#মায়াবতী
#অন্তিম_পর্ব
#SF_Tabassum
আজ স্নিগ্ধার জন্মদিন। আমি সকাল সকাল অফিসের কথা বলে বাসা থেকে বেড় হয়েছি। আসার সময় দেখলাম স্নিগ্ধার মন খারাপ। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বললো না। আমি বাসা থেকে বেড় হয়ে অফিসে না গিয়ে সোজা ছাদে চলে এলাম। নিজ হাতে পুরো ছাদ খুব সুন্দর করে সাজালাম। মা এবং আমি বুদ্ধি করে সব করেছি ওকে সারপ্রাইজ দিবো বলে।
বিকেলে দরজায় কলিং বেল বাজলো। মায়া স্নিগ্ধাকে বললো দেখো তো বউমা কে এসেছে। দরজা খুলে দেখলো একজন ডেলিভারি ম্যান পার্সেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পার্সেলটা স্নিগ্ধার নামে এসেছে কিন্তু স্নিগ্ধা তো কিছু অর্ডার করেনি। ডেলিভারি ম্যান বললো স্নিগ্ধার নামেই পার্সেল এসেছে। প্যাকেট খুলতেই দেখলো একটা সুন্দর শাড়ি সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি। কিছুক্ষণ পর মিসবাহর কল আসলো। এক ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে রেডি হয়ে নিচে আসো। স্নিগ্ধাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার কেটে দিলো। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।
স্নিগ্ধা খুব সুন্দর করে সেজেছে। সি গ্রিন কালার শাড়ি সাথে হালকা সাজ। কোন এক অপ্সরার চাইতে কম লাগছে না ওকে। এই সি গ্রিন রংটা ওর খুব পছন্দের। মিসবাহর কথা মতো নিচে আসলো কিন্তু কোথাও ওকে দেখতে পেল না। তাড়াহুড়োতে ফোনটাও আনতে ভুলে গেছে যে কল করবে।
আমি একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে ওকে উদ্বিগ্ন হতে দেখছিলাম। বার বার এদিক ওদিক তাকিয়ে আমাকে খুঁজছে। আর বেশি অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না ভেবে সামনে আসলাম। আমাকে দেখে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। আমি মন খারাপের ভঙ্গি নিয়ে বললাম,
‘ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে আজকে একটু বাহিরে যাবো কিন্তু হুট করে একটা কাজ পড়ে গেলো। আই অ্যাম সরি।’
‘ইটস ওকে, সরি বলার কিছু নেই। আগে আপনার কাজ সেড়ে আসুন। আমরা না-হয় অন্য কোন দিন যাবো।’
‘তুমি মন খারাপ করো নি তো?’
‘আরে না পাগল। আপনি সাবধানে যান।’
মিসবাহকে বিদায় দিয়ে স্নিগ্ধা উপরে চলে আসলো। যেতে পারেনি এই জন্য মন খারাপ করেনি। কিন্তু ও এতো সুন্দর করে সাজলো তবুও মিসবাহ একবারও ওর দিকে ভালভাবে খেয়াল করলো না। মনে মনে ভীষণ অভিমান হলো ওর।
সবকিছু খুলতে যাবে তখনই শাশুড়ির কল এলো। ভেবে পাচ্ছে না সেও তো বাসায়ই আছে তাহলে কল কেন দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে রিসিভ করলো।
‘হ্যা বউমা! জলদি ছাদে আসো তো। এখানে…
কথা শেষ না হতেই লাইন কেটে গেলো। স্নিগ্ধা উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রুত ছাদে গেলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কয়েক বার মা মা করে ডাকলো। কিন্তু কারো কোন সাড়া পাচ্ছে না। হঠাৎই সবগুলো লাইট জ্বলে উঠলো। আর সবাই একসাথে চিল্লিয়ে বলে ‘Happy Birthday’.
সেখান স্নিগ্ধার মা আর ওর কাছের কিছু বান্ধবীরাও ছিলো। এমনকি রাহা আর ওর হাসব্যান্ডও এসেছে। খুশিতে ওর চোখে পানি চলে এলো। মায়া স্নিগ্ধার কাছে এসে বলে, ‘তুমি কি ভেবেছিল আমরা ভুলে গেছি?’ স্নিগ্ধা এবার লজ্জা পেয়ে যায়। সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
একে একে সবাই ওর হাতে গিফট তুলে দেয়। সবশেষে আসে মিসবাহর পালা।
‘আজকে আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’
‘আপনি তো অলরেডি আমাকে সারপ্রাইজড করেছেন। আরও কি সারপ্রাইজ থাকতে পারে!’
‘সেটা না হয় নিজের চোখেই দেখে নাও।’
বলেই হাত দিয়ে পিছনের দিকে ইশারা করে। স্নিগ্ধা পিছনে তাকাতেই নিজের বাবাকে দেখতে পায়। মৃদু স্বরে উচ্চারণ করে ‘বাবা’।
আনোয়ার হোসেন স্নিগ্ধার দিকে হাত বাড়িয়ে ছলছল চোখে বলে, ‘মা আমার, বাবার বুকে আসবে না?’
স্নিগ্ধা অমনি গিয়ে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। মুহুর্তেই এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ যেন বাবা মেয়ের মিলনের এক সুন্দর মুহূর্ত। উপস্থিত সবার চোখে পানি। স্নিগ্ধা হাউমাউ করে কাঁদছে। এ কোন দুঃখের কান্না নয়। জীবনে প্রথম বার বাবার ভালবাসা পাওয়ার আনন্দগুলো সব অশ্রু হয়ে ঝড়ছে।
ফ্ল্যাশব্যাক……
মিসবাহর ফোনের ওয়ালপেপারে ওর আর স্নিগ্ধার সুন্দর একটি ছবি দেয়া। একদিন আনোয়ার হোসেনের চোখ পড়তেই তিনি স্নিগ্ধাকে চিনে ফেলেন।
‘ওয়ালপেপারের মেয়েটা কি তোমার স্ত্রী?’
‘জ্বী আঙ্কেল।’
‘কিন্তু একে তো আমি কোথায় যেন দেখেছি…
মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। মিসবাহ ওর ফোন থেকে আরও কিছু ছবি বেড় করে দেখায়।
‘হ্যা হ্যা মনে পড়েছে। আমার সাথে একদিন শপিং মলে দেখা হয়েছিলো। ভারি মিষ্টি মেয়ে।’
‘একদম আপনার মায়ের মতন তাই না?’
মিসবাহর কথায় আনোয়ার বেশ হয়ে। মিসবাহ আবার বলে,
‘মেহেরুন্নেসা….মেহেরুন্নেসা নূর।’
স্নিগ্ধার পুরো নাম মেহেরুন্নেসা নূর স্নিগ্ধা। আনোয়ারের কিছু পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। তার মা যখন মুনতাহার প্রেগ্ন্যাসির খবর জানতে পারেন খুব খুশি হয়েছিলেন। তার একটা নাতনীর খুব শখ ছিলো। সে বলেছিলেন, ‘দেখো আমার নাতনী ঠিক আমার মতই হবে আর ওর নাম আমি আমার নামেই রাখবো।’ সত্যিই স্নিগ্ধা তার মায়ের মতই হয়েছে। মুহুর্তেই আবেগাপ্লুত হয়ে যান তিনি। সেই সাথে তার মাঝে অপরাধবোধও কাজ করে। নিজের জেদের জন্য তিনি তার নিজের মেয়েকেই কষ্ট দিয়েছেন। স্নিগ্ধাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে যান তিনি। পরক্ষণেই আবার ভাবেন, ও কি আমায় ক্ষমা করবে? মেনে নিবে তো আমায়? বাবা বলে কি ডাকবে? মিসবাহ তাকে আস্বস্ত করে।
আসলে মিসবাহ স্নিগ্ধার বাবাকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলো। কিন্তু কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছিলো না। আর ভাগ্য দেখো, অফিসের কাজেই তার সাথে পরিচয় হলো। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতন। স্নিগ্ধার ফোনে আনোয়ার সাহেবের ছবি দেখেছিলো তাই চিনতে অসুবিধা হয় নি।
★★★
আনোয়ার হোসেন মুনতাহার কাছে ক্ষমা চায়। মুনাতাহা জানায় সে তাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছেন। এসবকিছুই তার ভাগ্যে ছিলো। মুনতাহা এতো বছর পর নিজের বাবাকে ফিরে পেয়েছে এটাই অনেক তার কাছে।
ভালভাবে সমস্ত আয়োজন শেষ হয়। মুনতাহাকে আজকে থেকে যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করলেও তিনি থাকলেন না। সবাই চলে যেতে ওরা দুজন নিজেদের ঘরে চলে আসলো।
বারন্দায় থাকা দোলনার উপরে মিসবাহর কাঁধে মাথা রেখে আছে স্নিগ্ধা।
‘আজ আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশিটা দিয়েছেন। আমার জীবনে আর কোন কিছু পাওয়া বাকি নেই।’
‘বিয়ের সময় কথা দিয়েছিলাম তোমার সমস্ত কষ্ট দূর করবো। এবং আমি তারই চেষ্টা করছি মাত্র। একজন স্বামী হিসেবে নিজের স্ত্রীর খেয়াল রাখা আমার কর্তব্য।’
‘আজ আমিও আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই।’
‘সারপ্রাইজ?’
স্নিগ্ধা মিসবাহর হাত নিয়ে ওর পেটে রাখে।
‘আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন মিসবাহ।’
স্নিগ্ধার বলা বাক্যটি যেন বারবার মিসবাহর কানে বাজছিলো। ও সত্যি বাবা হচ্ছে! খুশিতে আত্মহারা হয়ে স্নিগ্ধাকে কোলে তুলে নেয়।
‘তুমি ভাবতে পারবে না স্নিগ্ধা আজকে তুমি আমাকে কত্ত বড় একটা খুশির খবর দিলে। বিশ্বাস করো আমার জীবনে আর কোন অপূর্ণতা নেই। আমি আমার মায়াবতীকে পেয়ে গেছি আমার সন্তান আসতে চলেছে। আর কি চাই জীবনে!’
অতীতের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে শুরু হলো দুজনের জীবন এক নতুন মোড়। ভালো থাকুক ওরা। যার সাথে যার মনের মিল তার সাথে ভাগ্যেরও মিল হোক।
(সমাপ্ত)