#মায়াতলীর_মোড়ে – [০৩]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
বহুদিন পর আবারও বাবা মেয়ের মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সবটাই বিয়েকে কেন্দ্র করে। মাহারিন এক বাক্যে তাহমিদকে বিয়ে করবে না। আর মোরশেদ সাহেবও এক বাক্যে বলেছেন মাহারিন বিয়ে করলে তাহমিদকেই করবে। মোরশেদ সাহেব একসময় প্রশ্ন করলেন,
–“তাহমিদকে তোমার কেন পছন্দ না?”
–“কারণ সে তোমার পছন্দ।”
–“তো তুমি এখন কী চাচ্ছ?”
–“তোমার পছন্দে আমি বিয়ে করব না।”
মোরশেদ সাহেব অধর বাঁকিয়ে হাসলেন। ঠাট্টার সুরে বললেন, “তোমার পছন্দ তো দেখা হয়ে গেছে মা। কয়েক ঘণ্টার জেল ভ্রমণে ছেলেটা তোমার থেকে দশ হাত দূরে চলে গেছে। ফিরেই তাকায়নি তোমার দিকে।”
মোরশেদ সাহেব কখনোই মেয়ের সাথে কোনো দেয়াল রাখেননি। সম্পর্কটা তিনি সবসময় বন্ধুর মতো রেখেছেন। একমাত্র মেয়ে, বাবা-মাকেই আগে বন্ধু হতে হবে। এজন্যই বোধ হয় মোরশেদ সাহেব অবলীলায় এই ধরণের কথাটা বলে দিয়েছে। তবে মাহারিন লজ্জা পেল বাবার কথাতে। সে নিজেও জানে ওই ব্যাটা আস্ত এক বদজাত ছিল। খামাখাই মাহারিন ছেলেটাকে পছন্দ করেছিল, ছেলেটা প্রপোজ করার পর তো মাহারিন কত খুশি হয়েছিল। সেই মুহূর্ত মনে পড়লে মুখ কুচকে যায় তার। প্রেমিক হবে বীরপুরুষের মতো। যদি বীরপুরুষের মতো দম না-ই থাকে তার বুকে, তাহলে প্রপোজ করল কোন সাহসে? তাও আবার পুলিশের মেয়েকে? কীভাবে যে গোটা একটা দিন মাহারিন প্রেমে হাবুডুবু খেল। ছিহ!
তবে এসব তো আর মাহারিন তার বাবার সামনে প্রকাশ করবে না। সে নিজের জেদ বজায় রাখবেই। মাহারিন একবার নয়, কয়েকবার চেয়েছিল প্রেমে পড়তে.. সব খানেই বাবা এসে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ কাহিনী আগানোর আগেই ইতি টানতে হয়েছে।
মাহারিন সমান তেজ ধরে রেখে বলল, “জেলে ভরলে যে কেউ-ই ভয় পাবে বাবা। তাহমিদ সাহেব তো এখনো জেলে যায়নি। তাই ভয়ও পাচ্ছে না। তাকে জেলে ভরে দাও, সেও দেখবা বিড়ালের মতো মিউমিউ করছে।”
মোরশেদ সাহেব তখন মিটিমিটি হেসে বললেন, “আমার পছন্দকে আমি জেলে ভরব তা কী করে হয়? তুমি নিজেই তো একটা জেলখানা মা।”
মাহারিন এবার চটে গিয়ে বলল, “আমি আর কোনো কিছু শুনতে চাই না বাবা। আমি তাহমিদ সাহেবকে বিয়ে করব না মানে করব না। নয়তো আমি কিছু একটা করে বসব।”
মোরশেদ সাহেব টিভির রিমোট হাতে নিয়ে সিনেমার চ্যানেল ঘাটতে ঘাটতে বেশ নিশ্চিন্ত গলায় বললেন,
–“যা খুশি করো। বিয়ের সময়ই তো আছে হাতে কিছুদিন মাত্র।”
মাহারিন বাবার সামনে আর দাঁড়ালো না। হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। প্রতিবারের মতোই দরজা বিকট শব্দে লাগিয়েছে। এতে করে আয়েশা বেগম রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল,
–“আরে আস্তে দরজা লাগা। এত রাগ কিসের?”
মোরশেদ সাহেব তাতে হেসে বললেন, “করতে দাও মেয়ের মর্জি। দরজা ভাঙলে আরেকটা লাগিয়ে দিব।”
আয়েশা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কী যে শুরু হয়েছে তাঁর সুখের সংসারে!
বিকালে তাহমিদের মা অর্থাৎ পারভীন তাঁর ছোটো মেয়েকে নিয়ে আসলেন হবু ভাবীর সঙ্গে দেখা করাতে। ভদ্রমহিলা হুট করে এসেছেন বটে, তবে হাতে করে বাহারী মিষ্টান্ন আনতে ভুলেননি। ছেলের শ্বশুরবাড়িতে বুঝি খালি হাতে আসা যায়? তাহমিদের ছোটো বোনের নাম তাহিয়া। মাহারিনকে দেখতে আসাটা হুট করে ছিল। এছাড়াও বিয়ে ঠিক হলেই মেয়েকে নিয়ে আসবেন ভেবেছিলেন। এখন তাই করলেন পারভীন আক্তার। তাহিয়া এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। বেশ ছোটো সে মাহারিনের থেকে।
মোরশেদ সাহেব ঘণ্টাখানেক আগেই আয়েশাকে বলে দিয়েছিলেন মাহারিনের হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে দুজন আসবেন। সেই থেকেই আয়েশা প্রস্তুতি শুরু করেছেন। মেয়ে ঘরেই ছিল, তাই কিছু বলার প্রয়োজন পড়েনি।
মাহারিন ভেবেছিল বিকালে কোথাও ঘুরে আসবে। তৈরিও অর্ধেক হয়েছিল। এমতাবস্থায় হুট করে ওরা চলে আসায় মাহারিনের বাইরে যাওয়া বাতিল হয়ে গেল। আর কী, মুখ গোমড়া করে বাইরের পোশাক বদলে ফেলেছে। পারভীন আক্তার তাহিয়াকে সঙ্গে নিয়ে লিভিংরুমে বসে ছিলেন। মাহারিন সালাম দিয়ে অন্য সোফায় বসেছেন। মাহারিনের হাতে সেই আংটি। এখানে আসার আগেই আয়েশা জোর করে পরিয়ে দিয়েছেন। এতে মাহারিন বিরক্ত। বিয়ে করবে না অথচ কত নাটক করতে হচ্ছে। ভদ্রমহিলা সর্বপ্রথম যেন মাহারিনের হাতের দিকেই তাকিয়েছেন। অতঃপর তিনি হেসে মেয়ের উদ্দেশে বললেন,
–“দেখ তাহিয়া, তোর ভাইয়ের বউ।”
বউ শব্দটা কেমন গায়ে সুঁচের মতো বিঁধল মাহারিনের। তবুও মাহারিন সেসব দমিয়ে হাসি-মুখে তাকাল তাহিয়ার দিকে। তাহিয়া দেখতে অনেকটা পারভীন আক্তারের মতোই। পারভীন আক্তার এমনিতে দেখতে বেশ সুন্দরী। সৌন্দর্য এখনো তার ম্লান হয়ে যায়নি। তাহিয়ার চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করছে। সে আচমকা বলল,
–“এমন সুন্দর ভাবী কোথায় পেলে মা। লাল টুকটুকে লাগছে।”
মাহারিন লাল থ্রি পিছ পরেছিল। তাই সম্ভবত তাহিয়া এই কথাটা বলেছে। মাহারিন চুপচাপ সেসব প্রশংসা গিলে নেয়। ভদ্রতার খাতিরে টুকটাক কথা-বার্তাও বলল। তাহিয়া খুব মিশুক মেয়ে বোঝাই যাচ্ছে। মাহারিন ভাবল যদি আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হত তবে তাহিয়া তার ননদ হলে মন্দ হতো না। কিন্তু মাহারিনও যে তার জেদে অটল।
সন্ধ্যায় তাহিয়ারা চলে গেল। রাতে মাহারিনের ফোনে কল আসল। তাহমিদের। মাহারিন বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করল। বিরক্ত কণ্ঠে ঢেলে বলল,
–“কী চাই?”
–“আমার হবু বউকে। আপনার শপে এভেইলেবল?”
মাহারিনের ভ্রু কুচকে যায়। বলল,
–“বউয়ের সিগন্যাল অন্য কোথাও পাবেন, এখানে নেই।”
–“কিন্তু সিগন্যাল তো আমি তোমার থেকেই পাচ্ছি।”
–“আপনি ডাক্তার হলেন কী করে?”
–“পড়াশোনা করে।”
–“ডাক্তাররা এত তর্ক করে?”
–“কোথায় তর্ক করলাম? আলাপ করছি। আলাপ বুঝেন না?”
মাহারিন মহা বিরক্ত হলো। বলল,
–“আপনার আমাকে বিয়ে কেন করতে হবে? ভেঙে দিন না বিয়ে, তাহলেই তো সব ঝামেলা মিটে যায়।”
–“আপনার আমাকে বিয়ে করতে সমস্যা কী শুনি?”
এর জবাবে মাহারিন কোনো উত্তর দিতে পারল না। তাহমিদ আবার বলল,
–“আপনি ভীষণ অকৃতজ্ঞ জানেন?”
অবাক হয় মাহারিন। বলল,
–“কী করে?”
–“এইযে, সৌভাগ্যকে পায়ে ঠেলে দেন। আপনাদের মেয়েদের তো সবসময় নেশাখোর ছেলে পছন্দ। আমি নেশা করলে আপনিও আমাকে চুজ করতেন।”
ক্ষেপে যায় মাহারিন।
–“এক্সকিউজ মি।”
মাহারিন সবেই কঠিন এক কথা বলতে নিচ্ছিল, তখনই তাহমিদ তার কথায় ফোড়ন কেটে বলল,
–“পেশেন্ট কল দিচ্ছে। রাখছি।”
মাহারিন তখন ফোনের দিকে চেয়ে। মুখ ভেঙিয়ে আপনমনে বলল, “পেশেন্ট নাকি গার্লফ্রেন্ড কে জানে।”
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে আয়েশা দেখতে পান তার মেয়ে বাড়ির কোথাও নেই। না বলেই উধাও। ভয়ে আয়েশার বুক চিনচিন করে ওঠে। তিনি তৎক্ষণাৎ ছুটলেন স্বামীকে ডাকতে। মোরশেদ সাহেব তখন ঘুমোচ্ছেন। আয়েশা স্বামীকে ডাকতে ডাকতে বললেন, “শুনছেন, মাহারিন বাসায় নেই। কারো সাথে পালিয়ে যায়নি তো?”
মোরশেদ সাহেব ঘুমোতে পারলেন না আর। স্বাভাবিক ভাবেই ঘুম থেকে উঠে বসলেন। সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে বললেন, “আজ এত তাড়াতাড়ি উঠালে কেন? এখন স্পেশাল নাস্তা বানাও যাও। ঘিয়ের পরোটা খাব। সঙ্গে করলা ভাজি আর ঢেঁড়স ভাজি দুটোই করবে। চা টা আগে দিয়ে যাও। ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আয়েশা বেগম ক্ষেপে গেলেন স্বামীর বেপরোয়া কথায়। গমগমে কণ্ঠে বললেন,
–“আমি কী আপনার সাথে কৌতুক করছি? সব সময় মজা নেন কেন এত?”
–“আমি কোথায় বললাম কৌতুক করছ? মেয়ে পালায়নি কোথাও। তুমি গিয়ে নাস্তা বানাও। বেশি আজারে থাকলে মেয়ের ফ্রেন্ডদের কল দাও। দেখো কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। এখন এসব ভেবে প্রেশার বাড়িও না আর।”
–“আপনারা যা কাণ্ড করে বেড়াচ্ছেন তাতে প্রেশার না বাড়িয়ে উপায় আছে? যেমন বাপ তেমনই মেয়ে।”
আয়েশা হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মোরশেদ সাহেব হাই তুলে নিজ মনে বললেন,
–“আজ আর আমার কপালে নাস্তা জুটবে না।”
আয়েশা লিভিংরুমে বসে বসে মাহারিনের যে কয়জন বান্ধবী ছিল সবাইকে একে একে কল করল। কিন্তু কারো সাথেই মাহারিন নেই। কোথায় গেল মেয়েটা? ঠিক আছে তো? নাকি বাবার সাথে রাগ করে কোনো ছেলের সাথে পালিয়েছে? ধুর, কিসব ভাবছে সে। সিনেমা আজকাল বেশি দেখা হচ্ছে দেখেই উলটো পালটা চিন্তা বেশি আসছে। আয়েশা আর কোথায় কোথায় কল করা যায় খুঁজতে লাগল।
————————
–“না আন্টি, মাহারিন আমাদের বাড়িতে নেই।”
বলেই স্পৃহা মাহারিনের দিকে তাকাল। মাহারিন স্পৃহার বিছানার একপাশে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। শুধু শুয়ে নেই অবশ্য, ঘুমোচ্ছে। মাহারিনের জন্য বাধ্য হয়ে মিথ্যে বলে কল কেটে দেয় সে। স্পৃহা মাহারিনের কাছে এসে তাকে ঠেলে ঘুম ভাঙাল। মাহারিন ঘুমের মধ্যেই ভ্রু কুচকে ফেলল, পরপর ঘুমের ঘোরে বলল,
–“ঘুমোতে দে তো স্পৃহা। ঘুমাইনি গতকাল রাতে।”
চলবে—