মায়াতীর সংসার পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
1

#মায়াবতীর সংসার
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৪/শেষ পর্ব

মায়ার জ্ঞান ফিরল। অন্ধকার রুমে কুকড়ে বসে আছে সে। কিছুই যেন দেখছে না। এত বিদঘুটে অন্ধকার সে আগে কখনও অনুভব করেনি। বুকের ভেতরটা ধুকধুক করছে তার। শরীরটা ভীষণ কাঁপছে। কপালে ঘাম বেয়ে পড়ছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশেই। মায়ার ভীষণ ভয় করলেও সে নিজেকে সামলে নিয়ে চিৎকার করে বলল

“আমি জানি মিহান.. তুমি আমাকে ধরে নিয়ে এসেছো। আমার সাথে নোংরা গেইম খেলেও তোমার সাধ মিটেনি? এখনও কী চাই আমার কাছে? সব তো কেড়ে নিয়েছো আমার? আমার জীবনের সোনালি সময়টা কেড়ে নিয়েছো তুমি। আমার জীবনে তোমাকে ভালোবাসায় ছিল বড়ো অপরাধ। সে সময় যদি একটু সাবধানী হতাম আজকের এ কঠিন সময় পার করতে হত না। আমার জীবনের সব শখ কেড়ে নিয়ে আমাকে শূন্য করে দিয়েছো। তারপরও কী চাই তোমার?

আমাকে কষ্ট দিতে চাও তো তাই না? তাহলে জেনে রাখো আমি কষ্টেই আছি। আমি আবারও ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার স্বপ্নে দেখা আর সে সংসার আমার হয়ে উঠেনি। অসম্পূর্ণ মায়াবতীর সংসারের মায়া আজকে নিঃশ্ব। আমার কাছে বেঁচে থাকার মতো আর কোনো কারণ নেই। শুধু বেঁচে আছি জীবন্ত লাশ হয়ে। এ দুনিয়ায় আপন বলতে কেউ নেই। বিপ্রতীপকে আপন করে চেয়েছিলাম। ভাগ্যের নির্দয় পরিহাসে সেটাও হারিয়ে ফেলেছি।

আমার এ অভিশপ্ত জীবনটাকে আর কী নষ্ট করবে তুমি?

মিহান! মিহান! মিহান! কী হলো কথা বলছো না কেন তুমি? কেন তুলে এনেছো আমাকে বলো? কী চাই তোমার?”

মায়া চিল্লাতে চিল্লাতে থেমে গেল। হঠাৎ করে ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল। মায়া সামনে তাকাল। সামনের দেয়ালটা রঙ তুলি দিয়ে আঁকানো। সেখানে রঙতুলির ছোয়ায় ফুটিয়ে তুলা হয়েছে সুন্দর একটা বাড়ি। সুশীতল রুম। আর এ পুরো আর্টের নাম দেওয়া হয়েছে মায়াবতীর সংসার। মায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। চারপাশ ভালো করে খেয়াল করে দেখল সে সাজানো গুছানো একটা ঘরে বসে আছে। মায়ার অস্থিরতা বাড়তে লাগল। কী হচ্ছে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না সে।

এর মধ্যেই বিপ্রতীপ সামনে এসে বলল

“আপনি কী আপনার জীবন থেকে সক্সি শিলার নামটা মুছতে পারবেন না? এখানে রোমান্টিক একটা জায়গায় এসেও আপনি সেক্সিশিলার নাম ধরে ডাকছেন। উফ এ শিলাকে যে কী করলে আপনি ভুলতে পারবেন বুঝতে পারি না। আচ্ছা এটা ভাবতে পারলেন না আমিও তো কিডন্যাপ করে আপনাকে আনতে পারি। সারপ্রাইজ দিতে পারি।”

মায়ার মুখের কথা যেন চলে গেল। সে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমতা আমতা করতে লাগল। নিজেকে অনেক কষ্টে স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করল

“আপনার স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে? তার মানে আপনি কিছু ভুলেননি? আমি কী স্বপ্ন দেখছি নাকি এটা সত্য?”

বিপ্রতীপ মায়ার কাছে আসলো। তার হাতে একটা চিমটি কেটে দিল। মায়া আহ! করে শব্দ করে উঠল। মায়ার শব্দ শুনে বিপ্রতীপ বলে উঠল

“ব্যথা পেয়েছেন যেহেতু সেহেতু এটা স্বপ্ন না। আমার স্মৃতিশক্তি চলে গিয়েছিল সাময়িক সময়ের জন্য। এরপর আমার সব মনে পড়ে। তবে আমি চাচ্ছিলাম আমার জীবনে সিনেমার মতো কিছু ঘটুক। চাচ্ছিলাম গুন্ডারা আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে আর আমি গাড়িতে মাথা ঠুকে স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবার নাটক করব। তবে সে সুযোগ আর হয়ে উঠল না। তাই বাধ্য হয়েই নিজেই গোন্ডা ভাড়া করে আপনাকে তুলে আনলাম শুধুমাত্র একটা সারপ্রাইজ দিব বলে। শুনুন মায়াবতী আমি আপনার দ্বীপ। আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি আমি। আমার জীবনের সব স্মৃতি মুছে গেলেও আপনি থেকে যাবেন। আপনাকে আমি আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি। আমৃত্যু আপনাকে ভালোবেসে যাব।”

এ বাড়িটা আপনার মন মতো করে সাজিয়েছি। কয়েকটা দিন সময় শুধু নিয়েছি বাড়িটা সাজানোর জন্য। নাহয় জ্ঞান ফেরার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই আমার সবকিছু মনে পড়ে। কালো অতীতটাও মনে পড়ে। মেনে নিয়েছি, ভুলে গিয়েছি। এখন শুধু আমার জীবনে আপনাকে ভালোবাসি। যেখানে মেঘলার কোনো অস্তিত্ব নেই। মেঘলা কেবল আমার জীবনের মুছে যাওয়া স্মৃতি।

কথাগুলো বলেই বিপ্রতীপ হাত দিয়ে তিনটি তালি দিল।।সাথে সাথে ঘরে বিপ্রতীপের ভাই, নানী কাছের মানুষজন চলে আসলো। বিপ্রতীপের নানীর হাতে একটা ডালা। সেই ডালাটা মায়ার কাছে এনে মায়াকে দিয়ে বলল

“এখানে বিপ্রতীপের মায়ের বিয়ের শাড়ি আর কিছু গহনা আছে। আরও গহনা ছিল কিছু গহনা বিপ্রতীপের অন্য ভাইয়ের বউদের দেওয়া হয়েছে। এখানে শুধু তোমার গুলো আছে। দেশে কেবল বিপ্রতীপের কাছের বলতে আমি আর ওর ভাই আছে। সেও কয়েকদিন পর চলে যাবে। তাই সে দেশে থাকতে থাকতে বিয়েটা করিয়ে ফেলতে চাই। তুমি রাজি তো মা? একটু পর কাজী আসবে। কাজী এসে বিয়ে পড়াবে যদি তোমার অনুমতি থাকে। আমি জানি তোমার অমত নেই।”

মায়ার চোখ বেয়ে আনন্দঅশ্রু বেয়ে পড়ছে। সে নিজেকে সামলে নিল। চোখের বাঁধ ভাঙা জল গড়িয়ে যেতে দিয়ে বলল

“আমার বিশ্বাসেই হচ্ছে না এসব। এত সুখ কপালে সইবে তো। না পাওয়া সব কিছু যেন একবারে পেতে চলেছি। মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন। এই বুঝি ভেঙে যাবে।”

বিপ্রতীপ মায়ার এ কথা শুনে মায়ার চুল টেনে ধরল। মায়া উই! করে জোরে শব্দ করল। মায়ার শব্দ শুনে বিপ্রতীপ হেসে বলল

“এই যে দেখুন আপনি ব্যথা পেয়েছেন। তার মানে আপনি স্বপ্ন দেখছেন না।”

মায়া কপাল কুচকে বিপ্রতীপের দিকে তাকাল। বিপ্রতীপ হালকা হাসলো কেবল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী আসলো। মায়া লাল টুকটুকে শাড়ি আর গহনা পরে বউ সেজেছে। আয়নায় নিজেকে দেখে যেন তার অচেনা লাগছে। সে শুধু ভাবছে তার একটা সংসার হবে আর সেটার নাম হবে ময়াবতীর সংসার।

বিছানায় বসে আছে সে। কাজী এসে বিয়ে পড়াল। মায়া যখন কবুল বলছিল মায়ার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বুকটা কেঁপে উঠছে। কণ্ঠটাও ভারী হয়ে গিয়েছিল। একটু জড়তা তাকে ঘিরে ধরেছিল। তবে সকল জড়তা কাটিয়ে সবকিছু পেছনে ফেলে নতুন জীবনের সূচণা করতে তিনটি শব্দ উচ্চারণ করল। কবুল, কবুল, কবুল। সে সাথে তার শরীরটা ছেড়ে দিল। সকল দ্বিধা দূর হয়ে গেল। মায়ার পরে বিপ্রতীপও জোর গলায় বলল, কবুল, কবুল, কবুল। এ তিনটি শব্দের মাধ্যমেই তারা দুনিয়া আর আখিরাতের জন্য একত্রিত হয়ে গেল। তাদের একসাথে থাকার জন্য আর কেউ বাঁধা দিতে পারবে না৷ দুজনের অপূর্ণ জীবন যেন পূর্ণ হয়ে গেল। তিনটি শব্দের শক্তি যেন দুর্বার।

মায়া আর বিপ্রতীপকে একটা রুমে রেখে বাকিরা বের হয়ে গেল। বিপ্রতীপ পকেট থেকে একটা রিং বের করে মায়ার হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল

“আপনাকে আমার সাথে বেঁধে ফেললাম। আর এ বাঁধন যেন কখনও ছিড়ে না যায়। আমি সবসময় চেষ্টা করব আপনার চাওয়া পূরণ করতে। আমাদের এ জীবন বরকতময় হোক। আমাকে পেয়ে আপনার কী অনুভূতি?”

মায়া বিপ্রতীপে বুকে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বলল

“আমার না পাওয়া সকল কিছুর পূর্ণতা আপনি। আর সে পূর্ণতার রেশ ধরে আজকে থেকে শুরু হলো মায়াবতীর সংসার।”

সমাপ্ত