#মায়াতলীর_মোড়ে – [০৬]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
হাসপাতাল থেকে খুব দ্রুতই ছাড়া পেয়ে যায় মাহারিন। মায়ের বকুনি এই অবধি কম খায়নি সে। মাহারিনের বাবা মোর্শেদ সাহেবও কেমন গম্ভীর হয়ে গিয়েছেন, কথা তেমন বলেননি তার সাথে। এই ব্যাপারটা মাহারিনকে ভেতর থেকে কিছুটা অস্থির করে তুলেছে। মোরশেদ সাহেব যত যাই করুক, মাহারিনের সাথে যেকোনো মুহূর্তেই বন্ধুর মতো করে মিশতেন। মাহারিনও বাবার সাথে যত রাগ করুক, জেদ করুক কিন্তু বাবা এমন নিশ্চুপ হয়ে যাবে সেটা সে কখনোই মানতে পারে না। মাহারিনের শরীর কিছুটা দুর্বল। এজন্য সে ধীরে ধীরেই হসপিটালের করিডোর ধরে হাঁটছে। আয়েশা বেগম কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে। মাহারিন গোমড়া মুখে তার এগিয়ে যাওয়া শুধু দেখেই গেল। মিনমিন করে কিছু বললেও পরমুহূর্তেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। মিনিট কয়েক হেঁটে আসতেই দূরে তাহমিদকে দেখতে পেল মাহারিন। সাদা শার্ট গায়ে জড়ানো। হসপিটালেরই এক নার্সের সাথে কথা বলছে। নার্সের হাতে একটা রিপোর্টের ফাইল। ছেলেটাকে গলায় হাত ঝুলানো অবস্থাতেও সুন্দর লাগছে। এমন কেন?
তাহমিদ মোরশেদ সাহেবকে দেখতে পেতেই নার্সের থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে আসে। একবারের জন্য চোখা-চোখিও হলো হঠাৎ মাহারিনের সঙ্গে। মাহারিন মুখ ঘুরিয়ে চলতে চলতে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মাহারিন ভেবেছিল তাকে একবার হলেও তাহমিদ “কেমন লাগছে” জিজ্ঞেস করবে৷ কিন্তু একি, সে মোরশেদ সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। মাহারিন হতভম্ভ, পরপরই রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এই ছেলেকে অসহ্য লাগার কারণ আছে বলেই তো মাহারিনের তাকে এত বিরক্ত লাগে। নয়তো হবু বউয়ের অসুস্থতায় তাকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করবে না কেন? আশ্চর্য মানুষ। সুন্দর চেহারা থাকলেই হয় না, ত্যাড়ামিও যাকে তাকে দেখানো উচিত না।
ভার মুখে বাড়ি ফিরলো মাহারিন। বাড়িতে তখন বর্ষা, তুলিরা উপস্থিত। রাত এগারোটা অবধি চাচী থেকে বাড়ি চলে গেল। তবে বর্ষা এবং তুলি দুজনেই মাহারিনের সাথে থেকে যায়। মোরশেদ সাহেবের আজ নাইট ডিউটি থাকায় এশারের আগেই বেরিয়ে গিয়েছেন।
রাতের খাবারের পরপর তুলি মাহারিনকে বলল,
–“তুমি ঘুমের ওষুধ খেলে কেন আপা? তোমার এত কিসের দুঃখ?”
মাহারিন তুলির প্রশ্নে নির্বাক রইলো। মাহারিনের নীরবতা পেয়ে বর্ষা বলল,
–“জানো, সকালে যখন কিছুতেই জেঠী তোমার ঘুম ভাঙাতে পারছিল না তখন জেঠী কেঁদে-কেটে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। আমি কখনোই জেঠীকে কাঁদতে দেখিনি।”
মাহারিন এবার নড়েচড়ে বসলো। কী ভেবে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“তাহমিদ সাহেব কী এসেছিল বাড়ি?”
–“না। তোমাকে জেঠাই হসপিটাল নিয়ে গিয়েছিল। মাকে বলতে শুনেছি সেখানে নাকি ভাইয়াও ছিল। খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছে।”
মাহারিন শুনলো চুপচাপ। খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছে অথচ আজ কেমন ভাব দেখালেন জনাব। নাকের ডগা কেমন সুড়সুড় করছে তার। মাহারিন কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
–“নাটক করতে ছুটে যেতে বলেছিল কে? এত দয়া তো চাইনি কারো কাছ থেকে।”
তুলি এবার বলে ওঠে,
–“আচ্ছা আপু, তুমি কেন তাহমিদ ভাইয়াকে দেখতে পারো না? কী সমস্যা তোমার? এত ভালো ভাইয়া, তার উপর তুমি বিয়ে করবে না বলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিলে? জানো না সুইসাইড করা মহাপাপ?”
মাহারিন তড়িৎ তুলির মাথায় এক চাটি মেরে চোখ রাঙিয়ে বলল,
–“আমার মাথায় কী সমস্যা হয়েছে যে আমি সুইসাইড করতে যাব, তাও সামান্য কারণে? ছোটো, ছোটোর মতো থাক! আরেকবার ঘুমের ওষুধ নিয়ে কথা বললে তোকে এক পাতা খাইয়ে দিব। মা তো কানের কাছে খ্যাচখ্যাচ কম করলো না, তোরা আবার এক তালে সুর দিচ্ছিস কেন?”
তুলি মাহারিনের রাগ দেখে আর ঘুমের ওষুধ নিয়ে কিছু বলতে পারলো না। চুপসে গেল, সঙ্গে বর্ষাও। তবে তাহমিদের প্রসঙ্গ ছাড়লো না দুজনের কেউই। তুলি মাহারিনের পাশ ঘেঁষেই বসে ছিল। মাহারিনের হঠাৎ আক্রমণে এবার সে দূরত্ব বজায় রেখেই বলা শুরু করে। বর্ষা বলল,
–“তাহমিদ ভাইয়ের এক হাত ভাঙা। তোমার বুঝি মানুষটার উপর একটুও দয়া-মায়া হয় না? আমি তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছি, তাহমিদ ভাইয়ার মতো পার্ফেক্ট কাউকে সারাজীবন তপস্যা করেও পাবে না। লিখে রাখো।”
মাহারিন বলল,
–“এখন তোর হাত ভাঙার আগে দুটো আমার ঘর থেকে বের হ। কুইক।”
সেই রাতেই মাহারিন তুলি, বর্ষাকে বের করে দিলো ঘর থেকে। শুধু ঘর থেকেই বের করেনি। নিজ দায়িত্বে চাচীর ফ্ল্যাটে গিয়ে দিয়ে এসেছে। এই দুই মেয়ের মুখ চলে অতিরিক্ত, যা মাহারিনকে রাগিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। আজকের রাতটা একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায় সে, ব্যাস! আপাততর জন্য তার এইটুকুই চাওয়া।
পরেরদিন মাহারিনকে কল করলো তাহমিদ। মাহারিন কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাহমিদ বলল,
–“ফ্রি আছেন?”
মাহারিনের মনের কোণে সুপ্ত এক আশা ছিল যে, তাহমিদ তার শারীরিক অবস্থা কেমন জিজ্ঞেস করবে। এবারও তার আশা ধূলিসাৎ। তবুও নিজের রাগ বুকে চেপে বলল,
–“জি।”
–“তাহলে বিকালে তৈরি থাকবেন, মা আপনাকে নিয়ে শপিং এ যাবে। বাড়ি থেকেই পিক করে নিবে।”
মাহারিন জানতো শপিং এর কথা। সকালেই আয়েশা বেগম তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। সাথে এও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, যেন মাহারিন আর কোনো ত্যাড়ামি না করে। মাহারিন তাতে না চাইতেও রাজি হয়। এই পর্যায়ে তাহমিদও যে তাকে কল করে বলবে, বিষয়টা জানত না মাহারিন। সে বলল,
–“আগে থেকেই জানতাম, যাব।”
–“জানেন? তাহলে তো বেশ।”
–“তাহলে আপনি আলাদা করে কল দিলেন কেন?”
–“শিওর হয়ে নিলাম, আদৌ আপনি বিয়ে করবেন না বলে স্লিপিং পিল খেয়েছেন নাকি অন্য কারণে।”
মাহারিনের ভ্রু কুচকে যায়। বলল,
–“কারণ তো আপনিও হতে পারেন।”
ওপাশ থেকে আলতো হাসির শব্দ শোনা গেল। হাসি বজায় রেখেই তাহমিদ বলল,
–“আপনি এতটা বোকা নন মাহারিন, তা আমি জানি। সঙ্গে এটাও জানি আপনার অল্প বিদ্যার এই রাগ ভয়ঙ্কর।”
–“সবই যেহেতু জানেন, তাহলে বিয়ে করছেন কেন?”
–“আপনাকে বিয়ে করাটা আমার জন্য এডভেঞ্চারের মতো। এখন রাখি? আল্লাহ হাফেজ।”
খট করে কলটা কেটে দিতেই মাহারিন গরম চোখে তাকালো ফোনের স্ক্রিনে। এডভেঞ্চার মানে? সে কী ইনডিরেক্টলি তাকে অপমান করলো? মাহারিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। তার সাহস কী করে হলো বিয়েটাকে এডভেঞ্চার বলার? তাহমিদের কথার সুর এমন ছিল যেন মাহারিন জঙ্গলের কোনো এনা(!)কন্ডা। মাহারিন রাগের মাথায় মায়ের কাছে গেলো। আয়েশা বেগম তখন রান্না করছেন। মাহারিন সরু গলায় বলল,
–“আমি ঘুমের ওষুধ খেয়েছি এটা তাহমিদ সাহেবকে কেন বলতে গেলে আম্মা?”
আয়েশা বেগম নিরব, নির্বাক। তার অভিব্যক্তি এমন, যেন মাহারিনের কোনো কথা তার কানে পৌঁছায়নি। মাহারিন তখন রাগ রেখে হতভম্ভের পর্যায়ে চলে গেল। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, সে আদৌ আয়েশা বেগমের মেয়ে তো? নাকি সেএই পরিবারের অস্তিত্বহীন কেউ?
বিকালে সময় মতো মাহারিনের শাশুড়ি এবং ননদ চলে আসলো। তবে মাহারিনের জন্য আরেকটা চমক হচ্ছে তাদের সঙ্গে তাহমিদও এসেছে। তাহমিদের আসার কথা ছিল না, এ ভেবেই মাহারিন স্বস্তিতে ছিল। দুপুরে তাহমিদের বলা কথাতে সে এটা বুঝেছে তাহমিদ তাকে স্লিপিং পিল নিয়ে খোটা দিতে ছাড়বে না। মাহারিন কিছুতেই তার করা ভুলের কথা বারবার শুনতে রাজি না, ঠাট্টার সুরে তো একদমই না। কিন্তু ওইযে, কথায় আছে না.. অভাগী যেদিকে যায় সেদিকেই সাগর শুকায়?
তাহমিদ ড্রাইভারের পাশে বসেছে, আর মাহারিন তার শাশুড়ি ননদের সাথে পিছের সিটে বসেছে। তাহিয়া নানান গল্প করতে ব্যস্ত। সে বারবার তাহমিদের ব্যাপারে কথা বলেই যাচ্ছে। তাহমিদ নাকি বেশ ভালো ড্রাইভিং করতে জানে, কিন্তু এখন হাত ভাঙার কারণে ড্রাইভিং থেকে বিরতিতে আছে। মাহারিন এও জানতে পারলো তাহমিদের একটা ভাইও আছে। ভাইয়ের কথা শুনেছে বোধ হয় আগে। কিন্তু খেয়াল নেই। এবারও বিশেষ আগ্রহ দেখালো না। তাহমিদকে যেহেতু বড়ো ছেলে বলেছে সবাই তাহমিদের ভাইও হবে হয়তো ছোটো প্যাকেট। তাহিয়ার মতো কিংবা আরও ছোটো। এসব শুনতে শুনতে মাহারিনের হঠাৎ লুকিং গ্লাসে নজর যেতেই তাহমিদের সাথে চোখা-চোখি হয়ে যায়। মাহারিন অপ্রস্তুত হয়ে তৎক্ষনাৎ নজর সরিয়ে ফেলে। বুকের ভেতরটা এমন মুঁচড়ে উঠলো কেন তার?
শপিংমলে আয়েশা এবং মাহারিনের চাচীও যোগ দেয় শপিং এ। যেহেতু তাহমিদদের গাড়িতে জায়গা হয়নি তাই তারা ভিন্ন গাড়িতে এসেছে। হাতে যেহেতু সময় নেই তাই একসাথেই সব শপিং করার সিদ্ধান্ত নেয় দুই বাড়ি। সকলে একসাথে বিয়ের শপিং করলো। তাহমিদ মাহারিনের বিয়ের পোশাকগুলো চয়েজ করে দিয়েছে, মায়ের জোরাজুরিতেই। মাহারিন তাহমিদের করা চয়েজে ভীষণ অবাক হয়। প্রত্যেকটাই অদ্ভুত সুন্দর, তাহমিদের টেস্ট ভালো বোঝাই যাচ্ছে। মাহারিন চাইলেও তাদের বারণ করতে পারবে না। আবার এসব তার অপছন্দ হয়েছে এমনও নয়। তাই তাহমিদের পছন্দের পোশাকগুলোই কিনে নিয়েছে। তাহমিদ এর মধ্যে আরেকটা অবাক কান্ড করলো। মায়ের সামনেই বলল, তাহমিদের শেরওয়ানি, পাঞ্জাবি সব মাহারিনের পছন্দেই পরবে। এতে মাহারিন অল্প নয় বরং অনেকটাই অবাক হয়। এই মুহূর্তে তাহমিদের পক্ষ থেকে এমনটা আশা করাও যায় না। অগত্যা, মাহারিন নিজের চমক বজায় রেখে সব পছন্দ করে দিলো।
শপিং করে মাহারিন একপাশে ক্লান্ত হয়ে বসেছে। এ শো-রুম থেকে অন্য দোকান এমন করতে করতে সে ক্লান্ত। বাকিরা তখনো শপিং করতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাহারিনের পাশে এসে বসলো তাহমিদ। মাহারিন একপলক তাহমিদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। তাহমিদ নীরবতা ভেঙে বলল,
–“আপনার চয়েজ এত বাজে কেন? মেরুন কালারের পাঞ্জাবিটা একদমই সুন্দর না। আমি কত সুন্দর সুন্দর চয়েজ করে দিলাম আর আপনি কিসব চয়েজ করলেন!”
ধপ করে মাহারিনের মাথায় রাগ উঠে গেল। তাহমিদের দিকে ফিরে নাক ফুঁসিয়ে মাহারিন বলল,
–“আপনার চয়েজ আরও বাজে। আমারও আপনার পছন্দের একটা শাড়িও পছন্দ হয়নি। এত বড়াই আসে কোত্থেকে আপনার?”
তাহমিদ হাঁটুতে কনুইয়ের ভার দিয়ে বসে। হাতের চার আঙুল অধরের কাছাকাছি। ঘাড় আলতো বাঁকিয়ে মাহারিনের কোনো কথা তোয়াক্কা না করে বলল,
–“বাইরে যাবেন? হাঁটা দিয়ে আসি চলেন।”
চলবে—