মায়ামঞ্জরী পর্ব-১৫+১৬

0
2

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-১৫

ইভার ডায়েরিটা আস্তে আস্তে ভর্তি হতে লাগল তার জীবনের ছোটো ছোটো অনেক ঘটনা দিয়ে। স্মৃতিগুলো তাজা হবার সাথে সাথে তার মনটাও আগের চেয়ে অনেক সতেজ হয়ে উঠছে। শীত চলে গেছে প্রায়। বসন্ত উঁকি দিচ্ছে। মনের ভেতর অদ্ভূত আনন্দ নেচে উঠছে প্রায়শই। অনেকদিন ডেভিডের সাথে দেখা হয় না। ডায়েরিটা চোখে পড়লেই তার কথা মনে পড়ে। সে কি একেবারে উধাও হয়ে গেল? অফিসের আশেপাশে প্রায়ই তাকে খোঁজে ইভা। কিন্তু কোথাও চোখে পড়ে না৷ সে এখন আর বাড়িতেও আসে না। কয়েকবার ইভা খালাকে জিজ্ঞেস করেছে ডেভিডের কথা। খালার সাথেও নাকি একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ৷ একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, ঝামেলা ছুটে গেছে। আবার একদিক দিয়ে ভয়ও হচ্ছে ইভার। ডেভিডের কোনো বিপদ হয়নি তো? সে যে কাজ করে তাতে পদে পদে বিপদ। মানুষটাকে সে অপছন্দ করে, তবে মরে গেলে নিশ্চয়ই তার ভালো লাগবে না? ইদানীং তো এমনও মনে হয়, ডেভিডকে সে আসলে অপছন্দ করে না। পছন্দই করে। তার আশেপাশে থাকতে খারাপ লাগে না। যে রাগটা মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠে ওটা আসলে তার ইগো।

এসবই ভাবতে ভাবতে আজও রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল সে। বরফ সরে গেছে। গাছে গাছে নতুন পাতার সয়লাব দেখা যাচ্ছে। সবার মন খুশি। রাস্তায় এক বৃদ্ধ তাকে দেখে হ্যালো বললে ইভা জবাবে হাই বলে সুন্দর করে হাসল। হেসেই মনটা আরো ভালো হয়ে গেল।

অফিসে পৌঁছে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকাল সে। আজও কেউ নেই এদিকে৷ এই মুহূর্তে কারো লিফটের প্রয়োজন হচ্ছে না। এই ব্যস্ত দালানে শুধু প্রথমদিন এরকম একা হয়ে পড়েছিল ইভা। সেদিন ডেভিড এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু আজ? সে ইতস্তত করে চারদিকে চাইল। কেউই আসছে না। প্রায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে রইল সে। একা লিফটে ওঠার সাহস করবে কি করবে না তা নিয়ে ভাবতে থাকল। এতটা ওপরে উঠতে গিয়ে বিপদে পড়লে? না, খালাকে সে কথা দিয়েছে একা লিফটে উঠবে না৷

আরও কিছুক্ষণ পর একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল ইভা। “হ্যালো মিস পার্কার। ক্যান আই হেল্প ইউ?”

ইভা তাকাল। ডেভিড! কতদিন পর দেখা হলো! কিন্তু ওকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ইভা খানিকটা চিন্তিত সুরে বলল, “আর ইউ ওকে মিস্টার স্পাইক?”

“ইউ ক্যান কল মি ডেভিড।”

“হোয়াট হ্যাপেনড ডেভিড?”

ডেভিড হাসল। “নাথিং মিস। লেটস গো টু ইয়োর অফিস।”

ডেভিড লিফটের বোতাম চাপলে দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল দুজন। ইভা ডেভিডের দিকে চেয়ে রইল। ওর ওজন কমপক্ষে বিশ পাউন্ড কমে গেছে। চোখ বসে গেছে, চেহারা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। গায়ের জামাটা ঢলঢলে হয়ে আছে। চুল উষ্কখুষ্ক। ইভাকে চেয়ে থাকতে দেখে ডেভিড হেসে বলল, “কী দেখছেন?”

“আপনাকে।”

“খুব খারাপ দেখাচ্ছে?”

“হ্যাঁ।”

ডেভিড কাঁধ ঝাকাল। “সব দিন তো সমান যায় না মিস।”

“হুম। আচ্ছা আপনার সময় হবে?”

“কেন?”

“কথা বলতাম।”

“আপনার জন্য আমি সবসময় ফ্রি।”

“আজ আমরা একসাথে ডিনার করব। আমার ছুটির পর অফিসের নিচে অপেক্ষা করবেন।”

“ওকে।”

ইভা বিদায় জানিয়ে চলে গেল। ডেভিড অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটা অদ্ভূত। সে যতদিন ওর পেছনে ঘুরেছে ততদিন বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয়নি। আজ নিজে থেকে কথা বলতে চাইছে কেন? তার জন্য এত উদ্বেগই বা প্রকাশ করছে কেন?

********

কাঙ্ক্ষিত ফোনটা এলো তিনদিন পর রাত এগারোটায়। অধরা সারাক্ষণই ভাবত, এই হয়তো কল এলো, এখনই আসবে। ক্লাসের মাঝেও ফোন চেক করার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল৷ শেষে যখন কলটা এলো তিনদিন পর, তখন তার খানিকটা অভিমান হলো। সে ভেবেছিল সেদিনকার পর হয়তো সে শিশিরের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা দখল করে ফেলেছে। তার শিশিরের কথা এত মনে পড়ত, শিশিরের কেন তার কথা মনে পড়ছে না? সে অবশ্য ফোনটা না ধরে থাকতে পারল না।

“হ্যালো।”

“কেমন আছেন?”

“ভালো।”

“রাগ করেছেন?”

“রাগ করব কেন?”

“তাও ঠিক, আমার মনে হয়েছিল তিনদিন পর কল করেছি বলে আপনি একটু রাগ হবেন।”

“তা তিনদিন পর মনে পড়ল যে?”

শিশির হাসল। ম্যাডাম আসলেই রাগ করেছেন। কিন্তু সেটা স্বীকার করলে তো!

সে বলল, “একটু ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম।”

অধরা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “কী ঝামেলা?”

“সেদিন কাউকে কিছু না বলে আপনার সাথে হুট করে ঘুরতে চলে গেলাম সেটা নিয়েই ঝামেলা। আমার বাবার প্রচন্ড রাগ৷ এমনিতেই বিজনেস নিয়ে আমাদের হাজারো টেনশন চলছে, তার ওপর আমার গাফিলতি তার সহ্য হয়নি৷ সে এক বিশাল কাহিনী।”

“খুলে বলুন তো কী হয়েছে?”

“শোনার সময় হবে তো?”

“আমি নিজেই ফোন করতে বলেছিলাম। সময় না থাকলে নিশ্চিয়ই বলিনি?”

শিশির একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। রাতের ঝিরিঝিরি বাতাস লাগছে চোখেমুখে। অধরাকে সব বলতে শুরু করল সে। “সেদিন ফিরেই দেখি বাবা ড্রইংরুমে বসে আছে, চোখমুখ লাল। আমাকে ঢুকতে দেখে প্রথমে কিছুই বলল না। আমিই গেলাম কথা বলতে….”

অধরা ধৈর্য ধরে শুনে গেল কাহিনী। তার একঘেয়ে লাগছে না, বরং শিশিরের কষ্ট ভাগ করে নিতে ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে অবশ্য সে শিশিরের ভুল ধরিয়েও দিল। যেমন, “আপনার উচিত হয়নি একেবারে কাউকে না জানিয়ে চলে যাওয়া। অন্তত একটা মেসেজ করলে পারতেন। আপনার বাবার জায়গায় থাকলে আপনি কী করতেন?”

অধরার কথাগুলো মেনে নেয় শিশির। “সেটা আমিও বুঝতে পারছি। কিন্তু তাই বলে নিজের ভালো থাকাটাকে কি একটুও গুরুত্ব দিতে নেই?”

অধরা জবাব দেয়। কথা গড়িয়ে যেতে থাকে অনেক রাত পর্যন্ত। ক্লান্ত শিশির একসময় ঘুমিয়ে পড়ে ফোন ধরা অবস্থাতেই। অধরা বুঝতে পারে ওপাশের মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ ওর ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনে। তারপর ফোন রেখে নিজেও ঘুমের অতলে ডুবে যায়।

এভাবে বেশ কয়েকদিন চলে কথা বলা। সারাদিনের স্ট্রেসের পর শিশিরের বেশ হালকা লাগে অধরার সাথে কথা বলে। জমাট বরফের মতো কষ্টগুলো গলতে থাকে একটু একটু করে।

একদিন শিশির জিজ্ঞেস করে, “কাল দেখা করবেন?”

অধরা বলে, “করা যায়৷ কিন্তু আপনার অফিস?”

“অধরা কাল ছুটি।”

“ও হ্যাঁ তাই তো!”

“কখন দেখা করতে পারবেন?”

“বিকেলে?”

“ওকে!”

“শুনুন, আমার কিন্তু এখন আর গাড়ি নেই। একটা গাড়ি রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিতে হয়েছে। ওটা বাবার যখন তখন লাগে। তাই…”

“আমার ধারনা হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে আরো বেশি ভালো লাগবে।”

শিশির সামান্য হাসল, “তাই হোক!”

নির্দিষ্ট দিনে দেখা করল তারা। অধরা হালকা একটু সেজেছে। এর আগে ওকে তেমন সাজতে দেখেনি শিশির। তার মনে হলো সামান্য সাজেই অধরাকে অপ্সরার মতো লাগছে। সে হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই চোরা চোখে ওকে দেখে গেল। অধরা ব্যাপারটা খেয়াল করলেও কিছু বলল না।

তারা হাত ধরাধরি করে রাস্তা পার হলো, রাস্তার পাশের ঝালমুড়ি আর আচার খেল। একসময় ফুটপাতে চুড়ির দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে শিশির অধরাকে জিজ্ঞেস করল, “আমি আপনাকে একটা উপহার দিতে পারি? খুব সামান্য কিছু?”

অধরা কিছু না বলে চুপ করে রইল।

শিশির ওর মৌনতাকে সম্মতির লক্ষন ধরে নিয়ে একমুঠো চুড়ি কিনে দিল অধরাকে। ওর জামার সাথে মিলিয়ে নীল চুড়ি৷ অধরা চুড়িগুলো পরে রইল হাতে। এরপর যতক্ষণ তারা একসাথে রইল, চুড়ির রিনরিন শব্দে শিশিরের মনে হলো সে এক পশলা বৃষ্টি সাথে নিয়ে ঘুরছে। কিন্তু পরপর সে ঝুমঝুম আওয়াজ তুলে জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতির।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব- ১৬

ডেভিড অপেক্ষা করছে ইভার জন্য। তার হাতে একটা গোলাপের একটা তোড়া। মাঝারি আকারের গোলােপগুলোর রঙ হালকা গোলাপী। পাপড়ির লাইনিংয়ের দিকে গিয়ে সেই গোলাপী রঙে লালের আভা লেগেছে। দেখতে বেশ চমৎকার লাগে। তাকে ফুল হাতে দেখে ইভার কী প্রতিক্রিয়া হবে বুঝতে পারছে না ডেভিড। হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে ফুলগুলো দেখে সে লোভ সামলাতে পারেনি, কিনে ফেলেছে।

ইভাকে বের হতে দেখা গেল। সকালের তুলনায় ক্লান্ত ওর চোখমুখ। চুল কিছুটা এলোমেলো, জামাকাপড় খানিকটা কোঁচকানো। ঠিক এই অবস্থাতেই ওকে দেখতে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। কেন সেটা বুঝতে পারে না ডেভিড। সকালে যখন পরিপাটি থাকে তখন আরো ভালো লাগার কথা, লাগেও, কিন্তু এই সৌন্দর্যটা আলাদা৷ ইচ্ছে করে ওর গাল ছুঁয়ে দিতে। চুলগুলো হাত দিয়ে আরো একটু এলোমেলো করে ওকে রাগিয়ে দিতে। “অদ্ভূত আচরণ করছো তুমি ডেভিড। তোমার মাথায় গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে।” বিড়বিড় করে নিজেকেই নিজে বলল সে৷

ইভা কাছে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কার সাথে কথা বলছেন?”

ডেভিড অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হেসে বলল, “নিজের সাথেই। বাদ দিন। কী যেন বলবেন বলছিলেন?”

ইভা জিজ্ঞেস করল, “ফুলগুলো কি আমার জন্য?”

“ও হ্যাঁ। এই নিন।”

ইভা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফুলগুলো হাতে নিয়ে বলল, “চলুন হাঁটতে হাঁটতে বলি।”

“চলুন।”

“দেখুন, আমি অনেকদিন আগে আপনাকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলাম সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা কারনে৷ এবং সেই কারনটা এখনো বলবৎ আছে৷ তাই আপনার সাথে প্রেম ভালোবাসা কিংবা বিয়ে জাতীয় কোনো সম্পর্ক তৈরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে, আপনি যেহেতু ইন্ডিরেক্টলি আমাকে বন্ধু হবার প্রস্তাব দিয়ছেন, সেটা গ্রহণ করতে আমার আপত্তি নেই। এমনিতেও আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই। দুটো কথা বলার মানুষও নেই। কাউকে আমি সেভাবে বিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু আপনাকে কেন জানি না বিশ্বাস হয়। খালাও আপনাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি ক’দিন ধরে অস্থির হয়ে আছেন আপনার জন্য। দুশ্চিন্তা করছেন। সত্যি বলতে কী, আপনার সাথে এতদিন দেখা না হওয়ায় আমি নিজেও বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। আপনার পেশাটাই যে ওরকম৷ যাই হোক, সব কথার এক কথা, আমরা কি বন্ধু হতে পারি?”

ডেভিড কখনোই ইভার মুখে এতগুলো কথা একসাথে শোনেনি। তার কাছে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার সুর তার কানের সামনে বাজছে৷ শীতের রাতে উষ্ণতার চাদরে জড়িয়ে কেউ যেন তাকে গান শুনিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে আরামদায়ক বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছে। দিনটাকেও তার অসম্ভব সুন্দর বলে মনে হতে থাকল। এত সুন্দর দিন বোধহয় অনেক বছরে একবার আসে। সে সহসাই কোনো জবাব দিতে পারল না। মনে হলো সে কথা বললে এই চমৎকার পরিবেশের আবহটা নষ্ট হয়ে যাবে।

কিন্তু বেশিক্ষণ তো চুপ করে থাকা যায় না। ইভার ডাকে সাড়া দিয়ে কথা বলতেই হলো একসময়।

“হ্যালো, শুনছেন আমার কথা?”

“হু? জি শুনছি।”

“রাজি আপনি?” ইভা আগ্রহভরা চোখে তাকাল। ডেভিড খেয়াল করল ওর চোখের রঙ সবুজ দেখাচ্ছে। ওকে মনে হচ্ছে বন্ধুত্বের আহ্বান করে আগ্রহভরা চোখে তাকিয়ে থাকা কোনো কিশোরী যার চেহারায় লুটোপুটি খাচ্ছে পূর্ণ তরুণী সত্তা। ইভার প্রথমেই দিয়ে দেয়া সতর্কবাণী ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে ডেভিড প্রেমে পড়ল নতুন করে।

তবে সেটা প্রকাশ করাটা বোকামি। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো কাজ ডেভিড আবার করবে না। আগে মেয়েটার বিশ্বাস পুরোপুরি অর্জন করতে হবে। সে হেসে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ইভাও হাত মেলাল ওর সাথে। ডেভিড বলল, “আমার সাথে আজ ডিনার করবে?”

“ওকে!” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল ইভা।

একটা ছাদখোলা রেঁস্তোরায় গিয়ে বসল ওরা। ঝিনুকের মাংস, ফ্রায়েড চিংড়ি আর ওয়াইন দিয়ে ডিনার সারল। খেতে খেতে অনেক কথা হলো। কোনোটাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। খুব সাধারণ যে কথাগুলোও মাঝেমধ্যে দমবন্ধ করে দিতে চায় কাউকে বলতে না পারায় সেসব কথা৷

ফেরার পথে ইভাকে মেট্রোতে তুলে দেয়ার সময় ইভা বলল, “কাল তো ছুটি৷ চলে এসো আমাদের বাড়িতে। খালা খুবই খুশি হবেন।”

ডেভিড একটু ভেবে বলল, “কাল হয়তো সময় হবে না। আমরা সোমবার দেখা করি? তোমার ছুটির সময় নাহয় তোমার সাথেই যাব?”

“ঠিক আছে।” ইভা মিষ্টি হেসে উত্তর দিল।

ডেভিড চলে যাবার পর খানিকটা শূন্যতা ভর করল চারপাশে। অথচ কত লোক ওর আশেপাশে! ইভার মনে পড়ল সে দরকারি কথাটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে, ডেভিডের হঠাৎ এমন কী হয়েছিল যে পুরোপুরি ডুব মেরেছিল? ওর চেহারার এই অবস্থা হবারই বা কারন কী?

******

শিশির শেষ কবে বাস্কেটবল খেলেছিল তার মনেও নেই। আজ অনেকদিন পর প্র্যাক্টিস করতে এসে দেখল শরীর তেমন সায় দিচ্ছে না। অফিসে বসে বসে কাজ করতে করতে কেমন যেন জং ধরে গেছে পুরো শরীরে। ব্যয়ামের অভাবে আগের মতো দৌড়ানো তো দূরে থাক, ঠিকমতো নড়তেই পারছে না। যদিও তার ওজন আগের চেয়ে কয়েক কেজি কমেছে, তবুও বল নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে সে বেশ হাঁপিয়ে উঠল। একসময় ক্ষান্ত দিল। হচ্ছে না এভাবে।

বাড়িতে ঢুকে ঘামে ভেজা শরীরটা এলিয়ে দিল সোফায়। চোখ বুজল। মা এসে ঢুকলেন একটু পরেই।

“কিরে, কেমন লাগল?”

মায়ের প্রশ্নে চোখ মেলে তাকাল শিশির। “কী কেমন লাগল?”

“এইযে এতদিন পর খেলতে গেলি?”

“ভালো না।”

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমারও ভালো লাগে না।”

“কী?”

“শখের কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না।”

মা শিশিরের মুখোমুখি সোফাটায় বসেছিলেন। শিশির উঠে গিয়ের মায়ের সামনে মেঝেতে বসে পড়ে বলল, “চুলে হাত বুলিয়ে দাও তো।”

মা ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন কোম্পানির অবস্থা বল তো? তোর বাবা তো আমাকে কিছুই বলে না।”

“মা এখন ইম্প্রুভ হচ্ছে।”

“তোর বাবাকে দেখে তো সেরকম মনে হয় না৷ এত টেনশন করে যে সারারাত ঘুমাতে পারে না৷ এপাশ ওপাশ করে শুধু। অথচ সকালে উঠে আমাকে বলে ভালো ঘুম হয়েছে।”

“তুমি টেনশন করো না তো, বাবা একটুতেই হাইপার হয়ে যায় তুমি জানো না?”

“জানি। রাগ হলে সেটা কন্ট্রোল করতে পারে না তোর বাবা। কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি সেরকম না। এখন যা হচ্ছে তার বেশিরভাগই তোর বাবা ঠান্ডা মাথায় সামাল দিচ্ছেন। তবুও তো কাজ হচ্ছে না।”

“মা সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন কিছুই হয়নি।”

“তোর বাবার এত শখের গাড়িটা বিক্রি করে দিল, আর তুই বলছিস কিছুই হয়নি?” বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল শিশির। মা এখনো গাড়ির শোক ভুলতে পারছে না৷ এদিকে তাদের জমিজমা বন্দক রাখা হয়ে গেছে। তবুও কোম্পানিটা বাঁচানো যাবে কি না সন্দেহ। শিশির চোখে অন্ধকার দেখছে। পরিষ্কারভাবে কিছুই ভাবতে পারছে না৷ আজ বহুদিন পর সে মাথা একটু পরিষ্কার করতে খেলতে গিয়েছিল। বাবা আজ ছুটির দিনেও বাড়ি নেই। কোথায় কার সাথে মিটিং করতে গেছেন বলেও যাননি। শিশিরের এত অসহায় লাগছে বলার মতো না। সেই দেখা করে আসার পর প্রায় দিন পনেরো হয়ে গেছে অধরার সাথে আর দেখা হয়নি। তবে কথা হয়। প্রতিদিন না হলেও প্রায়ই। এখন অধরা বাদে আর কারো সাথে কথাও বলতে ইচ্ছে করে না। প্রতিদিন অফিস শেষে ইচ্ছে করে বাড়ি না ফিরে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যেতে। কবে যেন সত্যিই চলে যাবে!

নিজেকে সামলে নিয়ে মাকে সান্ত্বনা দিল সে। মায়ের দুই হাত ধরে বলল, “মা, তুমি টেনশন করে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবা কতটা ভেঙে পড়বে তোমার কোনো ধারণা আছে? তুমি ছাড়া বাবা একদিনও বাঁচতে পারবে? বাবার ভালো চাইলে তোমাকে সবার আগে নিজেকে ভালো রাখতে হবে বুঝলে?”

“আর তুই? তোর চেহারা কেমন হয়েছে দেখেছিস?”

“আমারও খেয়াল রাখার মানুষ দরকার। একটা বিয়ে দিয়ে দাও তো।”

মা কান্নাভেজা চোখে হেসে ফেললেন। “পরিস্থিতি ঠিক হলেই তোর বিয়েটা দিয়ে দেব। আমি একটা দারুণ পাত্রীর সন্ধান পেয়েছি৷ এটা তোর পছন্দ হবেই হবে।”

শিশির কথা ঘোরাতে নিজের বিয়ের কথাটা বলেছিল। এবার বলল, “তোমার পছন্দে আমি বিয়ে করলে তো? আমার নিজের পছন্দ আছে।”

“তাই নাকি? কে? ওইযে বেকার মেয়েটার বোন?”

শিশির আকাশ থেকে পড়ল, “তুমি… তোমাকে কে বলল?”

“কেউ না। আমার সেদিনই মনে হয়েছে। চোখটোখ নেই নাকি আমার?”

শিশির হা করে তাকিয়ে রইল। মা ওর পিঠে চাপড় মেরে বললেন, “যা গোসল করে আয়৷ একসাথে চা খাই।”

সে ভোঁতা মুখে বলল, “যাচ্ছি।”

রাতে অনেকদিন পর সবাই একসাথে খাওয়া হলো। ভাইয়ার বিদেশ যাওয়াটা আটকে গেছে। কী কী যেন ঝামেলা হয়েছে তার। অনেকগুলো টাকা লাগবে। বাবার জন্য এখন যে কোনো অঙ্কের টাকা দেয়াটাই কষ্টকর বলে ভাইয়া নিজেই চায়নি। আপাতত এখানেই একটা হাসপাতালে ঢুকেছে মাসখানেক হলো। যদিও শাওলী ভাবির বাড়ি থেকে বলেছিল দু’জনের খরচ দেবে তাদের বাইরে পাঠাতে। কিন্তু ভাইয়া নেয়নি। শিশির জানত নেবে না। ওর ভাইয়ের আত্মসম্মানবোধের কোনো তুলনা হয় না। কোনোদিন সে নিজের বাবার সমানেই মাথা নত করেনি। এদিকে ভাইয়াকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলে ভাবিও আর আগ্রহ পাচ্ছে না যেতে। তার মনমেজাজ বেশিরভাগ সময় খারাপ থাকে।

আজ খেতে বসে তেমন কথা হলো না। সবাই কথা বলার চেষ্টা করলেও বাবা এত নিরব হয়ে রয়েছেন যে কথাবার্তা বেশিদূর চলল না।

খাওয়া শেষে বাবা শিশিরকে ডেকে বললেন, “বাড়িটা বন্দক রাখতে হবে বুঝলে? ব্যবস্থা করে এসেছি। এটাই শেষ চেষ্টা। এবারের ইনভেস্টমেন্ট ফেল করলে আর কোনো আশা থাকবে না। পথে বসে যেতে হবে।”

বাবা কথাগুলো কতটা কষ্ট নিয়ে বললেন শিশির তার আঁচ পেল গভীরভাবে। তিলে তিলে গড়ে তোলা বিজনেস চোখের সামনে ডুবে গেলে কেমন লাগতে পারে শিশির কেবল আন্দাজ করতে পারে মাত্র। তার গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে কী যেন। মাথার ওপর থেকে এই ছাদটা চলে গেলে কী হবে তাদের? পুরো জীবনটা ওলট পালট হয়ে যাবে না?

সে কোনো কথা না বলে চলে গেল নিজের ঘরে।বারান্দায় চোখ বুজে চেয়ারে পড়ে রইল। তার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের যখন তখন কেঁদে ফেলা বারণ।

শিশির ফোন করছে না দেখে অধরা আজ নিজেই তাকে ফোন করল। শিশির ধরতেই জিজ্ঞেস করল, “আপনার কি আজ একটু বেশিই মন খারাপ?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“বলতে ইচ্ছে করছে না অধরা।”

“কী করতে ইচ্ছে করছে?”

“ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। একেবারে শান্তিতে ঘুমানো যেত যদি! কত রাত ঘুমাই না জানেন?”

“চেষ্টা করুন।”

“হবে না। কারো কোলে মাথা রেখে শুতে পারলে ঘুম আসতো হয়তো।”

শিশির এত গভীর স্বরে এমন সব কথা বলে যে অধরা বুঝতে পারে না সে মন থেকে বলছে নাকি ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছে। এসব কথার অধরা উত্তরই দেয় না। তবে আজ শিশিরের কথাগুলো কেন যেন বেশিই বেদনার্ত মনে হচ্ছে। অধরা জিজ্ঞেস করল, “সব ঠিক আছে?”

“কিছুই ঠিক নেই। বাবা…” বলতে বলতে থেমে গেল শিশির। মায়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। কিছু একটা যেন সজোরে খামচে ধরল শিশিরের হৃৎপিণ্ড। সে ফোন ফেলে দৌড়ে গেল মায়ের ঘরের দিকে। দেখল মা মেঝেতে বসে বাবার হাত ধরে চিৎকার করে যাচ্ছেন বাবার শরীরটা বিছানায় সজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু