#মায়াতলীর_মোড়ে – [১৩]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
তাহমিদের ঘরটা অন্যান্য ঘরের তুলনায় মোটামুটি বড়ো। ঘরটা পড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। যার ফলস্বরূপ সকালের নরম রোদ একদম চোখে এসে পড়বে। জানালা পর্দায় মোড়ানো না থাকলে এই আলো সহসা ঘুম নষ্ট করতে পারে। মাহারিন তিরিক্ষি মেজাজে চুপ করে ফুলে সাজানো বিছানায় বসে আছে। তবে বসাটা স্বস্তির হচ্ছে না। আচমকাই এলার্জি আক্রমণ করেছে তাকে। হাত চুলকে ইতিমধ্যেই লাল করে ফেলেছে। ব্যস্ত হাতে চুড়িও কয়েকটা খুলে ফেলেছে। এখন গলায় হাতের বিচরণ। পারছে না সব এখনই টেনে-হিঁচড়ে খুলে ফেলতে। কিন্তু শাশুড়ির নির্দেশ, তাহমিদ আসা অবধি এভাবেই যেন থাকে। মাহারিন নির্দেশ মানতে বাধ্য না, তবে বড়োদের অমান্য হতেও শিখেনি। মনে মনে কিছুটা গাল-মন্দ করলো তাহমিদকে, আসতে এত দেরী করছে কোন সুখে?
মাহারিন মাথার ঘোমটা খুলে যখন গলায় নখের বিচরণ করতে ব্যস্ত তখনই তাহমিদ ঘরে প্রবেশ করে। বাহির থেকে তখনো তাহমিদের কাজিন, বন্ধুদের হৈ-হুল্লোড় ভেসে আসছে। তাহমিদ কোনোক্রমে দরজা আটকে মাহারিনের কাছে আসলো। মাহারিনের এহেম অবস্থা দেখে তাহমিদ ভ্রু কুচকে বলল,
–“এলার্জি হলো নাকি?”
পরপর তাহমিদ মাহারিনের লালচে হাতের দিকে তাকালো। মাহারিনের সামনেই অবহেলায় ছড়িয়ে আছে চুড়ির দল। মাহারিন ভারি গাউনটা কোনোরকমে তুলে বিছানা থেকে নামতে নিলে গাউনে পা আটকে পড়ে যেতে নেয়, তৎক্ষণাৎ তাহমিদ তাকে ধরে ফেলে। আস্তে করে মাহারিনকে সামলে দিয়ে তাহমিদ বলল,
–“বেশি সমস্যা হচ্ছে?”
মাহারিন বিরক্তির চক্করে তাহমিদের কথায় কান না দিয়েই বলল,
–“আমি কী এখন চেঞ্জ করতে পারি?”
তাহমিদ চমকাল বেশ। মাহারিন এই ভারী পোশাকে এতক্ষণ তার অপেক্ষায় ছিল? অবিশ্বাস্য!
–“ডোন্ট টেল মি তুমি আমার অপেক্ষা করছিলে?”
–“আপনার অপেক্ষাই করছিলাম। আপনার মা বলল আপনি আসা অবধি যেন প্যাকেট হয়ে থাকি।”
তাহমিদ ঠোঁট চেপে হাসলো।
–“যাক, কোনো এক অজুহাতে হলেও মহারানি অপেক্ষা করেছেন এই অধমের!”
মাহারিন সেসবে কান না দিয়ে বলল,
–“রুম থেকে বের হন!”
তাহমিদ অবাক হলো। বলল, “কেন?”
–“চেঞ্জ করব। অন্তত বারান্দায় যান।”
তাহমিদ তর্কে না জড়িয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। মাহারিন ততক্ষণে ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অলংকার খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাহমিদও আসলো তাকে সাহায্য করতে। ঘাড়ে তাহমিদের হাতের স্পর্শ পেতেই মাহারিন চমকে ওঠে। আয়নার তাহমিদের দিকে চেয়ে বলল,
–“কী করছেন?”
তাহমিদ এবার মাথার টিকলিটা খুলতে খুলতে বলল,
–“বউ আনবক্সিং।”
–“বারান্দায় যেতে বললাম না?”
–“ভাগিয়ে দিচ্ছ কেন? বউয়ের জন্য মানবতার খাতিরে হেল্পে আসতেই পারি। তুমি যত তাড়াতাড়ি করবা তত দ্রুতই আমি বারান্দা থেকে ছুটি পাব।”
মাহারিন মুখ বাঁকালো। কিছু সময় পেরুতেই তাহমিদকে ঠেলে সে বারান্দায় পাঠিয়ে দিলো। দরজা লাগাতে ভুলে না সে। তাহমিদ ততক্ষণে ফোনে কাউকে মেসেজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেসেজ শেষ করে খোলা বাতাসে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। তৎক্ষণাৎ তাহমিদের চোখে ভেসে ওঠে বউরূপী মাহারিনকে। মুহূর্তেই চোখজুড়ে মুগ্ধতা ছেয়ে গেল তার। হালকা হেসে সে অদূরে নজর স্থির করল।
মাহারিন সব চেঞ্জ করে ফ্রেশ হতেই তার মনে হলো পাহাড়সম ভার থেকে মুক্তি পেয়েছে। না চাইতেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে সে, এটাই তো ভারমুক্ত প্রশান্তি। তোয়ালে মুখ মুছে বিছানার থেকে চুড়িগুলো সরাতে নিলে দরজায় নক পড়ল। পরপর তাহিয়ার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর, ‘ভাবী।’
মাহারিন ভ্রু কুচকে দরজার তাকাল। এই মুহূর্তে তাহিয়ার যে আসার কথা না। মাহারিন নিজেই এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। তাহিয়া দাঁড়ানো। মাহারিনকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
–“ভাইয়া এই ওষুধটা আনতে বলল।”
মাহারিন ওষুধটা হাতে নিয়ে দেখল এটা এলার্জির ওষুধ। এলার্জি হলে মাহারিন এই ওষুধটাই খায়। সে অবাক হয় তাহমিদের কাণ্ডে। ওষুধ তো মাহারিনের কাছেও ছিল, শুধু লাগেজ ঘেটে বের করতে হত। তাহিয়া অবশ্য দাঁড়ায়নি, ওষুধটা দিয়েই চলে গেল।
তাহিয়া যেতেই বারান্দার দরজায় ধুপধাপ শব্দ হয়। মাহারিনের তখনই মনে পড়ল সে তাহমিদকে লক করে রেখেছে। মাহারিনের কেন যেন দরজাটা খুলতে ইচ্ছে করছে না। যেন সে তাহমিদকে বন্দি করেই পৈশাচিক আনন্দ পাবে। সারা রাত বন্দি করে রাখলে মন্দ হয় না। তবে, আপন মনের ইচ্ছেগুলো সবসময় পূরণ হয় না। সেই অপূর্ণতা নিয়েই মাহারিন দরজাটা খুলে দেয়। তাহমিদ তখন ভেতরে প্রবেশ করে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর মুখপানে চাইলো। কে যেন বলেছিল মেয়েদের বিয়ের ফুল ফুটলে আল্লাহ তাদের মুখজুড়ে অন্যরকম নূর লেপ্টে দেয়। কথাটা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। মাহারিন অন্য দিকে ফিরে বলল,
–“দরজা খুলতে মনে ছিল না।”
–“তার জন্যে সরি বলতে চাচ্ছ?”
মাহারিন তার দিকে চোখ তুলে চেয়ে বলল,
–“মোটেও না।”
তাহমিদ হাই তুলতে তুলতে ঘরের অন্যপাশে চলে যায়। মাহারিন বিছানার চুড়িগুলো দ্রুত হাতে সরিয়ে নেয়। আচমকা সে বলল,
–“তাহিয়া এসেছিল।”
তাহমিদ তার শেরওয়ানির বোতামগুলো এক এক করে খুলতে খুলতে বলল,
–“তো ওষুধটা খেয়ে নাও।”
মাহারিন ওষুধটা খেয়ে নেয়। খেয়ে তাহমিদের দিকে চাইতেই দেখল তাহমিদের কাপড় চেঞ্জ করতে সমস্যা হচ্ছে। আহারে, বেচারার ভাঙা হাতটা। মাহারিনের ভাবনার আগেই তাহমিদ তাকে ডেকে বলল,
–“এই, এদিকে আসো। হেল্প করো আমায়।”
মাহারিনের ভ্রু কুচকে যায়। বলল, “নিজে করতে পারেন না?”
–“করতে পারলে তোমাকে নিশ্চয়ই ডাকতাম না? আর বাসর ঘরে বউ রেখে বাইরের মানুষ ডেকে কী হবে? এদিকে আসো।”
বাসর, বউ— তাহমিদের মুখে এহেম কথাগুলো শুনে সে গালে গরম আভা অনুভব করল। ইচ্ছে করল তাহমিদের থেকে দূরে থেকে যেতে। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না, তাহমিদ একদম তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা, মাহারিনের সাহায্যেই শেরওয়ানীটা খুলতে হলো। তাহমিদকে উদোম শরীরে দেখে মাহারিন অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে ফেলে, দ্রুত অন্য দিকে ফিরে দাঁড়ায়। তা দেখে তাহমিদ অবশ্য হাসল। মাহারিনকে জ্বালাতে বলল,
–“কষ্ট করে কাপড় পরে আর কী করব? এভাবেই ঘুমিয়ে যাই। গায়ের কাপড় হিসেবে বউ তো আছেই। কী বলো?”
মাহারিন চোখ রাঙিয়ে তাকাল তার পানে। চোখ-জোড়ায় রাগ এবং লাজের সংমিশ্রণ। তা দেখে তাহমিদ হাসতে হাসতে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। এর আগে বলে যায়,
–“আলমারির ডান পাশের শেষ ডোরটা খুলে একটা ফতুয়া করে দাও, আমি আসছি।”
মাহারিন চটপট বলল, “পারব না!”
তাহমিদ পিছে ফিরে চোখ ছোটো করে বলল,
–“আমাকে এভাবে দেখতে বুঝি তোমার ভালো লাগছে? ঠিক আছে, তুমি তো আমার বউ। এভাবে থাকাই যায়।”
মাহারিন ভীষণ ভড়কে যায়। তাহমিদ ততক্ষণে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছে। মাহারিন বুকে হাত দিয়ে দ্রুত আলমারির দিকে ছুটলো। হাতের কাছে যা পেল তাই নিয়ে বিছানার ওপর রাখল। ফুলের ঘ্রাণে ঘর মৌ মৌ করছে। কিন্তু এসব মাহারিনের অন্তরে কাঁটা দিচ্ছে। কী সাংঘাতিক অবস্থা।
সব শেষে যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি চলল তখন মাহারিন চট করে বলল,
–“আমার সাথে শুবেন না।”
তাহমিদ এহেম কথায় বেশ বিরক্ত হয়। বিয়ে করেছে, অথচ বউয়ের সাথে ঘুমাবে না। এটা কেমন কথা? এটা কী সিনেমা চলছে নাকি? তাহমিদ বলল,
–“এটা রিয়েল লাইফ মাহারিন, সিনেমার শুটিং চলছে না।”
–“আমি বিয়ে মানি না।”
–“মেনেছ বলেই কবুল বলেছ।”
–“বাধ্য ছিলাম।”
–“তোমাকে বাধ্য করা দুনিয়ার কারো কাছেই সম্ভব না।”
–“শুবেন না বলছি।”
তাহমিদ তাও জোর করে বিছানায় বসল।
–“আমি তোমার সাথে এই বিছানায় না থাকলে ফুলগুলার অপমান হবে, সাথে বাইরে বন্ধু, কাজিনদের যেই টাকা দিয়ে এসেছি তাও লস যাবে।”
–“কী বলতে চাইছেন আপনি?”
তাহমিদ কথা ঘুরিয়ে বলল,
–“এলার্জির ওষুধ খেয়েছ, চুপ করে ঘুমাও। স্পেস দিচ্ছি এটা নিয়েই খুশি থাকো।”
বলেই তাহমিদ মাহারিনের পাশে শুয়ে পড়ে। আর মাহারিন সেভাবেই ঠায় বসে রয়। বিছানাটা কিং সাইজের। এক বিছানায় ঘুমালেও কেউ কারো গা ঘেষবে না। মাহারিন নিজ মনে কিছু হিসাব-নিকাশ সেরে একপাশে শুয়ে পড়ল। আচমকা তার গায়ের ওপর তাহমিদ এক হাত রাখতেই মাহারিন চমকে যায়। অস্ফুট স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলে,
–“কী করছেন? দূরে সরে যান।”
তাহমিদ দূরে সরার বদলে মাহারিনকে কাছে টেনে বলল,
–“শুনেছি বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালে নাকি ঘুম ভালো হয়। এখন এক্সপেরিমেন্ট করে দেখি।”
–“আরেক হাত ভাঙতে চাচ্ছেন?”
–“তোমার মতোন চুনোপুঁটি এমনিতেও পারবে না। খালি কলসি বলে কথা।”
মাহারিন মুঁচড়ে উঠল। পেট থেকে তাহমিদের হাত সরানোর অদম্য চেষ্টা করে গেল। তা দেখে তাহমিদ বাঁকা হেসে বলল,
–“এডভেঞ্চার তবে শুরু হয়ে গেছে।”
চলবে—