বেটিতে দুশ্চিন্তায় কিছুক্ষণ, তার কি?
বেশ অনেক রাতে উৎসের ঘরের মধ্যে কেমন দমবন্ধ লাগতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পর যখন সে নিশ্চিত হলো ঘুম আজ রাতে আর আসবে না তখন সে বিরক্ত মুখে বিছানা থেকে নেমে যায়। ট্রাউজারের পকেটে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার ঢুকিয়ে বেরিয়ে আসে সে।
ছাদে আসতেই রেলিঙ ঘেঁষে একটা সরু কায়ার নারীমূর্তি থেকে থমকে যায় সে। বাতাসে তার চুল, ওড়না উড়ছে। উৎস দূর থেকেই নিশ্চিত হয়, এটা আর কেউ না, তার অনুপমা।
উৎস পা টিপে টিপে অনেকটা কাছে এসে দাঁড়ায় শীতলের। হঠাৎ সে টের পায় শীতল গুণগুণ করে কাঁদছে। একটু পর পর নাক টানার শব্দ আসছে। চমকে যায় সে। শীতলের কান্না অস্বাভাবিক কিছু না। সে প্রতিনিয়তই কাঁদছে কোনো না কোনো কারণে। তবে আজকের কান্নাটা অন্যরকম। ভিতরে কোনো একটা চাপা কষ্ট নিয়ে কাঁদছে সে। তীব্র যন্ত্রণার তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসছে হালকা শব্দ করে। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই শব্দ রোমাঞ্চকর শোনায়।
“শীতল।”
কেঁপে উঠে পিছনে তাকায় শীতল। ঘোর লাগা চোখে উৎস তাকিয়ে আছে তার দিকে।
শীতল কালবিলম্ব না করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
উৎসও দেরি না করে তার হাত ধরে তাকে আটকায়।
“ছাড়ুন।”
“ছাড়বো, আগে বলো কাঁদছো কেনো?”
“কাঁদছি না।”
“চোখে পানি দেখছি তো।”
“সুখে কাঁদছি, হয়েছে?”
উৎস হ্যাঁচকা টান দিয়ে শীতলকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। শীতল কিছুক্ষণ হাত পা ছোড়াছুড়ি করে নিজেকে উদ্ধারের জন্য।
উৎস নেশাক্ত গলায় শীতলের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”সুখে কাঁদার মতো সুখ তো তোমাকে এখনো দিইনি। তাহলে কোন সুখে কাঁদছো?”
শীতলের শরীর শিহরিত হলেও মুখে রাগ দেখিয়ে বললো,”ছাড়ুন, ভালো লাগছে না।”
“না ছাড়লে কি করবে?”
শীতল সজল চোখে তাকায় উৎসের দিকে। উৎস কিছুটা দমে যায়। চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে শুকতারার মতো। ফোঁটায় ফোঁটায় মুক্তোধারা পড়ছে সেখান থেকে। শুষে নিতে ইচ্ছে করে সেটুকু, নিয়ন্ত্রণ করার উপায় কি?
“যান যার জন্য শাড়ি কিনেছেন তাকে যেয়ে চেপে ধরুন।”
উৎস কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে শীতলের দিকে। শীতল নাক টানতে থাকে।
পরক্ষণেই শব্দ করে হেসে দেয় উৎস, বেশ শব্দ করে।
শীতল অসম্ভব রাগী গলায় বললো,”সমস্যা কি? হাসছেন কেনো?”
“এসো আমার সাথে।”
“না আপনার সাথে আর কোথাও যাবোনা আমি। কাল থেকে কলেজ থেকেও আনতে যাবেন না আমাকে।”
“বেশ যাবো না, এখন শেষবারের মতো এসো।”
শীতল তা-ও এক পা এগোয় না।
“যাবে না তুমি?”
“না।”
“বেশ।”
শীতলকে আচমকাই কোলে তুলে নেয় উৎস পাজাকোলা করে। ভয়ে শীতল চোখ বন্ধ করে ফেলে প্রথমে।
“ছাড়ুন, পড়ে যাবো তো।”
উৎস শীতলের কোনো কথা শোনেনা। সোজা তার ঘরের মধ্যে এনে দাঁড় করায়।
“আমাকে ঘরে নিয়ে এলেন কেনো?”
“আদর করবো তাই।”
শীতল স্তম্ভিত হয়ে যায় উৎসের কথা শুনে। বুক কাঁপতে থাকে তার। উৎস মাতাল মাতাল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
শীতল চোখ নামিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি যাচ্ছি।”
“ভয় পেলে?”
“না।”
“শীতল, আমার অনুপমা। ভালোবাসলে সুযোগ নিতে হয়না। ভালোবাসতে হয় সিংহের মতো, আদর করতে হয় ক্ষীপ্রতা আর বন্যতার সাথে। প্রেম ছড়িয়ে দিতে হয় প্রতিটা ভাঁজে, যাতে সহজেই বুঝতে পারো কেনো আমি প্রতিনিয়ত ভিতরের আগুন ধূম্রশলাকার মুখ থেকে ধোঁয়া হিসেবে উড়িয়ে দিই।”
“উৎস ভাই….”
উৎস শীতলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে যায় অন্যদিকে। বিছানার নিচ থেকে শাড়ির প্যাকেটটা এনে শীতলের দিকে বাড়িয়ে দেয়। শীতল কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়।
“এটা তোমার।”
“মানে?”
“মানে হলো পৃথিবীর ওই দামী নারীটি হলে তুমি। তুমি জানো না তা?”
শীতল লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। অদ্ভুত একটা শান্তিতে বুকটা ছেয়ে যায় তার।
“বহ্নির বিয়েতে এটা পরবে তুমি। আর হ্যা, খোঁপায় বেলীর মালা পেঁচাতে ভুল হয়না যেনো।”
শীতল মাথা নিচু করে কুটকুট করে হাসে।
“পছন্দ হয়েছিলো তো তোমার?”
“খুব। ইচ্ছা করছে এখনই পরতে।”
উৎস ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,”পরবে? বেশ পরো।”
শীতল আরো অবাক হয়ে বললো,”এখানে?”
“আমি চোখ বন্ধ করে থাকবো। খুলবোই না।”
“অসভ্য একটা।”
উৎস্র বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে শীতল নুপুরের ঝুমঝুম আওয়াজ করতে করতে চলে যায়। উৎস সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,”তোরে খুব আদর করতে ইচ্ছা করছে রে ময়না, কবে বুঝবি তুই? বুকের অবাধ্য শূন্যতা নিয়ে তোর বিরানভূমি ছুঁই। যেদিন বুঝবি, পূর্ণ করবি শুন্য খাঁচা, পোষ মানবো সেদিন তোর, তার আগ পর্যন্ত তোর শীতল ছোঁয়ায় আমায় একটু বাঁচা।”
উৎস ঈষৎ হেসে জামা পাল্টাতে থাকে। ভোরের আগেই তাকে বেরোতে হবে, মিশন রসুনের ব্যবসা।
দরজায় একনাগাড়ে ঠকঠক চলছে। রণ চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। মাথার কাছে রাখা হাতঘড়িতে সময় দেখে রাত তিনটা কুড়ি বাজে। এই অসময়ে কে এলো? কারো কোনো বিপদ হলো না তো? তার বাবা সেই যে গ্রামে গেছে এখনো ফেরেনি। বিপদের কথা মনে পড়তেই লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে যায় সে। গায়ে কোনো রকমে শার্টটা চাপিয়ে দরজা খুলতেই অবাক হয়ে যায়। বাইরে অপরিচিত একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কালো চাদরে ঢাকা শরীর। শুধু চোখ দু’টো আর নাক দেখা যাচ্ছে চাদরের ফাঁকা দিয়ে।
“রণ ভাই?”
রণ অবাক হয়ে বললো,”হ্যা, কে তুমি?”
ছেলেটা মাথার উপর থেকে চাদর ফেলে দিয়ে বললো,”আমাকে আপনি চিনবেন না। আমার নাম আজাদ। উৎস ভাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনার কাছে।”
রণ চমকে উঠে বললো,”উৎস পাঠিয়েছে তোমাকে? এতো রাতে? কেনো?”
আজাদ দাঁত বের করে হেসে বললো,”আপনি নাকি ভাইয়ের সাথে রসুনের ব্যবসা করতে চাইছেন।”
রণের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ কর ফেলে সে।
“তুমি সত্যি বলছো? আজকেই?”
“আরে চলেন, ব্যাপক মজা পাইবেন। সজীব্বা আজকা মনে করেন শ্যাষ। না না মেরে ফেলা হবে না। তবে ব্যাটা মানুষের ইঞ্জিন ছাড়া তার জীবন একরকম শেষই বলা যায়। জীবনযৌবন হারিয়ে সজীব্বা গান করবে, ওরে ওদের কেউ বোঝা, এতোই কি সোজা? তখন আমরা গাইবো, যতোই ডাকো ওঝা, আজকে হবি-ই তুই খোজা, বউয়ের সাথে খেলতে যেয়ে বুঝবি কেমন মজা।”
রণ শব্দ করে হাসে। উৎসের সাথে মেশা সবগুলোই বুঝি ওর মতোই চিজ একেকটা।
“চলো চলো।”
“আপনি কি লুঙ্গি পরেই যাবেন নাকি?”
রণ লাজুক হেসে বললো,”দেখেছো কান্ড, উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছি। তুমি এক মিনিট অপেক্ষা করো।”
আজাদ হাই তুলে বললো,”সমস্যা নেই, তৈরি হয়ে নেন। আমাদের রেখে ভাই ব্যবসা শুরু করতেই পারেনা।”
মদ খেয়ে টাল হয়ে ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরছে সজীব। ড্রাইভারকে আনেনি, নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে। হঠাৎ সামনে চারটা যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে।
“ধুর শালা, নেশা কি বেশি হয়ে গেলো? এখানে এরা কারা? আমার গাড়ি আটকে রাখবেই বা কেনো?”
সে বার বার হর্ণ দেয় সজীব। ছেলেগুলো সরেনা। আজব ব্যাপার, সবার গায়ে কালো চাদর পেঁচানো।
সজীব রাগে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।
“এই আপনারা কারা? সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ও বুঝতে পারছি ছিনতাইকারী। বড়লোকের ছেলে দেখলেই চলে আসেন তাইনা? কাজ কর্ম নাই?”
তাদের মধ্য থেকে গম্ভীর ভারী পুরুষালি গলায় একজন বললো,”অবশ্যই আছে, আমরা ব্যবসায়ী মানুষ।”
“ব্যবসায়ী মানুষ আমার কাছে কি চাই?”
“রসুন চাই, দুইটা রসুন।”
“তার মানে? আমি রসুন পাবো কোথায়? এই যান তোও, সরুন। রাতবিরেতে বিরক্ত করবেন না।”
হঠাৎ গাড়ির পিছন সীটের দিকে চোখ যায় উৎসের, কেউ একজন আছে ওখানে। আজাদকে চোখের ইশারা করতেই আজাদ চলে যায় সেখানে।
সজীব চিৎকার করে বললো,”এই ওদিক যাচ্ছেন কেনো? কি সমস্যা?”
আবির সজীবের মুখ চেপে ধরে। ধস্তাধস্তি চলে, রণও যোগ দেয় আবিরের সাথে। নেশাক্ত, মাতাল সজীব কীভাবে পারবে ওদের সাথে?
আজাদ হঠাৎ চিৎকার করে বললো,”ভাই মেয়ে আছে এখানে। সম্ভবত বেঁধে রেখেছে। কাঁচ আটকানো, দেখতে পাচ্ছি না ভালো।”
উৎস শান্ত চোখে তাকায় সজীবের দিকে। এরপর আজাদকে উদ্দেশ্য করে কোমল গলায় বললো,”আমি দেখছি, চলে আয়।”
আবির উৎসের দিকে তাকিয়ে বললো,”কি করবি এখন?”
উৎস মুচকি হেসে বললো,”রস বের করবো, রস।”
(চলবে……)
#মাতাল_প্রেমসন্ধি
পর্ব: ৩৩
ঝুম রাত, কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আবহাওয়া এতো স্নিগ্ধ, এতো সুন্দর। গরমের ভাবটা নেই বললেই চলে। অথচ সারাটা দিনই ছিলো গুমোট গরম। বিকেলের পর ছোট করে বহ্নির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটুকু হয়ে গেলো। বহ্নির জাঁকজমক আয়োজন পছন্দ না। হলুদের জন্য আলাদা করে অনুষ্ঠান হোক একদমই চায়নি সে। কিন্তু নওশাদের মন মানেনি। তার বড় মেয়ে, তার শরীরের একটা অংশ। আজ বাদে কাল চলে যাবে। হয়তো একই শহরেই থাকবে, সপ্তাহে কম করে হলেও দুই থেকে তিনবার দেখা হবে। তবুও বিয়ে তো বিয়েই। মানুষ বলে, বিয়ে হলে মেয়ে পর হয়ে যায়। এক বাড়ির আলো নিভিয়ে আরেক বাড়ির আলো জ্বালায়। নওশাদ যদিও এসব আমলেই নেয় না। মেয়ে তার কাছে কোনোদিন পর হবে না। তার দরজা তার মেয়েদের জন্য সবসময় খোলা। মেয়েরা যে কোনো সময় ঝাপিয়ে পড়বে তার বুকে এসে, কোনো বাঁধা থাকবে না।
অনাড়ম্বরভাবে চাইলেও বেশ সুন্দর করেই হয়েছে হলুদের অনুষ্ঠান। কুসুমরঙা জামদানীতে দেবীর মতো সুন্দর লাগছিলো বহ্নিকে, পরেছিলো কাঁচা হলুদ রঙের গাঁদাফুলের তাজা মালা। খোঁপায়, গলায়, হাতে। সামান্য সাজে কোনো নারীকে এতোটা রূপবতী লাগতে পারে নওশাদের ধারণাতে ছিলো না। সে বেশিক্ষণ তাকাতে পারেনি মেয়ের দিকে। বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। পুরো অনুষ্ঠানে সে ছিলোনা। বহ্নির অবাধ্য চোখজোড়া বারবার খুঁজেছে বাবাকে। সেই যে কপালে সামান্য হলুদ ছুঁইয়ে বাবা চলে গেলো, আর এলো না তার সামনে। টলমলে একজোড়া চোখ ইতিউতি উঁকি দিয়েছে বারবার, কিন্তু না কোথাও বাবা নেই। বাবার বুকের মধ্যে কোন ঝড়টা তাণ্ডব ঘটাচ্ছে বহ্নি বোঝে। কেনো হলো এমন অদ্ভুত নিয়ম কে জানে! ছেড়েই যদি যেতে হবে ভালোবাসার মানুষগুলোকে, তবে অন্তরে এতো মায়া দিলো কেনো খোদা?
ছাদে উৎসের সিগারেট খাওয়ার জায়গায় ঘর উঠেছে। নতুন জামাইয়ের জন্য একটা ঘরের কাজই শেষ হয়েছে মাত্র। তাই উৎসকে বাধ্য হয়ে মাঝরাতে উঠোনে আসতে হয়। কিছুক্ষণ তারাদের সাথে কথা বলা আর একমনে ধোঁয়া ছাড়া।
“উৎস বাবু।”
উৎস চমকে উঠে তাকায়। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে বহ্নি, তার হাতে একটা কাঁসার বাটি। হলুদ শাড়ি পালটে একটা লাল পাড়ের ধূসর রঙা শাড়ি পরেছে সে। মুখে কোনো প্রসাধনীর ছিঁটেফোঁটা নেই, গহনাগাটির বহর নেই শরীরে। তবুও যেনো রূপ ঠিকরে বের হচ্ছে তার। বিয়ে ঠিক হলে মেয়েদের রূপ কয়েকগুণে বেড়ে যায় বোধহয়।
উৎস উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকায়। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়।
বহ্নি অনুৎসাহিত না হয়ে উৎসের পাশে এসে বসে। বাটিটা এগিয়ে দেয় উৎসের দিকে।
“নে খা।”
“কি এটা?”
“আমের আচার, ফুপু বানিয়েছে। যা বানিয়েছে না! ভাবছি পুরোটাই নিয়ে যাবো সাথে করে।”
উৎস আরো চমকে উঠে বললো,”কোথায় যাবি তুই?”
বহ্নি মুখ টিপে হেসে বললো,”বাহ রে, কাল আমি চলে যাবো না? ভুলে গিয়েছিস নাকি?”
উৎসের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ঢোক চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সে। নিজের দূর্বলতা বোঝানো যাবে না, কোনোভাবেই না।
“কি রে কিছু বলছিস না যে?”
“কি আর বলবো। অনেক জ্বালিয়েছিস। সিগারেট খেতে মানা করেছিস, না খেয়ে ভার্সিটিতে যেতে দেখলে বকা দিয়েছিস, জোর করে ঘর গুছিয়ে দিয়েছিস। ভালো হবে তুই চলে গেলে। আর এসব খবরদারি করবে না কেউ আমার উপর। যা তো তুই।”
বহ্নি বাটিটা পাশে রেখে মুখে হাত চেপে নিঃশব্দে হাসে।
“সত্যি বলছিস?”
উৎসের ঠোঁটজোড়া ঈষৎ কেঁপে ওঠে, উত্তর দিতে পারেনা।
বহ্নি উঠে এসে উৎসের সামনে এসে দাঁড়ায়। উৎস ভুলেও তাকায়না সেদিকে।
“তাকা আমার দিকে।”
“ঘুমাবি না তুই? না ঘুমালে সকালে তোকে ডাইনীর মতো লাগবে। রণ ভাই উলটো দৌড়াবে বিয়ে না করে।”
“তোকে আমি তাকাতে বলেছি আমার দিকে, বেশি কথা বলিস না।”
উৎস তাকাতে চায়না, বহ্নি জোর করে তার মুখ টেনে ধরে সামনে তুলে ধরে। সাথে সাথে শিউরে ওঠে সে। বারান্দা থেকে ষাট পাওয়ারের একটা বাল্বের আলো কিছুটা এসে পড়েছে উঠোনে। সেই হালকা আলোয় বহ্নি স্পষ্ট দেখলো উৎসের চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের কান্নাটুকু গিলে ফেলার চেষ্টা করছে সে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন।
“উৎস, কি হয়েছে বাবু? কাঁদছিস তুই?”
উৎস বহ্নিকে হালকা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো,”খেয়ে কাজ নেই, কাঁদবো কেনো আমি? আমি তো খুশি তুই চলে যাচ্ছিস তাই।”
“তাহলে তোর চোখ লাল কেনো?”
উৎস বাম হাতে দুই চোখ চেপে ধরে বললো,”পোকা পড়েছে চোখে।”
বহ্নি ম্লান হেসে উৎসের কাঁধে হাত রাখে। উৎস কেঁপে ওঠে আবারও। এতোটা নিয়ন্ত্রণহীন কষ্ট কোনোদিন লাগেনি তার৷ এমন কেনো লাগছে সে বুঝতে পারছে না। কোনো যুক্তি দিয়েই নিজেকে সামলাতে পারছে না সে।
“উৎস পোকাটাকে বের করে ফেল। তোর চোখে পানি মানায় না।”
উৎস কিছুক্ষণ পা দিয়ে মাটি ঘষতে ঘষতে হঠাৎ থেমে যায়। আচমকা বহ্নিকে অবাক করে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। বহ্নি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
“উৎস….”
“বহ্নি তুই যাস না, তুই যাস না। আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি কীভাবে থাকবো তোর শাসন ছাড়া? কে আমাকে বকবে? কে আমাকে জোর করে খেতে বসাবে? আমার এলোমেলো রুটিনকে কে শাসন করে গুছিয়ে দিবে?”
বহ্নি মৃদু হেসে উৎসের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।
“কেনো? তোর অনুপমা আছে না?”
উৎস টকটকে লাল চোখে বহ্নির দিকে তাকায়।
“আমার বোনটাকে অনেক ভালো রাখতে হবে উৎস, অনেক ভালো। বিশ্বাস কর, ওর কোনো লোভ নেই। ওর শুধু একটাই লোভ, তা হলো তুই। তোর ভালোবাসা পেলে ওর আর কিচ্ছু লাগবে না। ওকে তোর সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসিস। ও খুব ভীতু উৎস। ও ভয় পায়, যদি তোর কোনো বিপদ হয়ে যায়। প্রায় রাতে ও নিঃশব্দে কাঁদে জানালায় মাথা রেখে। আমি ঘুমাইনা, স্পষ্ট শুনতে পাই আমার ওইটুকু বোনের কান্নার আওয়াজ। কষ্ট হয় আমার। ধরা দিইনা, পাছে আবার লজ্জা পায় কিনা মেয়েটা। তবে বোনটা তো আমার, আমি বুঝি ওর কান্নার কারণ, ওর কষ্টের উৎস। কারণটা শুধু তুই। ও বোকা, ও ছিঁচকাঁদুনে কিন্তু ওর মধ্যে কোনো ভান নেই রে। ও পুরোটাই তোর। একদম নরম কাদামাটির মতো। তুই ওকে যেভাবে গড়ে নিবি, ও সেভাবেই তোর সাথে লেপ্টে থাকবে। ওকে আর কষ্টটুকু দিস না তুই, দুশ্চিন্তা দিস না।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে বহ্নি থামে।
উৎস মাথা নিচু করে ভরাট গলায় বললো,”বহ্নি ওকে আমি আমার নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসি, এটা কি তুই জানিস, বুঝিস?”
বহ্নি স্মিত হেসে বললো,”জানি।”
“ওকে না কিছুক্ষণ না দেখলে আমার শরীর অবসাদে ছেয়ে যায়। আমার বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, দমটা বন্ধ হয়ে আসে। আমি ওকে কীভাবে কষ্ট দিবো বহ্নি? ওকে কষ্ট দিলে যে তার কয়েকগুণ কষ্ট আমাকে স্পর্শ করবে। ওকে কোনো কষ্ট ছোঁয়ার আগে আমার লা’শের উপর থেকে অতিক্রম করতে হবে, আমি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নিজের কাছে।”
বহ্নির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সাথে সাথেই মুছে ফেলে সে হাসিটা।
“তুই ভাবিস না, তোর আদরের বোনকে আমি রানী বানিয়ে রাখবো, একদম আমার বুকের ভিতর।”
বহ্নি একটা বড় করে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। তাদের তিন বোনের জীবনটা যেনো এভাবেই সুখে কেটে যায়, যেভাবে কেটেছে তার বাবা আর বাবার দোয়েল পাখির জীবন।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটে দুইজনের। কেউ যেনো কোনো কথা খুঁজে পায়না। এমন একটা অবস্থা যে কথা বলতে বলতে রাত কেটে যাবে তবু গল্প ফুরোবে না। কিন্তু বলার সময় কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না, অদ্ভুত!
নীরবতা ভেঙে বহ্নিই প্রথম কথা বলে।
“আচ্ছা উৎস একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“কর।”
“সত্য করে বলবি।”
“তোকে আমি মিথ্যা বলেছি কখনো?”
বহ্নি একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,”সজীবকে তোরা কি করেছিস?”
উৎস উত্তর না দিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে থাকে।
“কি হলো বল? কি করেছিস তোরা ওর?”
“কি আবার করবো?”
“ওকে অনেকদিন দেখছি না, কি হয়েছে ওর?”
“কেনো? খুব মনে পড়ছে বুঝি ওকে?”
“উৎস ফাজলামি করিস না, যা জিজ্ঞেস করছি ঠিকমতো উত্তর দে।”
উৎস একটা হাই তুলে বললো,”ওর খৎনা করিয়ে দিয়েছি। শুধু পার্থক্য হলো, এটা এমনই এক খৎনা যে, ওর পোলার খৎনা করা লাগবে না। কারণ ওর পোলাই হবে না আর, পোলা-মাইয়া কিছুই হবে না।”
বহ্নি হালকা চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়ে।
“তার মানে?”
“মানে আবার কি? সহজ বাংলায় যাঁহাকে বলে, খোজা। খোজা করে দিয়েছি ওকে। হয়েছি ওঝা, করেছি খোজা। সজীব্বা চান্দু বুঝবে এবার মজা।”
বহ্নি থমথমে গলায় বললো,”তোদের সাথে ওই বোকাচন্দ্রটাকেও নিয়েছিস তাইনা?”
“এই শোন, তোর বরকে আর যাই হোক বোকা বলিস না। কি জিনিস মাইরি, অস্থির।”
বহ্নি রাগী গলায় বললো,”থাম তুই, এসব কি করেছিস তোরা?”
উৎস শান্ত গলায় বললো,”ও যেই অপরাধ করেছে, ওকে যে আমি এখনো দুনিয়ায় বাঁচিয়ে রেখেছি এটা ওর সৌভাগ্য। আমার ইচ্ছা ছিলো ওকে জ্যান্ত পুঁতে দিবো। কিন্তু না, অনেক ভেবে দেখলাম ও তোকে যে যন্ত্রণাটা দিয়েছে, তার শাস্তি ওকে সারাজীবন ধরে পেতে হবে। ও একটা মুহুর্তের জন্যও শান্তি পাবে না বেঁচে থেকে। আর কোনো মেয়ের সর্বনাশ করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না, কারণ ওর সেই ক্ষমতা আর নেই।”
বহ্নি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আচমকা ফিক করে হেসে দেয়।
“কবিতাটা আরেকবার বল তো।”
“হয়েছি ওঝা, করেছি খোজা। সজীব্বা চান্দু বুঝবে এবার মজা।”
উৎসের গম্ভীর গলায় এমন হাস্যকর কিছু শোনাটা বহ্নির ভীষণ মজা লাগে। সে শব্দ করে হেসে দেয় এবার, উৎসও হাসে আস্তে আস্তে।
“তুই কি ভালো হবি না উৎস?”
“তোর বোনটাকে দিয়ে দে, আদর করে ভালো হয়ে যাবো। একদম সত্যি বলছি।”
“উৎস ভুলে যাস না আমি তোদের বড় বোন, ইজ্জত দিয়ে কথা বল।”
“ইজ্জত কি? খায় না মাথায় দেয়?”
বহ্নি রাগ করতে যেয়েও করতে পারেনা। এই ছেলেটার উপর রাগ করা যায়না, কেউ পারেনা।
বহ্নি হাসে, উৎসও হাসে। দুইজনের হাসিতে খাঁ বাড়ির আঙিনা গমগম করতে থাকে মাঝরাতে।
সারারাত কারো ঘুম হয়নি ‘খাঁ’ বাড়ির। সবাই ভান করেছে ঘুমের, কিন্তু কারো চোখেই ঘুম ছিলোনা। ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে এসেছিলো শাহানার। ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। গুণগুণ করে কেউ কাঁদছে। ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে সে।
পাশে তাকাতেই দেখে নওশাদ নেই। তড়িঘড়ি করে শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার দিকে ছোটে সে। ওখান থেকেই আওয়াজ আসছে।
নওশাদ বসে আছে চেয়ারে। কুরআন শরীফ তার সামনে। সেদিকে তাকিয়ে আছে সে আর কাঁদছে। দুই চোখ বেয়ে দরদর করে পানি পড়ছে তার। শাহানা ছুটে যেয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে।
“কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেনো এভাবে?”
“শাহানা তুমি এসেছো?”
“আগে বলো এভাবে কাঁদছো কেনো তুমি? তুমি জানোনা তোমার চোখে পানি দেখলে আমার দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে যায়?”
নওশাদ কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখে। এরপর শক্ত করে জাপটে জড়িয়ে ধরে শাহানাকে। তার কান্নার দমকে কেঁপে ওঠে শাহানা। কান্নাটা শুধু চোখে না, সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। শাহানাও নিঃশব্দে কাঁদে।
“শাহানা আমার শরীরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে। আমাকে তুমি আরো জোরে একটু চেপে ধরোনা।”
শাহানা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,”আমি আছি, আমি আছি।”
“আমার বহ্নি, আমার বহ্নি….”
“বহ্নি তো তোমার কাছেই থাকবে। মন চাইলেই দেখতে পারবে। আর ও তো বলেছে, রণের বাবা যতোদিন গ্রামে থাকবে ওরা এখানে এসেই থাকবে। বহ্নি ভার্সিটি থেকে এখানে চলে আসবে প্রায়ই, এরপর রণ অফিস থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে ওকে নিয়ে যাবে। তা-ও এভাবে কাঁদছো তুমি?”
“আমার সহ্য হচ্ছে না এই কষ্ট শাহানা। আমার মনে হচ্ছে আমার হৃৎপিণ্ডটা বুঝি কেউ খুবলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার এমন কেনো লাগছে?”
শাহানা নওশাদের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় আস্তে আস্তে।
“এ যে সমাজের নিয়ম খাঁ সাহেব, আমাদের যে মানতেই হবে। কন্যা সন্তানকে আজীবন কাছে রাখতে পারবে না, এ যে অসম্ভব। তা-ও তো বহ্নি আমাদের কাছেই থাকবে। কতো দূরদূরান্তে বিয়ে হয় মেয়েদের, এমন হলে তখন কি করতে তুমি?”
নওশাদ থামে না, কাঁদতেই থাকে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে তার কান্না। শাহানা কিছু বলতে পারেনা, মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে শুধু।
“বাবা।”
নওশাদ আর শাহানা দুইজনই থমকে যায়। বহ্নি দাঁড়িয়ে আছে, মুখটা যেনো তার পুর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলছে। এতোটা খুশি, এতোটা ঝলমলে তাকে কখনো লাগেনি। রণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আছে যেনো সে।
“মা রে, তুই এতো সকালে?”
বহ্নি ঈষৎ হেসে এগিয়ে আসে। চেয়ার টেনে বসে বাবার সামনে। বুক ভরে শ্বাস নেয়।
“বাবা তোমার ঘরে কিসের গন্ধ বলোতো?”
নওশাদ চোখ মুছে বললো,”কিসের?”
“জানিনা বাবা, একটা সুখ সুখ গন্ধ। এতো মিষ্টি গন্ধ আমি তোমার ঘর ছাড়া আর কোথাও পাইনি জানো তো?”
শাহানা চোখ মুছে হেসে বললো,”শোনো মেয়ের কথা, সুখের আবার গন্ধ আছে নাকি?”
“আছে মা আছে, ভীষণ মিষ্টি একটা গন্ধ। যতোই বুক ভরে নিই না কেনো, আরো নিতে ইচ্ছা করে।”
নওশাদ আর শাহানা দুইজনের মস্তিষ্কই মনের সাথে লড়াই করে যায় কান্না আটকানোর। শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্ক নাকি মনের জয় হয় বোঝা যাচ্ছে না।
বহ্নি বাবার পা’টা নিজের কোলে তুলে নেয়।
“এ কি করছিস মা?”
“তোমার পায়ের নখগুলো কেটে দিই।”
নওশাদ থমথমে গলায় বললো,”তুই?”
“কেনো? আমি বাদে কি এই কাজ আর কেউ করে বাবা? তোমার তিন মেয়ের মধ্যে তো কাজ ভাগ করাই আছে, এই কাজটা তো আমার।”
নওশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই শাহানা তাকে ইশারা করে কিছু না বলতে। মেয়ে যা করতে চাচ্ছে করুক।”
বহ্নি খুব যত্ন নিয়ে বাবার পায়ের নখগুলো কেটে দেয়। নওশাদ পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে চুপচাপ।
“নাও হয়ে গেছে।”
নওশাদ ম্লান হাসে, উত্তর দেয়না।
“বাবা একটা অনুরোধ করি?”
“মা বুঝি ছেলেকে অনুরোধ করে? আদেশ কর মা।”
বহ্নি মুখ টিপে হেসে বললো,”তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি? তোমার বুকে মাথা রেখে দিনটা শুরু করি?”
নওশাদ থতমত খেয়ে যায়, কি উত্তর দিবে সে? তার বুকটা যে খা খা করছে, মেয়েটা কি বুঝে ফেলেছে? তপ্ত মরুভূমিতে ঠান্ডা বৃষ্টির যে খুব দরকার এখন।
বহ্নি বাবার বুকে মাথা রাখে, নওশাদ কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়ের মাথা স্পর্শ করে।
“বাবা তুমি আমাকে মনে রাখবে তো? আমাকে কখনো পর করে দিবে না তো?”
নওশাদ আর সহ্য করতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রথমে আস্তে, পরে চিৎকার করে। বহ্নি মাথা তোলেনা। তার চোখের পানিতে বাবার সাদা পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে, তবুও মাথা তোলেনা সে।
“তুই যে আমার কলিজাটাই নিয়ে চলে যাচ্ছিস। আমার কি ক্ষমতা আছে তোকে ভুলে যাওয়ার? যদি আমার ক্ষমতা থাকতো সমাজের এই নিয়ম বদলানোর, আমি বদলে দিতাম। যাতে আর কোনোদিন কোনো অসহায় বাবার বুক খালি করে তার আদরের ধন অন্য ঘরে চলে যেতে না পারে।
“বাবা তুমি আমাকে যেভাবে ভালোবেসেছো, আর কেউ আমাকে ওরকম ভালোবাসতে পারবে না। আমারও যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে আমি তোমার বুক খালি করে যেতাম না।”
শাহানা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সরে যায় সেখান থেকে। এমন দৃশ্য চোখে দেখা যায়না, বুকে ভীষণ ব্যথা করে।
“বাহ রে! আপার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে দেখে বাবার সব আদর এখন আপাকে? আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি বাবা?”
নওশাদ আর বহ্নি তাকায়, শীতল আর আভা দাঁড়িয়ে আছে। দুইজনেরই চোখ ফোলা আর লাল। মনে হয় সারারাত না ঘুমিয়ে কেঁদেই কাটিয়েছে তারা। যদিও এখন মুখে এক চিলতে হাসি দুইজনেরই।
বহ্নি বাবাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,”দেখেছো বাবা, তোমার ছোট মেয়ে দু’টো কেমন হিংসুটে। চলেই তো যাচ্ছি আমি, সব আদর তো তোদেরই থাকবে।”
শীতল মাথা নেড়ে বললো,”সে পরের কথা পরে, বাকির নাম ফাঁকি। আমাদের এখনই আদর করতে হবে।”
আভাও সম্মতি জানায় মেজো আপার সাথে। অন্যদিন দুইজনের কাটাকাটি চলতে থাকলেও, আজ বেশ ভাব দেখা যাচ্ছে।
“একদম ঠিক মেজো আপা। বড় আপাকে একা সব আদর দিয়ে দিলে হবে না বাবা। আমাদের কোনো মূল্য নেই নাকি?”
নওশাদ হেসে আরেক হাত বাড়িয়ে দেয়। শীতল আর আভা যেনো অপেক্ষাতেই ছিলো। দৌড়ে যেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বাবার কোলে দুইজনই। নওশাদ তার প্রশস্ত বুকে তিন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। নিমিষেই কেমন ঠান্ডা হয়ে তার উত্তপ্ত বুকটা। আচ্ছা বেহেশতে কি এরচেয়ে বেশি শান্তি? বেহেশতে তার মেয়েগুলো থাকবে তো তার সাথে? সে যে আর কিচ্ছু চায়না। এরচেয়ে শান্তির আর কি আছে?
ঘুম হয়নি সারারাত উৎসেরও। রান্নার বাবুর্চির কথা বলতে সে সময়েই উৎস এসেছিলো মামার কাছে। এসে দেখে মামার ঘরে চাঁদের হাট বসেছে। তিন রাজকন্যাকে বুকে চেপে মানুষটা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সুখ যদি জড়বস্তু হতো, চোখে দেখতে পাওয়া যেতো তবে সে নিঃসন্দেহে বলতে পারতো তার মামা এই মুহুর্তে পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ। ছোট্ট করে হাসে সে মামার দিকে তাকিয়ে।
হঠাৎ চোখ যায় তার শীতলের দিকে। সাধারণ একটা চুড়িদার পরনে তার, আলুথালু এলোমেলো খোঁপা করা লম্বা চুলে। উৎসের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। এই এক নারীর চোখের দিকে তাকালে তার মতো উৎস প্রতিনিয়ত খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়, এটা কি মেয়েটা বোঝে? সে তো এমন ছিলোনা আগে, কেনো এমন হয়ে যাচ্ছে সে দিনদিন? কেনো তার প্রেম সময়ের সাথে সমানুপাতিক হারে বাড়ছে? প্রেমিকার আবেদনময়ী রূপ কি প্রেমিককে কষ্ট দেয়না? এক সমুদ্র শুন্যতায় ভাসিয়ে দেয়না? এটা কি মেয়েটা বোঝে?
আচ্ছা সে কি একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলবে? রাজকন্যাটিকে চাইবে তার বাবার কাছে? আজই? এক্ষুনি? সে যে সহ্য করতে পারছে না আর। চাইলেই কি পাবে সে?
কিন্তু সময় যে ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, এখন ভালো না বাসতে পারলে আর কখন? হৃদয় ভেঙেচুরে ভালোবাসতে না পারলে কিসের প্রেম? সময় গেলে কি সাধন হয়?
লাল, নীল রঙিন কাগজে সাজানো হয়েছে খাঁ বাড়ি। বহ্নি একেবারেই আড়ম্বরহীন অনুষ্ঠান চায়। বাড়াবাড়ি তার পছন্দ না। কিন্তু উৎসব বাড়ি কি এতোটাই সাদাসিধে হয়? আবির আর আজাদ চলে এসেছে সকাল সকাল। তারাই সাজাচ্ছে বাড়ি। গুমোট গরমটা ফিরে এসেছে। আকাশে কালো মেঘে, বৃষ্টি দেখা নেই যদিও। কপাল চুইয়ে ঘাম পড়ছে দুইজনের। বসে নেই উৎসও। হাজারটা কাজ তার। ছুটছে শুধু সকাল থেকে।
“নিন ধরুন।”
উৎস মাত্রই রোদ থেকে ঘরে ফিরেছে। অতিথিরা আসতে শুরু করেছে। দই-মিষ্টির দোকান থেকে ফিরে হাঁপাচ্ছে যেনো সে। ঘেমে-নেয়ে একাকার।
উৎস তাকিয়ে দেখে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত হাতে শীতল দাঁড়িয়ে আছে। সুতি একটা শাড়ি পরেছে সে, লম্বা চুল বেনী করা কোমর ছাড়িয়ে নিচে এসে পড়েছে। শাশ্বত বাঙালি নারীর সৌন্দর্য, এড়ানোর সুযোগ কই একজন প্রেমিকের?
“শীতল।”
“শরবতটুকু খেয়ে নিন, হাঁপাচ্ছেন আপনি।”
উৎস শীতলের হাত ধরে তাকে পাশে বসায়। শীতল শিউরে ওঠে।
“কি করছেন? বাড়িভর্তি মানুষ, কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে।”
“দেখুক, ভয় পাই নাকি?”
“শরবতটুকু খেয়ে নিন, আরাম পাবেন।”
“তুমি সামনে এলেই তো আরাম পাই। তোমাকে একটু পান করি?”
শীতল মাথা নিচু করে কুটকুট করে হাসে।
“কি হলো? হাসছো যে?”
“আপনি কি ভালো হবেন না?”
“ভেবেচিন্তে বলছো তো? প্রেমিক হিসেবে শান্ত পুরুষ কিন্তু ললনাদের পছন্দ নয়।”
“আপনি বুঝি ললনাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন?”
“তোমাকে নিয়ে করেছি।”
শীতল উঠে দাঁড়ায়, উৎস অসহায় চোখে তার দিকে। তার দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব স্পষ্ট।
“চলে যাচ্ছো?”
“তো কি করবো?”
“আমার পাশে একটু বসে থাকো, তোমাকে পান করার সুযোগ তো এলো না, দেখেই তৃষ্ণা মেটাই।”
শুকনো কাশির শব্দে ধাতস্থ হয় দু’জনই। আবির আর আজাদ দাঁড়িয়ে আছে। শীতল লজ্জায় একছুটে চলে যায় সেখান থেকে। উৎস উঠে দাঁড়ায়।
“কি হয়েছে কি?”
“বুঝি বুঝি সবই বুঝি।”
“কি বুঝিস?”
আজাদ এসে উৎসের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায়।
“আবির ভাই, আজ আমাদের চোখের বা বুকের কোনো তৃষ্ণা মেটানোর কেউ নেই। আমরা কি শরবত পাবো না?”
“বুঝতেছি না রে আজাদ, আমাদের কপালে মনে হয় শরবত নেই। না আছে শরবত, না আছে মোহাব্বত। এ জীবন রেখে কি লাভ?”
উৎস সরু চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,”ডুবে ডুবে কে কার জলাশয়ের পানি খায় সব খবর আমার কাছে আছে চান্দু। ওইযে, আমার ওই কথাটা মনে পড়লো। তোমরা ভাবছো আমি বুঝিনা, কিন্তু চান্দু আমি ভাত খাই, সুজি না। মোহাব্বতের শরবত গুলায় খাওয়াবো তোদের, খাড়া।”
আবির আর আজাদ বাঁচতে ছুটে পালায়, উৎস হাসে ওদের দিকে তাকিয়ে। পরক্ষণেই আবিষ্ট হয়ে যায় আবার। শীতলকে আরেক নজর দেখতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা সে এমন হয়ে যাচ্ছে কেনো দিন দিন? প্রেমে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে সে। প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে সামনে দেখা ছেলেটাও আজকাল বাঁচতে চায় ভীষণ। অনেক অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে। শীতলের শীতল বুকে মাথা রেখে এরকম কয়েকটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া মনে হয় না মন্দ হবে!
দোতলায় নিজের নতুন ঘরেই বউ সাজে বসে আছে বহ্নি। তাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে অগ্নি। তার সাজানোর হাত সুন্দর। অতিরিক্ত সাজসজ্জা বহ্নির পছন্দ না। তাই খুব সাধারণভাবেই সাজানো হয়েছে তাকে। রণের পছন্দ করা গাঢ় মেরুন রঙের বেনারশী শাড়ি পরনে তার। হালকা গহনা, চোখে টানা কাজল, ঠোঁটটা গাঢ় খয়েরিতে রাঙানো। দুই হাতভর্তি মেহেদী।
“আপা নিজেই দেখুন তো আপনাকে কেমন লাগছে।”
অগ্নি একটা ছোট আয়না বাড়িয়ে দেয় বহ্নির দিকে। বহ্নি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায়। সাথে সাথে লজ্জায় লাল হয়ে যায় তার গাল দু’টো। নিজেকে এই রূপে আগে কখনো দেখেনি সে। ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে তার।
“আপা রণ ভাই তো আজ পাগল হয়ে যাবে আপনাকে দেখে।”
বহ্নি অগ্নির দিকে লাজুক চোখে তাকায়, মেয়েটা মিটমিট করে হাসছে। এতো সুন্দর লাগছে তাকে। বহ্নি কপট রাগ করে বললো,”দুষ্টুমি হচ্ছে?”
“সত্যি বলছি বহ্নি আপা। আমি ছেলে হলে আপনাকে নিজেই তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম। আপনারা তিন বোন এতো সুন্দর কেনো? এতো মায়াবতী কন্যাদের দেখে আমার নিজেরই হিংসা হয়।”
বহ্নি অগ্নির গাল টিপে দিয়ে বললো,”তুমি বুঝি কম সুন্দরী? তুমি তো রূপসী ললনা।”
অগ্নি হাসতে হাসতেই নিচের দিকে তাকায়। এখান থেকে জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় উঠোন। আজাদ নামের ছেলেটা ছুটে ছুটে কাজ করছে, ঠিক যেনো নিজের বোনের বিয়ে। হঠাৎ একটা অদ্ভুত অনুভূতি জন্মায় অগ্নির, যা আগে কখনো হয়নি। আজাদের বলা মজার মজার কথাগুলো ভাবতে ইচ্ছা করছে, কি আশ্চর্য রাগ হচ্ছে না আজ একদম। ছেলেটাকে কি আজ একটু বেশি সুদর্শন লাগছে? সাদা পাঞ্জাবি কি পুরুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে? গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে অগ্নির, অস্থির লাগে। ফ্যানের তলে বসেও ঘামতে থাকে সে। সে বুঝতে পারছে না এই অদ্ভুত অনুভূতির নাম কি? এমন অনুভূতি আগে হয়নি তো তার। আচ্ছা এটা প্রেম নয় তো? শিউরে ওঠে অগ্নি, চোখ নামিয়ে নেয় সাথে সাথে।
আজাদের মন বলছে উপরের দিকে তাকাতে, অজান্তেই, এমনিতেই, কোনো কারণ ছাড়াই। মন মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠালে চোখজোড়ার আর দোষ কি? অবাধ্য চোখজোড়া চলে যায় উপরের ঘরের জানালা গলে ঘরের ভিতরে। জানালার পর্দার ওপাশে দুইটা নারীমূর্তি। একজন বিয়ের কনে, বহ্নি আপা অন্যজন…..
আজাদের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, পানি পিপাসা পায়। গজদন্তের হাসিটা হঠাৎ চোখে ভাসছে। আশ্চর্য! জোর করেও সরানো যাচ্ছে না।
আজাদ নিজের মনেই বলে ওঠে,”আশফাকের পুত, প্রেমে পড়ছোস নাকি? আগুন কন্যার প্রেমে পড়ার সাহস পাইলি কই রে বেটা?”
ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ হেসে আজাদ নিজের কাজে চলে যায়।
সিঁড়ির মাঝামাঝিতে আসতেই হেঁচকা টান পড়ে আভার হাতে। ভয়ে চিৎকার করে ওঠার আগেই কেউ যেনো তার মুখ চেপে ধরে শক্ত হাতে।
আভা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে দেখে আবির দাঁড়িয়ে তার সামনে। সে-ই মুখ চেপে রেখেছে তার। এতোটা কাছে কখনো আসা হয়নি তাদের। দমবন্ধ হয়ে যায় আভার। চোখ বন্ধ করে ফেলে সে সাথে সাথে।
আবির তাকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে যেয়ে দাঁড়ায়।
“আমি দুঃখিত আভা, আমি তোমাকে ধরতে চাইনি। তুমি ভয়ে চিৎকার করতে তাই…”
আভা মাথা নিচু করে বললো,”কি হয়েছে বলুন?”
আবির দেওয়ালে হেলান দিয়ে বুকে দুই হাত বেঁধে দাঁড়ায়। মায়ের একটা গোলাপি কাতান পরেছে আভা। একটা পুতুলের মতো লাগছে তাকে। বেশ বড়ও লাগছে, মনে হচ্ছে কলেজে পড়া মেয়ে।
“কি হলো? চুপ করে আছেন কেনো?”
“তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে আভা।”
আভা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়, কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা। তার বুকের মধ্যে কি হচ্ছে ভাগ্যিস সামনে দাঁড়ানো মানুষটা বুঝতে পারছে না।
“আমার আগলে রেখো, যেভাবে আমার মা যদি বেঁচে থাকতো, সে রাখতো।”
আভা ঝট করে মাথা তুলে তাকায়। আবির আভাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে চলে যায়। কথাটার মানে বুঝতে পারে না আভা। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যদি মানেটা সে বুঝতো, তাহলে হয়তো যতোটা মায়া তার লাগছে ওই মানুষটাকে তার কয়েকগুণ বেশি লাগতো। আচ্ছা, মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ কি আছে? কেনো নেই? যদি থাকতো তবে কি তাকে ‘আবির’ নামে ডাকা হতো?
চাতক পাখির মতো জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে বহ্নি। রণকে যেনো কতো বছর দেখে না সে! এক নজর দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে তার। ঘোলা চোখে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে নিচের দিকে। গেট দিয়ে ঢোকার মুখে এখান থেকেজ দেখতে পারবে সে।
বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। আচ্ছা ওরা আসতে কি দেরি করছে? সময় কি বেশি হয়ে যাচ্ছে? নাকি তার ভুল ধারণা? সে কি বেশি অস্থির হয়ে যাচ্ছে? নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পায়, সে তো এমন ছিলোনা। মাথা নিচু করে বসে নিজের হাতের মেহেদী দেখতে থাকে সে।
“উৎস বাবা রে, ওরা তো এখনো এলো না। তুই একটু খবর নে তো।”
উৎস দেখে নওশাদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। মানুষটা কেমন যেনো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। সাদা পাঞ্জাবি ঘেমে শরীরের সাথে লেপটে আছে।
উৎস মামাকে এক হাতে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে যায়। ফ্যানের নিচে বসিয়ে পানির গ্লাস হাতে দেয়।
“উৎস রে, ওরা এতো দেরি করছে কেনো?”
“মামা আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার সাথে কথা হয়েছে, ওরা রাস্তাতেই আছে।”
উৎস একটা মিথ্যা বলে ফেললো। তার সাথে রণের কোনো কথা হয়নি। যতোবার সে ফোন দিচ্ছে, ফোনটা বেজে যাচ্ছে, কেউ তুলছে না। দুশ্চিন্তা তারও হচ্ছে, কিন্তু এখন কোনোভাবেই এই মানুষটার সামনে তা প্রকাশ করা যাবে না।
নওশাদকে বিছানায় শুইয়ে উৎস ঘরের বাইরে আসতেই দেখে শাহানা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উৎস কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
“মামি, কিছু বলবেন?”
“ওরা এখনো আসছে না কেনো উৎস?”
উৎস জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
“মামি কথা হয়েছে তো আমার সাথে, ওরা রাস্তাতেই আছে।”
শাহানা শান্ত গলায় বললো,”আমাকে তোমার মামার মতো বোকা ভেবো না। মিথ্যাটা অন্তত আমার সামনে বলো না। সত্যটা বলো, আমি শুনতে প্রস্তুত।”
উৎস হেসে বললো,”মামি শুধু শুধুই ভাবছেন। হয়তো রাস্তাতেই আছে তাই ফোন তুলতে পারছে না। বুঝতেই পারছেন মা নেই, বোন নেই। নতুন বউ যাবে, বাবা ছেলেকেই সবটা গুছিয়ে এরপর আসতে হচ্ছে। এজন্যই হয়তো দেরি হচ্ছে।”
শাহানা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আচমকা উৎসের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে এনে চেপে ধরে। উৎস হতভম্ব হয়ে যায়, মামির হাত দু’টো অসম্ভব ঠান্ডা।
“বাবা আমার মেয়েটা যেনো কষ্ট না পায় কোনো, এই দায়িত্ব আমি তোমাকে দিলাম। তুমি জানো কি করবে তুমি।”
শাহানা আর দাঁড়ায় না। উৎসের হাত ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে যায় সে। উৎস হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কি করবে এখন সে?
মেঘ কালো হয়ে এসেছে, শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে বাতাসের, ঠান্ডা হাওয়া ছেড়েছে। যে কোনো সময় তীব্র ঝড় হানা দিবে। বাবুর্চিরা দৌড়ে দৌড়ে খাবারগুলো ঢাকার চেষ্টা করছে, বারান্দায় তুলেছে কিছু। অতিথিরা বারান্দায় ভীড় করেছে। হালকা বৃষ্টিপাতও শুরু হয়েছে এতোক্ষণে।
উঠোনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বহ্নি। গহনাগুলো খুলে রেখেছে সে। খুব ক্লান্ত লাগে তার চোখমুখ। তাকে চেপে ধরে রেখেছে শীতল, আভা আর অগ্নি।
“শীতল।”
“বলো আপা।”
“তোরা চলে যা এখান থেকে। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাবো।”
শীতল কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”তুমি এখন ঘুমাবে আপা?”
“হ্যা ঘুমাবো, তোরা চলে যা।”
শীতল কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”আপা তুমি ঘুমাও না, আমরা এখানে থাকি? এই কোণায় থাকবো, কেউ বিরক্ত করবে না তোমাকে।”
“না তোরা যা, তোরা না গেলে আমার ঘুম হবে না।”
শীতল কিছু বলতে যাবে তার আগেই উৎসের গলার আওয়াজ শুনে তাকায় সবাই দরজার দিকে। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে উৎস।
“বহ্নি গহনা খুলেছিস কেনো?”
“ধুর গরম লাগছে।”
বহ্নির অস্বাভাবিক শান্ত রূপে খটকা লাগে উৎসের। কিন্তু তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। অদ্ভুতভাবে বাড়ির সবাই তার দিকেই চেয়ে আছে। সবার ধারণা, উৎস কিছু করতে পারবে, আর কেউ পারবে না এখানে।
“শীতল, বহ্নির গহনাগুলো পরিয়ে দাও।”
বহ্নি মুচকি হেসে বললো,”তুই যা তো এখন, আমি ঘুমাবো। আর তোর মুখ এমন শুকনো লাগছে কেনো? খাসনি দুপুরে? আমার খুব খিদে পেয়েছে। পোলাওয়ের ঘ্রাণে মাথা খারাপ অবস্থা। আমাকে এক প্লেট পোলাও এনে দিতে পারবি রে?”
উৎস নির্লিপ্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে, সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দ পাওয়া যায়।
বহ্নি হাসে সেদিকে তাকিয়ে। প্রথম আস্তে, এরপর শব্দ করে। তাকে স্বাভাবিক মনে হয় না। অস্বাভাবিক হাসি, বিকারগ্রস্তের মতো। শীতল ভয় পেয়ে যায়। আভা মুখ চেপে ধরে কাঁদতে গেলে শীতল তার হাত চেপে ধরে। এখন কোনোভাবেই আপার সামনে কাঁদা যাবে না, ভেঙে পড়তে দেওয়া যাবে না মানুষটাকে।
সিঁড়ির মুখে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো সায়েরা। উৎসকে দেখে সাথে সাথে হাত চেপে ধরে তার।
উৎস অবাক হয়ে বললো,”মা, কিছু বলবে?”
সায়েরা কঠিন গলায় বললো,”রণকে নিয়ে আয় বাবা, যেখান থেকে পারিস।”
“মা আমি কীভাবে? আমি কীভাবে জানবো সে কোথায়?”
“আমি জানিনা, কিচ্ছু জানিনা। শুধু জানি তোকে নিয়ে আসতে হবে রণকে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ পরোক্ষভাবে তোর দিকে চেয়ে আছে। সবার ধারণা তুই আনতে পারবি।”
“মা এটা নাটক, সিনেমা নয়। বাস্তব বোঝার চেষ্টা করো।”
“আমি জানিনা বললাম তো। তোর মামার দিকে তাকা। মানুষটা অজ্ঞানপ্রায়। ওই মানু্ষটা না থাকলে কোথায় ভেসে যেতাম আমরা। আদৌ বেঁচে থাকতাম কিনা জানা নেই। আজ সেই ঋণের কিছুটা হলেও তোকে শোধ করতে হবে। তুই যেখান থেকে পারিস রণকে খুঁজে নিয়ে আয় বাবা আমার।”
মায়ের চোখে পানি দেখে উৎসের চোয়াল শক্ত হয় যায়। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের হাত ছেড়ে চলে যায় সে। সিঁড়ির গোড়াতেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সায়েরা। তার চোখভর্তি পানি। সে চাইলেই দোতলায় বহ্নির কাছে যেতে পারে। কিন্তু না, ওই মুখ দেখার সাহস সায়েরার নেই। দ্রুত পায়ে নিজের ঘরের দিকে ছোটে সে। জায়নামাজে বসতে হবে। রণ না আসা পর্যন্ত সে উঠবে না জায়নামাজ থেকে, নামাজ আদায় করতেই থাকবে।
ঝড় তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই সাথে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির বেগ এতোটাই বেশি যে এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। গাছপালা গুলো যেনো আছড়ে পড়ছে একের পর এক।
উৎস সেই ঝড়ের মুখে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শীতল জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে সেই দৃশ্য। এ যেনো উৎস নয়, এক পর্বত হেঁটে যাচ্ছে তীব্র ঝড় উপেক্ষা করে। দৃঢ়তার সাথে, শক্ত শরীরে। শীতল চোখ বন্ধ করে একমনে আল্লাহকে ডাকে। একদিকে বড় বোন, অন্যদিকে প্রেমিক। অথচ দিনটা কতোটা সুন্দর হওয়ার কথা ছিলো তাদের। কি হয়ে গেলো তাদের সাজানো জীবনটা? কোথায় গেলো রণ ভাই?
“উৎস দাঁড়া।”
গেটের বাইরে থেকেই উৎস ভিতরের দিকে তাকায়। আবির আর আজাদ দাঁড়িয়ে আছে। ভিজে চুপসে আছে তারা।
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“আমি জানিনা আমি কোথায় যাচ্ছি, কোন গন্তব্যে। শুধু জানি ওই বটবৃক্ষের মতো মানুষটাকে আমার বাঁচাতে হবে, বহ্নিকে আমার বাঁচাতে হবে। পাতাল ফুড়ে হলেও রণ ভাইকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে।”
আবির আজাদের দিকে তাকায়। আজাদ মৃদু হেসে বললো,”বেশ চলুন।”
“চলুন মানে? এই ঝড়ের মধ্যে তোরা কোথায় যাবি?”
আজাদ এগিয়ে আসে, আবিরও আসে। উৎসের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায় দুইজন।
“ভাই বাঁচলেও একসাথে, মরলেও একসাথে এই প্রতিজ্ঞা কি ছিলো না আমাদের? ভুলে গেলেন এতো তাড়াতাড়ি? ভাইকে একা ফেলে ভাইয়েরা বুঝি ঝড়ের ভয়ে কাপুরুষের মতো ঘরে বসে থাকবে?”
উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”বেশ চল।”
খাঁ বাড়িকে পিছনে ফেলে এক গন্তব্যহীন যাত্রায় পা বাড়ায় তিনজন পুরুষ। যাদের মধ্যে কোনো ভয় নেই। যে কোনো মূল্যে বহ্নির মুখে হাসি ফোটানোই তাদের বর্তমান লক্ষ্য। এই পুরুষদেরই বোধহয় নওশাদ ‘মহাপুরুষ’ নামে ডাকে। মহাপুরুষদের যে ভয় পেতে নেই। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষগুলোর স্বস্তির কারণ হওয়ার জন্য পিছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই তাদের।
(চলবে….)