মায়াতলীর মোড়ে পর্ব-১২

0
24

#মায়াতলীর_মোড়ে – [১২]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

পরেরদিনই হলুদের অনুষ্ঠান। সকালে উঠতেই মাহারিন দেখতে পেল তার হাতের মেহেন্দির রং একদম লাল টকটকে হয়েছে। মাহারিনের বোনেদেরও সেই রং নজর এড়ায়নি। রাইমা তো বেফাঁস বলেই বসলো,
–“আমাদের হাত ভাঙা দুলাভাই তো দেখছি মাহারিন আপুকে ভালোবাসায় ভরিয়ে ফেলবে।”

এহেম কথায় রাইমা যে মার খাবে না, এটা অস্বাভাবিক। পিঠের উপর এক ঘা দিয়ে মাহারিন চোখ রাঙিয়ে বলল,
–“একদম বাজে বকবি না।”

রুহি বলল,
–“বাজে কথা কোথায় আপু? তোমার মেহেন্দির রঙই তো যা বলার বলে দিচ্ছে।”

–“এসব কুসংস্কার।”

রাইমা নাক ফুলিয়ে বলল,
–“হ্যাঁ, সব ভালো কথাই তো তোমার জন্য কুসংস্কার। যখন তাহমিদ ভাইয়ের হাতে পড়বে তখন এসব ভালোবাসাই লাগবে।”

মাহারিন চোখ রাঙিয়ে বলল,
–“চুপ করবি নাকি তোর মাকে গিয়ে বলব?”

রাইমা মাহারিনের ইঙ্গিত বুঝলো। এক লহমায় রাইমা হাসি হাসি মুখে বলল,
–“মজা করছিলাম। আসলেই সব কুসংস্কার। তবে আমার বেলায় সেসব আসলই হবে। শুধু তোমার বেলায় কুসংস্কার মাহারিন আপু!”

রাইমা টেনে টেনে কথাগুলো বোঝানোর অর্থে বলল। সে কথা শুনে রুহি, নাজিয়া, বর্ষা সবাই একই সুরে হেসে দেয়।

এর মাঝে মামী আসেন ঘরে। এসে মাহারিনের হাত দেখে দুষ্টুমি ভরা গলায় বললেন,
–“আমাদের মাহারিন তো দেখছি স্বামীর সোহাগ পাবে।”

এই মুহূর্তে এসে মাহারিন চুপসে গেল। ওরা নাহয় বোন বলে ধমকাতে পেরেছে। মামীকে তো আর কিছু বলতে পারবে না। মাহারিনের এই অবস্থায় ওর পাশের সবাই মিটিমিটি করে হাসলো।

হলুদের অনুষ্ঠান বেশ সুন্দর করে সমাপ্ত হয়। আর মাত্র একটা রাত, এরপরই মাহারিন তার নিজের বসত ছেড়ে চলে যাবে অন্যের বসতে। সেখানেই মৃত্যুর আগ অবধি তাকে বসত গড়তে হবে। আর চিরচেনা এই বাড়িটায় শুধু মেহমান হয়েই আসতে পারবে। মাহারিন জানালা দিয়ে অদূরে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আহারে মেয়েদের জীবন। যত আহ্লাদী মেয়েই হোক না কেন, শ্বশুরবাড়িতে তাকে যেতেই হবে। সে আগে হোক কিংবা পরে।

অর্ধেক রাত অজানা যন্ত্রণায় মাহারিন ঘুমাতে পারলো না। এই যন্ত্রণা তার চিরচেনা রুম, বাবা-মাকে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। হলুদের সময় দেখেছিল তার শক্তপোক্ত মা কেমন আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে। একমাত্র মেয়ে মাহারিন, মাহারিনের এও চিন্তা হয়.. সে চলে গেলে তার বাবা-মাকে কে দেখে রাখবে?

রাতে দেরীতে ঘুমালেও সকাল সকালই উঠতে হয় মাহারিনকে। মাহারিনকে ছাদে নিয়ে হলুদ দিয়ে আবারও গোসল করানো হয়। মাহারিন একদম গোসল সেরে ভেজা চুলে সকালের নাস্তা খেতে বসে। মাহারিনের নাকে জ্বলজ্বল করছে সোনালী নথ। কেমন যেন বউ বউ আভা ফুটেছে তার সমস্ত মুখ জুড়ে। তুলি মাহারিনের দিকে একমনে চেয়ে আছে। তুলি এহেম চেয়ে থাকা দেখে মাহারিন ভ্রু কুচকালো। তুলির দিকে চেয়ে বলল,
–“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”

–“দেখছি তোমাকে আপু।”

–“আগে দেখিসনি?”

–“দেখেছি। তবে আজ তোমাকে আলাদা লাগছে। তুমি মুখে কিছু দাওনি, তাও তোমার মুখে কেমন বউ বউ আভা লেপ্টে আছে। মনে হচ্ছে আজকে বউ সাজলে তোমাকে সবথেকে বেশি সুন্দর লাগবে।”

মাহারিন তখন সরু চোখে চেয়ে আছে তুলির দিকে। তুলি অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
–“সত্যি বলছি, এভাবে তাকাও কেন?”

–“সত্যি বলা শেষ?”

তুলি মাথা নাড়ায়।
–“এবার খেতে যা।”
তুলি যেতেই মাহারিন বিছানার উপরে প্যাকেটে মুড়ানো লাল টকটকে গাউনটায় নজর বুলালো। খাবার চিবুতে চিবুতে একমনে চেয়েই রইলো। কিছুক্ষণ পর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল।

তুলির কথা অবশ্য সত্যিই ফলে যায়। মাহারিনকে আসলেই আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে, একদম বউ। মাহারিন নিজেও নিজেকে চিনতে পারছে না। লাল গাউনের সাথে সব ম্যাচিং জুয়েলারি। গলায় দুটো মাত্র হার। কানে বড়ো দুল জোড়া এবং মাথায় বড়ো টিকলি। নাকে টানা নথটাও রয়েছে। হাতজুড়ে ম্যাচিং চুড়িও রয়েছে। মাথায় যখন দোপাট্টাটা পরিয়ে দিচ্ছিল তখনকার সময়টা মাহারিনের জন্য বেস্ট অনুভূতি ছিল, এটা মাহারিন কখনো অস্বীকার করতে পারবে বা।

মাহারিনকে ঘণ্টাখানেক বাদেই নিচে স্টেজে নিয়ে যাওয়া হলো। মাহারিন স্টেজের নির্ধারিত চেয়ারে বসতেই বরপক্ষ আসার শব্দ শুনতে পায়। এবার স্পৃহাও গেট ধরতে যায়। বিয়েতে গেট ধরার মজাই আলাদা। বেশ কিছুক্ষণ পর হিসাব-নিকাশ সেরে অবশেষে বরপক্ষ ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলো। তাহমিদকে অদূরেই দেখতে পায় মাহারিন। সাদা পাজামার সাথে অফয়েড শেরওয়ানি পরেছে তাহমিদ। বাম হাতে কালো বেল্টের ঘড়িটা জ্বলজ্বল করছে। মাহারিনের মতোই তাহমিদকেও আজ অন্যরকম লাগছে। একদম বর, বর।

হঠাৎ পাশ থেকে কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল,
–“কী, জামাইকে দেখা হচ্ছে? দেখো তবে একটু কম করে দেখিও, রাতে তো সামনেই থাকবে।”

মাহারিনের বিরক্ত লাগলো এই ধরণের কথা-বার্তা শুনে। এভাবে খুঁচিয়ে, টেনে বলা কথাগুলো ইদানীং এত শুনতে শুনতে সে বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। মাহারিন তো আর তাহমিদের সাথে সুখের সংসার করতে যাচ্ছে না, তাহলে এসব শুনানোর মানে কী? সে মোটেও লজ্জায় লাল হওয়া মেয়ের কাতারে পড়ে না। তবে এই মুহূর্তে ভদ্রতার খাতিরে সে চুপ থাকলো। মাহারিন কিছু পারুক কিংবা না পারুক, যেকোনো পরিস্থিতিতেই নিজেকে সামলে রাখার গুণ আছে তার মধ্যে।

তাহমিদ লাল কার্পেটে হেঁটে একদম মাহারিনের পাশে এসে বসলো। তাহমিদের সাথে তার বন্ধু, কাজিনরাও আছে। তাহিয়া এসে মাহারিনকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে বলল,
–“তোমাকে কত সুন্দর লাগছে ভাবী। একদম মেড ফর ইচ আদার লাগছে। ফাইনালি আজ তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে!”

মাহারিন মুখে শুকনো হাসি ফোটালো। হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন খেলে গেল। আদৌ কী তারা “মেড ফর ইচ আদার”?

তাহমিদের বাবা তারেক সাহেব স্টেজে উঠে আসলেন। মাহারিনের মাথায় স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে বললেন,
–“তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে মা।”

আরেক বাবার এহেম যত্নে মাহারিন একদম মিইয়ে গেল যেন। শ্বশুরকে চওড়া হাসি দিয়ে তার সাথে হালকা কুশল বিনিময় করলো। তারেক সাহেব হেসে বললেন,
–“তোমার শ্বাশুড়ি বাড়িতেই রয়েছেন, তোমাকে বরণ করতে প্রস্তুত সে। আমাকে আসার আগে পইপই করে বলে দিয়েছে যেন বউমাকে নিয়ে দ্রুত ফিরি।”

খাওয়ার আগে বেশ কিছু ফটোসেশন হলো বর-বউয়ের। মাহারিন যখন তাহমিদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছিল তখন হঠাৎ-ই তাদের চোখা-চোখি হয়। তাহমিদ কেমন অনিমেষ চেয়ে আছে মাহারিনের দিকে। এতে মাহারিন অপ্রস্তুত অনুভব করে। কাছাকাছি থাকায় মাহারিন বলল,
–“এভাবে চেয়ে আছেন কেন?”

তাহমিদ নজরের নড়চড় না করে বলল,
–“দেখছি একজন লাল টুকটুকে বউকে।”

–“দেখার অনুমতি নেই।”

তাহমিদের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল। বলল,
–“তুমি অনুমতি দেবার কে, যেখানে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তোমাকে দেখার অনুমতি দিয়েছে?”

মাহারিন থতমত খেল তাহমিদের কথা শুনে। খাবারের জন্য ডাকতেই মাহারিন এক ঝটকায় তাহমিদের থেকে সরে এলো। আজ অবশ্য মাহারিনের তাহমিদকে খাইয়ে দিতে হলো না। তাহমিদ বাম হাতে চামচেই বেশ আরামে খেয়েছে। খাওয়ার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে এতদিনে বাম হাতে চামচ দিয়ে খাওয়া বেশ আয়ত্ত করে নিয়েছে।

——————————
মাহারিন শক্ত হয়ে গাড়িতে বসে আছে, তাহমিদের পাশে। মাহারিনের গাল ভেজা, সঙ্গে চোখের পানির চিহ্ন। আসার সময় মাকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছে সে। বাবাকেও আজ প্রথমবারের মতো সে কাঁদতে দেখেছে। ছোটো তুলি, বর্ষাও আজ কেঁদেছে, তাদের মাহারিন আপুকে জড়িয়ে। ছোটো থেকে মাহারিনের ছায়াতেই ওরা বড়ো হয়েছে। হয়তো মাহারিনের হাতে মার খেত, সে তাদের ধমকাত, তবুও এক বুক ভালোবাসাও তো দিয়েছে।

তাহমিদ মাহারিনকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়। মাহারিন বোতলটা হাতে ধরতেই দেখলো ঠান্ডা। তাহমিদ আগেই তার এক বন্ধুকে দিয়ে দুই বোতল ঠান্ডা পানি আনিয়ে রেখেছিল। এই গরমের মধ্যে ঠান্ডা পানিকে না করলো না মাহারিন। বোতলের মুখ খুলে আধ বোতল পানি খেয়ে শেষ করলো সে। মাহারিন আড়চোখে তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ গাড়ির ফন্টসিটে বসা বন্ধুর সাথে কথা বলছে।

এক ঘণ্টার রাস্তা পার করে অবশেষে এক বড়ো গেট দিয়ে মাহারিনদের গাড়ি প্রবেশ করলো। মাহারিন সামান্য উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো চারপাশ। যা বুঝলো, তার সামনেই বেশ বড়ো ডুপ্লেক্স বাড়ি। তাহমিদ মাহারিনকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করলো। মাহারিনের চোখ ঘুরিয়ে দেখলো বড়ো, মরিচবাতির একেক আলোতে সাজানো বাড়িকে। তাহমিদ মাহারিনের কানে ফিসফিস করে বলল,
–“এত বড়ো বাড়ির বড়ো বউ তুমি। তেল বেরিয়ে যাবে একদম!”

মাহারিন চোখ রাঙিয়ে তাকায় তাহমিদের দিকে। তাহমিদ সেই নজরের জবাবে চোখ টিপ দেয়। মাহারিনকে বিরাট সদর দরজার মুখে দাঁড় করানো হলো, তাহমিদ তার পাশেই। মাহারিন শুনেছিল তারেক আঙ্কেল একজন শিল্পপতি। তাই এই বাড়ি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাহমিদের মা অর্থাৎ পারভীন ডালা নিয়ে নতুন বউকে বরণ করলেন। ভদ্রমহিলার মুখজুড়ে জয়ের হাসি লেপ্টে আছে। আত্নীয়-স্বজন, প্রতিবেশিরা চেয়ে চেয়ে দেখছে নতুন বউকে। মাহারিন এত দিকে ধ্যান না দিয়ে বরণ করা কৌতুহলের সাথে দেখছে।

বরণ শেষ হতেই একজন দাদী জানালো তাহমিদ যাতে নতুন বউকে কোলে তুলে ভেতরে প্রবেশ করে। এটা তাদের বংশের পুরানো নিয়ম। এ কথা শুনে মাহারিন আঁতকে উঠে, এ দাদী বলে কী? মাহারিনের আবার সেই সময়েই খেয়ালে এলো, তাহমিদের তো এক হাত ভাঙা। সে চাইলেও ভারী কিছু তুলতে পারবে না। মাহারিন এই পর্যায়ে মুখ টিপে হাসলো। বেশ হয়েছে, একদম।

তবে মাহারিনকে চমকে দিয়ে তাহমিদ তার কোমড় ধরে এক হাতেই তুললো। শুধু কিছুটা আলগা করে তুলেছে। মাহারিন ভড়কে গিয়ে তাহমিদের কাঁধের শেরওয়ানির অংশ শক্ত করে খামচে ধরেছে। যেন হাত ছুটে গেলেই পড়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গেই তাহমিদের বন্ধু, কাজিনরা শিষ বাজিয়ে উঠে, পরপর হৈ-হুল্লোড় করে। তাহমিদ মাহারিনকে লিভিংরুম পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাহমিদ মিনমিন করে বলল,
–“তুমি ভারী নাকি তোমার গাউন, বুঝতে পারছি না। আমার এই হাতটাও যে ভাঙার পথে।”

মাহারিনের কাছে এই কথাটা অপমানজনক লাগল। সে রেগে গিয়ে বলল,
–“নামান আমাকে, নামান!”

–“এজ ইওর উইশ।”

বলেই তাহমিদ মাহারিনকে সোফায় বসিয়ে দিলো। সেও এক সোফায় ধপ করে বসে বাম হাত ঝাড়ছে, যেন দারুণ ব্যথা করছে। পারভীন ব্যস্ত হয়ে এসে আওড়াল,
–“হাত কী বেশি ব্যথা করছে? এই মাওইটাও না। শুধু শুধু যা-তা বলে, তার কথা শুনলে গেলি কেন বাপ?”

আকিব শিষ বাজাতে বাজাতে এসে বলল,
–“আহা, শুরুতেই নিজের ভালোবাসা দেখিয়ে দিলি বন্ধু।”

তাহমিদ এবার আকিবকে বিশ্রী এক গালি দিয়ে বসলো।
–“সু**দানিরফুয়া চোখের সামনে থেকে দূর হ।”

মাহারিনও সেই কথা শুনে মুখটা বিকৃত করে ফেলল। এই ভদ্রবেশে থাকা তাহমিদ তো চরম অভদ্র!

চলবে—