#মায়াতলীর_মোড়ে – [১৬]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
পরেরদিন মাহারিন নিচে আসতেই দেখল তানভীর আগেভাগেই খাবার টেবিলে বসা। তার সাথে বিভিন্ন আলাপে ব্যস্ত নাস্তারত তারেক সাহেব। আগেরদিন তানভীরকে নিচে দেখেনি সে। যতটুকু শুনেছে, তানভীর পা ভাঙার পর উপরেই থাকছে। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছুই তার ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে তানভীর দুদিন যাবৎ নিচে নামছে— অবাক করা বিষয়।
তাহমিদ পেশেন্টের জন্য সকাল সকাল ছুটেছে হসপিটালে। ইমার্জেন্সি পেশেন্ট, অন্য কোনো কলিগ ডাক্তাররাও এই মুহূর্তে হসপিটালে নেই। তাহমিদ তাকে বলেছে নাস্তার আগে আগেই ফিরে আসবে।
তারেক সাহেব খাবার টেবিল থেকে উঠতেই মাহারিনকে দেখলেন, পরপর মুচকি হেসে মাহারিনের মাথায় স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে দিলেন। মাহারিন অবশ্য শ্বশুরকে আগেই সালাম দিয়েছে। তারেক সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
–“এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো মা?”
–“জি না, বাবা।”
–“যাক, বেশ ভালো। এটা তোমার নিজের বাড়ি বুঝলে? আমরাও তোমার আপন। তাই কোনো কিছু নিয়ে ফর্মালিটিস দরকার নেই। ভালো লাগলেও জানাবা, সমস্যা হলেও জানাবা৷ বুঝেছ?”
মাহারিন মাথা নিচু করে মাথা নাড়ায়। তারেক সাহেব আশেপাশে তাহমিদকে খুঁজে বলল,
–“তাহমিদ কোথায় মা? ও নামেনি নিচে?”
–“উনি আসলে হাসপাতাল গিয়েছে। বলো দ্রুতই ফিরে আসবে।”
তারেক সাহেবকে চিন্তিত দেখাল। গলা খাদে নামিয়ে ভাবুক স্বরে আওড়ালো,
–“হাসপাতাল থেকে তো ও এমনিতেই ছুটিতে আছে, বিয়ের জন্য তো ছুটি আরও জোরালো ছিল। তাহলে হঠাৎ…”
তারেক থেমে আবার বললেন,
–“থাক, তুমি টেনশন করো না। আমি তাহমিদকে কল করে তাড়াতাড়ি আসতে বলছি। এখন তজমি নাস্তা করতে বসো, দেরী হয়ে যাচ্ছে ত।”
বলেই তারেক সাহেব সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তিনি সম্ভবত বাইরে বেরুচ্ছেন। মাহারিন তানভীরের দিকে তাকাতেই তানভীর এক গাল হেসে বলল,
–“গুড মর্নিং ভাবী।”
মাহারিন কিছুটা তটস্থ হলো। তানভীর হুবুহু তাহমিদের মতোই। একই কণ্ঠস্বরে বউ, আবার একই কণ্ঠস্বরে ভাবী— কেমন উদ্ভট লাগছে। সে এখনো মানতে পারেনি তাহমিদের জমজ ভাই আছে। দুজনের মধ্যে পার্থক্য করা কিছুটা কষ্টসাধ্য। এক দেখায় পার্থক্য করতে না পারলেও পরবর্তীতে মনোযোগ দিলে পার্থক্য বোঝা যায়। ওদের পার্থক্য করা যায় দুই ভাবে। এক, গায়ের রং এবং দুই, ভ্রুর কাঁটা দাগ। তাহমিদের গায়ের রং পরিষ্কার হলেও তানভীরের গায়ের রং আবার কিছুটা চাপা। দুজনের গায়ের রং নাকি একই ছিল। পারভীন বলেছেন তানভীরের অতিমাত্রায় বাইরে যাতায়াত এবং ঘুরাঘুরির কারণে রোদে পুড়ে এই হাল হয়েছে।
মাহারিন ঠান্ডা গলায় বলল,
–“গুড মর্নিং।”
–“আপনি এখনো মানতে পারছেন না যে আমরা জমজ ভাই, রাইট?”
মাহারিন বিশেষ কিছু বলল না। এতে তানভীর হো হো করে হেসে উঠল। সে এখনো হুইলচেয়ারেই বসা। তানভীর হাসি থামিয়ে বলল,
–“আচ্ছা থাক, ভয় পাবেন না। বসুন, নাস্তা করে নিন। তাহমিদ ভাই চলে আসছে, মাত্রই টেক্সট করল আমায়।”
এমন সময়ে রান্নাঘর থেকে পারভীন এসেও তাকে নাস্তা করতে বসতে তাগাদা দিল। মাহারিন একটা চেয়ার টেনে বসল। তবে তার কেন যেন তাহমিদকে ছাড়া খেতে ইচ্ছে করছে না। কে জানে মানুষটা খেয়েছে কি না! যেই মানুষটাকে সে দুই চোখেও দেখতে পারে না সেই মানুষটাকে নিয়েই মাহারিনের রাজ্যের চিন্তা, তাকে ছাড়া সে খেতে পারছে না। এ যেন আমূল পরিবর্তন মাহারিনের। এই পরিবর্তন এত জলদি ঘটে যাবে তা তো মাহারিন ভাবেনি। সে তো অন্য পরিকল্পনা মনে চেপে বিয়ে করেছে, তাহলে শুরুতেই সে পল্টি খাচ্ছে কেন? তার বিবেক, মন সেসব কেন সায় দিচ্ছে না?
মাহারিনের ভাবনার মাঝেই কালো টাউজার এবং লং টপস পরা জোনিরা এলো। মুখ, গলা তার ঘেমে-নেয়ে একাকার। জোনিরা এসে মাহারিনের পাশের চেয়ারেই বসেছে। পারভীন জোনিরাকে জিজ্ঞেস করলেন,
–“কোথায় গিয়েছিলি তুই? ভোরে তোর ঘরে উঁকি দিতে গিয়ে দেখি তুই নেই।”
জোনিরা রুমালে মুখ মুছছে আর তানভীর তাকে দেখেই যাচ্ছে। সেটা জোনিরা খেয়াল না করে ব্যস্ত গলায় বলল,
–“ওয়ার্কআউটে গিয়েছিলাম মামনি। ইদানীং ওয়ার্কআউট অনেকটা মিস গিয়েছে।”
মাহারিন পাশ ফিরে তাকাল। আবারও তার বুকে জ্বলন অনুভব হলো। সে কেন যেন জোনিরাকে পছন্দ করতে পারছে না। এটার সম্পূর্ণ দোষ তার মনের। মাহারিন চায়নি এখন খেতে, কিন্তু পারভীন ধমকের সুরে বলে তাকে খেতে বাধ্য করেছেন। তা দেখে তানভীর বুকে হাত দিয়ে মুগ্ধ হবার ভান ধরে বলল,
–“আহা, ভাবী আমার ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। এমন ভালোবাসা দেওয়া বউ যে আমার ঘরে কবে আসবে।”
এটা যে শুধু তানভীরের ঠাট্টা নয় বরং জোনিরাকে সূক্ষ্ম খোঁচাও দিয়েছে তা সে হাড়ে হাড়ে টের পেল। জোনিরা এই ছেলেকে বেশ গভীর থেকেই চিনে ফেলেছে। তাই সে মুখোমুখি বসা তানভীরকে চোখ রাঙালো। তা দেখে তানভীর সবার আড়ালে তাকে চোখ টিপ দেয়, এতে জোনিরা আরও রেগে যায়।
তানভীর আচমকা বলল,
–“মা, আজ তোমাকে আমার একটা ফাইনাল ডিসিশন শোনাতে চাই। আমি এখন থেকে নিচেই থাকব।”
এ কথা শুনে পারভীন ভ্রু কুচকাল। বলল,
–“তা কেন?”
–“কেন মানে? তুমি কী চাচ্ছ এই পা নিয়ে বারবার উঠি নামি? তার চাইতে ভালো নয় কী নিচেই শিফট হয়ে যাই?”
–“এতদিন উপরে ছিলি, কোনো সমস্যা হয়নি। এখন কী এমন আকাল পড়ল যে বারবার উপর-নিচ করবি? ফাজলামোর আর জায়গা পাস না?”
মায়ের কথায় তানভীরের মুখ ভার হলো। সে মিনমিন করে বলল,
–“আগে তো সামনের বান্দা আমার বাড়ি এসে থাকেনি। এখন থাকছে, তাকে আমি চব্বিশ ঘণ্টা চোখের সামনে দেখতে চাই কেন বুঝতে চাইছ না?”
কিন্তু তানভীর গলা উঁচিয়ে বলল,
–“উপরে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছি। নিচে থাকলে অনেক লাভ। সবার সাথে বসে খেতে পারব, আড্ডা দিতে পারব, গার্ডেনে সময় কাটাতে পারব।”
জোনিরা তানভীরের কথার মাঝে বলে ওঠে,
–“আমি আজই চলে যাচ্ছি মামনি।”
–“এই, কী শুরু করেছিস? চলে যাবি মানে? তোকে যেহেতু এনেছি সেহেতু তুই কয়েকদিন না থেকে কোথাও যাবি না। আমার কথার মূল্য নেই তোর কাছে?”
জোনিরাকে অসহায় দেখালো। সে তো ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে তানভীর কেন নিচে শিফট হতে চাচ্ছে। কিন্তু সে তো এত সহজে পা ভাঙা তানভীরকে জিততে দিবে না, কিছুতেই না। তাই মামনির ধমক খেয়ে সে চুপসে গেল আর তানভীর হাসলো বিশ্বজয়ের হাসি। পারভীন যে রাজি হয়েছে।
খুশির চক্করে তানভীর মাহারিনের উদ্দেশে বলতে লাগল,
–“জানেন ভাবী, আমি সারপ্রাইজ দিতে ভীষণ ভালোবাসি। এজন্য শুরুতেই বলেছিলাম আমাদের জমজ ভাইয়ের ব্যাপারটা সিক্রেট রাখব। তার ওপর এটাও ইগোতে লাগছিল যে নতুন ভাবীর সামনে ভাঙা পা নিয়ে যাওয়া কেমন দেখায়? তাও প্রথম সাক্ষাতে? তাহমিদের লজ্জা-শরম নাই থাকতে পারে, কিন্তু আমার তো আছে তাই না? বলেন ভাবী?”
তানভীরের কথা শুনে জোনিরা মুখ ভেঙাল। বিড়বিড় করে আওড়ালো,
–“কত যে লজ্জা-শরম আছে দেখাই যায়। এজন্যই তো নির্লজ্জের মতো নিজের বয়সের থেকে দুই বছরের বড়ো মেয়েকে টানা প্রপোজ করেই যাচ্ছে। নির্লজ্জ কোথাকার।”
তবে তানভীরের একটানা কথার চক্করে মাহারিন বিষম খেল। এতে জোনিরা দ্রুত তাকে পানি এগিয়ে দিয়ে তানভীরকে ধমক দিল,
–“এই ছেলে, কাণ্ড-জ্ঞান নেই? একসাথে এত পকপক করো কেন? একজন মানুষকে খেতে ত দিবে।”
তানভীর সেই ধমক গায়েই মাখল না। সে মাহারিনকে বলল,
–“ঠিক আছেন ভাবী?”
তাহমিদ তখনই এসে মাহারিনকে দেখল। সে হন্তদন্ত হয়ে বউয়ের কাছে ছুটে এলো। পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,
–“মাহারিন, আর ইউ ওকে?”
তাহমিদের কণ্ঠস্বর শুনে মাহারিন চমকে পিছে ফিরে চাইল। তানভীর তখন শিষ বাজিয়ে বলল,
–“ইয়ে, রোমিও আ গেয়্যি।”
এতে জোনিরা তানভীরকে চোখ রাঙালো, আর তানভীর? সে প্রতিবারের মতোই হেসে উড়িয়ে দিল। সে আবার বলতে শুরু করল,
–“জানেন ভাবী, জোনিরা আমার কাজিন হলেও ওকে প্রথমবার আমি খেয়াল করেছি বান্দরবান যাওয়ার পথে। বাসে আমার পাশের সিটে। আমি তখনো জানতাম না সে আমার পরিচিত কেউ। কিন্তু এই পাষাণ মেয়েটা আমাকে শুরুতে চিনেও না চেনার ভান করে ছিল। কেমন অভদ্র সে বলেন তো!”
এবার শক্ত করে ধমক দিল জোনিরা।
–“এই তুমি থামবে? এখন এসব বলার সময়? তুমি নিচে আসছ কেন ভাই? উপরেই থাকতে!”
জোনিরার মুখে ভাই ডাক তানভীর মোটেও পছন্দ করল না। সে চুপ করে রইলো ঠিকই তবে জোনিরাকে চোখে চোখে এ নিয়ে ধমকাতে ছাড়ল না। এত বড়ো সাহস তাকে ভাই বলে? তার অলরেডি বোন আছে, তাহিয়া তাকে ভাই বলবে। জোনিরা কেন বলবে, তাকে কে অধিকার দিয়েছে?
মোর্শেদ সাহেব নিজে আসলেন মেয়ে এবং মেয়ে জামাইকে নিতে। তিনি মোটেও জামাইকে ওভাবে একা যেতে দেখা পছন্দ করছিলেন না। জামাই প্রথমবার তার বাড়িতে একা যাবে নাকি?
তানভীর হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে মোর্শেদ সাহেবের সাথে এসে বিনয়ের সাথে কুশল বিনিময় করল। তাদের পরিচয় গতকালই হয়েছে। মাহারিনের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো মোর্শেদ সাহেবও চমকে গিয়েছিলেন তানভীরকে দেখে। এই চমক কাটিয়ে উঠতে সবারই একটু সময় লেগেছে। মোর্শেদ সাহেব বেশিক্ষণ থাকলেন না। মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে নিয়ে রওনা হলেন। গাড়িতে মোর্শেদ সাহেব ড্রাইভারের পাশে বসলেও মাহারিন এবং তাহমিদ পেছনের সিটে বসেছে। মাহারিনের সেই বিষমের পর থেকে খারাপ লাগছে। তাহমিদ তা বুঝতে পেরে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“এখনো খারাপ লাগছে?”
মাহারিন নেতিবাচক মাথা নাড়ায়। তবুও তাহমিদ বলল,
–“কাঁধে মাথা রাখো, ভালো লাগবে।”
মাহারিন তাই করল। ওদের দুজনকে প্রাণভরে দেখলেন মোর্শেদ সাহেব। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বুকে যে চাপা ভারটা ছিল সেটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। নিঃসন্দেহে তাহমিদ চমৎকার একজন মানুষ। জীবনসঙ্গী তো তাকেই বলে যে কি না অপরজনের খুঁটিনাটি সমস্ত ব্যাপার লক্ষ্য রাখে, তাকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়।
চলবে~~