#মায়াকুমারী ❤️
#মেহেরিন_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(৪১/ক)
___________________
পুরোপুরি সাতদিন হতে চললো অথচ নিশুরা এখনও ব্যাংকক। ব্যপারটি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলো না ধ্রুব সহ কেউ। শাফায়াত থেকে খবর পেলো ওরা থাইল্যান্ড নয় ব্যাংকক বামরূনগ্রাদ হসপিটালে রয়েছে। চমকায় ধ্রুব। জিজ্ঞেস করলেও বেশি কিছু বলার সুযোগ পেলো না তার পূর্বেই ইফতেখার মির্জা ডেকে উঠেন। চোখ বুজে শ্বাস নিলো ধ্রুব। পার্সোনাল নার্স রেখে কয়েক ঘন্টার জন্য ব্যাংকক ফিরলো কিন্তু বিষয়টি জানলো না ওরা কেউই। নিশুর ডিটেইলস বলতেই কেবিন নাম্বার বলে দিলো রিসিপশনিস্ট। দম আঁটকে লিফটে উঠলো ধ্রুব। যতই উপরে উঠছে ততই বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। কী হয়েছে নিশুর বুঝতে পারলো না। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কেবিনে নক পড়তেই ডোর খুলে দ্যুতি। ধ্রুবকে দেখতেই বিস্ফোরিত হয়ে আতঙ্কিত হলো। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। শক্ত চোখে-মুখে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ধ্রুব। ভড়কায় দ্যুতি। এখন কী হবে?
“ভ..ভাইয়া তুমি!”
চমকিত নয়নে তাকায় নিশু। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো।
“তোরা না থাইল্যান্ড?”
আমতা আমতা করলো দ্যুতি।
“কীরে?”
“আসলেই..”
“হসপিটালে কেন?”
কাঁপতে লাগলো দু’জন। শ্বাস আঁটকে এলো দু’জনের।
“কথা বলছিস না কেন?”
ধমকে উঠতেই কেঁপে উঠলো দু’জন। চোখে জল চলে এলো দ্যুতির।
“আসলেই নিশু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।”
“কখন?”
“ক..কাল।”
“ফাজলামো করিস আমার সাথে?”
শ্বাস আঁটকে জামার একাংশ চেপে ধরলো। নিশুর দিকে এগিয়ে যেতেই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ফেললো। মুখোমুখি দাঁড়ায় ধ্রুব। নিভু নিভু চোখ করে তাকায়।
“অভিনয় করছিস?”
ভড়কে তাকায় নিশু। আমতা আমতা করলো। চোয়াল শক্ত ধ্রুবর।
“ক..কখন এলে?”
“তুই অসুস্থ তাহলে মিথ্যা বললি কেন?”
“আসলেই..”
“কী?”
“আসলেই তোমাকে টেনশন দিতে চাইনি।”
“দেশ-দুনিয়ায় ঘুরেছি আমি। অন্তত আমাকে এইসব সস্তা কথা বলে কনভিন্স করার চেষ্টা করিস না।”
শ্বাস আঁটকে রইলো নিশু।
“তোর কী হয়েছে?”
নীরব রইলো নিশু।
“কী হলো?”
আমতা আমতা করলো।
“ফাইল কই?”
“মেজ ভাইয়ার কাছে।”
“ও কই?”
“ডেকে আনছি দাঁড়াও।”
দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল দ্যুতি। বেড খামছে ধরলো নিশু। ধ্রুবর কথা শুনতেই বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো ধূসরের মাথায়। দ্রুত হাত থেকে স্যালাইনের নল খুলিয়ে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে এলো যদিও কষ্ট হচ্ছিল। গম্ভীর মুখে কেবিনে প্রবেশ করতেই মুখোমুখি হলো দু’জন।
“কী হয়েছে?”
“নিশুর কী হয়েছে?”
“উইক।”
“আমাকে জানিয়েছিস?”
“টেনশন দিতে চাইনি।”
ধূসরকে কেমন রুগ্ন এবং মলিন দেখালো।
“আজ সাত-আট দিন তুই আমার বউকে নিয়ে দেশের বাইরে। এর কারণ কী? কী লুকাচ্ছিস তোরা আমার কাছে?”
চেঁচিয়ে উঠলো ধ্রুব।
“চেঁচাচ্ছ কেন?”
“চেঁচাবো না?”
“অসুস্থ হয়ে পড়েছে হসপিটালে ট্রিটমেন্ট করাচ্ছি এর পরে আর কী করতে পারি আমি?”
“আমাকে কেন ইনফর্ম করলি না?”
“বলেছিলাম।”
“এবার আমার বউয়ের ব্যপারে ইন্টারফেয়ার করা বাদ দে। আমার বউয়ের বিষয় আমাকে বুঝতে দে। তোর এইসব বাড়াবাড়ি আমার সহ্য হচ্ছে না।”
নিশু লক্ষ্য করলো ধূসর শান্ত,কোমল স্বরে কথা বলছে কিন্তু ধ্রুব উত্তেজিত এবং উগ্র। আচমকা টান দিয়ে স্যালাইনের নল খুলে একপ্রকার হামলে পড়লো ধ্রুবর উপর। কলার চেপে ধরে বলল,”খবর্দার তুমি আর একটা বাজে কথাও বলবে না।”
হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো ধ্রুব।
“কে বউ? কীসের বউ? তোমার কোনো বউ আছে? তুমি তো আমাকে বউ মানো না। সাড়ে এগারোটা বছর নাটক করলে,এরপর ডিভোর্সের নাটক করলে। তোমার যে একটা বউ আছে সেটা মনে পড়লো এখন? হাজারটা অবহেলা,অপদস্ত,আর মানসিক অত্যাচার করে তুমি আমাকে রোগী বানিয়ে ফেললে। এই যে আমার আজকের এই অবস্থানে থাকার কারণ তুমি। সাড়ে এগারোটা বছর তুমি আমাকে এতটাই অবহেলা করেছো যে আমি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে একবার পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। স্বামী না হওয়া সত্ত্বেও ছায়ার মতো চব্বিশটা ঘন্টা তোমার ভাই নিঃস্বার্থভাবে আমার পাশে ছিল। আর আজ বলছো ইন্টারফেয়ার করতে না? সাড়ে এগারোটি বছর কী করেছো তুমি আমার জন্য? বলো কী করেছো? কোন অধিকারে এইসব কথা বলার সাহস পেলে তুমি?”
“তুই আমাকে ভুল বুঝছিস?”
“নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা?”
চোয়াল শক্ত করলো ধ্রুব।
“তোমাকে আমি ভয় পাই না। কাগজে-কলমে আমি তোমার বউ হলেও আমার উপর তোমার কোনো রাইট নেই। আমার বিপদে-আপদে,সুখে-দুঃখে,অসুস্থতায়,পড়াশোনা থেকে শপিং আমার শখ,ইচ্ছে,আকাঙ্ক্ষা,আহ্লাদ সবকিছুর সময় তোমার ভাই ছিল। আমার উপর তার রাইট বেশি। যে আমার সুখে-দুঃখে,দুর্দিনে পাশে ছিল তার রাইট বেশি। এই বোকা আমি ঠকার পরেও বেহায়া,বেলাজের মতো তুমি নামক স্বার্থপর মানুষটাকে ভালোবেসেছিলাম বছরের পর বছর। এতদিন ডিভোর্সের নাটক করলে তুমি এখন আমি নিজেই তোমাকে ডিভোর্স দিবো। করবো না তোমার সাথে সংসার। আমি তোমার ভাইকে বিয়ে করবো। কারণ সে আমাকে ডিজার্ভ করে।”
কথাগুলো শুনতেই বুশরার মনটা মলিন হয়ে গেল। নিশু কি সত্যিই ধূসরকে বিয়ে করবে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো ধ্রুব।
“বেরিয়ে যাও চোখের সামনে দেখে। স্বার্থপর মানুষ কোথাকার! সারাজীবন নিজের স্বার্থের কথা ভেবে বাবা-মা,ভাই-বোন,বউকে পর্যন্ত অবহেলা করেছো তোমাকে আমি ঘৃণা করি। তোমাকে ঘৃণা করলেও আমার ঘৃণার অপমান হবে।”
আগুন চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব।
“কোন সাহসে তুমি আমাকে বউ বলে দাবি করো? কোন অধিকারে? সাড়ে এগারোটা বছর তুমি আমার জন্য কী করেছো বলো? এখন বউয়ের কথা মনে পড়েছে তাই না? এখন তোমার মনে হয়েছে তোমার বউ আছে? কোন দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছো তুমি? দায়িত্ব কর্তব্য যে পালন করেছে আমার উপর তার অধিকার বেশি। আমি সত্য বলতে ভয় পাই না? বলো কোন দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে তুমি বউ বলে অধিকার দেখাতো এসেছো? বলো!”
চেঁচিয়ে উঠলো নিশু। কলার চেপে ধরে ঝাঁকাতেই ছাড়িয়ে নিলো ধূসর।
“শান্ত হো।”
ইশারা দিলো সমস্যা হবে।
“না আমি শান্ত হবো না। হতে পারছি না। ও আমার সুখে-দুঃখে কোনো সময় ছিল না। ও সবসময়ই ওর স্বার্থ রক্ষার্থে মরিয়া হয়েছিল। আমাকে ও সহ্য করতে পারতো না এখন কীভাবে দাবি করছে আমি তার বউ?”
দাঁত-মুখ পিষালো নিশু।
“এমন একটা দিনের অপেক্ষায় পুরো এক যুগ ছিলাম এই মানুষটাকে প্রতিত্তোর দিবো বলে। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। বেরিয়ে যাও।”
বেরিয়ে গেল ধ্রুব। দপদপ করছে মস্তিষ্ক।
“কী শুরু করলি শান্ত হো।”
রাগে-দুঃখে হু হু করে কান্না করে নিশু।
“আমি বোকা নই। আমি জানি সে আমাকে অবহেলা করেছে। সেই ছোট থেকেই মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই স্বার্থের মানুষটা আমার স্বামী। তখন থেকে ওকে স্বামীর আসনে বসাই। যত অবহেলার পরেও আর কাউকে বসাতে পারিনি। ওই যে আমার শৈশবের কচি,কোমল মন ওকে স্বামী হিসেবে মানলো আর কাউকে সেখানে জায়গা দিতে পারলো না। হাজারটা বেটার অপশন থাকার পরেও আমার মন সব বুঝার পরোও স্বার্থপর মানুষটার জন্য ব্যাকুল ছিল। আশা করতাম হয়তো কোনো একদিন সে আমাকে মেনে নিবে। কিন্তু না সে এবার আসার পর থেকে যা করছে আমি সহ্য করতে পারছি না।”
ডক্টর এবং নার্স বকাবকি করতে লাগলো। ঘুমের ইনজেকশন দিলো নিশুকে। চেঁচানোর ফলে নিশু আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মানুষটাকে এইসব বলেছে ঠিক এখন সে নিজেই কষ্ট পাচ্ছে। পাক! তবুও দরকার ছিল বলার। সত্য কথা বলতে কীসের ভয়? হয়তো এসপার নয়তো ওসপার।
____
চলবে~