#মায়াতলীর_মোড়ে – [১৯]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
তানভীর হসপিটাল পৌঁছালেও ডাক্তারের কাছে গেল না। ওয়েটিং রুমে থম মে*রে বসে রইলো। তাহমিদ বহু কষ্টে তানভীরকে এক হাতে ঠেলে নিয়ে এসেছে। তাহমিদ বিরক্তের সাথে বলছিল,
–“তুই এত ভারী হলি কবে?”
–“ওয়ার্কআউট করলে ঠিক হয়ে যাব, শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে আসলেই ওজন বেড়ে গিয়েছে।”
–“খবরদার এখন পাকনামি করে কোনো ওয়ার্কআউট করতে যাবি না। সবে তোর পায়ের প্লাস্টার খুলবে। মিনিমাম আরো কয়েক মাস সাবধানে চলতে হবে।”
তানভীর নাক কুঁচকাল। সে এত নিয়ম টিয়ম মানতে পারে নাকি? তাহমিদ তানভীরকে ফেলেই নিজের কাজে চলে গেল। তাহমিদ যেতেই তানভীর জোনিরাকে কল দিল। জোনিরা এখন ডিউটিতে। তাই স্বভাবতই সে কলটা ধরল না। তানভীর এজন্য জোনিরাকে মেসেজ করল,
–“আমি ওয়েটিং রুমে বসে আছি। আপনাকে ছাড়া আমি ডাক্তারের স্বরণাপন্ন হচ্ছি না। আমার জেদ জানেন তো?”
উত্তর এলো না দুই ঘণ্টাতেও। তাই তানভীর ওয়েটিং রুমেই ঘুরঘুর করল, কোল্ড ড্রিংকের ক্যান কিনে গলা ভেজালো, চিপস খেল। এর মাঝে জোনিরা এসে উঁকি দিল, আদৌ তানভীর আছে কি না। যা ভেবেছিল ঠিক তাই, এই ছেলে শোধরাবার নয়।
জোনিরা সেখান থেকে নীরবে চলে যেতে নিতেই তানভীরের কাছে ধরা খেয়ে গেল। তানভীর সামনে চেঁচিয়ে ডাকল তাকে, “ড. জোনিরা। আমি আপনার পেশেন্ট।”
আশেপাশের মানুষ দুজনকেই ঘুরে ঘুরে দেখছিল। জোনিরা থেমে গেলেও তার কান গরম হয়ে যায়। তানভীর ততক্ষণে দ্রুত চাকা ঘুরিয়ে জোনিরার কাছে আসল। একজন পরিচিত নার্স বহুদিন যাবৎ তানভীরের এসব কাজকর্ম দেখে এসেছে। নাম তার তামান্না। তামান্না সেই নার্স যে কি না প্রথমদিন তানভীরকে জোনিরার নামের উচ্চারণ ঠিক করিয়ে দিয়েছিল। জোনিরা গরম চোখে তাকায় তানভীরের দিকে। নার্স তামান্না কিছুতেই হাসি দমিয়ে রাখতে পারল না। মুখে হাত চেপে শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসি বহু কষ্টে দামিয়ে বলল,
–“ভাইয়া, ম্যাম তো গাইনি ডাক্তার। আপনি কী প্রেগন্যান্ট?”
নার্সের সাথের এক জুনিয়রও এবার হাসি আটকাতে পারল না। জোনিরা এবার বেশ লজ্জিত হলো তানভীরের কর্মকাণ্ডে। অথচ এই নির্লজ্জটাকে দেখো! ভাব এমন, যেন সে কিছুই করেনি। জোনিরা ধমক দিয়ে বলল,
–“তাহমিদ কোথায়?”
–“সে জেনে আপনার কাজ নেই! আপনি আমাকে নিয়ে চলুন ড. আরিফের কাছে।”
–“ফাতরামি পেয়েছ? আমি গিয়ে কী করব?”
–“আজ আমার প্লাস্টার খুলবে। আপনি ছাড়া খুলছি না।”
–“না খুললে না খুলো, আমার কী? এই, চল তোমরা।”
জোনিরা যেতে নিলে তানভীর আবার পিছু ডেকে বলল,
–“ম্যাডাম! আমি আপনার পেশেন্ট! পেশেন্টকে ফেলে যাচ্ছেন কেন?”
–“এই চুপ! তুমি আমার পেশেন্ট কী করে হও?”
–“কেন হবো না? এইযে, আস্ত এক হৃদয়ের যন্ত্রণা সারিয়ে দেন আশেপাশে থাকলে। এটার সাধ্য অন্য কোনো ডাক্তারের আছে নাকি বলুন তো?”
–“তুমি এত জ্বালাও কেন আমাকে বলো তো?”
–“আপনি নিজে জ্বলতে চান, তাই!”
–“আমি চাই না।”
–“না চাইলে ওয়েটিং রুমে কেন আসলেন?”
–“আশ্চর্য! তোমার কথাতে এখন হসপিটালে চলতে হবে নাকি?”
–“না, তা নয়। তবে যেভাবে উঁকি দিয়েছিলেন আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর আপনি আমার জন্যই এসেছিলেন।”
চোর ধরা পড়ার মতো অবস্থা জোনিরার। সঙ্গে এও অনুভব করল এই ছেলের সাথে সে পারবে না। তাই রাগ গিলে সে নিজেই তানভীরকে ঠেলে ড. আরিফের চেম্বারে নিয়ে গেল। সেখানে আগে থেকেই তাহমিদ ছিল, সে তানভীরের এক্স-রের রিপোর্ট নিয়ে ড. আরিফের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত ছিল। জোনিরা তানভীরকে রেখে আসতে নিলে তানভীর তার হাত ধরে ফেলল। এতে জোনিরা তাহমিদ এবং ড. আরিফের সামনে লজ্জা পেয়ে বসল। তানভীর অযাচিত কিছু বলার আগেই জোনিরা তাকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
–“যাচ্ছি না কোথাও। আছি এখানে।”
জোনিরার চোখ রাঙানোতে স্পষ্ট হুমকি ছিল। যেন তানভীর লাগামহীন কিছু না বলে। তানভীর তা বুঝতে পেরে মুচকি হাসল। আহারে, জোনিরা তার চাইতেও বড়ো হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভয় পাচ্ছে। তাহমিদ জানালো আজই তানভীরের প্লাস্টার খুলে ফেলা হবে। এজন্য ওয়ার্ড বয় দুজন আসল তানভীরের প্লাস্টার কাটতে। জোনিরা তার পাশেই দাঁড়ানো। তানভীর এখন ডাক্তারের কেবিনে থাকা সিঙ্গেল বেডের ওপর বসা।
জোনিরা তানভীরের প্লাস্টার কাটা দেখলেও তানভীর দেখছে কিছুটা ঘেমে যাওয়া জোনিরার মুখ। কিছু ছোটো-বড়ো চুল জোনিরার কপালে লেপ্টে আছে। তার খুব ইচ্ছে করছে সেসব চুল গুছিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোস, তা আপাতত তার সাধ্যে নেই। জোনিরা যা রেগে আছে, তাতে দেখা গেল ভাইয়ের সামনে গালে দু’একটা চড় পড়ে গেল। তবে সে একটা সুযোগ হাতছাড়া করল না। সে সন্তর্পণে জোনিরার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নেয়। জোনিরা এতে চমকে আশেপাশে তাকায়। সবার নজর তানভীরের প্লাস্টারে। এতে জোনিরা সুযোগ বুঝে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। একসময় সফলও হলো, এতে তানভীর মুখ ভার করে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“বিয়েটা একবার করি আপনাকে। আপনার সমস্ত পালাই পালাই রোগ ছাড়িয়ে দেব।”
–“তোমার মতো বিচ্ছুকে বিয়ে করার কোনো সাধ নেই আমার।”
–“বিয়ে আপনি করবেন জোনিরা, আমার জন্যই আপনি বউ সাজবেন! তবে হয়তোবা সেদিন আমি থাকব না।”
তানভীর শুকনো গলায় কথাটা বলল। শেষ বাক্যটি সাধারণ হলেও কথাটার মধ্যে কেমন গভীরতা ছিল। সেই গভীরতা জোনিরার বুকে কাঁটার মতো বিঁধল। তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল, এই পাগলটা এসব বাজে কথা কবে শিখল? জোনিরা কোনো রকমে অন্য দিকে গিয়ে ড. আরিফের সাথে কথা বলল। ড. আরিফ জিজ্ঞেস করলেন,
–“ড. জোনিরার কী হন আপনারা?”
তানভীর উত্তর দেওয়ার আগেই তাহমিদ বলল,
–“জোনিরা আমাদের কাজিন হয়।”
তানভীর এতে চেতে যায়! কাজিন আর বোন দুটো কাছাকাছি লাগল তার। এজন্য মনে হলো কেউ তার বুকে পেরেক বিঁধে দিয়েছে। জোনিরা তার কাজিন হলেও তার ভবিষ্যৎ বউ! এইটা বলতে এত কার্পণ্য কিসের? এই কয়েক মিনিটের বড়ো ভাইয়ের ওপর তার ভীষণ রাগ হলো। আজ ঠিক করে মাহারিনের কান ভারী করবে তাহমিদের বিরুদ্ধে। তখন বুঝবে প্রেমিকা ক্ষেপলে কেমন লাগে!
প্লাস্টার খোলার পর আস্তে-ধীরে পা ফেলে তানভীরকে উঠে দাঁড়াতে বলা হয়। তানভীর উঠে দাঁড়াতে নিতেই পায়ে ব্যালেন্স রাখতে পারল না। যার ফলস্বরূপ সে জোনিরার উপর গিয়ে পড়ল। জোনিরা বহুকষ্টে তানভীরের ভার সামলে নিয়েছে। মিনমিন করে জঘন্য এক বকাও দিল তানভীরকে। এত কাণ্ড-জ্ঞানহীন কেন এই ছেলে? তানভীরের পায়ের কাছে ওয়ার্ড বয় ছিল। তাকেই ঠিকমত লক্ষ্য করেনি সে। ওয়ার্ড বয় কোনো রকমে সরি বলল। ততক্ষণে তানভীর নিজেকে সামলে সরে গিয়েছে। বহুদিন পায়ে প্লাস্টিক থাকায় তার পা অবশ হয়ে গিয়েছে। পা যেন শরীরের ভার নিতে পারছে না। তবুও তানভীর হাঁটার চেষ্টা করল দেয়াল কিংবা তাহমিদের সাহায্যে। তানভীর বাঁকা হেসে বলল,
–“কিছুদিন পর তো তোর পালা আমার ভাই!”
–“জানি। আমার ত এত সিরিয়াস ইস্যু না। আমার প্লাস্টার খুললেও এত ঝামেলা হবে না।”
–“না হলেই ভালো। তোর মতো হাত ভাঙাকে বিয়ে করে ভাবীর যা ঝামেলা পোহাতে হয়!”
–“ওর ঝামেলা লাগে না, যতটা এখন তোর লাগছে! ইডিয়েট!”
তানভীর বাড়ি পৌঁছাতেই দেখল তার বাবা-মা তাদের অপেক্ষায় বসে। পারভীন এতদিন পর ছেলেকে নিজ পায়ে হাঁটতে দেখে প্রাণ ফিরে পেলেন যেন। তানভীর মাকে কাঁদতে দেখে মাকে জড়িয়ে ধরল,
–“আহ মা! কাঁদছ কেন? আমি তো দাঁড়িয়েছিই। এইযে দেখো!”
পারভীন ছেলের মুখে মমতার হাত ছুঁয়ে বলল,
–“তুই জানিস না, তুই আমার কত দোয়ার।”
জোনিরা প্রাণভরে দেখল মা-ছেলেকে। তারেক সাহেব হেসে বললেন,
–“এবার বড়ো ছেলের হাত খোলার পালা। এরপর দুই ছেলেকেই প্রাণভরে দেখতে পারব।”
মাহারিন তাকাল তাহমিদের দিকে। গতকাল তাহমিদ এই এক হাত দিয়ে মাহারিনের জন্য কফি বানিয়েছে। তাও রাত বারোটার পর। মাহারিন তার ঘুম ভাঙিয়ে এই কাজ করিয়েছে। তাও যদি পুরো কফিটা খেত সে! বাকি অর্ধেক ঠান্ডা কফি তাহমিদকে খাইয়েছে সে। মাহারিনকে বিয়ে করার সাধ একদম মিটিয়ে দিচ্ছে তাহমিদকে। কিন্তু তাহমিদ যে কোন ধাতুতে তৈরি আল্লাহ ভালো জানেন। এ কোনো কিছুতেই বিচলিত হয় না। এ নিয়ে মাহারিনের রাগ হয়, খুব রাগ হয়! এতটা ধৈর্যশীলও তার পছন্দ নয়।
তানভীর হুট করে বলল,
–“ভাবী জানেন, আজ তাহমিদের ওপর একটা মেয়ে সেই পটেছিল। জোর করে নাম্বার নিতে চাইছিল।”
তারেক সাহেব এ কথা শুনে বলল,
–“তুই আর তাহমিদ তো একই! প্রপোজালটা আসলেই তাহমিদ পেয়েছে নাকি তুই?”
তানভীর কিছু বলার আগেই জোনিরা প্রতিবাদ ছুঁড়ল,
–“মিথ্যে খালু! এরকম কিছুই হয়নি। আপনার ছেলে এত বড়ো মিথ্যেটা কেন বলল জিজ্ঞেস করেন!”
তানভীর তাকাল তাহমিদের দিকে। তাহমিদ চোখ লাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। তানভীর এতে চোখ টিপ দেয়। তাহমিদ মিনমিন করে বিশ্রি গালি দিয়ে মাহারিনের দিকে তাকাল। মাহারিন কেমন করে চেয়ে আছে। তাহমিদ চোখের ইশারায় বুঝাল যে সব মিথ্যে।
মাহারিন রুমে আসলে তাহমিদ তার পিছু পিছু আসল। মাহারিন তাকে দেখেও না দেখার ভান ধরে আছে। তাহমিদ তার এড়িয়ে যাওয়া বিশেষ পছন্দ করল না। এজন্য সে মাহারিনকে নিজের কাছে টেনে নেয়। এতে মাহারিন শিউরে উঠে সামলায়। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
–“ছাড়ুন।”
তাহমিদ তাকে না ছেড়ে তাকে উলটো চুমু দিল। মাহারিনের চোখ জোড়া বড়ো হবার পাশাপাশি নিঃশ্বাসও ঘন হয়ে আসে। বলল,
–“কী সমস্যা?”
–“রাতে জ্বালানোর পারিশ্রমিক নিব না, ভাবলে কী করে?”
চলবে—