মায়াতলীর মোড়ে পর্ব-১৭

0
1

#মায়াতলীর_মোড়ে – [১৭]
লাবিবা ওয়াহিদ

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

তাহমিদরা চলে যাবার পরপরই তানভীর নিচে শিফট হয়েছে। যার দরুণ জোনিরা এবং তানভীরের ঘর এখন পাশাপাশি। শুধুমাত্র একটি দেয়াল তাদের মধ্যে৷ এ নিয়ে জোনিরা যতটা না বিরক্ত ততটাই আনন্দে দুলছে তানভীর। সে ঈদের আনন্দ নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে, যা মোটেও সহ্য হয় না জোনিরার। এজন্য সে লম্বা সময় ধরে শাওয়ার নিল। গোসল সেরে রুম থেকে বের হতেই দেখল তানভীর তার ঘরের সামনে বসে আছে। তা দেখে জোনিরা চোখ রাঙিয়ে বলল,
–“এখানে এভাবে বসে আছ কেন? কী সমস্যা?”

–“আপনার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাও শান্তির। কেমন আপন আপন অনুভব হয়। যেহেতু এখন দাঁড়ানোর সুযোগ নেই তাই বসে আছি। আই হোপ আপনার সমস্যা হচ্ছে না।”

জোনিরা ভাব ধরল। বলল,
–“তোমার বাড়ি। তুমি কোথায় বসবে, কোথায় শুয়ে থাকবে সেটা তোমার ইচ্ছে। ফ্লোরে গড়াগড়ি খাও, কেউ বারণ করেছে নাকি?”

–“উহু, আমার বাড়ি হলেও আমার ইচ্ছের মূল্য আপাতত নেই। এই ধরুন, আমার এখন আপনার ঘরে ঢুকে আপনার বিছানায় শুতে ইচ্ছে করছে। এখন বলুন, ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিই কী করে?”

জোনিরা রাগে-দুঃখে নির্বাক বনে গেল। কথায় জিতে গিয়ে তানভীরের বেশ সুখ সুখ অনুভব হলো। তর্কে সে সবসময়ই জিতে যায়। এটা তার জন্য প্লাস পয়েন্ট। জোনিরা তানভীরের প্লাস্টার করা পায়ে একটা লাথ মে* রেগে-মেগে সেখান থেকে চলে যায়। তানভীর হালকা ব্যথা পেয়ে জোনিরার যাওয়ার পানে চেয়ে বলল,
–“আহা, ব্যথা পেলাম যে। আপনি গাইনি ডাক্তার না হয়ে অর্থোপিডিক্স হলে অন্য পায়ের সাথে হাতটাও ভেঙে দিলে কিছু মনে করতাম না। কিন্তু সমস্যা আপনার প্রফেশন বাছাইয়ে। এত ফালতু ডিপার্টমেন্ট কেন চুজ করলেন আপনি, আশ্চর্য!”

তাহমিদ বিয়ের পর প্রথমবারের মতো শ্বশুরবাড়ি এসে বিপদে পড়ে গিয়েছে। আসার পর থেকে তাকে ভুরিভুরি খাওয়ানো হচ্ছে। এখন দুপুর, অথচ হাতের কাছে নাম জানা, অজানা কতশত খাবার আইটেম। খাবারের ঘ্রাণেই পেট ভরে যাওয়ার মতো। এদিকে তার পাত খালি হতে না হতেই আবারও পাত ভরে যাচ্ছে। সবাই যেন যত্ন করে খাওয়াচ্ছে তাকে। এতে তাহমিদের কাঁদো কাঁদো অবস্থা। চোখের ইশারায় মাহারিনকে বারবার তাকে বাঁচানোর জন্য অনুনয় করছে সে। তবে মাহারিনও কম ফাজিল নয়। সে পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে তাহমিদের অসহায়ত্ব উপভোগ করছে। খাবার দিয়েও কাউকে এভাবে টর্চার করা যায়, তা সে জানত না। মাহারিনের মনে হলো, তার হয়ে তার পরিবারই তাহমিদকে চরম শিক্ষাটা দিয়ে দিচ্ছে।

তাহমিদ পেট ফাটা খাবার নিয়ে কোনো রকমে মাহারিনের রুম অবধি এসেছে। শুয়ে পড়ারও উপায় নেই, গলগল করে যেন সব আবার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে। কী বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা। তানভীর আসার আগে তাকে নাস্তা খেতে দেয়নি। বলেছিল খালি পেটে ফুল প্রিপারেশন নিয়ে যেতে। তাহমিদ তখন না বুঝলেও এবার হাড়ে হাড়ে টের পেল। তার শিক্ষা হয়ে থাকলে আর জীবনে যদি সে শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েছে। এসবের মাঝে আবার একটা চিন্তাও আসছে, তানভীর এই ভোজনের আয়োজনের খবর জানলো কী করে? তাহমিদ শুনেছে তবে এত অতিরিক্ত হবে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।

বর্ষা এলো রুমের দরজায়। এসে তাহমিদকে জিজ্ঞেস করল,
–“দুলাভাইয়ের কী চা খেতে ইচ্ছে করছে? চায়ের সাথে কী কী খাবেন এখনই বলে দেন।”

তাহমিদ অসহায় নজরে বর্ষার দিকে চেয়ে বলল,
–“বিষ এনে দাও বোন, ওটাই আপাতত পেটে সইবে।”

বর্ষা গালে তওবা করার ভান করে বলল,
–“হায়হায়, নাউজুবিল্লাহ। আপনি এখনই ম*বেন কেন দুলাভাই? আমার তো এখনো খালামনি ডাকও শোনা হলো না।”

ইন্টার পঁড়ুয়া বাচ্চা মেয়ের মুখে এহেম কথা শুনে তাহমিদ হালকা করে হাসল। এই অসহায়ত্বের মাঝে এরকম তরতাজা মশকরা। তাহমিদ বলল,
–“সুপারি এনে দাও, ওটাই জরুরি।”

বর্ষা চলে যেতে নিলে তাহমিদ আবার বলল,
–“তোমার আপু কোথায়?”

–“জেঠার ঘরের দিকে গেল।”

মাহারিন তার বাবার মুখোমুখি বসে আছে। মোর্শেদ সাহেব চোখে চশমা লাগিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ঘাটছেন। মেয়ে-জামাই এসেছে অথচ এখনই গুরুত্বপূর্ণ কেসের ব্যাপারে একটা ফাইল চেক করতেই হবে। কিছুক্ষণ আগে তাঁর এক জুনিয়র এই ফাইলটি দিয়ে গিয়েছে। পেন্ডিং রাখারও উপায় নেই। মোর্শেদ সাহেব ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে মেয়ের দিকে নজর বুলালেন। তীক্ষ্ণ সেই চোখের নজর। এতগুলো বছর চোর-ডাকাতের মাঝে থাকতে থাকতে এখন সে মানুষের চোখের ভাষা পড়তে শিখে গিয়েছেন। মেয়ের এমন নির্বাক ব্যবহারে তিনি গলা খাঁকারি দিলেন। আবারও ফাইলে নজর স্থির করে বললেন,
–“খেয়েছ?”
–“হ্যাঁ। তুমি তো খেলে না।”
–“ফাইলটা দেখেই খেয়ে নিচ্ছি।”

আবারও নীরবতা দুজনের মাঝে। মোর্শেদ সাহেব থেমে আবারও বললেন,
–“ওখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”
–“না।”

মোর্শেদ সাহেব তাকালেন মেয়ের পানে। এবারও মেয়ের চোখে অবসাদের চিহ্ন নেই। মাহারিন আবারও বলল,
–“সকলেই ভালো। আমার খেয়াল রাখে, সামনে থেকে তো আমারও তাদের খেয়াল রাখতে হবে তাই না?”

মোর্শেদ সাহেব পলকহীন তাকিয়েই রইলেন মেয়ের দিকে। তিনি মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কয়েকদিনের ব্যবধানে মেয়ের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পারছেন তিনি, যা খুবই অবিশ্বাস্য। মোর্শেদ সাহেব বললেন,
–“ভেবে বলছ তো?”

মাহারিন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“নিয়তি আমি মেনে নিয়েছি বাবা। বিয়ে যেহেতু একবার হয়েই গিয়েছে সেক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব, কর্তব্য থেকে পিছপা হবো না। তোমারই মেয়ে আমি, তোমার নাক ডুববে এমন কাজ কখনো করিও না আর না সামনে থাকব।”

–“ব্যাপারটা দায়িত্ব নয় মা। আমি তোমার ভালো থাকাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি, তাহমিদ কেমন? তোমার প্রতি তার আচরণ কেমন? তুমি জানো তোমাকে বিয়ে দিয়ে আমি কতটা চিন্তিত? দায়িত্ব গ্রহণের আগে নিজের ভালো থাকা এবং সন্তুষ্টি থাকা প্রয়োজন।”

–“আচমকা বিয়েতে সবটা মেনে নেওয়া কষ্টদায়ক লাগলেও আমার মন্দ লাগছে না।” মাহারিনের মুখ শুকনো হাসির রেখা। মোর্শেদ সাহেব খনিকের জন্য স্বস্তি পেলেও চিন্তা যেন কাটতেই চাইল না।

মাহারিন রুমে আসলেই তাহমিদ নাক কুঁচকে বলল,
–“তুমি বড্ড পাষাণ নারী। স্বামীর বিপদে তাকে সাহায্য করতে আসো না, এটা হয়?”
–“বিপদ কোথায় হলো আপনার? আপনাকে তো সবাই খাওয়াচ্ছিল!”

–“এটাকে খাওয়ানো বলে? আমাকে কী তোমার হাতি-ঘোড়া মনে হয়? মানুষের পেটে এত খাবার সয়?”

–“এগুলা ভালোবাসা, যা আপনার মতো হাড়ের ডাক্তার বুঝবে না।”

–“ভালোবাসার অর্থ তো তোমার মতো শিক্ষিত মেয়েও বুঝে না। বুঝলে আমার এত অধ্যাবসায় করা লাগত না।”

মাহারিন মুখ ভেঙালো। চেঞ্জ করতে বাথরুমে ঢুকতে নিলে তাহমিদ বলল,
–“আমরা কিন্তু কালকে বিকালেই চলে যাব।”

মাহারিন ভ্রু কুচকায়। বলল,
–“এত জলদি?”

–“জলদি কিসের? জামাইদের শ্বশুরবাড়ি থাকা মানায় না। আমি গেলে তুমিও আমার সঙ্গেই যাবে, বউ ছাড়া থাকা যায় নাকি?”

–“এত বছর তো একাই ছিলেন।”
–“এখন ত তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছ। অভ্যেস না হলে ভেবে দেখতাম।”

–“বাহ। জোনিরা আপুর প্রতি এমন দরদ ছিল না?”

তাহমিদ বেকুব বনে যায় এ কথা শুনে। তাদের মাঝে আবার জোনিরা আসল কোত্থেকে? তাহমিদের মুখ দেখেই বোঝা গেল বেচারার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে।

মাহারিন তাই আবার বলল,
–“দেখুন, আমি ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা কথা পছন্দ করি না। এজন্য বলছি, রিসিপশনের দিন কে যেন বলেছিল আপনার সাথে জোনিরার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। সম্ভবত পরবর্তীতে কোনো কারণে সেই বিয়ে ভেঙে যায়।”

মাহারিনের কথা বুঝতে বোধ হয় তাহমিদের সময় লাগল। তবে কথাগুলো মাথায় সুঁচের মতো বিঁধতেই তাহমিদ হো হো করে হেসে ফেলল। মাহারিন বোকার মতো সেই হাসি দেখে যায়। আশর্য, সে কী কোনো কৌতুক বলেছে? এতে এত হাসির কী আছে?

তাহমিদ বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
–“কাম অন মাহারিন, জোনিরা আমার থেকে দুই বছরের বড়ো। তার ওপর আমার খালার মেয়ে, কিসের বিয়ের কথা বলছ তুমি? মাথা ঠিক আছে?”

মাহারিন আকাশ থেকে পড়ল। জোনিরা এত বড়ো? তাহমিদের সামনে জোনিরাকে নিয়ে কী বলে বসল তা ভেবেই সে চরম লজ্জা পেল। অস্বস্তির চক্করে সে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়ল। আর তাহমিদ শুধু হেসেই গেল। আপনমনে আওড়াল,
–“পাগলি।”

বিকালের দিকে তাহমিদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে। মাহারিন ফ্রেশ হয়ে যে রুম থেকে বেরিয়েছে, লজ্জায় আর ফেরেনি। মায়ের সাথে থেকেও শান্তি নেই, ধমক দিয়ে বারবার রুমে যেতে বলছে। এজন্যে সে গেল দুই ছোটো বোনের কাছে। কিন্তু সেখানেও নতুন কাহিনী। বর্ষা বারবার বলছে,
–“দুলাভাইয়ের মতো সেইম কপি আরেকজন আছে আমি তো ভাবতেই পারিনি আপু। প্লিজ প্লিজ, আমাকে পটিয়ে দাও! আমিও ও বাড়ির বউ হয়ে যাই।”

মাহারিন রাগে লাল হয়ে বর্ষার পিঠে এক ঘা দিয়ে বলল,
–“এসব কী ধরণের কথা বর্ষা? পড়াশোনা না করে এসব ভাবছিস?”

–“তো ভাবব না কেন? একদিন না একদিন তো বিয়ে করবই। এর চাইতে ভালো নয় কী, তোমার দেবরকেই করি।”

তুলি মাঝে দিয়ে আচমকা বলল,
–“এভাবে বললে হয় নাকি? ভাইয়া যেই সুন্দর, গার্লফ্রেন্ড থাকবে শিওর। আমি তো ওইদিন দেখেছিলাম লম্বা সময় ধরে কার সাথে যেন হেসে হেসে কথা বলছিল। যেখানে দুনিয়ার আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ওয়ালিমার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল সেখানে কার এত ঠ্যাকা পড়েছে আবার নতুন করে কল দিয়ে দীর্ঘসময় কথা বলার? নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ড ছিল।”

তুলির কথায় দম আছে। মেয়েটা স্কুল পঁড়ুয়া হলেও ভীষণ চতুর। বর্ষা এতে চরম ছ্যাঁকা খেল। সে অসহায় নজরে তাকাল মাহারিনের দিকে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
–“সত্যিই কী গার্লফ্রেন্ড আছে?”

–“হতে পারে।”

বর্ষার মন আরও ভেঙে যায় মাহারিনের ছোটো উত্তরে। মাহারিন ওদের সাথে থেকেই শান্তি পেল না, এজন্য শেষমেষ তাকে তাহমিদের নীড়েই ফিরতে হলো। তাহমিদ যেন তারই অপেক্ষা করছিল। তাহমিদ বলল,
–“কী ব্যাপার, শ্বশুরবাড়িতে এসে বউ দেখছি আমাকে ভুলেই গিয়েছে।”

তাহমিদের কথা বলার ধরণে মাহারিন বুঝতে পারল সেই প্রসঙ্গ তাহমিদ তুলছে না। এ ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাহারিন বিছানার অন্যপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তাহমিদ মাহারিনের শুয়ে পড়া দেখে বলল,
–“আর ইউ জেলাস বউ?”

মাহারিন অন্য দিকে ফিরে থাকায় তার লাল হয়ে যাওয়া চোখ তাহমিদ দেখতে পেল না। চোর ধরা খেলে যেমন অনুভূতি হয় মাহারিনেরও তেমনটাই অনুভব হচ্ছে। তাহমিদ সবকিছু পড়তে পেরে হাসল। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
–“আচ্ছা চলো, তোমায় আমি জোনিরার গল্প শোনাই।”

“আমার মায়েরা দুই বোন এবং চার ভাই। চার ভাইয়ের মধ্যে দুই বোন ছিল সবচেয়ে প্রিয়। জোনিরার মা আমার মায়ের ছোটো বোন। তাই খালামনির ঝুলিতে ভালোবাসার মাত্রাটাও ছিল সবসময়ই বেশি। খালামনির বিয়ে আমার মায়ের আগে হয়। এর কারণ অবশ্য জোনিরার বাবা। তিনি আমার খালা বলতেই অজ্ঞান ছিলেন। কত ত্যাগ তিতিক্ষা করে যে নানাকে রাজি করিয়েছেন! তাদের ভালোবাসার সংসারে একটাই মেয়ে, সেটা হচ্ছে জোনিরা। জোনিরা বড়ো হবার পর প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত। তানভীর অবশ্য কখনোই ঘরের খেয়াল রাখত না। সে সকাল থেকে রাত অবধি বাইরেই ঘুরে বেড়াত। তাই জোনিরার সাথে তার সাক্ষাৎ কিংবা ভাব বলো, কোনোটাই কখনো হয়নি। ও শুধু জানত আমাদের জোনিরা নামে একজন খালাত বোন আছে।”

মাহারিন অত্যন্ত কৌতুহলী মন নিয়ে তাহমিদের দিকে ফিরে শুইলো। তাহমিদের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বলল,
–“এজন্যই বুঝি ভাইয়া ওইদিন বলেছিল জোনিরা আপুর সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ বাসে?”

তাহমিদ হেসে বলল,
–“আর বলিও না এই পাগলটার কথা। যেমন অদ্ভুত খেয়ালি মানুষ, তেমনই দুনিয়ার সমস্ত অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড ওর সাথেই ঘটবে।”

তাহমিদ থেমে আবারও আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল।
–“জোনিরার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক হলো। ও আমার বড়ো হওয়া সত্ত্বেও ওকে আমি নাম বলেই সম্বোধন করি বন্ধুত্বের খাতিরে। তবে মাখোমাখো বন্ধুত্ব ছিল এমনও নয়। ও বাসায় আসলেই আমাদের কথা হত।

জোনিরার যখন ঊনিশ বছর বয়স তখনই হঠাৎ খালামনির থার্ড স্টেজের স্টোম্যাক ক্যান্সার ধরা পড়ে। আঙ্কেল তখন আর্থিক দিক থেকে বেশ স্বচ্ছল। দেশ-বিদেশ ঘুরে খালামনির চিকিৎসা করালো, কিন্তু তাঁর হায়াত ফুরিয়ে এসেছিল।”

এই পর্যায়ে এসে মাহারিনের বেশ খারাপ লাগল। অনুভব করল মা হারানোর মতো তিক্ত, দমবন্ধকর অনুভূতি পৃথিবীতে দুটো নেই।

“খালামনি চলে যাওয়ার পর হাসি-খুশি জোনিরা যেন অনেক বদলে গেল। অল্প বয়সী মেয়েটার কাছে হানা দেয় নানান কঠিন পরিস্থিতি। ঘটনা বিদঘুটে হলো তখনই যখন বছর দুয়েকের মধ্যেই আঙ্কেল ঘরে অল্পবয়সী বউ তুলল।

আঙ্কেল খালামনিকে হারিয়ে যেন নিজের মেয়েকেও ভুলে বসেছিল। সে মেয়েকে একা রেখে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেরিয়েছে। জোনিরা বেঁচে আছে কিনা সে খবরও কখনো নেয়নি। এ নিয়ে আমার মামারা রেগে ছিল ভীষণ। কিন্তু যখন আঙ্কেল এই কাণ্ড ঘটালেন তখন যেন তাদের সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।”

মাহারিনের বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল তাহমিদের মুখে এ কথা শুনে। এক সময়ের তীব্র ভালোবাসা বুঝি দুই বছরে এতটা ম্লান হয়ে গেল যে নির্দ্বিধায় অন্য একজনকে তার জায়গায় বসিয়ে দিল? মাহারিনের বড্ড বুকে ব্যথা হলো, আহত হলো সে৷ মুহূর্তেই মাথায় এলো তার কিছু হয়ে গেলে কী তাহমিদও এরকম করবে? পরমুহূর্তেই মাহারিন নিজেকে ধিক্কার দিয়ে সামলে নিল। একটু লজিক্যালি বলার চেষ্টা করল,
–“একজন মানুষের কী নিজেকে ভালো রাখার অধিকার নেই?”

–“হ্যাঁ, আছে। অবশ্যই আছে। খালামনি চলে যাওয়ার আগেই বলেছিল আঙ্কেলকে আবার বিয়ে করতে। সে বিয়ে করতে চায়নি এটাও মানা যায়। কিন্তু জোনিরার প্রতি সে চরম অন্যায় করেছে। জোনিরা তারই রক্ত, তারই মেয়ে। স্ত্রীকে এত ভালোবেসে, একুশ বছর যাবৎ এতকিছু করে লাভ কী হলো যদি সে দুই বছরের মাথায় মেয়ের খোঁজ না রেখে, স্ত্রীকে সম্পূর্ণ রূপে ভুলে আরেকটা বিয়ে করতে? সেদিন আঙ্কেলের মুখে কোনো অনুশোচনা ছিল না। সে নিজের নতুন বউ নিয়ে মত্ত ছিল, মা হারা মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকায়নি।

মামারা কখনোই বলেনি তাকে বিয়ে না করতে। অবশ্যই তাঁর ভালো থাকার অধিকার আছে। আর মানুষ নিজের সুখ, ভালোকে নিজেই খুঁজে নেয়। মামারা এত দ্রুত আঙ্কেলের বদলে যাওয়া মানতে পারেনি, সাথে একমাত্র আদরের বোনের মেয়ের প্রতি অন্যায়ও তারা মেনে নেয়নি। বোনকে হারিয়েছে কিন্তু বোনের মেয়ে তাঁদের কাছে মহা মূল্যবান। এজন্য সেদিনই মামারা গিয়ে জোনিরাকে নিয়ে আসে। তাঁরাই জোনিরাকে ডাক্তারি পড়ায়। আঙ্কেলের সাথে সবাই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ওই বছরে এক কিংবা দুইবার জোনিরার খোঁজ নেয় সে। জোনিরা সেই থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, হোস্টেলে থেকে একা একা নিজেকে সাবলম্বী করেছে।”

মাহারিনের মনে হলো সে এখনো ঘোরের মাঝে আছে। জোনিরার জীবনে এত দুঃখ তা হাসির পেছনে সে টেরই পায়নি। মেয়েটা দিব্যি তার মনোমুগ্ধকর হাসি দিয়ে মিথ্যে ভালো থাকার অভিনয় করে। একজন সন্তানের জন্য তার বাবা-মা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়। সেখানে যদি বাবা থেকেও না থাকার মতোন হয়…

–“জোনিরার সাথে যে বিয়ের কথা শুনেছ সেরকম কিছুই না। আমার মা জোনিরাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে। তাই জোনিরার কষ্টে সবচেয়ে বেশি যে কষ্ট পেয়েছে সে হচ্ছে আমার মা। তাই জোনিরাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় মাঝেমধ্যে মা খুব আফসোস করত এই বলে যে জোনিরা আমার ছোটো হলে তাকে আমার বউ করে আনত।”

তাহমিদ আচমকা মাহারিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
–“এছাড়া তোমাকেই আমি প্রথমবার দেখেছি, তাই তোমাকেই আমার ঘরের রানি করেছি। তাই শুধু, শুধু বিভ্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার তাহমিদ তোমারই, জান।”

মাহারিন শিউরে উঠল তাহমিদের এমন শীতল কণ্ঠস্বরে শুনে। তাহমিদ থেমে আবারও বলল,
–“মজার ব্যাপার জানো? তানভীর জোনিরাকে পছন্দ করে। পছন্দ বলতে, ভালোবাসে। দুই বছর হলো এই কাণ্ডের!”

মাহারিন যেন আকাশ থেকে পড়ল। চমকে গিয়ে বলল,
–“বয়স…”

–“ভালোবাসা কী বয়স কিংবা কোনো লজিক মানে? সে নিজের নিয়মে চলতে ভালোবাসে। তানভীরের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই হয়ে গিয়েছে।”

চলবে~~