মায়াবতী পর্ব-০১

0
312

#মায়াবতী
#পর্ব_১
#SF_Tabassum

জন্মের পর বাবা আমার চেহারাও দেখতে চায়নি। তার ধারণা ছিলো আমিও হয়তো আমার মায়ের মতো হয়েছি।

কথাগুলো কানে আসতেই ফোন থেকে চোখ সরিয়ে আমার সামনে বসা মেয়েটির দিকে দৃষ্টি দিলাম। আমি মুনাওয়ার মিসবাহ। যতদুর জানি ওনার নাম স্নিগ্ধা। আমার মা এই মেয়েটিকে আমার জন্য পছন্দ করেছে। ছবিতে দেখেছিলাম, খুবই সাধারণ একটি মেয়ে। আর আমার গার্লফ্রেন্ড স্মার্ট, আধুনিকা মেয়ে। ঠিক আমার মেন্টালিটির। সেখানে এই মেয়েকে পছন্দ করার প্রশ্নই আসে না। বুঝে আসে না আমার মা কিভাবে আমার জন্য এই মেয়েকে পছন্দ করলো। এখানে আসার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা ছিলো না আমার। শুধুমাত্র মায়ের কথার মান রাখতে আসা।

এখানে এসেছি প্রায় দশ মিনিট। এতক্ষণে প্রথম ওনার দিকে ভালো করে তাকালাম। নামের মতোই মেয়েটির চেহারাতেও রয়েছে স্নিগ্ধতা। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা নয়। উজ্জ্বল বর্ণ বলা যায়। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, চোখে গাড় কাজল, মাথায় সুন্দর করে হিজাব পড়ে আছে। চেহারার সবটুকু যেন মায়া দিয়ে ভরা।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটি আবার বলা শুরু করলো। আমার মা কৃষ্ণবর্ণের। মায়ের সরলতা দেখে আমার দাদি মাকে তার ছলের বউ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাবা নাকি কখনোই মাকে পছন্দ করতেন না। উঠতে বসতে কথা শুনাতেন। শুধুমাত্র দাদির কারণে তার সাথে সংসার করছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন দাদির বাধ্য সন্তান। হঠাৎই একদিন দাদি চলে যান না ফেরার দেশে। দাদির মৃত্যুর সাথে সাথে মায়ের জীবনে নেমে এলো ঘোর আমাবস্যা। সাত দিনের মাথায় আমার মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন আমার বাবা ও তার বোনেরা। আমি তখন মায়ের গর্ভে। বাবা কোন কিছুই শুনতে চাননি। আমার জন্মের পর বাবাকে খবর পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু তার সাফ কথা ছিলো, কালোর পেটে কালোরই জন্ম হবে। আর তিনি এমন সন্তান চান না।

আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, মেয়েটির চোখে পানি টলমল করছে। ঘনঘন পলক ফেলে সেই পানি আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমি যেন কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না। কোথায় গিয়ে যেন সব কথা আটকে যাচ্ছে।

আবারও কিছুক্ষন নিরব থেকে বলে উঠলো, আপনার পুর্বেও আরও অনেকের সাথেই আমার কথা হয়েছে। কিন্তু একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, যাকে তার বাবা পরিচয়ই দেন না তাকে কেউ কেন বিয়ে করবে! আপনারও হয়তো একই অভিব্যক্তি। সমস্যা নেই, আমি কিছু মনে করিনি। হয়তোবা আপনাদের জায়গায় আমি থাকলেও এমনটাই করতাম। আমাকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই মেয়েটি সেখান থেকে চলে গেলো।

.

বাড়িতে আসতেই শুরু হলো মায়ের প্রশ্নের ঝড়। মেয়েটার সাথে দেখা করেছিস? পছন্দ হয়েছে? খুব মিষ্টি না মেয়েটা? কেমন লাগলো তোর?

আমি মায়ের কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ঘরে চলে এলাম। পিছন থেকে মা কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দিলাম না।

আমার কেন জানি খুব রাগ হচ্ছিলো। ওই মেয়ের সাহস কি করে হলো আমাকে এমন কথা বলার? আমাকে দেখে তার এতো ছোট মানসিকতার মনে হয়েছে! আমি অন্যসব ছেলেদের মতো এই সামান্য কারণে তাকে রিজেক্ট করবো? পরক্ষণেই ভাবতে লাগলাম, ওই মেয়ের কথায় আমার এতো খারাপ কেন লাগছে? আমি তো এটাই চাচ্ছিলাম। এবার নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে। তবু না চাইতেও কেন জানি বার বার স্নিগ্ধার কথা মনে পড়ছিল।

এদিকে রাহা বার বার কল করে যাচ্ছে। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। ফোন সাইলেন্ট করে বালিশের পাশে রেখে দিলাম। রাহা হচ্ছে আমার প্রেমিকা। এখন ওর কল রিসিভ করলেই নানান কৈফিয়ত দিতে হবে। এরপরেও গাল ফুলিয়ে থাকবে। আবার আমাকেই কয়েক ঘন্টা ধরে ওর রাগ ভাঙাতে হবে। এই মুহুর্তে আমার ওর রাগ ভাঙানোর মুড নেই। যা হবে পরে দেখা যাবে। এই মেয়েটাও না একটু বেশিই করে। কখনোই আমার সিচুয়েশন বুঝতে চায় না। সারাদিন পরিশ্রম করে এসে তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় দাও। আবার কিছু হলেই হুটহাট রাগ। তাও যেন তেন রাগ নয়।

এদিকে,
কিরে ছেলেটার সাথে কথা হলো? কেমন মনে হলো?
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে স্নিগ্ধা বলে, কেমন আর হবে মা! নিজের বাবার কাছে যে মেয়ে মূল্যহীন তাকে কি আর অন্য কেউ…. ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে স্নিগ্ধার।

মুনতাহাও আর কিছু বললো না মেয়েকে। সবসময় কেমন একটা অপরাধবোধে ভোগে সে। আজ তার জন্যই তার মেয়ের এই অবস্থা। যদি সে কালো না হতো তাহলে হয়তো স্নিগ্ধাও আজ ওর বাবার নয়নের মণি থাকতো। যদিও এসবে মুনতাহার কোন দোষ নেই। তবুও সে নিজেকেই দায়ী মনে করে।

.

অফিসের কাজেও ঠিকঠাক মন বসছে না। চোখের সামনে স্নিগ্ধার ওই দরদ মাখা মুখটা ভেসে আসছে শুধু। যতই চেষ্টা করছি ওকে নিয়ে না ভাবতে, ততই যেন ওর ভাবনাটা আরও জেঁকে বসছে।

তাড়াতাড়ি অফিসের কাজ শেষ করে রাহার সাথে দেখা করতে গেলাম। মেয়েটা রাগে ফুলে আছে। কোন কিছুতেই ওর রাগ কমছে না। শেষে উপায়ন্তর না দেখে শপিং-এ নিয়ে গেলাম। মেয়েরা যতই রেগে থাকুক না কেন শপিং করলেই তাদের মন মেজাজ একদম ফুরফুরে হয়ে যায়। আজ অনেকদিন পর রাহাকে এতটা সময় দিলাম।

রাতে খাবার টেবিলে মা আবার স্নিগ্ধার কথা তুললো। আমি কিছু না বলে মায়ের কাছ থেকে ওর নাম্বার নিলাম।

.

রাত প্রায় এগারোটা বাজে। কল দিবো কি দিবো না ভাবতে ভাবতে কল দিয়েই বসলাম। এর মাঝে কয়েক বার ডায়াল করেও কেটে দিয়েছি। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হলো।

‘হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম।’

‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। মিস স্নিগ্ধা বলছেন?’

‘জ্বী! আপনি কে?’

‘আমি মিসবাহ… মুনাওয়ার মিসবাহ। সেদিন যার সাথে আপনি দেখা করতে গিয়েছিলেন।’

‘ওহহ হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। কিন্তু আপনি হঠাৎ করে আমাকে কল দিলেন যে!’

‘আপনি সেদিন কথা শেষ না করে চলে গিয়েছিলেন কেন?’

‘এটা জানতে কল দিয়েছেন?’

‘না, আরও অনেক কিছু….’
এই কথা কেন বললাম নিজেও জানিনা।

‘মানে?’

‘কিছুনা। শুনুন, একজনের ক্যারেক্টার দিয়ে কখনো অন্যজনকে জাজ করবেন না। আমি জানিনা আপনার সাথে যাদের দেখা হয়েছে তারা কেমন। আর জানতেও চাই না। কিন্তু আমাকে আপনি অন্য সবার মতো করে ভাববেন না। আচ্ছা.. আপনার কেন মনে হলো যে, আমি আপনাকে এই কারণে রিজেক্ট করেছি?’

‘তাহলে কি আপনি আমাকে রিজেক্ট করেননি?’

মেয়েটার এমন প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। নিজের কথায় শেষে কিনা নিজেই ফেঁসে গেলাম। এবার কি বলি??

‘কি হলো, চুপ করে আছেন যে?’

‘আপনি সেদিন আমায় কোন কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলেন কি? তাহলে রিজেক্ট করার কথা আসলো কোথা থেকে?’

‘আসলে আমি ভেবেছিলাম আপনিও হয়তো…

‘আপনার সাহস কি করে হলো আমার সম্পর্কে এমনটা ভাবার?’
বলেই ঠুস করে ফোনটা কেটে দিলাম। আমি নিজেও জানিনা ওই মেয়ের কথায় আমার এতো রাগ লাগছে কেন।

কিছুক্ষণ বাদেই আবার ফোনটা তীব্র গতিতে বেজে উঠলো। কিন্তু এবার……

চলবে..?