মাতৃসত্তা
পর্ব ৩
মিথিলা জামান নিভা
“পাএ চাই….
মায়ের বিয়ে’র জন্য পাএ চাই!
মায়ের শেষ বয়সে’র সঙ্গী হিসেবে একজন বয়স্ক আদর্শ পুরুষ চাই। আগ্রহী’রা বিস্তারিত জানতে ইনবক্স করুণ।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা মেয়ের এহেন একখানা পোস্ট দেখে সেখানে চোখ আঁটকে যায়, শাফায়াত চেয়ারম্যানের। মেয়ে হয়ে মায়ের জন্য পাএ খুঁজছে, বিষয়টা বড়ই অদ্ভুত! আজকাল এমনটা সচারাচর দেখা যায় না। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!
শাফায়াত চেয়ারম্যানের বউ মা’রা গিয়েছে প্রায় এক বছর হতে চললো। সবকিছুই আগে নিয়মে চলছে, থেমে থাকছে না কিছু।
মা মরার কিছুদিন পর ছোট মেয়েরও বিয়ে হয়ে যায়। দুই মেয়েই শ্বশুর বাড়িতে থাকছে। সবাইকে হারিয়ে একা হয়ে যায়, শাফায়াত। নিজের দেখাশোনার জন্য কেউ রইলো না। নিজে’র শখের সংসারটা অযত্নে, অবহেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাধ্য হয়ে, মনে মনে দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাফায়াত।
তাই বিস্তারিত জানতে ‘জান্নাতুল রুহি’ নামক মেয়েটার সাথে কথা বললো এবং নিজের অবস্থান ও বিস্তারিত সম্পর্কে জানালো। রুহুি সবটা শুনে বললো,
“আপনাকে আমি সরাসরি দেখতে চাই এবং বিস্তারিত সামনাসামনি আলোচনা করতে চাই।”
শাফায়াত সম্মতি জানালো। পরদিন রুহির দেওয়া লোকেশন অনুযায়ী একটা কফিশপে মুখোমুখি বসেছে দু’জন। মানুষ হিসেবে উনাকে রুহির দারুণ পছন্দ হয়েছে। বেশভূষা, কথাবার্তায় শিক্ষিত আভিজাত্যের ছাপ। মনেমনে বাবা’র মতো এমন একজন মানুষই খুঁজে ছিলো, রুহি।
দু’জন টুকটাক কথা বলে রুহি বললো,
“দেখুন আঙ্কেল…আপনার সম্পর্কে জেনে, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আমাদের সম্পর্কে আপনাকে একটু বলি?”
“অবশ্যই, বলো মা।”
“পাএী আমার কে হয় জানেন, আঙ্কেল? উনি আমার মা। আমি তার একমাত্র মেয়ে। মেয়ে হয়ে এই বয়সে মায়ের জন্য পাএ খুঁজছি, এটা নিয়ে অনেকেই আমায় দেখে টিটকারি মূলক মন্তব্য করে। অবশ্য এতে আমার যায় আসে না।
আমার বাবা নেই। সেই ছোট বেলায় আমাদের একা করে মা’রা গিয়েছে, বাবা। তখন আমার বয়স ছিলো, চার বছর।তখন আমার মায়ের ও অল্প বয়স ছিলো। মা চাইলে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে পথে যায়নি। আমাদের দেখাশোনার জন্য মাথার উপর কেউ ছিলো না। আমার মা বহু কষ্টে আমাকে বড় করছে। মায়ের সে জার্নিটা ছিলো বড্ড বেদনাদায়ক!
এরপর মা মেয়ে মিলেই ছিলো আমাদের সংসার। এখন আমিও অনেকটা বড় হয়েছি। ভার্সিটি’তে পড়ছি, ওখানেই হোস্টেলে থাকি। আমার মা থাকে গ্রামে। উনি মধ্য বয়স্ক, শিক্ষিত একজন নারী। উনার ইচ্ছে, মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার। তাই মায়ের স্বপ্ন পূরণে মা’কে একা রেখেই শহরে এসেছি আমি। মাসের পর মাস এখানেই থাকছি।
শেষ অবলম্বন হিসেবে, একমাত্র আমি ছিলাম তার সঙ্গী। আমি চলে আসার পর, মানুষটা একদম একা হয়ে গেলো। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় একা, মা। উনি মানসিক ভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। তাই এই একাকিত্বের থেকে পরিত্রাণ পেতে মায়ের একজন সঙ্গী প্রয়োজন। আর একজন মেয়ের স্বামীর চেয়ে বড় সঙ্গী আর হয় না। সারাজীবন তো মা কষ্টই করলো, এবার তার একটু যত্নের প্রয়োজন, একজন সঙ্গী’র সাপোর্ট প্রয়োজন।
তাছাড়া, আমিও একটা মেয়ে। জীবন চক্র হিসেবে আমারও বিয়ে হবে, সংসার হবে। আমার মায়ের যে আত্মসম্মান,ব্যক্তিত্ব উনি কখনো মেয়ের জামাইয়ের ঘরে থাকবে না। আমি কি পারবো, আমার মায়ের দায়িত্ব এবং তার সব স্বপ্ন পূরণ করতে। সেই’তো মা জীবনের অনেক অংশই একা কাটিয়ে দিলো, আগামীতেও দিতে হচ্ছে ।
এভাবে তো আর জীবন চলে না। এজন্যই, আমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এতে মায়ের অমতের কমতি নেই। তবুও, মানিয়ে নিবো আমি।
এবার আপনি যদি আমার মায়ের দায়িত্ব নিতে চান আপনাকে কথা দিতে হবে আঙ্কেল, আমার মা’কে আপনি ভালো রাখবেন…” আর হ্যাঁ আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি সারাদিন আপনার সংসারে গিয়ে পড়ে থাকবো না। অবশ্য, মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে মা’কে দেখতে যাবো। এইটুকু সুযোগ আমাকে দিতে হবে। কেননা, মা ছাড়া দুনিয়াতে আমার আর কেউ নেই।”
লম্বা এক কথা শেষ করে দ’ম নিলো রুহি। শাফায়াত চেয়ারম্যান সবটা শুনে বললো,
“আমি আগ্রহী। আমি তোমার মা’কে যথেষ্ট ভালো রাখার চেষ্টা করবো।তাছাড়া তোমাকে নিয়ে ও আমার কোনো প্রবলেম নেই, মা রুহি। আমারও দু’টো মেয়ে আছে। তুমি ও তাদের মতো আমার আরেকটা মেয়ে হয়েই থাকবে।”
লোকটার কথা রুহির বড্ড পছন্দ হলো। আরো টুকটাক কথা বলে রুহি জানালো,
“মায়ের সাথে আলোচনা করে আপনাকে আমি খুব শীগ্রই মতামত জানাবো। আজ আসছি।”
শাফায়াত চেয়ারম্যান ও নিজের বাসায় পৌঁছে মেয়েদের এ ব্যাপারে জানালো। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করবে শুনে, মেয়েরা একটু কষ্ট পেলেও বাবার কথা ভেবে উনারাও সম্মতি দিলো। এবং দু’বোন জানালো, মহিলাকে একবার তারা দেখবে। কেননা, যাকে তাকে তোর আর মায়ের সংসারের দায়িত্ব দেওয়া যায় না।
.
.
উদাস মনে দুপুরে রান্না করছিলো, রুহির মা নেহা সিদ্দিকী। এরিমধ্যে, রুহি এসে মা’কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আদুরে কণ্ঠে শুধালো,
“কি করছে আমার, মেয়েটা?”
মা আলতো হেসে বললো, “এইতো আমার আম্মা জানের জন্য একটু হালুয়া বানাচ্ছি।”
“আমি কিন্তু আমার মেয়ের জন্য পাএ দেখেছি, আশা করছি…. ”
রুহিকে থামিয়ে দিয়ে নেহা সিদ্দিকী গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তুই কিন্তু এবার বেশীই বাড়াবাড়ি করছিস রুহি। কতবার বললাম, আমি এভাবেই ঠিক আছি। আমি তোর বাবা’কে এখনো ভীষণ ভালোবাসি, রুহি। উনি ছাড়া আমি অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মানতে পারবো না।”
“এভাবে আর কত দিন একা থাকবে, আম্মু? আমি জানি তুমি আব্বুকে ভীষণ ভালোবাসো। কিন্তু, মানুষটা আর বেঁচে নেই। যে যাওয়ার সে তো চলেই যাবে। তাকে ছাড়াই আমাদের চলতে হয়, জীবন চালিয়ে নিতে হয়। এভাবে আর কত নিজেকে কষ্ট দিবে, আম্মু? তোমার একজন সঙ্গী’র খুব দরকার। প্লিজ আর অমত করো না, আম্মু।”
“কিন্তু, তুই ভাবছিস আমি এই বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে লোকজন কি বলবে? তোর কি হবে? কে দেখবে তোকে? ”
“এখনো তুমি সংসার করার মতো যথেষ্ট ইয়াং, আম্মু। লোকজন কি বললো, এতে কিছু যায় আসে না আমার। স্বামীর অবর্তমানে ইসলামে দ্বিতীয় বিয়ে করা জায়েজ। লোক কি বললো, কি ভাবলো, উনাদের কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানেই হয় না, আম্মু।
আর আমার কথা ভাবছো, আমি আর এখন ছোট নেই আম্মু। তোমার মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে। তাই, তুমি এখন আমার মেয়ে আর আমি তোমার মা। মা হয়ে আমি আমার মেয়ের ভবিষ্যতে নিয়ে চিন্তিত। আমি সারাক্ষণ দূরে থাকি অথচ মন পড়ে থাকে তোমার কাছে। তুমি সম্পূর্ণ একা থাকো, কখন কোন বিপদ হয়, সারাক্ষণ ভয়ে থাকি আমি। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেও তোমাকে দেখার মতো কেউ নেই।
তোমার একটা স্হায়ী নিরাপত্তা দিতে পারলে, আমি দূরে থেকেও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো, আম্মু। ত্যাগ তো কম করোনি আমার জন্য। প্লিজ আম্মু, আর অমত করো না..”
এরপর ও নেহা সিদ্দিকী অমত করলেও মেয়ের যুক্তি’র সাথে পেরে উঠলো না। অগত্যা বাধ্য হয়ে “হ্যাঁ সূচক” সম্মতি দিলো উনি।
একটু ভালো থাকার জন্য, একটু বাঁচার জন্য, আমরা কখনো কখনো মনের বিরুদ্ধে গিয়েও জীবনকে তার মতো চালিয়ে নিতে হয়।
মায়ের সম্মতি পেয়ে, রুহি আর দেরী করলো না। অগোচরে বারকয়েক শাফায়াত চেয়ারম্যানের গ্রামে গিয়ে উনার বিষয় খবরা-খবর নিয়ে দেখেছে, কোথাও কোনো আপওি কর বিষয় নজরে পড়েনি তার। এরিমধ্যে, একবার মায়ের সাথে লোকটার আলাপ করিয়ে দিয়েছে। হাসি-খুশি দু’বোনও লোকজনের অবর্তমানে নেহা সিদ্দিকী’কে একবার দেখে গিয়েছে। মাঝ বয়স্ক, সুন্দর, মার্জিত মহিলাকে তাদের ও মনে ধরেছে।
রুহি আরো কিছুদিন পর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লোকটার ডিটেইলস জেনে, তবেই “হ্যাঁ বোধক” সম্মতি জানালো। অবশেষে ঘরোয়া ভাবে’ই তাদের বিয়েটা হয়ে গেলো।
এরপর আশেপাশের লোকজন যখন জানলো, “রুহি তার মা’কে বিয়ে করিয়েছে”এটা নিয়ে তারা কম তিরস্কার করেনি। রুহি ছিলো তার মায়ের পাশে শক্ত ঢাল স্বরুপ। যুক্তিশীল, স্পষ্টবাদী মেয়ে রুহি, তার সামনে কেউ কথা শুনিয়ে পাড় পায়নি। মেয়েটা একাই সবটা সামলে নিয়েছে।
চলবে….