মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-৩৪+৩৫

0
39

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ৩৪

বিশাল ফাঁকা একটা মাঠ। যতোদূর চোখ যায় শুধুই ধূ ধূ মাঠ। বাড়িঘর, গাছপালা কিছুই নেই চারপাশে। বহ্নি শুধু দৌড়াচ্ছে আর হাঁপাচ্ছে। প্রচন্ড গরমে নাজেহাল অবস্থা তার। কপাল চুইয়ে ঘাম ঝরছে অনবরত। শ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে তার। পরনের মেরুন রঙের বেনারশী শাড়িটা ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। সেদিকে খেয়ালও নেই তার। ভীষণ পানি পিপাসা পেয়েছে তার। কিন্তু কোথায় কি? কোনো জলাশয় নেই কোথাও। খুব ভয় পেয়ে যায় বহ্নি। যেনো একটা গোলকধাঁধায় আটকে পড়েছে সে। যতোই ছোটে, তবুও যেনো আগের জায়গাতেই ফিরে আসছে সে। তার মনে হচ্ছে, এখান থেকে সে আর কোনোদিন ফিরে যেতে পারবে না। এখানেই বাকিটা জীবন কেটে যাবে তার।

হঠাৎ কোথা থেকে একটা অতি শীতল দমকা হাওয়া তার শরীরে আছড়ে পড়ে। বহ্নি হতবাক হয়ে দেখে চারপাশ অন্ধকার হওয়া শুরু হয়েছে। প্রথমে হালকা ধূসর আঁধার এরপর আস্তে আস্তে তা নিকষ কালো আঁধারে রূপ নেয়। বহ্নি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে ঘন, কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হয়েছে আকাশে। সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে সে কালো অম্বর পুরোপুরি। মাঝে মাঝে বিজলী চমকে উঠছে। সেই আলোতে চারপাশ আরো ভয়ংকর, আরো রোমাঞ্চকর মনে হয়।
ক্রমেই জমাট ভয়টা ছড়িয়ে যায় বহ্নির পুরো শরীরে। কেউ যেনো তাকে ডেকে বলছে, পালা বহ্নি, পালা। বাঁচতে চাইলে এখনই এই পৃথিবী থেকে পালা। কিন্তু বহ্নি বুঝতে পারেনা সে কোথায় পালাবে? এখান থেকে ফেরার পথই তো খুঁজে পাচ্ছে না সে। অনেক কষ্ট করে বাবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করে সে। অদ্ভুত ব্যাপার, শত চেষ্টা করেও বাবার মুখটা সামনে আসছে না তার। মা, ফুপু, শীতল, আভা, উৎস কারো মুখই মনে পড়ছে না তার।
আচমকা ধূলা ঝড় শুরু হয়। বহ্নির চোখমুখ ছেয়ে যায় সেই ধূলোয়। নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নেই সেই তপ্ত পরিবেশ, তবুও যেনো গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে সে।
সহ্য করতে না পেরে মাটিতে বসে পড়ে বহ্নি। ভেবেছিলো বোধহয় সে চিৎকার করতে পারবে না, মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হবে না। কিন্তু না, সে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে। নিজের আর্তচিৎকারে নিজেই শিউরে ওঠে সে। মাঝরাতে অমানবিক কষ্ট পেয়ে একটা বিড়াল যেভাবে আর্তনাদ করে ওঠে, ঠিক তেমন শোনায় বহ্নির আওয়াজটা। তার মনে হয় সে জ্ঞান হারাবে। বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবে না সে।
হঠাৎ জ্ঞান হারানোর আগে, খুব ক্ষীণ কিন্তু সুক্ষ্ম একটা আওয়াজ তার কানে আসে, ‘মিস বহ্নি।’

ঝাপসা চোখে বহ্নি শেষবারের মতো তাকায়। তার মনে হচ্ছে সব কষ্টের অবসান অতি সন্নিকটে। চোখ নুইয়ে পড়ছে, তবুও ক্লান্তিতে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বহ্নি জোর করে তাকায়। ঈষৎ আলোয় সে দেখতে পায় এক বলিষ্ঠ শরীরের পুরুষ। তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। এক হাত বাড়িয়ে রেখেছে তার দিকে।

“মিস বহ্নি, উঠে আসুন। এইতো আমি।”
বহ্নির ওষ্ঠের কোণে ছোট্ট হাসি ফুটে ওঠে। এইতো তার মহাপুরুষ, এইতো তার সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আশ্রয়স্থল।

“আসুন মিস বহ্নি, হাত দিন।”
“না আমি হাত বাড়াবো না। হাত বাড়ালেই আপনি আবার চলে যাবেন আমাকে ফাঁকি দিয়ে।”
“আমি ফাঁকি দেওয়ার জন্য আপনার জীবনে আসিনি। যদি তাই হতো, বহু আগেই দিতে পারতাম। প্রেয়সীকে ফাঁকি দেওয়ার মতো পাপ করলে আমি যে দোজখেও ঠাঁই পাবো না। দুনিয়াতেই দোজখের শাস্তি পাবো।”
“না না না….”
“আসুন মিস বহ্নি, এই জায়গা ভয়ংকর। একা থাকতে পারবেন না।”
“আপনি-ই তো আমাকে একা করে চলে গেছেন।”
“আমি যাইনি, আমি আছি। আর থাকবো সারাজীবন। আপনার কোলে শুয়েই শেষবারের মতো পৃথিবী দেখতে চাই। আপনি-ই যে আমার পৃথিবী।”
বহ্নি ডুকরে কেঁদে ওঠে।
“কাঁদবেন না, আপনি আমার শক্তি। আপনি কাঁদলে আমি শক্তি পাবো কোথায়?”
“ছেড়ে যাবেন না তো?”
“এমন ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস আমার নেই।”
“তবে আমি আসছি।”
“আসুন…..”

বহ্নি হাত বাড়ায়। কিন্তু কিন্তু….

কোথায় রণ? কোথাও নেই। কোত্থাও নেই। পুরো এক নির্জন মাঠ। তবে সে কোথায় গেলো?

“রণ আপনি কোথায়? আমার ভয় করছে তো।”
“আসুন, এইতো আমি।”
“আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না।”
“এইতো এইতো, হাত দিন…”

পাগলের মতো হাত বাড়ায় বহ্নি। কিন্তু না, কোথাও নেই রণ। শুধু তার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। বহ্নি উন্মাদের মতো উঠে দাঁড়ায়। আবারও ছুটতে থাক্র, কিন্তু কোথাও নেই তার মহাপুরুষ। তবে কি মহাপুরুষ বলে কিছুই হয়না? সবই তার বাবার ভ্রান্ত ধারণা?

মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বহ্নি সাথে সাথে।

শরীরে প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়ে ঘুম ভেঙে যায় বহ্নির। বেশ অনেকক্ষণ সময় লাগে তার বুঝতে সে কোথায় আছে। চারদিক ভীষণ অন্ধকার। নীচতলায় আলো আছে, কিছুটা দোতলায় এসে পড়েছে। তবুও যেনো আঁধারটা কাটেনি। শরীর ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে আছে। প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু ওঠার একবিন্দু শক্তি নেই। তবে কি সে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো? স্বপ্ন এতোটা জীবন্ত হয়? ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে তার।

ক্ষীণ গলায় দুইবার শীতলকে ডাকে সে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। তাকে এভাবে একা ফেলে সবাই চলে গেলো? আচ্ছা সে কি মারা গেছে? তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ কেনো বের হচ্ছে না? আচ্ছা সে যদি মারা যেয়ে থাকে, তবে কেউ এখনো কেনো বুঝতে পারছে না? তারচেয়ে বড় কথা, সে কীভাবে মারা গেলো? সজীবের চরম বিশ্বাসঘাতকতার পর রণেরও বিশ্বাসঘাতকতাই কি তার মৃত্যুর কারণ? বহ্নি চোখ বন্ধ করে ফেলে।
আর যদি সে বেঁচে থাকে, তবে এই মুখ কীভাবে দেখাবে সে? বাবা বাইরে যাবে কীভাবে? এলাকার সবাই জানে আজ খাঁ বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে। এদিকে বর-ই কিনা আসেনি বিয়ে করতে! এ যে তার বাবার অপমান।

আচমকা উৎসের চিৎকারে ধাতস্থ হয় সে। উৎসের সাথে ওই ছেলেগুলোও, কি যেনো নাম? ও হ্যা, আবির আর আজাদের গলাও পাওয়া যাচ্ছে।
“আইলো দামান সাহেব হইয়া, রাজকন্যা গেলো পাইয়া, খুশির জোয়ার গেলো আঙিনা বইয়া গো আঙিনা বইয়া। তোমরা কে কোথায় আছো গো, দেখো আমাদের দামানরে চাইয়া। আসমানের চাঁন্দ নিচে আইছে, দেখো গো চাইয়া।”

চরম কষ্টের মধ্যেও হাসি পায় বহ্নির, ফিক করে হেসে দেয় সে। এটা নিশ্চিত যে সে এখনো মরেনি। তবে তার ঘুমও ভাঙেনি এখনো। স্বপ্ন দেখছে এখনো সে। উৎস কোনোদিন এভাবে গান করবে না। এটা অসম্ভব। আর দামান? দামান মানে তো জামাই। জামাই কীভাবে আসবে? এটাও নিশ্চিত স্বপ্ন। বহ্নি চোখ বন্ধ করে রাখে। স্বপ্ন যদি বাস্তবের চেয়ে সুন্দর হয় তবে সে স্বপ্ন দেখতে মানা কোথায়? এ স্বপ্ন যেনো না ভাঙ্গে।

কিন্তু না, স্বপ্ন কি এমন হয়? এ যে একদম স্পষ্ট কণ্ঠ। শীতল, আভা, অগ্নি খুশিতে চিৎকার করছে। শাহানা আর সায়েরার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আর একটা আওয়াজ, হ্যা এটা তো তার বাবা। নওশাদ চিৎকার করে কাঁদছে। কাঁদছে কেনো বাবা? তবে স্পষ্টত এটা কষ্টের কান্না নয়, আনন্দের কান্না। উৎসরা এখনো চিৎকার করে গান করছে। এতো কিসের আনন্দ সবার? এটা কি সত্যিই স্বপ্ন? কই না তো। এইযে ভীষণ মশা কামড়াচ্ছে তাকে। স্বপ্নে কি মশা কামড়ায়? কি জানি!

আরো মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর বহ্নি বুঝতে পারে সে স্বপ্ন দেখছে না, এটা বাস্তব। উত্তেজনায় পুরো শরীর কাঁপছে তার। তবে কি রণ এসেছে? সত্যিই মহাপুরুষ ফিরেছে রাজকন্যাকে নিয়ে যেতে।

ভীষণ দূর্বল, কাঁপা শরীরে বহ্নি উঠে বসে। মাথাটা ভার হয়ে আছে তার। বাম হাতে মাথাটা চেপে ধরে সে। ভয়ে ভয়ে জানালার দিকে তাকায় সে। যদি এ কল্পনা মিথ্যা হয়? যদি দেখে যে সে যা শুনছে সবই মেকি, মরীচিকা?

কিন্তু এ কি? এ কোন রূপকথার রাজ্য তার বাড়ির একফালি উঠোনে? বহ্নির মনে হচ্ছে তার দেখা পৃথিবীর সেরা দৃশ্য। এরচেয়ে শান্তির দৃশ্য সে এই জীবনে দেখেনি। এটা কি সত্যি? আর এটা যদি স্বপ্ন হয় সে চায় সারাজীবন এই স্বপ্ন দেখে কাটিয়ে দিতে, ঘুম যেনো না ভাঙে তার কোনোদিন।

ঝড়, বৃষ্টি নেই একদমই। ঠান্ডা পরিবেশ। মেঘ পুরোপুরি কেটে যেয়ে এক ফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। সেই কিরণে যেনো ঝকমক করছে উঠোন। উঠোনের মাঝে উৎস, আবির, আজাদ, শীতল, আভা আর অগ্নি চিৎকার করছে আর ভীষণ আনন্দে লাফালাফি করছে। তাদের মাঝে কেউ আছে, মাঝারি উচ্চতার একহারা গড়নের সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক পুরুষ। তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না, তবে বহ্নি জানে সে কে।
জানালার শিক ধরে নিজেকে সামলায় সে। ভিতরটা ভেঙেচুরে কান্না আসছে তার। তবুও নিজেকে সামলে রাখে, কান্নাটা গিলে ফেলে সাথে সাথে।

উঠোনের মাঝেই কাঁদছে নওশাদ মাটিতে বসে। শাহানা আর সায়েরা দুইজন দুইজনকে জড়িয়ে কাঁদছে। আশ্চর্য, এদের হয় কি মাঝে মাঝে? সকালেও না ঝগড়া করলো?
পুরুষটি এগিয়ে আসে নওশাদের দিকে। নওশাদের দুই হাত চেপে হাঁটু গেড়ে বসে তার সামনে। চাঁদের আলো তীর্যক ভাবে এসে পড়েছে পুরুষটির মুখে। সাথে সাথে আর্তনাদ করে ওঠে বহ্নি। সে এসেছে, সে এসেছে। আচ্ছা চন্দ্রকন্যা তো আছে, চন্দ্রকুমার নেই? এ যে তার সেই চন্দ্রকুমার।

মুখোমুখি বসে আছে বহ্নি আর রণ। উঠোনের দুই পাশে দু’টো মঞ্চ। একটায় বহ্নি, আরেকটায় রণ। তাদের সামনে ফুলের পর্দা। তবুও দু’জন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দু’জনকে। বহ্নি কেঁপে কেঁপে উঠছে একেকবার। শীতল আর আভা দুইজন দু’পাশ থেকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে।

রণের দুই পাশে উৎস, আবির, আজাদ। রণের বাবা নওশাদের হাত ধরে বসে আছে। তার জীবনটা যেনো পূর্ণতা পাচ্ছে। সে কোনো কথা বলতে পারছে না। বিয়ে পড়ানো চলছে, সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা, তবুও যেনো কেউ কিছু বলতে পারছে না।

ঘটনা মোটেই সামান্য নয়। রণের গাড়ি মাঝরাস্তা পর্যন্ত আসার সাথে সাথে কয়েকটা মোটরসাইকেল আটকে দেয় তাদের। রণই গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসে। মোটরসাইকেলে বসা আরোহী হঠাৎই নেমে আসে তাকে দেখে। একজন, দুইজন না। প্রায় বারোজন ঘিরে ফেলে রণকে। রণ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। নিজের আপন বলতে তেমন কেউ না থাকায় বরযাত্রীও নেহাৎ কমই ছিলো। রণের বাবা অন্ধ মানুষ। বাকিদের সাথে সে-ও নেমে আসে। কিন্তু কেউ কিছু বোঝার আগেই ওরা রণের চোখ বেঁধে ফেলে। বরযাত্রী বাঁধা দিতে আসায় তাদের আহত করে দিয়ে ওরা রণকে নিয়ে চলে যায়। যারা সুস্থ ছিলো তারা রণের বাবা সহ বাকিদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। রণের বাবা যেতে চায়না। ছেলেকে না নিয়ে কোথাও যাবে না সে। প্রয়োজন হলে এখানেই মারা যাবে সে। কিন্তু তাকে জোর করে বাকিরা নিয়ে যায়। সে নিজেও মাথায় আঘাত পেয়েছে।

উৎস ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে যখন পাগলের মতো এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে, গন্তব্য বুঝতে না পেরে একরকম উন্মাদ হয়ে গেছে। ঠিক তখনই তার ফোনে অচেনা একটা নাম্বার থেকে ফোন আসে। ফোনটা ধরতেই মেয়েলী গলার একজন ভারী গলায় তাকে বললো, সে যাকে খুঁজছে সে রুস্তমের ডেরায় আছে। রুস্তম নওশাদের উপর শোধ তুলতে রণকে ধরে এনেছে। উৎস যেনো তাকে বাঁচায়।

এই বলেই ফোনটা কেটে দেওয়া হয়। পরে উৎস ওই নাম্বারে হাজারবার চেষ্টা করলেও পায়না, বন্ধ নাম্বার। তবে উৎসের কেনো যেনো মনে হচ্ছে এই কণ্ঠ সে চেনে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে, এতো লাভলী কণ্ঠ……

রুস্তমের ডেরায় পৌঁছে উৎস, আবির আর আজাদ কীভাবে রণকে মুক্ত করে আনে সে বোধহয় শুধু তারা-ই জানে। শুধু দূর থেকে উৎসের চোখ যায় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা লাভলীর দিকে। তার ঠোঁটের কোণে একটা সূক্ষ্ণ হাসি। যে হাসির মানে উৎস বোঝে না। এদিকে রুস্তমও বুঝতে পারে না, উৎস কীভাবে রণের ঠিকানা পেলো।
উৎসকে বেশি কষ্ট করতে হয়নি। রুস্তমকে যেয়ে শুধু সে বলেছে রসুনের ব্যবসা রমরমা চলছে তার। ইতোমধ্যে একজন রসুন হারিয়ে বৃহন্নলার খাতায় নাম লিখিয়েছে। রুস্তম বেশি বাড়াবাড়ি করলেও তাকেও অতিসত্বর সেই তালিকায় আনা হবে। রুস্তম শুধু ভয়ে ভয়ে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো বৃহন্নলা মানে কি? উৎস মুচকি হেসে বলেছিলো,”ঘুরে যাবে চাক্কা, হবে তুমি ছক্কা।”
আর কিছু বলা লাগেনি, রুস্তম নিজে থেকেই রণকে ছেড়ে দেয়। রণ অবশ্য নিজেও অনেকটা আহত হয়েছে। তাকেও হাসপাতালে নিতে হয়। সব মিলিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ওদের রাত সাড়ে দশটা বেজে যায়। এই লম্বা সময় বহ্নি অবাকভাবে মরার মতো ঘুমিয়ে ছিলো, সে এসবের কিছুই জানেনা।

রাত ঠিক বারোটা বাইশ মিনিটে রণের সাথে বহ্নির বিয়ে হয়ে যায়। ইস্পাতের মতো শক্ত মেয়েটার মনে হলো সে জ্ঞান হারাবে। কম্পিত দৃষ্টিতে রণের দিকে তাকায় সে। রণও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মায়াবতীকে আজ মায়ারাজ্যের রাজকন্যা মনে হচ্ছে। নতুন করে তাকে সাজানোর কথা বলেছিলো শীতল। রণ রাজি হয়নি। সে তার প্রিয়তমা কে যে কষ্ট দিয়েছে, সেই কষ্ট উশুল করতে আর এক মুহুর্তও দেরি কর‍তে নারাজ সে। বাকি সাজ সে নিজে সাজাবে, একান্তে…..

উঠোনের এক কোণায় বসে সিগারেট খাচ্ছে উৎস। আবির আর আজাদ মাটিতেই শুয়ে পড়েছে। বৃষ্টির পর মাটিতে খুব সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যায়, একদম সোঁদা মাটির গন্ধ। মাটির সাথে শরীর মিলিয়ে দিতে ইচ্ছা করে যেনো।
আবিরের চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এমন শান্তি সে জীবনেও পায়নি মনে হচ্ছে। এই পরিবারটা এতো শান্তির কেনো? বহ্নিকে তার মহাপুরুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারাটা এতোটা শান্তির কেনো সে বুঝতে পারছে না। ভাগ্যিস পুরুষ মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছিলো সে। নাহলে যে আজকের ইতিহাসের মুখোমুখি হতে পারতো না সে। এ যে এক ইতিহাস রচিত হয়ে গেলো। এ ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারাটা কম ভাগ্যের বিষয় না।

আজাদ পায়ের উপর পা তুলে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে আকাশের দিকে। বুকটা ভার হয়ে আছে তার। টকটকে লাল শাড়ি পরা, লম্বা বিনুনী করা চুলের সামান্য মেয়েটাকে অসামান্য সুন্দর লাগছিলো তার। আচ্ছা মেয়েটা কি বুঝতে পারছে যে আজাদ নামের এই ভবঘুরে ছেলেটা তার প্রেমে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে? এই অনুভূতি তার জীবনে প্রথম। প্রথম নারীর কাছ থেকেই ছ্যাকা খেয়ে যাবে সে? প্রথম অভিজ্ঞতা কি তবে তেতোই হয়ে যাবে?

“উৎস ভাই….”
শীতলের অতি ঠান্ডা গলায় সবাই চমকে তাকায়। রাত বাজে প্রায় দেড়টা। রণ আর তার বাবাকে ফিরতে দেওয়া হয়নি তাদের বউকে নিয়ে। আজ রাতটা এখানেই থাকবে তারা। বহ্নির বাসর এ বাড়িতেই হবে। উঠোনে ফোঁটা কিছু নাম জানা-অজানা ফুল দিয়ে শীতল, আভা আর অগ্নি খুব যত্ন করে ঘর সাজিয়ে ফেলেছে খুব সুন্দর ভাবে। ওদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে বাকিরা নিচে নেমে এসেছে। বরযাত্রীর বাকিরা চলে গেছে। গ্রামের কিছু আত্মীয় যেতে পারেনি। তারা সবাই রয়ে গেছে। ছোট্ট বাড়িটায় মানুষজন গিজগিজ করছে। উৎসের ঘরেও কয়েকজনকে জায়গা দেওয়া হয়েছে। বাস্তুহারার মতো ঘুরছে ছেলেগুলো। অথচ ওদেরই বিশ্রাম দরকার ছিলো বেশি। ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে একেকজন।

“শীতল তুমি?”
শীতল মাথা নিচু করে বললো,”আসুন আপনারা আমার সাথে।”
“কোথায় যাবো?”
শীতল গম্ভীর গলায় বললো,”নিজেদের চেহারা দেখেছেন? ক্লান্তিতে কি অবস্থা একেকজনের। ঘুমাতে হবে না?”
আবির আর আজাদ উঠে দাঁড়িয়েছে।
উৎস ম্লান গলায় বললো,”সমস্যা নেই শীতল। আজ রাতটা আমরা এখানেই কাটিয়ে দিতে পারবো। আর বিশ্বাস করো। একটুও ক্লান্তি নেই আজ আমাদের। মনে হচ্ছে স্বর্গসুখ পেয়ে গেছি। এই সুখ পেলে কয়েক রাত না ঘুমালেও ক্ষতি নেই।”
শীতল চাপা গলায় বললো,”আসতে বলেছি আসুন। নাহলে সকালে দেখবেন মশা আপনাদের উঠিয়ে নিয়ে আরেক দুনিয়ায় নিয়ে গেছে।”
উৎস অবাক হয়। শীতল কখনো এভাবে কথা বলেনা। আজকে তার গলায় যেনো শাসনের সুর।
শীতল দাঁড়ায় না আর, এগিয়ে যায়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওরাও যায় শীতলের পিছন পিছন। এতো মানুষের মধ্যে শীতল কোথায় তাদের ঘুমাতে দিবে সে এক বিস্ময়।

কিন্তু না, মেয়ে জাতির জন্মই হয়েছে অগোছালো কিছু গুছিয়ে ফেলার জন্য। সৃষ্টিকর্তা তাদের অদ্ভুত একটা শক্তি দিয়েছেন। সেই শক্তি দিয়ে তারা মাঝে মাঝে অসাধ্যকে সাধন করে ফেলতে পারে বোধহয়। পুরুষেরা যতোই শক্তিশালী হোক না কেনো, এই গুণ মেয়েদেরই বেশি।

বারান্দার এক কোণায় তোষক বিছিয়ে দিয়েছে শীতল। সেখানে তিনটা বালিশ, কাঁথা আর মশারী টাঙানো সুন্দর করে। কয়েলও জ্বালিয়ে দিয়েছে আবার পাশে। বৃষ্টির পর ভীষণ মশা আসে জংলা জায়গা থেকে।
অভিভূত হয়ে যায় আবির আর আজাদ। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে তাদের। ঝপ করে বিছানায় পড়ে যায় তারা। তাদের মনে হচ্ছে এতো শান্তি বোধহয় দামী কোনো জায়গাতেও তাদের হবে না। এরচেয়ে শান্তির ঘুম কোনোদিন হয়নি তাদের।

উৎস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার কেনো যেনো ভীষণ কান্না পাচ্ছে। তার খুব সাধারণত কান্না পায়না। সাধারণ একটা ব্যাপারে কেনো তার এভাবে কান্না পাচ্ছে তা-ও সে বুঝতে পারছে না। এই মুহুর্তে সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভূবনভোলানো রূপসী, তার প্রেয়সীর দিকে তাকাতে পারবে না। সে দূর্বল হয়ে পড়বে। প্রেয়সীকে একবার জোরে বুকে চেপে রাখার অসম্ভব ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে পারবে না।

“কি হলো? দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? শুয়ে পড়ুন।”
উৎস নিচু গলায় বললো,”তোষক পেলে কই?”
শীতল মুচকি হেসে বললো,”আমার খাটেরটা দিয়েছি, অতিরিক্ত আর কোথায়?”
উৎস ঝট করে মাথা তুলে তাকায়। শাড়ি পালটে সাধারণ একটা জামা পরেছে শীতল। মুখে একবিন্দু প্রসাধনীর চিহ্ন নেই, ধুয়ে ফেলেছে। চুলগুলো খোঁপা করে রাখা মাথার উপরে।
কাজল ধুয়ে ফেলার পর একটা মেয়ের সারা মুখ জুড়ে যে সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে, সেই আভায় পুরো দুনিয়া আলোকিত হতে পারে। অন্তত প্রেমিকের কাছে তো তাই।

“তাহলে তুমি ঘুমাবে কীভাবে?”
“ও কিছু হবে না। আমি একটা কাঁথা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়বো।”
উৎস ঢোক চেপে কান্নাটা গিলে ফেলে। এমন লাগছে কেনো তার? বুকটা কেমন উথাল-পাতাল করছে।

“কি হলো যান?”
“শীতল…”
“বলুন।”
“তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি? মিনিট পাঁচেকের জন্য?”
শীতল হতভম্ব হয়ে যায় উৎসের কথা শুনে। উৎসের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। বারান্দার ষাট পাওয়ারের টিমটিমে আলোটার নিচে দুইজন মানব-মানবী ক্লান্ত চোখে অক্লান্ত দৃষ্টিতে দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে একনাগাড়ে। ঘোর লাগে এই পরিবেশে। কেউ যেনো কানে কানে বলে, ভুল কর, ভুল কর, ভুল কর।

“উৎস ভাই…”
“উহু, শুধু উৎস।”
“কি বলছেন কি?”
“এই পাঁচটা মিনিট আমাকে দাও, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি সারাজীবন তোমার সুখের দায়িত্ব আমি নিবো। শুধু এই পাঁচটা মিনিটের সুখ আমাকে দাও।”
শীতল তাকায় আবির আর আজাদের দিকে, ওরা বেহুশের মতো ঘুমিয়ে গেছে এটুকু সময়ের মধ্যে।
শীতল আবার তাকায় উৎসের দিকে। প্রণয়ের আকাঙ্ক্ষা ভরা দৃষ্টি উপেক্ষা করার শক্তি পাচ্ছে না সে। নিজেও দূর্বল হয়ে যাচ্ছে।

শীতলকে নীরব দেখে উৎস ম্লান হেসে বিছানায় পা রাখতেই শীতল উৎসের হাত টেনে ধরে পিছন থেকে। উষ্ণ, কোমল হাতের স্পর্শ টের পেতেই উৎস পিছন ঘুরে তাকায়।

“পাঁচ মিনিটের বিনিময়ে সারাজীবন এক মহাপুরুষের দেওয়া সুখ পাওয়া গেলে ক্ষতি কি?”
“ভেবে বলছো?”
“ভাবাভাবির অধ্যায় পার করে আসছি তো সেই কবেই।”
“তাহলে এখন কোন অধ্যায়ে আছো?”
“ভালোবাসাবাসির।”
উৎস ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,”আর পরে কোন অধ্যায়?”
“ধুর এতো কিছু জানিনা আমি।”
“আমি জানি।”
“কি?”
উৎস শীতলকে আচমকা বুকের সাথে চেপে ধরে। বরফের মতো জমে যায় শীতল। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে উৎসের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ। লাভ-ডাভ, লাভ-ডাভ আওয়াজের পরিবর্তে শীতলের মনে হচ্ছে সেই আওয়াজটা বুঝি বলছে, অনুপমা, অনুপমা….

উৎসের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে শীতল। সে জানে সে অন্যায় করছে, ভয়ংকর অন্যায়। তবে মাঝে মাঝে কিছু অন্যায় অনুশোচনার বদলে তীব্র শান্তি দেয়। পরিণাম না ভেবেই বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে বসে থাকে।
সিগারেটের, ঘামের গন্ধ ছাপিয়ে একটা গন্ধ মাতাল করে দেয় শীতলকে। উৎদের নিজস্ব গন্ধ। লোহা যেমন চুম্বকের তীব্র আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারেনা, সে নিজেও পারছে না এই শান্তিটুকু থেকে নিজেকে উপেক্ষা করতে। বুকটা হাহাকার করে ওঠে তার।

মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার একটাই অসুবিধা, শুধু ভুল করতে ইচ্ছা করে। ভুল জেনেও পিছিয়ে আসার শক্তিটুকু পাওয়া যায়না। যা এই অতৃপ্ত মানব-মানবী দু’টো খুব ভালো করে বুঝতে পারছে।

উৎসকে হঠাৎ হালকা ধাক্কা দিয়ে শীতল তার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে দৌড়ে ঘরে চলে যায়। একরাশ শূণ্যতা ঘিরে ধরে উৎসকে। তার কেনো যেনো মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে সে রাখতে পারবে না, হারিয়ে ফেলবে। বেঁচে থাকার কারণটুকু বোধহয় মুছে যাবে তার। খোদা তার এতোটুকু কপালে এতোটা শান্তি বোধহয় রাখেনি।

“কাছের মানুষ দূরে থুইয়ে, মরি আমি ধড়ফড়াইয়া রে….”
উৎস কিছুটা চমকে ঘুরে তাকায়। আজাদ উঠে বসেছে, আবিরও। আজাদের গানের কণ্ঠ চমৎকার। এই রোমাঞ্চকর পরিবেশে যা আরো সুন্দর মনে হয়।

“তোরা ঘুমাসনি?”
“না ঘুমালেও আমরা কিছু দেখিনি, কি আবির ভাই? বলেন না কেনো?”
“হ্যা হ্যা, আমরা কিছুই দেখিনি।”
উৎস মুচকি হেসে বিছানায় উঠে যায়। বুক থেকে ঠেলে আসা কান্নাটা আবার ঢুকিয়ে দেয় ভিতরে। ওইযে, এক অলিখিত নিয়ম যে আছে, পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই। ওটা শুধু নারীর জন্যই সৃষ্টিকর্তা বরাদ্দ করে রেখেছেন!

“শাহানা…”
“বলো, শুনছি।”
“তোমার মনে আছে, এমনই এক ঝড়-জলের রাতেই আমাদের বিয়ে হয়েছিলো?”
শাহানা ছোট্ট করে উত্তর দেয়,”মনে আছে।”
“ইতিহাস তবে সত্যিই পুনরাবৃত্তি হয়?”
“ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়, কিছুটা বিবর্ধিত বাকিটা অপরিবর্তিত।”
“বাহ খুব সুন্দর একটা কথা বললে তো।”
শাহানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”তুমি খুশি তো?”
নওশাদ উঠে বসে শোয়া থেকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে জানালা থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে। শাহানাও উঠে বসে পাশে।

“কি হলো?”
নওশাদ ছোট্ট করে হেসে বললো,”আজ বহ্নির দিকে তাকিয়ে কেনো যেনো তোমার মুখটা ভেসে উঠছিলো আমার জানো তো? আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে এই দৃষ্টি আমি দেখেছিলাম আমার অর্ধাঙ্গিনীর চোখে। সেই দৃষ্টিতে তুমি এই নওশাদ খাঁ’কে সাথে সাথে ঘায়েল করে ফেললে। আর আজ সেই একই দৃষ্টি আমার রাজকন্যার চোখে আমি দেখেছি। তার প্রিয় মানুষটার জন্য এমন প্রেমময় দৃষ্টি ছিলো। আমি সাথে সাথে খোদার দরবারে দুই হাত তুলেছি। আমার কলিজার এই দৃষ্টি যেনো তার স্বামীর প্রতি জীবনের শেষ দিন অবধি থাকে।”
শাহানা স্বামীর বাহু জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রাখে। তার চোখের নোনাপানিতে ভিজে যায় নওশাদের ফতুয়ার হাতা।

“কেঁদো না দোয়েল পাখি আমার, কেঁদো না।”
“পরজন্ম বলে কিছু নেই, এই পৃথিবীতে আর ফিরে আসতে পারবো না। যদি আসার সুযোগ পেতাম আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী হয়েই বার বার আসতে চাইতাম। হয়তো মানুষ হয়ে নাহয় দোয়েলের বেশে।”
নওশাদ মুচকি হেসে বললো,”পরকাল তো আছে। সেই কালে কি আমাকে চাওনা?”
“চাই, একবার না, একশত বার না, এক সহস্র বার না, কোটি কোটি বার না অসীম বারের জন্য তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকেই চাই। গণিতের ভাষায় যাকে বলে টেন্ডস টু ইনফিনিটি…..”

“ওরে বাবা, গণিতের ভাষা শিখলে কোথা থেকে?”
শাহানা লাজুক হাসে। নওশাদ এক হাতে জড়িয়ে ধরে শাহানাকে। শাহানার কোমল শাড়ির আঁচল থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। নওশাদের ভীষণ ঘুম পায় সেই সুঘ্রাণ থেকে। সবকিছু এতো সুন্দর লাগছে কেনো এ রাতের? এই রাতের বিশেষত্ব কি? প্রকৃতি যে ক্ষণে সুখ দেয়, সে ক্ষণ কি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সুখ বৃদ্ধি করতেই থাকে? আশ্চর্য তো!

ফুলের মাঝে চুপচাপ বসে আছে বহ্নি। মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছে সে। শ্বাস যেনো ফোঁপানোর মতো শব্দে বেরিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। তার এখনো মনে হচ্ছে সে স্বপ্নের মধ্যে আছে। এমন অদ্ভুত অনুভূতি আগে কখনো হয়নি তার। ভয়, সুখ, আনন্দ, উত্তেজনা সবকিছু যেনো একসাথেই হচ্ছে। একটা বারের জন্যও মানুষটার দিকে তাকাতে পারছে না সে। তার মনে হচ্ছে তাকালেই সে স্বপ্নের মতো উধাও হয়ে যাবে।

তবে রণ কিন্তু তাকিয়েই আছে বহ্নির দিকে। ঘরে একটা নীল আলো জ্বলছে। সেই হালকা আলোয় সামনে বসে থাকা এই মানবীটাকে হুরের মতো লাগছে।
রণ কিছুটা এগিয়ে আসে বহ্নির দিকে। বহ্নির ঠোঁট তিরতির করে কেঁপে ওঠে।

“বহ্নি।”
“হুম।”
“ভয় পেয়েছিলে খুব? ভেবেছিলে আর আসবো না?”
বহ্নি উত্তর দেয়না।
“ওই সময় আমার মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর যে কোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও আমার তোমার কাছে পৌঁছাতে হবে। একমাত্র আল্লাহর পাঠানো মৃত্যুদূত ছাড়া আর কেউ আমাকে তোমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না, এমনটাই মনে হচ্ছিলো। ভীষণ অসহায় লাগছিলো, এতোটা অসহায় আগে কখনো লাগেনি।”
বহ্নি সজল চোখে তাকায় রণের দিকে। রণের দৃষ্টিতে পাহাড়সম মাদকতা।

“যদি হারিয়ে ফেলতেন আমাকে? এসে দেখতেন আমি আর নেই?”
“তবে যে আমি নিজেও শেষ হয়ে যেতাম।”
“এমন হয় নাকি?”
“ভালোবাসলেই হয়।”
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
“প্রমাণ চাও?”
“প্রমাণ আছে?”
“আছে।”
“তো দিন।”

রণ বহ্নির অনেকটা কাছাকাছি এসে বসে। বহ্নি শ্বাস নিতেও যেনো ভুলে যায়। রণ বহ্নির হাতটা ধরে তার চুড়িগুলো একেক করে খুলতে থাকে, খুব যত্ন করে। রুনঝুন শব্দ হতে থাকে চুড়ির। বহ্নি শ্বাস আটকে বসে থাকে।
চুড়ি খোলা শেষে একেক করে বাকি গহনাও খুলতে থাকে রণ।
বহ্নি মৃদু গলায় বললো,”প্রমাণ কোথায়?”
“এইতো আমার কাছেই।”
কথাটা বলে রণ বহ্নির হাতটা নিয়ে নিজের বুকের বাম পাশে চেপে ধরে।

“বুঝতে পারছো বহ্নি? কতোটা কাতর হয়ে পড়ছে এই বুকটা তোমার জন্য, তোমাকে ভালোবাসার জন্য? অতৃপ্ত হয়ে আছি, বাঁচার সুযোগ কই? বঞ্চিত করার আগে মেরে ফেলো।”
“যার মধ্যে নতুন জীবন পেয়েছি, তাকে মেরে ফেলার মতো সাহস তো আমার নেই।”
“তবে বঞ্চিত করোনা।”
“প্রিয়তমকে বঞ্চিত করতে চাইনি তো।”
রণ অবাক হয়ে বললো,”তুমি আমাকে ভালোবাসো বহ্নি? এই সৌভাগ্য আছে আমার?”
“চাঁদের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই জেনে নিন ভালোবাসি কিনা। বাকিটা আমার কাতরতা আপনাকে বুঝিয়ে দেবে।”
“প্রশ্রয় দিচ্ছো?”
“পাপ তো করছি না। নাকি আমি এখনো অপবিত্র বলে ছুঁতে ইতস্তত করছেন?”
“বহ্নি……”
হালকা চিৎকার করে ওঠে রণ।

বহ্নি হেসে বললো,”কি হলো?”
“এই কথা যেনো এ জীবনে এটাই শেষবার বলা হয়। আমার কাছে তুমি পবিত্রের চেয়েও পবিত্র।”
বহ্নি মাথা নিচু করে ফেলে। দু’ফোঁটা নোনা পানি গাল বেয়ে নেমে যায় তার।

“তুমি প্রমাণ চেয়েছিলে না? তুমি প্রস্তুত থাকলে এই চন্দ্রভরা রাতে তোমাকে আমি প্রমাণ দিবো। কথা দিচ্ছি বহ্নি, এই উন্মাদের মতো সুখ, এই স্বর্গীয় ভালোবাসা তোমার পুরোনো সকল ক্ষত সারিয়ে দেবে। অপবিত্র নয়, তোমার পবিত্র বিরানভুমিতে আমি প্রেম ছড়িয়ে দিবো। প্রতিটা শিরা-উপশিরা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে তোমার প্রিয়তমের প্রেমে, এ আমার প্রতিজ্ঞা।”

রণ জানালার পর্দা টেনে দেয়। চাঁদের অবাধ্য হালকা আলো তবুও আছড়ে পড়ে বহ্নির মুখে, গলায়, বুকে। স্বর্গীর সুখের মুহুর্তে বহ্নির চোখের সুখ অশ্রু একবাক্যে মেনে নেয়, রণ তার প্রতিজ্ঞা রেখেছে, একবিন্দুও মিথ্যা বলেনি সে।

(চলবে……)

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ৩৫

কলেজে কিছু একটা ঝামেলা হওয়ায় দুইটা ক্লাস না হয়েই ছুটি হয়ে যায় শীতলের। এদিকে উৎস আসবে আরো ঘন্টা দুই পরে। শীতলকে কড়াকড়ি নিষেধ করা আছে, কোনোভাবেই যেনো উৎস না এলে সে কলেজ গেটের বাইরে পা না রাখে। তার পা নাকি ভেঙে ফেলা হবে তাহলে স্ট্যাম্প দিয়ে। বাকি জীবন তাকে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করা লাগবে। কি ভয়ংকর কথা!

বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে শীতল। শীতল যাচ্ছে না তাই অগত্যা অগ্নিও যেতে পারছে না। সে বলেছে যে সে নিজে শীতলকে বাড়ি পৌঁছে দিবে। তা-ও শীতল যাবে না। হুইলচেয়ারে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ঢের ভালো। অগ্নি ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বারবার রাগী চোখে তাকায় শীতলের দিকে। তাকাতেই আবার রাগটা ভেঙেও যায় তার। শীতলের মুখটা এতোই নিষ্পাপ যে, তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তার উপর কোনোভাবেই আর রাগ করা যায়না।

বেশ কিছুক্ষণ দুইজন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর শীতল মিনমিন করে বললো,”কি করবো রে অগ্নি? চলে যাবো নাকি? ভীষণ গরম লাগছে তো। কিরকম রোদ পড়েছে আজকে। বরফ গলা পানি ঢালতে ইচ্ছা করছে মাথায়।”
অগ্নি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”এতোক্ষণ পর তোর এই বোধদয় হলো?”
“কি করবো বল? তুই তো চিনিস উনাকে। খাটাস একটা। কোন কুক্ষণে যে উনার মতো মানুষের প্রেমে পড়তে গিয়েছিলাম। কাঠখোট্টা লোক।”
অগ্নি মুখ টিপে হেসে শীতলের ঘাড়ে হাত রেখে বললো,”শুধুই কাঠখোট্টা? একদম রসকষ নেই বল?”
“হ্যা নেই-ই তো। এতে আবার হাসির কি আছে?”
অগ্নি শীতলের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,”এখন বুঝবি না আছে কিনা, বিয়ে হোক তারপর বুঝবি।”
“কেনো? বিয়ের পর কি হবে?”
“বিয়ের পর বাসর হবে, এরপর কিছু বছর পর বাচ্চাকাচ্চা হবে। রসকষ না থাকলে বাচ্চা হবে কীভাবে?”
শীতলের কান লাল হয়ে যায়। অগ্নি অসভ্যটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে। এই মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর মাশাল্লাহ, শুধু তার মুখের ভাষা আস্তাগফিরুল্লাহ। সে অবলীলায় এমন সব কথা বলতে পারে যা শীতল স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা।

“অগ্নির বাচ্চা তুই কিন্তু বেশি করতেছিস এবার। তোরে আমি আস্ত রাখবো না।”
“আর এদিকে তোর হবু বর তো নিজের রসকষ জমিয়ে রেখে মানুষের রসকষ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে শুনলাম।”
শীতল অবাক হয়ে বললো,”তার মানে?”
“সে তো রসুনের ব্যবসা শুরু করেছে, তুই জানিস না?”
“এসব কি উল্টাপাল্টা কথা বলছিস? উনি রসুনের ব্যবসা শুরু করবে আর আমি জানবো না? আর তার সাথে রসকষের কি সম্পর্ক?”
“আছে আছে।”
“তুই এতোসব জানলি কীভাবে? আমার প্রেমিক আর সব জানিস তুই?”
“হিংসা করিস না তো। আর তোর প্রেমিকের দিকে আমার নজরও নেই। বাপরে, ওটা তো একটা সাক্ষাৎ এনাকোন্ডা। উল্টাপাল্টা কিছু করতে গেলে আমাকে নিঃশ্বাস দিয়েই ভস্ম করে দিবে।”
“তবে কীভাবে কি জানলি তুই?”
অগ্নি কুটকুট করে হাসে মাথা নিচু করে। শীতলের কেনো যেনো মনে হয় অগ্নি কারো প্রেমে পড়েছে, ভীষণভাবে। অগ্নির মতো মেয়ে কার প্রেমে পড়তে পারে? সে কি সৌভাগ্যবানকে চিনে?

শীতল কিছু বলতে যাবে তার আগেই ভুস করে একটা সাদা প্রাইভেট গাড়ি এসে থামে, তাদের অনেকটা কাছেই। শীতল কিছুটা চমকে ওঠে। গাড়িটা ভীষণ পরিচিত মনে হয় তার কাছে, কোথায় যেনো দেখেছে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে সে গাড়িটার দিকে।

গাড়ির দরজার খোলে, গাড়ি থেকে নামে অত্যন্ত রূপবতী এক নারী, স্বল্পবসনা। যার নাম প্রত্যাশা। যাকে শীতল একদমই সহ্য করতে পারেনা।

প্রত্যাশা উঁচু হিলে খটখট করে শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসে শীতলের দিকে। শীতল চোখমুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে।
“শীতল, তুমি এখানে?”
শীতল জোর করে হাসির চেষ্টা করে।
“আমার কলেজের সামনে আমার থাকাটা কি খুব অসম্ভব কিছু?”
“না তা না। তবে আমি ভীষণ অবাক হয়েছি, সত্যি। আমি এদিক দিয়েই একটা কাজে যাচ্ছিলাম। দূর থেকে তোমাকে দেখে গাড়ি থামাতে বললাম।”
“ভীষণ অবাক হওয়ার কারণ?”
“কারণটা তেমন কিছু না, আমি অনেকদিন থেকে ভাবছি তোমার সাথে কিছু কথা বলবো, একদম একান্তে।”
“আমার সাথে আপনার কথা? তা-ও আবার একান্তে?”
“হ্যা, আর আজ সেই সুযোগটা পেয়ে গেলাম।”
শীতল অগ্নির দিকে তাকায়, অগ্নি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে শীতলের দিকেই। বরাবরই শীতলরা তিন বোন খুব সাধারণ পরিবারের অসাধারণ তিন রাজকন্যা। তাদের চালচলন, পোষাক খুবই সাধারণ। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যই তাদের অপরূপা করে তোলে। এরকম একটা মেয়ের সাথে ওর কি সম্পর্ক থাকতে পারে অগ্নি বুঝতে পারেনা।

“কিন্তু আমি যদি আপনার সাথে কথা বলতে রাজি না হই?”
প্রত্যাশা অবাক হয়ে বললো,”তুমি আমার সাথে কথা বলতে চাওনা?”
“না চাইনা। আপনার সাথে আমার কোনো কথা থাকতে পারে বলেও মনে হচ্ছেনা। আপনি হয়তো মনে করেন যে আপনাদের প্রচুর টাকা আছে তাই আপনি যখন যা বলবেন তাই অপর পক্ষের মানুষটা করতে বাধ্য। তবে সবসময় ব্যাপারটা তা নয়। এর আগে আপনার সাথে আমার দুই থেকে তিনবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে একবারই মাত্র। আর সেই অভিজ্ঞতা আমার জন্য ভালো নয়। আপনি আমাদের সূক্ষ্ণভাবে অপমান করার চেষ্টা করেছিলেন। আপনার মনে পড়ে কিনা জানিনা। সবাই আমাকে বোকা বলে জানেন তো? তবে আমি এতোটাও বোকা নই। অপমানিত স্থানে আমি বারবার যাইনা।”

শীতলের কথায় রোমাঞ্চিত হয় প্রত্যাশা। সত্যিই সে এমন একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের, কলেজে যাওয়া মেয়ের মুখে এতোটা সুন্দর উত্তর আশা করেনি। এটা ভুল নয় যে, ও বাড়ির মেয়েগুলো ভদ্র৷ মার্জিত এবং সুন্দর। সারাজীবন সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া প্রত্যাশার এমন একটা জীবনের মুখোমুখি হতে হয়নি কখনো। সূক্ষ্ম একটা হিংসা তার মনেও দাগ কাটে, যা খুবই অস্বস্তিকর।

প্রত্যাশা ম্লান হাসে। হঠাৎ করে একটা হাত রাখে শীতলের হাতের উপর। শীতল থমকে যায় কিছুটা।

“শীতল আমি আমার ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত। আমি কি একটা সাধারণ ক্ষমার যোগ্য নই?”
শীতল হতবাক হয়ে তাকায়। এই মেয়েটা কিনা তার সাথে এভাবে কথা বলছে? কাহিনী কি?

“এভাবে তাকিও না তো, নিজেকে কেমন ভিলেন ভিলেন মনে হচ্ছে তোমার চাহনী দেখে।”
প্রত্যাশা হাসে, শীতল হাসতে যেয়েও হাসে না। সে খুব অল্পতেই গলে যায়, এটা একটা বড়সড় দোষ তার, সবাই বলে।

“কি হলো ক্ষমা করেছো?”
“দেখুন আমি আসলে ওভাবে…”
“আচ্ছা আর কিছু বলা লাগবে না। যদি ক্ষমা করে থাকো, তবে এসো।”
“কোথায় যাবো?”
“এখানে তো অনেক মানুষ, চলো কিছুটা এগিয়ে যাই। সামনেই তো ঘাট আছে, ওখানটা বেশ নিরিবিলি।”
শীতল উশখুশ করে। না-ও বলতে পারছে না আবার হ্যা ও বলতে পারছে না। যদি দেরী হয়ে যায়? উৎস ভাই যদি এসে যায় তার আগে? আবার প্রত্যাশার সাথে দেখে যদি আরো রেগে যায়? কিন্তু সে এমনভাবে তাকিয়ে আছে শীতলের দিকে, শীতল না বলতেও পারছে না।

শীতলকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রত্যাশা ছোট্ট করে হাসে।
“মনে হচ্ছে তুমি রাজি, তবে ভয় পাচ্ছো। ভয়ের কিছু নেই, তুমি চাইলে তোমার বান্ধবীকেও সাথে রাখতে পারো।”
অগ্নি শীতলের হাত চেপে ধরে, শীতলকে সে কোনোভাবেই একা ছাড়বে না।

“উঠো তবে গাড়িতে।”
শীতল প্রত্যাশার কথায় কঠিন গলায় বললো,”গাড়িতে উঠবো না।”
“কেনো?”
“প্রথমত আমার গাড়িতে ওঠার অভ্যাস নেই, বমি পায়। আর দ্বিতীয়ত আমাদের গায়ে ভীষণ ঘামের গন্ধ। আপনার এতো দামী গাড়ির ভিতরের সুন্দর গন্ধ তাতে চাপা পড়ে যাবে, যা আপনার ভালো লাগবে না। যদি আমাকে কিছু বলতে চান, তবে হাঁটুন আমার সাথে। ঘাট বেশি দূর তো নয় এখান থেকে।”
প্রত্যাশা মিনিট দুয়েক চুপ করে কিছু ভাবে, এরপর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে মুচকি হেসে বললো,”বেশ চলো।”

নতুন সংসার নিজের মতো করে সাজাচ্ছে বহ্নি আজকাল। কি যে ভালো লাগে তার এই কাজগুলো করতে। ঘরের প্রতিটা কোণা তার নিজস্ব, সে কতভাবে সাজাবে, কি রান্না করবে সব কিছু সে ঠিক করে। নিজেকে রানী রানী মনে হয় তার। রণের ভালোবাসা মুড়ে রেখেছে তাকে। তার এতোদিন ধারণা ছিলো, তার বাবার মতো স্বামী আর একটাও হয়না। তার বাবা যেভাবে তার মা’কে ভালোবাসে পৃথিবীর আর কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে এভাবে ভালোবাসতেই পারবে না। তবে সবকিছু যেনো নতুন করে আবিষ্কার করছে সে বিয়ের পর। তাকে যেনো মাথায় তুলে রাখতে পারলেই বাঁচে রণ। তার প্রতিটা বিষয় খেয়াল রাখে। কাজের লোকও রেখে দিয়েছে একটা বহ্নির সুবিধার জন্য। বহ্নির পড়াশোনার যেনো কোনো ক্ষতি না হয় সংসারের চক্করে।
প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই বহ্নিকে নিয়ে বের হয় সে অফিসের পর। বহ্নির পছন্দমতো ঘরের জিনিস কেনে, টুকটাক যা-ই পারে। আস্তে আস্তে এভাবেই সাজিয়ে নিচ্ছে তারা নিজেদের সংসার।
সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগে বহ্নির। এতো সুখ তার জীবনে ছিলো সে ভাবতেই পারেনি। মানুষটাকে সবসময় চোখের সামনে দেখতে ইচ্ছা হয় তার। কল্পনার জগতেই তাকে ভাসিয়ে রাখে সবসময় রণ।

বিকালের পড়ন্ত রোদ পড়েছে বারান্দায়। দুপুরের পরই ভার্সিটি থেকে ফিরেছে বহ্নি। খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে বহ্নি এক কাপ চা নিয়ে। রণের বাবা আজ সকালেই গ্রামে গেছে। বহ্নির ভীষণ একা একা লাগছে তাই। এই সময় বাড়িতে থাকলে কতো মজা হয়। শীতল আর উৎস ফেরে, আভাও ফেরে কোচিং শেষে। ফুপু মুড়ি মাখে, মা হয়তো ভাজাপোড়া বানায়। সবাই একসাথে বসে খাওয়া হয়। তিন বোনের আড্ডা জমে। কখনো তাদের ঘরে, কখনো উঠোনে বা বারান্দায়। আর এখানে? নির্জনতা আর নীরবতাই তার বন্ধু। রণ বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত বড্ড খারাপ লাগে তার। কোনোভাবেই মন খারাপটা কাটে না।

টবে লাগানো মানিপ্লান্ট গাছিগুলোতে পানি দিতে দিতে হঠাৎ দরজায় কষাঘাতের শব্দ শুনে বেশ চমকে ওঠে সে। রণের অফিস ছুটি হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তার বাবা মাঝে মাঝে অফিস শেষে তাকে দেখতে আসছে এ বাসায় আসার পর থেকে। কিন্তু তাও তো অনেক রাতে। এই অসময়ে কে আসবে? উৎস আসেনি তো? শীতলের তো কলেজ ছুটি হয় এমন সময়েই। তবে কি দুইজন তাকে দেখতে চলে এলো?

খুশির একটা ঝলক বয়ে যায় বহ্নির শরীর জুড়ে। যদি সত্যিই এমনটা হয়, ওর যে কি আনন্দ হবে। কতোদিন পর আড্ডা জমবে আবার। ইশ যদি আভাটাও আসতো সাথে।
পাখির মতো উড়তে উড়তে বহ্নি দরজা খোলে, আর সাথে সাথে অবাক হয়ে যায় সে। চোখ বড় বড় করে তাকায় সামনের দিকে।

ক্লাস শেষে উৎস, আজাদ আর আবির মাঠেই পা ছড়িয়ে বসে আছে। উৎসের হাতে সিগারেট, এটা শেষ করেই বেরিয়ে যাবে সে। শীতলের কলেজ ছুটি হওয়ার আগেই পৌঁছাতে হবে। রুস্তমকে সে বিশ্বাস করেনা একদম। রুস্তমের শত্রুতা উৎসের সাথে, উৎসের সাথে না পেরে সে চেষ্টা করছে উৎসের পরিবারের সাথে ঝামেলা করতে। বিশেষ করে বহ্নির বিয়ের সময় যা হলো। যদি লাভলী তাকে না জানাতো সময় মতো তাহলে কি হতো? কিন্তু লাভলী তাকে কেনো জানালো? এই চিন্তাও তার মাথায় ঘুরছে। লাভলী তো তাকে সহ্যই করতে পারতো না। তার এই উপকারটা লাভলী কেনো করলো? পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসছিলো সে রহস্যজনকভাবে। এই হাসির বা কারণ কি?
মানুষের মন কি ভীষণ অদ্ভুত! তারা কখন কি করে, কেনো করে নিজেরাই জানেনা অনেক সময়। মানুষের মনের মতো রহস্য এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।

“ভাই।”
আজাদের ডাকে উৎস তাকায় তার দিকে। আজাদের মুখটা কেমন ভার হয়ে আছে কিছুদিন। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে উৎস ঢুকতে চায়না। কিন্তু আজাদের এই মনমরা ভাব তাকে কষ্ট দিচ্ছে। এই ছেলেটাকে সে নিজের ভাইয়ের মতোই ভালোবাসে। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে উৎসকে ছেলেটা। যে ভালোবাসার মূল্য দেওয়ার ক্ষমতা উৎসের নেই। ভালোবাসার বিপরীতে শুধু ভালোই বাসতে হয়, আর কিছু না। সে ঠিক করেছে আরো দুই/একদিন সে দেখবে। এরমধ্যে আজাদের মন ভালো না হলে আর নিজে থেকে কিছু না বললে উৎস নিজে তাকে সবটা জিজ্ঞেস করবে। এমন হাসিখুশি একটা ছেলে চুপচাপ থাকলে আশেপাশের মানুষগুলোরই অস্বস্তি লাগে।

“বল আজাদ।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ভাই? ঠিকঠাক উত্তর দিবেন?”
“অবশ্যই, কি বলবি বল?”
আবিরও অবাক হয়ে তাকায় আজাদের দিকে। ছেলেটা হঠাৎ এমন ভারী গলায় কথা বলছে কেনো?

“ভাই ভালোবাসা মানে কি?”
উৎস আর আবির দুইজনই অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
“মানে?”
“আপনি তো একজনকে ভীষণভাবে ভালোবেসেছেন, তার মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছেন। কীভাবে বুঝলেন এই অনুভূতির নামই ভালোবাসা? আমাকে একটু বলতে পারবেন?”
অন্য সময় হলে উৎস আর আবির হেসেই অজ্ঞান হয়ে যেতো আজাদের কথায়। খুব ক্ষেপাতো তাকে দু’জন। কিন্তু আজ তার অসহায় মুখের সামনে ওরা নিজেরাই অবাক হয়ে যায়।

“বলুন না ভাই, কীভাবে বুঝলেন?”
উৎস আজাদের অসহিষ্ণুতা দেখে ভ্রু কুঁচকে। আসলেই তো কীভাবে বুঝলো সে?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উৎস আস্তে আস্তে বললো,”কবে বা কখন থেকে এই অনুভূতি আমার মধ্যে বেড়ে উঠেছে সে আমি নিজেই বুঝতে পারলাম না। শুধু মনে হলো হরিণচোখের ওই মেয়েটাকে বেশিক্ষণ না দেখলে আমার গলা শুকিয়ে আসে, মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত পানি খেয়ে ফেললেও সেই তৃষ্ণা মিটবে না। সে সামনে এলে এই শক্ত আমিটাও গলে তরল হয়ে যাই। যতোই মুখে যা বলি, তার সামনে আমি এখনো বাচ্চা। সে যদি আমাকে শাসন করে আমি এখনো ছোট শিশুর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য।”
উৎস থামে। পরক্ষণেই আবির খোলা গলায় বললো,”জেগে থেকেও স্বপ্ন দেখার নাম বোধহয় ভালোবাসা। কল্পনার চেয়েও সুন্দর অনুভূতির নাম হলো ভালোবাসা। যখন তুই কাউকে ভালোবাসবি তার চোখের দিকে তাকিয়ে মহাসমুদ্র দেখতে পাবি তুই। যে মহাসমুদ্র প্রশান্তের চেয়েও দীর্ঘ, আটলান্টিকের চেয়েও গভীর। যদি কখনো দেখিস ফেঁসে যাওয়ার মধ্যেও অদ্ভুত প্রশান্তি নিহিত আছে, তবে সেই অনুভূতির নাম তুই ভালোবাসা দিতে পারিস বোধহয়, খুব একটা ভুল হবে না।”

উৎস শান্ত চোখে তাকায় আবিরের দিকে, আবির মাথা নিচু করে বসে আছে। ছোট্ট করে হেসে অন্যদিকে তাকায় উৎস।

আজাদ মাঠেই শুয়ে পড়ে দুই হাত মাথার তলে রেখে। চোখ বন্ধ করে ফেলে সাথে সাথে। আসলেই তো, ভাইদের বলা অনুভূতি তো তার সাথে মিলে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই যে একজনের মুখ ভেসে উঠছে। ভালোবাসা বুঝি এভাবেই হয়?

কিছুটা দূরত্ব রেখে উৎসও শুয়ে পড়ে। তাদের দৃষ্টি আকাশের দিকে।
হাতের সিগারেটটা এগিয়ে দেয় আজাদের দিকে। আজাদ অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাতে নিয়ে লম্বা টান দেয় সিগারেটে।

“কাউকে ভালোবেসেছিস আজাদ?”
“অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে ভাই, একদম নতুন। অনেকটা ওরকম, চোখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা। এই অনুভূতির নামটা ভালোবাসা দিতে পারছি না এখনো। এতো তাড়াতাড়ি কি ভালোবাসা হয়?”
উৎস মুচকি হেসে বললো,”ভালোবাসা জন্মাতে অনন্তকাল লাগেনা, ছুটতে হয়না হাজার আলোকবর্ষ। ভালোবাসা হতে পারে এক দেখাতেই, এক পলকেই।”
“সত্যিই কি তাই?”
“হ্যা তাই।”
“তবে কি সত্যি আমি ভালোবেসে ফেলেছি? প্রেমে পড়েছি?”
“তাতো আমি বলতে পারবো না। তুই জিজ্ঞেস কর তোর মনকে। নিশ্চিত হলে তবেই বলিস আমাদের।”
“আর যদি সে রাজি না হয়?”
উৎস দাঁত বের করে হাসে, আবিরও হাসে।

“শুধু তুই আমাদের বলবি তোর ভালোবাসা নিখাদ কিনা, তাকে সব কষ্ট থেকে বাঁচাবি কিনা। বাকিটা আমরা দেখবো।”
আজাদ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,”কি দেখবেন?”
“তুইলা আনবো।”
উৎস হাসে শব্দ করে, আবিরও হাসে। আজাদও আর গম্ভীর হয়ে থাকতে পারেনা। গলা মিলিয়ে সে-ও হেসে দেয়।

“আপনি? এখন? এই সময়ে?”
রণ মুচকি হেসে ঘরে ঢোকে। বহ্নির নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না। অদ্ভুত ভালো লাগায় শরীর মন ছেয়ে যায় তার। সে ভাবতেই পারেনি রণ এই সময়ে বাসায় ফিরবে। ইচ্ছা করছে রণকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। যদিও এ কয়দিনে তাদের সম্পর্ক যথেষ্ট সহজ হয়েছে, বাড়িতে কেউ নেই। জড়িয়ে ধরলে কেউ দেখবে না। তবুও বহ্নির কেমন লজ্জা লাগে।

“জড়িয়ে ধরতে চাইলে ধরতে পারো। কেউ দেখবে না।”
এই বলে রণ মুখ টিপে হাসে। বহ্নি হতভম্ব হয়ে তাকায় তার দিকে।

“কি ভাবছো? তোমার এই সহজসরল বরটা মাইন্ড রিড করা শুরু করলো আবার কবে থেকে?”
বহ্নি উত্তর দেয়না। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। কি যে ভালো লাগছে তার।
রণ টাইয়ের বাঁধন খুলতে খুলতে বললো,”ভালোবাসা মানুষের চাওয়া বুঝতে মাইন্ড রিড করার প্রয়োজন হয়না জান। তার জন্য একটু বেশি ভালোবাসা থাকাই যথেষ্ট।”
বিয়ের পর থেকে রণ বহ্নিকে এই নামে সম্বোধন করছে। সে যতোবার ডাকে বহ্নি ততবার শিউরে ওঠে।

“আপনি আমাকে একটু বেশি-ই ভালোবাসেন?”
“সন্দেহ আছে? প্রমাণ লাগবে আরো?”
“কীভাবে প্রমাণ করবেন?”
রণ এগিয়ে আসে বহ্নির দিকে। বহ্নি চোখ বন্ধ করে দাঁড়ায়।
বহ্নির অনেকটা কাছে এসে রণ ফিসফিস করে বললো,”আমার নিঃশ্বাস যখন জড়িয়ে যায় তোমার নিঃশ্বাসের সাথে তখন কি তুমি বুঝতে পারো না আমার অসহায়ত্ব? আমি তোমাকে আরো বেশি ভালোবাসা দেওয়ার জন্য কতোটা ছটফট করি? তোমার শান্তিতে পূর্ণ ছোট ছোট আর্তচিৎকার আমাকে যখন উন্মাদ করে দেয়, আমার প্রতিটা যত্নে ভরা আদর কি তোমাকে বুঝতে দেয়না আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি? তোমার অনুপস্থিতি আমার বুক কতোটা ক্ষতের সৃষ্টি করে সে কি তুমি বোঝো না জান? তবে কেনো আমার ভালোবাসার প্রতি এখনো সন্দেহ তোমার? আর কি প্রমাণ চাও বলো? আমি দিতে প্রস্তুত। ঘরওয়ালীর কাছে যে সব অসাধ্য সাধন হতে বাধ্য।”
বহ্নি মুচকি হেসে রণকে হালকা ধাক্কা দেয়। রণ কিছুটা দূরে ছিটকে যেয়ে পড়ে।

“বারান্দায় যেয়ে বসুন, আমি কফি করে আনছি।”
“আনো আনো, কফি খেয়ে শক্তি বৃদ্ধি করি। শক্তির দরকার আছে না?”
বহ্নি লজ্জায় লাল হয়ে যায়, রণ ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে।

“এসব কোথা থেকে শিখেছেন?”
“কেনো? আমার কি সে অধিকার নেই?”
বহ্নি ছুটে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। শান্তিতে ছাওয়া শরীরটা যেনো বাতাসে ভাসছে তার।

দুই কাপ কফি নিয়ে দুইজন মুখোমুখি বসেছে বারান্দায়। কন্যা সুন্দর আলো এসে পড়েছে জানালার গ্রিল হলে। বহ্নির মুখ বেয়ে গলা বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে সেই আলো। এই মুহুর্তে তাকে গ্রীক দেবী আফ্রোদিতির মতো রূপবতী মনে হয় রণের। হাতের ধরা কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই রণের।

“খাচ্ছেন না কেনো? কফি যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“আমি তো উত্তপ্ত হয়ে আছি।”
“তার মানে?”
রণ কাপটা পাশে রেখে দেয়, বহ্নির হাত থেকেও তার কাপটা নিয়ে রেখে দেয়।

“কি হলো?”
“কিছু হয়নি, এখন হবে।”
“মানে? কি হবে?”
বহ্নি কিছু বুঝে ওঠার আগেই রণ তাকে পাজাকোলা করে কোলে তুলে নেয়। বহ্নি ভয়ে, লজ্জায় রণের বুকে মাথা লুকায়।

“নামান বলছি।”
“আগে নিজে শান্ত হবো, এরপর যা বলার বলবে। মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত, আমি সেদিন হবো শান্ত।”
বহ্নি রণের শার্ট খামচে ধরে। রণ সেদিকে তাকিয়ে হাসে। কিছু বলেনা, কিছু বলার সময় নেই এখন তার হাতে।

ফাঁকা একটা ঘরে প্রত্যাশা, শীতল আর অগ্নিকে আটকে রাখা হয়েছে। ঘরটা মাঝারি, কিছুটা অন্ধকার। শীতল ভয়ে কাঁপছে, প্রত্যাশা হতবাক, সেই তুলনায় অগ্নি শক্ত আছে।

“কি সমস্যা কি? আমাদের এভাবে এখানে আটকে রাখা হয়েছে কেনো? কেউ আছেন?”
ফাঁকা ঘরে অগ্নির কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে তাদের কাছেই ফিরে আসছে। শীতল ডুকরে কেঁদে উঠতে গেলেই অগ্নি ভয়াবহ রাগী চোখে তাকায় তার দিকে। শীতল থেমে যায় ভয়ে ভয়ে।

প্রত্যাশা অবাক হয়ে বললো,”আমাকে কেনো কেউ তুলে আনবে? আমরা তো শুধু কথাই বলছিলাম ঘাটে দাঁড়িয়ে।”
শীতল নাক টানতে টানতে বললো,”যা হলো আপনার জন্য হলো। আজ যদি আপনার কথা শুনে কলেজ গেট থেকে না যেতাম এমনটা হতো না।”
অগ্নি শান্ত গলায় বললো,”আচ্ছা এখন কেঁদে কি হবে শীতল? এরচেয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে এখান থেকে বের হবো কীভাবে আমরা?”
প্রত্যাশা মাথা নেড়ে বললো,”তার আগে জানতে হবে আমাদের কেনো এখানে তুলে আনা হলো? এরা কারা?”
শীতল ঠোঁট উল্টে কাঁদতে কাঁদতে বললো,”তারচেয়েও বড় কথা উৎস ভাই জানতে পারলে আমাকে নির্ঘাত মেরে হাড্ডি ভেঙে দিবে। হুইলচেয়ারে থাকতে হবে আমার বাকি জীবন।”
“উফফ তুই থামবি? ভাবতে দে আমাকে।”
অগ্নি চিন্তিত মুখে ভাবতে থাকে। ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। জায়গাটা ছিলো ভীষণ নির্জন। হঠাৎ একটা সাদা পাজেরো থামলো তাদের সামনে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শীতলের দিকে এগিয়ে গেলো দুইজন। শীতলের মুখে রুমাল চাপা দিয়ে গাড়িতে উঠালো তারা। বাকিরা অগ্নি আর প্রত্যাশাকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলো। কিন্তু অগ্নি ঝামেলা, চিৎকার করায় তাকেও ধরে নেওয়া হয়, সাথে প্রত্যাশাকেও। তার মানে বোঝা যাচ্ছে শীতলকে ধরাই তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো।
কিন্তু শীতল যেমন মেয়ে তার সাথে কারো ঝামেলা থাকা সম্ভব নয়। তবে কার সাথে এই ঝামেলা? উৎস ভাইয়ের সাথে নয়তো? যদি তাই হয়, উৎস ভাইকে খবর দিবে কে?

অগ্নির ভাবনা চিন্তার মধ্যেই দরজায় কারো গলার আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে ওরা। শীতল অগ্নির হাত চেপে ধরে। অগ্নি এদিক ওদিক তাকায়। ধাতব কিছু খোঁজার চেষ্টা করে। তাদের ছুঁতে আসলেই যেনো ছুঁড়ে মারতে পারে।
কিন্তু আশেপাশে কিছুই না পাওয়ায় হতাশ হয় অগ্নি। কীভাবে বাঁচাবে এখন সে শীতলকে?

ঘরে ঢোকে প্রথম মতিন। তার মুখ হাসি হাসি। পরনে লুঙ্গি আর কটকটে হলুদ শার্ট। কোনো মানুষকে হলুদে এতো বিশ্রী লাগতে পারে মতিনকে না দেখলে ওরা বুঝতো না। আর এই রঙ পুরুষ মানুষ পরে? কি রুচি লোকটার?

শীতলের দিকে মতিন এগিয়ে আসতে গেলেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে অগ্নি।
“এই মোটা শালা, হলুদ তেল্লাচুরা।”
মতিন হতবাক হয়ে যায় অগ্নির কথায়। প্রত্যাশা ফিক করে হেসে দেয়। মতিন অপমানিত বোধ করে। মেয়ে মানুষের সামনে ইজ্জতের দফারফা।

মতিন থমথমে গলায় বললো,”কথাটা কি আমাকে বললেন আপা?”
“তোকে ছাড়া আর কাকে মোটা শালা? আমাদের এখানে আটকে রেখেছিস কেনো? ঘুষি মেরে ভুড়ি গলিয়ে দিবো।”
শীতল বড় বড় চোখ করে অগ্নির দিকে তাকায়। সে নামেই শুধু অগ্নি নয়, কাজকাম আর কথার ঝাঁঝেও অগ্নি। আর সে নিজে নামে শুধু শীতল নয়, কাজকর্মে ঠান্ডা, শীতল।

“আপা মুখ সামলান, নাহলে কিন্তু…..”
“নাহলে কি করবি রে? তুই তো ভুড়ি নিয়ে নড়তেই পারিস না। ছোটবেলা থেকে কুংফু শিখেছি আমি। বাংলা কুস্তি ভালোই পারি। আয় আমার সাথে কোস্তাকুস্তি কর।”
মতিনের মুখ ঝুলে যায়, এটা মেয়ে না ধানী লঙ্কা? সে কি জানে সে কার সাথে এভাবে কথা বলছে? এই শহরের অন্যতম মাফিয়া ছোট রুস্তমের সবচেয়ে কাছের সহকারী সে। তাকেই কিনা এভাবে অপমান?

মতিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই খিলখিল হাসির শব্দে ধাতস্থ হয় সবাই। প্রত্যাশা হেসেই খু’ন হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা যেনো কোনো একটা শুটিং স্পট, তারা একশন সিনেমার নায়িকা। সবকিছুই তার কাছে মজা।

শীতল ভয়ে কাচুমাচু হয়ে হাতের সাথে ওড়না পেঁচাতে থাকে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে ফুল স্পিডে, তাও ঘাম পড়ছে কপাল চুইয়ে তার। আর কিছু নিয়ে না, তার ভয় উৎসকে নিয়ে। সে যদি জানতে পারে প্রত্যাশার সাথে সে কলেজ থেকে বের হয়ে ঘাটে এসেছিলো, কি যে করবে।

প্রত্যাশার শব্দ করে হাসির মধ্যেই ঘরে ঢোকে রুস্তম। ভুরভুর করে তীব্র সেন্টের গন্ধে ভরে যায় ঘরটা।

“এই মতিন কে হাসে রে? কে হাসে? কার মনে এতো ফূর্তি?”
প্রত্যাশা তখনও হাসছে, চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে তার হাসতে হাসতে।
রুস্তম ঘরে ঢুকতেই সবার আগে নজর যায় তার প্রত্যাশার দিকে। সাথে সাথে একটা শীতল পরশ নেমে যায় তার মেরুদণ্ড বেয়ে। স্তম্ভিত হয়ে যায় সে এক নজরেই। এইটা মানুষ না পরী?

প্রত্যাশা নিজেও হাসি থামাতে থামাতে রুস্তমের দিকে তাকায়। কালো বেটেখাটো একটা লোক, ধূসর রঙের শার্ট আর সাদা লুঙ্গি পরনে তার। চোখগুলো কেমন লাল। চেহারার মধ্যেই একটা নেতা নেতা ভাব। চেহারা মোটেই ভালো নয়। তবুও প্রত্যাশার কেমন যেনো একটা মায়া লাগে তাকে দেখে। লোকটা তার দিকে এভাবেই বা তাকিয়ে আছে কেনো?
অসম্ভব সুন্দরী হওয়ার প্রেমের প্রস্তাব প্রচুর পেয়েছে সে, সবাইকে কাছ থেকেই দেখেছে। কই কারো চোখে তো এমন মায়া দেখেনি সে। সে এই দৃষ্টিতে কেনো তাকিয়ে আছে প্রত্যাশার দিকে? প্রত্যাশা একরাশ মায়া অনুভব করে প্রথম দেখায় রুস্তমের প্রতি। কি অদ্ভুত!

(চলবে…..)