#মায়াবতীর সংসার
#পর্ব-১৩
#শারমিন আঁচল নিপা
মায়া নিজেকে সামলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তারকে ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল
“বিপ্রতীপ কী আমাকে চিনতে পারবে না? সে কী কাউকেই চিনতে পারবে না? ও কী সব ভুলে গেছে? সত্যিই কী কিছুই মনে করতে পারবে না? এ মেমোরি ঠিক হওয়ার কোনো চিকিৎসা কী নেই?”
ডাক্তার মায়ার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল
“বিষয়টা এমন নয় যে তিনি এখন স্মৃতি হারিয়েছেন। তিনি যে সময়টা পার করছিলেন সেটা স্মৃতি হারানো অবস্থায়। উনার স্মৃতি চলে গিয়েছিল আরও ৫ বছর আগে। এখন পুরনো স্মৃতি ফিরে পেয়েছে।”
মায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
“বুঝতে পারলাম না আপনার কথা।”
এবার ডাক্তার একটু নড়েচড়ে বসে বললেন
“বিপ্রতীপের স্মৃতি পাঁচ বছর আগেই হারিয়ে গিয়েছিল। তার স্ত্রী মেঘলার মৃত্যুর কারণে। আর এখন সে স্মৃতিই ফিরে পেয়েছে।”
মায়ার বিস্ময় বাড়তে লাগল। সে বিস্ময় গলায় বলল
“বিপ্রতীপ বিবাহিত?”
ডাক্তার নম্র গলায় উত্তর দিল
“দেখুন আমি বিপ্রতীপের আগের ডাক্তার আর পরিবার থেকে যতটা শুনেছি এখন আপনাকে আমি সেটাই বলতে যাচ্ছি। বাকি সত্যতা আপনি যাচাই করে নিবেন।”
মায়া চুপসে গেল। ডাক্তার বলতে লাগলেন
“বিপ্রতীপ পাঁচ বছর আগে স্মৃতিশক্তি হারায়। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মেঘলা নামের এক মেয়েকে। সেই মেয়ের সাথে তার সংসার ছিল ১ বছরের। ১ বছরের সংসারে মেঘলার বিপ্রতীপের প্রতি তিক্ততা বাড়ে। সে বিপ্রতীপকে রেখে প্রেমে পড়ে ইব্রাহীম নামের একজন পরিচালকের। ইব্রাহীম ছিল বিপ্রতীপের মামা। মেঘলার ছোটো থেকেই নায়িকা হওয়ায় প্রবল ইচ্ছা ছিল। সে ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়েই বিপ্রতীপের মামা ইব্রাহীমের সাথে অবৈধ সম্পর্ক জড়িয়ে পড়ে। যার ফলে মেঘলার কাছে দিনকে দিন বিপ্রতীপকে অসহ্য লাগতে শুরু করে। এভাবের তাদের বিবাহিত জীবনের অবনতি হতে শুরু করে। একদিন মেঘলা বিপ্রতীপকে একটা চিঠি দিয়ে ইব্রাহীমের সাথে দেশের বাইরে চলে যায়। এতে তার নানীও বেশ দুঃখ পায়। বিপ্রতীপের জীবনে এমন নোংরা কিছু ঘটবে সেটা সে বুঝতেও পারেনি৷ জীবনের এ ধাক্কা নিতে তাকে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে।
এদিকে ইব্রাহীম মেঘলাকে কখনও বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ইব্রাহীমের সংস্পর্শে এসে মেঘলা চেয়েছিল নায়িকা হতে। তবে ইব্রাহীম কেবল মেঘলার লোভটাকে কাজে লাগতে চেয়েছিল। সে মেঘলাকে দিনের পর দিন নিজের মতো নাচাতে লাগল। মেঘলাও বুঝতে পারল তার জীবনে সে ভুল করেছে। তাই সে ইব্রাহীমের থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দেশে ফিরে এসেছিল। নিজেকে শুধরে নেওয়ার ওয়াদা করেছিল। সে পুনরায় বিপ্রতীপের কাছে ফিরে আসতে চেয়েছিল৷
এদিকে বিপ্রতীপ মেঘলাকে পাগলের মতো ভালোবাসত। মেঘলা তাকে ছেড়ে যাওয়ার পরও সে তাকে ডিভোর্স দেয় নি। মেঘলা দেশে ফিরেই বিপ্রতীপের কাছে ক্ষমা চায়। বিপ্রতীপ ক্ষমাও করে দিয়েছিল। আবার নতুন করে সে জীবন শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইব্রাহীমের জন্য সেটা আর হয়নি। ইব্রাহীম তার আর মেঘলার স্ক্যান্ডাল বের করার হুমকি দিত। মেঘলা একে তো বিপ্রতীপের মামার সাথে পালিয়েছিল তার উপর এসব নোংরা স্ক্যান্ডাল ফাঁস হলে মান সম্মান অবশিষ্ট যা আছে সেটাও থাকবে না। তাই সব বিবেচনা করে মেঘলা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে।
আর মেঘলার এ মৃত্যুই বিপ্রতীপের মাথায় বেশ আঘাত হানে। মেঘলার মৃত্যুর দিনেই সে এসব সইতে না পেরে ব্রেন স্ট্রোক করে। এরপর সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া কালো অতীত ভুলে যায়। তার জীবনের সে এক বছর সে ভুলে যায়। তার স্মৃতি মেঘলার প্রেম পর্যন্তই আটকে ছিল। মেঘলাকে সে পাগলের মতো খুঁজেছিল। মেঘলার জন্য একের পর এক পাগলামি সে করতে লাগল। তার এ পাগলামি দিনকে দিন বাড়তে লাগল। মেঘলার মৃত্যুর কথা তার পরিবার তার অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে বলেনি। কিন্তু মেঘলার খোঁজ না পাওয়ায় বিপ্রতীপ আরও বেশি হতাশ হয়ে যেতে লাগল। আর তখন তার পরিবার বুদ্ধি করে মেঘলার ফোন থেকে একটা মেসেজ করে বিপ্রতীপকে। আর সে মেসেজে লেখা ছিল সে আর বিপ্রতীপের সাথে থাকতে চায় না। সে যেন মেঘলাকে খোঁজে আর সময় নষ্ট না করে। । কারণ সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। আর তাকে বিয়ে করেই সে বিদেশ চলে যাচ্ছে।
আর বিপ্রতীপ সেটাই বিশ্বাস করে নেয়। সে যে মেঘলাকে বিয়ে করেছিল সংসার করেছিল ভুলে গেছে। সে সাথে ভুলে গেছে মেঘলা আর তার মামা ইব্রাহীমের ভালোবাসা। মেঘলার আত্মহত্যা।
ইব্রাহীম এখনও বিদেশে আছে। দেশে ফেরার সাহস তার নেই। পরিবার থেকেও বিতারিত। আর এখন বিপ্রতীপের জীবন ঠিক ৫ বছর আগে মেঘলার মৃত্যুতে আটকে আছে। গত পাঁচ বছরের কথা সব ভুলে গেছে সে। পেটের এ আঘাতে তার অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। আর তিনি এমনিতেও স্ট্রোকের রোগী। তাই তার এ আঘাত তার মস্তিষ্ক সঠিকভাবে নিতে পারে নি। যার ফলস্বরূপ তিনি তার জীবনের পাঁচ বছর ভুলে গেছেন।
অর্থাৎ তার জীবনের পড়াশোনা শেষ করে চাকুরির জীবন তিনি ভুলে গেছেন। খুব অল্প বয়সে বিয়ে। বিয়ের পর পারিবারিক টানপোড়ান। জীবনের গতির উত্থান পতন উনার মস্তিষ্ককেই এলোমেলো করে দিয়েছে।”
মায়ার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করল
“উনার কী এ স্মৃতি ফেরার কোনো সম্ভবনা নেই? উনি কী আর সুস্থ হবেন না?”
ডাক্তার মোলায়েম গলায় উত্তর দিল
“এটা একচুয়েলি এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের মস্তিষ্কের উপর আল্লাহ ছাড়া কারও হাত নেই। আমরা ডাক্তাররা কেবল উসিলা।”
মায়া কথা শেষ করে চেম্বার থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হলো। করিডোরের চেয়ারে বসে সে অনবরত কাঁদতে লাগল। বিপ্রতীপের নানী এসে মায়াকে ধরল। মায়া আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সে বিপ্রতীপের নানীকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল
“আমার জীবনের এ কষ্ট কী শেষ হবে না? নিঃশ্ব হয়ে যাওয়া আমি আর কী হারাব বলেন? আমার জীবনে আলো হয়ে আসা রশ্নিটা নিভে গেল আবার। হারিয়ে ফেললাম আমি নিজের প্রিয় মানুষটাকে। নিয়তি আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিল। আমি কী করে বাঁচব? যে ভালোবাসায় বাঁচতে চেয়েছিলাম সে ভালোবাসাটায় যে ভুল সময়ে আসলো। ভুল সময়ে আসা ভালোবাসাটা চোখের পলকেই মুচড়ে গেল। এ জীবনটা আবারও ফিকে হয়ে গেল। শূন্য হয়ে গেলাম আমি। সে সাথে সর্বশান্ত আর নিঃশ্ব হয়ে গেলাম। কী নিয়ে বাঁচব আমি?”
বিপ্রতীপের নানী মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
“কিছুই হারাসনি তুই। সব ফিরে পাবি তুই। বিপ্রতীপকে সবাই মিলে সব মনে করাব। কতদিন ভুলে থাকবে সে। নিজেকে সামলে নে।”
বিপ্রতীপের নানীর কথা শুনে মায়া কান্না থামালো। কিন্তু নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা এ মুহুর্তে তার নেই। যে বিপ্রতীপকে সে ভালোবেসেছিল সে বিপ্রতীপ আর আগের মতো নেই। একদম বদলে গেছে।
এর মধ্যেই ডাক্তার এসে জানাল বিপ্রতীপের জ্ঞান ফিরেছে। সবাই ছুটে গেল। মায়াও গেল সাথে। বিপ্রতীপ সবাইকে চিনলেও মায়াকে চিনে নি। মায়া বিপ্রতীপকে জিজ্ঞেস করল
“কেমন আছেন? শরীর ভালো লাগছে?”
বিপ্রতীপ হালকা গলায় জবাব দিল
“হুম।”
এরপর আর কোনো কথা বলল না।
হাসপাতালে ১ সপ্তাহ থেকে বিপ্রতীপকে বাসায় নেওয়া হলো। মিশবা আসলো বিপ্রতীপকে ধন্যবাদ জানাতে। তবে বিপ্রতীপ মিশনের কথাও ভুলে গেছে। ভুলে গেছে তার পরিচয়। তাকে এ কাজের জন্য সম্মননার ঘোষণা করলেও সে এ বিষয়ে বেশ উদাসীন। পাগলের মতো সে কেবল মেঘলাকে মত্যুর জন্য অনুতাপ করতে লাগল। মেঘলার শূন্যতাকে ফিল করতেছিল। মায়া বিপ্রতীপের এ অবস্থা দেখে তাকে বলল
“আমি মায়া। হয়তো এখন চিনবেন না। চেনার কথাও না। আপনার জীবনের যে অধ্যায়ে আমি এসেছিলাম সে অধ্যায় টা ভুল ছিল। অধ্যায়টা ভুল হলেও আপনার প্রতি আমার ভালোবাসাটা ভুল ছিল না। আমার জীবনটা ফিকেই রয়ে গেল। মেঘলাকে আপনি পাগলের মতো ভালোবাসেন। তবে সে এখন আর দুনিয়ায় নেই। মেঘলার জায়গাটা যাকে দিয়েছিলেন সেও অতীতের সাথে মিশে গেছে। তার স্মৃতি মুছে গেছে আপনার মস্তিষ্ক থেকে। যে আপনি আমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য পাগলামি করেছেন। সে আমাকেই আপনি চিনতে পারছেন না। সময়ের সাথে আমি হারিয়ে গিয়েছি। হয়তো একটা সময় আপনার ফেলে আসা মুছে যাওয়া অতীত মনে পড়বে। তবে তখন আমি আর আপনার থাকব না। কোনো এক কড়ালগ্রাসে হারিয়ে যাব। সময় থেমে থাকে না। আমিও থেমে থাকব না। চলতে হবে বাঁচতে হবে। তবে মৃত হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এ শহর আমাকে কেবল কষ্ট দিয়েছে যন্ত্রণা দিয়েছে। অশান্তি দিয়ে আমার জীবনটাকে নষ্ট করেছে। তবে সুখ দেয়নি। এ অসুস্থ শহরে আমি আর থাকব না। চলে যাব বহুদূরে। সবার নাগালের বাইরে। যেখানে কেবল আমি থাকব আর থাকবে আমার একাকীত্ব।
আপনাকে বিশেষ সম্মননা দিয়েছে। কারণ আপনি একজন সফল ডিটেকটিভ। আপনার কাজের প্রশংসা সবার মুখে মুখে। স্কুলের হেলেন আপাকেও ধরে নিয়ে গিয়েছে। আপনার বুদ্ধিমত্তার জন্য অনেক বড়ো একটা চক্র ধরা পড়েছে। অনেকগুলো বাচ্চার জীবন বেঁচেছে। এ সবকিছুই আপনার স্মৃতি থেকে চলে গিয়েছে। সে সাথে হারিয়ে গিয়েছি আমি। অনেক বার কথা বলার চেষ্টা করেছি। মেঘলার জন্য আপনার অস্থিরতা দেখে পারি নি। তবে আমি আর স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। আমার জীবনের সব হারিয়ে ফেলেছি আমি। ভালো থাকবেন।”
বিপ্রতীপ কেবল মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আর কোনো কথায় সে বলছে না। মায়া লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো।
বিপ্রতীপ কেবল মায়ার চলে যাওয়া দেখল। মায়া বাসা থেকে বের হয়ে একটা সি এন জি তে উঠল। সি এন জি তে উঠেই মায়া হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ লক্ষ্য করল সি এন জি টা থেমে গেছে।কেউ একজন তাকে মুখ চেপে ধরল। মায়ার ভয়টা বাড়তে লাগল। সে কোনো কথায় বলতে পারছে না। মায়ার মাথায় শুধু আসতে লাগল মিহান কী প্রতিশোধ নিতে এসব করছে? এসব ভাবতে ভাবতেই সে অজ্ঞান হয়ে গেল।
চলবে।