#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(২৪/ক)
❌[সাওম পালন অবস্থায় পর্বটি পড়া থেকে বিরত থাকুন।]
___________________
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে! দমকা এবং শীতল বাতাস বইছে! বিজলি চমকাচ্ছে! খানিকক্ষণ ঝড়ো-হাওয়া বইলো হুহু করে। কয়েকটা টব পড়ে ভেঙে গেল। বৃষ্টির পানিতে মাটিগুলো ধুয়ে নিচে চলে যাচ্ছে চিকন পাইপ বেয়ে। শীতলতায় ওম পেয়ে পালক ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে বোধহয় নিশুর প্রিয় পায়রাগুলো। কিন্তু সুয়াচন্দনের এখনও ঘুম পায়নি বোধহয় একটু চেপে গেল সুন্দরীর দিকে। নিভু নিভু চোখে একপলক তাকিয়ে পুলকিত হলো সুন্দরী! রঙিন কাগজের মতো বাগানবিলাসগুলো বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু! আহা! ওমন দৃশ্য দেখলে নিশ্চয়ই নিশুর ভীষণ মনখারাপ হতো! মেয়েটার যে আবার এইসবে কত্ত মায়া! প্রকৃতি স্পর্শ করতে খুবই পছন্দ করে। টানাটানা দু-চোখে যে তার কত্ত রাজ্যের মায়া! সবকিছুতেই মায়া খু্ঁজে বেড়ায় মেয়েটা! তাই তো প্রকৃতি খুব গোপনে তার একটি নাম দিয়েছে,মায়াকুমারী! যাকে প্রকৃতি ভালোবাসে তাকে তো সবাই ভালোবাসবে! বৃষ্টিসিক্ত কাঠগোলাপ,হাসনাহেনা আর বেলিফুলগুলো সুগন্ধি ছড়িয়েছে! সুগন্ধি ছড়াতে থেমে নেই লেবুফুলগুলোও। লেবুফুলের সুগন্ধির কাছে সকল ফুলের সুগন্ধি নস্যি মনে হলো! সেই সবে একটুও মনখারাপ হয়নি বুনো গোলাপগুলোর। মনের সুখে বৃষ্টিস্নান করছে তারা! ছাঁদের এক কোণ জুড়ে থাকা হুরহুরে ফুলগুলোর থোকা বৃষ্টির ভারে নুয়ে পড়েছে!
ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো ধূসর। সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা সুখটান দিয়ে ধোঁয়াগুলো ওড়িয়ে দিলো শূন্য নীলাম্বরীর বুকে। অবশ্য সিগারেট সে পান করে না তবে কেন জানি আজ না করে পারলো না! নিশুকে নিয়ে রুমে ঢুকতে দেখেছিল ধ্রুবকে। তারমানে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়নি! যদি হতো তাহলে কি ওমন কাজ ধ্রুব করতো! নিশুকে অসচেতন দেখালেও তাকে তো স্বাভাবিক দেখলো। এমন তো নয় যে জোরজবরদস্তি করা হয়েছিল। কৌতুহলী হয়ে ধ্রুবই বরং ওদের পিছু নিয়েছিল এটা সম্পর্কে সে অবগত! নিশুর কথা আর কী বলবে সে-তো এমনিতেই আধমরা রোগী! কাউকে দেখলেই মৃগীরোগীর ন্যায় ওর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ সে স্বাভাবিক থাকতে পারে না। সে যাইহোক,তবে ধ্রুবর ব্যপারটি ঠিক বুঝতে পারলো না। সুদীর্ঘ সাড়ে এগারোটি বছর তো দেখেই এসেছিল নিশুকে করা তার অবহেলা-অপমান। অবহেলা বললেও ভুল। সে নিশুর নামটা পর্যন্ত শুনতে পারতো না! মানে এতোটাই ঘৃণা করতো! যাকে বলে চরম ঘৃণা! হঠাৎই এতো চেঞ্জ ঠিক বুঝতে পারলো না। তাহলে ডিভোর্সের নাটকটা কেন সাজালো! এর মূলে কে রয়েছে তার বাবা নাকি! হৃদপিণ্ডটা এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে সূঁচালো সুইয়ের ক্ষতবিক্ষত আঘাতে। তাকে ধ্বংস করার আর কোনো অস্ত্র ছিল না বুঝি! নিশুকে সেই দশ বছর বয়স থেকে সে আগলে রেখেছিল অতীব সযত্নে। না তখন ভালোবাসা কী সে বুঝতোই না। বুঝার মতো মন এবং বয়সও হয়নি। বড় ভাই হিসেবে আদর,যত্ন,স্নেহ,মায়া-মমতা আর ভালোবাসা এবং শাসন সব করেছিল। তারপর যখন থেকে বুঝতে শিখেছিল নিশুকে তার ভাই সহ্য করতে পারে না তখন থেকেই কেন জানি আগ্রহ তৈরি হয়। হৃদ মাঝারে তৈরি হয় নিশুর জন্য সফ্ট কর্ণার। আর সেই আগ্রহ একসময় প্রকট হয়ে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয় নিশুর মায়ায় পড়ে। বাবা-মা বেঁচে থাকলেও সে এতিম-অসহায়। খুব মায়া হতো! দশ বছর বয়সে যখন মাইল্ড স্ট্রোক করে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় হসপিটালের বেডে পড়ে রয়েছিল অসহায় অনাহুতের ন্যায় তখন থেকেই মেয়েটার জন্য তার অজস্র মায়া। সে ডিভোর্সের সুযোগ নিয়ে নিশুকে কখনো ইমপ্রেস করার চেষ্টা করেনি। হাজার-কোটি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাজেভাবে স্পর্শ করেনি। তার স্পর্শগুলো ছিল ভাইদের মতোই কোমল,নমনীয়! আর যেটা তার দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে পড়েছিল সে সেটাই করেছিল তাদের জন্য। পৃথিবীর আর কেউ না জানুক সে-তো জানে নিশু তাকে ভাইয়ের চোখে দেখে। ইমপ্রেস কিংবা তাদের মধ্যে বিয়ের মতো কিছু হলে নিশু যে এতো দিন তাকে সম্মানের চোখে দেখতো সেটা নষ্ট হতো! আর নিশু তাকে ঘৃণার চোখে দেখতো! নিশুর ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব! তখন সু’ইসাইড করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তবে সে সুযোগের সদব্যবহার কখনো করেনি। তার ভাইয়ের নামেও নিশুর কানে বিষ ঢালেনি,নেগেটিভি ছড়ায়নি! তবে চাইলে অসম্ভব কিছু ছিল না। বরং সবসময়ই চেষ্টা করেছিল,জেলাশফিল করিয়েছিল তারা যেন এক হয়। নিশু যেন তার স্বামী ভালোবাসার মানুষটাকে পায়! আর সে তকদিরে বিশ্বাসী। সৃষ্টিকর্তা চাইলে মুখের সামনে আসা খাবারের থালাটা কেঁড়ে নিতে পারেন আবার অন্যের থালা এনে তার মুখের সামনেও ধরতে পারেন। সে যাইহোক,নিশুর জন্য সে বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করেনি। যেখানে তার ভাই তাকে ইগনোর করে নিজের ফিউচার গুছাতে গিয়েছিল। আর সেখানে সে নিশুর জন্য নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিলো। বারবার তার বাবা-মা বলেছিল বিদেশে গিয়ে স্টাডি কমপ্লিট করে সেটেল্ড হতে কিন্তু সে করেনি। সে গেলে কতজন ওদের দু’জনকে ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলতো! আবার এদিকে আবিরও ছিল। কম ঝামেলা কিন্তু পোহায়নি নিশুকে নিয়ে। তবে অনিকের জন্য কিছুটা সম্ভব হয়েছিল আবিরকে ঢাকা থেকে সুকৌশলে চট্টগ্রামে ট্রান্সফার করায়। নয়তো কী যে হতো! অন্যদিকে ডিভোর্স সংক্রান্ত ফের মানসিক আঘাত পেয়ে মেমোরিলস হয়ে সে-কি বিভৎস অবস্থা! নিশুকে দেশ-বিদেশে নিয়ে ডক্টর দেখানো,নিয়ম করে তিন বেলা থেরাপি,কাউন্সিলিং ইত্যাদি এইসব করতে কিন্তু একদিন সময় লাগেনি। বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। সৃষ্টিকর্তার পরে এতে কিন্তু ডক্টরের অবদান বললে ভুল হবে। তার অবদানও কিন্তু কম ছিল না।।সে-তো নিশু-দ্যুতির আরেক আহ্লাদ-আবদারের ভাই! মেয়েটা তার মাকে একপলক দেখার আকাঙ্ক্ষায়,আক্ষেপে রয়েছে তৃষ্ণার্ত চাতকীর ন্যায়। হাজার চেষ্টা করলেও তার মায়ের সন্ধান পেতে সে অক্ষম ছিল। সে যাইহোক,বলা যায় ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও ওদের জন্যই সে বিদেশে পড়াশোনার ইচ্ছেটা কবর দিয়েছিল। আর একটা কথা আছে,ভালোবাসলে তৃতীয়জনকে অবশ্যই কষ্ট পেতে হয়। অবশ্যই সে তৃতীয় ব্যক্তি! নিশু কি তাকে বলেছিল ভালোবাসতে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেটটা পায়ের তলায় পিষে রুমে ঢুকলো। ল্যাম্প জ্বালিয়ে রিডিং টেবিলের চেয়ারে বসলো। আনমনা হয়ে ডায়েরি খুললো। সেখানে নয়নতারার মতো গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো-“তাকে পেলে বোধহয় কদর করতে পারতাম না! থাক না কিছু জিনিস অধরা!”
__
দু’জনের হৃদয় ভূমিতে উত্তাল পাতাল ঝড় বইছে! বেডের উপর শুইয়ে দিলো নিশুকে। কয়েক কদম এগিয়ে ডোর অফ এবং লাইট অন করে ফের পা বাড়ালো বিছানার দিকে। অশীতিপর বৃদ্ধার ন্যায় ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে নিশু! দাঁতে দাঁত লেগে আসছে! মনেই হয় না আদোও এই জগতে বিচরণ করছে সে। মোহগ্রস্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। চোখ বুজে রয়েছে নিশু। ঠোঁটগুলো রক্তিম হয়ে রয়েছে। তাতে বৃষ্টির ফোঁটা! তার সম্পূর্ণ মুখশ্রী দেখতেই মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষে কোষে শুধু একটি কথাই সার্কেলের ন্যায় ঘুরপাক করছে,মায়াকুমারী! অজস্র অজস্র মায়া তার মুখে আর টানাটানা দুচোখে। চোখ বুজতেই মোমবাতির ন্যায় দপ করে মস্তিষ্ক নড়েচড়ে উঠলো! ন্যায়-অন্যায়,পাপ-অনাচার সবকিছুর কথা বেমালুম ভুলে নিশুকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্রভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই এক ঝটকায় কাছে টেনে এনে আবারও ঠোঁট দুটো পুরে নিলো। বেপরোয়া হয়ে উঠলো ধ্রুব। পাগলের মতো ধ্রুবকে আঁকড়ে ধরলো নিশুও। আগ্রাসী নখের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে লাগলো পুরো পৃষ্ঠদেশ জুড়ে। ধক করে বুকে লেগে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলো মুডিবয় ধ্রুব। তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় এতো তৃষ্ণার্ত ছিল নিশু যা এখন খুব করে উপলব্ধি করছে! আবারও ঝড় বয়ে গেল দুটি তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে। একপশলা বৃষ্টির প্রতিক্ষায় চাতকী হয়ে গেল দু’জন। নিশু একটু ন্যুব্জ হয়ে যেন শরীরের ভারসাম্য ছেড়ে দিলো। হয়তো সুখের ভেলায় ভাসতে প্রস্তুত সে। আর তারই ইঙ্গিত এটা। দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেল ওরা একে-অপরের সান্নিধ্যে আর সংস্পর্শে। ক্রমশ স্পর্শগুলো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগলো। মৃদু মৃদু আর্তনাদ করে শিউরে শিউরে উঠছে নিশু। ঝুম বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার গতিবেগও যেন ক্রমশ বাড়লো। সৃষ্টিকর্তার পরে প্রকৃতি ও কি চায় আজ তাদের মিলন হোক শুভমিলন! তাহলে না হয় সব মান-অভিমান ভুলে তাই হোক! হয়ে যাক না হয় একটা ভুল! ক্ষতি কি তাতে! ধ্রুবর শরীর থেকে টি-শার্ট খুলে ফেললো নিশু। একে একে তার শরীর থেকে গয়নাগুলো খুলে ভেজা শাড়ি খুলে নিলো ধ্রুব। দু’জনের রেসপন্স এবং পারফরম্যান্স খুবই দারুণ লাগলো! চরম পর্যায়ে যেতেই খানিক ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে হুট করে হুঁশ হলো নিশুর। আকস্মিক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ধ্রুবকে। যার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। নিশুকে পাওয়ার নেশায় তখন মস্তিষ্ক টগবগ করছে ফুটন্ত পানির ন্যায়। অর্থাৎ এই মুহূর্তে যত যাইহোক নিশুকে তার চা-ই! গভীরভাবে চাই-ই চাই! চোখে-মুখে এবং মস্তিষ্কে তখন অন্য এক প্রবল নেশা! চট করে শোয়া থেকে উঠে শরীরে কাপড় জড়িয়ে নিলো নিশু। ভীষণ রাগ হয় ধ্রুবর। ফুটন্ত পানির ন্যায় টগবগ করতে লাগলো মস্তিষ্ক। রণচণ্ডী রূপ ধারণ করলো নিশু। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
“তোমার সাহস কী করে হলো আমাকে ছোঁয়ার?”
অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো ধ্রুব। তার মাথায় এখন ভালোমন্দ কিছু কাজ করছে না! আপাতত মস্তিষ্কের জ্ঞানগর্ভ শূন্যের কোঠায়! এমন ঘোর মুহূর্তে ওমন কথা তার কাছে নিছকই মূল্যহীন!
“লজ্জা করে না?এই লজ্জা করে না তোমার?কোন সাহসে আমাকে স্পর্শ করেছো জবাব দাও? কী ভেবেছো আমাকে?”
শক্ত চোখে তাকালো ধ্রুব।
“তোমাকে আমি ঘৃণা করি! ঘৃণা! ভেবেছো কী? চাইলেই আমাকে অবহেলা করবে আবার ইচ্ছে হলেই ভোগ বস্তু বানাবে এতোই সহজ?এতোই সস্তা?”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
“তোমাকে আমি ঘৃণা করি! এখন আর আমি আগের সেই আলাভোলা নিশু নই! মোমের মতো নরম থেকে পাথরের মতো শক্ত হওয়ার জার্নিটা এতোটাই সহজ ছিল না আমার! তুমি না আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো তাহলে কোন মুখে আবার আমাকে ভোগ করতে এলে? তুমিও কি তবে চরিত্রহীন পুরুষদের কাতারে পড়লে?”
হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো ধ্রুব। দপদপ করছে মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরা!
“লজ্জা করে না তোমার?কোন মুখে আমাকে স্পর্শ করেছো?”
“তোর উপর অধিকার আছে তাই।”
“অধিকার! কীসের অধিকার? কীসের অধিকার তোমার? কীসের অধিকারের কথা বলছো? তুমি কি আমাকে লাইসেন্স করা দাসি পেয়েছো?”
“মুখ সামলে কথা বল!”
“আজ তুমি আমার মুখ বন্ধ রাখতে পারবে না। বলো কোন অধিকারে তুমি আমাকে স্পর্শ করছো? বলো?এখন আমার নিজেকে ঘৃণা লাগছে! মনে হচ্ছে আমি একটা নোংরা আবর্জনায় পরিণত হয়েছি একটু আগে তোমার ছোঁয়ায়! ছিঃ!”
“আমাকে তুই ঘৃণা করতে পারিস কিন্তু অস্বীকার করতে পারবি না। আমার উপস্থিতিকে তুই অপছন্দ করতে পারিস কিন্তু আমাকে তুই এড়িয়ে যেতে পারবি না। কারণ আমি তোর স্বামী!”
চমকে তাকায় নিশু।
“তোমাকে আমি স্বামী হিসেবে মানি না। ঘৃণা করি ঘৃণা! প্রচুর ঘৃণা করি!”
“এমন বিহেভিয়ার কেন করছিস?”
“তো কেমন করবো তোমাকে চুমাবো?”
“হ্যাঁ করলি তো পাগলের মতো!”
লজ্জায়,অস্বস্তিতে এবং রাগে কাঁপতে লাগলো নিশু। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত মুখশ্রীতে। ধ্রুবর ঘাড় এবং কপালের শিরাগুলো কেমন ফুলে নীল হয়ে গিয়েছে। অতিরিক্ত রাগে চোখগুলোর শিরা লাল হয়ে উঠেছে! ভড়কায় নিশু। ধ্রুবকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে! মনে হচ্ছে নেশা করেছে!
“তুমি করতে বাধ্য করেছো?”
“তোরও ইচ্ছে ছিল।”
দাঁতে দাঁত চাপলো নিশু।
“এক হাতে তালি বাজে না।”
“সব দোষ তোমার।”
“তোকে সব ক্লিয়ার করে দিয়েছিলাম। তারপরেও এমন বিহেভিয়ার করার মানে কী?”
“ক্লিয়ার! কী ক্লিয়ার করলে?”
“তুই কি আমার দেওয়া খামটি পাসনি?”
“ও! ডিভোর্স লেটারে সাইন করে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে?”
“পেয়েছিস কি না সেটা বল?”
“পেয়েছি! ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি!”
আচমকা চোয়াল চেপে ধরলো।
“ছিঁড়লি কেন?”
“আমার ইচ্ছে হয়েছে।”
“তোকে পুঁতে ফেলা উচিৎ!”
“ফেলো বাঁচিয়ে রেখেছো কেন? কম অবহেলা করে তো আমাকে আর জীবিত রাখোনি! আমি তো তোমার জন্য মৃতই!”
হঠাৎই অভিমানী হয় নিশু। এতক্ষণ শক্ত থাকলেও এবার ইমোশনাল হয়ে পড়লো। রাগে-দুঃখে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো প্রবল ঝর্ণাধারায় ন্যায়। গলা ছেড়ে ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টা করলো ধ্রুব।
“যা হয়েছে এনাফ!”
“কীসের এনাফ! কোনো এনাফ নেই! আঘাত তো তুমি করেছো তাই মনে নেই কিন্তু কষ্ট তো আমি পেয়েছি তাই ভুলিনি! তোমাকে আমিই ক্ষমা করবো না।”
“বরং তোকে আমি ক্ষমা করবো না। তোর জন্য আমার শৈশব-কৈশোর দুই-ই নষ্ট হয়েছে! ফ্যামিলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি আমি। কিন্তু তোর মা-বাবা না থেকেও তুই সব পেয়েছিস,আমার ফ্যামিলির সঙ্গে মহানন্দে কাটাতে পেরেছি যা পাওয়ার কথা কেবল আমার! তোর জন্য আমার স্বাধীনতা নষ্ট হয়েছে! সব তোর জন্য! তুই ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য! এরপরেও যে তোকে গ্রহণ করার ইচ্ছে পোষণ করেছি এটাই তো আকাশচুম্বী! কিন্তু এবারও আমার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। আরো একবার ভুল করলাম! সামনাসামনি বলতে না পেরে তোকে চিঠি লিখলাম সেটা না দেখেই ছিঁড়ে ফেললি! সে যাইহোক,তোর তো অন্তত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝা উচিত ছিল আমার অনেক কিছু বলার বাকি! তা না করে তুই তোর মতো এটিটিউড নিয়ে চলেছিস! সস্তা তো তুই আমাকে ভেবেছিস! কারণ আমি বোকা!”
চমকিত নয়নে তাকিয়ে রইলো নিশু।
“এনিওয়ে,যা হয়েছে এনাফ,ফিউচারের কথা চিন্তা কর।”
“কী বলতে চাও?”
“কম্প্রোমাইজ!”
“কখনো না!”
শক্ত চোখে তাকায় ধ্রুব।
“তুমি এখন আমার প্রাক্তন! আর প্রাক্তনকে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না,কারণ একটা চ্যাপ্টার আমি একবারই পড়তে ভালোবাসি। তাতেই যা বোঝার বুঝে নেওয়া যায়। আর এটিটিউড আমি না তুমি দেখিয়েছো কারণ তুমি আমার মুখ দেখতে চাওনি!”
“প্রলুব্ধ করছিস আমাকে!”
বিছানা থেকে নামতেই ধরে ফেললো।
“চল তোকে স্ত্রীর মর্যাদা দিই।”
“ছাড়ো আমাকে! ছাড়ো বলছি!”
কাছে টেনে আনতেই চেঁচিয়ে উঠলো।
“ছাড়ো! ছাড়ো বলছি! এতো সহজেই তুমি আমাকে পাচ্ছ না! সাড়ে এগারো বছরের জন্য গুনে গুনে সাড়ে এগারো হাজারবার সরি বলবে!”
“ভিক্টিম আমি তুই না! বরং তুই আমাকে বলবি। তোর উচিত কান ধরে উঠ-বস করে আমাকে সরি বলা।”
দাঁতে দাঁত চাপলো নিশু। আরেকটু কাছে টেনে আনলো।
“আয়!”
“ছাড়ো! ছাড়ো!”
“এমন রূপে প্রলুব্ধ করেছিস আমাকে। এখন আমাকে সামলানোর দায়িত্ব তোর!”
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো নিশু।
_____
চলবে~
#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(২৪/খ)
___________________
হ্যাঁচকা টান দিয়ে কাছে টেনে আনতেই চেঁচিয়ে উঠলো নিশু।
“ছোঁবে না আমাকে ছোঁবে না! ছাড়ো!”
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো নিশু।
“সিংহ থেকে বিড়াল হয়ে গেলে তাই না?কোথায় তোমার অ্যাটিটিউড?”
অবশ্য হ্যাঁ রাজা-বাদশাও কিন্তু এই একটা মুহূর্তে মাথা নোয়ায় স্ত্রী হোক কিংবা দাসীর কাছে। তদ্রূপ মুডিবয় ধ্রুবরও হলো তাই! পিঠ খামছে ধরতেই চোয়াল শক্ত করলো ধ্রুব।
“কোনো যোগাযোগ নেই,কথাবার্তা নেই সাড়ে এগারো বছর পর এসেই এখন শয্যাসঙ্গী হওয়ার জন্য এপ্রোচ করছো ভাবলে কী করে আমিও ঢ্যাং ঢ্যাং করে শুয়ে-বসে যাবো সস্তা ভেবেছো আমাকে?”
নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো নিশু।
“তোমার কোনো রাইট নেই আমাকে ছোঁয়ার!”
“কষ্ট কিন্তু আমিও কম পাইনি। আর তোরটা ছিল ন্যাকামি।”
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো নিশু। আচমকা বুকের মধ্যে একের পর এক কামড় দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললো। ব্যথা পেলেও নীরব রইলো ধ্রুব। ওই অবস্থায় বেরিয়ে গেল নিশু। ঢুকলো নিজেদের রুমে। শাড়ি বদলে দ্যুতি সবে বিছানায় শুয়ে পড়তেই নিশুকে দেখতেই চমকায়।
“কীরে তুই বাসর করিসনি? ওয়েদারটা কিন্তু দারুণ! চলে এলি কেন পাগলি?”
প্রতিত্তোর না করে ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করে দাঁড়িয়ে রইলো। মস্তিষ্ক টগবগ করছে ফুটন্ত পানির ন্যায়। নিশু যেতেই আচমকা ফুলদানিগুলো ছুঁড়ে ফেললো ফ্লোরে। মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। শব্দটি বোধহয় ধূসরের কানেও পৌঁছালো। চমকে উঠলো সে। ঠিক আছে তো নিশু! টেনশন হলো। ধ্রুব নিশুকে মা’রছে না তো! মস্তিষ্ক টগবগ করছে ধ্রুবর। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করে দাঁড়িয়ে রইলো। একজন এখানে তো আরেকজন ওখানে। পানির ফোঁটা পড়তেই জ্বলে উঠলো শরীর। কয়টা কামড় দিয়েছে ঠিক নেই! মনে হচ্ছে নিশু তার মাংস কামড়ে নিয়ে গিয়েছে। সাংঘাতিক জিদ পুষে রেখেছিল মেয়েটা যেভাবে এগ্রেসিভ হয়েছিল। চোখগুলো কেমন লাল হয়ে গেল। কোনো মেয়েকে পাত্তা না দেওয়া সে কি-না একটু সুখের জন্য নিশুর কাছে আত্মসমর্পণ করলো! তাকে পাওয়ার জন্য কত মেয়ে পাগল! অ্যানি,নীলির পরেও সাড়ে তিন বছরে অসংখ্য মেয়ের প্রপোজাল পেয়েছে সে। বাঙালি থেকে শুরু করে নানান দেশের। কিন্তু সে নিশুর জন্য নিজেকে সংযত রেখেছিল। চাইলে কতশত মেয়ের সঙ্গে ডেট করতে পারতো! কিন্তু নিশুকে ঠকানো হবে বলে সে সেইসব মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি। অ্যানির রূপের কাছে নিশুর রূপ নস্যি! তবুও সে অ্যানিকে গুরুত্ব দেয়নি বরং কুকুরের মতো দূর দূর করে তাঁড়িয়ে দিয়েছে! নীলিও কি কম সুন্দরী? যথেষ্ট সুন্দরী বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে! সেই মেয়েকেও পর্যন্ত গুরুত্ব দিলো না। বরং অপমান-অপদস্ত করেছিল প্রতিনিয়ত। নীলি তার দ্বিতীয় বউ হতেও রাজি! অপশন তো তার কাছে কম ছিল না তাহলে নিশু কেন এমনটা করলো?এখন সে যদি সুখের তাড়নায় অন্য নারীর কাছে যায় তখন তো আবার সহ্য হবে না কারো! সে যাইহোক,সাড়ে এগারো বছরে সে-কি খুব সুখে ছিল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে? তার বাসায় আসা কঠোরভাবে নিষেধ ছিল। নিষেধ করেছিল তার বাবা। সেখান থেকেই আরো অভিমান প্রকট হয়। এরপর আসলো বাসায়। সপ্তাহ না পেরুতেই আবারও বিয়ে পড়ালো তার কোনো মতামত নিলো না। তার সারা জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্তে তাকে প্রায়োরিটি দেওয়া হলো না। ধরে বেঁধে বিয়ে দিলো সংসার করতে! প্রতিটি ছেলেরই ইচ্ছে নিজে দেখেশুনে বিয়ে করার সেখানে তার স্বাধীনতা হরণ করা হলো তাও সে কম্প্রোমাইজ করলো। তার দাদী-ফুপি কম বিষ ঢালেনি নিশুর নামে সে-সবের তোয়াক্কাও করেনি সে। সবসময় ফ্যামিলিকে প্রায়োরিটি দিয়েছিল। সেদিন নিশুর সাথে ইন্টিমেন্ট হলেই হবে তার দায়িত্ব নেওয়া লাগবে না? ২৩ বছর বয়স খুব একটা বেশি নয়। তখনও সে ছিল ইমম্যাচিওর। ২৩ বছর হলেই যে সে ম্যাচিওর হয়ে যাবে এমন তো কথা নয়! মানুষ ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ম্যাচিওর হয়! নিশুর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বিদেশ গিয়ে তার স্কিল বাড়ানো,স্টাবলিশ হওয়া এগুলোর আরো বেশি প্রয়োজন ছিল। নিশুকে চিঠি দিয়েছিল পড়েনি উল্টো ভুল বুঝেছিল। যখন সে বেকার ছিল,তার ইচ্ছে ছিল না তখন সবাই জোর করলো,এখন সে যখন নিজেকে স্টাবলিশ করলো নিশুর সান্নিধ্য চাইলো উল্টো তাকে ভুল বুঝে ইনসাল্ট করলো।
__
শাওয়ার নিয়ে বাথরোব পরে বেরিয়ে এলো নিশু। চুলের পানি নিলো না। বিছানায় বসতেই দ্যুতি তাকালো। নিশুর চোখ-মুখ লাল এবং ফোলা ফোলা।
“কী হয়েছে নিশু?”
“আমি তাকে রিজেক্ট করেছি।”
“কেন?”
“সাড়ে এগারো বছর পর এসে কোনো কথাবার্তা,আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছাড়াই সেই আমার সাথে ইন্টিমেন্ট হতে চায় এটা কেমন কথা?”
“তো কী হয়েছে?সে তোর স্বামী তার আদেশ মানতে তুই বাধ্য! একশো বার বাধ্য। ইসলাম ধর্মেও এটা বলা হয়েছিল।”
“কীসের স্বামী সে আমার?সে না আমায় ডিভোর্স দিয়েছিল?”
“তোকে বলেছে?”
“সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য খাম পাঠালো।”
“খুলে দেখেছিস?”
“দেখব না। ডিভোর্স তো হয়ে গিয়েছে আর কী! এখন কেন সে বাসর করতে চায়! আমি যখন তার জন্য ওয়েট করেছিলাম সাড়ে তিন বছর আগে তখন কেন এলো না?”
“এত জিদ দেখালে তো হবে না। আর হয়তো তখন আনইজি ফিল করেছিল কিংবা সময় চেয়েছিল অথবা তোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সময় চেয়েছিল। আর সেদিন বাসর করতে চাইলে নিষেধ করতে নাকি তুই স্বইচ্ছায় দিতি! তাহলে আজ এমনটা কেন করলি? স্বামীর অবাধ্য হওয়াটা কি তোর ঠিক হয়েছে?তোকে এইসব শিক্ষা দিয়েছে আমার বাবা-মা? আব্বু-আম্মু তোর এই বেয়াদবীর কথা জানলে মনঃক্ষুণ্ন হবে।”
“তোর ভাই আমাকে সস্তা ভাবলো তাই না? সাড়ে এগারো বছর পর এসে বললেই আমি আত্মসম্মানহীন মেয়েদের মতো শুয়ে-বসে যাবো! আমার কোনো আত্মসম্মান নেই?”
“স্বামীর কাছে কীসের আত্মসম্মান?তোদের দু’জনেরই অহংকার। কেউ কাউকে বুঝতে চায় না। কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। যে যার যার মতো অ্যাটিটিউড নিয়ে আছিস! একজন আগুন হলে একজনকে পানি হতে হয়। ও পুরুষ মানুষ ওর তো মেজাজ চড়া থাকবেই তুইও যদি এমন করিস কেমনে কী! মনে রাখিস,পুরুষ মানুষ কষ্ট পেলে নষ্ট হয়ে যায়। আর সেটা যদি হয় শখের নারী থেকে।”
“তুই বলতে চাচ্ছিস আমি তার আহ্বানে সাড়া দিতাম?”
“একশো বার দিবি। সে দেশ-বিদেশে ছিল তার কাছে অপশন কিন্তু কম ছিল না। নিজ থেকে তোর কাছে এসেছিল এর মানে বিশেষ কিছু ছিল।”
“তাহলে ডিভোর্স?”
“সেটা আমরা কেউই ক্লিয়ার নয়। সেটা আব্বু আর ভাইয়া জানে। তবে তোকে যেহেতু গভীরভাবে চেয়েছে এর মানে ডিভোর্স হয়নি! মুসলিম ধর্মে ডিভোর্স সেন্সিটিভ ব্যপার। একবার ডিভোর্স হলে দ্বিতীয়বার জোড়া দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আমার ভাই মূর্খ না যে সে ভুল কিছু করবে তাও আবার তোর সাথে!”
উল্টোমুখ করে শুয়ে রইলো দ্যুতি। সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো নিশু। সে ভুল না ঠিক বুঝতে পারছে না! কিন্তু জিদ সামলাতে পারেনি! ঠিকই তো কোনো যোগাযোগ কিংবা কথাবার্তা ছাড়াই সে কেন ইনভলভ হতে চাইবে! আর ডিভোর্স যদি না হয় তাহলে সেই খামে কী ছিল? ইমোশনাল হয়ে পড়লো নিশু। অপ্রত্যাশিত ভাবে মানুষটাকে কাছে পেতেই হঠাৎ কেমন রিয়েক্ট করবে বুঝে উঠতে পারলো না। অর্থাৎ সবটাই ছিল আনএক্সপেক্টেড! অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করলো নিশু। পাশ ফিরলো দ্যুতি।
“নিশু কী হয়েছে তোর?”
“শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে!”
ঘাবড়ে গেল দ্যুতি। উঠে বসলো।
“কেন?”
“জানি না! কেমন জানি লাগছে!”
“শান্ত হো! মাথা ঠান্ডা কর! দেখ কিচ্ছু হয়নি!”
তবুও নিশু শান্ত হলো না। হঠাৎ পেয়ে আবার হারিয়ে ফেললো জিনিসটা কেমন জানি নিতে পারছে না! নিশুর একবার মনে হচ্ছে ঠিক হয়েছে আবার মনে হচ্ছে ঠিক হয়নি! দোষারোপ করতে লাগলো নিজেকে। নিশু নার্ভাসফিল করছে এই না প্যানিক অ্যাটাক হয়!
“যা হয়েছে এখন টেনশন করে কী হবে! সকালে সরি বলে নিস।”
কিন্তু শান্ত হলো না নিশু। সে যে আচরণ করেছে মনে হচ্ছে ধ্রুব এবার তাকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই শ্বাস আঁটকে এলো। কিন্তু সে-তো ধ্রুবকে ভালোবাসে,মায়া করে! সাড়ে এগারো বছরের মায়া সে কীভাবে কাটাবে?
“দ্যুতি আমি কি ভুল করেছি?”
নীরব রইলো দ্যুতি। সে-তো সেখানে ছিল না কী বলবে এখন। এতক্ষণ এইসব বলার মানে নিশু যাতে পুনরায় বেয়াদবী করার সাহস না পায়! এইরকম জেদ করতে থাকলে আজীবন দ্বন্দ্ব লেগেই থাকবে! কীভাবে ঠিক হবে তাদের দাম্পত্য জীবন? তার বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। নিশুকে নিয়ে অনেক টেনশন করেন দু’জন। প্রতিক্ষায় রয়েছেন কবে তাদের মিলন দেখবে,কবে সুন্দর একটা সংসার দেখবে! নাতিপুতির আশায় রয়েছেন বয়স্ক দু’জন মানুষ। তার বাবা-মায়ের নাতিপুতির সঙ্গে মজা করার বয়স এখন। এদের এক করতে না পারলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার মায়ের অনেক আগ্রহ নিশু এই বাড়ির বউ হয়ে থাক!
“গিল্টিফিল হচ্ছে?”
“জানি না।”
“তাহলে ভাইয়ার কাছে যা সরি বল। একজন সরি বললেই দেখবি তোদের সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে। ইগো ধরে রেখে কী লাভ সেই কষ্ট তুই পাস আমরা তো আর পাই না! একটু ছোট হয়েও যদি তোরা তোদের সম্পর্ক ঠিক করতে পারিস আমার মতে অন্যায়ের কিছু না। ভালোবাসিস তো তাকে। ভালোবাসার মানুষের কাছে আত্মসম্মান দেখাতে নেই যদি মানুষটা সঠিক হয়।”
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো নিশু। ঠিক কী করা উচিত বুঝতে পারছে না! নিশুর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ঘাবড়ে গেল দ্যুতি। এই না আবার ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বসে। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেল নিশু। সামান্য একটা ব্যপার মেয়েটা ইজিভাবে নিতে পারে না। বাবা-মা ঘুমাচ্ছে ডাকলে টেনশনে অসুস্থ হয়ে পড়বে। ধ্রুবর মেজাজ ঠিক নেই বোধহয়। এমন অপমানের পর কীভাবে ঠিক থাকবে! একটু আগে কিছু ভাঙার শব্দ টের পেয়েছে। বুঝতে পারছে কিয়ামত হচ্ছে সেই ঘরে। উঠে ধূসরের রুমের দিকে পা বাড়ালো। নক করতেই সঙ্গে সঙ্গে খুললো। যেন প্রস্তুতই ছিল।
“ভাইয়া একটু আসবে?”
“নিশু ঠিক আছে?”
ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায়। কত উদ্বিগ্নতা!
“ভাইয়া নিশু অস্বাভাবিক আচরণ করছে! একটু আসো।”
একপ্রকার ছুটে এলো। রুমে ঢুকতেই দেখলো সত্যিই নিশু আবোলতাবোল বকছে! ঘাবড়ে গেল ধূসর। দ্রুত এগিয়ে গেল। চিবুক তুলে ধরলো।
“নিশু কী হয়েছে? ঠিক আছিস।”
বসা অবস্থায় আচমকা দু’হাতে জড়িয়ে ধরতেই বুক কেঁপে উঠলো।
“ভাইয়া,আমি ওকে রিজেক্ট করেছি! আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল আগের কথাগুলো ভেবে। তাই নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি।”
“এটার জন্য টেনশনের কী আছে! নরমাল ব্যপার। হি ডিজার্ভ দিস।”
ডুকরে কাঁদে নিশু।
“পেয়েও হারিয়ে ফেললাম!”
“মোটেও না সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হবে না।”
“খারাপ লাগলে ভাইয়ার কাছে যা। সরি বলে মিটমাট করে নে।”
“না যাব না।”
মাথায় হাত রাখলো। অকপটে নিশুর কম্ফোর্টজোন ধূসর। যার সঙ্গে সে সব শেয়ার করতে পারে। ধূসর একটা খোলা বই তাদের জন্য।
“দ্যুতি ওর মেডিসিনগুলো দে।”
বক্সটা এগিয়ে দিলো। মেডিসিন নিয়ে খাইয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর নিশু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে ঘুমিয়ে পড়তেই ঠিক করে শুইয়ে দিলো। গায়ে নকশীকাঁথা টেনে দিলো।
“জাগানোর প্রয়োজন নেই। যতক্ষণ ঘুমায় ঘুমাক বুঝলি?”
“হুম।”
“আব্বা-আম্মাকে বলিস না।”
একপলক তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ধূসর। কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না! পৃথিবীর নিয়মটা বড়ই অদ্ভুত! যখন মেয়ে মেনে নেয় তখন ছেলে নেয় না। যখন ছেলে মেনে নেয় তখন মেয়ে নেয় না। যখন দু’জনেই মেনে নেয় তখন পরিবার মানে না। যখন সবাই মেনে নেয় তখন সৃষ্টিকর্তা বোধহয় মেনে নেয় না। যেকোনো একজনকে নিয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ালো।
______
চলবে~