মাতৃসওা পর্ব-০১

0
2

মাতৃসওা
#সূচনা_পর্ব
সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

“চল্লিশ বছর বয়সে এসে আমি আবারো গর্ভধারণ করেছি। যেখানে আমার বড় মেয়েটা সাত মাসের সন্তান-সম্ভবা, ছোট মেয়েটার বিয়ে কয়েক দিন বাদে। এর থেকে লজ্জা জনক পরিস্থিতি আর কি হতে পারে ডক্টর? এই ভ্রু’ণ’টি কোনো-ভাবে রাখা সম্ভব নয় ডক্টর, আপনি অ্যা’ব’র’শ’ন করিয়ে দিন।”

“সম্ভব নয়..! এই বয়সে এসে সাড়ে তিন মাসের ভ্রুণটি নষ্ট করা চারটে খানিক কথা নয়, মিসেস পারভীন। এই অবস্থায় লাইফ রিস্ক রয়েছে আপনার।

“আমি রিস্ক নিতে প্রস্তুত। নিজের কথা ভেবে আমি আমার মেয়েদের অশান্তির কারণ হতে চাই না ডক্টর। এই খবর শুনলে, সমাজের লোক-জন হাসাহাসি করবে। শেষ বয়সে এসে সবার হাসির খোরাক হতে চাই না আমি। প্লিজ ডক্টর, কিছু একটা করুণ আপনি!

সামনের চেয়ারে বসা শাহনাজ পারভীনের কথা শুনে ডক্টর ” অথৈ” পূর্ণ দৃষ্টি বুলালো অর্ধ বয়স্ক মহিলাটির পাণে। লজ্জায় ভিত মুখে কাচুমাচু হয়ে বসে আছেন তিনি। অজানা আতঙ্কে, দুশ্চিন্তায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। ডক্টর মিনিট সময় চুপ থেকে উনাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,

“মাতৃত্ব কখনো লজ্জার হয় না, বরং সৃষ্টিকর্তা দেওয়া বিশেষ রহমাত! আপনি লজ্জা পাবেন না। বড় মেয়েদের কথা ভেবে ছোট্ট প্রাণটা মে’রে ফেলতে চাইছেন? গর্ভে যে ছোট্ট প্রাণটা রয়েছে সে-ও আপনারই সন্তান। তাহলে, নিষ্পাপ ফুলটির প্রতি কেনো এতো অবিচার?”

শাহনাজ পারভীন ডক্টরের এহেন কথায় সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললেন। মাতৃত্ব আনন্দের! কিন্তু, অসময়ে ভিন্ন পরিস্থিতিতে এসে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছেন তিনি। বড় বড় মেয়েরা এই বয়সে এসে এখন নিশ্চয়ই নতুন করে তারা ভাই-বোন চাইবে না। তাছাড়া, মেয়েদের শ্বশুর বাড়ির লোকজন শিক্ষিত, উঁচু শ্রেণির মানুষ তারা। শ্বাশুড়ির অন্তঃসত্ত্বার ব্যাপারটা তারা কিভাবে নিবে?
ভাবতেই,ফাঁকা ঢোক গিললো শাহনাজ পারভীন। সঠিক ভাবে প্রডাকশন নেওয়ার পরও কি করে যে এমনটা হলো, বুঝে উঠে পারছে না উনি।

নার্ভাস,দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পেশেন্ট’কে একবার পর্যবেক্ষণ করে ডক্টর অথৈ পরমুহূর্তে উনাকে ভরসা দিয়ে বললেন,

“ক্যারি অন মিসেস! আপনি হতাশ হবেন না। আরো কয়েকদিন সময় নিয়ে ভাবুন। আপনার হাসবেন্ড ও ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করুণ, তাদের জানান। উনারা নিশ্চয়ই এই অবস্থায় আপনার পাশে দাঁড়াবেন। আপনি একটু ভেবে আবার না হয় আসবেন।”

ডক্টরের কথায় একটুখানি ভরসা পেলো শাহনাজ পারভীন। তবুও চিন্তা কমলো না তার। বিষয়টা সবাইকে কি করে জানাবে? এটা নিয়ে বিরাট সংশয়ে পড়লেন তিনি।

দোনোমোনো, দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে বাসায় ফিরে আসলেন তখন। বাড়িতে পা রাখতেই ছোট মেয়ে খুশী চলে আসলেন মায়ের কাছে। উশখুশ নয়নে একবার মা’কে পর্যবেক্ষণ করে তড়িৎ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“মা ডক্টর কি বললো?”

চমকে উঠলো শাহনাজ পারভীন। খুশী তার সঙ্গে ডক্টরের কাছে যেতে চাইলেও উনি সঙ্গে নেয়নি। সব পরিস্থিতি একাই সামলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, হলো কই? মিনিট খানিক সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে উনি গম্ভীর হয়ে মেয়েকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

“তোদের যদি নতুন করে ভাই-বোন আসে, এটা নিয়ে কোনো সমস্যা তোদের?”

খুশী’র মুখটা থমথম খেয়ে গেলো। মায়ের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে খুশী এই ব্যাপারে আগেই আন্দাজ করে ছিলো, তবে নিশ্চিত ছিলো না। তার মানে যে ভয়টা পেয়েছিল এটাই সঠিক। খুশী কিছু না বলে থমথম মুডেই, নিজের রুমে চলে গেলো।

শাহনাজ পারভীন মেয়ের যাওয়ার দিকে একবার চেয়ে হতাশার শ্বাস ছাড়লেন। পরমুহূর্তে, নিজেও তাদের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু, পারলো না। মাথায় চক্কর দিয়ে পড়ে যেতে নিলো। এরিমধ্যে “শাফায়াত” এসে নিজের স্ত্রী’কে ধরে ফেললেন। ভাগ্যিস, উনি মাএই বাসায় এসে ছিলেন। স্ত্রীকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে, পানি এনে দিলেন। শাহনাজ পারভীন ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিলেন। শাফায়াত এবার উনার পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে চিন্তিত হয়ে বললো,

“ডক্টর কি বললো শাহনাজ? ঔষধ দিয়েছে? ঠিকঠাক ভাবে সব করতে পেরেছো তুমি? হঠাৎ কি হলো তোমার? ”

শাহনাজ পারভীন মাথা নিচু করে আমতা আমতা করছে। স্ত্রী’র লজ্জা রাঙা, ভয়ার্ত মুখো ভঙ্গিমা দেখে ফের উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শাফায়াত বললো,

“কি হলো নাজ? তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? তুমি কিছু নিয়ে চিন্তিত? ডক্টর কি বললো, রিপোর্ট খারাপ এসেছে? বলো আমায়?”

শাহনাজ পারভীন চোখ তুলে তাকালো। জড়ানো কণ্ঠে শুধালো,

“আমি আবারও মা হতে চলছি। সাড়ে তিন মাসের একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে আমার সাথে।”

“হোয়াট?”

শাহনাজ পারভীন ফাঁকা ঢোক গিললেন। শাফায়াত উওেজিত হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তার বিস্ময় কাটছে না। বর্তমানে চেয়ারম্যান তিনি। পাঁচ এলাকার লোক তাকে চেনে-জানে, সম্মান করে। তাছাড়া, মেয়েরা বড় হয়েছে, বিয়েসাদী হয়ে নাত নাতনী আসতে চলছে। এই অবস্থা স্ত্রী’র এহেন কথায় কান গরম হয়ে গেলো তার। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে চা’পা স্বরে পুনরায় আবারো বললো,

“তুমি কি বলছো নাজ? সত্যিই কি তাই?”

“আমি ভুল বলিনি আপনাকে।”

শাফায়াত খানিকটা উচ্চ স্বরেই বললো,

“এটা কি করলে তুমি? যখন একটা ছেলের দরকার ছিলো আমার তখন শত চেষ্টা করেও কোনো বাচ্চা জন্ম দিতে সক্ষম হওনি তুমি। আমি মেনে নিয়েছি সেসব। কিন্তু, কিন্তু, এখন, এই বয়সে এসে সন্তানের কি দরকার ছিলো আমাদের?”

“এখানে কি আমার হাত আছে, এখন আল্লাহ দিয়েছে। আমি কি করবো?” মিনমিন করে বললো শাহনাজ পারভীন।

“তুমি কি করবা মানে? তোমার লজ্জা লাগছে না… এই আধুনিক যুগে এসে প্রাচীন যুগের মতো একটা কাজ করতে। যেখানে কিছুদিন গেলেই নানা-নানি হবো আমরা। নাতি-নাতনী, বড় বড় মেয়ে, জামাই এদের মধ্যে নতুন করে আমাদের বাচ্চা। এমনটা কি আজকাল হয়? মুখ দেখাবো কি করে তাদের।
লজ্জায় আমার মাথা কা’টা যাচ্ছে। ছি! ছি! আমাদের আর সন্তানের দরকার নেই নাজ। দুই মেয়ে আছে, এটাই যথেষ্ট। তুমি আগামীকাল’ই এই বাচ্চা অ্যা’ব’র’শ’ন করাবে, বুঝতে পেরেছো আমার কথা?”

অ্যা’ব’র’শ’ন শব্দটি কানে আসতেই আ’ত’ঙ্কি’ত হয়ে উঠলেন শাহনাজ পারভীন।
ততক্ষণাৎ শাহনাজ পারভীনের একটা হাত পেটের উপর রাখলো। এখানে ছোট্ট একটা প্রাণ রয়েছে তার সাথে। মা হয়ে লোক সমাজের কথা ভেবে এই প্রাণটা বি’না’শ করবে… ভাবতেই, কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো তার। না যে ভুল একবার করতে চাইছে, দ্বিতীয় বার এই ভুল করতে পারবে না তিনি। উনি মা। আগাত দু’টো মেয়ের মতোই অনাগত সন্তানটি’র জন্য এখন মায়া হচ্ছে তার।

মাতৃত্ব সবসময় আনন্দের। মায়াময়! যা সবার কথা ভাবতে গিয়ে উনি টের পায়নি। ডক্টরের চেম্বার থেকে বের হয়ে সারা রাস্তায় যখন একা একা আসছিলেন, হাঁটছিলো, তখন এই সুখের অস্বস্তি টের পেয়েছে মা। নিজের করা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত ও হয়েছে। সেই ভুল আবার কোনো ভাবে দ্বিতীয় বার সমর্পণ করা যাবে না। এই সুখ থেকে বঞ্চিত হবে না শাহনাজ পারভীন। হোক তার বয়স। তার অনাগত সন্তান পবিত্র। এই কোমল ফুলটি কি করে নষ্ট করবে মা!

পরমুহূর্তে উনি ছলছল চোখে আ’ত’ঙ্কি’ত স্বরে স্বামীর পানে তাকিয়ে শুধালো,

“ওমন করে বলবেন না গো, ওমন করে বলবেন না। এটা তো আমাদেরই সন্তান। আমার হাসি-খুশি’র মতো এ ও আমার র’ক্তে’র অস্তিত্ব। এই র’ক্ত কি করে ডাস্টবিনে ফেলে দিবো আমি? আপনি বাবা হয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত আমাকে চাপিয়ে দিবেন না। দোহাই আপনার!
জানি ঠিক হয়নি। তবুও আল্লাহ’র ইচ্ছে হয়ে গেছে। আপনি আমাকে সাপোর্ট করবেন, এতটুকুই আমার সাহস।”

স্ত্রী’র কথা শুনে এবার মেজাজ বিগড়ে গেলো শাফায়াত চেয়ারম্যানের। একে তো ভুল করছে, আবার বুড়ো বয়সে ন্যাকামি। উনি কঠিন চোখে তাকিয়ে, সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এই বাচ্চা রাখা সম্ভব নয়।

এই সমাজের মাঝেই চলতে হয় আমাদের। লোক জানাজানি হলে, কি বলবে? চেয়ারম্যান সাব বুড়ো বয়সে নাতি-নাতনীদের মধ্যে বাবা হচ্ছে। উনাদের টিটকারি মূলক মন্তব্য কেমন হবে? ছি! ভাবতেই পারছে না উনি।
এই বাচ্চার জন্য লজ্জা জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারবে না সে। উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল। তারই সম্মুখে বসে কাঁদছে শাহনাজ পারভীন। যা দেখে বিরক্ত খুশী। সে ও বাবা-র সাথে সহমত।
_____

ইতোমধ্যে আর চা’পা নেই বিষয়টি। অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। পাড়া-পড়শীরা টিটকারি মূলক মন্তব্য করছে, কানাকানি করছে। কোনো ভাবে এই খবর পৌঁছে গেলে বড় মেয়ে হাসির শ্বশুর বাড়ি’তে। সবটা শুনে তাজ্জব হাসি। শ্বশুর বাড়ি’তে মানুষ তাকে নিয়ে এবং তার আম্মাকে নিয়ে আড়ালে মজা নিচ্ছে। সবটা শুনে থমথম মুডে রান্না করছিলো হাসি। এরিমধ্যে তার চাচি শ্বাশুড়ি এসে কুটিল হেসে বললো,

“বউ.. শুনলাম বিয়ান ও না-কি পোয়াতি। তোমার তো সাত মাস চলছে। তোমার মায়ের কয় মাস? দুই মা মেয়ে একসাথেই পেট বাঁধালে!”

চলবে?