মায়াকুমারী পর্ব-৩৫/ক

0
115

#মায়াকুমারী ❤️
#মেহেরিন_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(৩৫/ক)
___________________

বেরিয়ে গেল ধূসর। গাল হাত দিয়ে অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে রইলো নিশু। ধূসর তার গায়ে হাত তুলেছে! তাও এই নিয়ে দু’বার! অভিমানে ঝরঝরিয়ে চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কীভাবে পারলো তার গায়ে হাত তুলতে? অবশ্য বাড়াবাড়িটা তো সেই করেছে! তার উচিৎ হয়নি ব্যক্তিত্বহীনের মতো কারো পারসোনাল ডায়েরি ঘাঁটা আর সেটা কৌতুহল থেকেও না। নিজের ডায়েরি কেউ ঘাঁটলে যেমনটা জঘন্য লাগবে তদ্রূপ প্রতিটি মানুষেরও এমন। প্রতিটি মানুষেরই ব্যক্তিগত কিছু গোপন অনুভূতি থাকে; কেউ সেটা মনের ডায়েরিতে জমা করে রাখে আর কেউ কাগজের ডায়েরিতে। কাগজের ডায়েরিতে যারা রাখে তারা ভীষণ বোকা! নিশু জানে সে কাজটা একদম ঠিক করেনি। শুধু তাই নয় সে ডায়েরি ঘেঁটেছে,পড়েছে এবং ধূসরের অনুভূতিগুলোকে সম্মান না করে সে আবার প্রতিত্তোরও লিখেছিল। মেজাজ খারাপ হওয়ার তো কথাই! থমকে রইলো নিশু। আসলেই কৌতুহল থেকে হুট করে কী করে ফেললো বুঝে উঠতে পারলো না। লেখাগুলো দেখে কেন জানি নিজেকে সামলাতে পারলো না। তবে তার উচিৎ ছিল ধূসরের গোপন অনুভূতিগুলোকে সম্মান প্রদর্শন করে নীরবে সরে আসা। না সে প্রাউডফিল করছে না বরং কষ্ট হচ্ছে ধূসর তাকে একতরফা ভালোবেসে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। আর তাই তো ওমন দুঃসাহস করা যাতে তার প্রতি ঘৃণা জন্মে! এবার যদি সে একটু সফল হয় আর বুশরার সঙ্গে ধূসর সেটেল্ড হয়। তবে অনুতপ্ত হলো এবং সতর্কও হলো নিশু। ধূসরের সঙ্গে এতদিন ফ্রী মাইন্ডে মিশলেও এখন থেকে সে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখবে। তার প্রতি কীভাবে ঘৃণা আনা যায় এখন থেকে সেগুলোই করবে! বড় ভাই হিসেবে সে ধূসরকে সম্মান করে। ভাই-বন্ধু ভেবে কম্ফোর্ট জোন ভাবতো; এতে ধূসর আরও উইক হতো তার প্রতি। তাই এখন থেকে এমনটা আর করা যাবে না। হঠাৎ কিছু ভাঙ্গার শব্দ শুনতেই চমকে উঠলো। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। ধূসর কি ঝামেলা করবে এই ব্যপারটি নিয়ে! তাহলে তো বিরাট সমস্যা দেখা দিবে। আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো বুকের ভেতর। ভেজা ঢোক গিললো। শ্বাস আঁটকে রইলো। চোখ খোলার চেষ্টা করলো দ্যুতি। কী হচ্ছে এইসব বুঝতে পারছে না! তার চোখে এখনও রাজ্যের ঘুম।

“তোকে বকলো কেন নিশু?”

নীরব রইলো সে। চোখ বুজে রইলো দ্যুতি। সকাল সকাল এমন ঘটনা দেখে ঘুম ভাঙ্গলো আল্লাহ জানে দিনটা আজ কীভাবে শুরু হবে! ছট করে মস্তিষ্ক স্ক্যান করে উঠতেই ভেসে উঠলো অনিকের রক্তাক্ত মুখটা! আর্তনাদ করে উঠলো দ্যুতি। নাক টানলো নিশু। সকাল সকাল এমন কাণ্ড ঘটাবে ভাবতে পারেনি। চোখের জল মুছে দ্যুতির দিকে এগিয়ে গেল।

“কী হয়েছে?”

“নিশু! অনিক কেমন আছে খবর পেয়েছিস?”

“না।”

অস্থির হলো দ্যুতি।

“আমার ফোন কই?”

“মেজ ভাইয়ার কাছে।”

“নিয়ে আয় প্লিজ।”

“একটু আগে বকেছে!”

ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেল। শ্বাস আঁটকে আসছে,মাথা ঘুরে কেমন বমি এলো। চোখ বুজে শুয়ে রইলো ধ্রুব। নিশু কেন এলো আর কেনই বা চলে গেল ওভাবে বুঝতে পারলো না। নীলি যে কেন এমন করছে সেটাও বোধগম্য হচ্ছে না। ব্লক দিলে আবারও আইডি ওপেন করে। নিস্তার পাচ্ছে না নীলির থেকে। ভাঙ্গচুরের শব্দ শুনতেই চমকায়। আচমকা তার রুমে ঢুকলো ধূসর। ফের চমকায়। সোজা তার মুখের সামনে এসে দাঁড়ালো। ফণা তোলা সাপের মতো কেমন শক্ত মুখাভঙ্গি। উঠে বসলো ধ্রুব। চোখ-মুখ কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। থমকায় ধ্রুব।

“কী হয়েছে?”

“নিশুর সঙ্গে তুমি সংসার করবে?”

“কেন?”

“উত্তর দাও!”

নীরব রইলো ধ্রুব।

“নিশুকে ডিভোর্স দিয়েছো নাকি দিবে বিষয়টি ক্লিয়ার করো?”

“তোর এত কৌতুহল কেন?”

“প্রয়োজন আছে।”

“যখন সময় হবে তখন সবাই জানবে।”

“তোমার এই সব ভণ্ডামি অন্য কোথাও গিয়ে দেখাও!”

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।

“কী বললি?”

“বিষয়টি দ্রুত ক্লিয়ার করো। মুক্তি দাও নিশুকে না হয় সংসার করো। ভণ্ডামিপনা অন্তত করো না সহ্য হচ্ছে না! টলারেট করতে পারছি না!”

বেরিয়ে গেল ধূসর। শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। তাদের ডিভোর্সের খবর দিয়ে ওর কী কাজ? কী করতে চায় ধূসর? নীলির ব্যপারে নিশু কিছু বলেছে বোধহয় তাই ধূসর হয়তো রেগে গিয়েছে। নিশু তাকে অহেতুক ভুল বুঝলো! সে নীলিকে সহ্য করতে পারে না। রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করতেই যেন পুরো ভবন কেঁপে কেঁপে উঠলো। বাড়িতে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না উনারা স্বামী-স্ত্রী। সেই কখন থেকে বসে রয়েছেন ডাইনিংয়ে। চিন্তাগ্রস্ত দেখালো দু’জনকে। কী যে হচ্ছে বাড়িতে! রাগে-জিদে ফণা তোলা সাপের মতো ফুঁসতে লাগলো ধূসর। কত বড় দুঃসাহস মেয়েটার! কীভাবে পারলো ওই লেখাটুকু লিখতে! আমি ধ্রুব ভাইয়ার হতে চাই! তার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই! এ দুনিয়ায় না হয় সে সবর করলো,সেই দুনিয়ায় চাইলো তাতেও বাঁধা! সিগারেট ধরালো।

“ছিঃ! তুমি সিগারেট খাও ভাইয়া!”

চমকিত নয়নে পিছু ফিরলো কিন্তু কেউ নেই। কে বলেছে কথাটা কিন্তু দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ! ধূসর বুঝতে পারলো তার মস্তিষ্ক ঝট পাকিয়েছে! নিশু তার মাথাটা নষ্ট করে ছেড়েছে! লম্বা করে সুখটান দিয়ে ধোঁয়াগুলো ওড়িয়ে দিলো আকাশের দিকে। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার মধ্যে যেন নিশুর অশ্রুসিক্ত মুখখানি ভেসে উঠলো।

“হ্যাঁ খাই তোর জন্য খাই! তুই শিখিয়েছিস আমাকে। এখন শান্তি?”

কড়াঘাত পড়লো ডোরে। বিরক্ত হয় ধূসর। সিগারেটটা পায়ের তলায় পিষে দরজা খুললো।

“ভাইয়া আমার ফোন কই?”

ফোন বের করে হাতে দিলো। পা চালিয়ে রুমে ঢুকলো দ্যুতি। ফোন অন করলো। বিছানার এক কোণে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো নিশু। একপলক তাকায় দ্যুতি।

“কাঁদছিস কেন?”

নীরব রইলো নিশু। ফোন অন করতেই বুশরার শত শত কল,মেসেজের নোটিফিকেশন ভর্তি হলো। শুকনো ঢোক গিললো দ্যুতি। হুট করে বুশরার কল এলো। কম্পিত হাতে পিক করতেই ভেসে উঠলো বুশরার অশ্রুসিক্ত ফোলা ফোলা সফেদ মুখখানি! আতঙ্কিত হয় দ্যুতি।

“আমার ভাইকে কী করেছিস দ্যুতি?”

টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

“বল কী করেছিস? আমার ভাই মৃত্যুর মুখে!”

শ্বাস আঁটকে রইলো।

“বল কী করেছিস?”

কিছু বলতে পারলো না। কীভাবে বলবে আমি তাকে আঘাত করেছি! দ্যুতির মতো কেয়ারফুলি একটা মেয়ে আউল ফাউল বেফাঁস কথাবার্তা বলা,বাউণ্ডুলে এক ছেলেকে কখন কীভাবে হৃদয় দিয়ে বসলো জানে না!

“আমার ভাই বাঁচবে না বোধহয় দ্যুতি!”

কেমন অসহায় কণ্ঠ বুশরার।

“ভোর রাতে প্রচুর রক্তবমি করেছিল। থাইল্যান্ডে নিয়ে গেল। এখন খুশি হয়েছিস তুই?তোকে আর বিরক্ত করবে না!”

বিস্ফোরিত চোখে তাকায় দ্যুতি। রক্তবমি তো ভালো লক্ষ্মণ নয়! অনিক কি তাহলে মরে যাবে! ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে চিৎকার দিয়ে উঠলো।

“না!”

ঠাস করে ফোনটা পড়ে স্ক্রীন ভেঙে গেল।

“আমি বিশ্বাস করি না! মরতে পারে না!”

দ্যুতির চিৎকারে ঘাবড়ে গেল নিশু। ছুটে এলো। জড়িয়ে ধরলো। অঝোরে কাঁদতে লাগলো নিশুও। অনিক তার শুভাকাঙ্ক্ষী! কখনো তার ক্ষতি করেনি। কখনো বাজে স্পর্শ করেনি। মাঝেমধ্যে দ্যুতিকে জেলাশফিল করানোর জন্য তার সঙ্গে এমনটা করতো! সবার সঙ্গে আউল ফাউল বেফাঁস কথাবার্তা বললেও তাকে যথেষ্ট সম্মান করতো! তার বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে কখনো দ্বিধাবোধ করেনি বরং তার অসুস্থতার সময় খুব যত্ন নিয়েছিল। সেদিন তাকে রক্ষা না করলে আজ তার ঠিকানা হতো নিষিদ্ধ কোনো পল্লীতে। হাজার হাজার পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতো সে। অনিকের উছিলায় আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছেন,ইজ্জত বাঁচিয়েছেন। কথাগুলো ভাবতেই শরীরটা কেমন শিউরে উঠলো। বুক ফেটে যাচ্ছে! ডুকরে শব্দ করে কেঁদে ফেললো নিশু। যেন কিছু হারিয়ে ফেলেছে। এমন কান্না সে সাড়ে তিন বছর আগে ধ্রুবর জন্য কেঁদেছিল।

“এই আমি কী করে ফেললাম নিশু! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি অনিককে আঘাত করেছি!”

দ্যুতি কেমন করে কাঁদে। দ্যুতির ওমন বুকভাঙা কাতর কান্নায় নিশুরও ভীষণ কান্না পায়। নিশুর ওমন কান্নায় দ্যুতির কান্না পায়। দু’জনকে দু’জন জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো। ওদের কান্না শুনতেই বাসার সবাই ছুটে এলো। আঁতকে উঠে দিলরুবা খাতুন বললেন,”কী হয়েছে তোদের?”

কী বলবে,কিছু বলতে পারলো না ওরা। মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো দ্যুতি।

“আম্মু গো! আমি খুব জঘন্য কাজ করে ফেলেছি!”

থমকান তিনি।

“কীসের জঘন্য কাজ?”

“বলতে পারবো না। বললেও বিশ্বাস হবে না তোমাদের।”

গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন আসাদ সাহেব। বুঝে উঠতে পারলেন না কিছু। সকালে ধ্রুবকে এই রুম থেকে বেরুতে দেখেছেন। আর কাল তো সব ঠিক ছিল। কী প্রতিক্রিয়া করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না!

“আমি মা’র্ডার করেছি আম্মু!”

বুকের ভেতর মোচড় দিলো।

“কী বলছিস?”

“আম্মু! আম্মু গো! ও আম্মু,আমি এখন কী করবো?”

বাকরুদ্ধ হলেন তিনি। আগামাথা তো কিছুই বুঝতে পারছেন না। ধ্রুব এলো।

“দ্যুতি কী হয়েছে?”

তীরের বেগে ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

“ভাইয়া! ও ভাইয়া,অনিক ঠিক নেই। ওকে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়েছে। ওর অবস্থা ভালো নয়! আমার খুব ভয় হচ্ছে ভাইয়া!”

হতভম্ব হলেন উনারা। বাবা-মাকে ইশারা দিলো বেরিয়ে যেতে। নির্লিপ্তে বেরিয়ে গেলেন উনারা।

“আমি এখন কী করবো? আমিও কি নিশুর মতো পাগল হয়ে যাবো?”

চমকিত নয়নে তাকায় ধ্রুব।

“মানে?”

“আমি নিশুর মতো পাগল হতে চাই না ভাইয়া! আমি ভালো থাকতে চাই! আমি পাগল হতে চাই না! পাগল হলে আমি সব ভুলে যাবো।”

কেমন অসহায় কণ্ঠস্বর দ্যুতির। ঠিক বুঝতে পারলো না ধ্রুব। নিশু তো পাগল নয়! সব মাথার উপর দিয়ে গেল।

“কী বলছিস?”

অশ্রুসিক্ত এবং অসহায় নয়নে তাকায় দ্যুতি।

“ঠিক বলেছি ভাইয়া।”

কেমন কাতর গলা!

“কী হয়েছিল?”

“তুমি যখন নিশুকে ডিভোর্স দিয়ে গেলে তখন ওর মেমোরিলস হয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল। নিশু ডিমেনশিয়ার পেশেন্ট ছিল অনেক বছর! আমি নিশুর মতো ডিমেনশিয়ার পেশেন্ট হতে চাই না!”

চমকিত নয়নে তাকায় ধ্রুব। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনবরত কাঁদতে লাগলো নিশু। দ্যুতির কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না! ধ্রুব,ধূসর,অনিক,দ্যুতি,বুশরা,নিজের মা সবার কথা মনে পড়ছে! কার জন্য কাঁদবে সে? তার তো অনেক দুঃখ!

“অনিকের জন্য আমি পাগল হতে চাই না!”

“কিচ্ছু হবে না বোকা! আমার বিশ্বাস খুব শীঘ্রই সেরে উঠবে দেখিস! আবারও আউল ফাউল বেফাঁস কথাবার্তা বলে তোকে বিরক্ত করবে মিলিয়ে নিস।”

দ্যুতির মন মানে না!

“পাসপোর্ট থাকলে চল আমরাও যাই।”

“না আমি ওকে ওমন অবস্থায় দেখতে পারব না।”
____

চলবে~
রিচেইক করিনি। অগোছালো এলোমেলো থাকতে পারে।