মায়াকুমারী পর্ব-১৫

0
129

#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(১৫)
___________________

কোচিং সেন্টারের পাশের একটি কফিশপে বসলো নিশু-দ্যুতি,বুশরা। হঠাৎ শপের সামনে ব্রেক কষলো অনিক। ভিতরে ঢুকে আচমকা দ্যুতির হাত টেনে নিয়ে যেতেই চেঁচিয়ে উঠলো,”কী করছেন হাত ছাড়ুন!”

“বিয়ে করবো চলো।”

“কী বললেন?”

“বিয়ে করবো।”

“ছেড়ে দিন আমাকে। আমার আব্বু মা’রবে। ছেড়ে দিন।”

“ভাইয়া কী করছো?”

“বিয়ে করবো ধুতিরে।”

“ছাড়ো ওকে,পাগলামি করো না।”

তবুও টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো। ভয় পেয়ে এবার হাউমাউ করে সত্যি কেঁদে উঠলো দ্যুতি। ছেড়ে দিলো অনিক।

“বিয়ে করবে না?”

“বখাটে কোথাকার!”

হঠাৎ ধূসর এলো। ওদের একসঙ্গে দেখতেই মেজাজ খারাপ হলো।

“আমার বোনের সাথে কী?”

“তুই শালা এখানে কী করিস?”

“খুব বেড়েছিস!”

“আমারও একই কথা!”

একজন আরেকজনের দিকে এগিয়ে যেতেই ওরা দু’জন ছুটে এসে আঁটকালো।

“ভাইয়া তুমি কী শুরু করলে?”

“শালাটার জন্য প্রেম করা যায় না।”

“আজেবাজে কথা কম বলো চলো বলছি!”

অনিকের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বুশরা। ক্রোধ সংবরণ করলো ধূসর। দেখল দ্যুতির চোখ ভেজা। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে ব্যস্ত।

“ও তোকে কী করেছে?”

“কিছু না।”

নীরব হয়ে সব দেখল নিশু। দ্যুতিকে কিছু বলতে নিতেই হঠাৎ ইন্সপেক্টর আবির ঢুকল শপে। চমকে থেমে যায় ধূসর। বিব্রতবোধ করলো সে। সেদিন তাকে হাজতে ঢুকিয়েছে তাই আবিরকে অপছন্দ তার।

“মি.ধূসর না?”

“জ্বী!”

“কী করছেন আপনারা?”

“ওদের নিতে এলাম।”

চোখ পড়লো নিশুর দিকে। নিশু এদিকে তাকিয়ে রয়েছে। হৃদয়টা দুলে উঠলো আবিরের। ব্যপারটা লক্ষ্য করলো ধূসর। আবিরের চাহনি ভালো লাগলো না তার। বুঝতে পারলো ঘটনা কী!

“আপনি এখানে?”

“একটা কাজে এলাম।”

“ও। আচ্ছা আমরা আজ আসি।”

“চলে যাচ্ছেন কেন আসুন কফি পান করি।”

“না সময় নেই।”

“আরে একটু!”

মেজাজ খারাপ হলো ধূসরের। কী চায় এই ইন্সপেক্টর আবির? নিশুর মুখোমুখি চেয়ারে বসলো আবির। মুগ্ধ নয়নে তাকালো। নিশুর কিউট এক্সপ্রেশন,আর যেন ওর চোখগুলো কথা বলে,ঠোঁট কথা বলে। নিঃসন্দেহে মেয়েটার কিউট লুক প্রশংসার দাবিদার! কানে-গলায় ঠিক তারার মতো ঝলমলে জারকন পাথর খচিত হুপ ডিজাইনের দুল এবং লকেট। যা নিশুকে স্টার-লুক দিচ্ছে! নাকে জ্বলজ্বল করছে পাঁচ স্টোনের ছোট্ট একটি ডায়মন্ড নোজ পিন। ঝলমল করায় নোজ পিনটায় এত্ত গর্জিয়াস লাগছে নিশুকে। সবমিলিয়ে অসম্ভব দারুণ লাগছে! চোখে চোখ রেখে বলতে ইচ্ছে করলো,”তোমার দু-চোখের সৌন্দর্যের বর্ণনা করতে গেলে পুরো একটা উপন্যাস লেখা সম্ভব সুস্নিগ্ধা! আর খোলা চুলে তোমাকে দেখতে অসাধারণ লাগছে!”

“হায় প্রিটি গার্ল কী খবর?”

অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করলো নিশু। ধূসরের দিকে একপলক তাকালো।

“ভালো।”

“দিনকাল কেমন যাচ্ছে?”

“তেমন একটা ভালো না।”

“কেন?”

“একটু আগে মা’রামারি হতো!”

“মানে কার সাথে?”

“সেদিনের ওই ছেলেটা।”

“এখানে এসেছিল?”

“হুম।”

ব্যপারটা ভালো লাগছে না ধূসরের। পুরাতন পাগলের ভাত নেই নতুন পাগলের আমদানি! মৃদু হাসলো ইনস্পেক্টর আবির। নিশু তাকায়। আবিরকে দেখলেই তার ঝাপসা স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে লুটোপুটি খায়। ধ্রুবর মুখটা ভেসে উঠে অস্পষ্ট হয়ে। নিশু তাকিয়েই রইলো।

“কী দেখেন?”

“আপনাকে।”

আবির ভাবলো নিশু তাকে পছন্দ করেছে তদ্রূপ ধূসরও তাই ভাবলো। শরীর টানটান করে বসলো আবির। বিষাক্ত লাগছে ধূসরের। কফি স্ন্যাকস অর্ডার করলো আবির।

“আপনার নামটা যেন কী?”

“মনে নেই।”

“সেদিন বলেছিলেন বলবেন।”

কিছুক্ষণ ভাবলো নিশু।

“ধুতরাফুল!”

চমকে তাকায় আবির।

“ধুতরাফুল মানুষের নাম হয়?”

“হ্যাঁ।”

“এমন বিষাক্ত ফুলের নাম রেখেছে কে?”

ধূসরকে দেখাল। বিষম খেয়ে কাশতে লাগলো ধূসর। মেয়েটা সত্যি একটা গাধা! সিক্রেট নামটা দিলো পাবলিক করে। তার দিকে তাকায় আবির ও দ্যুতি।

“নিশু তুই কী বলছিস?”

“কালরাতে আমাকে ডেকেছিল।”

“কখন?”

“রাতে নুডলস বানানোর সময়।”

সন্দিহান হলো আবির। কী চলছে দু’জনের মধ্যে?কেন জানি ভালো লাগলো না।

“আচ্ছা আজ আমরা উঠি। লাঞ্চ করে নিশুর মেডিসিন নিতে হবে।”

উঠে গেল ওরা। ভাইয়ের দিকে তাকায় দ্যুতি। মানে কী এইসবের? নিশুকে ধুতরাফুল বলে ডাকে অথচ সে জানে না!
___

লাঞ্চ করতে বসে চেঁচামেচি করলেন আসাদ সাহেব।

“ওই ছেলে একটা ফ্রড! একটা পাগল!”

নীরব রইলো দ্যুতি।

“কোথায় কী বলতে হয় জানে না। একটা সিরিয়াস মুহূর্তকেও ওই ছেলে জগাখিচুরি বানিয়ে ছাড়ে! যত্তসব ফাউল!”

“আপনি ওকে ডাকলেন কেন আব্বা?”

“মানে মানে আমার মেয়ের পিছু ছাড়তে বলেছি উল্টো আমাকে থ্রেট দেখিয়ে গেল।”

এখন ব্যপারটা বুঝতে পারলো দ্যুতি কেন অনিক এমন করেছে!

“দ্যুতির জন্য পাত্র দেখ।”

“এখন কীসের বিয়ে?”

“অঘটন হতে কতক্ষণ! তার চেয়ে বিয়ে দিয়ে দিবো।”

“কী লাভ সে-ই নিশুর পিছনে পড়বে।”

কথাটা মন্দ বলেনি ধূসর। ওই ঘাড়ত্যাঁড়া ছেলে তো দু’জনকেই বিয়ে করতে চায়।

“নিশুর জন্যও পাত্র দেখ। বিয়ে দিয়ে দিবো।”

চমকে তাকায় ধূসর।

“আব্বা,নিশুতো অসুস্থ। ওকে বিয়ে করবে কে?”

“পাত্রের অভাব আছে নাকি!”

ব্যপারটা কেমন লাগলো ধূসরের। খেয়েদেয়ে ছাঁদে চলে গেল ওরা দু’জন। দ্যুতির মন ভালো নেই। অনিক সবখানেই ফাজলামো করে যেটা খুবই বিশ্রী। লোকটা কি একটুও সিরিয়াস হতে পারে না নিজের জন্য? কান্না পায় দ্যুতির। তারা অনেকগুলো পায়রা পুষে। সেগুলোকে খাবার দিচ্ছে নিশু। এখানে নিশুর চারটি বিলাতি পায়রা রয়েছে। ধবধবে সাদা দুটোর নাম সুয়াচন্দন আর সুন্দরী। আর একটু ধূসর রঙের দুটোর নাম গিরিবাজ আর ডিগবাজি। এমন নাম রাখার কারণ ওরা শূন্য আকাশে ডিগবাজি দিতে পারে। ওদের ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে কার্নিশের উপর বসে আদর করতে লাগলো নিশু। অশ্রুসিক্ত নয়নে সেদিকে তাকিয়ে রইলো দ্যুতি। হঠাৎ ফোন করলো অনিক। পিক করলো না দ্যুতি। প্রায় নয়-দশবার দেওয়ার পর এবার জিদ করে পিক করলো।

“কী সমস্যা আপনার? কী চাইছেন কী? বিরক্ত করছেন কেন?”

“রেগে গেলে কেন ধুতি?”

“চুপ একদম চুপ! বদলোক একটা! সবখানেই গাধার মতো কাজকারবার।”

“শুনলাম বাসায় তোমাকে গাধী বলে ডাকে আর আমি গাধীর জামাই গাধা। তাই গাধার মতো কাজ করি।”

“ননসেন্স!”

“ধুতি একটা আইডিয়া দাও তো!”

“কীসের আইডিয়া?”

“তোমার আব্বা বলছে পড়াশোনা করে কোটিপতি হতে!”

“কখন বলছে?”

“যখন ইচ্ছে তখন।”

“এখন কী?”

“ভাবতাছি পড়াশোনা শুরু করবো।”

“তো করুন না নিষেধ করেছে কেউ?”

“বাই দ্যা ওয়ে,একচুয়ালি ইনটার শেস একন কি আনারস স্যরি অনারস করব নাকি ডিগরি করব নাকি মাছটাছ করব নাকি বিয়ে-শাদি করব অভিগদের পরামসশো চাই! মানে তোমার পরামসশো চাই! একটু পরামসশো দাও ধুতি!”

“পাগল!”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো দ্যুতি। মেজাজ খারাপ হলো অনিকের। সোজা বাবার কাছে গেল।

“আব্বা আমি একজনকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করতে চাই! এখুনি এই মুহূর্তে!”

ছেলের দিকে তাকান তিনি।

“তা ওই মেয়ে কি তোমাকে ভালোবাসে?”

“হ্যাঁ খুব!”

“যেই মেয়ের রুচি এত বাজে তাকে কখনো আমার বাড়ির পুত্রবধূ বানাব না।”

“কী বললেন?”

“রুচির কথা বলছি।”

“আ’ম সিরিয়াস আব্বা।”

“কত টাকা স্যাল্যারির জব করছো?”

“আপনার কী কম টাকা?”

“আমার টাকাপয়সা আমার বউ-বাচ্চার জন্য। তোমার স্ত্রীর জন্য তোমার কী আছে?”

“এত কথা বুঝি না,আমি ধুতিরে পছন্দ করি। ধুতির সাথে বিয়ে না দিলে আমি কারো সাথে বিয়ে করবো না।”

“তোমার ইচ্ছে।”

“আমি পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চাই।”

“সেটা আগে বললেই পারতে। কোথায় পড়বে?”

“বিদেশে।”

“আরো আগে বলোনি কেন?”

“এখন বলছি শুনতে পান না?”

“ঠিক আছে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। প্রিপারেশন নাও।”

“ধুতিরে আমি বিয়ে করবো। ধুতির কিছু হইলে সব পুঁড়ে ধ্বংস করে দিব।”
__

“ও আচ্ছা! তা এজন্যই বুঝি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলে?”

“মানে!”

তাচ্ছিল্য হাসলো নিশু।

“অ্যানি মেয়েটার সঙ্গে তো দেখছি ভালোই মুহূর্ত উপভোগ করছো!”

“না বুঝে কম কথা বলিস!”

“তাতো চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছি! অ্যানির উপস্থিতি তোমার অনেক ভালো লাগে আর আমাকে লাগে বিষাক্ত!”

“কী বলতে চাস?”

“স্টাডির নামে তুমি আমাকে ঠকাচ্ছ! তুমি পরকীয়া করছো! তুমি তোমার পরিবারকেও ঠকাচ্ছ! তুমি একটা সেলফিস!”

“মিথ্যে কথা!”

ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিশু।

“আমি প্রার্থনা করি তুমি যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ পাও; আর অভিশাপ দিই তুমি যেন সারাজীবন আমার শূন্যতা ফিল করে অভাব ও ফিল করো!”

চমকিত নয়নে তাকায় ধ্রুব।

“আমাকে রাতজাগা শিখিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। মনে রেখো ঠিক এইভাবে একসময় আমার মতো তোমায়ও রাত জাগতে হবে! শত-সহস্র রাত!”

“আমি না বরং তুই আমাকে রাতজাগা শিখিয়েছিস!”

“তুমি অ্যানির জন্য রাত জাগো! ওকে তোমার ভালো লাগে কারণ ও ভীষণ সুন্দরী তাই!”

“বাজে বকা বন্ধ কর!”

“ও শুনতে খারাপ লাগছে তাই না?”

“অপবাদ দিচ্ছিস!”

“তাই বুঝি শরীর জ্বলছে!”

“চুপ কর!”

খোলা চুলে হলুদ শাড়ি পরনে ঝুনঝুন আওয়াজ তুলে পা বাড়ালো নিশু।

“এই শোন!”

পায়ের গতিরোধ করলো তবে পিছু ফিরলো না নিশু।

“থাকো না তোমার অ্যানিকে নিয়ে! আমি তোমার কে!”

অভিমানী কণ্ঠ নিশুর। খারাপ লাগলো ধ্রুবর।

“চুপ করবি?”

“আমাকে আর কী বলার আছে তোমার?”

“তুই না একটু বেশিই বুঝিস!”

“তোমরা সব পুরুষ এক! সৌন্দর্যের পূজারী!”

“সবাই এক নয়।”

কয়েক কদম পা বাড়িয়ে হঠাৎ থামলো।

“শোনো,নারীর জিদ সম্পর্কে তোমাদের মতো পুরুষদের কোনো ধারণাই নেই! তোমরা জানো না নারীর জিদ কী জিনিস আর ঠিক কতটা ভয়ংকর! নারীরা অহংকারী কিংবা রহস্যময়ী নয় তবে অবহেলা পেতে পেতে তারা পাথর হয়ে যায়। আঘাত করলে রিয়াকশন দেয় না,তাদের কিছু যায়-আসে না তখন তাদেরকে দেখে এই ভ্রম হয় সবার। সে যাইহোক,পুনর্জন্মে আমি বিশ্বাসী নই! তবে পুনর্জন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে আমি তোমায় হাজারবার অভিশাপ দিচ্ছি,তুমি আমি হয়ে জন্মাও। তোমায় ভালোবেসে বোকা হয়ে যাওয়া,তোমার ভালোবাসার জন্য দিশেহারা হওয়া মানুষটা হয়ে জন্মাও। সে জন্মে তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাও আপন মানুষের কাছের মানুষ হতে না পারাটা ঠিক কতটা যন্ত্রণার! কতটা কষ্টের! কতটা দুঃখের! তুমি টের পাও কয়েক’শ কথার প্রশ্নে যখন কোনো প্রতিত্তোর আসে না তখন দেখতে কী বিচ্ছিরি লাগে! অসহায় লাগে! শূন্য শূন্য লাগে! দমবন্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়! অন্তঃসারশূন্য হয়ে শুকিয়ে যায়! সে জন্মে যেন তুমি বুঝতে পারো অপেক্ষা করতে হয় কীভাবে! অবহেলার স্বাদ ঠিক কেমন আর কতটা প্রখর ভয়ানক যন্ত্রণার! ছোটখাটো দুঃখগুলোকেও কেমন ভয়ানক মনে হয়! কারো শান্ত্বনা দেওয়ার বুক হতে চেয়ে কারো বিরক্তি হতে কেমন লাগে তুমিও জানো খুব করে! যদি পুনর্জন্ম বলে কিছু থাকে,তুমি আমি হয়ে জন্মে টের পাও ভালোবাসা একটা বোকা ফিলিংস যা ভেতরটা গুঁড়িয়ে নিঃস্ব করে দেয়। কারো কাছের মানুষ আপন মানুষ না হতে পারে,কারো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ডাঙায় তোলা চিতল মাছের মতো তড়পাতে কেমন লাগে তুমিও যেন খুব করে টের পাও। তোমাকে অভিশাপ দিলাম তুমিও আমার মতো ভালোবেসে চাঁদের মতো ক্ষয়ে যাও,ম’রে যাও ভেতরে ভেতরে যেমন গুমরে গুমরে প্রতিনিয়ত ম’রে যাচ্ছি আমি। কারো কাঁধে মাথা রেখে তুমিও কাঁদো এই আক্ষেপে যে,ও আমায় কেন ভালোবাসেনি?কেন আমায় ভালোবাসেনি?কেন?কেন?”

“তুই আমায় অভিশাপ দিলি?”

“হ্যাঁ!”

“তুই না আমাকে ভালোবাসিস!”

“হ্যাঁ!”

“ভালোবাসার মানুষকে কীভাবে অভিশাপ দেয়!”

“আমি দিয়েছি! আরো দিব! হাজার কোটি সহস্রবার দিব! আমি চাই তুমি কষ্ট পাও! খুউব কষ্ট! অনেক কষ্ট! কঠিন কষ্ট! আমাকে অবহেলা করার কষ্ট! আমাকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেওয়ার কষ্ট!”

“এতে তোর কী লাভ?”

“আমি পৈচাশিক আনন্দ পাবো।”

নুপুরের ঝংকার তুলে ফের পা বাড়ালো নিশু। সেদিকে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। ঘেমে-নেয়ে একাকার! চোখ বুজে বসে রইলো ধ্রুব। প্রতিদিনই এমনটা হচ্ছে! ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। নিশুর অভিশাপ নাকি! এই প্রথম নিশুকে ভীষণ মিস করছে! কেন জানি নিশুর সঙ্গ পেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে! কান গরম হয়ে গেল ধ্রুবর। সত্যি নিশুর সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করছে তার। কেমন জানি লাগছে! ফিল করছে! বেশ রাত হয়েছে অর্থাৎ গভীর রাত। ঝেঁকে ঠান্ডা পড়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো ধ্রুব। একটি ক্যানভাসে পেপার রেডি করে রংতুলি নিয়ে বসলো। কেন জানি ড্রয়িং করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে তার। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে ড্রয়িং করতে লাগলো। ছিপছিপে গড়নের শ্যামবর্ণের মিষ্টি দেখতে এক তরুণী ক্রিম কালারের শাড়ি পরে বাগানে ঘাসের উপর শুয়ে রয়েছে,তার মাথার লম্বা লম্বা কার্লি করা চুলগুলো খোলা এবং পিঠের নিচে ছড়ানো। ঠোঁটে গাঢ় পিংক কালারের লিপস্টিক,হাতে একটি লাল চুড়ি,শ্যামবর্ণের এক হাত দিয়ে তার এক চোখসহ মুখখানি ঢেকে রেখেছে। আর ডাগর ডাগর একটা চোখ দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। সেই এক চোখে দুনিয়ার অজস্র মায়া। পুরো পেইন্টিংটা করতে বেশ সময় লাগলো। সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে একপলক তাকালো। ভারী মিষ্টি দেখাল পেইন্টিংটা। ঠিক আজ থেকে আট-নয় বছর পূর্বে নিশুকে দেখেছিল। এরপর আর দেখা হয়নি বাস্তবে। তবে প্রায় ছয় বছর আগে দেখেছিল পিকচার। সেখানে কেমন রুগ্ন দেখাচ্ছিল বলে মেজাজ খারাপ হয়। সব পুরুষেরই তো স্বপ্ন তার বউ অনেক সুন্দর হবে। প্রতিটি নারী-পুরুষের মনের অভ্যন্তরে আলাদা একটা কল্পনার জগৎ থাকে। আর সেই জগতে তারা সবাই রাজকুমার-রাজকুমারী। তাই তারা জীবনসঙ্গী হিসেবেও ওমন কাউকে ডিজার্ভ করে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরপর থেকে বাস্তবে,কল্পনায় এবং স্বপ্নেও নিশুর মুখটা দেখতে পায় না ধ্রুব। শুধু পিছনের অংশটুকু দেখেই তার হৃদয় আলোড়িত হয়ে গিয়েছে। মায়াবী দৃষ্টিতে তাকালো ধ্রুব। পেইন্টিং-এর নিচে পেঁচিয়ে লিখলো,”মায়াকুমারী!”

তারপর দেয়ালে পেরেক আঁটকে ঝুলিয়ে দিলো।

“তোর অনেক দুঃসাহস! এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যে আমার হাতে পেইন্টিং করে ছাড়লি! শোন,আমি সৌন্দর্যের পূজারী নয় আজ থেকে এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল! তুই দেখতে যেমনি হোস না কেন আমি তোকে ভালোবেসে তোর সাথেই সংসার করবো ওকে! আর তুই আমাকে মানসিক শান্তি দিবি। পুরুষ মানসিক শান্তি পেলে সৌন্দর্য খুঁজে না! যদি খুঁজতো তাহলে প্রিন্সেস ডায়না,রাজকুমারী শেখ মাহরা কিংবা বিশ্ব সুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাই এরা কেউ ঠকতো না! এদেরকেই এদের স্বামীরা পূজা করতো!”

ছটফট করতে লাগলো ধ্রুব। ঠিক তখুনি আযান হতেই লাফিয়ে উঠলো। নিভু নিভু চোখে তাকালো আশেপাশে। ওহ! তারমানে এতক্ষণ সবই স্বপ্ন ছিল! তারমানে ঘুমের মধ্যেই সে সবকিছু করেছে। সে-তো পেইন্টিং করতে জানে না অথচ নিশুর জন্য স্বপ্নে পেইন্টিং করলো! ভীষণ বিরক্ত হলো ধ্রুব। এই মেয়েটা তাকে এত জ্বালাচ্ছে কেন আর নিতে পারছে না! ফোনটা হাতে নিলো। একবার ফোন করবে কি মাকে?দোনোমোনো করে তবুও ফোন করলো। ঠিক সেই সময় মাগরিবের নামাজ পড়ে চা পান করছিলেন দিলরুবা খাতুন। ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই মৃদু হেসে পিক করলেন। ব্যপার কী ছেলে ইদানীং ঘনঘন ফোন করছে! এই তো প্রায় দেশে থাকাকালীন কখনো ফোন করেনি। এই নিয়ে তিনবার করেছে। পিক করতেই সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”আম্মা কেমন আছেন কী করেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। চা পান করি। তা তুমি কী করো বাবা?”

“ঘুম থেকে উঠলাম সকাল হয়েছে।”

“খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করো তো?”

“হুম।”

“পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“ভালো।”

নিশুর কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো কিন্তু আড়ষ্ট হলো।

“আচ্ছা রাখি।”

দুম করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো। হতভম্ব হলেন দিলরুবা খাতুন। ছেলেটা এমন কেমন? নিশুর থেকে ধ্রুবর ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে সত্যিই তাকে ভালোবাসে নাকি ঘৃণা করে? ধ্রুবর কেন জানি মনে হলো নিশু তাকে ঘৃণা করে তাই তো সংসার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বারবার। কিন্তু ইদানীং সে স্বপ্নে যা দেখছে তাতে মনে হচ্ছে নিশু তাকে ভালোবাসে! আর নিশু কি সত্যিই তাকে অভিশাপ দেয়?কেন দেয় এতে তার কী দোষ? তিন কবুল বলে বিয়ে হয়েছে প্রেম তো হয়নি! ধ্রুবর মাঝেমধ্যে মনে হয় এই সম্পর্কটা তার মতো নিশুরও গলার কাঁটা! হতে পারে সংসার করার জন্য তাকে যেভাবে প্রেসার ক্রিয়েট করা হয় নিশ্চয়ই নিশুকেও করা হয়! আর এইজন্যই তো সে সেদিন বাসর করেনি। আর ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে অবশ্য ভুল কিছু করেনি! রেডি হয়ে জিমে গেল। সেখান থেকে এসে গোসল সেরে ব্রেকফাস্ট করে ভার্সিটির জন্য রেডি হলো। ভার্সিটিতে পৌঁছাতেই গাড়ি থেকে নামতেই আকস্মিক মুখোমুখি হলো অ্যানির। গুরুত্ব না দিয়ে দ্রুত ক্লাসরুমের দিকে হাঁটা ধরলো। একটা মেয়ে ঠিক কতটা সস্তা তা অ্যানিকে না দেখলে বুঝতে পারতো না। ক্লাসরুমে ঢুকতেই কিছুক্ষণ পর ম্যাম এলেন এবং ক্লাস নিতে শুরু করলেন।
______

চলবে~