মায়াতলীর মোড়ে পর্ব-০১

0
1

#মায়াতলীর_মোড়ে
লাবিবা ওয়াহিদ
|সূচনা পর্ব|

পাত্রপক্ষ মাহারিনকে দেখতে এসেছে, পাত্র ডাক্তার। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে এই ডাক্তারের এক হাত প্লাস্টার অবস্থায় গলায় ঝুলে আছে। এমন অবস্থায় কেউ মেয়ে দেখতে আসে, কখনো দেখেনি সে। তার ছোটো বোনেরা অর্থাৎ কাজিনরা তো সেই ডাক্তারকে দেখার পর থেকে মিটিমিটি হেসেই চলেছে। হাসির চক্করে কেউ ঘর ছেড়েও বেরুচ্ছে না। বারবার তাকে খুঁচিয়ে বলছে,
–“এ কী মাহারিন আপু। ডাক্তার মানুষের আবার হাত ভাঙা কেন?”

আরেকজন বলছে, “নির্ঘাত ভাঙা হাতের সেবা করার জন্য ঘরে বউ তুলছে। আহারে মাহারিন আপু, তোমার জন্য মায়া হচ্ছে।”

আরেকজন তো বলে বসল, “ডাক্তার দেখতে তো সুন্দরই, তবে হাতের এই অবস্থা কেন? নিশ্চয়ই দুই নম্বরি ওষুধ বিক্রি করে। কোনো ভাবে হয়তো কাস্টমার হাত মচকে দিছে।”

আরেকজন সেই কথা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করতে করতে বলল, “কিন্তু ডাক্তারের ফিটনেস ভালো। হাত মচকাতে গেলে অপর পক্ষেরই হাত মচকে যাবে।”

শুরু হলো আরেক দফা হাসা-হাসি। ওদের এসব ঠাট্টা-মশকরায় মাহারিন বিরক্ত। সুন্দর সেজে ভদ্র থাকার কথা মাহারিনের। সেই মাহারিন একসময় বিরক্তির জন্য ধমকে উঠলো সবাইকে। ওদের বকাঝকার মাঝেই মাহারিনের মা আর চাচী আসলেন। মাহারিনকে এখন পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া হবে। এই পর্যায়ে এসে মাহারিনকে কিছুটা নার্ভাস দেখালো। ফর্সা গায়ে তার কমলার মধ্যে সোনালী কাজ করা তাঁতের শাড়ি। মুখে খুব হালকা সাজগোছ। মা অর্থাৎ আয়েশা বেগম মাহারিনের মাথার সরে যাওয়া আঁচলখানা টেনে সামনে নিয়ে আসলো। যখন রুম থেকে বেরিয়ে আসছিল তার একটা বোনের দিকেও তাকায়নি। এই মেয়েগুলো চরম অসভ্য, বেয়াদব। শেষমেষ মাথায় রাগ চড়লে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

পাত্রপক্ষের বাড়ি থেকে পাত্রের বাবা, মা এবং পাত্র এসেছে। মাহারিন কোণা চোখে একপলক পাত্রের দিকে চাইলো। পাত্র মায়ের পাশে বসে আছে। সোফায় বেশ হেলে-দুলে বসেছে সাহেব। গায়ে সবুজ রঙের পাঞ্জাবি। মূলত ডান হাত ভাঙা। বাম হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। বেশ সুদর্শন এই ডাক্তার। মাহারিন বেশি ঘাটার সুযোগ পেলো না। পাত্রপক্ষের সামনে বসা এই প্রথম। নার্ভাসনেস তো কাজ করবেই। মাহারিনকে পাত্রপক্ষের সামনে বসানো হলো। পাত্রের মা প্রাণভরে দেখলেন মাহারিনকে। কথা-বার্তায় বুঝল বেশ শিক্ষিত পরিবার। ভদ্রমহিলা হঠাৎ পাত্রকে ঠেলে দিয়ে বললেন,
–“খালি সোফাটায় গিয়ে বস। মাহারিন মা, আমার পাশে এসে বসো তো দেখি।”

শুরুর দিকে ভদ্রমহিলার গলা খচখচে শোনালেও মাহারিনের বেলায় গিয়ে গলাটা কোমল হয়ে এসেছে। পাত্র উঠে দাঁড়াল। মাহারিনও বাধ্য হয়ে ভদ্রমহিলার কাছে গিয়ে বসল। পাত্রের মা মাহারিনের চিঁবুক ছুঁয়ে বললেন,
–“কত মিষ্টি দেখতে। আপনার পছন্দ আছে তাহমিদের বাবা। তাহমিদের জন্যে তো এমনই বউ চাচ্ছিলাম।”

মাহারিন জোরপূর্বক হাসল। হাত ভাঙা ডাক্তারের নাম তবে তাহমিদ। ভদ্রমহিলা হঠাৎ তার হাত থেকে আংটিটা খুলে পরিয়ে দিল। পুণরায় মাহারিনের চিঁবুক ছুঁয়ে বললেন,
–“আমাদের মাহারিনকে বেশ পছন্দ হয়েছে। আশা রাখছি আমাদের মাহারিন মায়ের এই বিয়েতে আপত্তি নেই।”

মাহারিন তখন স্তব্ধ হয়ে বসে। প্রশ্নটা আংটি পরানোর আগে করলে বোধ হয় বুঝত। কিন্তু এই মুহূর্তে জোরপূর্বক হাসা ছাড়া কোনো উপায় হাতে নেই। মাহারিন মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সম্মতি মাই প্রথমে দিয়েছে। মাহারিন তার বাবা মোরশেদ সাহেবের দিকেও তাকাল। বাবার সাথে চোখা-চোখি হলে বাবা তাকে ভরসা দিলেন।

আংটি পরানোর পর সকলে মিষ্টি মুখ করল। মোরশেদ সাহেবের স্কুল জীবনের হারিয়ে ফেলা বন্ধু হচ্ছে তাহমিদের বাবা অর্থাৎ তারেক সাহেব। তাই এই দুজনের মধ্যেই বোধহয় উচ্ছ্বাসটা বেশি দেখা গেল। বন্ধু থেকে নতুন এক নাম হলো তাদের সম্পর্কের। এক পর্যায়ে তারেক সাহেব দুজন মেয়ে-ছেলেকে আলাদা কথা বলতে বললেন। যতই হোক নতুন জীবনে পা দিতে যাচ্ছে দুজন। আলাদা কথা না বললে তো হচ্ছে না। অগত্যা, মাহারিনের তাহমিদকে নিয়ে ছাদে উঠতে হলো।

তাহমিদ এক নজরে চেয়ে আছে মাহারিনের দিকে। এতে মাহারিন অন্য দিকে ফিরে থেকেও অপ্রস্তুত হয়। বহু কষ্টে মাহারিন অধর নাড়ায়। মিনমিন করে বলল,
–“এভাবে কী দেখছেন?”

তাহমিদের নজর এতক্ষণে সরলো। ঘাড় কিছুটা কাত করে বলল,
–“কথা বলছেন না, তাই।”

মাহারিন তাহমিদের দিকে তাকাল। অদ্ভুত লোক তো। মাহারিন তার বাম ভ্রু কুচকে বলল,
–“কথা না বলার সঙ্গে তাকানোর কী সম্পর্ক?”
–“তাকিয়ে ছিলাম বলেই তো কথার ফুল ফুটেছে।”

মাহারিন থেমে গেল। বিরক্তও অনুভব করলো। আবারও নীরবতা দুজনের মাঝে। মাহারিন হঠাৎ বলল,
–“আংটি ফিরিয়ে নিন। আমি বিয়েটা করতে চাই না।”

তাহমিদ পুরোটা শোনার আগেই তার মোবাইলে কল আসলো। তাহমিদ ডান পকেটে ফোনটা ঢুকিয়েছিল। এখন ডান পকেট অবধি হাত যাচ্ছে না। মাহারিন এতক্ষণ নীরব দর্শক হলেও এবার ধ্যান ভাঙে তাহমিদের গলায়।
–“মা বোধহয় কথা বলে ভুলবশত ডান পকেটে মোবাইলটা রেখেছে। একটু বের করে দিবেন? আর্জেন্ট কল হতে পারে।”

মাহারিন হতভম্ভের মতো তাহমিদের কাছে এগিয়ে গেলো। তাহমিদের পকেট থেকে ফোন বের করে দিতেই তাহমিদ সেটা হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানালো। অতঃপর সে ছাদের অন্যপাশে গিয়ে কথা বলতে লাগল। হঠাৎ মাহারিনের চোখ গেল ছাদের দরজার সামনে। মাহারিনের দুজন কাজিন দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মধ্যে একজনের নাম তুলি, আরেকজন বর্ষা। ওরা কেমন অদ্ভুত চোখে চেয়ে হাসছে। মাহারিনের চোখ গরম হয়ে আসে তাতে। সে তাহমিদের কাছে গিয়ে বলল,
–“আপনি আসুন, আমি নিচে যাচ্ছি।”

তাহমিদ ফোন কানে ঠেকিয়েই মাথা নাড়ায়। তাহমিদ তখনো খেয়াল করেনি তুলি কিংবা বর্ষাকে। মাহারিন ভেবে নেয়, যেহেতু তাহমিদকে মনের কথা বলেই দিয়েছে সেহেতু নির্ঘাত তাহমিদ বিয়েটা ভেঙে দিবে। তার মতো ভালো প্রফেশনে থাকা ছেলে নিশ্চয়ই মাহারিনের জন্যে বসে থাকবে না। মাহারিন হনহনিয়ে ছাদের দরজার দিকে গিয়ে দুহাতে দুজনের কান টেনে ধরল। কান টেনেই দুজনকে নিচে নিয়ে যায় সে। সেদিনের মতো তাহমিদরা বিদায় নেয়। মাহারিন তখন স্বস্তি পায়।

মোরশেদ সাহেব একজন পুলিশ অফিসার। তাই স্বভাবতই বেশ গম্ভীর মানুষ তিনি। বাবার মতোই হয়েছে একমাত্র মেয়ে মাহারিন। মাহারিনকে দেখতে ছোটো লাগলেও মাস্টার্সের শেষ বর্ষে আছে। মাহারিনের সুন্দর, সরল মুখ দেখলে যে কেউ এক দেখায় বুঝে নিবে সে যেন ভাজা মাছটাও ওলটাতে পারে না। কিন্তু মাহারিন তার বাবার স্বভাব অনেকাংশেই পেয়েছে। যাকে বলে যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান। কিন্তু মাহারিন আর যাই করুক, কেন যেন বাবাকে ভয় পায়। অথচ বাবা কখনোই তাকে ফুলের টোকা অবধি দেয়নি। মাহারিন জীবনে অনেক আহ্লাদ করেছে কিন্তু তবুও বাবার প্রতি তার এক অদ্ভুত ভয় কাজ করে। এর কারণ অবশ্য আছে। সেই কারণটাও ভীষণ অদ্ভুত।

যখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ছিল তখন প্রেমের বাতাস ছুঁয়েছিল মাহারিনের মনে। এক সিনিয়র তাকে প্রপোজ করেছিল। মাহারিন একদিনের সময় নেয়, তার উত্তর জানানোর জন্য। সে রাতে মাহারিনের খুশিতে ঘুমই আসছিল না যেন। শেষ রাতে ঘুমিয়ে পরেরদিন সকাল সকাল তার বান্ধবীর কল আসলো। সে জানালো মাহারিনের বাবা পুলিশ পাঠিয়ে সেই সিনিয়রকে থানায় ভরেছে। সেই কথা শুনে মাহারিন ছিল হতবাক, নির্বাক। হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হলে দেখতে পেয়েছিল মোরশেদ সাহেব খাবার টেবিলে বসে আছে। তিনি সুখের সাথে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন সঙ্গে পত্রিকায় তাঁর ধ্যান ছিল। মাহারিন বাবার সামনে গিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,
–“তুমি কাকে জেলে ভরেছ বাবা?”

মোরশেদ সাহেব মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে হাসলেন আলতো। বললেন, “খবর পেয়ে গেছ তবে?”
–“এরকম কেন করেছ তুমি?”

মোরশেদ সাহেব পত্রিকায় নজর ডুবিয়ে বললেন,
–“এসব ছেলেরা ভালো না। মেয়েদের ফাঁসায়, এরপর সুযোগ বুঝে খালাশ হয়ে যায়। তুমিও যাতে ফেঁসে না যাও এজন্য এরকম করেছি।”
–“তুমি সোজাসাপ্টা বলতে চাচ্ছ আমি যেন কোনো প্রেম না করি?”
মোরশেদ সাহেব তখন মেয়ের পানে চেয়ে বললেন,
–“বুদ্ধিমতী মেয়ে আমার।”

সেদিন বাবা মাহারিনকে শর্ত দেন, সে যদি গ্যারান্টি দেয় ছেলেটার সাথে কোনোদিনও কথা বলবে না, দেখা করবে না তবেই ছেলেকে ছাড়বে। মাহারিন সেদিন বাধ্য হয়ে বাবার শর্ত মেনে নেয়। বাবাও ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেন। মাহারিন কী কথা বলবে ছেলেটার সাথে, ছেলেটা উলটো মাহারিনের থেকে দশ-বারো হাত দূরত্ব বজায় রাখত। প্রেমের অনুভূতিতে ভেসে যাওয়ার আগেই কঠিন ধাক্কায় ধপ করে মাটিতে পড়েছে সে। সেই চরম ধাক্কাটাও নিজের বাবার থেকেই পেয়েছে। তখন ত্থেকেই মাহারিনের ভেতর চরম জেদ চাপলো। সেটাও অদ্ভুত জেদ। বহুদিন সেই জেদকে পুঁজি করে বেড়াচ্ছে মাহারিন।

সেদিন রাতে বর্ষা মাহারিনকে একটা ছবি দেখিয়ে ব্লেকমেইল করতে শুরু করে দেয়। ছবিটা তখনকার যখন মাহারিন তাহমিদের পকেট থেকে ফোন বের করে দিচ্ছিল। কিন্তু ছবিতে এমন দেখাচ্ছে মাহারিন যেন তাহমিদের বুকে মাথা পেতে আছে। মাহারিন চেতল ঠিকই তবে শেষ মুহূর্তে গিয়ে বলল,
–“গিয়ে দেখা সবাইকে। আমার কী!”

আসলেই কিছু হবে না মাহারিনের। বর্ষা তবুও ছবিটা রেখে দিল। মাহারিন অবশ্য ভারমুক্ত। এই হাত ভাঙা ডাক্তারের সাথে তার যে বিয়ে হবে না সেটা সে জানে। পরেরদিন মাহারিন আংটি খুলে মায়ের হাতে দিয়ে দিলো। আয়েশা বেগম অবাক হলেন মেয়ের কাণ্ডে। মাহারিন বেশ নরম গলায় বলল,
–“বিয়েটা দ্রুতই ভেঙে যাবে মা। তাই আংটিটা তোমার কাছেই রেখে দাও। ফেরতও তো দিতে হবে, তাই না? আমার কাছে থাকলে যদি হারিয়ে যায়?”

আয়েশা বেগম ধমকালেন মেয়েকে। মাহারিন সেই ধমক তোয়াক্কা না করে বাইরে থেকে ঘুরে আসল। অদ্ভুত ভাবে কয়েকদিন কেউ তাকে কিছু বলল না। বর্ষারা বলেছিল তাহমিদ নাকি তাকে কল দিবে। কিন্তু তাহমিদও কল করেনি। করবে কেন? বিয়ে তো আর হচ্ছে না। কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারেক সাহেব আসলেন বিয়ের তারিখ ঠিক করতে। তারিখও নাকি এই মাসের শেষে। অর্থাৎ হাতে সময় মাত্র বারোদিন। মাহারিন ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে এরকম এক খবরের জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না। চোখ-মুখ শোকে জর্জরিত হয়ে যায় তার। মাহারিনের এ খবর শুনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এমন সময়ে মোরশেদ সাহেব এক পিস মালাই চমচম মাহারিনের মুখের সামনে ধরে হাসি-মুখে বললেন,
–“মা, বিয়ের মিষ্টিটা তুমিই নাহয় আগে খাও। তোমাকে প্রথমে খাওয়াব বলে এখনো কেউ মিষ্টি খাইনি। দেখি, হা করো। হা..”

চলবে—