#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৫
ইভা ছুটির পর খানিকটা উত্তেজনা নিয়ে নিচে নামল। লোকটা নিশ্চয়ই বসে আছে। কী বলবে কে জানে! তিন তলার লিফট থেকে নামতেই তাকে অভ্যর্থনা জানাল আফ্রিকান ভায়োলেটের সারি। বেগুনী রঙা ফুলগুলো যেন হেসে বলছে, “ওয়েলকাম ইভা। ইট’স আ ভেরি গুড ইভনিং!”
কাচের স্লাইডিং ডোর সরিয়ে ভেতরে ঢুকে কফিশপের চারদিকে চাইল সে৷ কফিশপটার ডেকোরেশন খানিকটা জমকালো। কালো কাঠের গোল গোল টেবিলগুলোর ওপর সাদা কাপড় বিছানো। প্রতিটা টেবিলে ছোটো ছোটো ফুলদানিতে রাখা রক্তগোলাপ। দেয়ালগুলোতে বড় বড় পেইন্টিংয়ের বেশিরভাগের বিষয়বস্তুই রোমান্টিক। এই কফিশপে সে আসেনি কোনোদিন। এটা কি বিশেষত কাপলদের জন্য তৈরি? লোকটাকে খুঁজে পেতে চোখদুটোকে আরেকটু কসরত করতে হলো। কোণার একটা টেবিলে বসে আছে সে। পরনে কালো জ্যাকেট। চুলগুলোর রঙ কুচকুচে কালো। পুরোপুরি ফিট, শরীরে কোনো মেদ নেই। সব মিলিয়ে লোকটাকে বেশ দেখতে লাগে। আজ বোধহয় একটু বেশিই ভালো লাগছে।
এগিয়ে গিয়ে ইভা বলল, “আমাকে ডাকার কারনটা জানতে পারি?”
“আমরা কি একসাথে বসে এক কাপ কফি খেতে খেতে কথা বলতে পারি?”
ইভা বসল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনটা কেমন করে উঠল। বরাবরের মতো বিষন্ন শীতের দিন। এমন দিনে কী যেন মনে পড়ে যায়। মনের ভেতর হু হু করে পাক খেতে থাকে হাহাকার। এমনটা কি শুধু তার সাথেই হয়?
ডেভিড দুই কাপ কফি নিয়ে এলো। কফিতে চুমুক দিতে দিতে নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিয়ে বলল, “আমি যে এই বিল্ডিংয়ের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করি সেটা আপনি নিশ্চিয়ই দেখেছেন?”
“দেখেছি।”
“কেন করি বলে মনে হয়?”
“এখানে আসা না আসা আপনার ইচ্ছে! এটা আমার নিজস্ব বিল্ডিং নয় যে আপনার আসা নিষিদ্ধ। বা সেটা নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার কোনো কারন আছে।”
“সেটা নয়…”
“আপনি আপনি আমার জন্য আসেন?”
ডেভিড একটু স্বস্তি পেল যেন। এই শীতেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ঘাম মুছল। ইভা বিড়বিড় করে বলল, “অদ্ভূত!”
ডেভিড কথাটা শুনে ফেলল। মৃদু হেসে বলল, “আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কেন আমি এসব অদ্ভূত আচরণ করছি। প্রথম যেদিন আপনার সাথে দেখা হলো সেদিন আমি সত্যিই একটা কাজে এসেছিলাম। কিন্তু আপনার সাথে দেখা হবার পর… বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, আমি তেমন কোনো কাজকর্ম করতে পারিনি। কেন পারিনি সেটাও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। এমন নয় যে আপনার জন্য পাগল হয়ে গেছি। আবার একেবারে যে হইনি তাও না। প্রতিদিন সকালবেলা সব কাজ বাদ দিয়ে মনে হয় একটু এখানে আসি। আপনাকে আমি কয়েক মুহূর্তের জন্যই দেখতে পাই। আপনি অফিসে ঢুকে যান, তারপর একটু স্বস্তি বোধ হয়। অন্য কাজে যেতে পারি। একটু পরেই আবার অস্থির লাগতে থাকে। মনে হয় কখন সন্ধ্যা হবে, আপনার ছুটি হবে। আপনার ছুটির সময়ও আমি এখানেই অপেক্ষা করি।”
ইভা এতক্ষণ একদৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ এবার ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করল, “আপনি নিশ্চয়ই আমার বাড়িটাও চেনেন?”
ডেভিড অস্বীকার করার কোনো চেষ্টা না করেই বলল, “চিনি। আপনার খালাকেও চিনি।”
“এখন আপনি আমার কাছ থেকে কী চাচ্ছেন?”
ডেভিড বড় করে দম নিয়ে বলল, “আমি সমস্যাটা নিয়ে আমার একজন বিজ্ঞ বন্ধুর সাথে আলাপ করেছিলাম। সে বলেছে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবার একটাই উপায়, আপনাকে বিয়ে করা। আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?”
ইভা স্তব্ধ হয়ে গেল। লোকটা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসবে এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। সে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল। তার পক্ষে বিয়ের কথা ভাবার প্রশ্নই আসে না।
সে একসময় মাথা তুলে সোজা ডেভিডের চোখে চোখ রেখে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলল, “না। আমি আপনাকে বিয়ে করব না।”
“কিন্তু কেন? আমি মোটেও খারাপ ছেলে নই। ভালো চাকরি করি, ভালো স্যালারি, আমার নিজের বাড়ি আছে, আমি মানুষ হিসেবেও ভালো। চাইলে আপনি যাচাই করে দেখুন?”
“আপনি যেমনই হন না কেন আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। এমনকি কাউকেই বিয়ে করা সম্ভব নয়।”
ডেভিড শেষ চেষ্টাটা করল, “মিস ইভা, আপনার কোনো ধারনাও নেই আমি কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বুকের ভেতরটা এত ফাঁপা লাগে, হৃৎপিণ্ড সারাক্ষণ এত জোরে চলতে থাকে যে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে৷ আপনাকে না দেখলে সারাদিন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ বলে মনে হয়। আমি কথা দিচ্ছি, বিয়ের পর আমি আপনাকে কখনোই অসুখী হতে দেব না।”
ইভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সুখ এমন একটা জিনিস যেটা কারো হাতে থাকে না৷ কখনো কখনো কারো সব ভালোবাসা, যত্ন আর লয়্যালিটি দিয়েও সুখকে কিনতে পারা যায় না। আর এসব সস্তা ডায়লগ দেবেন না প্লিজ। ক্লিশে লাগে শুনতে। গুডবাই। আশা করি আর কখনো আমাদের দেখা হবে না।”
ডেভিড আহত হৃদয় নিয়ে বসে রইল। তার বলা প্রতিটা কথা সত্য। সে যা উপলব্ধি করে তাই বলেছে। আর মেয়েটা বলে গেল সে নাকি সস্তা ডায়লগ দিচ্ছে! মেয়েরা এত নিষ্ঠুর কেমন করে হয়? তাদের কাছে কি অনুভূতির কোনো দাম নেই? এত ভালোবাসা অবলীলায় পায়ে ঠেলে চলে যেতে একবারও বুক কাঁপে না?
*******
শিশিরের ফেসবুক আইডিটা দেখবার মতো! অধরার খুব জানতে ইচ্ছে হলো এই ছেলের পার্সোনাল ফটোগ্রাফারটা কে? এত ভালো ছবি তোলে! কালো শার্ট আর কালো সানগ্লাস পরা একটা ছবির দিকে সে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। এত দারুণ লাগছে কেন দেখতে?
ছেলেটার সেন্স অব হিউমারও ভালো। মজার মজার লেখা পোস্ট করে। ওদের বাড়ির কিছু ছবিও আছে। বাড়িটা দেখতে চমৎকার। পুরানো ধাঁচের দোতলা বাড়ি। বাড়ির পেছনে বাস্কেটবল কোর্ট। সেখানেও একটা ছবি আছে শিশিরের। বাস্কেটবল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে খেলোয়াড়ের জামাকাপড়। অধরা এই ছবিটাও সময় নিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। নিজেকে অত্যন্ত নির্লজ্জ মনে হলেও সে কাজটা করল। শেষ পর্যন্ত কালো সানগ্লাস আর বাস্কেটবল হাতে ছবিটা সে নিজের মোবাইলে সেভ করে রাখল।
খুব ইচ্ছে হতে লাগল ছেলেটাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে। হঠাৎ নিজের এই মনের পরিবর্তনে সে নিজেই অবাক। কিন্তু যা হচ্ছে তা যেন তার হাতে নেই। কেউ তাকে দিয়ে এসব করিয়ে নিচ্ছে।
অ্যাড ফ্রেন্ড বাটন চাপতে গিয়ে তার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপল। ফেক আইডি দিয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিলে কেমন হয়? নিজের ইগোও বজায় থাকল, আবার ছেলেটার সাথে কথাও হলো।
অধরা একটা ফেক ফেসবুক একাউন্ট আছে অনেকদিন আগের খোলা। মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ যেগুলো আসল আইডিতে আত্মীয় বন্ধুদের জ্বালায় সে পোস্ট করতে পারত না সেগুলো লিখত। এখনো চালু আছে সেটা৷ ফেক আইডির নাম নিধিতা জামান নীরা। নাম একখানা দিয়েছিল বটে! এই নামের আইডি থেকে রিকোয়েস্ট এলে ছেলে আবার একসেপ্ট করবে না? ওর ঘাড় করবে। নিজের সৃজনশীলতায় নিজেই মুগ্ধ হলো অধরা। নীরা নামের আইডিতে লগইন করে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিল।
ওর ধারণা ঠিক ছিল। রিকোয়েস্ট দেবার দশ মিনিটের মধ্যে সেটা একসেপ্ট হয়ে গেল। অধরা ‘ইয়েস!’ বলে ছোটোখাটো একটা লাফ দিল। এবার ইচ্ছেমতো মজা করা যাবে এর সাথে।
শিশির ল্যাপটপে কাজ করছিল৷ নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের নোটিফিকেশন এলো ফেসবুক থেকে। নিধিতা জামান নীরা। তার একটা স্কুলের বন্ধু ছিল নাম নিধিতা জামান জাতীয় কিছু। বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া সেই বন্ধুটিই তাকে বন্ধু হবার অনুরোধ জানাল কি না দেখতে সে তাড়াতাড়ি ফেসবুকে ঢুকল। কিন্তু আইডিটা দেখে সন্দেহ জাগল। কোনো ছবি নেই প্রোফাইলে। স্কুল কলেজের নাম নেই। এমনকি তার সাথে কোনো মিউচুয়ালও নেই। এটা সেই নিধিতা মনে হচ্ছে না। আইডিটা ফেক হবার সম্ভাবনা প্রবল। সে রিকোয়েস্ট ডিলিট করে দিতে গিয়েও কী মনে করে আবার ঢুকল। মেয়েটার ফলোয়িং লিস্টে গেল। কাদের ফলো করে এটা দেখলে মন মানসিকতা সম্পর্কে অন্তত জানা যাবে।
ফলোয়িং লিস্টে গিয়ে শিশিরের মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল। এই আইডি শুধুমাত্র দু’জনকে ফলো করছে৷ একজন, তাসমিয়া অধরা শেখ, অপরটি অদিতি’স কিচেন।
শিশিরের বুঝতে বাকি রইল না এটা কে। সে রিকোয়েস্ট সাথে সাথেই একসেপ্ট করল। আপনমনেই বলল, “খেলাটা জমে যাচ্ছে। And now I’m enjoying.”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু