#মায়াবতীর সংসার
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১০
মিশবা বিপ্রতীপকে দেখে বলল
“রুমাইশার কোনো খবর কী পেয়েছো? আমার আর এসব ভালো লাগছে না।”
মিশবার এমন প্রশ্নে মায়ার মনে সন্দেহ ঢুকে গেল। মনে হচ্ছে বিপ্রতীপ কিছু লুকাচ্ছে। তবে সেটা কী? কিছুই যেন বুঝে উঠছে না মায়া। মায়া মিশবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনার চেষ্টা করলো। কিন্তু বিপ্রতীপ মিশবাকে চোখে ইশারা দিয়ে থামিয়ে দিল। বুঝাতে লাগল মায়ার সামনে এসব বলা ঠিক হবে না। মায়াও ইশারাটা ঠিক বুঝতে পারল। তবে সেটা না বুঝার ভান ধরে বসে রইল। এই বিপ্রতীপের মাঝে কিছু একটা আছে সে বুঝতে পারছে। তবে সঠিক বিষয়টিই সে উদঘাটন করতে পারছে না। বিপ্রতীপ মিশবাকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। মায়া বিপ্রতীপের পিছু নিল। বিপ্রতীপ রুম থেকে বের হয়ে সিড়ি দিয়ে নীচে গেল। বাসাটা ডুপ্লেক্স। এতক্ষণ মায়া বুঝেনি বিষয়টি। কারণ রুমে বসে থেকে বাসার গড়ন বুঝা মুশকিল। মায়া আর নীচের দিকে গেল না। এতে করে বিপ্রতীপ মায়াকে দেখে ফেলবে। তবে মায়ার ভেতরের খুতখুতটা একদম সরছে না। সে তার রুমে এসে এসবেই ভাবছে।
এদিকে বিপ্রতীপ মিশবাকে নিয়ে নীচের একটা রুমে গেল। রুমটা সে তালা দিয়ে রেখেছিল। চাবি দিয়ে তালা খুলে সে রুমে প্রবেশ করল। এরপর মিশবাকে বললো
“মিশবা ভাই আপনার কী বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? আপনি চেনেন না জানেন না একটা মেয়ের সামনে এ নিয়ে কথা বলছেন? এতে কতটা ঝুঁকিতে পড়তে পারি কোনো আইডিয়া আছে?”
মিশবা কান্না গলায় বলল
“তোমার ভাবী খুব স্ট্রেসে আছে। মেয়ের শোক সে কাটিয়ে উঠতে পারছে না। মেয়েটা আমার বেঁচে আছে কি’না সেটাই জানি না। দেড় মাস হতে চলল দ্বীপ। আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। ধৈর্য ধরতে ধরতে মারা যাব আমি। তোমার ভাবীর দিকে তাকানো যাচ্ছে না।”
বিপ্রতীপ মিশবার কাঁধে হাত রেখে বলল
“মিশবা ভাই ধৈর্য আরেকটু ধরেন। রুমাইশার খোঁজ আমরা পেয়েছি। ওকে চিটাগং রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সে সুস্থ আছে। ওদের দলটা অনেক শক্ত। চাইলেও এত সহজে ধরতে পারব না। ১৬ তারিখ আমরা অপারেশনে যাব। আর মিশবা ভাই যে মেয়েটার সামনে কথা গুলো বলছিলেন সে ও ঐ স্কুলের টিচার। আমি দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস করি না। তাকে আমি ভালোবাসি তবে পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। সে যদি কথায় কথায় কখনও বিষয়টা বলে দেয় তাহলে সব পরিকল্পনা বিফলে যাবে। থানায় জেনে গিয়েছিল আমার পরিচয়। সেটাও আমি কোনোভাবে কৌশলে হ্যান্ডেল করেছি। এখন উল্টো থানার লোক আমাকে পেদানোর জন্য খুঁজছে। তবে সবকিছুই আমি সামলে নিব। আমার এ পরিচয় আমার বড়ো ভাই আপনি ছাড়া কেউ জানেন না। মায়াও জানতে পেরেছিল। তবে এ মুহুর্তে সবাইকে আমার বিপদজনক লাগছে তাই বিষয়টি কৌশলে লুকাতে হয়েছে। রুমাইশা আমারও ভাগ্নী। আমার বংশের রক্ত সে। ওকে বাঁচাতে নিজের জীবন দিতে হলেও দিব। তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন আল্লাহ রুমাইশাকে হায়াতে রাখলে আমি তাকে বাঁচিয়ে আনব।
আমি আপাতত ১ সপ্তাহ স্কুলে যাব না। স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছি। মায়ারও ছুটির ব্যবস্থা করেছি। যে করেই হোক মায়াকে এ বাসাতেই রাখব। আর আমি ১ সপ্তাহের মধ্যেই দলটিকে হাতেনাতে ধরব। রুমাইশার সাথে সেখানে আরও ১৬ টি বাচ্চা আছে। ১৬ তারিখ তারা বাচ্চাগুলোকে চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটিতে নিয়ে যাবে। সেখানে আদিবাসীদের একটা টিলাতে রাখবে বাচ্চাগুলোকে। সে টিলাতেই অপহরণকারীরা অবস্থান করবে। এ টিলা থেকেই আমরা ওদের উদ্ধার করব। আদিবাসীদের কিছু সংখ্যক মানুষ এ কাজে জড়িত। তাই ঐ এলাকায় আমরা নিরাপদ না। সবাইকে নিরাপত্তা নিয়েই যেতে হবে। আমি চাই না আমার টিমের সাথে কোনো খারাপ কিছু হোক।।আমি চাই সবাই বেঁচে তার পরিবারের কাছে ফিরুক।”
মিশবা বিপ্রতীপকে জড়িয়ে ধরে বলল
“আমি শুধু আমার রুমাইশাকে চাই।”
বিপ্রতীপ মিশবাকে স্বাত্ত্বণা দিল। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে সে ঘরটা আবার তালাবদ্ধ করে দিল। জানালার ফাঁক দিয়ে মায়া সবই খেয়াল করল। ভাবতে লাগল সে ঘরে কী আছে? মিশবা কী বড়ো মাফিয়া? কিছু তো একটা আছে। সবকিছুই তাকে আড়াল করা হচ্ছে। থানায় গিয়ে এতসব কাহিনি, তারপর এত ঘটনা ঘটে যাওয়া। এর মধ্যে সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাওয়ার বিষয়টা একদম স্বাভাবিক লাগছে না। মায়া মনে মনে ওয়াদা করল বিপ্রতীপকে সে নজরে রাখবে। বিপ্রতীপের সকল তথ্য সে যে করে হোক উদঘাটন করবে। যদিও সে আজকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তবে এসব কারণে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
মিশবা চলে গেল। বিপ্রতীপ পুনরায় মায়ার কাছে আসলো। মায়ার কাছে এসেই বলতে লাগল
“খাওয়া হয়েছে? নাকি আমার বউ সতীন আনার জন্য রাগ করে আপনাকে খাবারেই দেয় নি?”
মায়া বিরক্ত গলায় বলল
“আপনার এসব মজা আমার ভালো লাগে না। একতরফা জিনিসটাকে আর বাড়াবেন না। আপনার আমার প্রতি ভালোলাগা ভালোবাসা থাকতে পারে। আমি সেটা সম্মান করি। তবে আমার দিক থেকে কিছু নেই। তাই সবসময় আপনার করে যাওয়া মজা আমি নিতে পারি না৷ মিহানের বিষয়টা মানতে পারছি না। জীবনে একের পর এক শুধু ভুলেই করে গিয়েছি। আমি সেসব ভুলের ভার নিতে পারছি না। মাকে হারিয়েছি ছোটোবেলায়। আর বাবা চলে গেলেন ৬ বছর আগে। সব মিলিয়ে আমি শান্তিতে নেই। একা একটা জীবন। আত্মীয়স্বজন থেকেও যেন নেই। খুব শূন্য লাগে, অস্থির লাগে। যখন চিন্তা করি জীবনে কাউকে আনব ঠিক তখনই মনে হয় আমি আবার ঠকব। সেজন্য আমি আমার জীবনে কাউকে আনার সাহস করতে পারি না। আমার এ অস্থিরতা কবে কাটবে জানি না। আমি একটু স্বস্তি চাই।”
বলেই মায়া কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।।বিপ্রতীপ মায়াকে ধরে উঠাল তারপর বিছানায় বসিয়ে বললো
“আপনি না চাইলে আমি আর এমন মজা করব না। আমি হেয়ালি করে চলি। জীবনে আমারও একটা কষ্ট আছে। খুব অল্প বয়সে একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। সেই মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কেন চলে গেছে জানা নেই। একদিন একটা মেসেজ আসলো মোবাইলে। মেসেজটা ছিল সে আমার সাথে থাকতে চায় না। এ সম্পর্ক আর আগাতে চায় না।
এরপর বিয়ে করে দেশের বাইরে চলে গেল। আর দেখা হলো না। কথা হলো না। শূন্য বুকটা কেবল খা খা করত। কত যে কেঁদেছি হিসাব নেই। মেয়েদের মতো হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদতাম। আস্তে আস্তে সময় পাল্টেছে। জীবনের গতি পাল্টেছে। আর সে সাথে আমার জীবন থেকে কালো মেঘটাও চলে গেছে। আমারও ভুলতে কষ্ট হয়েছে তবে ভুলে গেছি।
এরপর স্কুলে আপনার সাথে দেখা। গম্ভীর একটা মেয়ে। সবসময় চুপচাপ থাকে। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কম কথা বলে। কারও সাথে বাড়তি কথায় মেতে উঠে না। ক্লাস,অফিস নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে চলে যায়। আমার কাছে মনে হত আপনার মুখটা কালো ছায়ায় তলিয়ে গেছে। হয়তো কোনো দুঃখ আপনাকে গ্রাস করেছে। সব মিলিয়ে মনে হলো আপনার সাথে একটু কথা বলা জরুরি। আপনার সঙ্গ দেওয়া জরুরি। সে চিন্তা করতে করতেই কখন যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি জানি না। জাত, কূল কিছু বিচার করিনি আমি। যোগ্যতা বা অযোগ্যতার বিচার তো বাদ আপনাকে আমার জীবনের বিচারক বানাতে চেয়েছি। খুব ভালোবাসি আপনাকে। আমার খামখেয়ালেপনা কথা আপনার কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য পায় আমি জানি না। তবে আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি। আপনার খারাপ লাগাকে সম্মান করে আমি আর আপনার সাথে মজা করব না।”
কথাগুলো বলেই বিপ্রতীপ বের হয়ে গেল। ছাদে গিয়ে খালি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মেঘলা আকাশ দেখে আজ তার মেঘলার কথা মনে পড়ছে। যে মেঘ হয়ে এসেছিল তার চোখে বৃষ্টি দিয়ে চলে গিয়েছিল। প্রথম ভালোবাসা ছিল সে। তবে সে ভালোবাসার স্থান আজকে অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে। তাকে ছাড়া বাঁচব না বলা মানুষটাও তাকে ছাড়া দিব্যি বেঁচে আছে। এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম৷ তবে মস্তিষ্ক থেকে চায়লেই মানুষ সব মুছতে পারে না। চায়লেই সব ভুলা যায় না। পুরনো স্মৃতি, পুরনো মানুষ তখনেই মনে পড়ে যখন নতুনকে নিয়ে সে স্যাটল হতে পারে না। আজকে ঠিক একইরকম বিষয়টা বিপ্রতীপের সাথে ঘটেছে।
বিপ্রতীপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ গড়িয়ে তার পানি পড়ছে। মায়ার হাতের স্পর্শে সে আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে মায়ার দিকে তাকালো। মায়া হালকা গলায় বলল
“অন্ধকার মেঘলা আকাশে কী দেখছেন?”
বিপ্রতীপ নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল
“ফেলে আসা কালো অতীত।”
মায়া বিপ্রতীপের দিকে তার ঘরের চাবিটা এগিয়ে দিয়ে বলল
“হুম ভালো। তবে ভুল করে আমার বিছানার উপর আপনার গোপন কক্ষের চাবিটা ফেলে এসেছিলেন। সেটাই দিতে আসলাম। ”
বিপ্রতীপ মায়ার হাত থেকে চাবিটা নিয়ে ঘামতে লাগল। কারণ..
চলবে।