#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-১৩
সেদিন শিশিরদের বাড়ির পার্টি থেকে ফেরার পর প্রায় মাসখানেক হয়ে গেল শিশিরের সাথে আর দেখা হয়নি অধরার। শিশিরও কোনোরকম যোগাযোগ করেনি। প্রথম ক’দিন ঠিকঠাকই ছিল সব, এরপর হঠাৎ একদিন অধরা আবিষ্কার করল সে শিশিরকে মিস করছে। যেন তাকে চারপাশের সবকিছুই একটু একটু করে শিশিরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে৷ এই যেমন অদিতিকে কেক বানাতে দেখলে তার মনে পড়ে যাচ্ছে শিশিরের কথা। বাগান করতে বসলে মনে পড়ছে সে তার বাগানের প্রশংসা করেছিল। রাস্তার সামনে দাঁড়ালে মনে পড়ছে শিশির হাত ধরে রাস্তা পার করে দিয়েছিল৷ ফেসবুকে ঢুকলে মনে পড়ে যাচ্ছে ফেক আইডি দিয়ে চ্যাটিংয়ের কাহিনী৷ এমনকি জুনায়েদ স্যারের ক্লাসেও শিশিরের কথা মনে পড়ছে। প্রায় সারাদিনই মাথায় একটা পোকার মতো বসে ঝিমঝিম শব্দ করছে যেন এই ছেলেটা।
পাগলাটে ছেলেটা তাকে বিয়ে করবে বলেছিল। অধরা এই কদিনে হাজারবার ভেবেছে, যদি সে সেদিন হ্যাঁ বলে দিত তাহলে কেমন হতো? যদি সত্যিই বিয়ে হয়ে যেত শিশিরের সাথে? শিশির কেমন স্বামী হতো?
একেক সময় সে ঝট করে উঠে পড়ে। এসব আজেবাজে চিন্তা প্রশ্রয় দিতে চায় না৷ কিন্তু চিন্তা আবারও নিজের অজান্তেই মাথায় চলে আসে। পড়া বা কাজের ফাঁকে কোন সুযোগে যেন টুপ করে মাথায় ঢুকে জাল ছড়াতে থাকে। যখন উপলব্ধি হয় তখন অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। অধরা নিজের ওপরেই খুব বিরক্ত হয়। উঠে বাগানে হাঁটতে বের হয়। একচিলতে বাগানে হাঁটার জায়গা কম। মনে হয় বড় বাগান হলে বেশ হতো! শিশিরদের বাড়ির মতো! আবার শিশির! ধ্যাৎ!
সুবর্ণকে পড়াতে গিয়ে ওর টেবিলে একটা বই উল্টেপাল্টে দেখছিল অধরা। প্রেমের গল্প। সুবর্ণাকে কোনোদিন সে গল্পের বই পড়তে দেখেনি। ওর বই পড়ায় আগ্রহ আছে যে সেটাই জানত না। অধরা জিজ্ঞেস করল, “এটা কিনেছ নাকি কেউ উপহার দিয়েছে?”
“গিফট। বান্ধবী দিয়েছে। দারুণ একটা গল্প এটা!”
অধরা পড়েনি বলে জানে না কেমন দারুণ। তবে প্রেমের গল্প পড়ে এই মেয়ের মাথা আরো খারাপ হলে একে সামলানো কঠিন হবে।
“ম্যাম বইয়ের কাহিনী বলি?”
“না, ম্যাথ করো।”
“করে তারপর বলব?”
অধরা একটা সুযোগ পেয়ে গেল। এই মেয়েকে দিয়ে আজ কিছুতেই পাঁচটা অংক করানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না। সে বলল, “পাঁচটা অংক করতে পারলে পুরো গল্প শুনব।”
সুবর্ণা একটু দ্বিধায় পড়ল। পাঁচটা অংক করে গল্প বলবে নাকি দুই তিনটা করে ধানাইপানাই করে বাঁচার চেষ্টা করবে? শেষে সে অংক করে গল্প শোনানোর সিদ্ধান্ত নিল।
অংক শেষে জোর করে পুরো বইয়ের গল্প শোনালো সুবর্ণা। অধরা অবাক হয়ে গেল এই ভেবে যে, যে মেয়ে দুই লাইন পড়া মনে রাখতে পারে না সে কিভাবে অনায়েসে পুরো গল্প বলে গেল! খুঁটিনাটিও বাদ দিল না। গল্পের মাঝে মাঝে আবার অধরাকে প্রশ্ন করে গেল দু’একটা। যেমন নায়ক নায়িকাকে যখন বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ম্যাম আপনাকে কেউ বিয়ের প্রস্তাব দেয় না? নিশ্চয়ই দেয়। আপনি বিয়ে করছেন না কেন? আমাকে তো কেউ প্রপোজ করে না। করলে এক্ষুনি বিয়ে করে ফেলতাম। আর পড়াশুনা করতে হতো না।”
অধরা জবাব দেবে কী, হকচকিয়ে গেল বেশ খানিকটা। বিয়ের প্রস্তাবের কথা উঠছে কেন বারবার? সে তখন একটু কড়া গলায় ওকে পড়াশুনার উপযোগিতা সম্পর্কে বলে ফিরে এলো। এসব ভালো লাগছে না।
দেখতে দেখতে আরো এক মাস কেটে গেল। অধরার মন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সে ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছে না কিছুই। রোজ ভোরে সে বাগানে হাঁটাহাঁটি করতে করতে বার কয়েক গেট খোলে এই আশায় যে এখনই হয়তো দেখা যাবে একটা বড় গাড়ি গেটের সামনে আর ঘরোয়া পোশাকে এলোমেলো চুলের একটা ছেলে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।
অধরার একসময় মনে হলো সে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে। এভাবে হচ্ছে না। কাউকে সে সমস্যাটা বলতেও পারছে না। সে নিশ্চিত বন্ধুদের কথাটা বললে আড়ালে তারা তাকে গোল্ড ডিগার জাতীয় উপমা দিয়ে বসবে। ওর যেমন বন্ধুদের প্রেমিকের টাকাপয়সা আছে সবাইকে এরকম শুনতে হয়। সেদিক থেকে ভাবলে শিশিররা রীতিমতো বিরাট বড়লোক। সবাই বলবে টাকার জন্য তার মন কেমন করছে, মানুষটার জন্য নয়। অথচ অধরা কোনোদিনই টাকাপয়সাকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি৷ তার কাছে সাধারণ, আরামদায়ক, শান্তিপূর্ণ আর আনন্দময় জীবন সবসময়ই সবকিছুর থেকে বড়। উল্টো এত টাকা আছে বলেই সে শিশিরকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল৷
এভাবেই সময় কেটে যেতে থাকল। অধরার মনের অবস্থা দিনদিন ভালো না হয়ে খারাপ হতে থাকল আর সে মনে মনে প্রবলভাবে চাইতে লাগল যেন শিশিরের সাথে একটাবার দেখা হয়। সে নিজে থেকে দেখা করতে চাইতে পারবে না। কাকতালীয় কিছু কি হতে পারে না?
অবশেষে শিশিরের সাথে অধরার এরপর দেখা হলো পুরো চার মাস পর। সেই প্রথম দিনকার মতো রাস্তার পাশে। সে সেদিনও আপুর বাসা থেকে বের হয়েছিল ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে। রাস্তা পার হতে পারছিল না। হঠাৎ একটা হাত তার হাত আঁকড়ে ধরল। ঝড়ের মতো রাস্তা পার করে দিল। রাস্তা পার হবার পর হাতের মালিকের দিকে চেয়ে অধরা দেখল ওটা শিশির।
কিছুক্ষণ দু’জন কোনো কথা না বলে একে অপরের দিকে চেয়ে রইল অপলক। একসময় অধরা জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন?”
শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভালো না।”
“কেন?”
“লম্বা কাহিনী।”
“বলা যাবে?”
শিশির তৃষ্ণার্তের মতো তাকিয়ে বলল, “আপনার এত সময় হবে?”
অধরা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “হবে।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-১৪
অধরা যে শিশিরের সাথে কথা বলতে রাজি হয়ে যাবে এটা শিশিরের ধারনার বাইরে ছিল। সে অনেকদিন পর অধরাকে দেখতে পেয়ে বেশ খুশি হয়ে গিয়েছে। মনে মনে রাগ থাকলেও এই মেয়েটাকে কেন যেন অপছন্দ করতে পারেনি সে। বরং সময় অসময়ে ওর কথাই মনে পড়েছে। অনেক ভেবে শিশিরের মনে হয়েছে মেয়েটা কোনো এক সুক্ষ্ম মায়ার জালে তাকে জড়িয়ে ফেলেছে। এই জালের টানই তাকে বারবার ওর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। মনে হয়েছে তার কথাগুলো বলার জন্য কাউকে প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই মেয়েটার বিকল্প হতে পারে না। কেন এমন হয়? এই অদ্ভূত অনুভূতির নাম কী? মায়া নাকি ভালোবাসা? দুটোর কোনোটাই হবার কারন কি ঘটেছে? নাকি সবই তার কল্পনা? আজ হঠাৎ অধরাই বা রাজি হয়ে গেল কেন?
পলকেই অনেকগুলো কথা খেলে গেল শিশিরের মাথায়। সে অধরাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো মনে হয় ক্লাসে যাচ্ছিলেন৷ যাবেন না?”
“হু?” চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল অধরা। তার মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছে সে। ক’দিনে এতবার শিশিরের কথা মনে পড়েছে যে এখন বাস্তব ছেলেটাকে দেখেও বিশ্বাস হতে চাইছে না। মনে হচ্ছে এটাও একটা কল্পনা। কখন যেন চোখের সামনে থেকে জ্যান্ত মানুষ উধাও হয়ে যাবে।
শিশির আবারও কথাটা পুনরাবৃত্তি করল। অধরা উত্তর দিল, “সমস্যা নেই। আজ অত ইম্পর্টেন্ট ক্লাস নেই।”
“কোথাও গিয়ে বসি তাহলে?”
“ওকে।”
“আমার গাড়িটা ওপাড়ে। আবার যে রাস্তা পার হতে হয়?” বলে হাতটা বাড়িয়ে দিল শিশির। অধরা ওর হাত ধরল। স্বেচ্ছায় যেন হাতটা সপে দিল শিশিরের হাতে। শিশিরের হাতটা শক্ত করে ধরল তার হাত৷ অধরার ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল! অচেনা দুর্বোধ্য আনন্দে মনটা নেচে উঠল। যেন এটাই হবার ছিল। এটাই সে চাইছিল।
শিশিরের পাশে গাড়িতে বসে অধরার আর সেদিনকার মতো অস্বস্তি হলো না। কেমন যেন আপন আপন মনে হতে থাকল সব।
শিশির গাড়ি স্টার্ট দিল। চুপচাপ চালিয়ে যেতে থাকল। অধরা বসে রইল বাইরের দিকে চেয়ে। নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। শিশির একসময় শহর থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। হাইওয়ে দিয়ে জোরে ছুটে চলল গাড়ি। অধরা মাঝে একসময় নিজেই গাড়ির এয়ার কন্ডিশন বন্ধ করে জানালা খুলে দিয়েছে। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে। পুরো পথে অধরা একবারও জিজ্ঞেস করল না তারা কোথায় যাচ্ছে।
শিশির গাড়িটা নিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঢুকে গেল। লাল ইটের রাস্তা ধরে যেতে যেতে ধুলোমাখা রাস্তায় পড়ল গাড়ি। একসময় তারা পৌঁছুল একটা খামারবাড়িতে। অধরা এবার জিজ্ঞেস করল, “পৌঁছে গেছি?”
“হ্যাঁ।”
“এটা কোন জায়গা?”
“এটা আমার বন্ধুর বাড়ি।”
গ্রাম্য এলাকায় বিশাল জায়গা জুড়ে বাড়িটা। বেড়ার একটা গেট পার হয়ে ওরা ভেতরে ঢুকল। বাড়ির ভেতর পুকুর আছে, আছে সবজির বাগান, গোয়াল। ওদের শব্দ শুনে বেরিয়ে এলো একজন৷ শিশির পরিচয় করিয়ে দিল, “ইনি এখানকার কেয়ারটেকার সবুজ মিয়া।”
সবুজ মিয়া পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হেসে বললেন, “শিশির ভাইয়া, আফনে যে বিয়া কইরা ফেলছেন সেইটা তো বলেন নাই।”
শিশির সবুজ মিয়ার ভুলটা ভাঙনোর কোনো প্রয়োজন বোধ করল না। বলল, “আমরা এখানে বিকাল পর্যন্ত থাকব। পুকুরপাড়ে বসব এখন। দুপুরে তোমার হাতের দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খাব, তারপর পেছনের খেজুর বাগান ঘুরে দেখে ফিরে যাব।”
“ভাইয়া রেস্ট নিবেন না? ঘর খুলে দেই?”
“না তার দরকার নেই। আমরা ভেতরে ঢুকব না। দিনে দিনে ফিরতে হবে।”
সবুজ মিয়ে হেসে মাথা হেলিয়ে চলে গেল।
সে চলে যেতেই অধরার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে শিশির বলল, “আমার ছোটোবেলার বন্ধু কলরব। ওদের বাড়ি এটা। ছোটোবেলায় প্রতি বছর শীতকাল কাটাতে এখানে চলে আসত ওরা৷ কয়েকবার আমিও এসেছি৷ এখন ওরা সবাই আমেরিকায় সেটেলড হয়ে গেছে। বাড়ির দেখাশোনা কেয়ারটেকার সবুজ মিয়াই করে। আরও লোকজন আছে আশেপাশে, দেখতে পাবে। আমার এখানে আসতে কোনো বাঁধা নেই। প্রায়ই চলে আসি। কলরব নিজেই এসে দেখে যেতে বলে। আজ হঠাৎ মনে হলো সময় যখন আছে চলে আসি।”
অধরা মাথা ঝাকাল, “ঠিক আছে।” শিশির কেন সবুজ মিয়াকে তার সঠিক পরিচয় দিল না সেটা জিজ্ঞেস করল না।
ওরা গিয়ে বসল পুকুরের পাড়ে। অধরা বলল, “আপনার কাহিনী বলবেন নাকি শুধু ঘুরতে নিয়ে এসেছেন?”
“বলছি।”
শিশির কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল, “আচ্ছা, আপনি কি বিশ্বাস করেন মানুষ ‘অপয়া’ হতে পারে?”
“মানে?”
“আনলাকি মানুষ হতে পারে?”
“অনেক মানুষই হতভাগ্য হয়।”
“তাহলে প্রশ্নটা হয়নি। ধরুন কারো সাথে আপনার দেখা হলো, আর তারপরেই আপনার জীবনের বিপর্যয় শুরু হলো তাহলে মানুষটাকে কি আপনি অপয়া বলবেন?”
অধরা হাত নেড়ে বলল, “নাহ, ওসব বিশ্বাস করি না।”
“তাহলে কী মনে করেন কেন এমন হলো?”
“ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে। কিন্তু এসব প্রসঙ্গ কেন আসছে? কেউ আপনার জীবনে এসে আপনাকে বিপদে ফেলেছে নাকি?”
“না। ঠিক উল্টোটা হয়েছে।”
“কিরকম?”
“বাবার অফিসে জয়েন করার পর থেকে হাজারটা ঝামেলা শুরু হয়েছে। এমন অবস্থা যে কোম্পানিটাই ডুবতে বসেছে।”
ঝিরিঝিরি বাতাস অধরার মুখে আদুরে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছিল। তার ঘুম ঘুম পাচ্ছিল বসে বসে। শিশিরের কথাগুলো কানে যেতেই সোজা হয়ে বসল সে। “মানে? কী বলছেন কী?”
“যা হয়েছে তাই।” শিশির বেশ ভগ্নস্বরে বলল।
“খুলে বলুন তো কী হয়েছে?”
শিশির খুলে বলল। অনেক ঘটনা ঘটে গেছে মাত্র চার মাসে। এত দ্রুত সব হয়েছে যে শিশির এখনো বুঝে উঠতে পারেনি কী ঘটছে। কাজ ঠিকমতো বোঝার আগেই ধ্বস নেমেছে কোম্পানিতে। নতুন একটা প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি হঠাৎ করেই গজিয়ে উঠে চোখের পলকে যেন তাদের ক্লায়েন্টদের টেনে নিয়েছে৷ তারা বড় সংখ্যক শেয়ার হারিয়েছে। সবচেয়ে বড় ঝামেলা হয়েছে এই বছরই তাদের কোম্পানি নতুন একটা প্রোজেক্টের জন্য বড় এমাউন্টের ঋণ নিয়েছিল। তারা ধরেই নিয়েছিল প্রজেক্টটা সফল হবে, কিন্তু পুরোটাই ফেইল করেছে, সাথে কোম্পানিটাকেও ডুবিয়ে মারার অবস্থায় নিয়ে গেছে। এই সবকিছুর জন্য শিশিরের মনে হচ্ছে সে নিজেই দায়ী। তাকে কোম্পানিতে নিয়ে বাবা নিজের কপালে শনি ডেকে এনেছেন।”
অধরা সব শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। শিশিরও স্থির দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারা বেদনায় মাখামাখি। অধরা খেয়াল করে দেখল ওর চোখের নিচে কালি পড়েছে। ওর মাথার চুল কমে এসেছে, রোগা হয়ে গেছে আগের তুলনায়। ওর এত মায়া হলো মানুষটার জন্য! ইচ্ছে হলো ওর হাত ধরে একটু সান্ত্বনা দিতে।
একসময় সে বলল, “এসবের জন্য কি আপনার বাবা আপনাকে দোষ দেন?”
“না।”
“মা?”
“কেউই দোষ দেয় না আমার।”
“তাহলে আপনার মাথায় এসব কথা কে ঢুকিয়েছে?”
শিশির কিছুক্ষণ ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বাবা আমাকে যোগ্যতার তুলনায় একটু বেশিই ওপরের পদ দিয়ে দিয়েছেন। কাজ জানে না এমন একটা মানুষকে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দিলে সেটা সবার চোখে ভালো লাগবে না স্বাভাবিক। লাগছেও না। আমার সমবয়সী কিংবা বয়সে বড় জুনিয়র পদের কর্মীরা আমাকে শুরু থেকেই অপছন্দ করে। সামনে কিছুই বলে না, তবে তাদের ভাবে বোঝা যায় তারা মানতে পারেনি আমার এই হঠাৎ করেই বাবার কোটায় সিনিয়র পদে বসে যাওয়াটা। এসব কথা তাদের থেকেই ছড়িয়েছে বলে মনে হয়। তবে যেই বলুক না কেন, এখন আমার রীতিমতো অপরাধবোধ হয়।”
“আপনি যেসব কারনে নিজেকে অপরাধী করছেন তার কোনোটার জন্যই কিন্তু আপনি সরাসরি দায়ী নন।”
“তাতে কিছু যায় আসে না অধরা। জীবনটা এত কম্প্লিকেটেড কখনো মনে হয়নি।”
এবার অধরা আর নিজেকে সংযত করে রাখতে পারল না৷ শিশিরের একটা হাত ধরে বলল, “পয়া অপয়া এসব কিছুই হয় না। আমার বিশ্বাস আপনি একদিন নিজের যোগ্যতার প্রমান দিয়ে ছাড়বেন।”
শিশির হেসে ফেলল, “এগুলো সিনেম্যাটিক ডায়লগ। বাস্তবতা কতটা কঠিন আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিটা কিনে নিতে চাইছে। আমাদের এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছে যেখানে গেলে আমরা কোম্পানি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হব।”
অধরা বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না৷ এদিকে সবুজ মিয়া লোকজন নিয়ে এসেছে পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরতে। ওরা মাছ ধরা দেখল। বেশ বড় সাইজের কাতলা জালে ধরা পড়ল। ওরা তারপর হাঁটতে বের হলো। গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শিশির নিজেই বলল, “ওই প্রসঙ্গটা থাক। অন্য কথা বলি।”
অধরা বলল, “ঠিক আছে।”
শিশির তাদের ছোটোবেলার স্মৃতি বলতে থাকল। অধরাও স্বাভাবিকভাবেই গল্প করতে থাকল তার সাথে, যেন তারা খুব সাধারণ বন্ধু। অনেকটা পথ গিয়ে আবার ফিরে আসার সময় অধরা বলল, “আপনি কি এত ঝামেলায় এতদিনে আমার কথা ভুলে গিয়েছিলেন নাকি মনে ছিল?”
শিশির নিজের থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, “মনে তো ছিলই৷”
“সত্যি?”
“হুম। রোজকার কথাগুলো কাউকে বলার জন্য বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠত। বিশ্বাস করুন, তখন আপনার কথাই মনে পড়ত।”
অধরা আর কিছু বলল না। চড়া রোদ উঠেছে। তাদের চলার পথের দু’পাশে নারকেল গাছ আছে বিধায় ছায়ার গালিচা তৈরি করেছে পথে। ওরা হাঁটছে। শিশিরের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো অধরার তার কথা মনে পড়েছে কি না। কিন্তু ভয়ে জিজ্ঞেস করল না। মেয়েটাকে সে ঠিক বুঝতে পারে না।
একসময় পথের শেষে এসে অধরা নিজে থেকেই বলল, “আমারো এই ক’মাস আপনার কথা খুব মনে পড়েছে। কেন পড়েছে সেটা ঠিক বলতে পারব না।”
শিশির ভেতরে ভেতরে পুলকিত হয়ে উঠলেও বাইরে তেমন ভাব ফুটে উঠতে দিল না। তারা বাড়ির ভেতর পৌঁছে গেল।
দুপুরে ফ্রেশ সবজি, কাতলা মাছ, দেশি মুরগির ঝোল আর ডাল দিয়ে আরাম করে গরম ভাত খেল ওরা। খাওয়ার পর দই পরিবেশন করা হলো। এত ভালো দই অধরা কবে খেয়েছে বলতে পারবে না। এটা নাকি কাছেই এক বাড়িতে পাতা হয়। পেটে জায়গা থাকলে অধরা বুঝি আরো কিছুটা খেয়ে নিত।
খাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে ওরা রওনা দিল। খেজুর বাগান ঘুরে দেখতে গেলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে বলে সেদিকে আর যাওয়া হলো না। এবার আর নিশ্চুপ পথচলা হলো না। প্রচুর গল্প হলো। দরকারি, অদরকারী অনেক কথা হলো।
অধরাদের বাড়ির কাছাকাছি এলে সে গাড়ি থামাতে বলল। একেবারে গলিতে ঢুকতে চায় না শিশিরের সাথে। বিদায় নিয়ে নামার সময় অধরা বলল, “আপনি স্ট্রেসড ফীল করলে আমাকে ফোন করতে পারেন।”
বলেই সে গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল। শিশির চেয়ে রইল ওর চলার পথের দিকে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু