#মায়াকুমারী ❤
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(০৬)
___________________
জলপ্রপাতের ন্যায় চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে নিশুর দু-গাল বেয়ে। মন্দ বলেনি ধূসর। নিশুর বলতে ইচ্ছে করলো,”মেয়েদের জীবনে বিয়ে একবার। উনাকে আমি হারানোর ভয় পাই। এই আঘাতে প্যানিক হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। কারণ আমি খুব ভালোবাসি উনাকে। উনার জন্য নিজের সবটুকু উৎসর্গ করতে রাজি। কিন্তু তিনি তো সেটা বুঝেন না। বুঝবেন কীভাবে তিনি তো আমাকে ভুল বুঝে আছেন। আমার মুখটা পর্যন্ত দেখতে চান না। আমি সবসময়ই উনার প্রতি লয়্যাল থেকেছি। কোনো আবর্জনায় মুখ দিইনি। আমি উনাকে খুব বেশি ধৈর্য নিয়ে একতরফাভাবে ভালোবাসি,ইভেন ভালোবেসে যাচ্ছি। কথা না বলেও তিনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করছেন যেন আমি নিজেই উনাকে ছেড়ে দিই কিন্তু আমি তা পারি না। উনার মধ্যে কী আছে তা আমি জানি না। শুধু জানি তিনি আমার স্বামী এবং প্রথম ভালোবাসা। আমাকে প্রচন্ড ঘৃণা করার পরেও আমি উনাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসি। উনাকে ছাড়া আমি কিচ্ছু বুঝি না। উনাকে না পেলে একা বাঁচবো তাও দ্বিতীয় কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না। উনার বিরহে,চিন্তায় সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। শুধু অবয়বটাই আছে। কোনো আশা-ভরসা নেই জীবনে। জীবনটা থমকে আছে শুধু উনার একটু সার্পোট,একটু ভালোবাসা আর ভালো কথার আশায়। উনার চিন্তায় আমার রূহটা যেন তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”
তা না বলে শুকনো ঢোক গিলে বলল,”জানোই তো খ্রিস্টানদের একটা বিষয় আছে; ওরা চার্চে গিয়ে ফাদারের কাছে সব স্বীকারোক্তি দিয়ে দায়মুক্ত হতে পারে কিন্তু এখানে বিষয়টা অনেকটা এই রকম। তোমার সাথে আমি অনেকটা স্বাভাবিকভাবে মিশার চেষ্টা করি,কথা বলি তাই আমার মনের কথাগুলো তোমার সাথে শেয়ার করছি। আমি উনার ভালোবাসার ভিখারি। উনাকে ছাড়া একটি মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না যে উনাকে ছাড়া বাঁচবো না। এগুলো ভাবলে দমবন্ধ হয়ে যায়। আর এইসব ওভারথিংকিং করে পাগল হয়ে যাচ্ছি। সব থেকে কষ্ট পাই যখন আমার প্রতি উনার কোনো আগ্রহ দেখি না শুধু অবহেলাটুকু ছাড়া। তিনি আমার মুখও দেখতে চান না। উপস্থিততি তো সেখানে বড়ই বেমানান।”
“শোন,ভালোবাসার পথ সবসময়ই আঁকাবাকা হয়। তাই আপাতত একটু দূরে থাকার চেষ্টা কর। এতে কিছু সময় পাগল থাকবি তবে এরপর আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবি। কিন্তু এর পিছনে যত লেগে থাকবি আর যত দেরিতে ছুটবি ততবেশি মেন্টালি ট্রমার মধ্যে থাকবি। আর তোর মতো করে বললে,রূহের কোনো কষ্টই চিরস্থায়ী নয়। সময়ের সাথে সাথে কেটে যাবে এইসব। আপাতত নিজেকে সময় দেওয়ার চেষ্টা কর যতটা সম্ভব। শোন,মৃত্যুও রূহকে ধ্বংস করতে পারে না। মানবশরীর থেকে রূহকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে মাত্র। তাই স্ট্রংলী কাম ব্যাক কর।”
“মাঝেমাঝে বাবা-মায়ের উপর ভীষণ রাগ-ক্ষোভ,জিদ-অভিমান সব জন্মে; কেন তারা আমাকে জন্ম দিলেন যখন এমনটাই করবে! মাঝেমাঝে পরিবেশটাকে দোষারোপ করি কেন আল্লাহ এই পরিবেশে জন্ম দিলেন! আবার হঠাৎ করে মনে হয় কেনই বা আমি এই সমাজে কিংবা দেশে জন্ম নিলাম! তবে এসবের উত্তর খোঁজা একসময় ফিকে হয়ে যায় যখন ভাবি এই পৃথিবীতে আমি একজন নগণ্য মানুষ,আমার হাতে তো কোনো ক্ষমতা নেই,সবকিছুর ক্ষমতাই তো একজনের মধ্যে নিহীত আর বাবা-মায়ের কিইবা করার আছে কারণ সৃষ্টিকর্তাকে তো কোনোভাবেই দোষারোপ করা যায় না,প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না! তাঁদের দায়িত্ব ছিল জন্ম দেওয়া,লালন-পালন করা। তাঁদের এই দায়িত্ব তাঁরা পালন করেছেন কিন্তু এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় চাপাকান্না ছাড়া আর কিছু করার নেই। জীবন চলবে জীবনের নিয়মে কিন্তু মনের ভিতর শত ব্যথা জমে থাকাটা কেউ দেখবে না এটাই তো জীবন,এটাই মনে হয় নিয়তি। এইসব ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছি। এর এইসবের মধ্যে কীভাবে এত স্ট্রংলী কাম ব্যাক করবো বলো! সে যাইহোক,এইসব ছাড়ো। তবে মাঝেমাঝে তোমার কথাগুলো শুনে অনেক কিছু নতুন ভাবে ভাবতে শিখি,উপলব্ধি করি তাই অগোছালোভাবে অনেক কিছু বলে ফেলি হয়তো বলা যায় মনের অজান্তেই এসব বন্দী কথা বেড়িয়ে আসে। তুমি সবসময়ই এভাবেই বলে যেও আর আমার মনের মধ্যে যত লুকায়িত,অপ্রকাশিত এবং পাথর হয়ে জমে থাকা সকল ভাবনাগুলোকে আরো সম্প্রসারিত করতে।”
___
মাকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন আসাদ সাহেব এবং এর কিছুক্ষণ পর দিলরুবা খাতুন। জামাকাপড় বদলে ফ্রেশ হলেন আসাদ সাহেব। নাস্তা খেতে টেবিলে বসলেন। মাথার মস্তিষ্ক টগবগ করছে উনার।
“রিনা,ধ্রুব কই?”
“ঘুমায়।”
“কী!”
চেঁচিয়ে উঠলেন আসাদ সাহেব। আতঙ্কিত চোখে তাকালেন রিনা খালা।
“বেলা কয়টা বাজে এখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে! ডেকে তোলো।”
“জ্বী আইচ্ছা।”
“চেঁচাচ্ছেন কেন?”
“এতকিছু হয়ে গেল তোমার ছেলে এখনও ঘুমাচ্ছে নবাবের মতো এইসবের মানে কী!”
নীরব রইলেন দিলরুবা খাতুন। স্বামী এবং শ্বাশুড়িকে নাস্তা বেড়ে দিলেন।
“তোমার ছেলের সাথে আমার জরুরি কথা ছিল বলোনি?”
“বলেছি।”
“তো আমার সঙ্গে দেখা করেনি কেন?”
“করবে থামুন একটু।”
রাগে গজগজ করলেন আসাদ সাহেব। নাস্তা খেয়ে তৈরী হলেন উনার শপে যাওয়ার জন্য।
“দিলরুবা আমি বেরুলাম। আসরের নামাজের পর তোমার ছেলের সঙ্গে আমার বৈঠক। বলে দিও প্রস্তুত থাকতে।”
“আচ্ছা।”
চিন্তায় অস্থির হলেন দিলরুবা খাতুন। কী নিয়ে আবার বাবা-ছেলে মুখোমুখি হবে,লাগবে ভেবে পাচ্ছেন না। সারাদিন চিন্তায় কাটতে লাগলো।
___
শপে গিয়ে চেয়ারে বসলেন আসাদ সাহেব। হিসাব খাতাগুলো খুলে চেক করতে লাগলেন। চোখের সামনে ভেসে উঠলো আজ থেকে আট বছর পূর্বের এক মর্মান্তিক,বিধস্ত ঘটনা। তখন ছোট্ট নিশুর বয়স ছিল মাত্র দশ। বাবা-মায়ের ডির্ভোস হয়ে যায় পরকীয়া সংঘটিত কারণে। বাবা পরনারীর হাত ধরে সংসার করতে লাগলো,অবশেষে তার মাও নতুন সংসারে আবদ্ধ হলো মামাদের চাপে। মাঝখান দিয়ে ছোট্ট নিশু এতিম হয়ে গেল দু-দিক থেকেই। কী দোষ ছিলো ছোট্ট বাচ্চাটির? বাবা-মায়ের ভুল সিদ্ধান্তে শুধু নিশু নয় এই রকম বহু বাচ্চারাও এতিম হয়ে যায়। সে যাইহোক,এরপর নিশুর দায়িত্ব কেউ নিতে চায়নি যে যার যার মতো আলাদা জীবন শুরু করলো। সৎ মায়ের অনাদর,অবহেলা,অত্যাচারে মুমূর্ষু প্রায় নিশু ছোট্ট বয়সেই মাইল্ড স্ট্রোক করে বসে। শুনতে পেয়ে উনারা স্বামী-স্ত্রী আসেন এবং হসপিটালে এডমিট করেন। এরপর আংশিক সুস্থ হলে দিলরুবা খাতুন ইনিয়ে-বিনিয়ে স্বামীকে বললেন নিশুর কথা। আপত্তি করেননি আসাদ সাহেব। তবে সুফিয়া বেগম হচ্ছে অন্য রকম মানুষ। সাংসারিক জীবনে অনেক ভোগ-ভোগান্তি দিয়েছিলেন দিলরুবা খাতুনকে তদ্রূপ সাদিকা খাতুনও। সবই জানতেন আসাদ সাহেব। তাই দিলরুবা খাতুন চাননি নিশু আশ্রিতা হয়ে উনাদের কাছে থাকুক। নয়তো উঠতে-বসতে খোঁটা তো শুনতেই হবে ভাতিজিকে। পরে আবারও স্ট্রোক করে বসবে মেয়েটা। আপন রক্ত বিধায় ভাই-ভাবীর মতো নির্দয় হয়ে ফেলে দিতে পারেননি। তাই স্বামীর সঙ্গে আলাপ করে জানালেন পুত্রবধূ করে রাখতে চান। স্ত্রীর মানসিক অবস্থা এবং শুকনো মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে ভেবেচিন্তে আসাদ সাহেব না করেননি। বরং মায়া হলো। প্রকৃত অর্থে মা-বোন যেমনই হোক না কেন আসাদ সাহেব একজন সাদা মনের মানুষ। সায় দিলেন বিয়েতে। ধ্রুবর বয়স তখন পনেরো। ছেলেকে ডেকে মায়াবী গলায় সব বুঝিয়ে বললেন এবং অনুরোধ করলেন। শুনতেই বিস্ফোরণ ঘটালো ধ্রুব। ভাঙচুর করলো ঘরের ভিতর। কিছুতেই সে ছোট্ট নিশুকে বিয়ে করবে না। এছাড়াও জীর্ণশীর্ণ দেখতে কেমন ইত্যাদি বলে বাকবিতন্ডা তৈরী হলো বাবা-ছেলের মধ্যে। সেখান থেকে আরো একধাপ হাতাহাতি-মা’রামা’রি। এরপর আসাদ সাহেব এবং সামাদ সাহেব ধ্রুবকে একটি রুমে নিয়ে অনেকক্ষণ বুঝালো। হঠাৎই শান্ত হলো ধ্রুব। তবে কী বুঝালেন সেটা উনারা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানেন না। এরপর বাধ্য ছেলের মতো রইলো ধ্রুব। সেদিনই বিয়েটা হয়ে যায়। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন নিশুকে। তারপর হতে যে কয়দিন বাড়িতে ছিল ধ্রুব সে কয়দিন মারধর করতো নিশুকে। সামনে পড়লেই আঁছাড় দিতো কিংবা চড়থাপ্পড় তো ছিলোই। যাক সে-সব কথা। ছোট্ট নিশুর উপর ওমন শারিরীক-মানবিক নির্যাতন সহ্য করতে পারলেন না আসাদ সাহেব। হুমকি-ধামকি দিলেন ছেলেকে। সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঢাকা চলে এলো। উঠলো ফুপির বাসায়। তিনি কী কী বুঝালেন কে জানে! হঠাৎই শক্ত হয়ে গেল ধ্রুব। আাসাদ সাহেব এলেন নিতে পারলেন না ছেলেকে। তারপর টি.সি নিয়ে নিজ দায়িত্বে ঢাকার একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন এবং হল ঠিক করে দিলেন। সে-সময় অভাব-অনটনে দিন পার করছিলেন আসাদ সাহেব। তিনি যে বড়লোকের ব্যাটা তা নয় খেটে-খাওয়া মানুষ। মা-স্ত্রী সহ চার সন্তান এবং উনার ভাইয়ের পরিবার সহ যৌথ পরিবার ছিল উনাদের। তাতে আবার যোগ হলো নিশু। এতজন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন আসাদ সাহেব। ছেলের চিন্তায় গ্রামে থাকতে পারলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও ঢাকা ফিরে যাবেন। ভাত মেখে দু’জনকে খাওয়াচ্ছিলেন দিলরুবা খাতুন। ঠিক তখন রেডি হয়ে আসাদ সাহেব বললেন,”আমি ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। সেখানে কোনো কাজ খুঁজে নিবো।”
এগিয়ে এসে নিশু বলল,”এই দশটাকা রেখে দাও ফুপা।”
বলেই পকেটে রেখে দিলো। উনি বললেন,”কেন?”
“পথে কিছু খেও।”
“টাকা কোথায় পেয়েছো?”
“সেদিন যে খেতে দিয়েছ সেই টাকা।”
“কিন্তু এখন আমার টাকা লাগবে না।”
“আরে লাগবে রেখে দাও।”
মুচকি হাসলেন স্বামী-স্ত্রী।
“বুঝছ দিলরুবা,মেয়েটা তেমার মতো সহজসরল হবে।”
মুচকি হাসলেন তিনি। এরপর দু’জনকে আদর করে চলে গেলেন। ঢাকায় আসার পর উনার পরিচিত এক বন্ধুর সাহায্যে একটি কারখানায় কাজ পান। একদিন কারখানার মালিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। আসাদ সাহেব সাহায্য করেন। কৃতজ্ঞ হয়ে উনার প্রমোশন বাড়ান। দুই বন্ধু মিলে যুক্তি করলো এভাবে হবে না। উনারা দু’জন বেশ কয়েক লাখ টাকা লোন নিয়ে রিকশা,সিএনজি নামান। সেগুলো ভাড়া দিতে থাকেন। এরপর হুট করে একের পর এক টাকা আসতে থাকে। খবর দিয়ে সামাদ সাহেবকেও নিয়ে গেলেন। কারখানায় থাকাকালীন সামাদ সাহেব সব সামলিয়ে নিতেন। রাতারাতি বদলে গেল উনাদের অবস্থা। অবস্থা ভালো দেখে গ্রাম থেকে নিয়ে গেলেন পরিবারকে। বড়সড় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে শুরু করে সবাই। তারপর বাচ্চাদের ভালো একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। এরপর বন্ধুটি বললেন,লাভের টাকা দিয়ে উনারা আরেকটি বিজনেস শুরু করতে চান। আসাদ সাহেব জানতে চাইলেন কীভাবে? বললেন পুরাতন বিল্ডিং কিনে নতুন করে তৈরী করবেন অথবা পুরাতন ফ্ল্যাটগুলো কিনে নতুন করে সব তৈরী করে এরচেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রয় করবেন। ভেবে দেখলেন মন্দ না। তারপর সামাদ সাহেব খোঁজ নিতে লাগলেন কোথায় কোথায় পুরোনো ফ্ল্যাট,বাড়ি বিক্রি হচ্ছে। এভাবে তারা সামলে নিলো বিজনেসটা। মোটামুটি ভালোই উন্নতি হচ্ছিল দেখে কারখানার কাজ ছেড়ে দিলেন। তারপর ইট,বালু,রড,সিমেন্ট,টাইলস ইত্যাদি ভ্যারাইটিজের ব্যবসা খুলে বসলেন। তারপর বন্ধুর ভাইও পার্টনার সহ নিযুক্ত হলেন। চারজন মিলে বিজনেসগুলো সামলাতে লাগলেন। একের পর এক টাকা আসতে লাগলো দেখে ভীষণ খুশি হলেন আসাদ সাহেব। উনার মনে খালি নিশুর প্রতি একটা কথা ঘুরপাক খেত। নিশুকে পুত্রবধূ করে আনার পরেই হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেলেন। অনেকেই বলে না বিয়ের পর মেয়েদের সঙ্গে সৌভাগ্য আসে স্বামীর সংসারে। তা না হলে অভাব-অনটনের সংসারের হঠাৎই এত পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব? হুট করে টাকা আর টাকা আসতে লাগলো সমুদ্রের স্রোতের মতো। নিশুকে নাতবৌ করার অপরাধে ছেলে সহ বউয়ের ইজ্জতও রাখলেন না সুফিয়া বেগম। সাদিকা খাতুনও আনাগোনা করতেন। দিন-রাত গালমন্দ করতেন,খাওয়ার খোঁটা দিতেন। কিন্তু নিশু তার রিযিক নিয়ে এসেছিল। স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করলেন এই বিষয়ে। দিলরুবা খাতুন চুপ ছিলেন। পরের মেয়েকে আদর করে আপন করলে আল্লাহ এমনিতেই রিযিক দেন। আল্লাহ তো বলেছিলেন,তোমাদেরকে আমি এতএত দিব যে খুশি হয়ে যাবে। সত্যিই আল্লাহ এতএত দিয়েছিলেন যে আসাদ সাহেব ঢাকায় জমি কিনে পাঁচতলার একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি তুললেন। নিচ তলায় বিশাল লিভিং স্পেস,ডাইনিং আর কিচেন। আর দোতলায় পুরো দুটি ইউনিট একসঙ্গে করে বিরাট একটি এপার্টমেন্ট করলেন। উপরে বারোটি বেড রুম আর আর সঙ্গে এটাচ ব্যালকনি এবং ওয়াশরুমও রয়েছে। দুটি তলায়ই রুচিসম্মত আসবাবপত্রে সাজানো। সেখানে যৌথ পরিবার নিয়ে থাকতে শুরু করলেন। তারপর আস্তে আস্তে বাকি ইউনিটগুলো কমপ্লিট করে ভাড়া দিলেন। মাস শেষে মোটা অংকের টাকা আসে বাকি তিনতলা মিলিয়ে ছয়টি ফ্ল্যাট থেকে। ভবিষ্যতে ইচ্ছে আছে বাড়িটি আরেকটু বড় করার। সে যাইহোক,নিশুর সম্পূর্ণ খরচ আসাদ সাহেব বহন করেন। অনেক সুখে ছিল নিশু বিয়ের পর। সে বুঝতোই না বিয়ে কী! শ্বশুড়বাড়িতে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কাছে খুব যত্নে ছিল; যত্ন করেছিলেন উনারা দু’জন। তিনজনকে স্কুলে দিয়ে আসতেন আসাদ সাহেব এবং নিয়ে আসতেন দিলরুবা খাতুন কিংবা ধূসর। নিশু তো ভুলেই গিয়েছিল এটা তার শ্বশুরবাড়ি। আসাদ সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওরা দু’জন পরিণত বয়সের হলে সংসার করবে। আর পরিণত বয়সের হলে ধ্রুব ঠিক বুঝতে পারবে নিশুকে তখন নিশ্চয়ই সংসার করবে। ততদিন তাদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখবেন। দ্যুতি-নিশু এইচএসসি দিয়েছে এবার। এডমিশন টেষ্ট সামনে। মেডিকেলে কিংবা ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স না পেলে প্রাইভেট কোনো ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিবেন। ধ্রুব মাস্টার্স করতে চায় ইউএসএ গিয়ে। ব্যাংক স্টেটমেন্ট চাচ্ছে ত্রিশ-সত্তর লক্ষ টাকা। বিমান ভাড়া ছাড়াও আনুষাঙ্গিক খরচাপাতি বাদে। এতগুলো টাকা তিনি খরচা করে ছেলেকে বিদেশ পাঠাবেন কিন্তু ছেলে যদি পল্টি দেয় তাহলে? অথবা এতিম মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয় ওইখানকার কোনো অপরূপা সুন্দরীর ফাঁদে পড়ে তাহলে?একই জেলায় থাকার পরেও যেই ছেলেকে আটটি বছর তিনি বাসায় আনতে পারেননি হাজারও বলে-কয়েও,উল্টো জিদ চাপলো হলে থাকতে পারবে না তাকে আলাদা ফ্ল্যাট দিতে হবে। ছেলের জন্য তিনি আলাদা ফ্ল্যাটও কিনলেন। এখন সেই ছেলেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠালে আর কি ফিরিয়ে আনতে পারবেন সেটা নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দে রয়েছেন। তাই তিনি বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেগুলো নিয়ে বৈঠক করবেন ছেলের সঙ্গে। দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে এলো। বাসায় ফিরার পথে ওয়েলফুড থেকে রসমালাই,শুকনো রসমালাই,মিষ্টি দধি,ছানা,সন্দেশ এবং মতিচুর লাড্ডু কিনলেন। নিশুর ভীষণ পছন্দের রসমালাই। তবে এবার যোগ হলো ওয়েলফুডের শুকনো রসমালাইটা। বাসায় ফিরে গোসল এবং ইবাদত সেরে খাওয়া-দাওয়া সারলেন। তবে বড় আদরের ধন পুত্রকে দেখতে পেলেন না টেবিলে। মেজাজ চটলেও নীরব রইলেন। কিছুক্ষণ রেস্ট করলেন।
“দিলরুবা!”
“জ্বী,কিছু বলবেন?”
“সকালে কী বলে গেলাম?”
মৌন রইলেন তিনি।
“তোমার ছেলেকে ডাকো।”
নীরবে প্রস্থান করলেন। ছেলের রুমে নক করলেন।
“কী আম্মা?”
“তোমার বাবা ডাকছে।”
“কেন?”
“সেটা গেলেই বুঝতে পারবে।”
“আসছি বলে দাও।”
কিছুক্ষণ পর গম্ভীর হয়ে বাবার রুমে ঢুকল ধ্রুব। ছেলের দিকে তাকালেন আসাদ সাহেব।
“বসো।”
মুখোমুখি একটি সোফায় বসলো ধ্রুব। সুফিয়া বেগম এবং দিলরুবা খাতুন নীরব হয়ে রইলেন।
“তোমার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল।”
“বলুন।”
“বিদেশে পড়াশোনা করতে চাও ভালো কথা। আমার সমস্যা নেই। টাকা ম্যানেজ করেছি। তবে আমার বেশকিছু শর্ত রয়েছে।”
“কীসের?”
“আটটি বছর তোমাকে বাসায় আনতে ব্যর্থ আমি। এবার যুক্তরাষ্ট্রে গেলে যে তুমি বাংলাদেশে ফিরবে তার কী গ্যারান্টি?”
“কী বলতে চান?”
“নিশুর সঙ্গে সংসার করবে কি-না জানতে চাই!”
“এই কথা আট বছরে কয় হাজার বার বলেছি বলুন?”
“শেষ বারের মতো শুনতে চাই!”
“ওই মেয়ের সাথে আমি কিছুতেই সংসার করবো না ম’রে গেলেও না।”
থমকে দাঁড়ালো ওরা তিনজন।
____
চলবে~