#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-২
ইভা পার্কার লিফটের সামনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ আশেপাশে নেই। এত বড় ব্যস্ত একটা বিল্ডিংয়ে কারোই কি এখন ওপরে যাবার প্রয়োজন নেই? নাকি কয়েক মুহূর্তের জন্য সবাই যার যার জায়গায় পজ হয়ে গেছে? ইভার অন্তত তাই মনে হচ্ছে।
তার ক্লস্ট্রোফোভিয়া আছে৷ একা একা লিফটে উঠলেই প্যানিক অ্যাটাকের মতো হয়। সাথে কেউ থাকলে ব্যাপারটা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়েও ওঠার উপায় নেই। কিছুদিন আগে বাস্কেটবল খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছিল। ব্যথা এখনো আছে। এই হাঁটু নিয়ে বারো তলায় ওঠা অসম্ভব। সে আবারও আশেপাশে তাকাল। আশেপাশে বেশকিছু ব্যস্ত মানুষজন আছে, তবে কারোই এখন লিফটের প্রয়োজন নেই। ‘আজব!’ বিড়বিড় করল ইভা।
ডেভিড অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটাকে লক্ষ্য করছিল। সে ঠিক বুঝতে পারছে না মেয়েটার সমস্যাটা ঠিক কোথায়। প্রথমে তো সন্দেহই হয়েছিল মেয়েটার উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু ক্রমেই সে বুঝতে পারল মেয়েটা আসলে কোনো একটা বিপদে পড়েছে। আর তার প্রবল কার্যকরী সিক্সথ সেন্স এটাও বলে দিল, মেয়েটা একা লিফটে উঠতে ভয় পাচ্ছে। তাকে সাহায্য করা প্রয়োজন।
ডেভিড এগিয়ে গেল। লিফটের বোতাম চাপলে দরজা খুলে গেল। সে ভেতরে ঢুকল। সাথে সাথে মেয়েটাও ঢুকল। ডেভিড মুচকি হেসে বলল, “গুড মর্নিং।”
মেয়েটিও পাল্টা হাসি দিয়ে বলল, “গুড মর্নিং।”
মেয়েটি ইলেভেনথ ফ্লোরের বোতাম চেপে দিল। ডেভিড চাপল টুয়েলভথ ফ্লোরের। আর কোনো কথা হলো না তাদের। ডেভিড মেয়েটাকে লক্ষ্য করছে আঁড়চোখে। মেয়েটার বড় বড় চোখ, লম্বাটে মুখ, খুব একটা প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই তাতে। গাঢ় বাদামী চুল পনিটেইল করে বাঁধা৷ পরনে শার্ট-প্যান্ট। তার ওপর ওভারকোট চাপানো। বাইরে হালকা বরফ পড়ছে আজ৷ শীত পড়ে গেছে ভালোই।
ডেভিডের মনে হলো লিফটটা খুব দ্রুত ওপরে উঠছে। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে মেয়েটার সাথে। কিন্তু কেন? কী বলবে? লিফট যখন টেনথ ফ্লোরে চলে এলো তখন সে গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলল, “হ্যালো মিস?”
“ইভা। ইভা পার্কার।”
“আমি ডেভিড স্পাইক।”
“কিছু বলবেন?”
ডেভিড পকেট থেকে নিজের একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিল। “কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করবেন।”
মেয়েটা কার্ড নিয়ে অদ্ভূত চোখে তাকাল। ততক্ষণে লিফট বারো তলায় চলে এসেছে৷ স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গেছে। মেয়েটা বেরিয়ে গেল। যাবার আগে একবার ফিরেও তাকাল।
ডেভিড অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে কেন কার্ডটা দিল? এই কার্ড সে সবাইকে দেয় না। সে কখনোই নিজের পরিচয় ফাঁস করে না৷ তার পেশাটাই এমন। সে ডিটেকটিভ ব্র্যাঞ্চের সিক্রেট এজেন্ট। অথচ এখন মেয়েটাকে কার্ড পর্যন্ত দিয়ে দিল। মাথা বোধহয় এলোমেলো হয়ে গেছে৷ একটা ড্রিংস দরকার। তেরো তলায় উঠে সে আবার নিচতলার বোতাম চেপে দিল৷
নিচে পৌঁছে মনে হলো মেয়েটার উপকার করতে গিয়ে সে নিজের কাজে ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছে। আজকে সে এই বিল্ডিংয়ের আশেপাশে ঘুরছিল এক ড্রাগ ডিলারকে ধরার জন্য৷ একে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডের কিছু খবর জোগাড় করতে হবে। আগেও একসাথে কাজ করেছে তারা। লোকটার সাথে সরাসরি যোগাযোগ নেই তার। তবে সে জানে কিছু নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট জায়গায় তাকে পাওয়া যায়৷ আজকেও নিশ্চয়ই এসেছিল। কিন্তু চলে গেছে এতক্ষণে!
ডেভিড কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার কর্মজীবনে এমনটা প্রথমবারের মতো ঘটল।
******
শিশির বারান্দায় বসে আছে। বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। বৃষ্টি সবসময় মন ভালো করে দেয়, আজ মন মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে আছে৷ সকালের ব্যাপারটা মাথা থেকে যাচ্ছে না।
বাড়ির ছোটো ছেলে হিসেবে শিশিরের কখনো আদরযত্নের কমতি হয়নি। বাবা মায়ের চোখের মণি হিসেবেই বেড়ে উঠেছে৷ বড় ভাই কবির বাবার পছন্দমতো পড়াশোনাও করেনি, বাবার ব্যবসাতেও যোগ দেয়নি। নিজের প্যাশন থেকে ডাক্তারি পড়েছে, ডাক্তার মেয়েকে বিয়ে করে দু’জন একসাথে বিদেশে পাড়ি জমাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবার তাই একমাত্র ভরসা হচ্ছে শিশির। শিশিরেরও এখনই ব্যবসায় যোগ দিয়ে নিজের জীবন বাবার মতো টাইট শিডিউলড বানিয়ে ফেলতে চায়নি। চেয়েছে মুক্ত বাতাসে একটু শ্বাস নিয়ে নিতে। সদ্যই পড়াশুনাটা শেষ হয়েছিল তার! কিন্তু কোথায় কী? বাবা যেন উঠেপড়ে লেগেছেন তাকে কাজে ঢোকাতে!
বাবার রোজকার কথা শুনতে শুনতে অবশেষে সে আজ রাজি হয়েছিল অফিসে যেতে। আজই তার প্রথম জয়েনিং ডেট ছিল। বাবা বলেছিলেন ঠিক দশটায় উপস্থিত থাকতে। এদিক থেকে বাবা খুব কড়াকড়ি। কোনো কাজ ঘড়ির কাঁটার একচুল এদিক ওদিক হলে তার মাথা গরম হয়ে যায়। এ সময় যে ধারেকাছে থাকে তার পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
শিশির আজ সেই আগুনেই পুড়েছে। তার বড় ভাই কবির এসবে অভ্যস্ত হলেও আদরের ছোটো ছেলে হিসেবে তার ওপর এই অগ্নিবর্ষণ হয়েছে কালেভদ্রে। এজন্যই ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে৷
আর এই পুরো ঘটনার দোষ হচ্ছে একটা মেয়ের যাকে সে রাস্তা পার করে দিয়েছে নিজে এগিয়ে গিয়ে। অফিসে যাবার আগে সে একটা গিফটশপের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল বাবার জন্য কিছু উপহার নিয়ে যাবার। গিফট কিনে বের হয়ে গাড়িতে উঠে বাসতেই মেয়েটাকে দেখল সে। রাস্তা পার হতে পারছে না। এরপর মেয়েটাকে সে যেচে পড়ে গিয়ে রাস্তা পার করে দিল, নিজের কার্ড পর্যন্ত দিয়ে এলো। আর সেজন্যই অফিসে যেতে বিশ মিনিট লেট হয়ে গেল।
আর ওই মেয়েটা! শিশিরের মেজাজ খারাপের আরেকটা বড় কারন হলো মেয়েটা৷ সে কার্ড দিল অথচ একটাবার মেয়েটা যোগাযোগ করল না? সে ধরেই নিয়েছিল মেয়েটা হয়তো ফোন করবে, নয়তো ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কিংবা মেসেজ পাঠাবে। এত আহামরি কিছুই ছিল না মেয়েটার মধ্যে৷ তবুও সে কেন আকর্ষণ বোধ করল? আর মেয়েটাও এত সহজে তাকে অবহেলা করে গেল? সে কি ফেলনা নাকি? কলেজে রীতিমতো মেয়েদের হার্টথ্রব ছিল৷
শিশিরের এক বন্ধু বলত, “এত হট মাইয়াগুলারে পাত্তা দাও না মিয়া, এমন একজনের পিছে ঘুরবা যে তোমারে পাত্তা দিবে না।”
কথাটা হয়তো ঠিক! ওর ফোনের আশায় সারাদিন মোবাইলটাও হাতে ছিল। আরেকবার সেটার দিকে তাকিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। ধুর! মেজাজ ভালো করতে হবে।
উঠে নিচে নেমে পেছনের উঠানে চলে গেল সে। এখানে সে নিজের জন্য বাস্কেটবল কোর্ট তৈরি করেছে। বেশিরভাগ সময় একাই প্র্যাক্টিস করে এখানে। বিশেষ করে মন খারাপ থাকলে বা কোনো মনোযোগের কাজ করার আগে সে ঘন্টাখানেক খেলে নেয়। তাতে অনেকটা ফ্রেশ লাগে।
আজ প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে টানা ঘাম ঝরিয়ে খেলল। একটা সময় হাঁপিয়ে গিয়ে বসে পড়ল। বলটা অবহেলায় গড়াচ্ছে দূরে। ঝিরঝির বাতাস বইছে। ধীরে ধীরে শরীর জুড়িয়ে যেতে থাকল, একইসাথে মন। রাতে খাবার জন্য ডাক পড়ল এমন সময়।
রাতের খাবারটা বাড়ির সবাই একসাথে খায়। তবে আজ বাবা নেই। অফিস থেকেই ফেরেননি। এমনটা খুব কম হয়। আজ সেরকম দিন। ভাইয়া ভাবি গেছে ভাবির বাপের বাড়িতে। মা খেতে খেতে এটা সেটা গল্প বলার চেষ্টা করলেন। আজকের ঘটনাটা মা জানেন। সেজন্য তিনি ঠিক কী করবেন এটা বুঝতে পারছেন না।
শিশিরের মায়ের চেহারা দেখে হাসি পেয়ে গেল। মা খানিকটা চিন্তিত, কিছুটা শঙ্কিত, এবং বেশ খানিকটা কনফিউজড। মা অল্পতে ঘাবড়ে যাওয়া মানুষ। মাকে দেখেই হঠাৎ ওর মনে পড়ল আগামীকাল মা বাবার এনিভার্সারি! অথচ কোনো প্ল্যান করা হয়নি৷
বাবা ঘড়ির কাঁটা ধরে চলা মানুষ৷ তাই তাকে রাত বিরাতে সারপ্রাইজ দেয়া অসম্ভব একটা ব্যাপার। তার সাথে সম্পর্কিত যে কোনো ইভেন্টে কেক কাটা হয় ভোরে। কিন্তু এত রাতে কেক পাবে কোথায়? বেকারিগুলোতে এখন সারাদিনের বাসি কেক পাওয়া যাবে৷ এখনকার মতো হলে চলত, কাল সকাল পর্যন্ত চালানো যাবে না।
খেয়ে কোনো কথা না বলে উঠে গেল সে। অনলাইনে খুঁজতে থাকল। যেসব হোম বেকারদের থেকে সে আগেও কেক কিনেছে তাদের নক করে দেখল। কেউই ভোর পাঁচটার মধ্যে ফ্রেশ কেক দিতে পারবে না। অগত্যা সে একটা পোস্ট করে দিল বেকিংয়ের গ্রুপে।
এক ঘন্টা পর একটা মেয়ে নক করল তাকে। সে কেক দিতে পারবে। তবে অত সকালে ডেলিভারি ম্যান পাওয়া যাবে না বলে গিয়ে আনতে হবে।
শিশির উত্তর দিল, “আমি গিয়ে নিয়ে আসব৷ রেডি রাখবেন প্লিজ!”
সে কেকের ডিজাইনের ডিটেইলস বলে নিশ্চিন্ত হয়ে ফোন রাখল। আবার কী মনে করে মেয়েটার পেজে ঢুকল। কেমন কেক বানায় তাই তো দেখা হয়নি। প্রচুর কেকের ছবি আপলোড করা আছে। দেখতে চমৎকার! ছবিগুলো আসল হয়ে থাকলে বলা যায় বেশ ভালোই কেক বানায় ‘অদিতি’স কিচেন’!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু