#মায়াতলীর_মোড়ে – [০৪]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
স্পৃহার সাথে মাহারিনের পরিচিতির শুরুটা ছিল অদ্ভুত। মাহারিনের কাছাকাছি পাশের শহরে এক সুন্দর নদী বয়ে গিয়েছে। নদীটা পদ্মা নদীরই একটি শাখা। সেই নদীরই এক তীড়ে বড়ো পাথর বসিয়ে সুন্দর ঘোরাঘুরির স্থান হিসেবে বানানো হয়। জায়গাটার নাম ঝিলচত্তর। তাই কম-বেশি বিভিন্ন, বিচিত্র মানুষরাই এখানে আসে ঘুরতে কিংবা নদীর স্নিগ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে আসে। অনেকে দূর থেকেও এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসে।
মাহারিনও তার বোনদের সাথে প্রায়ই যেত। তো প্রতিবারের মতো সেবারও মাহারিন গিয়েছিল। সেখানকার এক পাথরে নদীর দিকে মুখ করে স্পৃহা বসেছিল। বর্ষার ছবি ভালো আসছিল না বলে স্পৃহাকে ডাকে সে। স্পৃহা চমকে চাইতেই মাহারিন প্রথমবারের মতো দেখেছিল তার চোখে জল। স্পৃহা অবশ্য সেই পাথর থেকে সরে বসেছিল, কিন্তু মাহারিন স্পৃহার কান্নারত মুখটা দেখে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না। আবার বিরক্তও করবে, সেটাও পারছিল না। দোটানায় ভুগতে ভুগতে মাহারিন সেদিন স্পৃহার পাশে বসে। স্পৃহার সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করে।
স্পৃহাও সেদিন চোখ মুছে মাহারিনের সাথে মিশেছিল। মাহারিন সবসময়ই মোটিভেট করতে পারে ভালো। তার বিশেষ গুণটির মাঝে এটি অন্যতম। স্পৃহার ডিপ্রেশন সে নিজেই যেন ধীরে ধীরে মুছে দেয়। দেখাটা তাদের ঝিলচত্ত্বরে হলেও মাহারিন পরবর্তীতে জানতে পারে স্পৃহা তার ভার্সিটিতে তারই এক ইয়ার ছোটো। তা অবশ্য বিশেষ প্রভাব ফেলেনি তাদের বন্ধুত্বে।
স্পৃহা বাজেরকম ভাবে প্রেমে ধোকা খায়। স্পৃহা মন থেকেই ভালোবেসেছিল ছেলেটাকে, কিন্তু সে ঠকে যায়। এই বিষয়টা কিছুতেই মানতে পারছিল না স্পৃহা, এজন্য নিজেকে সামলে নিতে সে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকত। এখানে লোক সমাগম বেশি থাকলেও কেউ কখনো তাকে বিরক্ত করেনি। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেসও করেনি কী হয়েছে। স্পৃহা নিজেও কাউকে গোণায় ধরত না। তবে মাহারিনের বেলায় গিয়ে স্পৃহার কী হলো কে জানে?
মাহারিন ফোলা চোখে স্পৃহার সাথে নাস্তা করছে। সকাল এখন এগারোটা বাজে। মাহারিনের চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার বিশেষ ঘুম হয়নি। স্পৃহা মাহারিনের মুখোমুখি বসে মাহারিনকে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। একসময় না পেরে স্পৃহা বিরক্ত হয়ে বলল,
–“আঙ্কেল-আন্টিকে শুধু শুধু প্যারা কেন দিচ্ছিস মাহারিন? তারা তো তোর ভালো চাচ্ছে।”
মাহারিন যেন শুনলোই না স্পৃহার কথা। স্পৃহা আবার বলল,
–“আমি তোর হবু বরের ছবি দেখেছি। দেখতে তো ভালোই, সঙ্গে ডাক্তার। তোর লাইফ তো সেট হয়ে গেছে। তাহলে এমন করছিস কেন?”
মাহারিন এবার চোখ তুলে তাকাল স্পৃহার দিকে। মাহারিন ভ্রু কুচকে বলল,
–“দেখতে ভালো তো কী হয়েছে? ওই লোক পুরো দমে অসভ্য। তাকে এত করে বলেছি আমি তাকে বিয়ে করব না, অথচ সে ত্যাড়া বাঁকা কথা বলে মাথায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। গলতে গিয়েও গলতে পারছি না।”
–“ওটা বিয়ের আগে অনেক কিছুই মনে হয়। এখন যে তোর আঙ্কেলের প্রতি অন্ধ রাগ, এজন্যই ভাইয়াটার ভালো গুণ চোখে পড়ছে না। এত রাগ, জেদ ভালো নয় মাহারিন। বুঝতে শেখ।”
মাহারিনের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল। বলল, “আমার শেখার বয়স পেরিয়ে গেছে। এখন তুই বল, আমি তোর বাসায় থাকলে কোনো সমস্যা হবে? হলে বল, আমি এখনই বেরিয়ে যাচ্ছি।”
মাহারিনের জেদের পাল্লায় পড়ে স্পৃহা দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। নিজে তো কিছু করছেই না সাথে তাকেও কাউকে কিছু বলতে দিচ্ছে না। এই চরম ত্যাড়া মেয়েটাকে নাকি স্পৃহা একসময় আইডল ভাবত। সেসব মাথায় আসতেই স্পৃহার নাক কুঁচকে যায়। স্পৃহা এবার বিরক্তির সাথে বলল,
–“এবার তবে কী করতে যাচ্ছিস তুই?”
মাহারিন আড়চোখে স্পৃহার দিকে চেয়ে বলল,
–“প্রেম করব ভাবছি। এছাড়া বিয়ে থেকে নিস্তার নেই।”
স্পৃহা হেসে ফেলল মাহারিনের কথা শুনে। মাহারিন ভ্রু কুচকে বলল, “মজা নিচ্ছিস নে। তবে আমি সত্যি বলছি, করা প্রয়োজন প্রেম।”
মাহারিন থেমে আবার বলল, “এবারের প্রেমের কথাটা তোর আর আমার মধ্যে থাকবে। বাকি বন্ধুদের জানাবি না। আমি একশো পার্সেন্ট শিওর আমারই বন্ধুমহলের কেউ আমার সব আপডেট বাবাকে দিত। নয়তো আজও বুঝলাম না, বাবা কী করে সবার আগে সব খবর পেয়ে যেত? নিশ্চয়ই কোনো গোয়েন্দা আছেই।”
স্পৃহা অবাক চোখে তাকাল এবার মাহারিনের দিকে। তবে মাহারিনের এ সমস্ত কথাবার্তায় কান না দিয়ে বলল, “তুই এখন যা ভাবার ভেবে নে, আমি আঙ্কেলকে কল দিয়ে বলে দিচ্ছি তুই বাড়ি ফিরছিস।”
মাহারিন তখনই চট করে স্পৃহাকে ধরতে যায় কিন্তু স্পৃহা নিজের মোবাইল সামলে বারংবার এক কথাই বলে। মোরশেদ সাহেবের নাম্বারে কল করতেই নিচ্ছিল ওমনি মাহারিনের মোবাইলে একটা কল আসল। মাহারিন স্পৃহাকে ছেড়ে নিজের মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল তাহমিদের কল। এই মুহূর্তে সে কল করছে কেন? মাহারিন এবং স্পৃহা এবার একে অপরের দিকে তাকাল। স্পৃহা মাহারিনকে একপ্রকার জোর করিয়েই কল রিসিভ করালো। মাহারিন ফোনে স্পিকার দিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তাহমিদ বলে ওঠে,
–“কতক্ষণ লাগবে আপনার নিচে নামতে? তাহলে সেই অনুসারে সিএনজি ছেড়ে দিতাম। বলুন তো একটু।”
মাহারিন অত্যন্ত চমকে যায়। স্পৃহার দিকে অবাক চোখে চাইলে স্পৃহা ইশারায় বুঝাল সে নিজেও বুঝতে পারছে না। মাহারিন গলা পরিষ্কার করে বলল,
–“কোথায় আপনি?”
–“কোথায় আবার? আপনি যেখানে আছেন সেই বাড়ির নিচে। কী যেন নাম আপনার বান্ধবীর? সি, সি, ইস..”
মাহারিন তৎক্ষণাৎ স্পৃহার ঘরের বারান্দায় ছুটল। রাস্তায় তাকাতেই দেখল এক গাছের ছায়াতলে লম্বাটে করে একজন দাঁড়াল। গলায় প্লাস্টার ঝোলা হাত দেখে মাহারিনের তাকে চিনতে অসুবিধা হলো না। মাহারিন খট করে কলটা কেটে দেয়। স্পৃহা একবার মাহারিনের দিকে তো একবার তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“আঙ্কেল মনে হয় এবারও তোর চাল ধরে ফেলেছে। এমনি এমনি তো আর পুলিশ অফিসার হয়নি। আমার ভাই তো এক মাসও টেকেনি পুলিশ ট্রেনিং-এ। হাত-পা ভেঙে ঘরে ফিরেছে। মাহারিন, যা এবার তাহমিদ ভাইয়ার সাথে। শুধু শুধু জেদ করে নিজের শক্তির অপব্যবহার করিস না।”
মাহারিন গরম চোখে তাকাল স্পৃহার দিকে।
–“তোর বিয়ে হয়েছে, তোর উচিত বিয়ে নিয়ে আমায় সাবধান করা। আর তুই কি না আমাকে আরও উস্কে দিচ্ছিস?”
স্পৃহা হেসে বলল,
–“বিয়ের মতো মজার সম্পর্ক আর কিছু নেই। আমি এঞ্জয় করি, তাই তোকেও বললাম এঞ্জয় কর। আমার মতো নেশাখোরের কবলে পড়িস না।”
স্পৃহা বিবাহিত। মাস ছয়েক হয়েছে তার বিয়ের। এরেঞ্জ ম্যারেজই ছিল। বাবার বাড়িতে এসেছে গতকাল রাতে। মাহারিন এই মুহূর্তে কী করবে যখন ভেবে যাচ্ছিল তখনই স্পৃহার বাড়ি ফেরার কথা জানতে পারে সে। তাই আর দেরী করে না। মোটামুটি এক পরিকল্পনা করে ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে আসে।
মাহারিন জেদ ধরে বলল,
–“যাব না আমি।”
তখনই তাহমিদের মেসেজ আসল। মেসেজে লিখা,
–“পায়ে হেঁটে আসতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি? কোলে তো আনতে পারব না, হাতের ব্যথা আছে। তবে আপনি চাইলে আপনার হাত ধরে ঘর থেকে নিয়ে আসতে পারি। আপনি কী তাই চাচ্ছেন আপনার বান্ধবীর বাসায়?”
এরকম এক হুমকি পেয়েও মাহারিন নড়ল না অবধি। স্পৃহা সেই মেসেজ পড়ে বারংবার মাহারিনকে যেতে বলছে। স্পৃহার মা বাড়িতে। সে কিছুতেই এই ধরণের ব্যাপারগুলো ভালো চোখে দেখে না। তাদের তর্কের মাঝে স্পৃহাদের বাড়ির কলিংবেল বেজে ওঠে। মাহারিন নিজেই ঘাবড়ে যায় কলিংবেলের শব্দ শুনে। দুই বান্ধবী তখনই রুমের বাইরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে স্পৃহার মা দরজা খুলে দেয়। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। তাহমিদ সাবলীল গলায় সালাম দেয় স্পৃহার মাকে। পরপর জিজ্ঞেস করল,
–“মাহারিন আছে?”
তাহমিদের নজর তখন মাহারিনের ওপর এসে পড়ল। মুহূর্তেই দুজনের চোখা-চোখি হয়ে যায়। স্পৃহা পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎক্ষণাৎ বলল,
–“মা, ভাইয়া মাহারিনের হবু বর। বিয়ের ডেট দিয়ে দিয়েছে। এখন মাহারিনকে নিতে এসেছে।”
স্পৃহার মা বুঝলেন। তাহমিদকে বিনয়ের সাথে ভেতরে ডাকলেন, মাহারিনের রেডি হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে বললেন। কিন্তু তাহমিদ ভেতরে প্রবেশ করল না। বরং হেসে বলল,
–“বিয়ের পর মাহারিনের সাথে আপনার আজকের দাওয়াত রাখব। আজকে একটু তাড়া আছে।”
স্পৃহা ততক্ষণে মাহারিনকে ঠেলেঠুলে তৈরি হতে পাঠিয়ে দেয়। মাহারিনও বাধ্য। রাগে গজগজ করতে করতে তৈরি হয় দ্রুত। এই তাহমিদকে সে কিছুতেই শিক্ষা দিতে পারছে না। তার জীবনে বাবা নামক মানুষটা কী কম ছিল যে নতুন করে এই তাহমিদ এসে জুটেছে?
মাহারিন তৈরি হয়ে তাহমিদের সাথে চলে আসল। বাসার নিচে এসে দেখল একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। তাহমিদ সেই গাড়ির পেছনের দরজা খুলে মাহারিনকে ভেতরে বসতে বলল। মাহারিন তখনো চুপ করে দাঁড়িয়ে। তাহমিদ হাই তুলে বলল,
–“রাস্তা-ঘাটে ভদ্রতা বজায় রাখুন। ঘুম থেকে উঠে সোজা এখানে এসেছি আমি। আপনি কী চান এই রোদের মাঝে একজন অভুক্ত, আহত মানুষকে দাঁড় করিয়ে রাখতে?”
মাহারিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
–“এসির হাওয়া খেতে খেতে বলব। উঠুন।”
মাহারিন উঠে বসে। মাহারিনের পাশে বসে তাহমিদ। পুরো রাস্তায় মাহারিনের একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিল না সে। এতে বিরক্ত হয় মাহারিন। গাড়িটা তাহমিদদের। সেটা ড্রাইভার এবং তাহমিদের মধ্যকার কথাবার্তাতেই ধরতে পারে মাহারিন।
তাহমিদ একটি রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করায়। মাহারিনকে নামতে বলে বলল,
–“আমি এখন করব ব্রেকফাস্ট আর আপনি করবেন লাঞ্চ। আসুন।”
মাহারিন বেঁকে বসে বলল,
–“আমি যাব না।”
তাহমিদ তখন গলা খাদে নামিয়ে মাহারিনের উদ্দেশে বলল,
–“আখন চাচা আমাদের পারিবারিক ড্রাইভার। তাই এমন কিছু করবেন না যেন সে আপনার বাবার শিক্ষাতে ভুল ধরে। আসুন।”
চলবে—