#মায়াবতীর সংসার
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৪
বিপ্রতীপ কল করেছে। কল ধরতেই মায়াকে বলে উঠল
“ম্যম আপনার বাসার নীচে আমি। তখন খাবার দিতে পারলাম না তাই খাবার নিয়ে এসেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত এখনও একটা আকাম করে ফেলেছি। আপনার বাসার সামনে যে কুকুরটা সে আমাকে কামড় দিয়েছে। কী করা যায় বলুন তো? এ কুকুরের কী ভ্যাক্সিন দেওয়া?”
মায়ার হাসিও পাচ্ছে আবার বিরক্তিও আসছে। সে কঠোর গলায় উত্তর দিল
“এটা রাস্তার কুকুর ভ্যাক্সিন কেন দেওয়া থাকবে? অবশ্যই আপনাকে ভ্যাক্সিন নিতে হবে। পশু হাসপাতালে গিয়ে ভ্যাক্সিন নিয়ে নিয়েন ছাগল কোথাকার।”
বিপ্রতীপ মনমরা কন্ঠে বলল
“ঠিক আছে সকাল হলেই যাব। আপাতত কী করব? আর খাবার টা একটু কষ্ট করে নিয়ে যাবেন?”
মায়া বেশ রাগান্বিত গলায় উত্তর দিল
“আপনি এসব বাড়াবাড়ি করছেন। ভুলে যাবেন না আপনি শুধুই আমার কলিগ।”
বিপ্রতীপ মায়ার কথা ব্যাগড়া দিয়ে বলল
“আমি জানি কলিগ। তবে সেটা অফিসে। অফিসের বাইরে তো আমরা ভালো ফ্রেন্ড।”
মায়া আবারও রাগান্বিত গলায় উত্তর দিল
“আমরা কেউ না। এভাবে বিরক্ত করবেন না।”
বলেই কলটা কেটে দিল সে। চুপ করে শুয়ে আছে। বিপ্রতীপের অল্প বয়স। এ বয়সে এসব পাগলামি কেবল আবেগের বশেই করছে। এমন পাগলামি একটা সময় সেও করত। আর আজ সব স্মৃতি। আবারও পুরনো স্মৃতিতে ডুব দিল সে। সেদিন ছিল ভ্যালোন্টাইন ডে। মায়া আর মিহানের দূরত্ব বেশি না। তবে সে অসুস্থ হওয়ায় এসব ডে পালনের চিন্তা আসেনি তার। তবুও রিলেশন হওয়ার পর প্রথম ভ্যালেন্টাইনে সে শাড়ি পরেছিল। একটা লাল জরজেট পাতলা শাড়ি। চুলগুলো ছেড়ে কানের একপাশে লাল টকটকে গোলাপ ফুল গুজেছিল৷ ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। বেশ সুন্দর করেই সেজেছিল সে। মিহানকে কল করে বলছিল সে সেজেছে। বিকেলে একাই বের হবে। চারপাশটা দেখবে। একা একটা রেস্টুরেন্টে কিছুক্ষণ খাবে তারপর চলে আসবে। সে ভাবনা থেকেই সে বিকেলে বের হয়। একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। হঠাৎ কারও হাতের স্পর্শ তার কাঁধে এসে লাগল। সে ভয়ে পেছন তাকিয়ে চমকে গেল। মিহান দাঁড়িয়ে আছে। মিহান তার দিকে একটা ফুলের বুকে এগিয়ে দিয়ে বলল
“অসুস্থ যদিও তারপরও কী তোমার স্পেশাল মোমেন্ট স্পয়েল করতে পারি বলো? আমার মনে হলো আজকের দিনটা তোমার স্পেশাল করতে না পারলে তোমাকে কষ্ট দেওয়া হবে। তাই জ্বর নিয়েও চলে আসলাম।”
কথাগুলো বলে মিহান আমার পাশে বসলো। মায়া কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। সেদিনের তার এ এফোর্ড মায়াকে মুগ্ধ করেছিল। মায়া খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। তার ভালোবাসা সেদিন মায়াকে পাগল করে তুলেছিল। সেদিন বয়স অল্প ছিল অভিজ্ঞতা কম ছিল। তাই হয়তো এসব ম্যাকি ছলনাগুলো খুব বেশি ভালো লাগত আর বিশ্বাস করে ফেলেছিল। তবে আজকে তো আর সেই ছোট্ট মায়া নয় সে। আজকে সে যথেষ্ঠ বড়ো আর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তাই এ নাটক, ম্যাকি আবেগ তাকে আর গায়েল করতে পারে না।
কলটা পর পর দুবার বাজলো। হাতে ফোনটা নিয়ে দেখল বিপ্রতীপ কল করেছে। সে আর কল ধরেনি। তবে বিপ্রতীপের মেসেজ আসলো
“ম্যাম আমি চলে যাচ্ছি। আপনার খাবার আপনার ব্যালকনিতে রেখে গেছি। পাইপ বেয়ে তিনতলায় উঠে বেলকনির গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে ভেতরে খাবার রেখে গিয়েছি। বড্ড রিস্ক নিয়ে ফেলেছি। তার উপর কুকুরের কামড়ের জখম। এত কষ্ট করে খাবার এনেছি অবশ্যই খাবেন। আমার উপর রাগ করলেও রিজিকের উপর রাগ করবেন না প্লিজ। ইতি দ্বীপ। এ দ্বীপ নামটা শুধু আপনার জন্য। আপনি আমাকে দ্বীপ বলেই ডাকবেন।”
মায়া কিছুটা অবাক হয়ে বেলকনির কাছে গেল। সত্যিই দুই বক্স খাবার বেলকনির গ্রিলের ভেতর দিয়ে ভেতরে রেখে গেছে সে। মায়া খাবারের বক্সটা হাতে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে আসলো। সে খাবার গুলো খুলে দেখল একটাতে মাসালা মুরগি আরেকটাতে পরোটা। মায়া ভাবছে বিপ্রতীপ কী করে জানলো এসব তার পছন্দ। মায়া বেশ দুটানায় পড়ে গিয়েছে এ খাবার খাবে কি’না। একটা মানুষের উপর রাগ করে এ খাবার ফেলে দেওয়াও ঠিক হবে না। আর এত রাতে কাউকে দেওয়ার অবস্থাতেও সে নেই। তাই বেশ চিন্তা করে সে খাবারগুলো খেল। বেশ মজার রান্না ছিল। খাওয়ার পর মন চাচ্ছিল আরও খেতে। সে ভাবল সকালে বিপ্রতীপকে কলিগ হিসেবে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দিবে।
সকালের রোদ এসে মায়ার মুখে পড়েছে। সে হুড়মুড়িয়ে উঠল। ফজরের নামাজটাও তার কাজা হয়ে গিয়েছে। দ্রূত সে নামজটা পড়ে নিল। এরপর তৈরী হয়ে স্কুলের গেল। স্কুলে গিয়ে সে বিপ্রতীপকে খুঁজছে মনে মনে। তবে বিপ্রতীপ আজকে আসে নি। বিপ্রতীপকে কল দেওয়ার সাহসও তার হচ্ছে না। কারণ এতে তার পাগলামি আরও বাড়বে। তাই সবকিছু ভেবে সে প্রন্সিপালের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে বিপ্রতীপ কেন আসে নি। প্রিন্সিপাল হেলেনা গম্ভীর গলায় উত্তর দিল
“আমাকে এক্সপ্লেনেশন করেছে সে তার গার্লফ্রেন্ডকে খাবার দিতে রাত তিনটেতে গিয়েছিল তখন নাকি গার্লফ্রেন্ডের পোষা কুকুর তাকে কামড় দিয়েছে। সে এখন খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি আর কুকুরের ইনজেকশন দিয়েছে৷ আসতে তার এক সপ্তাহ সময় লাগবে। আমি বুঝতে পারলাম না মানুষ এত বড়ো আহম্মক হয় কি করে? কুকুর কামড়ানোর এত অদ্ভুত এক্সপ্লেনেশন এ প্রথম শুনলাম। যদিও প্রথম বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু পরে ডকুমেন্টস পাঠানোর পর বিশ্বাস হলো ঘটনা সত্য। এ আহাম্মকের গার্লফ্রেন্ড কে সেটা দেখার অনেক ইচ্ছা জাগছে। আর কী করে এত বড়ো একটা স্কুলের টিচার হলো সেটাও ভাবছি। আর ওর পরিবারে খোঁজ নিয়ে দেখেছি বেশ স্ট্যাবল পরিবারের ছেলে। ওর তো এ স্কুলে জব না করে বাবার বিজনেস দেখার কথা। কেন যে জব নিতে আসলো সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। ওর সব কাজেই একটা সন্দেহ মিশে থাকে। যাইহোক অনেক বকবক করে ফেললাম। তুমি তোমার কাজে মন দাও।”
মায়া আর কথা বাড়াল না। মিসেস হেলেনার কথা শুনে সে তার ডেস্কে চলে আসলো। ভেতরে ভেতরে বিপ্রতীপের জন্য তার একটু খারাপ লাগছে। তাই স্কুল ছুটি হওয়ার পর সে সরাসরি চলে গেল বিপ্রতীপকে দেখতে। কেবিনে নক করলেই একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ দরজাটা খুলে দিল। মায়াকে দেখেই জিজ্ঞেস করল
“কে আপনি? কিছু চাই?”
মায়া অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিছুক্ষণ নীরব থাকল চারপাশ৷ সে নীরবতা ভেঙে বিপ্রতীপ উত্তর দিল
“ভাইয়া ও তো মায়া। আমার কলিগ। যার কথা বলেছিলাম তোমাকে। উনার জন্যই তো রান্না করে খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। খাবার নিয়ে গিয়ে কুকুরের কামড় খেলাম। ভেতরে আসতে দাও। আমি তো চিন্তাও করতে পারতেছি না উনি আসছে।”
বিপ্রতীপের ভাই বিপ্লব তার কথা শুনে একটু গলাটা খাকালো। তারপর মায়াকে বলল
“হুম ভেতরে আসুন। চেয়ারে বসুন। আমার প্রথম চিনতে ভুল হয়েছে। কখনও দেখিনি তো তাই৷ আর ছবিতে আপনাকে দেখতে যতটা সুন্দর লাগে সামনাসামনি আপনি আরও বেশি।”
মায়া কথা বাড়াল না। হালকা গলায় বলল
“ধন্যবাদ।”
এরপর বিপ্রতীপের পাশে বসলো। জানতে চাইল সে কেমন আছে। বিপ্রতীপ হাসি মুখে উত্তর দিল
“অনেক ভালো আছি। ভালোই হয়েছে কুকুরটা কামড় দিয়েছে নাহয় তো আপনি এসে দেখা করতেন না। আর এত ভালো করে কথা বলতেন না।”
মায়া কপালটা কুচকে উত্তর দিল
“হেলেনা ম্যামের কাছে আপনি এরকম অদ্ভুত এক্সপ্লেনেশন কেন দিলেন? আমি কী আপনার গার্লফ্রেন্ড হই?”
বিপ্রতীপ হাসতে হাসতে উত্তর দিল
“আমার দিকে থেকে হ্যাঁ। আপনার দিক থেকে না। আমি আমার দিক ভেবে বলেছি।”
মায়া রাগে উত্তর দিল
“আপনি কী পাগল? পাগলামির একটা সীমা থাকা দরকার। একদম অসহ্য লাগছে এসব।”
বলেই মায়া চেয়ার ছেড়ে উঠে হাসপাতাল থেকে বের হলো। হাসপাতাল থেকে বের হতেই সে মিহানের মুখোমুখি হলো। মিহান মায়াকে দেখে বলতে লাগল
“তুমি এখানে? যাইহোক এসেছো ভালো করেছো। আমি এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। চলো তোমাকে ড্রপ করে দিই।”
মায়া নিজেকে সামলাতে পারল না। সে মিহানের গালে কষে চড় দিয়ে বলল
“কী ভেবেছেন? আমি কিছু জানি না? গেইম খেলতে খলতে আপনার স্বভাব হয়ে গেছে। নিজের মেয়েকে এমন নোংরা গেইমে কী করে জড়ালেন? আমি নিজেকে কন্ট্রোল করে শুধু আপনার সীমা দেখলাম। আপনি সেটা অতিক্রম করে ফেলেছেন। নিজের বউ থাকা সত্ত্বেও এত বড়ো ড্রামা করতে বিবেকে বাঁধছে না? অসভ্য ইতর লোক।”
কথাগুলো বলেই মায়া রাস্তা পার হতে যাবে। ঠিক এমন সময় হাসপাতাল থেকে হৈ হৈ রৈ রৈ শব্দ বের হতে লাগল। মায়া কাহিনি বুঝার জন্য পেছনে ফিরতেই হা হয়ে গেল৷
চলবে।