#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-২০
ইভাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডেভিড সোজা চলল তার অফিসে। তাদের বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার নাম এফ ডব্লিউ টি। গোপন এই সংস্থা কাজও সারে অতি গোপনে। জনসাধারণের মাঝে এর তেমন পরিচিতি কিংবা জনপ্রিয়তা নেই। সান্তা মনিকায় বীচের পাশে দোতলা দালানের ওপরতলায় তাদের অফিস। নিচতলায় একটা ক্রোকারিজের দোকান। ওপরতালটা দোকানদারের নিজের বাসা বলেই জানে সবাই। গোপনীয়তা বজায় রাখতে যা যা ব্যবস্থা নেয়া দরকার সবটাই আছে ভেতরে। বাইরে থেকে আপাত সাদামাটা এই অফিসের ভেতরে অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা আছে যে কেউ প্রথম দেখায় হতবাক হয়ে যায়।
অফিসে ডেভিড গেল ঠিক এক মাস পরে। খুব গোপনীয় একটা মিশনে কাজ করছিল তারা৷ এক পাগলা বৈজ্ঞানিক কাম অভিনেতার পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল পুরো একটা জেনারেশন। সেই বৈজ্ঞানিক লোকটার ইচ্ছে ছিল হলিউডে গিয়ে নাম কামাবে। বহুদিন বিভিন্ন স্টুডিওর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তেমন কিছুই করে উঠতে পারেনি সে। সবাই বলে দিত, অভিনয়টা তার হয় না। মাথা খারাপমতো হয়ে গিয়েছিল একসময়। যখন তাকে হলিউডে দেখা যেত সে সময়ে শেষের দিকে সে বলাবলি করত, লোকের উপকারে যখন লাগতে পারেনি, লোকে যখন তাকে পছন্দ করেনি, তখন সে অপকারে লাগবে, পছন্দের চরিত্র হতে না পারলে অপছন্দের চরিত্র হয়ে দেখাবে। এর কিছুদিন পরেই সে উধাও হয়ে যায় পুরোপুরি।
গোয়েন্দাগিরি করে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে জানা যায় লোকটা হলিউড থেকে সোজা চলে গেছে তার গ্রামে। সেখানে খুব গোপনে একটা গবেষণাগার তৈরি করে গবেষণা করছে মারাত্মক সব জিনিস নিয়ে। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রিতে এই লোকের দক্ষতা অসামান্য। একাডেমিক রেজাল্ট ছিল দুর্দান্ত। সেই মেধা কাজে লাগিয়ে তৈরি করতে থাকে ড্রাগ। সুচতুরভাবে সেই ড্রাগ পৌঁছে দেয় ইয়াং জেনারেশনের কাছে।
এই পাগলা বৈজ্ঞানিকের গবেষণাগার সন্দেহে তার বাড়িটা অনেকদিন ধরেই নজরে রাখছে তাদের সংস্থা। এই কেসটা নেবার পরপর একবার ব্যবসায়ী সেজে বাড়িটা রেকি করতে গিয়েছিল ডেভিড৷ সে কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছিল বৈজ্ঞানিকের চোখে। সরাসরি সে কিছুই বলেনি, কিন্তু ধারণা করতে পেরেছিল শক্তিশালী কিছু লেগেছে তার পেছনে৷ তখন থেকে লোকটা দ্বিগুণ সতর্ক হয়ে গেছে। আর এর দায়ভার এসে পড়েছে ডেভিডের ওপর। তাকে অন্যসব তদন্ত থেকে অব্যহতি দিয়ে শুধু এই একটা কেসের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ছয় মাসের জন্য। যদি সে এর মধ্যে কেসটা সলভ করতে পারে তাহলে ডিপার্টমেন্ট তাকে রাখবে, নয়তো চাকরিচ্যুত করে দেবে।
এরপর থেকেই ডেভিড লোকটার পেছনে লেগেছে। লোকটাও ওকে পদে পদে ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে৷ সব মিলিয়ে ডেভিডের অবস্থা নাজেহাল।
আজ ইভার খালার তৈরি স্ট্রবেরি পাই দেখে একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মনে পড়ে গেছে। সে যখন বৈজ্ঞানিকের বাড়ি রেকি করতে গিয়েছিল তখন সেই বৈজ্ঞানিকের স্ত্রী তাকে স্ট্রবেরি পাই খেতে দিয়েছিল। কিন্তু…. একটা খটকা সেখানেই….
*********
বাবা রিলিজ পেলেন দিন তিনেক পর। তিনি অফিসে জয়েন করলেন প্রায় সপ্তাহখানেক পর। এতদিন শিশিরের ওপর যেন এক জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল। বাবা আসায় সেটার ভার কমে এলেও টেনশন দিনদিন উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল৷ বাবা এখন কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছেন। আগের মতো উদ্যম নিয়ে কাজ করতে পারছেন না। শারীরিক দুর্বলতা আছেই, তাছাড়া মনটাও দুর্বল হয়ে গেছে। কোম্পানির অবস্থা খারাপ হচ্ছে দিনে দিনে। প্রায় মাসখানেক পর শিশির উপলব্ধি করল তাদের আর কিছুই করার নেই। এত লসে পড়ে গেছে তারা যে কোম্পানি হাতে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
দেখতে দেখতে আরো মাসখানেকের মধ্যে শিশিরে আশঙ্কা সত্যি হয়ে গেল। কোম্পানিটা বিক্রি করে দিতে হলো। সেও এক লম্বা প্রসেস। বিশাল ঝামেলা পেরোতে গিয়ে বাবা ফের অসুস্থ হবার উপক্রম হলে শিশির তাকে আর অফিসে যেতে দিল না। নিজেই বাকিটা দেখল৷ এটুকু বাবা না দেখলেও চলবে।
কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধল বাড়ি নিয়ে। এত ঋণ হয়েছে যে সবটা শোধ করার জন্য তাদের একটাই প্রপার্টি আছে, সেটা হলো বাড়ি, যেটা ইতিমধ্যেই বন্দক রাখা হয়েছে।
বাবার সাথে এই বিষয়ে তাদের দুই ভাইয়ের দীর্ঘ আলোচনা হলো। বাবা শেষ পর্যন্ত বললেন, এখন বাড়ির মায়া করে লাভ নেই। বাড়ি রাখতে হলে যে ঋণের চড়া সুদ গুনতে হবে তার থেকে ভালো বাড়িটা বিক্রি করে দেয়া৷ কপালে থাকলে বাড়ি আবার করা যাবে। শিশির আর শাওনও একমত হলো।
প্রথমবার ঘটনাটা মাকে জানানো হলে মা এত ভেঙে পড়লেন যে শিশিরের মনে হলো এবার হয়তো তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু বাবার যত্নে মা আবার সেরে উঠলেন। শাওলী এতকিছুর চাপ নিতে পারছিল না বলে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। শাওন তাকে আর নিতে গেল না। এসব ঝামেলা ওর না দেখাই ভালো।
সময় গড়িয়ে যেতে থাকল। তাদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল। নতুন কোথায় উঠবে তা ঠিক করতে এর মাঝে দুই ভাইয়ের কালঘাম ছুটে গেছে। ভাড়া বাড়িতে মা বাবা কেমন করে থাকবে তাই নিয়ে দুই ভাই পড়ে গেছে মহা পেরেশানিতে। হাতে অল্প যে ক’টা টাকা শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিল তাই দিয়ে ভেবেছিল ছোটোখাটো একটা বাড়ি কিনবে। কিন্তু মনমতো বাড়ি কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না৷ এই পোড়া শহরে একটুখানি জমির দাম সোনার চেয়েও বেশি।
সমস্যার সমাধান শেষ পর্যন্ত এলো মায়ের বাপের বাড়ির দিক থেকে। ওদের এক দূর সম্পর্কের মামা খোঁজ দিলেন পুরানো এক দোতলা বাড়ির৷ বাড়িটা শহরের ভেতরে না, শহর থেকে বাইরে শহরতলীতে। বাড়ির পাশ দিয়ে ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। দোতলা শ্যাওলাধরা পুরানো বাড়ি হলেও মজবুত আছে। সামনে একচিলতে বাগান ছিল যা এখন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বাড়িটার প্রাক্তন বাড়িওয়ালার ছিল দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ের পর তারা শ্বশুরবাড়িতেই স্থায়ী হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালা আর তার স্ত্রী দু’জনেই গত বছর মারা যাওয়ায় বাড়িটা তার মেয়েরা জলের দলে বিক্রি করে দিয়েছে।
প্রায় এক বছর বাড়িটা খালি ছিল বলে একটু বেশিই জঙ্গল হয়ে উঠেছে। তবে পরিবেশটা ভারি পছন্দ হয়ে গেছে শাওনের। চারদিকে গাছপালা, পাখির কিচিরমিচির, ছাদ থেকে নদীর দৃশ্য, বড় বড় বেশ কয়েকটা ঘর, সব মিলিয়ে ওরা আরামেই থাকতে পারবে। প্রতিদিন হাসপাতালে যাতায়াতে যদিও বেশ ঝক্কি হবে, তবে শহরের মাঝে ঘুপচি ফ্ল্যাটে থাকার চেয়ে এ বেশ ভালো! শিশিরও একমত হলো ভাইয়ের সাথে। দু’জনের তত্বাবধানে বাড়ি কেনা হয়ে গেল।
কোনো এক বসন্তের সকালে ওরা সদ্য কেনা বাড়িতে গিয়ে উঠল। বাড়ির গেটের পাশে শ্যাওলায় ঢেকে গেছে নামফলকটা। সাফ করতেই ফুটে উঠল বাড়ির নাম, “মায়ামঞ্জরী”।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-২১
মায়ামঞ্জরীতে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে শিশির প্রকৃতপক্ষে উপলব্ধি করতে পারল পরিস্থিতি ঠিক কতটা প্রতিকূল হয়ে আছে। একটা নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়াটা এমনিতেই কঠিন, তার ওপর যদি সেটা হয় জোরপূর্বক অনেকটা নির্বাসনের মতো, তাহলে ছোটো ছোটো সহজ জিনিসও অনেক কঠিন মনে হয়৷ তার ওপর সংসার চালানোর ঝক্কিটা তো আছেই৷ এতদিন এত বড় সংসারের চাকা কেমন করে ঘুরত, ঘোরার জন্য টাকা কোথা থেকে আসত তার বিন্দুমাত্র চিন্তা দুই ভাইয়ের কারোরই কখনো করতে হয়নি। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পেয়েই তারা অভ্যস্ত সবসময়। সেই পাওয়ার গাড়ি হঠাৎ করেই ব্রেক চেপে থেমে গেলে পৃথিবীটাই কেমন এলোমেলো মনে হয়। মাঝেমধ্যে মনে হয় কানের কাছে একটা ঝিঁঝিপোকা অনবরত ডেকে যাচ্ছে, কানে তালা লেগে গেছে, আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
শিশির অল্প কদিনেই বুঝতে পারল হিসেবের অল্প কটা টাকা দিয়ে সংসারের প্রতিটা খরচ চালাতে হবে। প্রতিদিন বাজার করতে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দেখে বারবার ব্যাংক ব্যালেন্সের কথাটা মনে পড়ে যাওয়ার মতো যন্ত্রণাকর আর বোধহয় কিছু হয় না। খুব দ্রুতই তাকে কিছু একটা করতে হবে। না পারলে কিছুদিন পর বোধহয় না খেয়ে থাকতে হবে। জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে শাওনের ইনকাম খুব একটা বেশি নয়, সেটা দিয়ে সংসার চালানোর চিন্তা করা হাস্যকর। তাদের যে জীবনযাপনের ধরন ছিল তা থেকে বের হয় সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাবার চেষ্টাটা আরো বেশি কঠিন। দোকানে গেলে এখনো শিশির সবচেয়ে দামী জিনিসটা পছন্দ করে, অন্যগুলো চোখে ধরেই না, শেষে দাম শুনে চোখ নামাতে হয়। বাস, অটো, রিকশায় চলাচল করতে গেলে মাঝেমধ্যে মনে হয় সব ছেড়ে কোথাও চলে যেতে!
বাড়ির সামনের জঙ্গলটুকু পরিষ্কার করার ইচ্ছে হচ্ছে প্রথমদিন থেকেই, কিন্তু লোক লাগিয়ে পরিষ্কার করাটা বাহুল্য মনে হচ্ছে। এদিকে তাদের বিশাল বাড়ির অজস্র জিনিসপত্র নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যেগুলোই আনা হয়েছে, সেগুলোই তুলনামূলক অনেক ছোটো বাড়িটাতে জায়গা করে নিতে হয়েছে ঠাসাঠাসি করে। কিছু ঘরে চলার জায়গাটাও নেই।
মায়ের এখন আর রান্নায় মন বসে না। মা রান্না না করলেও ওদের বাড়িতে আগে রান্নার জন্য মানুষ ছিল। এখন তাকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ শুধু রুনু খালাকে রাখা হয়েছে, যার আসলে যাবার কোনো জায়গা নেই। সেই ঘরদোর সাফ করা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না করে। কিন্তু খুব একটা ভালো রান্না করে না বলে কেউ তেমন খেতে পারে না।
বাবার শরীর মোটামুটি সুস্থ থাকলেও তিনি কেমন যেন উদাস প্রকৃতির হয়ে গেছেন। বাবার ঘর নিচতলায়। সবচেয়ে কোণার ঘরটা তার। এই ঘরের লাগোয়া বারান্দা দিয়ে দেখা যায় সামনের বড় বড় কয়েকটা গাছ। সেসব গাছে কাঠবিড়ালিরা খেলা করে। বাবার সময় কেটে যায় তাদের দেখতে দেখতে।
মা বাবার মুখ চেয়ে বোধহয় একটু শক্ত আছেন। তবে বাবা সামনে না থাকলে তার চোখের জল কিছুতেই বাঁধ মানে না৷ নতুন বাড়িটা তার কিছুতেই পছন্দ হয় না৷ আগের সংসারটা ছিল তার নিজের হাতে সাজানো সুখের সংসার৷ এখন মনে হচ্ছে যেন ভিন্ন কোনো জায়গায় চলে এসেছেন, যেখানে কিছুই তার নয়।
শাওনের কোনো হেলদোল নেই, তবে শাওলী এখানে এসে মাত্র দুই রাত থেকে চলে গেছে। তার নাকি রাতের বেলা বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি বলে মনে হয়। আর এত নির্জনতা অসহনীয় বোধ হয়। মুখ ফুটে না বললেও সবাই জানে, সারাজীবন বিত্তবৈভবের মধ্যে বড় হওয়া শাওলীর জন্য হুট করে এই পরিবেশে চলে আসাটা সহজ না৷ তাদের জন্যও কঠিন, তবে তাদের আর কোনো উপায় নেই বলে তারা থাকছে, শাওলীর তো তবু বাপের বাড়ি আছে। শুধু কফির পেছনেই যার প্রতি মাসে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়, তার অল্প টাকায় সারা মাস চলার জন্য এডজাস্ট করাটা কঠিনই বটে!
এতসব মানসিক টানাপোড়েন আর শারীরিক পরিশ্রমের মধ্যে ডুবে থাকার কারনে দেখা গেল এই বাড়িতে আসার পর অধরার সাথে তেমন কথা হয় না শিশিরের। সে সারাদিন এটা সেটা করতে বাইরে বাইরে থাকে, রাতে ফেরে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে। তখন ফোনে কথা বলার ইচ্ছে থাকে না। আগে কাজের ক্লান্তি থাকত, স্ট্রেস থাকত, অধরার সাথে কথা বললে সেই চাপটা কমে যেত। এখনকার ক্লান্তির সিংহভাগটাই শারীরিক৷ বিশেষ করে রোজ পাবলিক বাসে শহরে আসা যাওয়ার জার্নিটা বেশ ক্লান্তিকর। একে ছাপিয়ে কানে ফোন ধরে রেখে কথা বলা যায় না। নিজের অজান্তেই কখন যেন মৃদু কুয়াশার চাদরের মতো লেপ্টে আসে ঘুম৷ জড়িয়ে ফেলে পুরোপুরি। অধরা ওপাশ থেকে শিশিরের ক্লান্তিটা বোঝে, সে চুপচাপ কিছুক্ষণ ওর ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনে। একসময় ফোন কেটে দেয়। তার চোখ বেয়ে কখন যেন জল গড়িয়ে পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়। শিশিরের জার্নিটা সে দূর থেকে হলেও পুরোটাই দেখেছে৷ একই সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে ওর সাথে যে এখন আর ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে কাছাকাছি বসে হাতে হাত রেখে কথা বলতে। যখন তীব্র কষ্টে শিশিরের গলা ধরে আসতে চায়, তখন তাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে। ইচ্ছেগুলো কি খুব অসমীচীন? নিজেকেই প্রশ্ন করে অধরা। প্রতি রাতেই সে শিশিরের জন্য কাঁদে। এই কান্নার উৎস কী? ভেতর থেকে একা একাই যেন ফোয়ারার মতো দুঃখগুলো উথলে উঠতে থাকে।
আপার কথাগুলো সে অনেক ভেবেছে। রোজই ভাবে, তারপর একটাই উত্তর পায়। শিশিরকে ছাড়া তার জীবনটা এখন আর আগের মতো হওয়া সম্ভব নয়। অদৃষ্ট কেমন করে যেন তাকে জড়িয়ে ফেলেছে এই খেলায়। খেলা ছেড়ে মাঝপথে বেরিয়ে পড়া অসম্ভব৷
এক ভোরে সে ঘুম থেকে উঠে দেখে মা বাগানে কাজ করছেন। অধরা অনেকদিন ধরেই চাইছে মায়ের সাথে খোলাখুলি শিশিরের ব্যাপারে বলতে। সাহস হচ্ছে না। আজ কী মনে করে এগিয়ে গেল৷ পেছন থেকে চুপচাপ কিছুক্ষণ মায়ের কাজ দেখল। তারপর একসময় সাহস করে বলে ফেলল, “মা, আমি বিয়ে করতে চাই।”
মা বেশ অবাক হয়ে অধরার দিকে চাইলেন। “বিয়ে? কাকে বিয়ে করবি তুই?”
“তুমি চেনো তাকে মা।”
মা বুঝতে পারলেন না অধরা ঠিক কার কথা বলছে। তিনি ফের জিজ্ঞেস করলেন, “কাকে বিয়ে করবি?”
অধরা কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে মাথা নিচু করে বলল, “শিশিরকে।”
মা ছোট্ট একটা নিঃশাস ফেলে বললেন, “তুই করবি বললেই তো হলো না, সে করতে রাজি হবে?”
“বোধহয় হবে।”
“ওদের অবস্থা তো শুনলাম৷ এই পরিস্থিতিতে বিয়ে হবে কেমন করে?”
“জানি না।”
অধরা মনে মনে বলল, “এই পরিস্থিতিতে বিয়ে হওয়াটা জরুরি মা। কেন জরুরি আমি নিজেও জানি না। শুধু জানি, আমার আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে যেখানে আমার থাকার কথা আমি সেখানে নেই।” কথাগুলো চাইলেও সে মাকে বলতে পারবে না, তাই বলার চেষ্টাও করল না।
মা বাগানে কাজ করতে করতেই অধরার কাছে পুরো ঘটনা শুনলেন। মায়ের বন্ধুর মতো আচরণ দেখে অধরাও অনেকটা সহজ হয়ে তার মনের অবস্থাটা মোটামুটি ব্যাখ্যা করল। মা শেষ পর্যন্ত বললেন, “বিয়েতে তো পরিবারের সম্মতিও জরুরি। শিশিরদের পরিবার থেকে আগ্রহ দেখালে আমরাও এগুবো।”
অধরা ঢোক গিলল। শিশিরের সাথে অনেক কথা হলেও কখনো তরল রোমান্টিক জাতীয় কথা হয়নি। ওরা বন্ধুর মতো ছিল। যদিও জানে ভেতরে ভেতরে অনেকটাই জড়িয়ে গেছে একে অপরের সাথে, তবে সেটা কখনোই প্রকাশ্যে আসেনি। অধরা সেই পথটা বন্ধ করে দিয়েছিল, এবার তাকেই খুলতে হবে।
শিশির প্রায়দিনই শহরে আসছে। মনমতো একটা চাকরির খোঁজে ঘুরছে। তার যা বায়োডাটা তাতে চাকরি পাওয়াটা সহজ, কিন্তু সবদিক মিলিয়ে হচ্ছে না। এমনই একদিন ভোরে অধরা শিশিরকে ফোন করে বলল, “আজ দেখা করতে পারবেন আমার সাথে?”
শিশিরের প্রায়ই ইচ্ছে করে অধরার সাথে দেখা করতে। তবে সময় সুযোগ হয়ে ওঠে না। আজ অধরা নিজেই বলায় খুশি হলো শিশির৷ ভাবল মেয়েটার সাথে দেখা করলে মনটা একটু হলেও ভালো হবে, পরিস্থিতি থেকে সরে গিয়ে একটু খোলা আকাশে উড়াউড়ি করার সুযোগটা হাতছাড়া করার কোনো মানে হয় না।
তাদের দেখা করার সময় ঠিক করা হলো বিকেলে। অধরা সেই বিকেলে সুন্দর করে শাড়ি পরল। সাজগোজ করল। একটা চমৎকার কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, “আমাকে বিয়ে করবেন?”
সেই কাগজ ভাজ করে খামে ভর্তি করে খামটা জুড়ে দিল একটা ফুলের তোড়ার সাথে৷ তোড়ার প্রতিটা ফুল অধরার বাগানে নিজের হাতে ফোটানো। তবে এগুলো সে বাড়িতে করল না। ফুলসহ সব জিনিস লুকিয়ে এনেছিল একটা বড় ব্যাগে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা খোলা মাঠের কোণে বসে সব তোড়জোড় সম্পন্ন হলো তার৷ এবার শুধু শিশিরকে এটা দেয়া বাকি।
আচ্ছা শিশির রাজি না হলে কী হবে? যদি বলে এখন সম্ভব নয়? হয়তো এখন সত্যিই সম্ভব নয়। কিন্তু অধরা তো বিত্ত বৈভব, স্বাচ্ছন্দ, বিলাসিতা কিচ্ছু চায় না, সে শুধু শিশিরের পাশে থাকতে চায়৷ কখনো মনে হয় এটা তার ভালোবাসা, কখনো মনে হয় নিয়তি। যেটাই হোক, তার টানে তাকে এগিয়ে যেতেই হবে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-২২
অসময়ে বৃষ্টি নামল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরতে লাগল অনবরত। অধরার সাথে যেখানটায় শিশিরের দেখা করার কথা সেই চত্ত্বর ভিজে একাকার হয়ে গেল। অধরা গিয়ে দাঁড়াল একটা ছোট্ট ক্যাফেতে। শিশির তখনো পৌঁছায়নি, হয়তো কোথাও অপেক্ষা করছে বৃষ্টি থামার। সে ফোন করল শিশিরকে। “কোথায় আপনি?”
শিশির উত্তর দিল, “কাছাকাছি। একটা কাজে আটকে গেছি৷ দশ মিনিট লাগবে আসতে।”
“ওকে।”
ক্যাফেতে গান চলছে মিহি সুরে। কাচের দেয়ালের ওপাড়ে বৃষ্টি, এপাড়ে সুরেলা আবহে চমৎকার লাগছে। অধরা হাতের ফুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল। তার কাছে এখন সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। সে সত্যিই কি এখানে শিশিরকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছে?
শিশির দশ মিনিটের আগেই পৌঁছে গেল। অনেকটা ভিজে গেছে৷ কাচের দরজা ঠেলে নিঃশব্দে ওর ভেতরে ঢোকাটা চোখে পড়ল না অধরার৷ সে তখন নিজের মনেই কী যেন ভাবছে। শিশির কিছুক্ষণ দূর থেকে তাকে নিরীক্ষণ করল৷ অধরার হাতে ফুলের তোড়া দেখে সে আন্দাজ করতে পারল আজ কী হতে পারে। তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগল বিষয়টা৷ অধরা এতদিনে তার কাছে এলো? এই পরিস্থিতিতে? তবে যাই হোক, সেটা ভাববার ইচ্ছেটা তার হচ্ছে না৷ সে চেয়ে আছে অধরার দিকে। অপলক। মেয়েটা এত সুন্দর ভঙ্গিতে বসে এক হাতে ফুলের তোড়া আর অন্য হাত মুঠো করে গালে ঠেস দিয়ে বৃষ্টি দেখছে! পেছনে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো গড়িয়ে পড়ছে কাচের দেয়াল বেয়ে। সে কোনো শিল্পী হলে এখুনি ওর একটা ছবি আঁকতে বসে যেত। এমন দৃশ্যের জন্য যেন কোনো স্বাপ্নিক শিল্পীর তুলি অপেক্ষায় বসে থাকে।
শিশিরের কল্পনার সুতো কেটে দিয়ে একজন ওয়েটার জিজ্ঞেস করল, “স্যার, কাউকে খুঁজছেন?”
ঠিক সেই সময় অধরাও ফিরে তাকাল। এদিকে তাকানোর পর শিশির এতক্ষণে খেয়াল করল অধরা সাজগোজ করেছে। ওকে এভাবে কখনো দেখেনি শিশির। কাছাকাছি গিয়ে বসতেই চোখে পড়ল অধরার হাতে শিশিরের কিনে দেয়া চুড়ি৷
অধরা যেন আজ বাকহারা হয়ে গেছে৷ চুপচাপ বসে আছে। লজ্জা লাগছে তার। কী বলবে এই শিশিরকে? কোনো মেয়ে কি কোনো ছেলেকে প্রপোজ করতে পারে?
শিশির নিজেই ফুলের তোড়াটা টেনে নিল। এসব ফুল সাধারণত দোকানে বিক্রি করা ফুলের তোড়ায় থাকে না৷ সে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, “অধরা, ফুলগুলো কি তোমার বাগানের?”
অধরা একটু কেঁপে উঠল। শিশির তাকে তুমি করে বলল এই প্রথম। কেন বলল? সে কি তাহলে বুঝে গেছে?
অধরা মাথা ওপর নিচ করল শুধু।
“ফুলগুলো আমার জন্য?”
“হুম।”
“আর সাথের এই চিঠিটাও আমার?”
“হুম।”
শিশির খুব সাবধানে চিঠিটা খুলল। একটা মাত্র লাইন লেখা। সে চোখ বুজে হেলান দিল চেয়ারে। অধরা বসে রইল জবাবের অপেক্ষায়। এখন আর লজ্জা লাগছে যে। যা ঘটার ঘটে গেছে৷ এখন শুধু ফলাফল শোনা বাকি। সে চেয়ে রইল শিশিরের দিকে।
শিশির চোখ খুলল মিনিটখানেক পর। মনের ভেতর জেগে ওঠা প্রশ্নটা করেই ফেলল সে, “এখন কেন অধরা?”
অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার এখনই উপযুক্ত সময় মনে হয়েছে তাই।”
শিশির হাসল, “তুমি বড় অদ্ভূত অধরা।”
“হয়তো।”
“হয়তো না সত্যিই। তুমি সবার মতো নও।”
“আচ্ছা!”
“কী খাবে?”
“আগে উত্তর দিন।”
“তোমার চিঠিটাই উত্তর ছিল অধরা। আমি তোমাকে আমাদের পুরানো বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে যে প্রশ্নটা করেছিলাম সেটা এখনো বহাল ছিল যে! তুমি উত্তরটা পাল্টা প্রশ্নে দিয়েছ। আমিই বা জবাব দেব কেন?”
“আমি সেদিন নেগেটিভ উত্তর দিয়েছিলাম।”
“সেটা আমি গ্রহণ করিনি। করলে তোমার সাথে এক ক্যাফেতে বসে থাকতাম না। আমি সেদিনও জানতাম কোনো না কোনোদিন তুমি জবাবে তোমার মন যা বলে তাই জানাবে।”
“সেদিন আমার মন যা বলেছিল আমি তাই জানিয়েছিলাম।”
শিশির ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল বাইরের দিকে চেয়ে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তুমুল বৃষ্টি ধুয়ে দিচ্ছে শহরের আলোয় রাঙা পথঘাট।
“আশ্চর্য তো! হাসছেন কেন?”
শিশির সোজা হয়ে বসে খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, “তুমি আমাকে পছন্দ করো অধরা। যথেষ্ট পছন্দ করো সেই শুরু থেকেই। পছন্দ না করলে আমার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্টও তুমি দেখাতে না৷ আমার ফেসবুকে ফেক আইডি দিয়ে কথা বলা তো অনেক দূরের বিষয়। কিন্তু তোমার মনে সবসময় একটা দ্বন্দ্ব ছিল। আমার যতদূর মনে হয় সেটা টাকাপয়সা, সামাজিক অবস্থানের জন্য। তোমার ভেতর থেকে একটা ইনসিকিউরড ফীল আসত যেটা তুমি স্বীকার করো না। তোমার ধারণা ছিল আমার সাথে বা আমার পরিবারের সাথে তোমাকে মানায় না। এখন আমাদের সামাজিক অবস্থান অনেকটা তোমাদের মতো হওয়ায় তুমি আবার সহজ বোধ করছ। আমাকে এড়িয়ে যেতে পারছো না, তাই নিজে থেকেই কাছে আসতে চাইছ।”
অধরা প্রতিবাদ করল, “আমি মোটেও এতকিছু ভাবিনি।”
“সচেতন মস্তিষ্কে ভাবোনি ঠিকই, কিন্তু তোমার সব কনশাস মাইন্ড কিন্তু এটাই ভেবেছে।”
“আপনি বুঝি মনোবিশারদ?”
“হুম।”
“ডিগ্রিধারী নাকি হাতুড়ে?”
“আমাকে তুমি করে বললে বলব।”
অধরা খিলখিল করে হেসে ফেলল। শিশির বোধহয় প্রথমবার তাকে এভাবে হাসতে দেখল। সে একটু আগের কথাগুলো বলার আগে কিছুটা শঙ্কিত ছিল অধরা ভালোভাবে নেবে কি না ভেবে। তবে তার মনে হয়েছিল কথাগুলো বলা দরকার। অধরার ভেতরের দ্বিধা, তার কাছে আসতে চেয়েও না আসতে পারার ব্যাপারগুলো অধরার নিজের কাছেই ধোঁয়াটে ছিল। ও বুঝতে পারছিল না এসব কেন ঘটছে৷ সম্পর্ক শুরু করার আগে কিছু বিষয়ে খোলামেলা বলে নেয়া তার কাছে ভালো মনে হয়৷
অধরা কফির অর্ডার দিয়ে বলল, “আজকের কফি আমার পক্ষ থেকে।”
“ওকে!”
“এই অসময়ের বৃষ্টি কেমন লাগছে?”
“আজকের দৃশ্যে বৃষ্টি প্রয়োজন ছিল।”
“বাড়িতে চিন্তা করবে না তো?”
“বলে দেব দেরি হবে। আচ্ছা, তুমি কি ‘তুমি’ বলার ভয়ে ভাববাচ্যে কাজ চালাতে চাইছো?”
অধরা অবাক হবার ভান করে বলল, “না তো!”
শিশির কয়েক পলক ওর দিকে চেয়ে থকে গভীর স্বরে বলল, “তোমাকে সুন্দর লাগছে অধরা।”
অধরা লজ্জা পেয়ে গেল। অন্যদিকে চোখ সরিয়ে খানিক পর হেসে ফেলল।
কফি চলে এসেছে।
শিশির জিজ্ঞেস করল, “তোমার প্রিয় গান কোনটা অধরা?”
“উমম… অনেক গানই তো আছে।”
“আজকে যদি শোনার হয় তবে কোনটা শুনবে?”
“বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি নিয়ে কোনো গান?”
শিশির হুট করে এগিয়ে এসে অধরার নাক টেনে দিয়ে বলল, “তুমি বড্ড বোরিং! স্পেসিফিক গানও বলতে পারো না।”
বলেই উঠে চলে গেল। সে ফিরতে ফিরতে গান বদলে গেল, এখন বাজছে, “আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ.. বৃষ্টি, তোমাকে দিলাম…”
শিশির ফিরে এসে বসলে অধরা আর ওর দিকে চাইল না। বাইরে ফিরে বসে রইল। শিশির জিজ্ঞেস করল, “হলোটা কী? কথা বলো না কেন?”
“আমি তো বোরিং। আমার সাথে কথা বলে কী লাভ?”
শিশির যেন খুব মজা পেয়ে প্রাণ খুলে হাসল। অধরা আঁড়চোখে ওর হাসি দেখল। এত সুন্দর লাগছে কেন?
শিশির বলল, “আমার বোরিং মেয়েই পছন্দ অধরা।”
“তবুও বলবেন না আমি বোরিং নই!”
“বলব। আগে আমাকে তুমি করে ডাকো, তারপর।”
অধরা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ডাকব না।”
ওরা বের হলো বৃষ্টি থামার পর। শিশির অধরার হাত ধরে গাড়িতে তুলে দিল। বিদায়ের সময়ে শিশির মৃদু স্বরে বলল, “তুমি তো জানোই বাড়ির পরিস্থিতি। এখন বিয়ের কথাটা তোলা একটু কঠিন। তবে আমি সুযোগ পেলেই বলব।”
অধরা শিশিরের হাতটা চেপে ধরে বলল, “আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য।”
গাড়িটা চলে গেল। শিশির স্বপ্নালু চোখে চেয়ে রইল সেদিকে। মনে হচ্ছে এক পৃথিবী আঁধারের মাঝে কেউ যেন আলোকবর্তিকা হাতে এসে দাঁড়িয়েছে তার দুয়ারে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু