মায়াকুমারী পর্ব-৪৩

0
1

#মায়াকুমারী ❤️
#মেহেরিন_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(৪৩)
___________________

মানুষ যত্নে পাখি হয়ে যায়। অভিমানিনী,আহ্লাদী নিশুও পাখির মতো গুটিশুটি হয়ে রইলো ধ্রুবর বুকে তার কথার যত্নে। এই মুহূর্তে সত্যিই তাকে ছোট্ট পুঁচকে একটি টুনটুনির ছানার মতো বড্ড আদুরে লাগছে। তবে সব শুনেও সে তার জেদে অটল। মানতে নারাজ তার কোনো দোষই নেই সব দোষ ধ্রুবর। সে একজন নিষ্পাপ মানুষ। নারীরা আসলেই এমন। যার উপর তার অধিকার এবং অভিযোগ বেশি তারা তাদের ওপরই নিজের দোষগুলো চাপিয়ে দিয়ে শান্তি পেতে পছন্দ করে। অবশ্য এটা নারীদের একটা জন্মগত সমস্যা।

“তাই বলে তুমি আমাকে একবারও দেখতে চাইবে না? তোমার কি মনে পড়ে তুমি আমাকে কখনো দেখতে চাইতে না?”

“হুম পড়ে। এর কারণও রয়েছে। বিয়ের পর যখন ঢাকায় চলে এলাম তখন ফুপির বাসায় উঠেছিলাম। ফুপি আমার ব্রেইনওয়াশ করেছে। অবশ্য তখন টিনএজ ছিলাম তাই যা বলেছিলো সবই আমার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিলো এবং আমি প্ররোচিত হয়েছিলাম দাদী-ফুপির কথায়। এরপর বাবা আসে বাসা নেয় দু’জনের জন্য। মাঝেমধ্যে ফুপি এসে বাবা আর আমার কান ভারী করতো। তখন বাবাকে ভুল বুঝতাম আর উনার সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ের ঝামেলা হতো। এরপর আব্বা অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট নেয় আর আমরা চলে যাই সেখানে। তারপর হঠাৎ শুরু হয় দাদী-ফুপি এবং ফুপাতো বোনদের যাতায়াত। আমাকে নানারকম বুঝিয়ে ব্রেইনওয়াশ করে ফেলতো। তারপর তোর নামে নানারকম নেগেটিভ কথা বলে আমাকে বুঝাতো। আর বলতো তোর বাবা-মায়ের চরিত্র খারাপ। তুইও তোর বাবা-মায়ের মতো হবি ইত্যাদি। তারপর আরও বলতো তোর শ্বশুরবাড়ি নেই,জামাই আদর পাবি না মানে ইত্যাদি। যদিও এইসবে আমি ভীষণ বিরক্তবোধ করতাম তবুও বলতো। তখন আমিও ভাবতাম নিশ্চয়ই তোর বাবা-মায়ের মতো তুইও ওমন চরিত্রের হবি। মানে তখন তোর প্রতি নেগেটিভ ধারণা এসে গিয়েছিলো। এভাবে পেরিয়ে গেল আট বছর। বাসায় ফিরলাম প্রথমবারের মতো। তুই আড়ালে রইলি সামনে এলি না। হঠাৎ একদিন রাতে তোকে পেছন থেকে দেখি। কেন জানি অন্যরকম অনুভূতি ফিল করলাম। এরপর আবারও আমাদের বিয়ে হয়,বাসর হয়। তোর মুখোমুখি হতে ইতস্ততবোধ করছিলাম আসলেই ওমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ছাঁদে চলে গেলাম। মনের মধ্যে হাজারও কথার জলোচ্ছ্বাস বইলেও সংকট ছিলো। ভোর সকালে রুমে ফিরে দেখি সব লণ্ডভণ্ড। তারপর মা অনেক বুঝালো আমি নীরবই রইলাম। ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে নিতেই দেখলাম ভেজা। বুঝতে পারলাম সাইন করতে গিয়ে তুই কেঁদেছিলি। কেন জানি জীবনে সেদিনই এই প্রথম কোনো সাইন করতে নিয়ে হাত কাঁপছিলো। আমি থামলাম,ভাবলাম একটু সময় নিই। ডিভোর্স যখন-তখন দেওয়া যাবে। ততদিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঘুরে আসি। একটু সময় দরকার। সারা রাত অনেক ভাবনা-চিন্তা করলাম। বারবার পেপারটা দেখেছিলাম। এরপর চিঠি লিখে মায়ের হাতে দিলাম। অপেক্ষা করছিলাম তোর প্রতিত্তোর কিংবা তোর। ভাবলাম ফেইস-টু-ফেইস হবি। বাট তেমন কিছুই হলো না। তারপর চলে যাই যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে একদিনও ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। প্রতি রাতে স্বপ্নে তুই আসতি। আমাকে অভিযোগ করে অভিশাপ দিতি। দিনকে দিন পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। ফের সাইকিয়াট্রিস্ট-এর শরণাপন্ন হলাম। অনেক চড়াই-উৎরাই করে দেশে ফিরলাম। তবুও তুই দূরে রইলি। তোকে দেখার জন্য ছটফট করলাম,ইতি-উতি করলাম কিন্তু তুই আড়াল হয়েই রইলি; বুঝতে পারলাম এটা তোর প্ল্যান। সে যাইহোক,তুই যদি তোর অধিকার দাবী করে আমার সামনে দাঁড়াতি আমি যদি তোকে ফিরিয়ে দিতাম তাহলে বলতে পারতি আমার দোষ।”

“এখন সব দোষ আমাকে দিলে?”

নিশু তার জেদে এখনও অটল। সে মানতে নারাজ তার কোনো দোষ নেই।

“যা সত্য তাই।”

“এখানে সব দোষ তোমার।”

নাক টানলো নিশু।

“ঠিক আছে স্বীকার করলাম সব আমার দোষ; সব আমার কারণে হয়েছে এবার তুই খুশি?”

ফুঁপিয়ে উঠে নিশু। আকস্মিক বেড থেকে নেমে পা জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজল। অপ্রস্তুত হলো ধ্রুব।

“কী করছিস?”

“ক্ষমা করে দাও। আমার জন্য তুমি অনেক মানসিক নির্যাতন সহ্য করেছো। বন্দী জীবন কাটিয়েছো। তোমার নীরব অভিশাপেই হয়তো আমি আজীবন অসুখী,অসুস্থ। নয়তো এত এত সুখ,আহ্লাদের মধ্যেও কেন আমি সুখী ছিলাম! কেন আমি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম! কখনো ভাবিনি তোমার মন থেকে আসা নীরব অভিশাপগুলো আমার অশান্তি,অসুস্থতার কারণ। আজ আবারও বুঝতে পারলাম আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেয় না আর সেটা তিলার্ধ পরিমাণ পাপ হলেও। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি কখনো সুখী হইনি। তোমার নীরব অভিশাপগুলো তুলে আমাকে মুক্তি দাও।”

হাত ধরে উঠিয়ে বুকের মধ্যে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। ধ্রুব কখনো ভাবতেই পারেনি নিশু তাকে এত ভালোবাসে। এত ভালোবাসা তার জন্য জমিয়ে রেখেছিল হৃদকুঠিরে। না দেখেও কেউ বুঝি কাউকে এত ভালোবাসতে পারে কিংবা এতটা মায়া জমিয়ে রাখতে পারে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সবই শুনলো দ্যুতি। জলোচ্ছ্বাস নামছে তার দু-চোখ দিয়ে। চোখে-মুখে আঁধার দেখলো। তারাও তো তার ভাইকে ভুল বুঝেছিলো। ভেবেছিলো তার ভাই সত্যি স্বার্থপর। টুং করে নোটিফিকেশন বেজে উঠতেই স্ক্রীন জ্বলতেই ঝাপসা চোখে তাকায় দ্যুতি। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আকস্মিক কেবিন থেকে বেরিয়ে করিডোর থেকে নিচে লাফ দিতেই টান পড়লো হাতে। দেখলো শক্ত করে ধরে রেখেছে ধ্রুব।

“ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও!”

“কী করছিস পাগল হয়েছিস?”

“ছেড়ে দাও! বাঁচতে চাই না!”

ততক্ষণে বেশ কিছু মানুষ নিচে জড়ো হয়ে গেল। এগিয়ে এলো কয়েকজনও। উঠাতে নিলেই আরেক হাত দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।

“বোকামি করিস না।”

“ছেড়ে দাও।”

ছুটে এলো কয়েকজন ডাক্তার-নার্স। কলরব শুরু হলো চতুর্দিকে। একপ্রকার ছুটে এলো ধূসর। এমন দৃশ্য দেখতেই মেজাজ খারাপ হলেও নীরব রইলো। ঝুলে রইলো দ্যুতি। চিন্তায় ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেল ধ্রুব। চোখ-মুখ উল্টে আতঙ্কিত হয়ে কাঁদতে লাগলো নিশু। এমনটা কেন করলো দ্যুতি?

“পাগলামি না করে উঠে আয় দ্যুতি।”

উঠানোর চেষ্টা করলো কয়েকজন মিলে। কিন্তু দ্যুতি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ওদের।

“ছেড়ে দাও মরে যাক।”

“কী বলছো তুমি?”

পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো ধূসর। দ্যুতির এই কৃর্তীকলাপ ভালো লাগছে না তার।

“ছেড়ে দাও মরুক!”

শক্ত চোখে তাকায় ধ্রুব। অনেক কষ্টে উপরে তুললো দ্যুতিকে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো ধ্রুব। সত্যি বলতে হঠাৎই মেজাজ খারাপ হলো। আকস্মিক কষিয়ে দুটা থাপ্পড় দিতেই ফ্লোরে আঁচড়ে পড়তেই কপাল এবং ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরুতে লাগলো। বন্ধ হয়ে গেল কান। থমকে রইলো দ্যুতি। কিছুক্ষণের জন্য বোধশক্তি হারিয়ে ফেললো। ধ্রুবর ওমন অগ্নিরূপে থরথর করে কাঁপতে লাগলো নিশু। কাঁধ চেপে উঠে দাঁড় করালো।

“কী করতে নিয়েছিলি?”

“ভাইয়া!”

আকস্মিক জড়িয়ে ধরলো। থমকায় ধ্রুব। ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো নিজেকে। আঙ্গুল গুঁজল চুলের ভেতর।

“কী করতে নিয়েছিলি?”

কিছু বলতে পারলো না দ্যুতি। ধ্রুবর বুকের ভেতর কেমন কাঁপছে। কটন দিয়ে রক্ত মুছে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে মাথার ওপর ওড়না দিয়ে শরীরে জড়িয়ে দিলো। হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। সেদিকে তাকিয়ে রইলো ওরা দু’জন। লিফটে উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে গেল। দ্রুত একটি ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লো। চলে গেল হসপিটালে। লিফটে উঠে অনিকের আইসিইউ রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। আদনীন ফেরদৌসের কান্নাকাটির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মাথা তুলে তাকায় দ্যুতি। সব তার জন্য হয়েছে। তার জন্য অনিক আইসিইউতে,নিশু জখম হয়েছে,তার ভাইও। এরপর তার বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শেষমেশ বুশরার গায়ে হাত তুলেছে তার বাবা এবং টেনেহিঁচড়ে কোথায় যেন নিয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকে দৃষ্টি বুলালো। সবাইকে দেখলেও ইফতেখার মির্জাকে দেখলো না। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে ধ্রুব। অনিকের অবস্থা খারাপের দিকে গিয়েছে এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। একটা প্রাণের সঙ্গে কতগুলো মানুষ জড়িত। বেঁচে থাকতে মূল্য দেয় না কেউ এরপর হারালে কদর বাড়ে। অনিকের বেলায়ও হলো তা। বেঁচে থাকাকালীন দু’পয়সার মূল্য কেউ দিলো না। এখন কোটি টাকা খরচা শেষ তবুও ছেলের উন্নতি হলো না। অনিককে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার জন্য রেডি করা হচ্ছে। অঝোরে কাঁদে দ্যুতি।

“দ্যুতি,অনিককে একবার দেখে নে।”

নীরব রইলো সে।

“যা কাছে গিয়ে একবার ডাক। হয়তো মিরাক্কেল কিছু হতে পারে।”

“যাব না।”

“আচ্ছা একবার হাত বুলিয়ে দে। হয়তো কিছু একটা হতেও পারে।”

যাবে না সে।

“বাচ্চারা যেমন মায়ের গন্ধ খোঁজে হয়তো ওর হৃদয় তোকে খুঁজছে! যদিও এটা একান্তই আমার মনের কথা।”

অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় দ্যুতি।

“চল।”

হাত ধরে টেনে নিতেই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো,”না যাব না। আমি দেখতে পারব না।”

“ভয়ের কিছু নেই দেখ আমি আছি।”

ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।

“তবুও না।”

হতাশ হয় ধ্রুব। মাথার চুলে আঙ্গুল গুঁজল।

“দ্যুতি,শুনবি না ভাইয়ের কথা?”

“ও যদি কখনো জানতে পারে আমি ওকে দেখতে এসেছি তাহলে ওর দেমাক বেড়ে যাবে।”

এমন কথা ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি ধ্রুব।

“পাগল হয়েছিস?”

“ওর অহংকার বাড়বে।”

“ওর বাঁচারই তো গ্যারান্টি নেই।”

স্ট্রেচারে করে রুম থেকে বের করতেই ভাইকে খামচে ধরে মুখ গুঁজল বুকে। তাকাবে না সে। অনিককে ওমন অবস্থায় দেখতে পারবে না সে। নিচে নিয়ে এম্বুল্যান্সে তুলে রওনা দিলো এয়ারপোর্টের দিকে। চোখের সামনে মূর্ছা গেল মূহ্যমান আদনীন ফেরদৌস। বুক থেকে মুখ তুলে ভীত চোখে তাকায় দ্যুতি।
_____

চলবে~