মায়াকুমারী পর্ব-৩৫/খ

0
69

#মায়াকুমারী ❤️
#মেহেরিন_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(৩৫/খ)
___________________

থমথমে মুখে লিভিং স্পেসে বসে রইলেন আসাদ সাহেব। কোনোকিছুই বুঝতে পারছেন না। দিলরুবা খাতুনের ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেল। অস্থির অস্থির লাগছে উনার। গত কয়েক বছর থেকেই মেয়ের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখলেন। বিয়ের কথা উঠলেই কেমন জানি আচরণ করে। জিজ্ঞেস করলেও হেসে উড়িয়ে দেয়। বুঝতেই দেয় না কিছু। জীবনে প্রথম মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখেছেন। খারাপ কিছু না হলে মেয়ে কখনো এমন করে কাঁদার কথা নয়! কীভাবে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। চোখে-মুখে ঝাপসা দেখছেন। শ্বাসপ্রশ্বাস আঁটকে আঁটকে আসছে।

“দিলরুবা কী হয়েছে তোমার এমন করছো কেন?”

কেমন ঘামতে লাগলেন তিনি।

“আমার মেয়ের কী হয়েছে? কী বলছে এইসব?”

কেমন মরা কণ্ঠস্বর উনার।

“তুমি টেনশন করছো কেন?”

কিছু বলতে পারলেন না হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। ছেলেদের ডাকাডাকি করতে লাগলেন আসাদ সাহেব।
__

সব মিলিয়ে তিন-চার ঘন্টার মধ্যেই থাইল্যান্ডে নিয়ে আসা হলো অনিককে। চিকিৎসা চলছে! রাত থেকে এই অব্ধি কাঁদতে কাঁদতে আদনীন ফেরদৌসের দু-চোখ ক্ষয় হয়ে গেল যেন। একদিকে পুত্র অন্যদিকে স্ত্রীর ওমন কান্না ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো ইফতেখার মির্জার হৃদপিণ্ডকে। শক্ত মনের অধিকারী মানুষটা কেন জানি স্ত্রীর কান্না সহ্য করতে পারছেন না। অবশ্য আগে কখনো স্ত্রীকে কাঁদতে দেখেননি। তাও আবার এমন করে। কেমন জানি লাগলো। বুঝতে পারলেন স্ত্রীর প্রতিও ভালোবাসা রয়েছে। রাজনীতির দিকে মন দিতে গিয়ে তেমন একটা স্ত্রীকে স্পেশাল কোনো মোমেন্ট উপহার দিতে পারেননি। স্ত্রীও অবশ্য কখনো অভিযোগ করেননি। তবে সবসময়ই মলিন মুখে থাকতেন। হয়তো বলতে গিয়েও আবার নীরব হয়ে যেতেন। এভাবে জীবনের গোল্ডেন সময়গুলো তিনি কখন যে শেষ করে ফেললেন বুঝে উঠতে পারলেন না। অপরাধবোধে মাথা নুয়ে এলো। ভাগ্যগুণে পরীর মতো সুন্দরী বউ পেয়েছেন তিনি,তবে কদর করতে জানলেন না রাজনীতি আর ক্ষমতার অহংকার এবং মোহে পড়ে। ভাবতেন এক বউ গেলে কত বউ পাবেন! বউয়ের অভাব হবে নাকি! বুঝতে পারলেন বছরের পর বছর স্ত্রীকে তিনি নীরবে কষ্ট দিয়ে এসেছেন। চোখজোড়া হঠাৎ কেমন ঝাপসা হয়ে এলো। অহংকারের কারণে কখনো মাটিতে পা পড়েনি উনার। স্ত্রী তাঁর বাবা-মা,ভাই-বোন সবাইকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে কাঁদলেও একবারও উনাকে অভিযোগ করে কাঁদেননি। মনে হচ্ছিল সবার মাঝে তিনি স্ত্রীর কেউ হোন না। অবশ্য দেয়ালটা তো তিনি নিজেই অনেক আগে তুলে দিয়েছিলেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বুজে তপ্তশ্বাস ফেললেন। পুত্রের কথা মনে পড়তেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন। এর একটা বিহিত করেই ছাড়বেন তিনি। উনার এসিস্ট্যান্টকে দিয়ে নিশু-দ্যুতির তথ্য নিলেন এবং ফোন করলেন থানায়। হ’ত্যা চেষ্টার মামলা করলেন দু’জনকে আসামী করে। রাতে অনিককে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করার ঘটনাটি কিছু লোক দেখেছিল। মামলা শেষে আসামীদেরকে গ্রেফতার করার কড়া নির্দেশ দিলেন এবং এখুনিই! উনার একমাত্র পুত্রকে হ’ত্যা চেষ্টা করা হয়েছিল আর তিনি কীভাবে ওই আসামীদেরকে ছেড়ে দিবেন তা তো হয় না! তিনিও দেখিয়ে ছাড়বেন কী কী করতে পারেন। সোজা ফাঁসিতে ঝুলাবেন নয়তো উনার নামও ইফতেখার মির্জা নয়। ক্ষমতার দম্ভে ফুলেফেঁপে উঠলো উনার বুকের ভেতর। একজন মন্ত্রী হিসেবে সমাজে উনার প্রেস্টিজ রয়েছে। ছেলের বাউণ্ডুলে চালচলনকে কখনোই প্রশ্রয় দেননি তিনি। কিন্তু অনিক তো শোনার মানুষ নয়। এই নিয়ে ছেলের গায়ে মাঝেমধ্যে হাতও তুলতে দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। তবে কখনো কোনো মেয়েকে ইভটিজিং কিংবা ব্যাড হ্যাবিটের রেকর্ড নেই সেই বিষয়ে তিনি সবসময়ই চোখ-কান খোলা রেখেছেন। কী এমন হলো যে দুটি মেয়ের হাতে মুমূর্ষু অবস্থায় ফিরলো ছেলে!
__

মন্ত্রী সাহেবের কড়া নির্দেশ পেতেই পুলিশ এসে ভরে গেল স্বপ্নমহল ভবনে। পুলিশকে আশা করেননি কেউই। নিশু-দ্যুতিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝামেলা পাকালো। শোকে মূহ্যমান দ্যুতি পাথর হয়ে রইলেও আতঙ্কিত হয়ে রইলো নিশু। সে কখন অনিককে হ’ত্যার চেষ্টা করেছে! সে-তো বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে উল্টো দ্যুতির দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এই তো এখনও ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে কিডনিতে ব্যথা পেয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে হজম করছে সকল ব্যথা,যন্ত্রণা! আর কত কষ্ট পাবে সে! অশ্রুর জলধারা বইতে লাগলো সফেদ দুগাল বেয়ে। নাক-মুখ,চোখ এবং পুরো মুখশ্রী কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। দিকবিদিকশুন্য হলেন আসাদ সাহেব। অনিকের বিষয়টি জানতেই তেঁতে উঠলেন। কাল মান হানির মামলা করলে আজ বোধহয় এত ঝামেলায় পোহাতেন না! কালকের ঘটনাটি তিনি ভুলেননি। বিজনেস পার্টনারদের সামনে ইনসাল্ট হয়েছিলেন। ছেলেটির প্রতি মেয়ের দূর্বলতা আছে বলে কোনো ব্যবস্থা নেননি। পিতা হলেও মেয়ের চোখের ভাষা তো বুঝেন। উনাকে শান্ত থাকতে বলে গম্ভীর হয়ে পুলিশদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো ধ্রুব। কিন্তু ওর কোনো কথা আমলে নিলো না পুলিশ। স্বয়ং মন্ত্রীমশাই কড়া নির্দেশজারি করেছে মানে পালন করতেই হবে এর কোনো হেরফের করা যাবে না। কোনোভাবেই বিষয়টি হেল্ডেল করতে পারলো না ধ্রুব-ধূসর। এটা তো সত্যি যে দ্যুতি অনিককে বাজেভাবে আঘাত করেছে। কিন্তু নিশুকে ফাঁসানোটা নিতে পারলো না। বেচারি এমনিতেই রোগী। কাউকে দেখলেই ভয়ে আধমরা হয়ে কাঁপতে থাকে সেখানে আবার হ’ত্যার চেষ্টা করবে এটা হচ্ছে একটা বানোয়াট কনস্পায়ার। অবস্থা সুবিধার নয় দেখে বুশরাকে ফোন করলো ধীরাজ। বুশরা তখন থাইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য লাগেজ গুছিয়ে ড্রেস পরে রেডি হলো। পাঁচ মিনিট বাদেই বেরুবে সে। হঠাৎ ফোন ভাইব্রেট করতেই দ্রুত পিক করলো।

“হ্যালো ধীরাজ!”

“সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে আপু!”

“ক..কী হয়েছে?”

শ্বাস আঁটকে রইলো বুশরা। দ্যুতি কী করেছে আবারও?

“পুলিশ এসে ঝামেলা করছে!”

শ্বাস ফেললো।

“কেন?”

“তোমার বাবা ওদের দু’জনের নামে হ’ত্যা চেষ্টার মামলা করেছে!”

“কখন?”

“আজ।”

“এখন?”

“দু’জনকে জেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝামেলা করছে পুলিশ। দ্যুতি আপু না হয় আঘাত করেছিল কিন্তু নিশু ভাবী তো নির্দোষ! ভাবীর নামে মামলা করলো কেন?”

“ওয়েট! ডোন্ট ওয়্যারি,আ’ম লুকিং ইনটু দ্যা ম্যাটার।”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো বুশরা। ভিডিও কল করলো তার বাবাকে। বিষন্ন মনে পিক করলেন তিনি।

“পাপা তুমি কি পাগল হয়েছো?”

জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

“মামলা করেছো কেন?”

“ভাবলে কী করে আমার ছেলের খু’নিদের আমি ছেড়ে দিবো?”

“নিশুর নামে মামলা করলে কেন?”

“ওই মেয়েকে ভালো ভেবেছিলাম। ভাবখানা এমন যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না!”

তাচ্ছিল্যতা উনার চোখ-মুখ জুড়ে।

“পাপা ভুল হচ্ছে তোমার। ও আঘাত করেনি দ্যুতি করেছে।”

“দু’জনেই করেছে। ছাড়বো না কাউকে।”

“পুলিশদের চলে যেতে বলো পাপা।”

“অসম্ভব! ওদের আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো! জেলের ঘানি টানাবো। ফাঁসির দড়িতে ঝুলাবো।”

“পাপা তোমার ছেলে ভালো?”

“কী বলতে চাও?”

“তোমার ছেলে কেন মেয়েদের ইভটিজিং করে?”

“হোয়াট?”

“এখন ওরা যদি উল্টো তোমার ছেলের নামে মামলা করে?”

“কী বলতে চাও?”

“ওরা যদি বলে যে তোমার ছেলে তার গ্যাংদের নিয়ে রেপ করার চেষ্টা করেছে আর ওরা আত্মরক্ষার জন্য আঘাত করেছে তখন কী করবে? মুখ থাকবে তোমার?”

চোয়াল শক্ত করলেন।

“ব্ল্যাকমেইল করছো?”

“নয়তো তোমার ছেলে মার খায় কেন? আর কারো ছেলে খায় না কেন?”

“সাট আপ!”

“আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না।”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন। হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন। জেলে নিয়েই ছাড়বেন! উনাকে ব্ল্যাকমেইল করছে এইটুকু আণ্ডাবাচ্চা মেয়ে! সাহস কত! বার কয়েক কল দিলো পিক করলেন না। উনার এসিস্ট্যান্টকে কল দিলো। পিক করতেই বলল,”পাপাকে বলে দিন এই ড্রামা বন্ধ করতে। নয়তো আমি সু’ইসাইড করব!”

ঘাবড়ে গেলেন উনার এসিস্ট্যান্ট শারাফাত।

“বলে দিন।”

“দিচ্ছি।”

ভয়ার্ত গলায় বললেন,”স্যার ছোট ম্যাম ব্ল্যাকমেইল করছে!”

“করুক।”

শুনতে পায় বুশরা। ভিডিও কল দিলো।

“পাপার সামনে ধরো।”

মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

“পাপা! ভাইয়া দ্যুতিকে ভালোবাসে। তুমি তার ভালোবাসাকে এইভাবে কলঙ্কিত করো না। তোমার ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরলে এলোমেলো করে ফেলবে তোমাকে!”

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।

“আমার দিকে তাকাও পাপা!”

তাকালেন না তিনি।

“আমার ভাইয়ের ভালোবাসার হাতে হাতকড়া উঠবে তো আমার গলা দড়িতে ঝুলবে!”

বিস্ফোরিত নয়নে তাকালেন তিনি। ফ্যানের সঙ্গে একটি মোটা দড়ি বাঁধলো বুশরা।

“ভালোবাসা যদি বন্দী হয় আমি হবো মুক্তির আগুন!”

“ব্ল্যাকমেইল করছো?”

“হ্যাঁ! আমার ভাইয়ের ভালোবাসার জন্য।”

“ভেবেছো আমি ইমোশনাল হব?”

দড়ির ভেতর গলা ঢুকাতে নিতেই চেঁচিয়ে উঠলেন।

“স্টপ! স্টপ!”

“পুলিশকে চলে যেতে বলো!”

“ইম্পসিবল!”

“তো ঠিক আছে!”

“থামো বলছি!”

“চলে যেতে বলো!”

একমাত্র মেয়ের ব্ল্যাকমেইলের কাছে পরাজিত হয়ে ফোন করলেন পুলিশকে এবং ফিরে যেতে বললেন।

“কিন্তু আমি মামলা তুলবো না। আমার ছেলের জীবনের সঙ্গে ওই মেয়ে দুটোর আয়ু! আমার ছেলে বাঁচবে তো ওরাও বাঁচবে।”

“ওদের সঙ্গে আমার আয়ুও। ওরা বাঁচবে তো আমিও বাঁচবো।”

অগ্নি চোখে তাকিয়ে রইলেন। আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছে সমানে! মুষ্টিবদ্ধ করলেন হাত!

“এইটুকুন আণ্ডাবাচ্চা মেয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো?”

বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠলেন তিনি।

“ভুলে যেও না আমি তোমার মেয়ে! তোমার রক্ত আমার শরীরের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে!”

চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলেন।

“তুমি আমার জন্মদাতা পিতা আর আমি তোমার একমাত্র মেয়ে!”
_____

চলবে~