#মায়াবতীর সংসার
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১১
কারণ ঐ ঘরটায় বিপ্রতীপের কাজের সকল বর্ণণা ছিল। মায়া বিপ্রতীপকে ঘামতে দেখে জিজ্ঞেস করলো
“ঘামছেন কেন? রহস্য ফাঁস হয়ে গিয়েছে তাই? আপনি নিজেকে বড্ড চালাক মনে করেন তাই না? ভুল করে পরিচয় ফাঁস করে দিয়ে আবার সেটা গোপন করতে চেয়েছেন। আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন তাই না? ভালোই যদি বাসেন তাহলে এ সত্য লুকানোর চেষ্টা কেন করেছেন? ভালোবাসার প্রথম ভিত্তি হলো বিশ্বাস। সেটা উঠে গেলে কখনও সে ভালোবাসা টিকে না। মিহান আর আমার ভালোবাসার বিশ্বাসটাই চলে গিয়েছিল। তাই এত বছর হবার পরও আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনি। সেজন্য আমার এ জীবনে আমি শূন্যতাকে আগলে ধরে রেখেছি। আপনার আমার প্রতি ভালোবাসা না বরং যেটা আছে সেটা মোহ।”
বিপ্রতীপ চুপসে গেল। বিপ্রতীপের অবস্থা দেখে মায়া আরও বলল
“আপনার চুপসানো মুখটা ভালো লাগছে না আমার। আপনাকে আমি ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। কারণ আমার ক্রাইসিস মোমেন্টে আপনাকে পাশে পেয়েছিলাম। সব মিলিয়ে একটু দুর্বলতা আপনার প্রতি আমার জন্মেছিল। সেটা হয়তো একটা সময় ভালোবাসায় রূপ নিত। তবে আপনি সেটাও নষ্ট করে দিলেন। আমাকে বললে আমি কী আপনার ক্ষতি করতাম? নূন্যতম বিশ্বাস আপনার আমার প্রতি ছিল না।”
বিপ্রতীপ ঘাবড়ে গেল। মায়াকে পেয়েও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। শরীরটা ভীষণ কাঁপছে তার। সরাসরি সে মায়ার পায়ের কাছে গিয়ে মায়ার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল
“আমাকে কী ক্ষমা করে দেওয়া যায় না। আমি প্রফেশন লাইফ আর পারসোনাল লাইফ এক করতে চাইনি। সেজন্য এতগুলো কথা লুকিয়েছি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। তবে মনের মধ্যে কিন্তু ছিল সেজন্য বলতে গিয়েও সব লুকিয়েছি। আপনি ক্ষমা করে দেন। আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ। আপনিও এতিম আমিও এতিম। আমার বাবা থাকা স্বত্ত্বেও আমি বাবার ভালোবাসা পাইনি। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। আর সবগুলো কষ্ট ছিল কাছের মানুষ থেকে ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট। আপনি ভুল বুঝলে আমার নিজেকে অনেক অসহায় লাগবে। দয়াকরে একটা কাজের উপর ভিত্তি করে আমার ভালোবাসাকে মাপবেন না। আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি।”
বিপ্রতীপের এ আহাজারিতে মায়ার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে। সে বিপ্রতীপকে পায়ের কাছ থেকে তুলল। লক্ষ্য করলো বিপ্রতীপ ঠিক মেয়েদের মতো কাঁদছে। মায়া নিজেকে সামলে হালকা হেসে বলল
“কাঁদলে ঠিক আপনাকে মেয়েদের মতো লাগে। আপনি কাঁদবেন না তো। হাসুন একটু। হাসলেই আপনাকে অপূর্ব লাগে। আপনার হাসি মাখা মুখ আর চোখে আমি শক্তি খুঁজে পাই। আপনার ভালোবাসাকে আমি সম্মান করি। আপনার এ অপারেশন সাকসেস হোক। এ অপারেশনের পর আপনার আর আমার একটা সংসার হবে। এরপর সে সংসারের নাম হবে মায়াবতীর সংসার। এ অপারেশনে আপনার সঙ্গী হতে চাই আমি। ”
বিপ্রতীপ মায়ার কথায় হাসলো। হেসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। তার মনে হচ্ছে আল্লাহ যেন এ মুহুূর্তে সকল পূর্ণতার বার্তা মায়ার মাধ্যমে দিল। হাসতে হাসতেই মায়াকে বলল
“এ অপারেশনে আপনাকে সাথে নিতে পারলে আমার অনেক ভালো লাগত। তবে নন প্রফেশন কাউকে আপাতত রাখা যাবে না। খুবই জটিল কাজ। তাই মন সায় দিলেও আমি সেটা পারছি না। আর এতে আপনার জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভবনা আছে। আমি তো জেনে শুনে আপনাকে বিপদে ফেলতে পারি না।”
বিপ্রতীপের কথা শুনে মায়া নিজের কামিজের পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বিপ্রতীপকে দিয়ে বলল
“প্রাইভেট ডিটেকটিভ মায়া বলছি। আশা করি এখন আমাকে সাথে নিয়ে কাজ করতে সমস্যা নেই? আমি কাজ করছি বিজনেসম্যান সুয়েব চৌধুরির কেইস নিয়ে। তার মেয়ে সনিয়া নিঁখোজ। এ স্কুলে আমি জয়েন করেছি অনেকদিন হয়েছে। আমি ডিটেকটিভ হয়ে স্কুলে জয়েন করিনি। তবে স্কুলে জয়েনের পর আমি ডিটেকটিভ হয়েছি। সরকারি কোথাও হচ্ছিল না। তাই ভাবলাম স্কুলের পাশাপাশি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হয়ে কাজ করি। আমার প্রথম কাজ এটা। আমার বন্ধু রিনা জানত আমি ডিটেকটিভ হয়ে কাজ করতে চাই। আর তার পরিচিত ছিল সুয়েব চৌধুরি। উনার মেয়েও এ স্কুলে পড়ত। সেজন্য তিনি আমাকে এ কাজ দেন যেহেতু আমি এ স্কুলেই আছি। গত তিনমাস ধরে এটা নিয়ে কাজ করছি। এ কয়দিনে অনেক তথ্যই সংগ্রহ করেছি আমি। আর জানা গেছে সনিয়াও রুমাইশার সাথে চট্টগ্রামে রয়েছে। ১৬ জন বাচ্চার জীবন বাঁচাতে হবে। এটা যে করেই হোক। আশা করি আমার পথচলার সাথী আপনি হবেন।”
বিপ্রতীপ থমকে গেল। মায়ার পরিচয় তাকে অবাক করে দিয়েছে। গম্ভীর মানুষের আড়ালে কত পরিচয় থেকে যায় সেটা বুঝা অনেক কঠিন। সে মায়াকে হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল
“আপনার পথ চলার সাথী হয়ে আজীবন আপনার পাশে থাকতে চাই। আমার জীবনের সে কালো মেঘটা যেন আপনার স্পর্শে সরে যায়। তবে আমার একটা বিষয় জানতে ইচ্ছা করছে। ডিটেকটিভ যারা তারা পুলিশে ভয় পায় না। আপনি কেন পুলিশ ভয় পাচ্ছিলেন মিহানের বিষয়টা নিয়ে? নাকি সেটা নিছক অভিনয় ছিল? কারণ নারী তো অভিনয়ে সেরা। ”
বিপ্রতীপের কথা শুনে মায়া মুখটাকে একটু প্রশস্ত করল। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর হালকা গলায় বলল
“আমি পুলিশ ভয় পাইনি। আমি দুর্বলতাকে ভয় পেয়েছি। মিহান আমার জীবনের একটা দুর্বলতা ছিল। সে দুর্বলতার মুখোমুখি কীভাবে লড়াই করব সেটা ভেবেই আমি ভয় পাচ্ছিলাম। আমার জীবনের ফিকে হয়ে যাওয়া রঙও যেন আপনার স্পর্শে রঙিন হয়ে যায়।”
মায়ার কথা শুনে বিপ্রতীপ মায়ার হাত ধরে ওয়াদা করে বলল
“এ হাত কখনও ছাড়ব না। যতক্ষণ এ দেহে প্রাণ থাকে। যতক্ষণ আমার হার্টবিট চলে। ঠিক ততক্ষণ এ হাত সবসময় আপনার পাশে থাকবে। যেদি কখনও আপনার নিকট আমার হাত অনুপস্থিত থাকে সেদিন মনে করবেন বিপ্রতীপ নামক ছায়াটা পৃথিবীর মোহ ত্যাগ করেছে। কথা দিলাম আমাদের একটা সংসার হবে আর সে সংসারের নাম দিব মায়াবতীর সংসার। সে সাথে আমাদের একটা রাজ্য হবে আর সে রাজ্যের নাম দিব মায়ার রাজ্য।”
মায়ার বুকের স্পন্দন বাড়ছে। এত বছরের অপূর্ণ জীবন যেন বিপ্রতীপের কথায় পূর্ণতা আসলো। সে কাঁদছে নিজের জীবনের শূন্যতাকে মুছতে পেরে। মিহানের জায়গাটা অন্য কাউকে দেওয়া খুব কষ্টকর ছিল। সে যে সেটা পেরেছে এটা ভেবেই খুশিতে তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে ও চায় তার জীবনের ফিকে হওয়া রঙ রঙিন হয়ে ফিরে আসুক। সে বিপ্রতীপকে ধরে বলল
“আমাদের এ চাওয়া আল্লাহ পূরণ করুক। এ অপারেশনটা আমাদের জীবন বদলে দিক। আমরা যেন ১৬ টা বাচ্চার জীবন বাঁচাতে পারি৷ সে সাথে মিহানের বাচ্চার খবরটা জানতে চাচ্ছি। মিহান কী এখনও জেলে নাকি বাসায় আছে?”
বিপ্রতীপ মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো
“আপনি সত্যিই অনেক উদার। শত্রুর বাচ্চার চিন্তাও করছেন।”
মায়া চোখের পানি মুছে বলল
“বাচ্চাটা শত্রুর হলেও শত্রু তো আর বাচ্চা না।”
বিপ্রতীপ মায়ার কথার জবাবে বলল
“মিহান এখনও জেলে আটক। আর বোরহানকেও আটকে রাখা হয়েছে। থানা থেকে কথা জানাজানি হতে পারে তাই থানায় নাটক সাজানো হয়েছে যে আমি মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এগুলো করেছি। আর মিহান আর বোরহান জেলে আটক ঠিক তবে থানার জেলে না। আমাদের জেলে। মিহানের বাচ্চার দায়িত্ব একজন সোস্যাল ওয়ার্কারকে দেওয়া হয়েছে। চিন্তা করবেন না। সব ঠিক করেই রেখেছি।”
বিপ্রতীপ আর মায়া হাতে হাত রাখলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।।আকাশের কালো মেঘ কেটে আকাশটা পরিষ্কার হতে লাগল। এক রাশ ভালোবাসা মুগ্ধতা আর পরিপূর্ণতা দিয়ে সে রাতের সমাপ্তি হলো।
দেখতে দেখতে ১৬ তারিখ চলে আসলো। আজকেই তাদের অপারেশনে যেতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা সকাল সকাল চলে গেছে চট্রগ্রামে। গোপনসূত্রে জানা গেছে বাচ্চাগুলো রাঙামাটির একটি টিলাতে আছে। আর সেখানের আদিবাসীরাও বেশ বিপদজনক। সুতরাং সেখানে গিয়ে তাদের একদম নিঁখুত ভাবে কাজ করতে হবে। একটু এদিক সেদিক হলে বড়ো বিপদ হতে পারে।
এ টিমে আছে মোট ১৪ জন৷ ১৪ জনকে লিড দিচ্ছে বিপ্রতীপ। বিপ্রতীপের লিডেই অপারেশনের সকল কাজ এগুবে। সাথে মায়াও বিপ্রতীপকে বিভিন্ন উপায় বলে সাহায্য করছে। ১৪ জনের টিমে মোট ৪ টা গ্রূপ। ৪ টা গ্রূপের প্রধান ৪ জন। গ্রূপের নামগুলোও দেয়া হয়েছে অদ্ভুত। নাম গুলো হলো সং, লং, টিং, টাং। সং গ্রূপের প্রধান প্রিয়ম, লং গ্রূপের প্রধান দিতি, টিং গ্রূপের প্রধান চিন্ময়, টাং গ্রূপের প্রধান সাকিব। প্রতিটি গ্রূপে গ্রূপ প্রধান সহ মোট বারোজন। আর সে সাথে মায়া আর বিপ্রতীপকে মিলে ১৪ জন৷
১৪ জন মিলেই চলে গেছে রাঙামাটি।। তারা ১৪ দর্শনার্থী সেজেই রাঙামাটি এসেছে। সেখানে টিলাটির কাছে একটি আদিবাসী হোটেলে তারা বসেছে। আদিবাসীদের নানান রকম খাবারা তারা খাচ্ছে। তাদের সামনে পরিবেশন করা হলো আদিবাসীদের বিশেষ একটি খাবার। যার নাম লাফাং। বিপ্রতীপকে আদিবাসী হেসেলের একজন জানালো এ খাবার এখানকার বেশ জনপ্রিয়। এটা বেশ সুস্বাদু। বিপ্রতীপ খাবারটা হাতে নিয়ে দেখল এটার ঘ্রাণও বেশ প্রখর এবং সুন্দর। টিং গ্রূপের প্রধান চিন্ময় খাবার খাওয়ার জন্য বিপ্রতীপের হাত থেকে খাবার নিতেই যাবে এমন সময় বিপ্রতীপ চিন্ময়কে চড় দিয়ে বসলো। কেন চড় দিল সেটা গ্রূপের কেউ এই বুঝতে পারল না। সে সাথে ঘটে গেল কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা।
চলবে।