#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(০১)
০১.
“আর কয়দিন থাকবি এখানে! এবার তো বিদেয় নে! আপদ একটা! একবার আসলেই হলো আর যেতে চায় না! যত্ত জ্বালা সব আমার পোঁড়া কপালে!”
অতিষ্ঠ হয়ে বকতে লাগলেন আফসানা বেগম। বিছানার উপর বসে নিভু নিভু চোখে পান চিবুতে লাগলেন জাহানারা বেগম। উনার পাশে বসে জানালা দিয়ে বাইরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলো নিশু। বেশ অনেকগুলো রাজহাঁস জলকেলি করছে; দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে কিন্তু মায়ের অমন কথায় বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বর্ষার ভরা বিলের মতো টইটম্বুর হয়ে গেল নয়নজোড়া। জলপ্রপাতের ন্যায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো দুগাল বেয়ে।
“কীরে তোর স্বামীর বাড়িতে আর যাবি না! আর কতদিন থাকবি! এবার তো বিদেয় নে!”
মলিন মুখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকালো নিশু।
“ওমন করে কী দেখিস! খেয়ে ফেলবি নাকি আমাকে!”
বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মায়ের কাছে চলে গেল নিপুণ।
“আপদটা কী করে এখনও? যায় না কেন?”
“কী জানি!”
“একবার আসলেই হলো আর যেতে চায় না মাথায় চড়ে বসেছে।”
নিমিশা বলল,”ওর জামাই তো ওকে দেখতে পারে না! কাজের লোক আর মিসকিনের মতো থাকে স্বামীর বাড়িতে।”
সবই শুনলো নিশু কিন্তু প্রতিত্তোর করলো না। ওড়নার কোণা দিয়ে চোখের জল মুছে ব্যাগ গুছিয়ে বোরকা গায়ে দিয়ে হিজাব বেঁধে নিলো।
“আমি ফিরে যাচ্ছি দাদু দোয়া করিও।”
কিছু বললেন না জাহানারা বেগম। পূর্বের ন্যায় পান চিবুতে লাগলেন। বাবার রুমে ঢুকতেই দেখলো শুয়ে রয়েছেন তিনি। সম্ভব রাতে নেশা করে এসেছিল তাই শরীরের ক্লান্তি বোধহয় এখনও কাটেনি।
“আমি ফিরে যাচ্ছি আব্বা।”
কিছু বললেন না তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে সাপের মতো আঁকাবাকা মেঠোপথ ধর হাঁটতে লাগলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে চতুর্দিকে তাকালো। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বাবার বাড়িতে বিষন্ন এক ট্যুর! অবশ্য এটা প্রতিবারই হয়। বিষন্ন এর কারণ এখানে এতোটা ফাঁকা অনুভূতির চাদর ঠেসে ধরেছিল তাকে যে সে যেদিকে তাকিয়েছিল কেবলই হারিয়ে যাওয়া কাছের মানুষগুলোর স্মৃতির গন্ধ পেয়েছিল যেন। তবুও যতটা পারলো এই কয়দিনে কিছুটা স্মৃতি নিজের করে নিলো। সে যে স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখা মানুষ। বাসস্ট্যান্ডে এসে ঢাকার বাসে উঠলো নিশু।
০২.
ঢাকা এসে পৌঁছালো নিশু প্রায় সন্ধ্যার দিকে। লং জার্নি করতে খুব কষ্ট হয়ে যায় তার তবুও করে দাদীকে একপলক দেখার জন্য। কম্পিত হাতে বাসার কলিংবেল চাপতেই দরজা খুললেন দিলরুবা খাতুন। উনাকে দেখতেই চমকায় নিশু। তদ্রূপ তাকে দেখতেই চমকান তিনি।
“নিশু,তুই একা কেন?তোর সাথে কেউ আসেনি?”
মাথা নোয়ালো নিশু।
“না।”
“একা একা এলি কোন সাহসে?”
উনার গলায় স্পষ্ট ক্ষোভ। নীরব রইলো নিশু।
“সাহস কত মেয়ের!”
নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো নিশু। ভাইকে ফোন করলেন দিলরুবা খাতুন। হঠাৎ বাকবিতন্ডা শোনা গেল উনার রুম থেকে। ভীতসন্ত্রস্ত হলো নিশু। বোরকা-হিজাব খুলে পরনের জামা বদলে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। খুব ক্লান্ত লাগছে তার। রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরুলেন দিলরুবা খাতুন।
“নিশু কইরে!”
শোয়া থেকে উঠে রুম থেকে বেরুলো নিশু।
“জ্বী ফুপি।”
“পথে কিছু খেয়েছিস?”
“জ্বী।”
“তো তোর মুখ শুকনো কেন?”
“বমি হয়েছিল।”
“টেবিলে ভাত দিয়েছি দ্যুতিকে নিয়ে খেয়ে নে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নিশু।
“দ্যুতি চল খেয়ে নিই।”
সায় দিয়ে দ্যুতি। তাকে নিয়ে ভাত খেতে বসলো নিশু।
“তোর জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে নিশু।
চমকায় সে।
“কীসের?”
“বলবো না।”
নীরবে খাওয়া শেষ করে প্লেটগুলো ধুয়ে রাখলো নিশু। লক্ষ্য করলো দিলরুবা খাতুন আসাদ সাহেবের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করছেন কিছু একটা নিয়ে। সেদিকে কান না দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতেই শুনলো,”নিশু শুন!”
“জ্বী ফুপি!”
“খেয়েছিস?”
“জ্বী।”
“ধ্রুবর রুমটা পরিষ্কার করে রাখতো। ও রাতে আসবে।”
কথাটা শুনতেই যেন কয়েক’শ বেগে টর্নেডো হানলো নিশুর বুকে। ঢিপঢিপ করতে লাগলো বুকের ভিতর। সারা শরীর কেমন কাঁপতে লাগলো। ধ্রুব আসছে!
“কী হলো যা!”
“যাচ্ছি!”
কম্পিত পায়ে ধ্রুবর রুমের দিকে পা বাড়ালো। ভিতরে ঢুকে আসবাবপত্র মুছে,বেড কভার তুলে ঝাঁট দিয়ে রুম ঝাড়ু দিয়ে নতুন বেড কভার বিছিয়ে দিলো। একপলক তাকালো পুরো রুমের দিকে। রুমটা এখন একদম ঝকঝক করছে।
“কী করছিস?”
হকচকিয়ে পিছু ফিরতেই দেখলো তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ধূসর। অপ্রস্তুত হলো নিশু।
“রুমটা গুছিয়েছি।”
“আমার রুমটাও গুছিয়ে দে।”
“দিচ্ছি।”
ধূসরের রুমের দিকে পা বাড়ালো নিশু। ধ্রুবর রুমের মতো গুছিয়ে দিয়ে ফিরে এলো রুমে। হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসলো কিন্তু পড়ায় মনযোগ দিতে পারলো না। ঢিপঢিপ করে তার বুকটা সমানে কাঁপছে। অস্থির অস্থির লাগছে! স্বস্তি পাচ্ছে না একদণ্ডও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বইয়ের উপর মাথা রেখে দু-চোখ বুজতেই হঠাৎ ভেসে উঠলো একটি মুখ। কিন্তু সেই মুখটি চেনা হলেও বড্ড অচেনা; অপরিচিত! দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো টুপটুপ করে। তার ভাগ্যটা এমন কেন?এত কুৎসিত কেন? তার বয়স যখন দশ তখন তার বাবা-মা দু’জনের ডিভোর্স হয়ে যায়। বাবার পরকীয়ার জন্য তার মা শত চাইলেও সংসার টিকাতে পারেননি। শেষমেষ হুট করে একদিন আফসানা বেগমকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন বাড়িতে। এরপর সেদিন তাদের মা-মেয়ে দু’জনকে অত্যন্ত প্রহার করলো। তারপর মুখে তিন তালাক উচ্চারণ করে তার মাকে ঘর থেকে বের করে দিলো তার বাবা। দিকদিশা হারিয়ে নিরুপায় হয়ে তাকে নিয়ে নানার বাড়িতে উঠে তার মা। এরপর তার মামীরা তাদের সহ্য করতে পারতো না। দিন-রাত তার মাকে কটুবাক্য ছুঁড়তো আর সব কাজ করাতো। এরপর মামাতো ভাইগুলো তাকে ধরে মা’রতো। হঠাৎ একদিন এক বিপত্নীক পুরুষের কাছে তার মাকে বিয়ে দিয়ে দিলো তার মামারা। এরপর তার মাও তাকে আর নিতে চাইলো না। যে যার যার মতো জীবন শুরু করলো। আর অন্ধকারে তলিয়ে গেল ছোট্ট নিশুর জীবনটা। এরপর তার ঠাঁই হয় ফের বাবার বাড়ি। আফসানা বেগমের কথা ধরে তার বাবা তাকে মারধর করতো। কেউই তার দায়িত্ব নিতে চাইলো না। তার বাবা বারবার তাকে বলতো ম’রে যেতে। কিন্তু ম’রতে গিয়েও পারলো না ছোট্ট নিশু। একবার আফসানা বেগমের মারধরের চোটে মাইল্ড স্ট্রোক করে বসলো নিশু। সব খবরাখবর কানে গেল দিলরুবা খাতুনের। এরপর তিনি চিকিৎসা করলেন এবং জানালেন নিশুর দায়িত্ব নিতে চান। তা শুনে খুশি হলো তার বাবা এবং সৎ মা। দিলরুবা খাতুন আরো জানালেন দায়িত্ব নিবেন তবে এভাবে নয়। তিনি উনার বড় পুত্র ধ্রুবর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নিশুর দায়িত্ব নিতে চান। কথাটা শুনতেই যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলেন নিশুর বাবা এবং সৎ মা। কারণ সে ছিল সবার ঘাড়ের বোজা। আর বোজাটা ঘাড় থেকে নামাতে পারতেই তো বাঁচে! মোটামুটি সবাই রাজি হলেও বিপত্তি বাঁধালো ধ্রুব। কিছুতেই সে বিয়ে করবে না।
“নিশু কইরে?”
দিলরুবা খাতুনের ডাক শুনতেই ধ্যান ভাঙ্গলো নিশুর। ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক হলো।
“নিশু!”
“জ্বী।”
মাথায় ওড়না দিয়ে রুম থেকে বেরুলো।
“ডেকেছেন ফুপি?”
“হ্যাঁ,ধ্রুবর রুমটা গুছিয়েছিস?”
“জ্বী ফুপি।”
“তোর গলার চেইনটা কই?”
“খুলে রেখেছি।”
“কেন?”
“ভাবলাম আসার পথে যদি ছিনতাই হয় তাই।”
“ভালো করেছিস। কিন্তু তুই আজ যেই সাহস দেখিয়েছিস আর কখনো এমনটা করবি তো দেখিস তোর হাড্ডি-গুড্ডি সব ভেঙে ফেলবো।”
মলিন মুখে মাথা নোয়ালো নিশু।
“এদিকে আয়।”
উনার পিছু পিছু গেল। আলমারি খুলে একটি লাল রঙের শাড়ি হাতে তুলে দিলেন।
“এটা পরে তৈরি হয়ে নে।”
জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালো নিশু।
“ধ্রুব আসবে শুনিসনি?”
মাথা নোয়ায় নিশু।
“একটু পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে থাক।”
অস্বস্তি হলো নিশুর।
“কিছু হবে না যা। সোনার চেইন আর কানের দুলগুলোও পরে নিস।”
“আমি শাড়ি পরতে পারি না ফুপি। মানে ওতটা ভালো হয় না।”
“আচ্ছা পেটিকোট আর ব্লাউজটা গায়ে দিয়ে আয়। আমি আজ শিখিয়ে দিবো তুই মন দিয়ে দেখিস।”
তাই করে নিশু। শাড়ি পরা শিখিয়ে দিলেন।
“মাথায় তেল-পানি দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়ে একটু পরিপাটি হয়ে থাক।”
সায় দিয়ে চলে গেল নিশু। রুমে ঢুকতেই নিশুকে দেখে ভীষণ অবাক হলো দ্যুতি।
“নিশু তোকে এখন বউ বউ লাগছে! ভাইয়ার জন্য তাই না?”
শাড়ির দিকে ইঙ্গিত করলো।
“হুম।”
০৩.
প্রায় রাত এগারোটার দিকে বাসায় ফিরলো ধ্রুব। কারো সঙ্গে মত বিনিময় না করে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল বাসার সবাই। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে লাগলো নিশুর। আতঙ্কে হাত-পা কাঁপতে লাগলো। মনঃক্ষুণ্ন হলেন দিলরুবা খাতুন। নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে গেলেন আসাদ সাহেব। ছেলের দরজায় কড়া নাড়লেন দিলরুবা খাতুন।
“বাবা দরজা খোল।”
কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না ধ্রুবর।
“ধ্রুব দরজা খোল।”
খুললো না।
“ধ্রুব!”
“ডিস্টার্ব করো না আম্মা রেস্ট নিচ্ছি।”
“আচ্ছা নিবি তো! দরজা খোল।”
“আম্মা যাও তো প্লিজ।”
“খাওয়া-দাওয়া করবি না?”
“করে এসেছি।”
“সে কি! আমরা অপেক্ষা করছিলাম তো!”
“খেয়ে নাও।”
নিরাশ হয়ে মলিন মুখে চলে গেলেন দিলরুবা খাতুন। কতগুলো বছর পর ছেলে এলো অথচ একটু জড়িয়ে ধরে কিংবা মন খুলে কথা বলতে পারলেন না। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। ভয়ে ভয়ে রইলো নিশু। বিছানায় এসে বসলো।
“কীরে তুই এখনও আমার রুমে কী করিস নিশু?”
মলিন মুখে তাকায় নিশু।
“তোর স্বামী এলো তোর তো তার রুমে থাকার কথা।”
নীরব রইলো নিশু। বিছানায় শুয়ে দু-চোখ বুজতেই চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। দুঃখ একটাই,নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে মানুষটা কেন এমন করছে? তার তো বাবা-মা থেকেও নেই! কত আগুন তার বুকের মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলছে! ধ্রুব বিদেশ থেকে ফিরেনি ঢাকা থেকেই ফিরেছে। হ্যাঁ,অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি যে একই জেলায় থাকলেও সেই যে আট বছর আগে বাসা ছেড়ে হলে উঠেছে এরমধ্যে আর একটি বারের জন্যও ফিরেনি। ঈদ-চাঁদে কিংবা কোনো উৎসবেও না। এবারও ফিরতো না ফিরেছে অন্য একটি কারণে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে দুঃখে। যেই মেয়ের স্বামী ঠিক নেই সেই মেয়ে দুনিয়াতেই অর্ধেক জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করে। ভাবনা-চিন্তা করতে করতে চোখজোড়া লেগে গেল নিশুর।
০৪.
ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুপির সাথে হাত লাগিয়ে কাজ করতে লাগলো নিশু।
“নিশু!”
“জ্বী।”
“ধ্রুবকে কফিটা দিয়ে আয় তো!”
আতঙ্কিত চোখে তাকায় নিশু।
“দ্যুতিকে বলুন।”
“তুই যা।”
“না ফুপি,উনি রাগ করতে পারেন।”
“আরে কিছু হবে না যা।”
হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে দিলেন। ঠেলে ছেলের রুমে পাঠালেন। উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে ধ্রুব। মুখটা দেখতে পেলো না। সেই যে দেখেছে ছোট্ট বেলায় আজ অব্ধি আর নয়। মগটা রেখে বেরিয়ে গেল নিশু। আগ্রহী হয়ে রইলেন দিলরুবা খাতুন। নিশুকে দেখতেই উৎকণ্ঠা হলেন।
“দিয়েছিস?”
“হুম।”
“ধ্রুব কী করে?”
“ঘুমায়।”
“জাগাসনি?”
“না।”
“কেন?”
“যদি রেগে যায়!”
“রাগবে কেন বোকা! ধূৎ! তোকে দিয়ে কিছু হবে না।”
বেশ কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙ্গলো ধ্রুবর। ওয়াশরুম থেকে এসে দেখলো বেডসাইড টেবিলে কফি দেওয়া। লক্ষ্য করলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। চেঁচিয়ে মাকে ডাকলো।
“আম্মা কফি দাও।”
ছেলের ডাক শুনতে পেয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলেন।
“দিয়েছে তো।”
“ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।”
“আচ্ছা নাস্তা করতে আয়।”
কিছুক্ষণ পর নাস্তা করতে বেরুলো ধ্রুব। বাবা-মা ভাই সবাই থাকলেও নিশু নেই। অবশ্য নিশুর কথা তার মনেও নেই। ধীরস্থিরে গম্ভীর হয়ে নাস্তা খেতে লাগলো ধ্রুব। তার বাবা-মা কিছু জিজ্ঞেস করলে এক-আধটু উত্তর দিয়ে থেমে যাচ্ছে। আড়াল থেকে ডাইনিংয়ে তাকালো নিশু। প্রায় দীর্ঘ আট বছর পর ধ্রুবকে দেখতে পেলো। মানুষটা ঠিক ওতটাও ফর্সা নয় গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা আর একটু লম্বা-চওড়া। গালভরা খোঁচা খোঁচা চাপদাড়ির শেইপ ফুটে উঠেছে। চুলগুলো একদম ছোট ছোট করে ছাঁটা। কেন জানি দেখতে ভালো লাগছিল নিশুর। ফেইস লুক আর চাহনির স্টাইলটা ভীষণ দারুণ লাগছে নিশুর। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে। শ্বাস আঁটকে এলো। কী ভেবে হঠাৎ এদিকে দৃষ্টি পড়লো ধ্রুবর। চট করে সরে গেল নিশু। বুক ধরে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো। আর একটুর জন্য মানুষটা তাকে দেখে ফেলতো! তারপর কেলেঙ্কারি বেঁধে যেতো ঘরের মধ্যে ঠিক আট বছর আগের মতো। পর্দাটা নড়েচড়ে উঠতেই চমকালো ধ্রুব। ধ্রুবর মনে হলো কেউ একজন ওখানে দাঁড়িয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। তবে ঠিক বুঝতে পারলো না কে! নাস্তা খেয়ে উঠে গেল ধ্রুব। কফি পান করে ছাঁদে গিয়ে কার্নিশের পাশে দাঁড়ালো। রোডের দিকে দৃষ্টি ফেলে একটা সিগারেট ধরালো।
০৫.
“নিশু কইরে!”
“জ্বী ভাইয়া।”
“কী করিস?”
“কিছু না।”
“আমার শার্টটা একটু ধুয়ে দিতে পারবি?”
মাথা নাড়ালো নিশু।
“বিকেলে এক জায়গায় যাব।”
“আচ্ছা দিচ্ছি।”
নিশুর মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ধূসর।
“শোন!”
“বলো!”
“ছাঁদে শুকাতে দিস তাহলে তাড়াতাড়ি শুকাবে।”
“আচ্ছা।”
“আর আমার রুমটা একটু গুছিয়ে দিস।”
“আচ্ছা।”
ওয়াশরুমে ঢুকলো নিশু। উষ্ণ পানি যোগে ডিটারজেন্ট দিয়ে শার্টটা ভিজিয়ে দিয়ে রুমটা গুছিয়ে দিলো। এরপর শার্টটি ধুয়ে ছাঁদে গেল রোদে দিতে। ছাঁদে উঠে শার্টটা নিয়ে দড়িতে মেলে দিতেই দেখলো ধ্রুব দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে অন্য দিক করে। কেঁপে উঠে মাথায় বড় করে ঘোমটা টানলো নিশু। দ্রুত শার্টটি মেলে দিতেই কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ধ্রুব তাকায়। কিন্তু নিশুর মুখ দেখতে পেল না। পায়ের দিকে তাকাতেই লম্বা লম্বা কদম ফেলে নেমে গেল নিশু। সেদিকে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। ঠিক কে ছিল বুঝতে পারলো না। ছাঁদ থেকে নামতেই মুখোমুখি হলো দিলরুবা খাতুনের।
“এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”
“ভাইয়ার শার্ট ধুয়ে ছাঁদে শুকাতে দিয়েছি।”
“ধ্রুবর!?”
প্রজ্জ্বলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
“না মেজ ভাইয়ার।”
“ওহ।”
চুপসে গেল উনার মুখটা। ভাবলেন ধ্রুব হয়তো বলেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিচেনে গিয়ে চিকেনগুলো ধুতে লাগলেন। আজ আট বছর পর ছেলে ফিরেছে বাসায়। কী রান্না করবেন সেটা ভেবেই দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেলেন। উনার ইচ্ছে করছে নিজের কলিজাটা কেটে রান্না করতে। যদি সেটা খাওয়া মনুষ্যত্ব জাতির জন্য হালাল হতো তবে আরকি! মাঝেমধ্যে বাসা থেকে মাটন কিংবা বিফ বিরিয়ানি অথবা খিচুড়ি করে পাঠাতেন। বলা যায় ধ্রুবর ভীষণ পছন্দ তাই। কিন্তু আজ বিরিয়ানি কিংবা খিচুড়ি কোনোটাই রান্না করবেন না। পোলাওর সাথে চিকেন রোস্ট,গরুর মাংস,খাসির রেজালা,চিংড়ি,ডিম,সবজি,গরুর মাংসের কাবাব,ইলিশ ভাজা,চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা আর সালাদ ইত্যাদি এগুলোই করবেন। সাথে দধি রেখেছেন আর জর্দা করবেন। বিকেলের দিকে পায়েস রান্না করবেন। সে যাইহোক,ছেলে এসেছে তাই খুশিতে যত পারছেন রান্নার আইটেম বাড়াচ্ছেন। শিলনোড়ায় মশলাপাতি বেটে নিচ্ছেন রিনা খালা। দিলরুবা খাতুন গ্রামের মানুষ,তাই ব্লেন্ড করা মশলা পছন্দ করেন না। প্রতিদিন রিনা খালার হাতে বাটাবেন আর তাজা মশলা দিয়ে তরকারি রান্না করতে পছন্দ করেন তিনি। এই নিয়ে রিনা খালার অভিযোগের শেষ নেই। প্রতিদিন মশলা বাটা লাগবেই। বটি নিয়ে পেয়াজ কাটতে বসলো নিশু। রিনা খালাকে নিয়ে কতক্ষণে এইসব করবে তার ফুপি! জোছনাকে বাজারে পাঠিয়েছেন কাঁচামরিচ আনতে। কখন আসবে মেয়েটা কে জানে! চোখ জালাপোঁড়া করে পানি বেরুতে লাগলো।
“ধুয়েছিস?”
চমকে তাকায় নিশু।
“হ্যাঁ।”
“কাঁদছিস কেন?”
“কাঁদছি না।”
রুমের দিকে পা বাড়ালো ধূসর।
“তুই আবার পেয়াজ কাটতে বসলি কেন নিশু যা উঠ।”
“একটু কেটে দিই!”
হ্যান্ডওয়াশ করে এসে বাহু ধরে দাঁড় করান।
“তোর এইসব করার দরকার নেই। তোকে বলেছি কিচেনে আসারও দরকার নেই। কথা শুনে না মেয়ে। যত যন্ত্রণা! দ্যুতি কইরে!”
_____________
#চলবে~