#মায়াতলীর_মোড়ে – [২০]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
মাহারিন আজ বেশ শখ করে ক্ষীর বানিয়েছে। তার ক্ষীর পছন্দ। পারভীন যখন বললেন তাহমিদ ক্ষীর অপছন্দ করে তখন তার মন ভেঙে গেল। এত মজার খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলেই তো এত তেতো কারবার করে সে। এজন্য মাহারিন আচমকাই একটা ফন্দি করল। এজন্য সে ক্ষীরের পাশাপাশি দুপুরে ভালো ভালো রান্না করল। তারেক সাহেবকেও কল করে অফিস থেকে চলে আসতে বলল। পারভীন বেশ খুশি হলেন মাহারিনকে তাদের সাথে এতটা মিশে যাওয়ার জন্য। মেয়েটা আসলেই চাঁদমুখী। কী সুন্দর অমায়িক ব্যবহার, তাহমিদসহ সবাইকে এক আঁচলে বেঁধে রেখেছে। মোর্শেদ সাহেবের মেয়ে তাঁর মতোই বিচক্ষণ। মেয়েটা তাদের আপন করে নিয়েছে, এরচেয়ে স্বস্তির আর কী হতে পারে?
দুপুরে সকলে খাবার টেবিলে উপস্থিত হলো। তানভীর, জোনিরাও। জোনিরা এখনো তাদের বাড়িতে আছে। আর তানভীর তার পাশের ঘরেই। তানভীর এখন হাঁটতে পারে, তবুও সে রুম বদলায়নি। কোনো না কোনো বাহানা দিয়ে থেকে যাচ্ছে। জোনিরা এতে রেগে প্রশ্ন করে,
–“এত বাহানা কিসের? আমার সাথেই তোমার এত লেগে থাকতে হবে কেন?”
–“আপনাকে এত কাছ থেকে অনুভব করার সুযোগ হাতছাড়া করি কী করে?”
–“আবারও ফালতু কথা!”
–“এগুলো ভালোবাসা।”
–“তুমি নিচে থাকো, আমি উপরে শিফট হচ্ছি।”
–“উপরে কেন? আমি গর্তে ঢুকে পড়লেও আমি আপনার পেছন পেছন চলে যাব। পেশেন্ট আবার ডাক্তারের থেকে এত দূরে থাকতে পারে না।”
–“তুমি কী চাও আমি বাড়ি থেকে চলে যাই?”
–“সে তো আপনি এমনিতেই যাবেন! যতদিন থাকছেন ততদিন সুযোগ হাতছাড়া করার মতো মুর্খ এই তানভীর নয়।”
খাবার টেবিলে এত আয়োজন দেখে তাহিয়া বেশ অবাক হলো। চোখ জোড়া চকচক করে বলল,
–“ওয়াও ভাবী, আজ এত খাবারের আয়োজন! আজকে কী স্পেশাল কিছু?”
তাহমিদ চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
–“তোর ভাবীর মন ভালো মানেই স্পেশাল কিছু।”
–“তাহলে ভাবী তুমি সবসময় হাসি-খুশি থাকো।”
মাহারিন হালকা হাসে। সে ঠিকই বুঝতে পারে তাহমিদের কথার মাধ্যমে দেওয়া সূক্ষ্ম খোঁচা। কিন্তু তাহমিদ তো এখনো ভাবতেই পারছে না তার জন্য ঠিক কী অপেক্ষা করছে! তাহমিদ খুব না বলেছিল তাকে বিয়ে করা মানে এডভেঞ্চার? কোথায় যেন শুনেছিল স্ত্রীরা স্বামীকে রান্না দিয়েই কুপোকাত করতে পারে। মাহারিন তাই এই টেকনিককেই কাজে লাগাল।
তারেক সাহেব আয়োজনে সন্তুষ্ট হয়ে বিনয়ের সাথে হেসে বসতে বসতে বলল,
–“আমার বউমা তো বেশ গুণবতীও দেখছি। বলতে হবে, আমার বন্ধুর মেয়েটা সবদিক থেকেই পার্ফেক্ট, মা-শা-আল্লাহ্।”
পারভীন হেসে দিয়ে বললেন,
–“এখন তো খেতেও বসবেন তাই না?”
জোনিরার পাতে পারভীন কিছু খাবার তুলে দিয়েছেন। জোনিরা খাবার চেখে দেখতেই তৃপ্তিতে তার চোখ বুজে এলো। সে মাহারিনকে বলল,
–“কী মজা হয়েছে মাহারিন! আমাকে শিখাবে? আমি রান্নায় ভীষণ অপটু।”
তানভীর পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল,
–“শিট! তবে তো রান্না-বান্না আমাকেই শিখতে হবে।”
জোনিরা তানভীরের পায়ে পা দিয়ে চাপ দিল। এতে তানভীর ব্যথায় কিছুটা নড়ে উঠল। সবাই সব খেতে পারলেও তাহমিদের সামনে ক্ষীর আর পরোটা রাখা। তার অন্য কোনো খাবারে হাত দেওয়া নিষেধ। তাহমিদ এতে করে মাহারিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“আমি ক্ষীর খাই না।”
–“কিন্তু আজ থেকে খাবেন!”
–“সত্যি খাই না।”
–“এই পুরো বাটি আপনি একা শেষ করবেন।”
–“আর বাকি খাবার?”
–“সেসব অন্যদের জন্য।”
–“এটা অন্যায়।”
–“ডাক্তারদের সব খেতে হয়।”
–“কিন্তু এটা ত হেলদি না। সুগার বেশি।”
–“তবুও খাবেন!”
–“তুমি কী খাবার দিয়ে আমাকে টর্চার করতে চাচ্ছ?”
–“কেন, আপনিই তো বলতেন আমাকে বিয়ে করা মানে এডভেঞ্চার! তবে?”
তাহমিদ এতক্ষণে মাহারিনের চাল বুঝতে পারল। সে কী যেন ভেবে হাসি-মুখে বলল,
–“তুমি বিষ ছাড়া যা দিবে, হাসতে হাসতে খেয়ে নিব।”
–“বিষ দিলে কী হবে?”
–“শেষ বয়স অবধি তোমার হাতে হাত রেখে এডভেঞ্চার অনুভব করতে হবে না? এত দ্রুত আল্লাহর প্রিয় হতে চাচ্ছি না।”
বলেই তাহমিদ ক্ষীর এক চামচ, দু চামচ করে খেতে লাগল। বাকি সবাই খাওয়া ভুলে অবাক হয়ে তাহমিদের খাওয়া দেখছে। যাকে কখনোই ক্ষীর গেলানো যায়নি, যে ক্ষীরের নামটাও শুনতে পারত না সে কিনা গপগপ করে ক্ষীর খাচ্ছে। এ কী আমূল পরিবর্তন! বাকিরা নির্বাক হলেও তানভীর তার স্বভাবতই মুখ খুলল,
–“ভাই আমার। তুই না ক্ষীর পছন্দ করতি না, তবে?”
পারভীন বললেন,
–“মাহারিনের পছন্দ।”
–“ওহহো, হাসবেন্ড ম্যাটারিয়াল! আচ্ছা ভাই, আসলেই কী বিয়ে করলে ছেলেরা এভাবে বদলে যায়?”
তারেক সাহেব খেতে খেতে বললেন,
–“তোকে মনে হচ্ছে শিগগিরই বিয়ে দেওয়া লাগবে। কথায় কথায় যে হারে বিয়ে বিয়ে করিস! হাড়ি ভাঙার আগেই শুভ কাজ সারতে হবে।”
–“তো দাও বিয়ে। ভাই আমার থেকে তিন মিনিটের বড়ো হয়ে বিবাহিত হতে পারলে আমি তিন মিনিটের ছোটো হয়ে কেন পারব না?”
জোনিরার খাবার গলায় আটকে যায়, যার ফলস্বরূপ যে বিষম খায়। মাহারিন ওদের ব্যাপারটা জানে বিধায় ঠোঁট চেপে হাসল। সে মুগ্ধ হয় তাহমিদের কাণ্ডে। ছেলেটা কী বদ, তার এক কথাতেই অপছন্দের খাবার খেয়ে নিচ্ছে। নাহ, এতটা টর্চারও করা যায় না। এজন্য মাহারিন ক্লনিজ হাতে অন্য প্লেটে পোলাও, কালোভুনা এবং টিকা কাবাব তুলে দেয়। পারভীনের দিকে তাকাতেই পারভীন চোখের ইশারায় তাহমিদকে খাইয়ে দিতে বলল। মাহারিন তাই হাত ধুঁয়ে এসে তাহমিদের পাশের চেয়ার টেনে বসল। অতঃপর মিনমিন করে বলল,
–“আর খেতে হবে না ক্ষীর।”
–“আমি ক্ষীরের স্বাদ জানি না। তবে তোমার বানানো ক্ষীর খেয়ে মনে হলো দারুণ কিছু খাচ্ছি।”
তাহমিদের এহেম প্রশংসায় তানভীর শিস বাজিয়ে উঠল। মাহারিন এতে লজ্জা পেয়ে বলল,
–“আর খেতে হবে না। আসেন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। আর বাম হাতে খেতে হবে না।”
তাহমিদ তৎক্ষণাৎ হাতের চামচটা নামিয়ে ফেলল। মাহারিন তাকে খাইয়ে দিলে তার ভীষণ শান্তি অনুভব হয়। মাঝেমধ্যে আকিবকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হয়, ওর জন্যই তো তার হাতটা ভেঙেছিল। ভাগ্যিস!
তানভীর ভাই-ভাবীকে দেখছে। জোনিরা ওদের থেকে নজর সরিয়ে তানভীরের দিকে তাকাল। তানভীরকে দেখে সে হালকা হাসল। এরা দুই ভাই একই। না জানি তানভীর তার বউকে কীভাবে ট্রিট করবে? ভাবতেই জোনিরার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সেই মন খারাপের ভারে সেদিন বিকালে যে বের হলো, আর আসল না এ বাড়িতে।
মাহারিন ভেবেছিল তাহমিদ সব সুন্দর ভাবেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সব কী আদৌ এত সোজা? সন্ধ্যার পর তাহমিদ নিজ হাতে রেঁধে আনল গরম ভাত আর করোলা ভাজি। করোলা মাহারিন খাবে কী, গন্ধ শুকলেই তার বমি পায়। সেখানে তাহমিদ তো রাঁধতে পারে না। তেতো করোলা আরও বিচ্ছিরি হবে নিশ্চয়ই? মাহারিন তাহমিদের হাতে এই বিচ্ছিরি জিনিস দেখে থতমত খেয়ে গেল।
–“এসব কী?”
–“কেন? করোলা ভাজি!”
–“আমি তো করোলা দেখতেই পারি না, খাব কী? ভাতটাও ভর্তা ভর্তা হয়ে গেছে।”
–“সমস্যা কী? এত ভালোবেসে রাঁধলাম তোমার জন্য। ভাতের ভর্তাই দেখলে, ভালোবাসাটা দেখলে না?”
তাহমিদের ইনোসেন্ট মুখটার পেছনে যে কঠিন শ*তান লুকানো তা মাহারিন হারে হারে টের পেল। মাহারিন হালকা ঢোক গিলে বলল,
–“আপনাকে আমি ক্ষীর খাইয়েছি বলে আপনি আমার সাথে এমন করতে পারবেন? আমার রান্না তো মজাই ছিল।”
–“উহু, জান! আমি ট্রেন্ড ফলো করছি। “অপছন্দের খাবার ভালোবেসে খেয়ে নেওয়া ট্রেন্ড” এই ট্রেন্ড তুমিই চালু করেছ। তোমাকে কী করে এ থেকে বঞ্চিত করি বলো তো বউ?”
মাহারিন বুঝল তার চাল তার উপরই এসে জঘন্যভাবে পড়েছে। তবুও সে খাবে না মানে খাবে না। কিন্তু তাহমিদ কী শোনার পাত্র? সে জোর করে মাহারিনকে এক চামচ খাওয়াতেই মাহারিন বমি আসার উপক্রম। সে তাহমিদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। তাহমিদ ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল,
–“তোমাকে তো ছুঁলামই না আমি, এত দ্রুত প্রেগন্যান্ট হলে কী করে?”
ভেতর থেকে মাহারিনের ধমক শোনা যায়,
–“চুপ করেন বদজাত লোক।”
চলবে—