#মায়াতলীর_মোড়ে – [০৮]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
–“হবু বরকে ব্লক করে রেখেছেন কেন?”
মাহারিন তাহমিদের এই প্রশ্নে উত্তর না দিয়ে পালটা শুধালো,
–“আপনি আমার হবু বর, সেটা এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে? আমি কিন্তু এখনো এই বিয়েতে রাজি নই।”
তাহমিদ ভ্রু কুচকে তাকাল মাহারিনের দিকে। মাহারিন আবার বলল,
–“আপনি কী করে জানলেন আমি এখানে?”
এমন সময়ই তাহমিদের পেছন থেকে একটা ছেলে এসে মাহারিনকে সালাম দিলো। মাহারিন বোকার মতো সালামের উত্তর দিলো। ছেলেটা তাহমিদের বয়সী। সে এক গাল হেসে বলল,
–“ভালো আছেন ভাবী? আমার নাম আকিব। আমি তাহমিদের বন্ধু। একদম ছোটো থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব।”
অপরিচিত একজনের মুখে ‘ভাবী’ ডাক কেমন অদ্ভুত শোনায়। বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতোই লাগল মাহারিনের নিকট, অনুভূতি অবশ্য মন্দ নয়। তাহিয়াও তাকে ভাবী ডাকে। মাহারিনের হঠাৎ এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে কেন? এসব অনুভূতি তো নিব্বি বয়সেই রঙিন লাগে। মাহারিন সৌজন্য হেসে বলল,
–“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া, আপনি কেমন আছেন?”
–“জি ভালো ভাবী। কিছুদিন আগেই বিয়ে করেছি আমি, এখন আবার বন্ধুর বিয়ে খাব! বলতে পারেন দুই আনন্দ জীবনে একসাথে এসেছে।”
বলেই তাহমিদের কাঁধ চাপড়ে হাসলো আকিব। আকিবের কথা বলার ধরণেই বোঝা যাচ্ছে, ভীষণ মিশুক সে। তাহমিদ আকিবের দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“হ্যাঁ, তোর বিয়ের চক্করেই তো আমার হাত গলায় ঝুলিয়ে চলতে হচ্ছে।”
মাহারিন তাহমিদের কথাটা শুনতে পেল। পরপর অবাকও হলো। তাহমিদের হাত ভাঙার সাথে আকিবের কী সম্পর্ক? আকিব অবশ্য এই মুহূর্তে ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলো। এমন সময়ই বর্ষা এলো তার জামা-গুলো নিয়ে। এসে তাহমিদকে দেখে ভীষণ চমকে যায়। ক্ষণিকেই চোখ জোড়ায় প্রফুল্লতা ফুটিয়ে বলল,
–“আরে তাহমিদ ভাইয়া! আপনি এখানে?”
তাহমিদ বর্ষাকে দেখে বিনয়ের সাথে হেসে বলল,
–“হ্যাঁ, এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। পরে এদিকে চোখ যেতেই দেখি তোমার আপুকে কেউ টিজ করছে। আর কী, নেমে পড়লাম। সুন্দরী বউ তো আমার, দেখে রাখতে হবে।”
বর্ষা অবাক হয়ে মাহারিনের দিকে চাইতেই মাহারিন চোখের ইশারায় জানালো, এরকম কিছুই নয়। আকিব বলল,
–“আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমার গাড়িতে আসেন, আমি আপনাদের বাড়ি নামিয়ে দিচ্ছি।”
মাহারিন কিছু বলার আগে বর্ষাই মত জানিয়ে আকিবের সাথে সাথে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। এই সময়ে এখান থেকে রিকশা, সিএনজি কিছুই সহজে পাওয়া যায় না। তাই সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্নই আসে না। মাহারিন, তাহমিদ পিছে ছিল। তাহমিদ আবারও গলা নামিয়ে বলল,
–“ব্লক খুলে দিন।”
–“দিব না।”
–“না দিলে আগামীকাল আপনাদের প্রোগামে চলে আসব। বড়োদের সামনে বলব আপনি ডেকেছেন।”
মাহারিন বড়ো বড়ো চোখে তাকালো তাহমিদের দিকে। কী মারাত্মক লোক রে বাবা। মাহারিন তৎক্ষণাৎ ফোনটা বের করে ব্লকগুলো আনব্লক করলো। তাহমিদ ফোনের দিকে তর্জনী তুলে বলল,
–“টেলিগ্রামেরও ব্লক ছুটান।”
মাহারিন বিরক্ত হয়ে বলল,
–“এত সোস্যাল এপে আছেন কেন?”
–“আপনি আছেন তাই। আপনারও তো কত স্পর্ধা, সব জায়গা থেকে ব্লক দিয়েছেন। ধৈর্য আছে বলতে হবে।”
অগত্যা, ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে তাহমিদ ব্লক ছুটায় মাহারিনকে দিয়ে। অবশ্য এক দোকান থেকে টুকটাক স্ন্যাকসও কিনে দেয়। মাহারিন নিতে চায়নি বলে তাহমিদ সেগুলো নিয়ে গাড়িতে উঠে বর্ষার হাতে দিয়ে দেয়। অতঃপর তাকে বলল,
–“এগুলা তোমার আপুর এবং তোমাদের। আপুর খাবার ঘর অবধি পৌঁছে দেওয়া তোমার দায়িত্ব, বুঝলে?”
বর্ষা খুশি হয়ে বলল, “কাজ হয়ে যাবে ভাইয়া।”
পুরো রাস্তা আকিব, বর্ষা বকবক করে গেলো। তাদের কথাবার্তায় বোঝা গেল তাহমিদের হাত ভাঙার পিছে আকিবও কোনো না কোনো ভাবে জড়িত। আর তাহমিদের ভাইয়ের ব্যাপারেও আলোচনা হলো। তাহমিদের ভাইও নাকি আকিবের বন্ধু, এবং তারা তিন জন নাকি একসাথেই পড়াশোনা করেছে, বড়ো হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, মাহারিন এখন পর্যন্ত তাহমিদের সেই ভাইকে দেখেনি। কিঞ্চিত কৌতুহল হলো বটে, তবে প্রশ্ন করতে পারলো না। বর্ষাকেও বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি এ বিষয়ে। সে যাই হোক, আশা করছে সামনের প্রোগ্রামগুলোতে তাহমিদের সেই ভাইকে দেখতে পাবে সে।
পরেরদিন তেলোয়ায় অনুষ্ঠান। চট্টগ্রামের অন্যতম রীতির মধ্যে পড়ে এটি। গতকালই অধিকাংশ মেহমান এসে ভীড় জমিয়েছে মাহারিনদের বাড়ি। মাহারিনকে তাহমিদ বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পরেই মেসেজ করেছিল। মেসেজটি ছিল এমন,
–“আপনি আনব্লক করেছেন, এবার ব্লক করার পালা আমার। আমি চাই না শুভ কাজে আপনার ‘বিয়েতে রাজি না’ কথাটি আবারও শুনতে। এই দুদিন রঙিন স্বপ্ন বুনতে দিন, আপনি তো আর বুনবেন না.. তাই আপনার ভাগের স্বপ্নটাও আমাকেই বুনতে হবে। আপনাকে বঁধুবেশে দেখার অপেক্ষায় রইলাম মাহারিন।”
মেসেজটার পরপরই তাহমিদ তাকে ব্লক করেছে। সব জায়গাতে নয়, শুধুমাত্র নাম্বার এবং হোয়াটসএপে। তাহমিদের করা কাণ্ডে মাহারিন কিছুক্ষণ থ হয়ে ছিল। মাথা ভর্তি রাগ তার টগবগ করছিল। উনি কী পাগল?
মাহারিনের রাগ আজও কমেনি। মাহারিনকে ক্ষেপে থাকতে দেখে তুলি বলল, “আপু, গোসলের সময় মাথায় বেশি বেশি ঠান্ডা পানি ঢেলো। ট্রাগ নেমে যাবে।”
মাহারিন গরম চোখে তুলির দিকে তাকাতেই তুলি সেই মুহূর্তে কেটে পড়েছে। মাহারিনকে সকাল সকাল তৈরি হতে হয়েছে। হলুদের মধ্যে সাদা জরির সুতি শাড়ি পরেছে সে, এর সাথে হালকা মেকআপ এবং তাজা রজনীগন্ধার অলংকার পরেছে। হাতে সাদা, হলুদে মিশ্রণের রেশমী চুরি। মাহারিনকে সাজিয়ে দিয়েছে তারই এক কাজিন।
তেলোয়ায় অনুষ্ঠান ঘরোয়া পরিবেশে হবে। এখানে শুধু ঘরের মেয়েরাই উপস্থিত আছে। মাহারিনকে নির্ধারিত এক পীড়ায় বসিয়েছে। তাকে ঘিরে বড়োরা অর্থাৎ চাচী, দাদী, ফুপি, মামীরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে কুলো নিয়ে তাদের রীতিতে মিনমিন করে কিসব বলছে। মাহারিন তার দুর্সম্পর্কের এক আত্নীয়র বিয়েতে এই নিয়ম-নীতি দেখে চমকে গেছিল। সেই স্থানে আজ মাহারিন নিজে বসে আছে। চারপাশে সবার কোলাহল, গোল হয়ে থাকা তাদের উচ্চারণে মাহারিনের মাথা ধরে এলো। তেলোয়ায় নিয়ম শেষ হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। অতঃপর সকলে মিলে যে, যেভাবে পারছে মাহারিনকে হলুদ দিয়ে দিচ্ছে। মাহারিন এতে ভীষণ বিরক্ত, কিছুক্ষণ আগে বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে মায়ের চোখ রাঙানির স্বীকার হয়েছে। নির্ঘাত চাটগাঁইয়া ভাষায় তাহলে বকা দিতে ভুলেনি। আয়েশা বেগম রেগে গেলে ঝড়ঝড় করে আঞ্চলিক ভাষা বলেন, এটা তার অন্যতম স্বভাব।
হলুদের পর বারান্দায় তার মাথায় পানি ঢালা হলো। এরপরই মাহারিন বড়োদের থেকে ছাড়া পেয়েছে। বারান্দায় যাওয়ার আগে তার সাথে টুকটাক ছবি তোলার পর্বও সেরে নিয়েছে কাজিনরা।
লম্বা গোসল দিতেই মাহারিনের মাথার ভারী ভাবটা হালকা হয়ে এলো যেন। কেমন সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। নিজের বিছানায় অর্ধেক জায়গা খালি আছে। সেই অর্ধেকেই গা এলিয়ে দেয় সে। মাহারিনের মামাতো বোন রুহি ভ্লগ ভিডিও বানায়। মোটামুটি লাখখানেক ফলোয়ার আছে তার। ভিডিও আপলোডেও রেগুলার। মাহারিনের আবার ক্যামেরার সামনে লোক দেখানো একদম পছন্দ নয়। এজন্য রুহিও কখনো সাহস করেনি মাহারিনের কাছ ঘেঁষার। কিন্তু এখন স্বয়ং মাহারিনেরই বিয়ে। সেই উপলক্ষ্যে মাহারিনের অল্পস্বল্প ক্লিপ ভিডিওতে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।
কাজিনদের মধ্যে মাহারিনই একটু গরম মেজাজের, এজন্য কম-বেশি প্রত্যেকেই মাহারিনের অপছন্দের কাজগুলো না করার চেষ্টা করে। মাহারিনও যে তাদের পছন্দ-অপছন্দে নাক গলায় এমনও নয়, যথেষ্ট স্পেস দেয় সকলকেই।
ঘড়ির কাঁটা দুপুর দুটোয়। নিভু নিভু চোখে মাহারিন ফোন স্ক্রল করছে। এর মাঝে বর্ষার একাউন্টে দেখলো ছবি ইতিমধ্যে আপলোড শুরু করে দিয়েছে সে। মাহারিন কী ভেবে যেন রিয়্যাক্ট সেকশন চেক করল, কাঙ্খিত একজনের খোঁজে। এ কী, তাহমিদের রিয়্যাক্টও আছে। আনমনে তাহমিদের আইডিতে ঢুকতেই দেখলো বান্দার ছবির পাশে সবুজ বাতি জ্বলজ্বল করছে। এই লোক তাকে ব্লক করে দিব্যি আছে তবে! ঠিক আছে, থাকুক। মাহারিনও এর শেষ দেখে ছাড়বে। মাহারিনের চোখ জোড়া থেকে যেন আচমকাই ঘুম উড়ে গেল রাগের চোটে। রুহির গলায় ধ্যান ভাঙলো।
–“ফোনে কাকে দেখে আবার রাগ ঝাড়ছ আপু?”
রুহির কথার মধ্যেই আরেকজন বলল,
–“কাকে আবার? দুলাভাইকে নিশ্চয়ই! বেচারার জন্য খুব মায়া হয়। সেধে সেধে বোম ঘরে নিচ্ছে।”
মাহারিন তৎক্ষণাৎ উঠে বসে কঠিন বকা দিলো রাইমাকে।
–“দেয়ালের সাথে মাথায় একটা দিলে দুলাভাইয়ের প্রতি দরদ কেটে যাবে। বিয়ে খেতে এসেছিস চুপ করে বিয়ে খা।”
রাইমা মুখ ভেঙিয়ে বলল,
–“বিয়ে আবার চুপ করে খাওয়া যায় নাকি? এখনো তো আসল প্রোগ্রাম গুলো আসলোই না। ধুর ধুর, সময় যেন কাটছেই না।”
আরেকজন রাইমার কথা শুনে বলল,
–“চল, রাতে কিছু একটা করি।”
–“কী করা যায়?”
সবাই মিলে ভাবনায় বসলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু বের করতে পারলো না। সবার ভাবনার মাঝেই দুপুরের খাবারের জন্য ডাক পড়ল।
রাতে রুম অন্ধকার করে বারান্দায় বসে আছে মাহারিন। আগামীকাল তার জন্য বিরাট কঠিন একটি দিন। সে এখনো বাবার সিদ্ধান্ত মানতে পারছে না, বিয়েটা সুখকর হবে কী করে? দুশ্চিন্তায় মাহারিনের কপালে ভাঁজ পড়েছে। কী করা উচিত এই মুহূর্তে? পালিয়ে যাবে? গিয়েও তো বিশেষ লাভ নেই। বাবার সম্মানহানি হবে।
মাহারিনের ভাবনার মাঝেই মোরশেদ সাহেব আসলেন। মাহারিন বাবাকে দেখে কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। বারান্দায় দুটো চেয়ার আছে। মাহারিনের পাশের চেয়ারেই মোরশেদ সাহেব নিঃশব্দে বসলেন। শব্দহীন নিঃশ্বাস ফেললেন আরও মিনিটখানেক। বারান্দাজুড়ে পিনপতন নীরবতা। মোরশেদ সাহেব নীরবতা ভেঙে চিরচেনা সেই সুরে বললেন,
–“আমার একমাত্র মেয়ের বিয়েতে আমি কোনো কমতি রাখিনি। নিজের সর্বস্ব দিয়ে তার বিশেষ দিনগুলোকে মধুর স্মৃতি হিসেবে জড়ো করতে চাই।”
মাহারিন নিশ্চুপ। আবারও ঘন নীরবতা। অদূর থেকে যানবাহনের টুকটাক শব্দ কানে ভেসে আসছে। হালকা, শীতল হাওয়া এসে ধাক্কা দিচ্ছে দুজন মানুষের দেহে। মোরশেদ সাহেব ফের নীরবতা ভেঙে বললেন,
–“মেয়েরা হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। সিন্দুকে গুছিয়ে রাখার মতো। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুন্দর হিরের থেকেও মেয়েরা দামী। মেয়ের বাবা হওয়াটাও সৌভাগ্য। মেয়েকে অত্যন্ত নাজুক, আদর-যত্নে বড়ো করে তুলি। এমন ভাবে মেয়েকে বড়ো করেছি যে তার গায়ে সামান্য আঁচড়ও পড়তে দেইনি। তোমার গায়ে নখের আঁচড় লাগলেও আমার হাঁসফাঁস লাগত, রাতে ঘুম হতো না। পরেরদিন প্রেশার মাপালে দেখলাম প্রেশার হাই।তোমার মা তো তখন কান্নাকাটি পর্যায়ে।”
ভদ্রলোক সামান্য হাসলেন। মাহারিন চুপসে আছে। চোখের পাতায় ভেসে উঠলো ছোটোবেলার এক দৃশ্য। তখন মাহারিন ক্লাস ফাইভে ছিল। সেদিন ছুটির সময় আয়েশা তাকে আনতে যেতে পারেনি। এজন্য মাহারিন নিজে নিজেই বাড়ির পথে রওনা হয়। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ কার সাথে যেন ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেল। হাঁটু ছিলে গেল, হাতে অল্প পেরেক ঢুকে যাওয়ায় রক্ত বেরোচ্ছিল। রক্ত দেখেই মাহারিন কেঁদে-কেটে দ্রুত বাসায় চলে গেল। মাহারিনের কথা শুনে মোরশেদ সাহেব তৎক্ষণাৎ থানা ছেড়ে বাসায় আসলেন। মেয়ের চাইতেও পেরেশানি বেশি ছিল তার। মাহারিন তখন কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে বাবাকে দেখছিল। সে রাতে মাহারিনের জ্বর এলো।পুরো রাত এক ভাবেই মাহারিনের পাশে বসে ছিলেন মোরশেদ সাহেব। জীবনে বাবার সাথে মাহারিনের সুন্দর স্মৃতির অভাব নেই। সব সুন্দর স্মৃতিগুলোই একে একে ভীড় জমাতে লাগে মাহারিনের চোখের পাতায়।
মোর্শেদ সাহেব বললেন,
–“আমার এতকিছুর মধ্যেও চিন্তা হতো, তোমাকে যতটা ভালোবাসায় বড়ো করেছি ততটা ভালোবাসা আদৌ বিয়ের পর পাবে তো? এই চিন্তা বোধ হয় সব বাবাদেরই হয়। আমিও তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম নই। আমার কাউকেই মনে ধরছিল না। আল্লাহর কাছে কত দোয়া করলাম, জীবনের সবটা দিয়ে দোয়া করলাম যেন আমার একমাত্র মেয়েটাকে দুঃখ স্পর্শ করতে না পারে। একটা ভালো পরিবারের চাইতে যেন ভালো একজন ছেলে আমার মেয়ের জীবনে আসে। এজন্য তোমার খুবই সেন্সিটিভ বয়সটায় তোমার উপর গোপনে নজর বসিয়ে দিলাম। তুমি কারো সাথে জড়ানোর আগেই আমি ভালো ভাবে ছেলেগুলোর খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নিতাম।”
মোরশেদ সাহেব থামলেন। আজ যেন তার মনের কথাগুলো ধীরে-সুস্থে ঝেড়ে দিচ্ছেন, জমানো কথাগুলো বলার জন্য যে হাতে বেশ সময় নিয়ে বসেছেন বোঝা গেল। মাহারিন চুপ। মোরশেদ সাহেব রয়েসয়ে বললেন,
–“মূল্যবান মেয়েদের ইজ্জতের চাইতে দামী জিনিস আর কিছুতে নেই। তাই জীবনের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মেয়েকে খারাপ নজর থেকে দূরে রাখা। যখন থানায় রেপ কেইস আসে, আমার ভেতরটা ছিঁড়ে যায়, নিংড়ে যায় মা। আমিও যে একজন মেয়ের বাবা।”
ছলছল করে উঠে মাহারিনের চোখ জোড়া। শেষের দিকে মোরশেদ সাহেবের কণ্ঠস্বরে যেন কতশত বাবার হাহাকার মেশানো ছিল। হৃদয় নিংড়ানো পরিস্থিতি।
–“একটা ছেলের একটি মেয়েকে জীবনে জড়াতে হলে তাকে কতশত মর্যাদা দিতে হয়। মোহরানা, পত্যক্ষ সক্ষী, ভরণপোষণের দায়িত্ব, ইজাজত, ওয়ালিমা, জীবনের নিরাপত্তা। এসবকিছুই একটা মেয়ের প্রাপ্য, মেয়েকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়ার পরেই তাকে ঘরে তুলতে হয়। কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ তরুণদের মধ্যে সেসব দেখা যায় না, কিংবা তারা সেই মূল্যবোধ দিতে জানে না। একটা ফুলের মধ্যে দিয়েই যদি একটা মেয়ের মন জয় করা যায়, তাহলে এত এত মর্যাদা কাদের জন্য?
তাহমিদ তোমাকে ফুল দেয়নি, তবে তোমায় স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা দিতে এসেছে। তুমি-ই বলো তো মা, আমি কাকে মেনে নিতাম? ফুল দিয়ে বেড়ানো ছেলেটাকে নাকি হালালরূপে তোমাকে সমাজের মধ্যে অনিন্দ্য মর্যাদা দিতে চাওয়া ছেলেটাকে?”
মাহারিন এবারও কিছু বলতে পারলো না। মোরশেদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর মেয়ে বুদ্ধিমতী, তবে জেদের বশে মাঝেমধ্যে ভুল করে বসে। তবুও তিনি আশাবাদী, তাঁর মেয়ে তাকে নিরাশ করবে না। শেষবারের মতো বললেন,
–“রাতটা ভাবার সময় দিচ্ছি। যদি আগামীকাল সকালেও তোমার মত না পালটায়, তবে আমি কথা দিচ্ছি। ভরা সমাগমের মাঝেই বিয়ে ক্যান্সেল করে দিব, মা। এখনো সিদ্ধান্ত তোমার হাতেই আছে, কেউ কোনোকিছু তোমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে না।”
মোরশেদ সাহেব আরও কিছুক্ষণ মেয়ের পাশে বসলেন। না জানি আবার কবে সুযোগ হবে মেয়ের পাশে এভাবে বসার? বিয়ের আগে বোধ হয় এবারই শেষ মেয়ের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে গল্প করা। দুজনের নীরবতার মাঝেই রাইমার কণ্ঠ ভেসে আসলো। ফিসফিস করতে করতে বারান্দার দিকেই আসছে।
–“আহা, এমন করছ কেন? আপুর বিয়ে.. এজন্যই তো তোমাকে সময় দিতে পারছি না। সেদিনই না দেখা করলাম? এখন কীভাবে পারব? ভালোবাসি বললাম তো জান, আর…”
রাইমা বারান্দায় প্রবেশ করতেই তার বলতি বন্ধ হয়ে গেল। বাহির থেকে আসা আবছা আলোয় দেখতে পেলো মাহারিন, মোরশেদ সাহেব চেয়ার পেতে বসে। দুজনের নজরই রাইমার দিকে। রাইমার বুকটা ধ্ক করে উঠলো। অনুভব করলো হাঁটু জোড়া অসম্ভব কাঁপছে। ফোনের ওপাশ থেকে অস্পষ্ট ফোনে চুমু দেওয়ার শব্দ ভেসে আসছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে রাইমা নড়তে তো ভুললোই সাথে মস্তিষ্ক অচল।।
চলবে—