মায়াকুমারী পর্ব-৩৬

0
2

#মায়াকুমারী ❤️
#মেহেরিন_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(৩৬)
___________________

মন্ত্রী সাহেবের ফোন পেতেই চলে গেল পুলিশ। ঠিক কী হলো বুঝে উঠতে পারলো না দু-ভাই। তপ্তশ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ালো দু’জন। শপে গেলেন না আসাদ সাহেব। মন-মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। একদিকে স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে তো আরেক দিকে মেয়ে। অন্যদিকে নিরপরাধ দুটো মেয়েকে মা’র্ডার কেইসের আসামি করে বসে আছে। মস্তিষ্ক টগবগ করছে উনার। যতটুকু বুঝতে পারলেন অনিককে আঘাত করেছে দ্যুতি কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হলো না উনার। উনার বিশ্বাস মেয়ে এমনটা করতেই পারে না ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। তিনিও এক কাঠি উপরে। মন্ত্রী সাহেব ষড়যন্ত্র করছে আর তিনি আঙ্গুল চুষবেন তাতো হবে না। তিনিও লইয়্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানহানি,ইভটিজিং এবং রেইপ কেইসের মামলা দিয়ে বসলেন অনিকের নামে। এবার তিনিও দেখবেন নাকউঁচু মন্ত্রীর সাহেবের কত ক্ষমতা! তিনিও টক্কর দিয়ে দেখিয়ে দিবেন কার সঙ্গে প্রতিনিয়ত উঠাবসা উনার। তীরের বেগের ন্যায় নোটিশ পেতেই দাঁতে দাঁত চাপলেন মন্ত্রী সাহেব। এত বড় স্পর্ধা! তিনিও দেখিয়ে ছাড়বেন কত ধানে কত চাল! তিনিও জেলের ঘানি টানিয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে ছাড়বেন ওই মেয়ে দুটোকে। ইগোয় লাগায় রাগে-জিদে নাক ফুলে এক হাত হয়ে গেল।
__

সিগারেট ধরালো ধ্রুব। মন-মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। কী থেকে হঠাৎ কী হলো! এত এত টেনশন নেওয়া যাচ্ছে না। নিরপরাধ নিশুকেও ফাঁসালো ওই নাকউঁচু মন্ত্রী সাহেব। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ইচ্ছে তো করছে লোকটার নাক-মুখ ঘুষিয়ে চেহারার রং বদলে ফেলতে কিন্তু অসম্ভব এটা। হুট করে মস্তিষ্ক স্ক্যান করে উঠলো দ্যুতির বলা কথাগুলো। দ্যুতি বলেছিল নিশু পাগল হয়ে গিয়েছিল এবং ডিমেনশিয়ার পেশেন্ট অর্থাৎ সে স্বাভাবিক নয়। অস্থিরতা শুরু হলো মনের ভেতর। ওরা দু’জনই আপসেট হয়ে রয়েছে আপাতত বিরক্ত করতে চাচ্ছে না। বাবা-মায়ের অবস্থাও জটিল হয়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে কেউই স্বাভাবিক নয়। ধীরাজ ভার্সিটিতে গিয়েছে। বাসায় রয়েছে শুধু ধূসর। হ্যাঁ ধূসরই নিশুর ব্যপারে সব জানবে। কারণ ধ্রুব লক্ষ্য করেছিল নিশুকে সবসময়ই সেই হসপিটালে নিয়ে যেত। পায়ের তলায় সিগারেটটা পিষে ওদের রুমে এলো। পাথরের মতো বসে রয়েছে দু’জন।

“নিশু তোর মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো কই?”

চমকায় নিশু।

“কেন?”

“প্রয়োজন আছে।”

আমতা আমতা করলো।

“কই?”

“আমার কাছে নেই?”

“কার কাছে?”

“মেজ ভাইয়া জানে।”

“ওকে কিছু খাইয়ে দে।”

মাথা নাড়ায় নিশু। বেরিয়ে গেল ধ্রুব। সোজা নক করলো ধূসরের দরজায়। কিছুক্ষণ পর গম্ভীর হয়ে দরজা খুললো। ভেতরে ঢুকে মুখোমুখি দাঁড়ালো।

“নিশুর মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো কই?”

“কেন?”

“প্রয়োজন আছে।”

“জানি না।”

চোয়াল শক্ত করলো।

“ভণ্ডামি না করে রিপোর্টগুলো দে।”

“আমার কাছে কিছু নেই।”

শক্ত চোখে তাকায় ধ্রুব।

“নিশু বলেছে তোর কাছে।”

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ধূসরের।

“দিবি নাকি আমি নিবো?”

“ওসবের কোনো দরকার নেই। সংসার করার ইচ্ছে থাকলে করো না করলে ডিভোর্সের বিষয়টি ক্লিয়ার করো। ওর জন্য পাত্রের অভাব হবে না।”

শক্ত চোখে তাকায় ধ্রুব।

“তোর দেখছি অনেক খচখচানি!”

“সাড়ে এগারো বছর ধরে ভণ্ডামি তো আর কম করোনি! সবার লাইফ হেল করে ঠিকই নিজের ক্যারিয়ার গড়েছো! তোমার মতো সেলফিশ এইসবের কী বুঝবে!”

“মুখ সামলে কথা বলিস!”

হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আলমারির প্রতিটি তাক চেক করতে লাগলো। একটি তাকে দেখল দুনিয়ার ফাইলপত্র। চমকায় ধ্রুব। এত ফাইল কার চিন্তা করলো! একটা একটা করে নামিয়ে দেখতে লাগলো সবগুলোতেই নিশুর নাম। চমকায় ধ্রুব। ঠিক পনেরো-বিশটা ফাইলেরও বেশি। সবগুলোর ভেতরে অনেকগুলো প্রেসক্রিপশন।

“ঢাকার আর কোনো ডাক্তার বাদ রাখিসনি?”

তাচ্ছিল্যতা ফুটে উঠলো ধূসরের চোখে-মুখে।

“কম ট্রমা তো আর দিয়ে যাওনি।”

সবগুলো নামিয়ে টেবিলের উপর রাখল। এগুলো চেক করতে করতে পুরো একদিন লাগবে। বেশ কতগুলো পরীক্ষা-নীরিক্ষার রিপোর্টও পেলো। সবগুলো নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। কারো থেকে কিছু জানার প্রয়োজন নেই। রিপোর্টগুলো চেক করলেই বুঝতে পারবে। বিছানার উপর রেখে বয়স অনুযায়ী একটা একটা করে চেক করতে লাগলো। সাড়ে এগারো বছরের ফাইলপত্র কি কম-সম! তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল দশ বছর বয়সে। এর পূর্বে পেলো মাইল্ড স্ট্রোকের ফাইলটা। এরপর একে একে সব ঘাটতে লাগলো। যতই ঘাটতে লাগলো ততই বুকের ভেতরটায় কেমন জ্বালাপোড়া অনুভব করলো। অজান্তেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। এত এত ডিপ্রেশন,আতঙ্ক আর ট্রমার ভেতর দিয়ে গেল মেয়েটা অথচ সে কখনও পিছু ফিরেও তাকালো না। কেন জানি মনে হলো সবকিছু তার জন্যই হয়েছে।
__

চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে দ্যুতি। হাত-পা ছেড়ে দিলো। চোখের সামনে বারবার ভাসছে কাল রাতের দৃশ্যটি। মানুষটা বুঝি আর বেফাঁস কথাবার্তা বলে তাকে নাস্তানাবুদ করবে না,তাকে রাগাবে না,তাকে বলবে না আমাকে কেন মর্নিং উইশ করলে না,আউল ফাউল কথা বলে তাকে লজ্জা দিবে না। দ্যুতি জানে না অনিক তাকে আদোও ভালোবাসে কিনা! ভালোবাসলে কি কেউ এত বেখেয়ালি হয়! দ্যুতির মনে হচ্ছে এটা ওয়ান সাইড লাভ। হয়তো তার বুঝার ভুল। অনিককে ওভাবে আঘাত করা উচিত হয়নি। হয়তো অনিক তার দূর্বলতা জেনে ফ্লার্ট করে মজা নিতো আর সে সিরিয়াস ভাবতো! শ্বাস আঁটকে এলো। ডুকরে কান্না পায়। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রইল নিশু। মা’র্ডার কেইসের মামলা খেয়ে ছক্কার মতো ধাক্কা খেলো মস্তিষ্কে। সেও এক মা’র্ডার কেইসের আসামি! শেষমেশ কিনা এত বড় অপবাদ! নিতে পারলো না নিশু। কেঁদেকেটে নাক-মুখ ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে ফেললো। তাকেও হাতকড়া পরিয়ে আসামির গাড়িতে করে নিতে এসেছিল পুলিশ। আর এটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে এই বাড়ির সবাই জেনে গিয়েছে। ছিঃ! ছিঃ! ভাবতেই দুঃখে-কষ্টে,রাগে-জিদে,লজ্জায়-অনুতাপে ভীষণ কান্না পেলো। সে এত খারাপ নাকি! কিন্তু মনের দুঃখ কাউকে বুঝাতে পারলো না। কাল রাত থেকে অতিরিক্ত চিন্তায় এবং কেইস খেয়ে আত্মহ’ত্যার প্রবণতা জাগলো নিশুর মনের মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিলো ঝাঁপ দিয়ে আত্মহ’ত্যা করবে কিন্তু এখন কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া ছাঁদে উঠলে সবাই সন্দেহ করতে পারে। সে যাইহোক,আত্মহ’ত্যা করার আগে নিশু একটা ভালো কাজ করতে চায়। শাড়ি দুটিতে অনিকের রক্ত লেগেছিল তাই ওগুলো পরিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলো। সে মরে গেলে তার শাড়িটা জড়িয়ে ধরে না হয় সবাই স্মৃতিচারণ করবে। নাক টেনে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নিলো শাড়ি দুটো। ওরা দু’জন আবার সবসময়ই একজন আরেকজনেরটা ধুয়ে দেয়। এই নিয়ে ওদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। পানি ঝরিয়ে বাম হাতের ভাঁজে নিয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। চারতলার সিঁড়ি ঘরে আসতেই আকস্মিক মুখোমুখি হলো তাহমিদের। অপ্রস্তুত হলো নিশু। লজ্জায় ফর্সা গাল দুটোয় গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়লো। আমতা আমতা করে চোখ নামিয়ে ফেললো। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। তাদরেকে জেলে নেওয়ার জন্য পুলিশ এসেছিল এটা নিশ্চয়ই তাহমিদও শুনেছিল! নিশুর দিকে তাকাতেই চোখ পড়লো হাতের ভাঁজে রাখা শাড়ি দুটির উপর। চিনতে ভুল হয়নি। টকটকে লাল এবং গোলাপি রঙের শাড়ি দুটো কাল ওরা পরেছিল। দু’জনকেই মারাত্মক লেগেছিল কাল। শ্বাস আঁটকে সাইড দিতেই নিচের দিকে পা বাড়ালো তাহমিদ। শ্বাস ফেলে উপরের দিকে পা বাড়ালো নিশু। কিছু একটা মনে করে হঠাৎ পিছু ঘুরে দাঁড়ালো তাহমিদ। নিশু ছাঁদে যেতেই শিওর হয়ে তড়িৎ উপরে উঠে বাসায় ঢুকলো। কাল রাত থেকে মেজাজ খারাপ তাহিয়া বেগমের তাই দেখেও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। এত না ভেবে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। রান্নাবান্না করছেন তিনি। রুমের দিকে পা বাড়ালো তাহমিদ।

টান টান করে শাড়িগুলো মেলে দিলো নিশু। আত্মহ’ত্যার কথা মনে পড়তেই কাঁপতে লাগলো বুকের ভেতর। সুখ ধরা দিতেই এখন তার উপর গ্রহণ লেগেছে! তার কপালে বোধহয় সুখ নেই! জলপ্রপাতের ন্যায় টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। দূর্বল পায়ে ছাঁদের কার্নিশের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখল পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রয়েছে তানজিল। চোখে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে দ্রুত নেমে গেল। সিগারেট ধরালো তানজিল। গোলাপি শাড়িটার দিকে চোখ পড়তেই তাকিয়ে রইল। আকস্মিক অক্ষিপটে ভেসে উঠলো দ্যুতির হাস্যজ্জ্বল চেহারা। সিগারেটে লম্বা করে টান দিয়ে ধোঁয়াগুলো ওড়িয়ে দিলো আকাশে। বেশ কয়েকটি শার্ট-প্যান্ট ধুয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো তাহমিদ। লক্ষ্য করলো টান টান করে শাড়ি দুটো ছায়ার মধ্যে মেলে দিয়ে গিয়েছে নিশু। টকটকে লাল শাড়িটার দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের শার্টগুলো হাঙ্গারে ঝুলিয়ে প্যান্টগুলো দড়িতে মেলে বাসায় ফিরে গেল।

“তাহমিদ তোর হঠাৎ কী হয়েছে?”

“কই?”

“তাহলে অফিসে যাসনি কেন মাঝপথ থেকে ফিরে এলি যে?”

বিরক্ত হলো তাহমিদ। এতকিছু কেন যে জিজ্ঞেস করে তার মা! ডমিনেটিং পছন্দ নয় তার তবুও তারা এটার মধ্যেই বড় হয়েছে। বলা যায়,তার মা একজন টক্সিক পার্সন। প্রতিত্তোর করলো না তাহমিদ।

“কীরে কিছু বলছিস না যে অফিসে যাসনি কেন?”

তাসফিয়া বলল,”ভাইয়ার ডায়রিয়া হয়েছে আম্মু। শার্ট-প্যান্ট সব নষ্ট করে ধুয়ে ছাঁদে শুকাতে দিয়েছে!”

“কী বললি?”

“তোমার ছেলে প্যান্ট নষ্ট করে ফেলেছে।”

বিষম খায় তাহমিদ। চাটি মা’রলো তাসফিয়ার মাথায়।

“তোর মাথা!”

“ওহ! মাথায় মারো কেন!”

ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের কিছু ড্রেস ধুয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো তানজিল। তাহিয়া বেগম লক্ষ্য করলেন আজ হসপিটালে যায়নি তানজিল। চিন্তিত হলেন তিনি।

“এই তোদের আজ হয়েছেটা কী! একজনের না হয় ডায়রিয়া কিন্তু তোর কী হলো তানজিল?”

“ওর কলোরা হয়েছে আম্মু!”

দাঁতে দাঁত চাপলো তানজিল। মুখ টিপে হাসতে লাগলো তাসফিয়া।

“হায় আল্লাহ কী বলিস!”

“সত্যি বলছি আম্মু। দু’জনের ডায়রিয়া,কলেরা দেখা দিয়েছে।”

“এই তোরা ডাক্তারের কাছে যাস না কেন?”

“ডাক্তারেরই তো কলেরা! সে আর কী যাবে ডাক্তারের কাছে।”

চোয়াল শক্ত করে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো তানজিল। হায় হায় করে উঠে দু’জনের জন্য ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ দিয়ে কাচ কলার ঝোল রান্নার আয়োজন করতে লাগলেন তিনি।
__

বিমর্ষ মুখে রিনা খালা আর জোছনাকে নিয়ে রান্নাবান্না করে গোসল সেরে নিলো নিশু। কোনোমতে লাঞ্চ করে থাইল্যান্ড যাওয়ার জন্য রেডি হলো ধ্রুব। বাসা থেকে বের হওয়ার পূর্বে দ্যুতিকে জিজ্ঞেস করলো,”তুই যাবি থাইল্যান্ডে?”

মাথা নাড়ালো যাবে না। নিশু বলল,”আমি যাব।”

“দ্যুতি গেলে তোকে নিতাম। ওর দিকে খেয়াল রাখিস কিছু একটা করে বসবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো। হাত ধরে ব্যালকনিতে নিয়ে গেল নিশুকে। আচমকা কোমর পেঁচিয়ে ধরে মুখ গুঁজল ঘাড়ে। শ্বাস আঁটকে থমকে রইল নিশু। বাম হাতে কোমর পেঁচিয়ে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ডান হাত দিয়ে চিবুক তুলে বলল,”তোর সঙ্গে অনেক কথা বাকি নিশু!”

নীরব হয়ে তাকিয়ে রইল সে। বাম গালে চুমু খেয়ে চুলে মুখ গুঁজল।

“তোর চুলগুলো ভীষণ সুন্দর,যত্ন নিস রুক্ষ যেন না হয়। তোর চোখগুলো ভীষণ সুন্দর,যত্ন নিস যেন বিষন্নতা না থাকে। তোর মুখ,ঠোঁট,দাঁত,চিবুক সব সুন্দর তবে আমার জন্য যত্ন নিস। আর নিজেকে আগলে রাখিস কারণ তুই আর এইসব আমার পৃথিবী তাই।”

মুহূর্তেই শিরদাঁড়া বেড়ে সর্পিল গতিতে শীতল স্রোত বয়ে গেল।

“তুই আমার চোখের শীতলতা! তোকে নিয়ে খুব শীঘ্রই একটা শান্ত শীতল সাধারণ সংসার করবো। আর একটু অপেক্ষা শীঘ্রই তোকে ঘরে তুলবো!”

আইসের ন্যায় জমে গেল নিশু। কিছু বলতে পারলো না। কপালে এবং চিবুকে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল ধ্রুব। ধীরাজকে নিয়ে রওনা দিলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ব্যালকনিতে থেকে তাকিয়ে রইল নিশু। অবশ্য ওদের সঙ্গে ধূসর যায়নি কারণ বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। এদিকে আসাদ সাহেবও চেঁচামেচি করছেন এদিক-সেদিক ফোন করে। হার্টের রোগী অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে ভেবে দুশ্চিন্তায় রইল। দিলরুবা খাতুনকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। তাই সবার কথা বিবেচনা করে ধূসর থেকে গেল। নিশুর মুখোমুখি হলো না ধূসর। নিশুও একপ্রকার নিজেকে আড়াল করে রেখেছে।
__

বিকেল বেলা তখন। পুরো বাসার অবস্থা গুমোট। ভালো লাগছে না নিশুর। কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে। কিছু খাওয়াতে পারেনি দ্যুতিকে।

“দ্যুতি ছাঁদে যাবি?”

নীরব রইল সে।

“চল একটু ছাঁদে বসি। কিছুক্ষণ সময় কাটালে ভালো লাগবে।”

প্রতিত্তোর করলো না।

“চল না। আর কতক্ষণ এমন থাকবি। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে এখন কান্নাকাটি করে কী হবে!”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশু। হাত ধরে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। ছাঁদে পা ফেলতেই আকস্মিক দুধপালংগুলো খসে বাতাসে উড়ে এসে পড়তে লাগলো তাদের গায়ে। কি সুন্দর একটা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এবং মুহূর্ত। ভীষণ ভালোলাগা কাজ করলো নিশুর। মেঘমুখে ছাঁদের কার্নিশের দিকে এগিয়ে গেল দ্যুতি। নিচের দিকে তাকালো। ট্যাবেবুইয়া ফুলে ফুলে ভরে গেছে তাদের বাড়িটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছু ঘুরে ছাঁদের চতুর্দিকে তাকায়। ছাঁদের চতুর্দিকে থাকা তারকাঁটাগুলোয় ঝুমকোলতার ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছে। আনমনা হয়ে টবগুলোর দিকে তাকায়। কয়েন প্লান্টের ফুল ফুটেছে! ইশ! কি সুন্দর! কয়েন ধরবে কি তাতে! আনমনা হয়ে এক থোকা বৃদ্ধাবেলী ছিঁড়ে তাকিয়ে রইলো ছুটন্ত যানবাহনগুলোর দিকে। নিশু হঠাৎ লক্ষ্য করলো শাড়ি দুটো নেই। চমকে উঠলো সে।

“খালা শাড়িগুলো কই?”

“জানি না।”

“কাউকে নিতে দেখেছো?”

“না।”

“আজ ছাঁদে এসেছিল কে দেখেছো?”

“হ,পাঁচতলার ভাড়াটিয়ার ছেলেগুলারে আইতে দেখছি।”

“আর কেউ এসেছিল?”

“হেরা ছাড়া তো আর কারো ছাঁদে উঠার অনুমতি নাই।”

এটা ঠিক যে ওরা দু’জন ছাঁদে এসে সময় কাটায় এবং পায়রা পুষে বলে কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। বাসা ভাড়া দেয়ার সময় এটাও উল্লেখ থাকে। তাই ছাঁদে কেবল নিশুরাই আসে। ইদানীং পাঁচতলার ভাড়াটিয়ারাও আসে। সে যাইহোক,এখন শাড়ি দুটো কে নিতে পারে চিন্তিত হলো নিশু।

“খালা কে নিতে পারে বলো তো?”

“বুঝতাছি না। পাঁচ তলার ভাড়াটিয়ার পোলারা ছাড়া আর কারো উঠার দুঃসাহস নাই।”

এটা ঠিক কিন্তু কী করবে এখন ভীষণ চিন্তিত হলো নিশু। ধূসর পছন্দ করে কিনেছিল তাদের জন্য। লাল শাড়িটার জন্য দ্যুতির মন ভীষণ খারাপ হয়েছিল সেদিন। দু-ভাইবোন অনেক তর্কবিতর্ক এবং রাগারাগিও করেছিল। খাবার টেবিলে মায়ের কাছে অভিযোগও করেছিল। একটা স্মৃতি ছিল শাড়ি দুটি। কিন্তু কে নিলো? ধূসর জানতে পারলে চেঁচামেচি করবে। কারণ সত্যিই সুন্দর শাড়িগুলো। প্রিয় একটা জিনিস ওভাবে হারিয়ে গেল। কেমন জানি লাগছে! পাঁচতলায় রিনা খালাকে পাঠালে আউল ফাউল কথা বলে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এতে তাঁরা অপমানিতবোধও করতে পারে। রিনা খালার হুঁশ জ্ঞান কম। নিশু সিদ্ধান্ত নিলো সে ভদ্রতার সহিত জিজ্ঞেস করবে তারা ভুলে নিয়েছে কিনা! অবশ্য ধূসর আজ ছাঁদে আসেনি আর এলেও তাদের জামাকাপড় ধরার মতো ওতোটাও বিবেকহীন নয়।

“দ্যুতি চল।”

আনমনা হয়ে বৃদ্ধাবেলীর থোকা গুঁজে দিলো নিশুর চুলে। অবশ্য চিন্তায় থাকায় লক্ষ্য করলো না নিশু। দ্যুতির হাত ধরে আড়ষ্ট হয়ে পাঁচতলার বাসায় কলিংবেল চাপতেই ডোর খুললো তাসফিয়া। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে রইল নিশু। দ্যুতি গম্ভীর হয়ে রয়েছে।

“কে তোমরা?”

“তিনতলা থেকে এসেছি।”

“ও আচ্ছা। ভেতরে আসো।”

“না। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম।”

“হ্যাঁ বলো।”

আমতা আমতা করলো নিশু। তাসফিয়া তাকিয়ে রইল। স্নিগ্ধ লাগছে নিশুকে। মলিন হাসলো নিশু।

“কে এসেছে তাসফিয়া?”

“তিনতলার আংকেলের মেয়ে।”

চমকে উঠলেন। তিন তলার আংকেলের মেয়ে কেন আসবে। একপ্রকার ছুটে এলেন। কথাটি শুনতেই দ্রুত ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় এসে বসলো তানজিল। পূর্ব থেকে বসা ছিল তাহমিদ।

“আরে তুমি!”

মলিন হাসলো নিশু এবং সালাম দিলো। সালাম নিলেন তিনি।

“দাঁড়িয়ে কেন ভেতরে আসো।”

চোখ পড়লো দ্যুতির দিকে।

“ওর কী হয়েছে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

“ও অসুস্থ।”

“ও ভেতরে আসো।”

“না আন্টি। একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম কিছু মনে না করলে।”

“হ্যাঁ বলো।”

হাত ধরে ভেতরে ঢুকাতেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হলো দু’জন। তাহমিদের দিকে চোখ পড়তেই লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। অপলকভাবে তাকিয়ে রইল তাহমিদ। পেস্ট কালারের একটি সেমি মসলিন স্নিগ্ধ সুন্দর অর্কিড শাড়ি পরনে নিশুর। শাড়িটার রঙ দেখার পর শুধু তাকিয়েই রইল। এত এত সুন্দর রঙটা,দেখতেই মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। পুরো শাড়ি জুড়ে বেগুনি রঙের অর্কিড ফুলের এমব্রয়ডারির কাজ ও তার সাথে কাটওয়ার্ক করা এবং ম্যাচিং ব্লাউজ। লম্বা চুলগুলো ভেজা এবং ছাড়া। চুলের একপাশে গুঁজে রাখা ফুটন্ত বৃদ্ধাবেলীর থোকা! কি সুন্দর চন্দনের সুবাস ছড়িয়ে পড়লো। ওর হাত ধরে টেনে আনতেই ঝুনঝুন করে উঠলো পায়ের সোনার নুপুর জোড়া। চোখ নামাতে পারলো না তাহমিদ। চিন্তা করতে লাগলো কে সুন্দর নিশু নাকি তার শাড়ি?এই মেয়ে এত সুন্দর সুন্দর শাড়ি পায় কোথায়? আর কে এনে দেয়? কোথ থেকে শপিং করে? নিশু ছাড়া এমন শাড়ি কারো পরনে দেখেনি তাহমিদ। মনে মনে বলল,”আপনাকে যতবার শাড়ি পরতে দেখি ততবার আমি খু’ন হয়ে যাই সুগন্ধি লেবুফুল!”

ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আড়ষ্ট হলো নিশু।

“বসো।”

“না আন্টি প্লিজ।”

আঁড়চোখে দ্যুতির দিকে তাকালো তানজিল। কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে।

“আরে বসো। বসে বসে কথা বলি।”

“আন্টি প্লিজ শুনুন সময় নেই। বাসায় ফিরতে হবে। আসলেই আমরা এসেছিলাম একটা কথা জিজ্ঞেস করতে।”

“হ্যাঁ বলো।”

“ইয়ে মানে আন্টি,সকালে আমি দুটি শাড়ি ধুয়ে ছাঁদে দিয়ে এলাম কিন্তু এখন নেই। কিছু মনে না করলে বলছিলাম আরকি আপনারা ভুলে আপনাদের জামাকাপড়ের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কিনা বেয়াদবি নিবেন না আন্টি।”

“আরে না না কী মনে করবো! বেয়াদবির কী আছে! আমি তো ছাঁদে যাই না৷ আমার ছেলেরা মাঝেমধ্যে শুকাতে দেয়। ওরা ছেলেমানুষ শাড়ি দিয়ে কী করবে!”

দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল দু’জন। হুট করে একজন তাকিয়ে রইল আরেকজনের দিকে।

“ও আচ্ছা তাহলে আমরা আসি।”

“চা-কফি খেয়ে যাও।”

“না আন্টি।”

বিষন্ন মুখে বেরুতে নিতেই হঠাৎ পায়ের তলায় কিছু একটা ফুঁড়তেই একটু ব্যথা পায় নিশু। পা তুলতেই দেখল একটা স্টোন। চমকায় নিশু। এই স্টোনগুলো তাদের শাড়ির। ধোয়ার সময়ও কয়েকটা পড়ে গিয়েছিল তাহলে এখানে এলো কী করে! মাথা ঘুরিয়ে একপলক পর্যবেক্ষণ করলো দু’ভাইকে। কেমন জানি লাগলো নিশুর। পরক্ষণেই ভাবলো,সত্যি এরা আনবে কেন! এরা তো ছেলেমানুষ। সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল দু’জন কিন্তু নিশুর মনের খচখচানিটা গেল না। শাড়ির কথা জিজ্ঞেস করায় দু’ভাইকে কেমন জানি দেখাচ্ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই মুখোমুখি হলো ধূসরের। অপ্রস্তুতবোধ করে মাথা নুয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো নিশু। সেদিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো ধূসর। ওরা যেতেই ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন,”ওদের শাড়ি কে নিয়েছে দেখেছিস তোরা?”

গম্ভীর স্বরে তাহমিদ বলল,”আমরা কী জানি!”

“তাহলে শাড়িগুলো নিলো কে?”

“জানি না।”

“তোরাই তো গেলি ছাঁদে।”

খেঁকিয়ে উঠলো তানজিল।

“বলতে চাচ্ছেন আমরা চুরি করেছি?”

“তা বলবো কেন?”

“হাজারটা শাড়ি কেনার ক্ষমতা আছে আমাদের।”

ছেলেদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বিরক্ত হলো তাহমিদ।

“কী হয়েছে আম্মা?”

“কিছু না।”

“বলতে চাচ্ছেন আমরা চুরি করেছি?”

“কখন বললাম?”

তানজিল বলল,”চুরির অপবাদ নিয়ে এই বাড়িতে আর থাকব না।”

“পাগল হয়েছিস তোরা! কখন বললাম চুরি করেছিস!”

রুমে ফিরে গেল তানজিল। ডায়েরি খুলে আনমনা হয়ে তাতে লিখল,”এই মেয়েটাকে আমার এত্ত ভালো লাগে কী বলবো! দেখলেই আমার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। অনেক সুন্দর সে!”
_______

চলবে~
কেমন হচ্ছে জানাবেন।
আশানুরূপ রেসপন্স না পেলে লেখার উৎসাহ পাই না পাঠক। আপুরা মন্তব্য করবেন তাহলে রিচ হবে।