#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(০৭)
___________________
সবেই হসপিটাল থেকে ফিরলো। বজ্রাহতের ন্যায় আঘাত হানলো নিশুর হৃদয়ে। রক্তক্ষরণ শুরু হলো। টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দু-গাল বেয়ে।
“রুমে যা নিশু।”
দূর্বল পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
“কী বললে তুমি?”
“যা শুনেছেন তাই! করবো না সংসার। কিছুতেই না!”
শুধু এই একটা কথার জন্য নিশুর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে ধূসর। হ্যাঁ এটা সত্যি আর শুধু তার ভাইয়ের এই একটি কথায়। দীর্ঘ আটটি বছর এই কথাটা শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে ধূসরের। সেখান থেকেই নিশুর প্রতি তার দূর্বলতার সৃষ্টি। নিশুর প্রতি দূর্বল হওয়ার জন্য তার ভাই পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। ধূসরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার ভাই সংসার না করলে সে করবে নিশুর সঙ্গে। নিজের চোখের সামনে বড় হয়েছে নিশু। কোনো পুরুষের আঁচড় তার শরীরে স্পর্শ করতে দেয়নি এতটাই আগলে রেখেছিল দু’জনকে। হয়তো ডিভোর্সী নামক কলঙ্কের প্রলেপ পড়বে তবে এটা ম্যাটার করে না তার কাছে। সেও দেখিয়ে দিতে চায় সব পুরুষ ঠকায় না। কিছু কিছু পুরুষ ঠকে যাওয়া নারীটিকে যত্ন করে আগলে রাখে। সে এলোমেলো হলেও মেয়েটাকে ঠিক গুছিয়ে নিবে; রাখবে। এগিয়ে গেল ধূসর। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আসাদ সাহেব।
“এইসব কী হচ্ছে বাবা?”
“তোমার ভাইয়ের কৃর্তীকলাপ দেখছি।”
“শান্ত হোন।”
“শান্ত হওয়ার কথা?”
“উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।”
“তো হবো না?”
“বাবা-ভাইয়া তোমাদের উদ্দেশ্যে বলছি,তোমরা শান্ত হও প্লিজ। আর ভাইয়া শোনো,হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। তুমি নিজেকে কিছুদিন সময় দাও। পরিবার ও কাছের মানুষদের সঙ্গে কিংবা তোমার কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীর সাথে শেয়ার করে আলোচনা করো। আর আবেগের বশে কিংবা রাগ-ক্ষোভ,জিদ-অভিমান পুষে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ভবিষ্যতে কষ্ট পেতে হবে এমন কোনো ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্ত নিও না প্লিজ। এটা শুধু তোমার একার ডিসিশন নয় এতে আরেকটি এতিম মেয়ের জীবনও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই শান্ত হও। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো তুমি আসলেই কী করতে চাচ্ছ! আপাতত তোমরা দু’জন ফেইস-টু-ফেইস হও,একজন আরেকজন দেখো,বুঝো,চিনো। কথা বলে ফ্রী হও। তারপর সপ্তাহ খানেক একসঙ্গে থাকো,সংসার করো অথবা কাছে আর না হয় দূরে কোথাও ঘুরতে যাও কিছুদিনের জন্য। একে-অপরকে সময় দাও। একজন আরেকজনের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে জানো,তার সঙ্গে ওপেনলি কথা বলো সে কী চায় আর তুমি কী চাও? তারপর দেখো সে তোমার জন্য পারফেক্ট লাইফ পার্টনার কি-না! আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবং মেন্টালিটি ম্যাচ করবে কি-না ইত্যাদি। প্লিজ ডিভোর্সের মতো জঘন্য সিদ্ধান্ত আপাতত নিও না। একটু সময় নাও। নিশুর জন্য বাবা-মা তোমাকে অনেক ভরসা করে। বাবা-মাকে হতাশ করো না। অনেক হয়েছে মান-অভিমানের খেলা এবার এইসব বন্ধ করো। আমরা সবাই বিরক্ত,হতাশ! আর কত এই রকম কষ্ট দিবে সবাইকে! তোমার জন্য বার-বার অসুস্থ হয়ে পড়ছে নিশু। বিয়ে থেকে এই অব্ধি একটাবার তুমি ওর খোঁজ-খবর নিয়েছ বলতে পারবে! চাইলেই বিয়ের মতো পবিত্র একটা সম্পর্কে তুমি অস্বীকার করতে পারো না! তিন কবুল বলে বিয়ে করেছ নিশুকে। সে তোমার তিন কবুল বলা বৈধ স্ত্রী। তাকে মেনে নিয়ে সংসার শুরু করো। স্ত্রীর মর্যাদা দাও। নিশ্চয়ই তুমি ছোট্ট শিশু নয় যে তোমাকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে! সে যাইহোক,এখন তোমার অবস্থা খুবই সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ; তাই ধাপে ধাপে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলে মনে করি। দূর্বল পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল নিশু। শরীরটা ভেঙেচুরে মুষড়ে আসছে ওই একটি কথায়। ওই একটি কথা সে শুনতে পারে না কিছুতেই না! ওই কথাটা শুনতেই সে আর সুস্থ-স্বাভাবিক থাকে না। হাজার বার চেয়েও মানুষটাকে সে ঘৃণা করতে পারেনি বরং আরও ভালোবাসা বাড়ে। এটা কি আল্লাহর কোনো রহমত? তা না হলে তাকে এতএত ঘৃণা করার পরেও কেন সে মানুষটাকে ভালোবাসে? ভালোবাসা সৃষ্টি হয়? দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। জলপ্রপাতের ন্যায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মেদুর দু-গাল বেয়ে। লেপ্টে দু-হাঁটু ভাঁজ করে সোজা ব্যালকনির মেঝেতে বসল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। মানুষটা কেন তার মুখ দেখতে চায় না? ধূসর ফোন কেনার পর দ্যুতি তাকে নিয়ে সেজেগুজে ছাঁদে গিয়ে নানান পোজ দিয়ে ছবি তুলতো। সেগুলো পাঠাতো ধ্রুবর মোবাইলে। এভাবে কয়েকদিন পাঠানোর পর একদিন দ্যুতিকে তার ফ্ল্যাটে ডাকলো। খুশি মনে গিয়েছিল দ্যুতি। কিন্তু ধ্রুব তাকে অনেকগুলো থাপ্পড় দিয়েছিল। কেন তাকে নিশুর ছবি পাঠায়! রাগে-জিদে নিজের মোবাইল ভেঙে ফেললো। পরে আবার মোবাইল কিনে দেওয়ার জন্য বাবার সাথে বাকবিতন্ডা করলো। এরপর সেই থেকে তার ছবি ধ্রুবকে আর কেউ পাঠায় না। আর নিশুরও অভিমান জমে এরপর থেকে সেও আর কারো ফোনে ছবি তোলে না। যতদিন নিজ থেকে তাকে দেখার আগ্রহ না করবে ততদিন পর্যন্ত সেও স্বইচ্ছায় ধ্রুবর মুখোমুখি হবে না; মুখ দেখাবে না। এক ঘর মানুষ নীরব রইলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ছেলের কথাগুলো মনে ধরলো আসাদ সাহেবের। মন্দ তো বলেনি।
“বাবা,আমার কথায় কি কোনো ঘাটতি আছে?”
“না।”
“তো ভাইয়াকে বলো তাই করতে।”
“তুই বললেই হবে?”
খেঁকিয়ে উঠলেন আসাদ সাহেব।
“মন্দ কী বলেছে?”
“আমি ওই মেয়ের সঙ্গে সংসার করব না লাস্ট কথা।”
“তাহলে আমিও কারো জন্য কোনো টাকাপয়সা ব্যয় করতে পারব না। কারো যদি উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন হয় তারটা সে নিজেই করে নিক।”
সামনে থাকা একটা চেয়ার আঁচাড় মা’রলো ধ্রুব। মুহূর্তেই ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে গেল। ছেলের দিকে তেড়েফুঁড়ে গেলেন আসাদ সাহেব। ধূসর থামাল।
“কী শুরু করলে তোমরা!”
“ওর স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি!”
“বাবা থামুন। জোর করে ভালোবাসা,সংসার এগুলো কিছুই হয় না। হলেও মন থেকে কেউ করে না। এখনও সে নিশুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কিংবা সংসার কিছুই করেনি তাতেই এই অবস্থা! সে যাইহোক,নিশুর জন্য পাত্রের অভাব হবে না। কত ভালো পাত্র পাওয়া যাবে যে নিশুকে যত্ন করে আগলে রাখবে।”
ক্ষুব্ধ চোখে তাকায় ধ্রুব।
“হ্যাঁ,আছিস তো তুই সমস্যা কী!”
“এইসব কী শুরু হয়েছে আমার মাথায় ধরছে না!”
হতাশ হয়ে বললেন দিলরুবা খাতুন। বেরিয়ে গেল ধ্রুব।
“দিলরুবা,তোমার ঘাড়ত্যাঁড়া ছেলে কিন্তু বেশি বেশি করছে! ওকে থামাও।”
“জোর করবেন না। জোর করে কিছু হয় না।”
“ওর কপালে দুঃখ আছে মনে রেখ।”
“উল্টাপাল্টা কী বলছেন!”
“বাবা,ভুলে গিয়েছেন আপনি হার্টের রোগী! গত বছর এনজিওগ্রাম করানো হয়েছে আপনাকে। এখন হার্টের অবস্থা খুব একটা ভালো না তাই শান্ত থাকুন রেস্ট করুন। উত্তেজিত হলে আপনারই সমস্যা।”
“ওই ঘাড়ত্যাঁড়া ছেলের জন্য,ওর টেনশনে টেনশনে আমার শরীরে এত রোগ বাসা বেঁধেছে!”
“আম্মা,বাবার ঔষধ দিন।”
ঔষধ খাইয়ে দিলো। শান্ত হোন আসাদ সাহেব।
“শুয়ে পড়ুন।”
বাধ্য মানুষের মতো শুয়ে পড়লেন। চোখ লেগে এলো উনার।
“ঘুমাক। ডাকাডাকি করো না। বাবার পর্যাপ্ত রেস্টের দরকার। সারাদিন টেনশনে থাকে।”
বুক অব্ধি একটি পাতলা নকশীকাঁথা টেনে বেরিয়ে গেল ধূসর। হসপিটালে ছিল সারাদিন গোসল কিংবা খাওয়া-দাওয়া হয়নি। নিজের রুমে গিয়ে ঢুকল ধ্রুব। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। তপ্তশ্বাস ফেলে বাম পাশের ব্যালকনির দিতে চোখ পড়তেই দেখল ওদিক ফিরে মেঝেতে বসে রয়েছে নিশু। একঝাঁক কালো চুলে পুরো পিঠ ঢেকে আছে। দাঁত-মুখ পিষালো। এই মেয়েটার জন্যই এইসব হচ্ছে। মে’রে ফেলতে ইচ্ছে করছে! গোসল সেরে এলো ধূসর।
“নিশু! নিশু! ভাত খাবি না?”
নীরব রইলো নিশু। ডোর খোলাই ছিল। দেখল রুমে নেই কিন্তু ব্যালকনির দিক থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। এগিয়ে গেল ধূসর। দেখল মেঝেতে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না করছে নিশু। ধূসরকে দেখল না,রুমে ঢুকে গেল ধ্রুব।
“নিশু গোসল নিয়েছিস?”
“না।”
“গোসল করে নে ভাত খাব আয়।”
“খিদে নেই।”
“আয় বলছি।”
নিশু উঠতেই হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠে বমি এলো। ওয়াক ওয়াক করে দৌঁড়ে রুমে ঢুকতে নিতেই ধূসরের টি-শার্টের বোতামের মধ্যে চুল আঁটকে গেল। ঠিক সে-সময় সিগারেট হাতে ফের ব্যালকনিতে এলো ধ্রুব। চুলগুলো ছাড়াতে লাগল ধূসর। এদিকে চোখ পড়তেই ধ্রুব দেখল ওরা দু’জন খুব কাছাকাছি এবং নিশুর চুলে কী করছে! চোয়াল শক্ত করলো। ধূসরের গায়ের উপর বমি করে দিলো নিশু। হতভম্ব হয়ে দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়।
“আসলেই..আসলেই ইচ্ছে করিনি।”
“ইট’স ওকে।”
চুল ছাড়াতেই রুমে ঢুকে গেল নিশু। খুব সুন্দর ঝুনঝুন শব্দ হলো নুপুরের। ধ্রুব আর তাকাল না সিগারেট টানায় মনোযোগ দিলো।
“নিশু গোসল করে আয় যা।”
“আচ্ছা।”
ওয়াশরুমে ঢুকল নিশু। ধূসর ফের গোসল করতে উদ্যত হলো। গোসল সেরে নিশুকে ডাকল।
“নিশু হয়েছে তোর?”
“হুম।”
“খেতে আয়।”
“আসছি।”
ধীরাজ-ধূসর ড্রাইনিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
“আম্মা গাধীটা কই?”
“আছে কোনদিকে।”
“ভাত খেয়েছে?”
“না।”
“কেন?”
“থাপ্পড় দিয়েছিস কেন?”
“দিনকে দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে।”
অসন্তোষ চোখে তাকান দিলরুবা খাতুন।
“তাই বলে মা’রবি?”
“গাধীকে বলো ভাত খেতে আসতে। নয়তো ডানগালে আরেকটা পড়বে।”
“তুই বল।”
“গাধী! ওই গাধী! গাধী ভাত খেতে আয়।”
ধীরাজের রুমে ছিল দ্যুতি। শুনতে পেয়ে দাঁত-মুখ পিষলো তবে নীরব রইলো।
“ধীরাজ গাধীটা কই?”
“আমার রুমে।”
“কী করে?”
“বসে আছে।”
“ডেকে নিয়ে আয়।”
দ্যুতিকে টেনে নিয়ে এলো ধীরাজ।
“কীরে গাধী ভাত খাসনি কেন?”
“তুমি আমাকে গাধী বলে ডাকো কেন?”
“ন্যাকামি কম করবি।”
“কী ন্যাকামি করলাম?”
“আর একবার তোকে যদি দেখেছি ওই বখাটে অনিকের সঙ্গে চ্যাট করতে তো দেখিস কী করি।”
“ওকে আমি বলেছি নাকি মেসেজ দিতে!”
“চুপ কর।”
“তুমি চুপ করো।”
“আরেকটা থাপ্পড় খাবি।”
রাগে গজগজ করলো দ্যুতি। গোসল সেরে মাথায় টাওয়াল জড়িয়ে ডাইনিংয়ের দিকে পা বাড়াল নিশু। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ঝুনঝুন শব্দ করল। রুম থেকে বেরুতেই ধ্রুব দেখল হলুদ শাড়ি পরনে,মাথায় টাওয়াল জড়িয়ে ডাইনিংয়ে যাচ্ছে নিশু। চোয়াল শক্ত করে রুমে ঢুকল।
“ডিজগাস্টিং!”
ঠাস করে দরজা বন্ধ করল। ডাইনিং টেবিলের সামনে যেতেই ওরা তাকাল। খুব সুন্দর একটি হলুদ শাড়ি পড়েছে নিশু। হালকা হলুদে পুরো শাড়ি শিউলী ফুলের কাজে ভরা। সম্পূর্ণ কাজটিই হাতে এমব্রয়ডারি করা এবং খুবই নিখুঁত। শাড়িটিকে এলিগ্যান্ট লুক দিতে কুশি লেস দিয়ে প্যাচওয়ার্ক পাড় রয়েছে। আর গোসলের পর মাথায় টাওয়াল জড়ানো অবস্থায় ভীষণ সুন্দর লাগছে নিশুকে! সব মিলিয়ে স্টানিং একটা লুক এসেছে। কেন জানি চোখ সরাতে পারলো না ধূসর।
“ভাত খেতে বস।”
ভাত বেড়ে দিলেন দিলরুবা খাতুন। খাওয়ায় মনোযোগ দিলো চারজন।
“ফুপি তুমি খেয়েছ?”
“হুম।”
উনার দিকে তাকায় নিশু কেমন গম্ভীর আর মুখটা থমথমে।
“তোমার কি মনখারাপ ফুপি?”
“না। তোর আব্বু রসমালাই এসেছে ভাত খাওয়ার পর খেয়ে নিস।”
“আচ্ছা। আমাদের সঙ্গে ভাত খাও ফুপি।”
“না পেট ভরা।”
“আব্বু নিশুর জন্য রসমালাই এনেছে আর আমার জন্য কিছু আনতে মনে থাকে না। আমি কার কে!”
অভিমানী হয় দ্যুতি।
“তোর জন্য সন্দেশ আর ছানা এনেছে।”
“লাগবে না কিছু খাও তোমরা বউ-শ্বাশুড়ি মিলে।”
সবাইকে বেড়ে দিতে লাগলেন। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। দিলরুবা খাতুন ডোর খুলতেই দেখলেন পিয়াসা আর পিপাসা দু-বোন দাঁড়িয়ে রয়েছে। চমকালেও মৃদু হাসলেন।
“আরে তোমরা!”
“চলে এলাম মামানি।”
“ভিতরে আসো।”
“ধ্রুব ভাইয়া কই মামানি?”
“রুমে।”
ওদের দিকে তাকায় নিশু। নিশুর দিকে তাকায় ওরা তিন ভাইবোন। নিশু এবার টেনশনে হাই প্রেসার তুলে ফেলবে নিশ্চিত!
“আচ্ছা আমরা তাহলে ভাইয়ার রুমে যাই।”
দ্যুতি বলল,”এসেই ধ্রুব ভাইয়ার খোঁজ নিচ্ছিস ব্যপার কী বলতো?”
পিয়াসা বলল,”কোনো ব্যপার নেই।”
ধূসর বলল,”তোরা বস। আম্মা ভাইয়াকে ডেকে পাঠাও তো।”
“বলছি তোরা খা। নিশু টাওয়ালটা দে,চুল শুকাক নয়তো ঠাণ্ডা লাগবে।”
তিনি নিজেই চুল থেকে টাওয়াল ছাড়িয়ে আলতো করে চুলগুলো একটু মুছে ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে ধ্রুবকে বলে দিলেন তার ফুপাতে বোনেরা এসেছে। চুল দিয়ে মুখ আড়াল করে বসল নিশু। কিছুক্ষণ পর গম্ভীর হয়ে টাউজারের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে লিভিং স্পেসে আসতেই ধ্রুব দেখল ভেজা চুলে পিঠ ঢেকে রয়েছে নিশুর কিন্তু মুখ দেখা গেল না। চুল থেকে পানি ঝরছে! ওদের সঙ্গে ভাত খাচ্ছে। হাসিখুশি দেখাল সবাইকে। মনেই হচ্ছে না ধ্রুব নামের কেউ এখান দিয়ে যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে লিভিং স্পেসে গিয়ে বসল। ওরা দু-বোন ধ্রুবর দু-পাশে বসল। খুব উচ্ছ্বসিত দেখাল ওদের। ধ্রুবকেও খুশি দেখাল। ছোট্ট করে মুখে এক লোকমা তুলে আঁড়চোখে ওদের দিকে তাকায় নিশু। কেন জানি খুব রাগ হয়,জেলাশ ফিল হয়,কষ্টও হয়,বুক ফাটে; অভিমানে ঝাপসা হয় নয়নজোড়া। ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগলো নিশু। দ্যুতি বলল,”নিশু ভাবী ভাত নাড়াচাড়া করছিস কেন তাড়াতাড়ি খা। তোর মামাতো ননদরা এসেছে।”
“খাচ্ছি।”
“শরীরে কী মাখিস নিশু?”
চট করে তাকায় ধ্রুব সহ ওরা। ধূসরের দিকে তাকায় নিশু।
“তুই কি জানিস তোর শরীরের ঘ্রাণ কেমন?”
“কেমন?”
“বেলিফুলের মতো!”
একটু জোরেই বললো ধূসর। কথাগুলো শুনতেই চোয়াল শক্ত করলো ধ্রুব। সে স্বামী হয়েও জানে না তার বউয়ের শরীরের ঘ্রাণ কেমন ওদিকে তার ভাই জানে। ভীষণ রাগ হলো নিশুর উপর। নীরবে ওদের তিনজনকে লক্ষ্য করল ধীরাজ। নির্ঘাত তার ভাইকে জেলাশফিল করানোর জন্য এটা বলেছে।
“নিশু চল দূরে কোথাও ঘুরে আসি।”
ওদের সঙ্গে কথা বললেও ধ্রুবর কান এদিকে। মাথা নাড়ায় যাবে না।
“কেন?”
“ইচ্ছে করছে না।”
“তাহলে চল শপিংয়ে যাই। তোদের দু’জনকে রেশমি চুড়ি আর সোনার নুপুর কিনে দিবো।”
তার বউকে চুড়ি আর নুপুর কিনে দেওয়ার ধূসর কে?এই ধূসরের মুখে এক অন্তরে আরেক। মতলবটা কী তার?একটু আগে তাকে কী শুনালো আর এখন আরেক রূপ! চোয়াল শক্ত করল। খুব যত্নে টুকটাক বেড়ে দিতে লাগল নিশুকে। আঁড়চোখে তাকায় ধ্রুব। এত যত্ন কীসের ওই মেয়েটাকে? মুচকি মুচকি হাসতে লাগল ধীরাজ। কিছুক্ষণ পর ফলমূল,মিষ্টি,ছানা আর সন্দেশ নিয়ে এলেন দিলরুবা খাতুন।
“মা কফি দাও তো।”
“এই তো দিই।”
হঠাৎ উঠে গিয়ে বেসিনে বমি করতে লাগল নিশু। এই সময়ে-অসময়ে বমি করার মানে কী?একটু আগেও দেখল বমি করেছে এখন আবার। গোসল ও করলো ব্যপার কী? ধূসরকেও একটু আগে অন্য টি-শার্টে দেখল কিন্তু নিশুর রুম থেকে বের হওয়ার পর এখন আরেকটা। দু’জনই গোসল করল ব্যপার কী?সে যাইহোক,এখন বার-বার বমি করছে; প্রেগন্যান্ট না তো! আজেবাজে চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক করতে লাগলো ধ্রুবর। আচ্ছা,প্রেগন্যান্ট হলে তার কী? আর ওই মেয়েটা তো তার কিছু না! যত্তসব! কুলি করে এক পা এক পা ফেলে ঝুনঝুন আওয়াজ তুলে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগল নিশু। ঝুনঝুন শব্দে তার পায়ের দিকে তাকায় ধ্রুব। নুপুরের শব্দে কোমড়ের নিচ অব্ধি পড়ে থাকা ভেজা চুলগুলো যেন নৃত্য করছে সেদিকে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। পিছন দিয়ে দেখতে এত নান্দনিক লাগল সামনে দিয়ে দেখতে কেমন জানি! না সে দেখবে না! কখনো না! দেখার ইচ্ছে নেই! ওইসব রংঢং করে তাকে ইমপ্রেস করতে পারবে না! ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। রুমে ঢুকল নিশু। মাথা ঘুরে উঠে আবারও বমি করল। হসপিটালে কিছু খেতে পারে না সে বদহজম হয়। আর ফিনাইলের গন্ধ তার ভীষণ বাজে লাগে। এখন মাথা ঘুরে উঠে যা খেয়েছে সব বের হয়ে আসছে। খাবার শেষ করে উঠলো ধূসর। পা বাড়াল নিশুর রুমের দিকে।
“নিশু তোর বমি কমেছে?”
“না।”
“এই ঔষধগুলো খেয়ে নে।”
“আচ্ছা।”
মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিতেই ধরে ফেললো ধূসর। নিজের রুমের দিকে যেতেই দেখল নিশু-ধূসর খুব কাছে। নিশুকে ধরে রেখেছে ধূসর। ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিলো ধ্রুব। সে ঢের বুঝতে পারলো নিশুর সঙ্গে তার ভাইয়ের অন্তরঙ্গতা রয়েছে। লা’থি মা’রলো একটা ফুলদানিতে। মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। ভড়কে উঠলো নিশু।
“কী হয়েছে তোর বলতো?”
ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেল নিশু।
“শরীর খারাপ লাগছে!”
নিশুর বোধহয় হাই প্রেসার উঠেছে। টেনশন নিতে পারে না মেয়েটা। সামান্যতেই খুব বড়সড় রিয়েক্ট করে ফেলে।
“টেনশন করিস না নিশু। শান্ত থাক! কিচ্ছু হবে না। কেউ তোর প্রিয় মানুষটাকে কেঁড়ে নিতে পারবে না। বিয়ে আর পবিত্র সম্পর্কের শক্তি অনেক।”
দূর্বল এবং ছলছল নয়নে তাকায় নিশু।
___
চলবে~